একজন মাতালের গল্প

 মূল: মুস্তফা লুতফী আল মানফালুতী

অনুবাদ:  ইবরাহীম জামিল:

জীবনের মুহূর্তগুলো কত দীর্ঘ অথচ জীবন কত ক্ষুদ্র!

কতটা বছর পিছনে ফেলে এলাম! কিন্তু অতীতের দিকে তাকালে মনে হয়- একটি বছর মাত্র জীবন পেয়েছি। যুগ-নক্ষত্রের মত। যা রাতের আঁধারে শুধু একবার চমকে উঠে চিরদিনের জন্য হারিয়ে যায়। জীবনের শুরুর ভাগ কেটেছে একজন সতীর্থ খুঁজে খুঁজে, যে বন্ধুর পানে পণ্যের দিকে তাকানো বণিকের মতো অথবা হালের বলদের দিকে তাকানো কৃষকের মতো লোভ-চকচকে দৃষ্টিতে তাকাবে না। এমন বন্ধু খুঁজে পেতে জীবনের আঠারোটি বসন্ত পার হয়ে গেছে। তারপর যাকে পেয়েছি তার মতো চমৎকার বন্ধু আরেকটি হতে পারে না। একজন মানুষের মধ্যে যতটুকু বিশ্বস্ততা  থাকতে পারে তা তার মধ্যে আছে। একজন মানুষের মুখে মানবীয় পূর্ণতা যতটুকু দ্যুতি ছড়াতে পারে তার সবটুকু তার চেহারায় ঝলমল করে। আমি তাকে লুফে নিয়ে হৃদয়ের এমন জায়গায় বসিয়েছি, যেখানে আর কেউ কখনো প্রবেশ করেনি। আমার আর তার বন্ধুত্বের মাঝে কোনো পঙ্কিলতার স্পর্শ ছিল না। কিন্তু জীবনের প্রয়োজন মানুষকে স্থির দাঁড়িয়ে থাকতে দেয় না। কায়রো থেকে আমাকে মাসকটে পাড়ি জমাতে হল। কায়রোর কোনো কিছু ছেড়ে আসতে আমার দুঃখবোধ হয়নি, শুধু প্রিয় বন্ধুটিকে ছেড়ে আসতে আমার ভিতরটা হুঁ হুঁ করে কেঁদেছে।

দীর্ঘদিন পর্যন্ত তার সাথে আমার পত্র আদানপ্রদান চলেছে। এক সময় সচকিত হয়ে দেখি,  সে অনেক দিন পর্যন্ত আমার পত্রের জবাব দেয় না। তারপর লক্ষ্য করি, সে আমার আর কোনো পত্রের জবাব দেয় না। কোনো পত্রও পাঠায় না। আমি ভীষণ দুঃখ পেলাম। মনে মনে ভাবলাম, তার বিশ্বস্ততার মধ্যে হয়তো খাঁদ ছিলো। মাঝে মাঝে মনে হতো, কায়রো গিয়ে দেখে আসি সে কেমন আছে। কিন্তু যাই যাই করেও যাওয়া হয়নি।

অনেক বছর পর আমি কায়রোতে ফিরে  গিয়েছিলাম। কায়রোর মাটিতে পা রেখেই মনে হল, বন্ধুকে দেখতে যেতে হবে।  সেদিন সন্ধ্যার পর আমি তার বাড়িতে গেলাম কিন্তু  সেখানে যা দেখতে পেলাম তার জন্য ক্ষমাহীন অনুতাপ আজো আমার বুকের সাথে লেপ্টে আছে।

এ বাড়িতো ছিল এক টুকরো ফেরদাউস জান্নাত। যেখানে রংবেরঙের সুখেদের উড়াউড়ি ছিল। এ বাড়ির বাসিন্দাদের চেহারায় সুখ আর সৌন্দর্য্য ঝিলমিল করতো। আজ যখন এখানে পা রেখেছি, মনে হচ্ছে আমি যেন কোন অচেনা গোরস্থানের সামনে এসে দাঁড়িয়েছি। কারো কথা বলার শব্দ নেই। বাড়ির পাশে জনমানুষের চিহ্ন নেই। আঙিনায় আলো জ্বালানোর ব্যবস্থা নেই। মনে হল, পথ হারিয়ে কোনো পরিত্যক্ত বাড়ির সামনে এসে দাঁড়িয়েছি বোধহয়। ফিরে আসার কথা ভাবছিলাম, হঠাৎ একটি শিশুর কান্নার আওয়াজ পেয়ে ঘুরে দাঁড়ালাম। জানালার ওপাশে টিমটিমে একটুখানি আলো জ্বলছে । বোধহয় বাড়িতে কেউ আছে। আমি এগিয়ে গিয়ে দরজায় করাঘাত করলাম। ভিতর থেকে সাড়া এলো না। আবার করাঘাত করলাম। এবার দেখতে পেলাম কুপি হাতে একটি ছায়ামূর্তি এগিয়ে আসছে। একটু পরেই ধুলোমলিন পোশাক আচ্ছাদিত একটি শিশুর অবয়ব  ভেসে উঠল। কুপির আলোয় আমি তার চেহারা পাঠ করলাম।  চেহারায় বাবার টান দেখতে পেয়ে বুঝতে পারলাম, এই সেই  সুন্দর শিশু,  যে ইতিপূর্বে এ বাড়ির শোভা ও কেন্দ্রবিন্দু ছিল। তার কাছে তার বাবার কথা জানতে চাইলাম।  সে ইশারায় আমাকে আসতে বলে কুপি হাতে একটি ধুলিধূসরিত ঘরে প্রবেশ করল। বসার জায়গাটিতেও ধুলোর আস্তরণ জমে গেছে। হাতের রেখার মতো কিছু আঁকিবুকি দেয়ালে ভেসে না উঠলে আমি বুঝতেই পারতাম না, এটিই সেই ঘর যেখানে আমি সুখময় বারোটি বসন্ত পার করেছি।

এখানে বসেই ছেলেটির সাথে সামান্য কথা হল, সে জেনে নিল আমি কে। আমিও জানতে পারলাম তার বাবা এখন অবধি ঘরে ফেরেনি। খুব তাড়াতাড়ি ফিরবে। তারপর সে আমাকে বসিয়ে রেখে কিছুক্ষণের জন্য ভিতরে গেলো। ফিরে এসে বলল,  তার আম্মিজান বাবার ব্যাপারে কিছু বলতে চায়। আমি খানিকটা শংকিত হলাম। অনুমান করলাম খারাপ কিছু ঘটেছে কিন্তু কী ঘটেছে তা ঠাওর করতে পারলাম না। কালো চাদরে ঢাকা একজন মহিলা দরজার ওপাশে দাঁড়িয়ে আমাকে অভিভাদন জানালো। আমি প্রতিউত্তর করলাম।  সে বলল, কালের দুর্বিপাকে আপনার বন্ধু কোথায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে আপনি কি জানেন? বললাম, জানি না। সাত বছর পর আজই প্রথম এই শহরে পা রেখেছি। সে বলল, আপনি যদি তাকে ছেড়ে না যেতেন তাহলেই বোধহয় ভাল ছিল। কারণ আপনি তার আশ্রয় ছিলেন। তাকে পতনের হাত থেকে বাঁচিয়ে রেখেছিলেন। আপনি চলে যাওয়ার পর একদল শয়তান চতুর্পাশ থেকে তাকে ঘিরে ফেলেছে। আপনি তো জানতেন, সে ছিল সহজ-সরল ভালো মানুষ।  শয়তান তাকে মন্দের পথে নিতে নিতে এমন গহ্বরে নিয়ে ফেলেছে যে, আমরাও দুর্দশায় পড়েছি। আমি জানতে চাইলাম, কী ধরণের মন্দের সাথে সে জড়িয়েছে? কারা তাকে নষ্ট করেছে?  সে বলল, আমি আপনাকে খুলে বলছি। একটু ধৈর্য্য নিয়ে শুনুন!

আমাদের দিন ভালোই চলছিল, হঠাৎ শহর প্রধানের সাথে আমার স্বামীর পরিচয় হয়, তারপর বন্ধুত্ব, তারপর সে তার একান্ত সহচর হয়ে ওঠে। শহর প্রধান তার জন্য ভাতা ঠিক করেছে। তাই সব সময় আমার স্বামী তার পাশে দরবারে থাকে, সকাল সন্ধ্যা সেখানেই তার যাওয়া আসা। তখন থেকেই সে  কেমন যেন পাল্টে গেছে। স্ত্রী সন্তানের দেখাশোনা প্রায় ছেড়ে দিয়েছে। শেষ রাতের আগে বাড়ি ফেরে না। শুরুর দিকে শহরপ্রধানের কাছে তার এ নৈকট্য অর্জনে আমি বেশ গর্বিত ছিলাম।  আমি ভেবেছিলাম, এ পথ ধরে আমাদের বাড়িতে অফুরন্ত সুখশান্তির অনুপ্রবেশ ঘটবে। তার অধঃপাতে যাওয়ার বিষয়টি আমি তখন ঠাওর করতে পারিনি। কারণ সে প্রায় বাড়ির বাইরে থাকতো। তার সাথে দেখা হতো খুবই কম।

হঠাৎ একরাতে সে ভীষণ রকম টলতে টলতে,  ভয়ানক ব্যথায় কাতরাতে কাতরাতে বাড়ি ফিরল। আমি তার মুখের কাছে মুখ নিয়ে মাদকের গন্ধ পেলাম। সেদিন আমার সামনে সবকিছু স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে। আমি বুঝতে পেরেছি যে, এইসব নেতারা তাদের নেতৃত্বগুণে মানুষকে ভালোর পথেও নিতে পারে আবার খারাপের পথেও নিতে পারে। আমার সহজ-সরল স্বামীটাকে খারাপের পথে নেয়া হয়েছে। সে তাকে প্রকৃত বন্ধু বানায়নি, বরং মদ্যপানের সঙ্গী বানিয়েছে। পরিচিত সবার মাধ্যমে আমি তাকে বোঝানোর চেষ্টা করেছি। দু’টি চোখ যতটুকু অশ্রু ঝরাতে পারে, তার সামনে আমি সবটুকু অশ্রু ঝরিয়েছি। আশা ছিলো হয়তো সে আগের জীবনে ফিরে আসবে,  যেখানে স্ত্রী-পুত্রদের সাথে সুখের একটি সংসার ছিল। কিন্তু তাকে আমি তার জায়গা থেকে এক বিন্দু নড়াতে পারিনি।

এরপর একদিন শুনতে পাই, যে হাত সুরার দিকে এগিয়েছিলো  সে হাত এখন জুয়ার দিকে প্রসারিত। আমি অবাক হইনি। কারণ আমার জানা আছে যে, পাপের পথ একটিই। এর মাথার কাছে দাঁড়ালে নামতে নামতে পায়ের কাছে পৌঁছে যেতে হয়।  সেই ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন অভিজাত যুবকটি, যে গতকাল পর্যন্ত  কোনো অষুধের মধ্যে এ্যালকোহলের গন্ধ পেলে তা ছুড়ে ফেলতো, যে পথে মদ্যপায়ীদের চলাফেরা সে পথ কোনোদিন মাড়াতো না, সেই যুবকটি এখন নাম-পরিচয়হীন মাতাল, জুয়াড়িদের সাথে উঠাবসা করতে একটুও দ্বিধান্বিত হয় না। গতকালও যে সন্তানদের কষ্ট দেখতে পারতো না, স্ত্রীর মলিন মুখ সহ্য করতে পারতো না আজ সে হৃদয়হীন বাবা ও স্বৈরাচারী স্বামীতে পরিণত হয়েছে। কাছে ঘেষলেই সন্তানদেরকে প্রহার করে, চোখের সামনে পেলেই স্ত্রীকে ধমকাতে থাকে। যে মানুষ অত্যন্ত ব্যক্তিত্ববান ছিল, নিজের মর্যাদার ব্যাপারে সীমাহীন সতর্ক ছিলো, এখন কোনো কোনো রাতে মাতাল বন্ধুদেরকে নিয়ে বাড়ি ঢুকে পড়তে তার বিবেকে বাঁধে না। আমি ও আমার সন্তানেরা যে ফ্লাটে থাকি, হৈ হৈ করে তারা সে ফ্লাটে ঢুকে পড়ে। একটি রুম দখল করে সেখানে হল্লা করে মদপান করে । তাদের  চিৎকার চেচামেচিতে বাড়ির পরিবেশ ভারি হয়ে ওঠে। তারপর সারা বাড়িতে একজনের পিছনে আরেকজন দৌড়াতে থাকে। এক সময় তারা আমার ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়ে। কেউ আমার মুখে থাপ্পড় মারে। কেউ ওড়না টেনে নিতে চায়। আমার স্বামীর চোখের সামনেই। সে কিছুই বলে না। সামান্য  সংকোচবোধও করে না। আমি তাদের হাত থেকে বাঁচার জন্য এ ঘর থেকে ও ঘরে ছুটতে থাকি। তারা পাশব চিৎকারে আমার পিছু ধাওয়া করে। কখনো এমন হয়েছে যে, আমি আমার ঘর থেকে পালিয়ে বের হয়ে এসেছি, অথচ আমার গায়ে এক সুতো কাপড় নেই। অন্ধকারের চাদরে নিজেকে জড়িয়ে পাশের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছি। সেখানেই ভয়ানক আতঙ্কে কাঁপতে কাঁপতে নির্ঘুম রাত কাটিয়েছি।

তার কথার আওয়াজ কান্নার আড়ালে চাপা পড়ে গেলো। সে মাথা নিচু করে গুমরে কাঁদতে লাগলো। আমিও কান্না আটকে রাখতে পারলাম না। এক সময় সে মাথা তুলে আবার বলতে শুরু করল-

অল্পদিনের মধ্যেই তার হাতের সব অর্থ নিঃশেষ হয়ে গিয়েছিল। এরপর ঋণ করা ছাড়া গতি রইলো না। যখন ঋণের বোঝাও ভারি হয়ে গেলো তখন ঘরের জিনিসপত্র বন্ধক রাখতে শুরু করল। এরপর যখন বন্ধক নিতেও কেউ রাজি হল না তখন সে সবকিছু বেঁচে দিলো। এমনকি আমরা যে ঘরে বাস করছি সে ঘরটিও বিক্রি হয়ে গেছে। এরপর তার হাতে কেবল সামান্য পরিমাণ মাসিক ভাতা রইলো। অবশ্য সেটাও ক্ষণিক সময়ের জন্য। সেই টাকাও খানিকবাদে হয় পাওনাদারের হাতে চলে যেতো নয়তো জুয়ার টেবিলে নিঃশেষ হয়ে যেতো। কালের কঠোর হাত তাকে এভাবেই থাপ্পড় মেরেছে।

আর আমাদের সাথে যা ঘটেছে তা হল, সংসার চালাতে গিয়ে এক বছর ধরে অলংকার বিক্রয় করতে করতে আমি আমার শেষ অলংকারটিও বিক্রি করে ফেলেছি। সুদী মহাজন বা বন্ধকীদের ঘরে গিয়ে দেখুন, আমার কাপড়-চোপড় ও ঘরোয়া জিনিসে তাদের ঘর পূর্ণ হয়ে আছে। একজন হতদরিদ্র সৎ প্রতিবেশি যদি তার সংসার থেকে বাঁচিয়ে মাঝে মাঝে সামান্য খাবার না দিতো তাহলে আমি ও আমার সন্তানেরা না খেয়ে মারা যেতাম।

এই হতভাগা মানুষটিকে তার অভিশপ্ত জীবন থেকে বের করে আনতে আপনি আমাকে সাহায্য করতে পারেন। আপনার সাথে তার যে হৃদ্যতা ছিল, তার উপর ভরসা করে বলতে পারি, সবাই ব্যর্থ হয়েছে। আপনি নিশ্চয়ই ব্যর্থ হবেন না। যদি আমাদের জন্য এটা করেন তাহলে আপনার অনুগ্রহের কথা আমরা মৃত্যু অবধি ভুলবো না।

মহিলাটি সালাম দিয়ে চলে গেলেন। আমি বালকটিকে জিজ্ঞাসা করলাম, তোমার পিতাকে এ বাড়িতে কখন পাবো? সে বলল, সকালে সে বের হওয়ার আগেই আপনি বাসায় আসুন। আমি বাড়ি ফিরে এলাম, কিন্তু এমন একটি কষ্ট সাথে করে নিয়ে এলাম যা আমাকে সারারাত ঘুমাতে দিল না। কতক্ষণ শুয়ে, কতক্ষণ বসে, কতক্ষণ অস্থিরভাবে পায়চারি করে রাত কাটলো। আহা কী দীর্ঘ একটি রাত!

পরের দিন  প্রত্যুষে আমি পুরোনো বন্ধুর সাথে সাক্ষাতের জন্য বের হয়ে পড়লাম। গতকাল যখন এই শহরে পা রাখি তখনও তার বন্ধুত্বের প্রতি আমার কী বিপুল আস্থা ছিল, কিন্তু এখন আমি অনুমানও করতে পারছি না, তার সাথে আমার বন্ধুত্বের পরিণতি কী হবে!

যে যুদ্ধে সবকিছু নিঃশেষ হয়ে গেছে সে যুদ্ধের মাঠে পুনরায় প্রবেশের আগে যে অনুভূতি হয়  আমার ভিতরে সে অনুভূতি কাজ করছে। এ যুদ্ধে আমি সবকিছু পুনরুদ্ধার করতে পারি  অথবা  শেষ সম্ভাবনাটুকুও খুঁইয়ে বসতে পারি।

এখন আমি বুঝতে পারি মুখ হল মনের আয়না। মনের আলোয় মুখ উজ্জ্বল হয় আর মনের অন্ধকারে মুখ অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে পড়ে।  সাত বছর আগে আমি তাকে শেষবারের মত দেখেছিলাম। এখন তার আগের চেহারাটা মনেও করতে পারছি না। চেহারা মনে করতে গেলে স্মৃতিতে কেবল একটি লাবণ্যময় দীপ্তি ভেসে উঠছে। ব্যক্তিত্ব ও আভিজাত্বের দীপ্তি, যার সামনে সূর্যের আলোও ম্লান হয়ে যায়। এখন যখন তার মুখের দিকে তাকিয়ে আছি, তার চেহারায় ব্যক্তিত্বের সেই দীপ্তি, আভিজাত্যের সেই উজ্জ্বলতা আর খুঁজে পাচ্ছি না। আমি যেন ভিন্ন কারো মুখের দিকে তাকিয়ে আছি, সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটি যেন সেই মানুষ নয়, যাকে আমি চিনতাম। লাবণ্যময় সুন্দর চেহারার সেই যুবকটিকে আর খুঁজে পেলাম না, যার মুখের প্রতিটি বিন্দুতে লাবণ্যময় হাসি ঝিলমিল করতো। তার পরিবর্তে আমি আমার সামনে বিপর্যস্ত উদভ্রান্ত একটি লোকের মুখ দেখতে পেলাম, বার্ধক্যের আগেই যে বুড়িয়ে গেছে। বয়স ত্রিশ না পেরোতেই ষাটে পৌঁছে গেছে। দৃষ্টি লক্ষ্যহীন, কপাল ও ভ্রুতে ভাঁজ পড়ে গেছে। কুঁজো মানুষের মতো দুই কাঁধ উঁচুতে উঠে গেছে আর মাথা  নেমে গেছে নিচের দিকে। প্রথম যে কথাটি আমার মুখ ফসকে বেরিয়ে গেলো তা হল, ‘বন্ধু! তোমার সবকিছু বদলে গেছে, এমনকি মুখটাও। সম্ভবত সে আমার মনের ভাব ধরে ফেলেছে। অথবা বুঝে ফেলেছে যে, আমি তার সব কথা জেনে গেছি। তাই এমনভাবে মাথা নিচু করে ফেলল যেন মাটি ফুঁড়ে ভিতরে ঢুকে যেতে পারলে বাঁচে। সে শুধু চুপ করে রইল। আমি তার কাঁধে হাত রেখে বললাম, আল্লাহর শপথ! আমি বুঝতে পারছি না তোমাকে কী বলবো। আমি কী তোমাকে নসীহত করবো? অথচ কিছুদিন আগে তুমিই আমাকে নসীহত করতে। তুমি ছিলে এমন নক্ষত্র যার আলোয় পথ দেখে দেখে আমি জীবনের অন্ধকার পথ পাড়ি দিয়েছি। আমি কী তোমাকে তোমার দায়িত্ব সম্পর্কে জ্ঞান দেবো? অথচ আমি যা কিছু জানি তার সবকিছু তুমিও জানো। আমি কি তোমার অসহায় পুত্র ও হতভাগা স্ত্রীর জন্য অনুতাপ প্রকাশ করবো, যাদের তুমি ছাড়া কোনো আশ্রয় কিংবা অবলম্বন নেই? যারা দূরের তাদের প্রতিও তোমার হৃদয় ছিল বিগলিত, যারা কাছের আজ তাদের প্রতি একটুখানি সদয় হও!

হে বন্ধু! এই যে জীবন পার করছো তা তোমাকে কেবল নিস্ফল অশ্রুই দিতে পারে। কিন্তু অশ্রুর আড়ালে জীবনের সব অপরাধ লুকিয়ে ফেলা যায় না। তুমি তো দুনিয়ার উপর কোনো প্রতিশোধ নিচ্ছো না বা তার কোনো ক্ষতি করতে পারছো না। তাহলে কেনো কবরের পথে হাঁটা শুরু করলে? কেনো রিক্ত নিঃস্ব অবস্থায় দুনিয়া থেকে বের হয়ে যেতে চাচ্ছো? আমাকে ক্ষমা করো! যদি তুমি এই জীবনের লাভের সাথে আগের জীবনের ক্ষতিকে তুলনা করো তাহলে সে ক্ষতিটাকেই বেশি লাভজনক মনে হবে। তখন ধনী ছিলে এখন দরীদ্র হয়ে গেছো। তখন সুস্থ ছিলে এখন অসুস্থ হয়ে পড়েছো। তখন সম্মানিত ছিলে এখন অবহেলিত হয়ে গেছো। এতকিছুর পরও যদি তুমি মনে করো তুমি সুখী তাহলে এই পৃথিবীতে হতভাগা মানুষ আর একটিও নেই। এই জীবনের কাছে একটি জিনিসই তুমি চাইতে পারো তাহলো মৃত্যু । তুমি একটি কাজ করো। এক পেয়ালা বিষ চেয়ে নিয়ে এক ঢোকে খেয়ে ফেলো। এতে তুমি প্রতিদিন একটু একটু করে মরার চেয়ে, যাতে কষ্টও বেশি, পাপও বেশি, সহজে মরবে। আর ওভাবে মরলে দুনিয়ায় এ জীবনে যে আযাব হবে তা পরজীবনের আযাবের চেয়ে কম নয়।

এক জীবনে নিয়তি আমাদের কপালে যত কষ্ট লিখে রাখে তা-ই অনেক। নতুন করে কষ্ট কুড়াবার প্রয়োজন হয় না।

বন্ধু! হাত বাড়িয়ে দাও। শপথ করো তুমি আগের জীবনে ফিরে আসবে। দুজনে মিলে আমরা আগে কত সুখি ছিলাম। যখন আলাদা হলাম তখনই দুর্ভাগ্য নেমে এলো। আজ আমরা আবার একত্রিত হয়েছি। এসো সম্মান ও মর্যাদায় ঘেরা সুখের জীবনে আমরা আবার ফিরে আসি।

আমি তার দিকে হাত বাড়িয়ে দিলাম। কিন্তু সে দেখি আমার দিকে হাত বাড়াচ্ছে না। আমি দ্বিধাস্থ গলায় বললাম, তুমি কেনো হাত বাড়াচ্ছো না? সে কেঁদে ফেলে বলল, হাত বাড়াচ্ছি না, কারণ আমি মিথ্যাবাদী বা প্রতিশ্রুতি ভঙ্গকারী হতে চাই না। বললাম, প্রতিশ্রুতি পূরণ করতে বাঁধা কোথায়? সে বলল, আমি আসলে দুর্ভাগা। সৌভাগ্যবানদের সুখে আমার কোনো অধিকার নেই। আমি বললাম, তুমি যদি নিজেই নিজের দুর্ভাগ্য ডেকে আনতে পারো তাহলে এখন সুখ আনতে সমস্যা কোথায়?  সে বলল, সুখ হল দূরের আকাশ আর দুঃখ হল কাছের মাটি। আকাশে উঠার চেয়ে মাটিতে নেমে যাওয়া সহজ।

প্রবৃত্তির গর্তে আমার পা পিছলে গেছে। এ গর্তের গহীন সীমানায় না পৌঁছা পর্যন্ত আমি কোনো কিছু আকড়ে ধরে পতন ঠেকাতে পারছি না। আমি তিক্ত জীবনের প্রথম ঢোক পান করে ফেলেছি। এ পেয়ালা খালি না হওয়া পর্যন্ত আমি থামতে পারছি না। একটি জিনিসই আমার পতন ঠেকাতে পারতো, তাহলো ওই প্রথম ঢোক পান না করা। কিন্তু আমি তো তা করে ফেলেছি। সুতরাং এখন নিয়তির কোলে নিজেকে ছেড়ে দেয়া ছাড়া আর কোনো পথ নেই। আমি বললাম, একটি মাত্র দৃঢ় সংকল্প তোমাকে এ পথ থেকে ফিরিয়ে আনতে পারে। সে বলল, সংকল্প বলা হয় এক ধরণের ইচ্ছাকে। আমার মধ্যে এখন ইচ্ছা অনিচ্ছা কোনোটাই নেই। নিয়তির ভেলায় চড়ে নরকের পথে সফর করছি। তুমি আমাকে আমার মতো ছেড়ে দাও। কপালে যা লেখা আছে তাই হবে। আর যদি কোনো হতভাগা পাপিষ্ঠের জন্য কাঁদতে তোমার অসুবিধা না হয় তাহলে তোমার পুরোনো বন্ধুর জন্য কেঁদো।

এরপর সে অঝোরধারায় কাঁদতে কাঁদতে উদভ্রান্তের মতো দৌড়ে ঘর থেকে বের হয়ে গেলো। আমিও ফিরে এলাম।

বুকের পাঁজরে যে কী পরিমাণ ব্যথা ও হতাশা নিয়ে ফিরলাম, আল্লাহই তার তার খবর জানেন।

সেই শহরপ্রধান বেশিদিন আর তার ‘পানসঙ্গী’কে সহ্য করতে পারলো না। তার কাজকর্মে অতিষ্ঠ হয়ে তাকে বরখাস্ত করল ও বেতন-ভাতা বন্ধ করে দিল। নিজের হাতে নষ্ট হওয়া মানুষটিকে বিপদে ফেলতে তার মন একবারও কাঁদলো না। চোখ দিয়ে একফোঁটা অশ্রুও ঝরল না।

আমার বন্ধু যার কাছে নিজের বাড়িটি বিক্রি করেছিল সে বেশিদিন সেই বাড়িতে থাকতে দিল না, পরিবার সমেত তাকে বের করে দিল। বন্ধুটি তার স্ত্রী-সন্তানদেরকে নিয়ে শহরের বাইরে একটি পরিত্যক্ত বাড়ির ছোট্ট কুটিরে গিয়ে উঠল। আমি প্রায়ই তাকে পানশালায় যেতে অথবা পানশালা থেকে ফিরতে দেখতাম। যখন পানশালায় যেতে দেখতাম তখন মুখ অন্য দিকে ফিরিয়ে নিতাম। আর যখন ফিরতে দেখতাম তখন তার মুখে লেগে থাকা মাটি ও ঘাম মুছে দিয়ে বাড়ি পর্যন্ত দিয়ে আসতাম। এভাবে দিন ও বছর কেটে যেতে লাগল। আর সেই বন্ধুটির মস্তিষ্ক ও শরীর একটু একটু করে ক্ষয়ে যেতে লাগল। এক সময় সে মানুষের কাছে অপসৃয়মাণ ছায়া অথবা প্রতিদিন দেখা দুঃস্বপ্নের মতো হয়ে উঠল। সে দিশেহারা মাতালের মতো টলতে টলতে রাস্তা ধরে হেঁটে যেতো।  গাড়ি-ঘোড়া ধাক্কা মেরে চলে গেলেও সে কিছু টের পেতো না। চলতে চলতে হঠাৎ করে থমকে দাঁড়াতো, নিজের চারপাশে হারিয়ে যাওয়া কিছু খুঁজে ফিরতো। অথচ হারানোর মতো আর কিছুই বাকি ছিল না। সে বারবার নিজের জামা-কাপড়ের দিকে তাকিয়ে দেখতো, অথচ সেখানে ফাটা আর তালি ছাড়া কিছুই ছিল না। কেউ হেঁটে আসতে লাগলে তার দিকে সন্দেহের চোখে তাকাতো, যেন ভয়ানক কোনো শত্রুকে দেখছে, অথচ তার কোনো শত্রুও ছিল না, বন্ধুও ছিল না। কখনো কখনো পথের শিশুরা তার ঘাড় ধরে ঝুঁলে পড়ত। সে সামান্য আপত্তি করত যেন ঘুমন্ত মানুষকে জাগানো হচ্ছে। যখন তার পেট মদ থেকে খালি হয়ে যেত, মস্তিষ্ক স্বাভাবিক হয়ে উঠত তখন আবার সে পানশালায় দৌড়ে যেত। মদ পান করতে করতে আগের অবস্থা ফিরে আসলে পুনরায় রাস্তায়  নেমে পড়ত।

এভাবেই চলতে লাগল, অবশেষে গত কয়েক মাস ধরে নতুন যা ঘটছে তার বিবরণ হল;

স্ত্রী-লোকটির দৈনন্দিন খাবারের বন্দোবস্ত শেষ হয়ে গেছে। বাচ্চা দু’টি চোখের সামনে সর্বক্ষণ কাঁদতে থাকে। মুখের ভাষায় যা বলতে পারে না, চোখের পানিতে তা বলে ফেলে। অবশেষে বাধ্য হয়ে খাদ্য আহরণের প্রাচীন পথটি তাদেরকে বেছে নিতে হল। পুত্র ও সন্তানটিকে তিনি কোনো এক ধনাঢ্য লোকের বাড়িতে কাজের লোক হিসেবে পাঠিয়ে দিলেন। তারা সেখানে খায়। মায়ের জন্য খাবার নিয়ে আসে। খুব সামান্য সময়ের জন্য তিনি  পুত্র ও কন্যাটিকে দেখতে পান। স্বামীকে দেখতে পাওয়া আরো দুরুহ ব্যাপার। যেদিন রাতে রাস্তার পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে বাড়ি ঢুকতে পারে সেদিন সে বাড়িতে আসে। অবশ্য এ সুযোগ খুব কমই হয়। ফলত একটি পরিত্যক্ত বাড়িতে স্ত্রী-লোকটি দীর্ঘ দীর্ঘ রাত, দীর্ঘ দীর্ঘ দিন একাকী পড়ে থাকে। একেবারে একা। অবশ্য মাঝে মাঝে একজন বৃদ্ধা প্রতিবেশি তাকে দেখতে আসে। একটুখানি গল্প করে যাওয়া। যখন সেও চলে যায়, সবকিছু একেবারে নিস্তরঙ্গ হয়ে পড়ে তখন সুখময় অতীত তার স্মৃতিপটে ভেসে ওঠে। ব্যক্তিত্ববান স্বামী ও আকাশের নক্ষত্রের মত সুন্দর শিশুদেরকে নিয়ে কী চমৎকার জীবন তারা কাটিয়ে এসেছে। তারপর ভাবনায় এক এক করে আসতে থাকে, কী করে একজন নিরেট ভালো মানুষ পুরোপুরি নষ্ট হয়ে গেল। সবার প্রিয় মানুষটি লাঞ্ছনার শেষ সীমানা স্পর্শ করে ফেলল। যেন একটি অতি মূল্যবান মুক্তার মালা ছিড়ে গেছে, তার দানাগুলো পথের ধুলোয় লুটোপুটি খায়, পথচারিরা পায়ের তলে পিষে চলে যায়। নারীটি চারপাশে অসীম শুন্যতার হাহাকার নিয়ে সর্বহারার  মত কাঁদতে থাকে।

অবাক ব্যাপার হল, যে লোকটির জন্য আজ তার এতো দুর্দশা, বাচ্চাগুলোর মুখের দিকে তাকানো যায় না, সেই মানুষটির প্রতি তার একটুও ক্ষোভ নেই। একবারও তাকে ছেড়ে যাওয়ার কথা মনে মনেও ভাবে না। কারণ সে একজন আদর্শ নারী। আদর্শ নারীরা কখনো হতভাগা স্বামীদেরকে দাগা দেয় না। মমতাময়ী মা যেভাবে তার অবুঝ শিশুর ভুলগুলোকে দেখে, সেভাবেই সে তার স্বামীর পদস্খলনকে দেখে। স্বামীর প্রতি একটি অব্যক্ত মমতা সব সময়ই হৃদয়কে আচ্ছন্ন করে রাখে। স্বামী যদি অসুস্থ হয় তাহলে সারারাত তার পাশে বসে শুশ্রুষা করে, যদি আঘাত পায় তাহলে জখম পরিস্কার করে ব্যান্ডেজ করে দেয়।

কোনো কোনো দিন টাকা না থাকলে মদের দোকানদার তার স্বামীকে ঘাড় ধরে বের করে দেয়। সে বাড়িতে এসে হিংস্র শাপদের মতো স্ত্রীর উপর চড়াও হয়। মদ কেনার টাকা চাইতে থাকে। স্ত্রী বেচারী বাধ্য হয়ে খাবারের টাকা অথবা ঘরের খাবার বেচে স্বামীর হাতে টাকা তুলে দেয়, যেন বেচারা অন্তত প্রাণে বেঁচে থাকে।

নির্মম নিয়তি তার পিঠে এতো বোঝা দিয়েও শান্ত হয়নি। নতুন আরেক ভার দিয়েছে। একদিন নিঃসঙ্গ সময়ে সে তার গর্ভাশয়ে প্রাণের স্পন্দন টের পায়। সে বুঝতে পারে এ অভাগা গৃহে আরেক অভাগার আগমন ঘটছে। সে চিৎকার করে বলে ওঠে- খোদা রহম করো! দুঃখে এ ঘর ভরে গেছে। আর এক ফোঁটা দুঃখ ধারণের জায়গা নেই।

দীর্ঘ নয় মাস  হতভাগা এ নারী রোগ, শোক ও গর্ভ-যন্ত্রণা ভোগ করার পর তার সন্তান প্রসবের মুহূর্তটি এসে গেল। তখন তার পাশে কেবল সেই বৃদ্ধা প্রতিবেশিনী ছিল। স্রষ্টার কৃপায় গর্ভপাতের কাজটি সেই সারল। কিন্তু গর্ভপাতের পর তার রক্তক্ষরণ আর বন্ধ হল না। ফ্রীতে চিকিৎসা করবে এমন ডাক্তারও খুঁজে পাওয়া গেল না। যে দেশে ডাক্তাররা রোগী মেরে ফেলে খুনের পারিশ্রমিক চাইতে লজ্জাবোধ করে না সে দেশে কেউ ফ্রীতে রোগী দেখে দেবে এমন আশা করা বোকামী। মৃত্যু নারীটির কাছে হামাগুড়ি দিয়ে আসতে আসতে এক সময় তাকে খপ করে ধরে ফেলল। যখন সে মারা যায়, পাশে কেউ ছিল না, শুধু সদ্য জন্ম নেয়া শিশুটি তার স্তনে মুখ  রেখে কাঁদছিল।

ঠিক সেই মুহুর্তে মাতাল স্বামীটি উন্মাদের মতো চিৎকার করতে করতে ঘরে এসে ঢুকল। ক্রুদ্ধ চোখে চারদিকে তাকিয়ে স্ত্রীকে খুঁজতে লাগল। তার এখন তার মদের পিপাসা। শিশুটি মায়ের পাশে শুয়ে কাঁদছিল। মাতাল স্বামী ভাবলো মহিলাটি বোধহয় ঘুমিয়ে আছে। কন্যা শিশুটিকে দূরে ছুড়ে ফেলে স্ত্রীকে ধরে ঝাঁকাতে লাগল। কিন্তু স্ত্রী লোকটি একটুও সাড়া দিল না। সে সন্দিহান হয়ে পড়ল। অজানা একটি ভয় তার শিরা বেয়ে মনের মধ্যে ঢুকে পড়ল। সে ঝুঁকে পড়ে স্ত্রীর মুখে সজোরে থাপ্পড় মারতে লাগল। চারপাশে ঘুরে ঘুরে তাকে পর্যবেক্ষণ করতে লাগল। হঠাৎ স্ত্রীর তাকিয়ে থাকা স্থির দুটো চোখ তাকে সচকিত করে তুলল। ভয়ে চিৎকার করে সে ঘর থেকে দৌড়ে বের হওয়ার সময় কন্যা শিশুটির বুক পা দিয়ে মাড়িয়ে দিল। মেয়েটি একবারের জন্য অস্ফূট একটি চিৎকার করে চিরদিনের জন্য নিরব হয়ে গেল। লোকটি বুঝতে পেরে কেঁদে ফেলল, হায় দুর্ভাগ্য! হায় নিয়তি!

লোকটি বাইরে বের হয়ে উন্মাদের মতো রাস্তা ধরে হাঁটছে, রাস্তার পাশের দেয়ালে, লাইটপোস্টের পিলারে সজোরে মাথা ঠুকছে। সামনে মানুষ বা প্রাণী যে আসছে তাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিচ্ছে আর চিৎকার করে বলছে, হায় আমার কন্যা! হায় আমার স্ত্রী! ফিরে এসো! আমাকে ধরো। আমি আর চলতে পারছি না।

এক সময় সে পথের উপর লুটিয়ে পড়ল। বলি দেয়া শুকরের মতো চিৎকার করতে করতে সজোরে মাটিতে পদাঘাত করতে লাগল। চার পাশে মানুষের ভীড় জমে গিয়েছিল। তারা দুঃখ করতে লাগল। লোকটিকে চেনে বলে নয়, বরং লোকটির চেহারায় তারা দুর্ভাগ্যের শিলালিপি পাঠ করে ফেলেছিল।

এরপর যখন তার জ্ঞান ফিরল তখন বোঝা গেল, লোকটি চিরদিনের জন্য পাগল হয়ে গেছে। এখন সে পাগলা গারদে বাস করে। সব সময় শিকলে বাঁধা থাকে। আমি মাঝে মাঝে তার শহীদ স্ত্রী ও কন্যার কথা স্মরণ করে নিরবে অশ্রুপাত করি।

আগের সংবাদঅচেনা এক নগরীর গল্প
পরবর্তি সংবাদইমদাদুল হকের কয়েকটি ছড়া