উলামা এবং পোপতন্ত্র

তাকি উসমানি
কাজী একরাম অনূদিত

কুরআন-সুন্নাহর তাফসীর ও ব্যাখ্যা এবং প্রতিনিয়ত উদ্ভূত নতুন সমস্যায় সেগুলো থেকে বিধান আহরণ কার কাজ? আর এ কাজের জন্য কী কী শর্ত ও গুণাবলী (qualifications) আবশ্যক? এ প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যায় হযরত আলি রা.-এর একটি বিশুদ্ধ রেওয়ায়েতে। সেখানে তিনি বলেছেন—

قلت يا رسول الله إن نزل بنا امر ليس فيه بيان امر ولا نهى فما تأمرنى؟ قال تشاوروا الفقهاء والعابدين ولا تمضوا فيه رأي خاصة. رواه الطبراني في الأوسط و رجاله موثقون من أهل الصحيح (مجمع الزوائد ص ۷۱ ج ۱، المطبع الانصاری دهلی ۰۱۳۰)

‘আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! আমাদের মধ্যে যদি এমন কোনো সমস্যা দেখা দেয় যার কোনো বয়ান (কুরআন ও সুন্নাহে) নেই, কোনো আদেশ নেই বা কোনো নিষেধ নেই, তাহলে সেক্ষেত্রে আমার জন্য আপনার আদেশ কী? তিনি বললেন, ফকীহ ও আবেদগণের সাথে পরামর্শ করো এবং এ ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত মতামত প্রকাশ-প্রচার করো না।’

এ হাদিসে রাসূল সা. অত্যন্ত স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন, কুরআন এবং সুন্নাহ থেকে বিধান আহরণের জন্য একজন ব্যক্তির মধ্যে দুটি শর্ত থাকা আবশ্যক। একটি হলো ‘ফকিহ’ হওয়া এবং অপরটি হলো ‘আবিদ’ হওয়া। প্রথম শর্তের গুরুত্ব সুস্পষ্ট। কারণ, কুরআন-সুন্নাহর অর্থ সেই ব্যক্তিই বুঝতে পারে, যার কুরআন-সুন্নাহ সম্পর্কে ব্যাপক ও গভীর জ্ঞান রয়েছে, যিনি উভয়ের মধ্যে বর্ণিত বিধানের মূলনীতি সম্পর্কে সম্পূর্ণ অবগত আছেন এবং যিনি এই কাজে নিজের জীবন ব্যয় করে দ্বীন-শরীয়ার মেজাজ বোঝার যথাসাধ্য চেষ্টা করেছেন। এভাবে তাঁর ‘আবিদ’ হওয়া অর্থাৎ ইসলামের বিধি-বিধানের অনুসারী হওয়াও রাসূল সা. আবশ্যক বলে ঘোষণা করেছেন। কারণ, যে ব্যক্তি তার ব্যবহারিক জীবনে হালাল-হারাম এবং জায়েজ-নাজায়েজের মধ্যে পার্থক্য করে না এবং যার দিন-রাত্রি ইসলামের বিধি-বিধানের পরিপন্থী, সে কখনোই দ্বীনের মেজাজ গ্রহণ করতে পারে না। আহকাম আহরণের কাজ প্রকৃতপক্ষে হকের সন্ধান করার অন্য নাম। এবং কুরআনের ব্যাখ্যা অনুসারে, যে ব্যক্তি তার জীবনে বাস্তবিকভাবে সত্যকে সম্মান করে, আল্লাহ তাকেই সত্যের পরিচয়ের বৈশিষ্ট্য দান করেন—

إن تتقوا الله يجعل لكم فرقانا.
‘যদি আপনি তাকওয়া অবলম্বন করেন, তবে তিনি আপনাকে (সত্য ও মিথ্যার) পার্থক্যজ্ঞান দান করবেন।’ (আনফাল : ২৯)

এই আয়াত স্পষ্টভাবে বলেছে, ‘সত্য ও মিথ্যার মধ্যে পার্থক্য করার জন্য তাকওয়া’ একটি প্রয়োজনীয় শর্ত এবং তা ছাড়া এই মহামূল্যবান সামর্থ্য লাভ করা যাবে না। তাই পবিত্র কুরআনের এ আয়াত এবং রাসূল সা.-এর উপরোক্ত বাণী এটা অত্যন্ত স্পষ্ট করে দিয়েছে যে, ইসলামি সমাজে যেসব নতুন নতুন সমস্যা দেখা দিতে পারে, সেগুলোর ধর্মীয় ও আইনশাস্ত্রীয় (ফিকহি) সমাধান খুঁজে বের করার কাজ সেই ব্যক্তি আঞ্জাম দিতে পারেন, যিনি একদিকে ‘ফকিহ’, আর অন্যদিকে ‘আবিদ’ বা ‘মুত্তাকী’।

এই কথাটিকে মুফতি মুহাম্মদ শফি রহ. সংক্ষিপ্ত ভাষায় এভাবে ব্যক্ত করেছেন, ‘যেসব সমস্যা কিতাব ও সুন্নাহতে সুস্পষ্টভাবে নির্দেশিত নয়, সেগুলির সমাধানের উপায় হলো আহলে ফাতওয়া এবং আহলে তাকওয়া আলেমদের পারস্পরিক পরামর্শ। ব্যক্তিগত এবং একক মতামত মুসলমানদের উপর চাপিয়ে দেওয়া অপরাধ।’

কিন্তু কেন জানি এই বিষয়টি আমাদের আধুনিকতাবাদী শ্রেণীর কাছে অনেক ভারী মনে হয়। এই ভদ্রলোকেরা কুরআন-সুন্নাহর ব্যাখ্যা ও বয়ান এবং তা থেকে বিধান আহরণ করার জন্য ‘আলেম’, ‘ফকীহ’ হওয়াকে প্রয়োজন মনে করেন না, প্রয়োজন মনে করেন না ‘আবিদ’ বা ‘আহলে তাকওয়া’ হওয়াকে। তাদের দিক থেকে বরাবরই এই আওয়াজের পুনরাবৃত্তি হয়ে আসছে যে, ‘কুরআন ও সুন্নাহর ব্যাখ্যায় আলেমদের একচেটিয়া অধিকার না হওয়া উচিৎ। ইসলামে কোনো পোপতন্ত্র নেই, তাই কোনো বিশেষ গোষ্ঠীকে আইন প্রণয়নের অধিকার দেওয়া যেতে পারে না। সকল মুসলমানের কুরআন ও সুন্নাহ ব্যাখ্যা করার অধিকার আছে, শুধু আলেমদের নয়। আলেমদের ইসলামের ব্যাপারে ভেটো দেয়ার অধিকার দেওয়া যেতে পারে না, ইত্যাদি।’

বস্তুত, এসব হলো সেই পুরানো স্লোগান, যা থেকে আধুনিকতাবাদী শ্রেণীর কোনও লেখা কমই মুক্ত পাওয়া যাবে। এই বিষয়ে কুরআন ও সুন্নাহর নির্দেশনার সম্পর্ক যতদূর, আমরা তা উপরে দেখিয়েছি যে, দ্বীনের ব্যাখ্যার জন্য ‘ইলম’ এবং ‘তাকওয়া’র শর্তের ওপর কতটা জোর দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এসব শ্লোগানের মধ্যে লুকিয়ে থাকা বিভ্রান্তির বাস্তবতা ব্যাখ্যা করাও প্রয়োজন, সকাল-সন্ধ্যায় যেগুলির গীত গেয়ে চলেন আমাদের আধুনিকতাবাদীরা।

তাদের প্রথম শ্লোগান হলো—‘ইসলামে কোনো ভ্রাহ্মণ্যতন্ত্র বা পোপতন্ত্র নেই। তাই আলেমদের বিশেষ গোষ্ঠীকে আইন প্রণয়নের অধিকার দেওয়া যায় না।’ দেখা যাচ্ছে, এই কথা যারা বলেন তারা হয় পোপতন্ত্র এবং থিয়োক্রেসির অর্থ এবং এর আসল কুফল সম্পর্কে অজ্ঞ, অথবা ইচ্ছাকৃতভাবে সাধারণ মানুষকে ধোঁকা দিতে চান। যে ব্যক্তির অন্তরে ইনসাফ এবং বাস্তবতাবাদের যৎকিঞ্চিত অস্তিত্ব রয়েছে, তিনি এটা উপলব্ধি করতে পারেন যে, ইলম এবং ফিকহ বা তাকওয়া কোনো বর্ণ, গোত্র বা জাত-পাতের নাম নয়, যাকে একজন ব্যক্তি চাইলেও অর্জন করতে পারে না। এটি একটি নির্দিষ্ট কাজের যোগ্যতার বৈশিষ্ট্যের (eligibility qualificators) নাম যা প্রতিটি ব্যক্তি সর্বদা হাসিল করতে পারে। যদি আপনার কাছে একটি নির্দিষ্ট কাজের জন্য নির্দিষ্ট যোগ্যতার কিছু বৈশিষ্ট্য নির্ধারণ করা ‘পোপতন্ত্র’ বলে মনে হয়, তবে বলুন জীবনের কোন্ ক্ষেত্রটি এই পোপতন্ত্র থেকে মুক্ত। দেশের রাষ্ট্রপতি ও মন্ত্রিত্বের জন্য যে শিক্ষাগত যোগ্যতা এবং যে নৈতিক চরিত্র প্রয়োজনীয় বলে ঘোষণা করা হয়, তাহলে সেটিও আপনার মতে পোপতন্ত্র হবে। একজন জজের জন্য আইনের জ্ঞানের যে দক্ষতাকে শর্ত হিসেবে ঘোষণা করা হয়, তাকেও তবে ‘পোপতন্ত্র’ বলতে হবে। ওকালতের যোগ্য হওয়ার জন্য ন্যূনতম এলএলবি-কে প্রয়োজনীয় বলে বিবেচনা করা হয়, তাহলে বলে দিন যে এটিও পোপতন্ত্র, একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠদানের জন্য যে ডিগ্রিসমূহ বাধ্যতামূলক ঘোষণা করা হয়, সে সম্পর্কেও এই ফতোয়া জারি করে দিন যে ‘এতে পোপতন্ত্রের চেতনা ক্রিয়াশীল’, এবং একটি নির্বাচনে প্রার্থীতার জন্য বয়স, বুদ্ধি এবং নৈতিক চরিত্র সংক্রান্ত যেসব শর্ত নির্ধারণ করা হয়, তা নিয়েও এই আপত্তি উত্থাপন করুন যে, এর উপর পোপতন্ত্রের আছর পড়েছে!

এই সমস্ত কাজের জন্য যোগ্যতার কিছু শর্ত আরোপ করা যদি ‘পোপতন্ত্র’ না হয়, তবে ‘কিতাব ও সুন্নাহর ব্যাখ্যা’ করার জন্য ইলম এবং তাকওয়া’ এর শর্তারোপ কোন্ যুক্তিতে ‘পোপতন্ত্রে’ প্রবেশ করে? যে ব্যক্তি পোপতন্ত্র এবং ব্রাহ্মণ্যবাদের ব্যবস্থা সম্পর্কে সাধারণ অধ্যয়নও করেছেন, তিনি ইসলামের উলামা এবং পোপ ও ব্রাহ্মণদের মধ্যে নিম্নলিখিত স্থুল এই পার্থক্যগুলি লক্ষ্য না করে থাকতে পারবেন না।

(১) ‘ব্রাহ্মণ’ এবং ‘পোপ’ একটি নির্দিষ্ট শ্রেণীর বর্ণ ও জাত-পাতের নাম। সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা এবং সর্বোচ্চ প্রতিভা থাকা সত্ত্বেও বহিরাগত কেউ এতে যোগ দিতে পারে না, এই কারণেই পোপদের ইতিহাসে এমন উদাহরণ রয়েছে যেখানে ডাকাত এবং জলদস্যুদের ‘পোপ’ বানিয়ে দেওয়া হয়েছে। অন্যদিকে, আলিম হলো এমন বৈশিষ্ট্য; যার অর্জনে জাতি ও বর্ণের কোনো বাধ্যবাধকতা নেই, যা জাতপাত দ্বারা সীমাবদ্ধ নয়। ইসলামের চৌদ্দশত বছরের ইতিহাসে প্রতিটি বর্ণে ও প্রতিটি বংশের মধ্যে ‘উলামা’ রয়েছেন, এমনকি দাসদের মধ্যেও বড় বড় আলেমের জন্ম হয়েছে। তারা দেশ ও জাতির নেতা হিসেবে বিবেচিত হয়েছেন। তাদের শ্রেষ্ঠত্বের কারণ সর্বদাই ছিল তাদের ইলম ও তাকওয়া, কোনো বিশেষ খান্দান নয়।

(২) পোপ যে ধর্মের ব্যাখ্যা করার দাবি করেন, তার শিক্ষা জীবনের অধিকাংশ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে নীরব। তাই পোপের মর্জি ঈশ্বরের মর্জিতে পরিণত হয়েছে, যার ওপর আর কেউ আপত্তির আঙুল তুলতে পারবে না। এই কারণেই তারা আইনের ব্যাখ্যাকারী নয়, বরং একটি স্বাধীন ও মুক্ত আইনের প্রবর্তনকারী হয়। এর বিপরীতে, কিতাব ও সুন্নাহর বিধি-বিধান সর্বব্যাপ্ত, সর্বজনীন এবং এর উসূল সম্পূর্ণ সুরক্ষিত। কোনো আলেম যদি এসব নিয়ম-কানুন বিরোধী কিছু বলেন, অন্য আলেমগণ সর্বদা তার স্খলন ও বিচ্যুতির উপর পাকড়াও করতে সর্বদা বর্তমান থেকেছেন এবং আছেন।

(৩) পোপতন্ত্রে, ধর্মের আইন প্রণয়ন এবং ব্যাখ্যা করার কর্তৃত্ব শেষ পর্যন্ত একক ব্যক্তির উপর গিয়ে শেষ হয়। এই একক ব্যক্তিকে “খ্রিস্টের ভেড়ার মেষপালক” এবং গির্জার প্রতিষ্ঠাতার ডেপুটি হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে, যেখানে “উলামা” একক ব্যক্তির নাম নয় যিনি একটি গৎবাঁধা ধর্মীয় সংগঠনের প্রধান। বরং সঠিক নীতির ভিত্তিতে দ্বীনি জ্ঞান অর্জনকারী প্রত্যেক ব্যক্তিই আলেম এবং পয়গম্বরের উত্তরাধিকারী। তাই সমগ্র উম্মাহর উপর নিজের মর্জিকে চাপিয়ে দেয়ার এক্তিয়ার একক একজন আলেমের নেই। পোপদের আইন প্রণয়ন এবং আলেমদের কিতাব ও সুন্নাহর ব্যাখ্যার মধ্যে এত বড় পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও, কেউ যদি ইসলামের আলেমদের উপর পোপতন্ত্র পদের ব্যবহার করে, তাহলে যুক্তি ও বুদ্ধিমত্তা, সত্য ও সততা এবং আমানত ও দীয়ানতের জানাযা উঠে যায় বৈকি।

এই পোপতন্ত্রের বিষয়টি আধুনিকতাবাদীদের তরফ থেকে আরেকটি শৈলীতে ব্যক্ত করা হয়ে থাকে এভাবে—‘কিতাব ও সুন্নাহর উপর কারো একচেটিয়া আধিপত্য নেই। তাই এর ব্যাখ্যা ও বয়ানের অধিকার আলেমদের জন্য সংরক্ষিত থাকতে পারে না।’ প্রোপাগাণ্ডাপ্রিয় লোকেরা এই শ্লোগানকে নিরলসভাবে পুনরাবৃত্তি করে চলে। কিন্তু কোনো বান্দা এটা ভাবতে পারছেন না যে, এই আপত্তির উদাহরণ হুবহু এমন একজন ব্যক্তির মতো, যে কখনো মেডিকেল কলেজের চেহারাও দেখেনি, কিন্তু সে আপত্তি জানাতে থাকল যে, দেশে চিকিৎসার ওপর সনদপ্রাপ্ত চিকিৎসকদের একচেটিয়া আধিপত্য কেন কায়েম করা হয়েছে? একজন মানুষ হিসেবে আমারও এই অধিকার পাওয়া উচিত। কিংবা যুক্তিতে অন্ধ একজন ব্যক্তি বলতে শুরু করল যে, দেশের নদ-নদী, খাল-বিল, বাঁধ নির্মাণের ঠিকাদারি কেন শুধু বিশেষজ্ঞ ইঞ্জিনিয়ারদেরই দেওয়া হয়? আমিও তো একজন নাগরিক হিসেবে এই সেবা আঞ্জাম দেওয়ার হকদার! অথবা কোনো বুদ্ধি-প্রতিবন্ধী ব্যক্তি আপত্তি তুলতে শুরু করল যে, কেন দেশের আইনের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণে আইন বিশেষজ্ঞদের একচেটিয়া আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, একজন আকেল-বালেগ মানুষ হিসেবে এই কাজ আমিও করতে পারি!

আমরা আশা করি না যে, কোনো সুস্থ বিবেকের অধিকারী ব্যক্তি এই ধরনের কথাবার্তা বলতে পারেন। যদি কেউ সত্যিই সংবেদনশীলভাবে তার মনে এই খটকা বহন করে, তবে কি তাকে বলা হবে না যে, একজন নাগরিক হিসেবে আপনার এই সমস্ত কাজ করার অধিকার অবশ্যই আছে, কিন্তু এই কাজগুলি করার ক্ষমতা বিকাশ করার জন্য বছরের পর বছর সময় ব্যয় করতে হবে, বিশেষজ্ঞ শিক্ষকদের কাছ থেকে সংশ্লিষ্ট উলূম ও ফুনুন শিখতে হবে। এর জন্য বিভিন্ন ডিগ্রী নিতে হবে, আগে তো এসব কসরৎ করে নিন, এরপর অবশ্যই আপনিও এই সেবাগুলো আঞ্জাম দিতে পারবেন।

প্রশ্ন হলো এই একই কথা কেউ যদি কুরআন-সুন্নাহর ব্যাখ্যার মতো সূক্ষ্মতর ও স্পর্শকাতর কাজের জন্য বলা হয়, তাহলে তা কীভাবে ‘একচেটিয়া’ হয়ে যায়? কুরআন ও সুন্নাহর তাফসীর ও ব্যাখ্যার জন্য কি কোনো যোগ্যতা ও কোনো সক্ষমতার প্রয়োজন নেই? তার জন্য কি কোনো বিদ্যালয়ে পড়া এবং কোনো শিক্ষকের কাছ থেকে ইলম অর্জন করার কোনো আবশ্যকতা নেই? সারা পৃথিবীতে কি শুধু কুরআন-সুন্নাহর ইলমই এমন বেওয়ারিশ হয়ে গেল যে, এর ব্যাপারে প্রত্যেকের নিজস্বমতে ‘ব্যাখ্যা’ করবার অধিকার অর্জিত আছে? যদিও সে কুরআন ও সুন্নাহর জ্ঞান অর্জন করতে কয়েক মাসও ব্যয় করেননি।

আমাদের আধুনিকতাবাদী ভদ্রলোকেরা আলেমদের বিরুদ্ধে এই রাগ-ক্ষোভ সকাল-সন্ধ্যায় ঝাড়তে থাকেন যে, তারা কেন কুরআন ও সুন্নাহর ‘আহল’ বনে বসে আছেন? কিন্তু তারা কখনো এই চিন্তা করার কষ্ট করতে রাজি নন যে, আলেমগণ এই যোগ্যতাকে অর্জন করতে কত পথ মাড়িয়েছেন? দুই শতাব্দীর ব্রিটিশ শাসনামলে কীভাবে তারা নিপীড়নের লক্ষ্যবস্তু হয়েছেন। যেহেতু ব্রিটিশ কতৃক তাদের জীবিকার সব দরজা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল, ফলে তারা ধন-সম্পদের চাকচিক্য থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে, শুকনো রুটি খেয়ে, অনাহারে-অর্ধাহারে, পরে না-পরে এবং এতদসত্ত্বেও আপনাদের মতো ভদ্রলোকদের ঠাট্টা-বিদ্রুপ শুনে এই জ্ঞান অর্জন করেছেন? বছরের পর বছর চেরাগ-বাতির সামনে চোখ ঝলসিয়েছেন! জীবন, সম্পদ ও আবেগ-আকাঙ্খার কত কত ত্যাগ-তিতিক্ষা দিয়ে দ্বীনি উলূমকে বাঁচিয়ে রেখেছেন! নিজের জীবনকে দ্বীনের ছাঁচে ঢালাই করার চেষ্টা করেছেন!… এত কিছুর পর যদি হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদেরকে কিতাব ও সুন্নাহর ব্যাখ্যা করার অধিকার দান করেন, আর গোটা ইসলামি উম্মাহ তাদের এই অধিকারে আস্থা রাখে, তাহলে এ নিয়ে আপনার অভিযোগ কেন?

কিতাব ও সুন্নাহর ব্যাখ্যার জন্য আপনার অনুরাগ নিঃসন্দেহে প্রশংসা-যোগ্য, তবে এর জন্য যে অধ্যবসায়ের প্রয়োজন, আসুন আগে এর কিছু স্বাদ আস্বাদন করে নিন, জীবনের কিছু অংশ কিতাব ও সুন্নাহর উলূমের পথে ব্যয় করুন, এই পথের আদব-কায়দা শিখুন, এর পর যদি কেউ আপনার জন্য কিতাব ও সুন্নাহ ব্যাখ্যা করার অধিকারে বিশ্বাসী না হয়, তাহলে নিঃসন্দেহে আপনার অভিযোগ জায়েজ ও ন্যায়সঙ্গত হবে।

থেকে গেল আরেকটি কথা যা ডক্টর ফজলুর রহমান মাসিক ম্যাগাজিন ‘ফিকর ওয়া নজরে’ এভাবে প্রকাশ করেছেন—‘ইসলামে, উম্মাহ সমষ্টিগতভাবে(?) আইন প্রণয়ন করে আসছে। এবং এখনও তার এই অধিকার থাকা উচিত৷’

আমি আশা করছিলাম, তিনি যদি এটাও ব্যাখ্যা করতেন যে, উম্মতের সম্মিলিতভাবে আইনপ্রণয়ন করার অর্থ কি এই যে, উম্মতের কোটি কোটি মানুষের মধ্যে প্রত্যেকেই আইন প্রণয়ন করবে এবং প্রতিটি অশিক্ষিত দেহাতি লোকও এই কাজে অংশ নেবে? কিংবা উম্মতের এই অধিকার হাসিল হওয়ার অর্থ হলো যে, এর কিছু মেধাবী ও বিশ্বস্ত প্রতিনিধি নির্বাচন করার এক্তিয়ার রয়েছে, যারা কুরআন-সুন্নাহর ব্যাখ্যা ও বয়ানের সম্পূর্ণ যোগ্য, কিন্তু অবশেষে তাকে এই নির্বাচিত ব্যক্তিদের কাজের উপর নির্ভর করতে হবে। স্পষ্টতই গণতন্ত্রের কট্টর সমর্থকরাও জনগণের অধিকারের এই আহাম্মকি মর্ম বোঝেন না যে, জনগণের প্রতিটি সদস্য রাষ্ট্রের প্রতিটি বিষয়ে হস্তক্ষেপ করতে পারে। বরং তাদের মতেও, প্রতিটি শিল্পকে তার নির্বাচিত বিশেষজ্ঞদের হাতে ন্যস্ত করা হবে, এরপর যাদের এই শিল্প সম্পর্কে অবগতি নেই তারা সেসব বিশেষজ্ঞদের উপর আস্থা রাখে এবং তাকে কেউ এটা বলে না যে, জনগণের কাছ থেকে তাদের অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়েছে।

জনগণের অধিকারের এই বিশ্লেষণের পর আপনি নিজেই সিদ্ধান্ত নিন যে, এদেশের কোটি কোটি মুসলমান কুরআন ও সুন্নাহর ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে কাদের উপর আস্থা রয়েছে। যখন তাদের কুরআন ও সুন্নাহর কোনো নির্দেশনা জিজ্ঞাসা করা ও বোঝার প্রয়োজন হয়, তখন তারা ইদারায়ে তাহকীকাতে ইসলামী (ইসলামিক রিসার্চ ইনস্টিটিউট) বা অন্য কোনো আধুনিকতাবাদী প্রতিষ্ঠানের কাছে যায় নাকি এসব ‘প্রতিক্রিয়াশীল’ উলামার কাছে যায়, যারা আপনার মতে, জনগণের অধিকার কেড়ে নিয়েছে? মুসলিম জনসাধারণ যদি কিতাব ও সুন্নাহর ব্যাপারে কোনোপ্রকার জবরদস্তি বা আইনি বাধা ছাড়াই, এই চাটাইয়ে বসে থাকা আলেমদের কাছে যায়, তাদের ওপর আস্থা রাখে এবং তাদের বিবেক তাঁদের কথায় সন্তুষ্ট থাকে, আর কেই বা এই বাস্তবতা অস্বীকার করতে পারে– তবে আপনি নিজেই বিবেচনা করুন যে কোন্ সুরতে জনগণের অধিকার লঙ্ঘিত হয়? এই আলেমদেরকে কিতাব-সুন্নাহ ব্যাখ্যা করার অধিকার দিয়ে? নাকি এই আধুনিকতাবাদী ভদ্রলোকদেরকে কুরআন-সুন্নাহর উপর ‘উৎপীড়ন’ করার অবাধ ছাড়পত্র দিয়ে? যাদের বিকৃতির বর্শাঘাত জনসাধারণের হৃদয়কে ক্ষতবিক্ষত করেছে!

এই ভদ্রলোকদের সবচেয়ে বড় আপত্তি হলো ‘তাকওয়া’ শর্তটির উপর। তাদের মতে, কিতাব ও সুন্নাহর ব্যাখ্যার জন্য ‘ইলমের’ ন্যায় ‘তাকওয়ার’ও আবশ্যকতা না হওয়া উচিত এবং এ ব্যাপারে জানি না কোন্ ‘আশঙ্কা’ বিবেচনায় তাদের নিকট সবচেয়ে বড় জটিলতা এই যে, ‘আহলে তাকওয়া’র শর্তটি এমন একটি শর্ত যে, প্রত্যেক আলেম সহজেই তার ফতোয়ার বিরুদ্ধে অন্যের মতামতকে প্রত্যাখ্যান করতে পারেন। কারণ তাকওয়া মূল্যায়নের মাপকাঠি হয় প্রত্যেকের নিজস্ব।’ (ফিকির ওয়া নজর, নভেম্বর ২৭, পৃ. ৩২৬)

এই বিষয়ে আমরা আর কি বলবো যে, আপনি যদি কিছুক্ষণের জন্য ‘ব্যক্তিগত আশঙ্কার’ ঊর্ধ্বে উঠে চিন্তা করেন, তাহলে এই ব্যাপারেও কোনো জটিলতা অবশিষ্ট থাকবে না। সেই একই জনসাধারণ যাকে আপনি আইন প্রণয়নের অধিকার দিতে চান, একজন ব্যক্তির মধ্যে ‘তাকওয়ার’ এই শর্তটি পাওয়া যায় তা সিদ্ধান্ত নেওয়ারও ক্ষমতা তার রয়েছে। মুসলমানদের সম্মিলিত বিবেক ভুল হয় না। যার ‘তাকওয়া’র উপর জনগণ আস্থা রাখে, তাকে কিতাব ও সুন্নাহর ব্যাখ্যার দায়িত্ব অর্পণ করায় কোন্ অসুবিধাটি রয়েছে?

ভালো করে বুঝুন, তাকওয়া এমন কোনো অস্পষ্ট এবং অনির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্য নয়, যা প্রত্যেকে তাদের মেজাজ এবং রুচি অনুযায়ী সংজ্ঞায়িত করতে পারে। তাকওয়া হলো ইসলামে এটি আইনী পরিভাষা, যার উপর অসংখ্য শরয়ী আহকাম নির্ভরশীল। যখনই এটি আইনি অর্থে ব্যবহার করা হয়, তখন এটি আদিষ্ট কর্তব্য সম্পাদন, কবীরা গুনাহ থেকে বেঁচে থাকা এবং সগীরা গুনাহের প্রতি অভ্যস্ততা পরিহার করাকে বোঝায়, যা কুরআনের পরিভাষা অনুসারে “ফুজূর” এর বিপরীত : فالهمها فجورها وتقواها অতএব, একজন ব্যক্তি যে ফুজূর অর্থাৎ ‘বাহ্যিক গুনাহ’ থেকে বিরত থাকে সে এই আইনি পরিভাষা অনুসারে একজন “মুত্তাকী” ব্যক্তি। এই কারণেই কারোর “তাকওয়া” বিচারে জনসাধারণের মধ্যে কোনো উল্লেখযোগ্য জটিলতা দেখা যায় না। এই আলাপগুলি মাথায় রেখে বলুন, কিতাব ও সুন্নাহর ব্যাখ্যার জন্য ‘ইলম’ ও ‘তাকওয়া’-এর শর্ত স্থাপনের ক্ষেত্রে কী বিভ্রান্তি ও জটিলতা রয়েছে?

পরিশেষে, আমরা আবারো ‘আধুনিকতাবাদী’ ভদ্রলোকদের প্রতি বিনীত অনুরোধ করবো যে, ইলমি ও ফিকরি মাবাহিস তথা একাডেমিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক বিষয়াদির চর্চায় প্রচলিত স্লোগান হাঁকিয়ে এবং বিশুদ্ধ প্রপাগাণ্ডার অস্ত্র ব্যবহার করে, না দেশ ও জাতির কোনো কল্যাণ করা যাবে, না এতে করে সমস্যার সমাধান হবে, আর না এই আদত ও কর্মপন্থা কোনো সংবেদনশীল মনের উপর একটি ভালো প্রভাব ফেলবে। এই শ্লোগানের ডাক-ডংকায় অল্প সময়ের জন্য আপনি সত্যের কণ্ঠস্বরকে নিচু করতে পারেন, তবে এটি কেবল কানকে প্রভাবিত করে, হৃদয়কে নয়, এবং একটি পর্যায় আসে, যখন শ্লোগানবাজদের কণ্ঠ স্তব্ধ হয়ে যায়, তাদের গলা শুষ্ক হয়ে যায়। তখন হকের মর্যাদাপূর্ণ কণ্ঠ পূর্ণ শক্তিতে উচ্চকিত হয়, সরাসরি হৃদয়কে প্রভাবিত করে এবং চিরতরের জন্য তার মধ্যে গ্রথিত হয়ে যায়।

আগের সংবাদইসরাইলের বিচার দাবিতে আইসিসিতে আল-জাজিরা
পরবর্তি সংবাদঢাকায় নিজ নাগরিকদের সতর্ক করল মার্কিন দূতাবাস