একুশে বইমেলায় ইসলামি প্রকাশনীগুলো কেন স্টল বরাদ্দ পায় না?

রাকিবুল হাসান নাঈম:

রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের স্মৃতিজড়িত ফেব্রুয়ারির প্রথম দিন ২০২৩ সালের অমর একুশে বইমেলা শুরু করতে যাচ্ছে বাংলা একাডেমি। করোনা অতিমারির কারণে গত দুটি বইমেলা ঐতিহ্যবাহী রীতি অনুসারে ফেব্রুয়ারির প্রথম দিন শুরু হতে পারেনি। এবার মেলার মূল প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে ‘পড় বই গড় দেশ, বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ’।

বইমেলার স্টল বরাদ্দের আবেদন গ্রহণ শুরু হয়েছিল ৬ ডিসেম্বর, যা শেষ হয়েছে ২০ ডিসেম্বর। ৪৫৩টি প্রতিষ্ঠান আবেদন করেছে। স্টল নং নির্ধারিত না হলেও কে কতটি স্টল পাবে, তা বরাদ্দ দেওয়া দেয়া হয়েছে। এরমধ্যে ইসলামি প্রকাশনীর সংখ্যা নিতান্তই হাতেগোণা। তালিকা পর্যবেক্ষণ করে দেখা গেছে, ইসলামি প্রকাশনীগুলোর মধ্যে স্টল বরাদ্দ পেয়েছে রাহনুমা প্রকাশনী, হুদহুদ প্রকাশন, সন্দ্বীপন প্রকাশন, বইঘর, বিশ্বকল্যান পাবলিকেশন্স এবং বাড কম্প্রিন্ট এন্ড পাবলিকেশন্স। তারা গত বছরও স্টল বরাদ্দ পেয়েছিল। নতুন কোনো ইসলামি প্রকাশনী এবার বরাদ্দ পায়নি এখন পর্যন্ত।

কেন বাতিল জানা যায় না কারণ

প্রতি বছরই অনেক ইসলামি প্রকাশনী স্টল বরাদ্দ চেয়ে আবেদন জানায়। কিন্তু স্টল বরাদ্দ পায় না। এমনকি কী কারণে স্টল বরাদ্দ পেলো না, তার কারণও জানতে পারে না প্রকাশনী কর্তৃপক্ষ। কারণ না জেনেই প্রতি বছর অবেদন করতে হচ্ছে তাদের। এদের মধ্যে অন্যতম একটি প্রকাশনী হলো গার্ডিয়ান পাবিলিকেশন্স।

এ প্রসঙ্গে কথা হয় গার্ডিয়ান পাবিলিকেশন্সের জিএম নাজমুল হুদার সঙ্গে। তিনি ফাতেহকে বলেন, ‘গত কয়েক বছর ধরেই আমরা স্টল বরাদ্দের আবেদন করে আসছি। ইতোমধ্যে আমাদের বইয়ের সংখ্যা ১৩০। এরমধ্যে চলতি বছরই প্রকাশ করেছি ৩৩টি বই। কিন্তু অন্যবারের মতো এবারও আমরা স্টল বরাদ্দ পাইনি।’

কেন বারবার রিজেক্ট হচ্ছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমাদের জানামতে আমরা সমস্ত প্রয়োজনীয় ডকুমেন্টসহই আবেদন করেছি। কিন্তু কেন বরাদ্দ দেয়া হচ্ছে না, তা জানতে পারিনি। জানার কোনো মাধ্যমও নেই। বাংলা একেডেমি কাকে কেন রিজক্টে করা হচ্ছে, তার কোনো ব্যাখ্যা দেয় না। এই ব্যাখ্যা না জানলেও প্রতিবছর আবেদন করে যাচ্ছি। সামনেও আবেদন করে যাব।’

তিনি আরও বলেন, ‘তবে এটা নিয়ে আমরা তেমন চিন্তিত নই। কারণ, আমরা বিশ্বাস করি, আমরা যদি ভালো কন্টেন্ট দেই, তাহলে মানুষ পড়বে। সারা বছরই আমাদের বই বিক্রি হয়। এতটুকু সত্য, একুশে বইমেলায় স্টল পেলে আমাদের আরও প্রচার-প্রসার হতো। তবে সেটা যেহেতু হচ্ছে না, কেন হচ্ছে না সেটাও যেহেতু জানতে পারছি না, তাই বিষয়টি নিয়ে অতটা চিন্তিত নই।’

কেন পাচ্ছে না স্টল?

গত কয়েক বছর ধরেই একুশে বইমেলায় স্টল পেয়ে থাকে বিশ্বকল্যান পাবলিকেশন্স। এর কর্ণধার মুহাম্মদ সাইফুল ইসলামের সঙ্গে কথা হয় প্রতিবেদকের। তার কাছে জানতে চাই, অনেকে বলে বাংলা একাডেমি কর্তৃপক্ষ ইসলামি প্রকাশকদের স্টল দেয় না। অথচ আপনি সবসময় মেলায় স্টল পাচ্ছেন। এর পেছনে সবচে বড় ভূমিকা কোন জিনিসের? তিনি ফাতেহকে বলেন, ‘আমরা নিজেদের যোগ্যতাবলে স্টল বরাদ্দ পাই, কারও দয়ায় পাই না। আমাদের কন্টেন্ট দেখেন, বুঝতে পারবেন। আমরা সমাজের মূল স্রোতের সাথে মেশার চেষ্টা করি। দেশের ও দশের কথা বলি। বাংলায় কথা বলি। ইসলামি প্রকাশনীগুলো বাংলা একাডেমিতে যায়ই না। বই মেলায় স্টল পাওয়ার জন্য তারা আবেদনই করে না। তারা মিথ্যাচার করছে যে, বাংলা একাডেমি ইসলামি প্রকাশনাগুলোকে স্টল দেয় না। বাংলা একাডেমির ডিজিসহ আরো উর্ধতন কর্মকর্তাদের সাথে আমি নিজে কথা বলেছি, তাদেরকে আমার অনেক ধর্মপরায়ণ মনে হয়েছে। গত বছর পর্যন্ত বাংলা একাডেমির সচিব ও বই মেলার দায়িত্বে ছিলেন জালাল আহমেদ। তিনি পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়েন। এ বছর তিনি রিটায়ার্ড হয়েছেন। ‘

অনেকে আবেদন করে। তবুও স্টল পায় না। কেন পায় না? মুহাম্মদ সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘একটু খতিয়ে দেখুন, তাদের কোনো ট্রেড লাইসেন্সই হয়তো নেই। তারা সরকারকে ঠিক মতো ট্যাক্সও দেয় না। বইতে হাজার হাজার বানান ভুল এবং মনমতো অনুবাদ প্রকাশ করেন তারা। লেখকের সাথে ঝামেলা তো বেধেই থাকে। এমনকি প্রকাশনাগত কোনো আইনও তারা মানেন না। বাংলা ভাষা বাদ দিয়ে উর্দূ নাম দিয়ে যারা বই প্রকাশ করেন, বাংলা একাডেমি কেন তাদের স্টলের জায়গা দেবে! তাদেরকে যে এখনও এই ব্যবসা করতে দিচ্ছে এটাই তো কপাল। বই মেলাতে ইসলামি প্রকাশনীগুলো স্টল না পাওয়ার পিছনে দায়ী তারাই। এর বাহিরে আর আমি কিছুই মনে করি না।’

এবার স্টল পেয়েছে সন্দ্বীপন প্রকাশন। যারা স্টল পাচ্ছে না কেন পাচ্ছে না জানতে চাইলে এর কর্ণধার রুকনুদ্দিন ফাতেহকে বলেন, ‘আমাদের প্রকাশকরা প্রফেশনাল না। অনেকে আবেদন করে ঠিক। কিন্তু দেখা যায়, তাদের ট্রেড লাইসেন্স নবায়ন করা নেই। সরকারের টেক্স পরিশোধ করা নেই ঠিকমতো। ফলে আবেদন একাডেমি গ্রহণই করে না।’

আবেদনের প্রস্তুতি নিচ্ছে কেউ কেউ

এতবছর আবেদন করেনি। তবে সামনে বছর বইমেলায় স্টল বরাদ্দের জন্য আবেদন করবে মুহাম্মদ পাবলিকেশন। এর কর্ণধার মুহাম্মদ আব্দুল্লাহ খান ফাতেহকে বলেন, ‘বইমেলায় স্টল বরাদ্দের আবেদন করার জন্য সমস্ত ডকুমেন্টস আমাদের আছে। তবুও আবেদন করিনি।’ কেন করেননি জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমাদের দৃষ্টিতে শর্ত পূর্ণ হলেই হবে না, একাডেমি কর্তৃপক্ষের দৃষ্টিতেও সেটা পূর্ণ লাগতে হবে। তাদের দৃষ্টিতে পূর্ণ না হলে হবে না।’ একডেমিক শর্তের বাইরে ‘কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি’ জিনিসটা কী খোলাসা করেননি তিনি।

তবে বিষয়টি তিনি খোলাসা না করলেও নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক প্রকাশক দাবি করেছেন, ‘স্ট্রং লবিং ছাড়া একুশে বইমেলায় স্টল বরাদ্দ পাওয়া যায় না। দেখা যাচ্ছে, সব শর্ত প্রকাশনী পূর্ণ করেছে, কিন্তু লবিং না থাকার কারণে প্রকাশনী স্টল বরাদ্দ পাচ্ছে না।’

এ প্রসঙ্গে কথা হয় একাডেমির পরিচালক (প্রশাসন) ও মেলা কমিটির সদস্যসচিব কে এম মুজাহিদুল ইসলামের সঙ্গে। ইসলামি প্রকাশনীগুলো একাডেমির মেলায় কেন বরাদ্দ পায় না জানতে চাইলে ফাতেহকে তিনি বলেন, ‘স্টল বরাদ্দ পায় না ভুল কথা। বরাদ্দ পায় তারাই, যারা শর্ত মেনে আবেদন করে। শর্ত পূরণ না করলে আবেদন গ্রহণ করা হয় না। এছাড়া বাংলা একাডেমি তাদেরকে স্টল না দেয়ার অন্য কোনো কারণ থাকতে পারে না। ইসলামিক-ননইসলামিক ধরনের বৈষম্য বাংলা একাডেমি সৃষ্টি করে না, ধর্মভিত্তিক বিভাজন হিসেবেও বাংলা একাডেমি কাউকে স্টল দেয় না। বইয়ের গুণগত মান, ৫ বছরে কমপক্ষে নিজস্ব ৫০ টা বই এবং যে বছরে আবেদন করছে সে বছরে ২৫টা বই ছাপছে কি না তা দেখে। এ বিষয়গুলো তো আমরা দেখি না, বইমেলার জন্য আমাদের কমিটি আছে। সে কমিটিতে পুস্তক প্রকাশনা সমিতির সাধারণ সম্পাদক থাকে, প্রতিনিধি থাকে। সকলের মূল্যায়ন বিবেচনায় যে সমস্ত প্রকাশনাগুলোর নাম আসে তাদের স্টল দেয়া হয়।’

এতটুকু বলেই কথা সমাপ্ত করেন মেলা কমিটির সদস্যসচিব। এ প্রসঙ্গে আরও কথা বলার জন্য মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হয় মেলা কমিটির সদস্য সাহেদ মন্তাজের সঙ্গে। কিন্তু তিনি জানান, বইমেলা নিয়ে তিনি সঠিক তথ্য দিতে পারবেন না। যা বলার সদস্যসচিবই বলবেন। আর তিনি যদি বলে থাকেন কিছু, তার বাইরে আমার কোনো কথা নেই।

এবারের মেলাও হবে দুটি অংশে। বাংলা একাডেমির মাঠে থাকবে সরকারি–বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সংস্থার স্টল। সোহরাওয়ার্দী উদ্যান বরাদ্দ থাকবে প্রকাশকদের জন্য। উদ্যানের প্রায় ছয় লাখ বর্গফুট এলাকা নিয়ে হবে মেলার পরিসর। প্রকাশনার সব স্টল থাকবে স্বাধীনতাস্তম্ভের সামনে থেকে উদ্যানের পশ্চিম অংশে। শিশুদের বইয়ের কর্নার থাকবে মুক্তমঞ্চের কাছে। এই অংশে এবার অন্য কোনো স্টল থাকবে না। ফলে যারা শুধু বই কিনতে চান, তাদের আর পূর্ব–পশ্চিম দুই প্রান্ত ঘুরতে হবে না। পূর্ব প্রান্ত অর্থাৎ ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনের পাশের অংশে থাকবে খাবারের দোকান, মোড়ক উন্মোচন, লেখক বলছি মঞ্চ, নামাজের স্থান, শৌচাগার ও মেলার সহায়তাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর স্থাপনা। এবার মেলার ভেতরে ক্রেতাদের বসার জন্য পর্যাপ্ত ব্যবস্থা থাকবে। গাড়ি পার্কিং থাকবে ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন প্রান্তের প্রবেশপথের পাশে। এ ছাড়া এবার ক্রেতাদের সুবিধার্থে প্রবেশপথের সামনে বড় আকারের দুটি ডিজিটাল বোর্ডে মেলার দিকনির্দেশনা থাকবে। উপরন্তু প্রতি সারির সামনে স্টলের নম্বর ও প্রকাশকদের পরিচিতিসহ একটি করে ডিজিটাল বোর্ড বসানো হবে। এতে পছন্দের প্রকাশকদের স্টল খুঁজে পাওয়া সহজ হবে।

আগের সংবাদইসলাম ধর্মবিরোধী সিলেবাস বাতিলের দাবি ইসলামি ঐক্যজোটের
পরবর্তি সংবাদআগামী ১৪ মে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন