একনজরে বাংলাদেশের শিক্ষা কমিশনসমূহ

হুসাইন আহমাদ:

শিক্ষা একটি চলমান প্রক্রিয়া। সময়ের প্রয়োজনে শিক্ষার ধারণা, বিষয়বস্তু ও শিক্ষাদান পদ্ধতি পরিবর্তন হয়ে থাকে। আবার কখনো প্রয়োজনের বিপরীতে শাসকগোষ্ঠীর অন্যায় হস্তক্ষেপে পরিবর্তিত হয় শিক্ষার গতিধারা। সময়ের দীর্ঘ পরিক্রমায় অনেকগুলো শিক্ষা কমিশনের প্রণীত প্রস্তাবনার ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা আজকের এ পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে। কাজেই বাংলাদেশের শিক্ষার ইতিহাস ও গতি-প্রকৃতি জানতে হলে ইতিহাসের পথ বেয়ে বহু পেছনে ফিরে যেতে হয়। জানতে হয় অতীতের সকল শিক্ষা কমিশন ও তাদের প্রস্তাবনা সম্পর্কে। শিক্ষার এই ঐতিহাসিক দিকটিকে বৃটিশ, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ— এই তিনটি কালপর্বের ভিত্তিতে উপস্থাপন করা হল।

এক. বৃটিশ ভারত

১৮১৩ সালে সনদ নবায়ন আইনের মাধ্যমে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ভারতীয় জনগণের শিক্ষার দায় স্বীকার করে নেয়। সেই সাথে বাজেট থেকে বাৎসরিক এক লক্ষ টাকা শিক্ষাখাতের জন্য বরাদ্দ দেয়। ক্ষমতা দখলের পর থেকে কোম্পানি এই প্রথম শিক্ষার দায় গ্রহণ করায় এদেশের মানুষ আশার আলো দেখে। অস্তিত্বের সংগ্রামে থাকা দেশীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো প্রাণ ফিরে পাবে ভেবে অনেকটা স্বস্তিবোধ করে।

১৮৩৫–৩৮ সালে পর্তুগিজ মিশনারির ফাদার উইলিয়াম এ্যাডাম দেশীয় শিক্ষাব্যবস্থার ওপর পৃথক তিনটি জরিপ চালিয়ে কোম্পানির কাছে রিপোর্ট করেন। এতে তিনি বাংলা ও বিহারের মক্তব, মাদরাসা ও টোল সহ এক লক্ষ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের তথ্য তুলে আনেন এবং এসব প্রতিষ্ঠানের সংস্কার, ও উন্নয়নের জন্য সহযোগিতা চেয়ে কোম্পানির নিকট সুপারিশ করেন। কিন্তু এদেশের মানুষ যে আশার আলো দেখেছিল তা নিভে যায় মেকলের বিরোধিতার দমকাতে। মেকলে হাজির হন ‘নিম্নগামী পরিস্রবণ নীতি’ বা চুইয়ে-পড়া শিক্ষাতত্ত্ব নিয়ে। তার মতে উপর তলার অনুগত কিছু মানুষকে শিক্ষা দেওয়া হবে। এদের থেকে শিক্ষা চুইয়ে-পড়া শিক্ষা পরবর্তীতে নিচের মানুষদেরও শিক্ষিত করে তুলবে। মেকলে তার মিনিটে লেখেন,

“We must at present do our best to form a class who may be interpreters between us and the millions whom we govern; a class of persons, Indian in blood and colour, but English in taste, in opinions, in morals, and in intellect.” (১)
“বর্তমানে আমাদের সর্বোচ্চ চেষ্টা করতে হবে এমন একটি শ্রেণি তৈরি করতে, যারা আমাদের ও ভারতীয়দের মাঝে দোভাষী হিসেবে কাজ করবে। এরা হবে এমন এক শ্রেণি যারা রক্তে-বর্ণে ভারতীয় হলেও রুচি ও মতাদর্শে হবে ইংরেজ।” কোম্পানি সরকার মেকলের এই নীতিকেই স্বীকৃতি দেয় এবং শিক্ষাখাতে বরাদ্দ দেওয়া অর্থের পুরোটাই ব্যয়িত হতে থাকে উপর তলার মুষ্টিমেয় কিছু মানুষের মাঝে, অনুগত একদল ‘দেশী ইংরেজ’ তৈরির কাজে। ফলে দেশীয় শিক্ষাব্যবস্থা ও ভাষা-সাহিত্য অনাদর অবহেলায় ধ্বংসের মুখে পতিত হয়।

পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়েছিল ১৮৫৪ সালে উডের ডেসপ্যাচ ঘোষণার মধ্য দিয়ে। এতে মেকলের নীতি পরিত্যাগ করে সাধারণ নাগরিকদের মধ্যে শিক্ষা বিস্তারের কথা বলা হয়। দেশীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে সচল করার সুপারিশও করা হয়। প্রাথমিক শিক্ষা থেকে ইউনিভার্সিটি পর্যন্ত বিভিন্ন ধাপে পশ্চিমা শিক্ষাব্যবস্থার আদলে ভারতে শিক্ষাকাঠামো তৈরির কথা বলা হয়।

কিন্তু এতেও দেশীয় ভাষা ও শিক্ষাকে বাদ দিয়ে ইংরেজি ও পাশ্চাত্যের পুঁথিগত বিদ্যাকেই মূল রাখা হয়। অর্থাৎ ব্যাপকহারে ‘দেশী ইংরেজ’ ও ইংরেজ সরকারের কেরানি তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হয়। এতে ভারতে ইংরেজি শিক্ষার যেমন বিস্তার ঘটে তেমনি শিক্ষিত বেকারের সংখ্যাও বাড়তে থাকে। কারণ দেশীয় শিক্ষা না থাকায় ইংরেজি শিক্ষিতরা দেশের জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল। ফলে ডেসপ্যাচের উপযোগিতা ও কার্যকারিতা নিয়ে নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। এই প্রেক্ষিতে উডের ডেসপ্যাচের পর্যালোচনার জন্য ১৮৮২ সালে হান্টারকে প্রধান করে কোম্পানি একটি শিক্ষা কমিশন গঠন করে। এটিই ছিল বৃটিশ ভারতের প্রথম শিক্ষা কমিশন; যা ‘হান্টার কমিশন’ নামে পরিচিতি পায়। এই কমিশন শিক্ষাক্রমে পাশ্চাত্যের পাশাপাশি দেশীয় শিক্ষাকেও অন্তর্ভুক্ত করার সুপারিশ করে। কিন্তু সরকারের সদিচ্ছার অভাবে তা আর বাস্তবতার মুখ দেখেনি।

তবে ঔপনিবেশিক আমলে লর্ড কার্জন শিক্ষা উন্নয়নে কিছু পদক্ষেপ নিয়েছিলেন, যা ভারতের শিক্ষার ইতিহাসে বেশ গুরুত্বের দাবী রাখে। তিনি ১৯০১ সালে শিমলা সম্মেলন থেকে প্রাথমিক ও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার সংস্কার ও উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। স্বীকৃতি দেন শিক্ষাদানে মাতৃভাষার ব্যবহার। তিনি মুখস্থবিদ্যার চেয়ে শিক্ষার্থীদের মেধাবিকাশকে গুরুত্ব দেন। কিন্তু দুঃখের কথা হল, লর্ড কার্জনের এই পরিকল্পনাও যথাযথ উদ্যোগের অভাবে বাস্তবায়ন হয়নি।

এরপর ১৯১৭ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাদান কার্যক্রম পর্যালোচনা, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষার উন্নয়নের লক্ষ্যে ড. মাইকেল স্যাডলরের নেতৃত্বে একটি শিক্ষা কমিশন গঠিত হয়। কমিশন সরকারকে বিভিন্ন প্রস্তাবের পাশাপাশি ইন্টারমিডিয়েট পাশকে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির যোগ্যতা নির্ধারণ এবং পূর্ব বাংলায় শিক্ষার উন্নয়নের জন্য ঢাকায় একটি আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সুপারিশ করে। বর্তমান ঢাকা ভার্সিটি হল ডেই স্যাডলর কমিশনের প্রস্তাবনার প্রতিফলন।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হলে ১৯৪৪ সালে জন সার্জেন্টের নেতৃত্বে ৪০ বছর মেয়াদী একটি শিক্ষা পরিকল্পনা গৃহীত হয়। এতে ৬ বছরের কমবয়সী শিশুদের নার্সারি স্কুল এবং ৬-১৪ বছর বয়সীদের জন্য অবৈতনিক প্রাথমিক শিক্ষার সুপারিশ করা হয়। কিন্তু এই রিপোর্ট বাস্তবায়নের পূর্বেই ভারতবর্ষ ভেঙ্গে পাকিস্তান ও ভারত নামে দু’টি পৃথক স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্রের জন্ম হয়।

দুই. পাকিস্তান

ঔপনিবেশিক ভারতের শিক্ষাব্যবস্থা কোন শিক্ষাক্রমই এদেশের আর্থসামাজিক ও সভ্যতা-সংস্কৃতির উপযোগী ছিল না। জনগণের ধর্মীয়, সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের কোন উপাদান ছিল না তাতে। তাদের উদ্দেশ্যই ছিল কেবল একদল ‘দেশী ইংরেজ’ তৈরি করে এদেশে তাদের শোষণ-শাসন দীর্ঘমেয়াদে টিকিয়ে রাখা। ফলে বৃটিশ ভারত থেকে পাকিস্তান স্বাধীন হওয়ার পর শিক্ষাব্যবস্থাকে এদেশের মানুষের ধর্মীয় মূল্যবোধ এবং আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের উপযোগী করে গড়ে তোলার প্রয়োজনীতা সর্বাগ্রে সামনে আসে। এ উদ্দেশ্যেকে সামনে রেখে ১৯৪৭ সালে করাচিতে পাকিস্তানের প্রথম শিক্ষা অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। অধিবেশনে পাকিস্তানের প্রাথমিক শিক্ষা সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এর মধ্যে অন্যতম হল, ইসলামি মূল্যবোধকে শিক্ষার মূল চেতনা ধরে নেওয়া হয়। (৪)

এই অধিবেশন থেকে কয়েকটি মৌলিক বিষয় ছাড়া প্রাদেশিক সরকারকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের ক্ষমতা দেওয়া হয়। ফলে ১৯৫১ সালে পূর্বপাকিস্তানে মাওলানা আকরাম খাঁর নেতৃত্বে ১০ সদস্যের একটি শিক্ষা কমিশন গঠন করা হয়। কমিশন ১৯৫২ সালে রিপোর্ট পেশ করে। এতে প্রাথমিক শিক্ষাকে সার্বজনীন, অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক করার প্রস্তাবনা সহ বেশকিছু সুপারিশ করা হয়। যার অধিকাংশ পরবর্তীতে বাস্তবায়িত হয়। এই কমিশনের রিপোর্ট অনুযায়ী ‘৫২ তে প্রাথমিক শিক্ষা বিস্তারে পূর্ব পাকিস্তান সরকার ১০ বছর মেয়াদি একটি পরিকল্পনা গ্রহণ করে। পরিকল্পনা অনুসারে প্রতি বছর গ্রামাঞ্চলগুলোতে ২৫০০ টি করে ১০ বছরে মোট ২৫০০০ টি প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপনের কাজ শুরু হয়। এ বছরই পূর্বপাকিস্তানে ৫০৫৮ টি প্রাথমিক বিদ্যালয় সংস্কার ও প্রতিষ্ঠা পায় এবং পাঁচ বছর মেয়াদি প্রাথমিক শিক্ষাক্রম চালু হয়।

১৯৫৪ সালে পূর্বপাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী আতাউর রহমানের নেতৃত্বে আরেকটি শিক্ষা কমিশন গঠিত হয়। কমিশন ৬–১৫ বছর বয়স পর্যন্ত ছেলেমেয়েদের জন্য শিক্ষাকে অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক করার সুপারিশ করে। এরপর আইয়ুব খান ক্ষমতায় আসার পর ১৯৫৮ সালে এম. এ. শরিফের নেতৃত্বে একটি শিক্ষা কমিশন গঠিত হয়। যার দায়িত্ব ছিল জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থার রূপরেখা তৈরি করা এবং প্রয়োজনীয় কর্মপন্থার সুপারিশ করা। শরিফ কমিশনের রিপোর্টে শিক্ষাকে মানবসম্পদ উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ বিনিয়োগ হিসেবে উল্লেখ করা হয়। সুপারিশ করা হয় উচ্চতর শিক্ষার গুণগত মান উন্নয়নের। কারিগরি, প্রযুক্তি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা বৃদ্ধির মাধ্যমে সামাজিক ও অর্থনৈতিক গতিকে তরান্বিত করার আশা ব্যক্ত করা হয়। নারী শিক্ষাকে এগিয়ে নেওয়ার আহ্বানও জানানো হয় এতে। কিন্তু শরিফ কমিশনের অনেকগুলো পরিকল্পনাই রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে বাস্তবতার মুখ দেখেনি।

১৯৬৪ সালে হামিদুর রহমানের নেতৃত্বে একটি কমিশন গঠিত হয়। হামিদুর রহমান কমিশনের দায়িত্ব ছিল ছাত্রদের সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে তা দূর করার প্রচেষ্টা গ্রহণ করা এবং ছাত্রদের কল্যাণে বিভিন্ন কর্মপরিকল্পনা সুপারিশ করা। ১৯৬৯ এ আইয়ুব খানের পতনের পর এয়ার মর্শাল নুর খানের নেতৃত্বে একটি শিক্ষা কমিশন গঠিত হয়। কমিশন শিক্ষার উন্নয়ন ও শিক্ষাকে কর্মমুখী করা সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাবনা ও সুপারিশমালা পেশ করে। কিন্তু পূর্বপাকিস্তানের শিক্ষা উন্নয়নের ক্ষেত্রে পাকিস্তান সরকার কখনোই আন্তরিক ছিল না। উপরন্তু তাদের ধারাবাহিক বৈষম্য ও বিমাতাসূলভ আচরণ বাঙালি মুসলমানদের জাগিয়ে ও ভাবিয়ে তোলে। অধিকার আদায়ের সংগ্রাম হয়। ফলে অভ্যুদয় ঘটে স্বাধীন বাংলাদেশের।

তিন. বাংলাদেশ

পলাশির প্রান্তরে ভাগ্যবিপর্যয়ের পর বাঙালি মুসলমানদের ভাগ্যোন্নয়নের কোন সুযোগ আসেনি। ১৯৭১ এ স্বাধীনতার মাধ্যমে বাঙালির জন্য সে সুযোগ আসে। জাতিগত উন্নতির ক্ষেত্রে শিক্ষার বিকল্প নেই। তাই শিক্ষাকে বাংলাদেশের মানুষের জন্য উপযোগী ও উন্নয়নমুখী করার লক্ষ্যে ১৯৭২ সালে শিক্ষাবিদ ড. কুদরত-এ-খুদার নেতৃত্বে জাতীয় শিক্ষা কমিশন গঠিত হয়। কমিশন ১৯৭৪ সালে তাদের রিপোর্ট দাখিল করে। নতুন প্রণীত বাংলাদেশের সংবিধানের মূলনীতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে তৈরি হয় এই রিপোর্ট। লক্ষ করার বিষয় হল, কমিশন এদেশের কোটি মুসলমানদের ধর্মীয় অনুভূতিকে পাশ কাটিয়ে উল্টো পথে চলে। তারা শিক্ষানীতিতে ধর্ম, ধর্মীয় শিক্ষা ও ইসলামের প্রতি অশ্রদ্ধা রেখে রিপোর্ট প্রণয়ন করে। মূলত কুদরত-এ-খুদা শিক্ষা কমিশন ইসলামি আদর্শ বিরোধী নৈতিকতাহীন এক কালো শিক্ষাব্যবস্থার ভিত্তি তৈরি করে। যার দীঘল ছায়া বাংলাদেশের পরবর্তী প্রতিটি শিক্ষানীতি ও শিক্ষাক্রমকে অন্ধকার করে রাখে।

কুদরত-এ-খুদা কমিশনের সুপারিশের আলোকে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও সিলেবাস প্রণয়নের জন্য প্রফেসর শামসুল হুদাকে প্রধান করে ১৯৭৬ সালে একটি কমিটি গঠন করা হয়। ৫১ জন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদের সমন্বয়ে গঠিত এই জাতীয় কমিটি মার্চ মাসে এর কার্যক্রম শুরু করে। লক্ষ্য অর্জনের উদ্দেশ্যে কমিটি দশটি সাব-কমিটি ও ২৭টি সাবজেক্ট কমিটি গঠন করে। কমিটি ১৯৭৬, ১৯৭৭ ও ১৯৭৮ সালে সাত খণ্ডে এর সুপারিশ সরকারের নিকট পেশ করে। কমিটি সুনির্দিষ্টভাবে একমুখী ও সমরূপ মাধ্যমিক শিক্ষা পদ্ধতির প্রবর্তন এবং ১৯৮০ সালের স্কুল সেশন থেকে নবম শ্রেণি স্তরে এই পদ্ধতি চালু করার সুপারিশ করে।

১৯৭৮ সালে সরকার কুদরত-এ-খুদা কমিশনের রিপোর্ট পর্যালোচনার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে এবং শিক্ষার সমস্যাবলি নতুনভাবে চিহ্নিত করার উদ্দেশ্যে একটি উপদেষ্টা কমিটি নিয়োগ দেওয়া হয়। এই কমিটি ১৯৭৯ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি ‘অন্তর্বর্তীকালীন শিক্ষানীতি সুপারিশ’ শিরোনামে একটি রিপোর্ট পেশ করে। এই রিপোর্টে দেশে শিক্ষিতের হার বৃদ্ধির ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হয় যাতে জনগণ দেশের উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে পারে। রিপোর্টে মাধ্যমিক শিক্ষার প্রচলিত কাঠামোকে তিনটি উপ-পর্যায়ে ভাগ করা হয়, নিম্ন মাধ্যমিক ৩ বছর, মাধ্যমিক ২ বছর এবং উচ্চ মাধ্যমিক ২ বছর। এরপর ১৯৮৩ সালে মজিদ খান শিক্ষা কমিশন গঠিত হয়। কিন্তু এই কমিশনের রিপোর্ট ব্যাপকভাবে প্রচার লাভ করেনি এবং তা বাস্তবায়নের কোনো আনুষ্ঠানিক উদ্যোগও নেয়া হয়নি।

দেশে শিক্ষা ব্যবস্থার সংস্কার, পুনর্বিন্যাস ও উন্নয়নের উপায় পুণর্বিবেচনার লক্ষ্যে ১৯৮৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভাইস চ্যান্সেলর মফিজউদ্দিন আহমদকে প্রধান করে একটি শিক্ষা কমিশন নিয়োগ দেওয়া হয়। চেয়ারম্যানের নামানুসারে এটি মফিজউদ্দিন শিক্ষা কমিশন নামে পরিচিতি লাভ করে। কমিশনের দুই সদস্য বিশিষ্ট দুটি দল উন্নত শিক্ষাব্যবস্থার সঙ্গে পরিচিত হওয়ার লক্ষ্যে থাইল্যান্ড, চীন, ফিলিপাইন ও জাপান সফর করেন। এই কমিশন ১৯৮৮ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি সরকারের নিকট রিপোর্ট পেশ করে।

১৯৯৭ সালের ১৪ জানুয়ারিতে জারিকৃত এক আদেশের ভিত্তিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভাইস চ্যান্সেলর প্রফেসর এম. শামসুল হককে চেয়ারম্যান করে ৫৬ সদস্যের একটি শিক্ষা কমিশন গঠন করা হয়। বাস্তবধর্মী, গণমুখী ও গতিশীল শিক্ষানীতি প্রণয়নের লক্ষ্যে এই কমিটিটি কাজ শুরু করে। তারা দেশের জন্য উপযোগী একটি শিক্ষা ব্যবস্থা তৈরির লক্ষ্যে সার্বিক চেষ্টা চালিয়ে যায় এবং ১৯৯৭ সালে কমিশন রিপোর্ট প্রদান করে। এই রিপোর্টের আলোকেই পাশ হয় ‘জাতীয় শিক্ষানীতি–২০০০’। এ সময়ের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের একটি মহল ইসলামি শিক্ষাকে ধ্বংসের পাঁয়তারা শুরু করে। দশম শ্রেণির ১০টি সাবজেক্টের সবগুলোকে অক্ষুণ্ণ রেখে তারা হাত দেয় ‘ইসলামি শিক্ষা’র প্রতি। ১০০ নম্বরের ইসলামি শিক্ষাকে ৫০ নম্বরে সঙ্কুচিত করার হীন প্রয়াস শুরু করে। কিন্তু এদেশের ধর্মপ্রাণ জনগণের প্রতিবাদে তারা সেটা বাস্তবায়ন করতে পারেনি।

এরপর ২০০১ সালে ড. এম এ বারীর নেতৃত্বে একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করা হয় যার উদ্দেশ্য ছিল শিক্ষাক্ষেত্রে বাস্তবায়নযোগ্য সংস্কার চিহ্নিত করা। শিক্ষাক্ষেত্রে সংস্কার ও পরিবর্তনের সুপারিশ করে ২০০২ সালে তারা রিপোর্ট প্রদান করে। এম.এ বারী শিক্ষা কমিশনের সুপারিশ বিবেচনায় নিয়ে ২০০৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভাইস চ্যান্সেলর প্রফেসর মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান মিয়ার নেতৃত্বে একটি শিক্ষা কমিশন গঠিত হয়। শিক্ষার মানোন্নয়ন এবং শিক্ষাক্ষেত্রে সংস্কার সাধনের উপায় বের করা ছিল যার উদ্দেশ্য। ২০০৪ সালের মার্চ মাসে এই কমিশন সরকারের কাছে রিপোর্ট প্রদান করে। সাধারণ শিক্ষা, পেশাগত শিক্ষা, বিশেষায়িত শিক্ষা— তিন ভাগে বিভক্ত এই রিপোর্টে সর্বমোট ৮৮০ টি সুপারিশ উত্থাপন করা হয়।

স্বাধীনতার পর উল্লেখিত শিক্ষা কমিশন ও কমিটি সমূহ গঠিত হলেও ২০০০ সালের জাতীয় শিক্ষানীতি ছাড়া কোন শিক্ষানীতি প্রবর্তিত হয়নি। তবে সেটিও ২০০১ সালের পর আর বাস্তবায়িত হয়নি। বাস্তবায়িত না হওয়া ২০০০ সালের জাতীয় শিক্ষানীতিকে যুগোপযোগী করে তোলার লক্ষ্যে ২০০৯ সালে অধ্যাপক কবির চৌধুরীকে চেয়ারম্যান ও ড. কাজী খলিকুজ্জমান আহমদকে কো-চেয়ারম্যান করে ১৮ সদস্যের একটি শিক্ষানীতি প্রণয়ন কমিশন গঠিত হয়। তারা ‘জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০’ নামে একটি খসড়া সরকারের নিকট আনুষ্ঠানিকভাবে প্রদান করেন এবং সরকার তা অনুমোদন করে বাস্তবায়ন করে। জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০ এ কুদরত-এ-খুদা শিক্ষা কমিশনের প্রস্তাবের প্রতিফলন দেখে এ দেশের জনগণ বিস্মিত না হলেও হতাশ হয়েছেন। ধর্মীয় মূল্যবোধ ও আদর্শিক নৈতিকতা থেকে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের দূরে সরিয়ে রেখে একটি ধর্মবিবর্জিত ‘ইহ-জাগতিক রাজনৈতিক পরিমণ্ডল’ তৈরির উপযোগী জনবল সৃষ্টিই হয়ে দাঁড়ায় এ শিক্ষানীতির অন্যতম উদ্দেশ্য। ইসলামি শিক্ষা নিয়ে তাদের ষড়যন্ত্র এখানে প্রকটভাবে প্রকাশ পায়। এই শিক্ষানীতি অনুসারে ২০১৩ সালে প্রণীত শিক্ষাক্রমে ‘ইসলাম শিক্ষা’ বইয়ের নাম পরিবর্তন করে নাম দেয়া হয় ‘ইসলাম ও নৈতিক শিক্ষা’। অথচ হিন্দুধর্ম শিক্ষা ও খ্রিস্টানধর্ম শিক্ষা বইতে এ রকম কোনো নাম দেয়া হলো না। এখানে প্রচ্ছন্নভাবে ‘ইসলাম ও নৈতিক শিক্ষা’ দুটো নামের মাঝখানে ‘ও’ অব্যয় দিয়ে দুটো ভিন্ন জিনিস বোঝানো হলো। আর উভয়ের মধ্যে বিরোধ আছে মর্মে একটি কারসাজির বীজ বপন করা হলো।

চলতি বছরের গত ৩০ মে ২০৪১ সাল পর্যন্ত শিক্ষার একটি রূপকল্প নিয়ে এবং শিক্ষাব্যবস্থায় বড় রকমের পরিবর্তন এনে পাশ হয় নতুন শিক্ষানীতি–২০২২। প্রাক-প্রাথমিক থেকে উচ্চমাধ্যমিক স্তরের নতুন শিক্ষাক্রমের রূপরেখার আনুষ্ঠানিক অনুমোদন দেওয়া হয় এতে। নতুন এই শিক্ষাক্রমে এখনকার মতো এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষা হবে না। শুধু দশম শ্রেণির পাঠ্যসূচির ভিত্তি করে হবে এসএসসি পরীক্ষা। একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণিতে দুটি পাবলিক পরীক্ষা হবে। প্রতি বর্ষ শেষে বোর্ডের অধীনে এই পরীক্ষা হবে। এরপর এই দুই পরীক্ষার ফলের সমন্বয়ে এইচএসসির চূড়ান্ত ফল প্রকাশ করা হবে। এ ছাড়া নতুন শিক্ষাক্রমে এখন থেকে শিক্ষার্থীরা দশম শ্রেণি পর্যন্ত অভিন্ন সিলেবাসে পড়বে। আর শিক্ষার্থী বিজ্ঞান, মানবিক না বাণিজ্য বিভাগে পড়বে, সেই বিভাজন হবে একাদশ শ্রেণিতে গিয়ে।

নতুন শিক্ষাক্রমে প্রাক-প্রাথমিক থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত ১০ ধরনের শেখার ক্ষেত্র ঠিক করা হয়েছে। এগুলো হলো ভাষা ও যোগাযোগ, গণিত ও যুক্তি, জীবন ও জীবিকা, সমাজ ও বিশ্ব নাগরিকত্ব, পরিবেশ ও জলবায়ু, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি, শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য এবং সুরক্ষা, মূল্যবোধ ও নৈতিকতা এবং শিল্প ও সংস্কৃতি। প্রাক-প্রাথমিকের শিশুদের জন্য আলাদা বই থাকবে না, শিক্ষকেরাই শেখাবেন। বরাবরের মতো দুষ্টচক্রটির চূড়ান্ত পদক্ষেপ ছিল ধর্মীয় শিক্ষাকে পাঠ্যসূচি থেকে স্থায়ীভাবে বাদ দেয়া। চক্রটি এ পর্যায়ে এসে উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে শতভাগ সফল হয়। বর্তমানে ২০২২ সালের নতুন শিক্ষাক্রমের সিলেবাস থেকে ‘ইসলাম ও নৈতিক শিক্ষা’কে বাদ দিয়েই তবে ক্ষান্ত হয়।

একটি জাতীয় শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে ওঠে সে জাতির সমাজ-সংস্কৃতি, বোধ-বিশ্বাস এবং বাস্তবতা ও প্রয়োজনবোধের ওপর ভিত্তি করে। তবেই সে শিক্ষাব্যবস্থা জাতির জাগতিক ও আধ্যাত্মিক উন্নতির আদর্শ সোপান হিসেবে কাজে আসে। পক্ষান্তরে স্বজাতির প্রয়োজন ও বাস্তবতাকে পাশ কাটিয়ে শিক্ষাব্যবস্থায় ভিন্ন কোন জাতির অনুকরণ করা এবং জাতে ওঠার কসরত চালিয়ে যাওয়া— হীনমন্যতা ও মানসিক দাসত্বেরই প্রকাশ ঘটে। এ ধরনের শিক্ষা জাতির বৃহৎ কোন কল্যাণ বয়ে আনতে পারে না। আমরা আশ্চর্যভাবে লক্ষ করছি, দুইশো বছর পূর্বে লর্ড মেকলে সহ বিদেশি ইংরেজরা যা করতে পারেননি স্বাধীনতা পর ‘দেশীয় ইংরেজরা’ সেই কাজ করে দেখালেন সফলভাবে। কিন্তু চরম সত্য হল, জাতির বাস্তবতা ও ধর্মীয় মূল্যবোধকে আমলে নিয়ে শিক্ষাব্যবস্থায় সংশোধনী না আনলে সেদিন বেশি দূরে নয় যখন ধর্ম, জীবন ও সমাজবিমুখ একটি প্রজন্ম তৈরি হবে। যারা জাতির ধ্বংস ডেকে আনার জন্য যথেষ্ট হবে।

এক নজরে শিক্ষা কমিশন সমূহ

বৃটিশ আমল :

১. লর্ড ম্যাকল-এর নিম্নগামী পরিস্রবণ বা ‘চুইয়ে পড়া শিক্ষানীতি’–১৮১৩
২. উইলিয়াম অ্যাডাম শিক্ষা কমিশন–১৮৩৫
৩. উড-এর ডেসপ্যাচ–১৮৫৪
৪. উইলিয়ম হান্টার শিক্ষা কমিশন–১৮৮২
৫. লর্ড কার্জন-এর শিক্ষা সংস্কার সম্মেলন–১৯০১
৬. মাইকেল স্যাডলার কমিশন–১৯১৭
৭. সার্জেন্ট কমিশন–১৯৪৪

পাকিস্তান আমল :

১. মওলানা মুহাম্মদ আকরাম খাঁ শিক্ষা কমিশন–১৯৪৯
২. আতাউর রহমান খান শিক্ষা কমিশন–১৯৫৭
৩. এসএম শরীফ শিক্ষা কমিশন–১৯৫৮
৪. হামিদুর রহমান ছাত্র সমস্যা ও ছাত্রকল্যাণ বিষয়ক কমিশন–১৯৬৪
৫. নূর খান শিক্ষা কমিশন–১৯৬৯

বাংলাদেশ আমল :

১. কুদরাত-ই-খুদা শিক্ষা কমিশন–১৯৭২
২. জাতীয় কারিকুলাম ও সিলেবাস প্রণয়ন কমিটি–১৯৭৬
৩. জাতীয় শিক্ষা উপদেষ্টা কমিটি–১৯৭৮
৪. মজিদ খান শিক্ষা কমিশন–১৯৮৩
৫. মফিজউদ্দীন আহমদ শিক্ষা কমিশন–১৯৮৭
৬. শামসুল হক শিক্ষা কমিশন–১৯৯৭ ও জাতীয় শিক্ষানীতি–২০০০
৭. এম.এ বারী শিক্ষা কমিশন–২০০১
৮. মনিরুজ্জামান মিয়া শিক্ষা কমিশন–২০০৩
৯. কবির চৌধুরী শিক্ষা কমিশন–২০০৯ ও জাতীয় শিক্ষানীতি–২০১০
১০. জাতীয় শিক্ষানীতি–২০২২ ও রূপকল্প–২০৪১

তথ্যসূত্র 

১. Zastoupil, L. and Moir, M. (eds.) The Great Indian Education Debate: Documents Relating to the Orientalist-Anglicist Controversy, 1781–1843. Richmond, 1999, p 193
২. উনিশ শতকের বাংলার শিক্ষায় বৃটিশ উদ্যোগ : ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া, ড. শোয়াইব জিবরান।
৩. যুগে যুগে শিক্ষা কমিশন ও শিক্ষার উত্তরণ, মোহাম্মদ ইলিয়াস আলী, জাগরণী প্রকাশনী, ঢাকা।
৪. Proceedings of the Pakistan Education Conference held at Karachi from 27 November to 1st December 1947, Education Division, Government of Pakistan, p.29
৫. ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশে শিক্ষা পরিকল্পনা ও বিভিন্ন শিক্ষা কমিশনের সুপারিশ, স্কুল অব এডুকেশন (পৃষ্ঠা ১–৩০)
৬. বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থার সংক্ষিপ্ত ইতিহাস, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় (পৃষ্ঠা ১–৩০)
৭. পূর্ব পাকিস্তানের প্রাথমিক শিক্ষা ১৯৪৭–‘৭১: সরকারের ভূমিকা, ড. মোছা. খোদেজা খাতুন
৮. History of abduction in India, Tripura University. P. 37–98
৯. বিভিন্ন শিক্ষা কমিশনের রিপোর্ট
১০. জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০, পর্যালোচনা মন্তব্য ও পরামর্শ, বাংলাদেশ আদর্শ শিক্ষক পরিষদ, ঢাকা, ৬ ডিসেম্বর ২০১০, পৃ. ৪, ১৬
১২. প্রথম আলো, ৩০ মে ২০২২
১২. ইনকিলাব, ১১ জুন ২০২২

১৩. নয়া দিগন্ত ২০ জুন ২০২২

 

আগের সংবাদ১১৬ আলেমের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান হচ্ছে না: দুদক সচিব
পরবর্তি সংবাদপদ্মা সেতুর দুয়ার খুললো