রাকিবুল হাসান নাঈম:
মুঠোফোনে মুফতি আমিনী রহ.-এর প্রসঙ্গ তুলতেই তিনি আবেগকাতর হয়ে পড়লেন। ধরা গলায় বললেন, ‘হুজুরের জীবনের শেষ পাঁচ বছর আমি তার খাদেম ছিলাম। তিনি যেখানেই যেতেন, আমাকে সঙ্গে নিয়ে যেতেন। রাজনৈতিক কর্মসূচি-মিটিং, মাহফিল-বয়ান সর্বত্র আমি তাকে ছায়ার মতো অনুসরণ করতাম। হাজারো স্মৃতি আমার বুকের তশতরিতে জমা আছে।’
মুফতি আমিনী রহ. চলে যাওয়ার দশ বছর পার হলো। সময়ের হিসেবে দশ বছর নেহাত কম নয়। এমন উথাল-পাতাল দশকে কতকিছু মুছে যায়, মানুষ কতজনকে ভুলে যায়। কিন্তু মুফতি আমিনী রহ.-এর স্মরণ এখনও আমাদের মনে জাগরূক। তার চলে যাওয়ার দিনে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমজুড়ে স্মৃতির যে মহড়া, তা থেকেই স্পষ্ট। এই দিনে মুঠোফোনে আলাপ তুলেছিলাম মুফতি আমিনী রহ.-এর দীর্ঘ পাঁচ বছরের একান্ত খাদেম মাওলানা আল-আমীন আজাদের কাছে। তিনি এখন শারিফুল উলুম মাদরাসার সিনিয়র উস্তাদ ও আমলীগোলা শাহী মসজিদের ইমাম ও খতিব। তিনি বললেন, ‘দশ বছর গুণলে অনেক মনে হয়। কিন্তু স্মৃতির দিকে তাকালে মনে হয়, সবকিছু বোধহয় কদিন আগেরই দৃশ্য। কোনো দৃশ্য এতটুকু মলিন হয়নি।’
আগে উবুদিয়াত, পরে খেলাফত
মাওলানা আল আমীন বলেন, ‘১৯৮১ সাল পর্যন্ত হাফেজ্জি হুজুরের হাত ধরে রাজনীতিতে নামার আগ পর্যন্ত হুজুর ছিলেন শুধুই শিক্ষক। ছাত্র গড়ার পেছনে ব্যয় হতো তার সবটুকু সময়। হাফেজ্জি হুজুর যখন রাজনীতিতে নামেন, মুফতি আমিনী রহ. তার সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেছিলেন। বলেছিলেন, আপনার উচিত শিক্ষা নিয়ে থাকা। কিন্তু হাফেজ্জি হুজুর তাকে বিভিন্ন যুক্তি দিয়ে বুঝিয়েছিলেন, কেন তাকে রাজনীতিতে নামতে হবে। আমিনী রহ.-ও রাজনীতি না করার পক্ষে যুক্তি দিয়েছিলেন।
একবার মুফতি আমিনী রহ.-এর সঙ্গে নূরিয়া মাদরাসায় এক মাহফিলে গেলাম। সেদিন মাহফিলে হুজুর বলেছিলেন, ‘খেলাফতের মানদণ্ড হচ্ছে উবুদিয়্যাত। হাফেজ্জি হুজুর রহ. আগে ইবাদত-বন্দেগি করে আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করেছেন। পরে রাজনীতিতে নেমেছেন খেলাফত প্রতিষ্ঠার জন্য।’ আমি বলতে পারি, আমিনী রহ. আগে ইবাদত-বন্দেগি করে আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করেছেন। পরে রাজনীতিতে নেমেছে। ফলে তিনি নীতিবিচ্যুত হননি। সবকিছুতে আল্লাহর স্মরণকে সর্বাগ্রে রেখেছেন।’
হুজুরের তখন বিভিন্ন জায়গায় মাহফিলে যেতে হতো। আমি সঙ্গে যেতাম। দেখা যেতো, একদিন চট্রগ্রাম থেকে ফিরে পরদিন যেতে হচ্ছে বরিশাল। বরিশাল থেকে ফিরে যেতে হচ্ছে পঞ্চগড়। বেশ ধকল হয়ে যেতো। একদিন হুজুরের জামাই মুফতি সাখাওয়াত রাজি সাহেব হুজুরকে বললেন, আব্বা, টাইম শিডিউল করে নিলে মনে হয় ভালো হতো। নির্দিষ্ট করে নিতে পারেন, এই দুই সপ্তাহ চট্টগ্রামে মাহফিল করবেন। যারা করাতে চায়, এ দুই সপ্তাহে করাতে হবে। পরে দুই সপ্তাহ অন্য জেলায়। এমন করলে ধকল কম হতো।’ হুজুর বললেন, ‘একটা জিনিস মনে রাখবা, আমার মূল মাহফিল না, মূল হলো দরস-তাদরিস।’
গভীর অধ্যয়ন
মাওলানা আল আমীন বলেন, ‘আমি যখন হুজুরকে পেয়েছি, তখন হুজুর স্ট্রোকের রোগী। তখন তার পান খাওয়া নিষেধ, রাত জাগা নিষেধ। কিন্তু এমন সময়েও বই পড়ার প্রতি তার এত গভীর মনোযোগ দেখেছি, তা ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। বড় কাটারা থেকে লালাবাগ আসতে কতক্ষণের পথ? সর্বোচ্চ দেড় কিলোমিটার। হুজুর এইটুকু পথ আসতেও বই পড়তেন। হুজুরের গাড়িতে কিছু বই থাকতো। একটা নোটপ্যাড থাকতো। হুজুরে যেখানেই যেতেন, একখণ্ড ‘খুতুবাতে হাকিমুল উম্মত’ থাকতোই। খুব মন দিয়ে হুজুর বইটি পড়তেন। এমনও দেখেছি, বইটির এক পৃষ্ঠায় তিনি আধাঘণ্টা ধরে তাকিয়ে আছেন, ভাবছেন। তিনি বলতেন, ‘আকাবিররা হচ্ছেন আমাদের মূল।’ এই নীতি সবসময় অনুসরণ করতেন। কোনো কাজে আকাবিরদের রেফারেন্স খুঁজতেন। মাদরাসায় নিকটাত্মীয় কিংবা পরিচিতদের নিয়োগের ব্যাপারে হুজুর দ্বিধান্বিত ছিলেন। একদিন ইউসুফ বানুরির একটা কিতাব পড়তে গিয়ে তিনি উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠলেন। বললেন, ‘রেফারেন্স পেয়ে গেছি। ইউসুফ বানুরি বলেছেন, তিনিও পরিচিতদের মাদরাসায় নিয়োগ দিতেন। কারণ, পরিচিতদের মধ্যে মেজাজের মিল থাকে। ফলে মাদরাসার শৃঙ্খলাও সহজে বজায় থাকে। মাদরাসার কল্যাণে পরিচিতদের নিয়োগ দেয়া যেতে পারে।’ হুজুরের মুখে তখন হাসি ছিল। তার একটি কাজের রেফারেন্স আকাবিরদের কাছে পেয়েছেন বলে।
হুজুরের জীবনে যে এত সংগ্রাম, এত বয়ান, এত আয়োজন, সবকিছুর উপাদান ও প্রেরণা নিতেন বইপাঠ থেকে। পাঠের তালিকায় তার পছন্দের শীর্ষে ছিল সিরাত। একবার তাকে বলা হলো, ছাত্রমোর্চার একটি সিলেবাস করে দিতে। তিনি বললেন, আলাদা সিলেবাস কী দরকার। সিরাত পড়ো। হেকায়াতুস সাহাবা এবং হায়াতুস সাহাবা পড়ো। এগুলো থেকেই সবচে বড় আদর্শ পাবে।
হুজুরের রাতজাগা নিষেধ ছিল। কিন্তু তিনি তা তিনি উপেক্ষা করে বই পড়তেন। একদিন তিনি বড় কাটারা আসবেন। হুজুর যে রুমে থাকতেন, সেখানে বিছানা বিছিয়ে দিলাম। সেদিন হুজুর মাহফিল থেকে ফিরছিলেন। মাহফিল থেকে ফিরে কাপড়ও বদলাননি। ওই কাপড়েই পড়তে বসে গেলেন। রাত দেড়টা না দুইটায় গিয়ে দেখি তিনি পড়ছেনই। ঘুমাননি। পরে তিনি আরেকদিন এলেন। আমি বিছানা করতে গেলাম৷ তিনি আমাকে বললেন, ‘আজ বিছানা করিস না। বিছানা দেখলেই ঘুম আসে। আমাকে পড়তে হবে।’
নতুন কোনো বই প্রকাশিত হলে হুজুর বইটি সঙ্গে সঙ্গেই পড়ে ফেলতেন৷ আবুল হাসান আলী নদভির ‘তারিখে দাওয়াত ওয়া আজিমাত’ যখন প্রকাশিত হয়, সঙ্গে সঙ্গেই পড়ে ফেলেছিলেন। একবার হুজুরের এক ছাত্র হুজুরের জন্য একটি বই হাদিয়া নিয়ে এলো। হুজুর তখন গোসল করতে যাচ্ছিলেন। জুমার দিন। কাঁধে লুঙ্গি-গামছা। হুজুর ওই অবস্থাতেই বইটি নিয়ে পড়া শুরু করলেন। জুমার আজানা হলো, বয়ান শুরু হলো, হুজুর বইটি পড়ছিলেনই। এমন মনোনিবেশ ছিল তার বইপড়ায়।
গাড়িতে থাকলে রাতে বই পড়তে পারতেন না। তখন তিনি তাসবিহ পড়তেন। কিংবা আমকে বলতেন, কুরআন শোনানোর জন্য।
আল্লাহর দিকে রুজু
যাপিত জীবনে তিনি যে সিদ্ধান্ত নিতেন, চাই সেটা রাজনৈতিক হোক কিংবা অরাজনৈতিক, সেটা আল্লাহর কাছে আগে নিবেদন করতেন। কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচি দিয়ে তিনি টানা রোজা রাখা শুরু করতেন। আল আমীন বলেন, তিনি সর্বশেষ যে হরতাল করেছিলেন, ২০১১ সালের ৪ এপ্রিল, তার একমাস আগে থেকেই তিনি টানা রোজা রাখা শুরু করেছিলেন। আমাকে বলেছিলেন, আমি যেন তার রুমের সামনে দফতরে ঘুমাই। সাহিরর সময় হলে আমি বাসা থেকে খাবার এনে তাকে জাগিয়ে দিতাম। কখনও কখনও আমি জাগতে পারতাম না, তিনি আমাকে জাগিয়ে দিতেন।
দেখা যেতো, গভীর রাতে মাহফিল থেকে এসেছেন। এসেই শাহি মসজিদের বারান্দায় নামাজে দাঁড়িয়ে গেছেন। নামাজ শেষে তিনি দোয়া করতেন, কান্না করতেন। দোআ করে অনেক সমস্যা সমাধান করতেন। তখন বড় কাটারা মাদরাসায় একটা সমস্যা চলছিল। হুজুর কেবল দোআর মাধ্যমে তা সমাধান করেছিলেন। তখন একদিন রাত তিনটায় দেখি হুজুরের রুম থেকে কান্নার শব্দ আসছে। তাকিয়ে দেখি হুজুর কান্না করছেন। বলছেন, ‘হে আল্লাহ, এই জাতিকে মাফ করে দাও। তাদেরকে হেদায়াত দিয়ে দাও।’ এভাবে দেড় থেকে দুই ঘণ্টা কেবল কান্নাই করেছেন।
মাওলানা আল আমীন বলেন, ‘হুজুরের আত্মবিশ্বাস ছিল খুব। যেকোনো কাজই করতেন, আত্মবিশ্বাস নিয়ে করতেন। রাজনৈতিক কোনো কর্মসূচি দিবেন, তার জন্য তো ফান্ড দরকার। তিনি নিজের টুপি খুলে মজলিসে উপস্থিত লোকদের সামনে বাড়িয়ে দিতেন। যার পকেটে যা আছে, তাই দিয়ে সবাই শরীক হতো। বারো-তেরোশ যাই হতো, তিনি তা সামনে রেখে দোয়া করতেন, হে আল্লাহ, এই তোরোশ টাকা তুমি তেরো কোটি বানিয়ে দাও।’
শিক্ষক হিসেবে যেমন ছিলেন
মাওলানা আল আমীন বলেন, ‘আমি হুজুরের কাছে পুরো বুখারি শরীফ পড়েছি। দেখেছি, হুজুরের দরসে পারতে কেউ অনুপস্থিত থাকতো না। হুজুর শান্তকণ্ঠে দরস দিতেন। মনেই হতো না, এই মানুষটি রাজনীতির ময়দানে এমন ভয়ংকর হুংকার দিয়ে সিংহাসনে কাঁপন ধরিয়ে দেন। তিনি দীর্ঘ তাকরির করতেন না, করতেন খুব সংক্ষিপ্ত। তারপর বলতেন, ‘কথা সামান্য। কিন্তু এটা আমার হাজার পৃষ্ঠা পড়াশোনার ফল।’ হুজুরের দরসে ইবারত পড়তে হতো খুব সুন্দর করে। সাধারণত অন্যান্য দরসে আমরা ইবারত পড়তাম ৩৬ জন। কিন্তু হুজুরের দরসে ইবারত পড়তাম মাত্র ১৫ জন। তাও কারও পড়া পছন্দ না হলে হুজুর বলতেন, ব্যাস। তখন অন্যজন পড়া শুরু করতো।
তিনি ছাত্রদের শাসন করা জানতেন। বেত হাতে নিতেন না। কিন্তু সবাই তাকে ভয় পেতো। একবার কিছু ছাত্র ক্রিকেট খেলা দেখতে গেলো। হুজুর বললেন, ‘ইলম এবং ক্রিকেটের নেশা একসঙ্গে হতে পারে না। সুতরাং, যারা খেলা দেখতে গেছে, তাদেরকে আমি বহিষ্কার করে দিব।’ হুজুরের কথা শুনে সবাই ভয়ে শেষ। মেধাবী একজন ছাত্র হুজুরের কাছে গেলো। হুজুর বললেন, ‘কী জন্য এসেছো?’ ছাত্রটি বললো, হুজুর খেলা দেখতে গেছিলাম। হুজুর তখন সঙ্গে সঙ্গে বললেন, ‘আর কখনও এমন করবে না। যাও।’ আমরা তো অবাক। এতক্ষণ কেমন রাগ দেখালেন, এখন যেন সব পানি।
ছাত্রদের অভিযোগ শুনতেন এবং মূল্যায়ন করতেন তিনি। একবার ছাত্ররা তার কাছে অভিযোগ জানালো, অমুক হুজুরের পড়া আমরা বুঝি না। আমাদেরকে যদি শিক্ষক বদলে দেয়া হতো ভালো হতো। হুজুর কথাগুলো শুনলেন, তদন্ত করে দেখলেন, ছাত্রদের অভিযোগ সঠিক। তখন তিনি নতুন শিক্ষক নিয়োগ দিলেন।
অনেকেই খাদেম দ্বারা প্রভাবিত হন। হুজুর কখনই প্রভাবিত হতেন না। খাদেম বলে স্বজনপ্রীতি দেখাতেন না। একবার বড় কাটারা মাদরাসায় জেনারেটর আনা হলো। কিন্তু সেটি চালু করা হচ্ছিল না। আমি আরও কয়েকজন ছাত্র দুষ্টুমি করে মানববন্ধন করলাম মাদরাসার ভেতর। তখন বাংলাদেশের পরিস্থিতিই এমন ছিল, কিছু হলেই মানববন্ধন। এক হুজুর মুফতি আমিনী রহ.-এর কাছে বিচার দিল। হুজুর মাদরাসার ছাত্রদের ডাকলেন। তাদেরকে জিজ্ঞাসাবাদ করলেন। জিজ্ঞাসাবাদে আমার নাম উঠে এল। হুজুর তো রেগে তখন আগুন। সে আমার কাছে থেকে এমন করবে! আমি তখন তরজুমানে ইসলামের অফিসে বসে ছিলাম লালবাগ চৌরাস্তায়। পত্রিকাটি তখন সম্পাদনা করতেন তামিম রায়হান। সেখান থেকে আমাকে ডেকে আনা হলো। মুফতি তৈয়ব সাহেবও বললেন, ‘এটা এমনিতেই হয়েছে। মাদরাসা বিরোধী কিছু না। দুষ্টুমি।’ কিন্তু হুজুর তবুও রাগ করলেন। নামাজ এবং দোআর পর হুজুরের মন নরম থাকতো। সেদিন নামাজের পর হুজুরের কাছে গিয়ে অনেক কাকুতি-মিনতি করে বিষয়টির সুরাহা করেছিলাম।
হুজুরের মাফহিলের প্রোগ্রাম রাখতেন মাওলানা আহলুল্লাহ ওয়াসেল রহ.। এই দায়িত্ব হুজুর কখনও খাদেমের হাতে দেননি। খাদেমকে দিয়ে কাপড়ও ধোয়াতেন না। হুজুরের সব কাপড় লন্ড্রিতে চলে যেতো।
তবুও টানতে হয় ইতি
আমাদের কথা বাড়তেই থাকে। যেন শেষ হবার নয়। তবুও শেষ করতে হয়। গলাটা ভারী হয়ে আসে মাওলানা আল আমীন আজাদের। তিনি বলেন, ‘একের পর এক স্মৃতি কেবল মনেই পড়ছে। আজকাল বক্তাদের টাকা-পয়সা নিয়ে কতকিছু হয়। কিন্তু মুফতি আমিনী রহ. এতদূর মাহফিলে যেতেন, কখনও কখনও টাকা পেতেন না। অভিযোগও করতেন না। একবার আমরা সিলেটা গোয়াইনঘাট গেলাম। দুই গাড়িতে আমরা এগারো জন। পরদিন হরতাল ছিল। তাই আমরা একদিন অগেই চলে যাই। মাহফিল শেষ হবার পর আয়োজকদের আর দেখা নাই। হুজুর বুঝে গেলেন, তারা টাকা দিতে চাচ্ছে না। আর কিছু বললেন না। শুধু এতটুকু বললেন, সমস্যা নেই, চলো।’
আমরা কথার ইতি টানি। মাগরিবের আজান পড়ে। ফোন রেখে মসজিদের দিকে পা বাড়াই।