আতিক ফারুক:
এ বেলায় আর হবে না—ওভারব্রিজ পেরিয়ে নিরুদ্দেশ পথে পা বাড়িয়েছি। তখন সন্ধ্যার অনেকগুলো আকাশ বিষণ্ণ হয়ে আছে। ঝিরিঝিরি বৃষ্টিসন্ধ্যা মনে হতেই আমি ফিরে এলাম—এ বেলায় আর হবে না। নিরুদ্যম শূন্যতা পুঞ্জীভূত ধোঁয়াটে আলোকবিন্দুর পথে চেয়ে আছে। অনির্বাণ দীপালোকে কেবল ধোঁয়াশা—যেভাবে বেঁচে আছি, অন্তর্গত বেদনা লুকিয়ে রেখেছি বুকভরা স্বপ্নের সবুজ উদ্যানে।
দেখো, সারাটি দিন এক অস্ফুট স্বরে বলে এসেছি ‘ভালো লাগছে না’ ‘ভালো লাগছে না’ দূর জানালায় বহুদিন বৃষ্টি নামে না। নরোম মাটির সোঁদা গন্ধ নাকে এলে এক অদ্ভুত তৃপ্তি পাই। এমন সময় চোখজুড়ে শুধু অন্তহীন অরণ্য ভেসে উঠে—আমার নদী হয়ে যেতে ইচ্ছে করে; নদী হব জেনে একজন কৃষক খেতের আলপথ কেটে দিচ্ছে, যেন আমার পায়ের তলায় নদী এসে আছড়ে পড়ে।
আমি জেনেছিলাম অশনিসংকেত—তোমার ভেতরকার নানান জটিলতা। তবু, যদিও চলে এসো—আমি আমার মতো করে তোমাকে সাজিয়ে নিব, বলে রাখলাম। যেভাবে বলা হয়েছিল আত্মগত জীবনের সন্ধ্যায়। পরম প্রাপ্তিগুলো যখন বিকেলের হলুদ আলোয় ফুরিয়ে যাচ্ছিল৷
যে ভাঙাচোরা জীবনের আহ্বায়ক ছিলেন আমাদের ঘুমহীন রাত্রি—তারা আর ফেরে না সেইসব গলির ভেতর, আলোর ধুলো ওড়া দিনে। আমরা সমস্ত গ্লানি ঝেড়ে দুপুরের উদাসীন রোদ্দুরে ঘুমিয়ে থাকি মায়ের কোলে, যেখানে ঘুম হয়ে উঠে স্বর্গীয়।
যে ভাঙাচোরা জীবনের আহ্বায়ক ছিলেন আমার মা—আজ তিনি ভুলে গেছেন সন্তান লালনের উদ্বেগ, হাতের আঙুল চুষে খেয়ে নিচ্ছেন সর্ষে ফুলের মধু। জীবনের এই ভাঙাচোরা কিম্বা গড়া-ভাঙার আখ্যানে বহু বিপর্যয়, ইতিউতি হাঁটাহাঁটির শব্দ।
মেহেরুন—আমার মন খারাপের আকাশ জানে, আমি কতটা নতজানু হয়ে আছি মৌনমুখর সন্ধ্যায়—শৈবালে যেসব উদ্ভিদ জমে আছে তাদের ভেতর লিখে দিয়েছি তোমার নাম, ছুঁড়ে এসেছি তুমুল বিষণ্ণতা আর একরঙা জীবনের নানান কারচুপি গল্পের সারাংশ।
আজ শিমুল বাগান ঘুরে এলাম—একা, এতো পাতা পড়ে আছে সবুজ ঘাসে—এতো অপূর্ব সৌন্দর্য ঘিরে আছে এখানে, তা যদি তোমাকে দেখানো যেতো মেহেরুন। কখনো ভাবি, চলো পালাই—আবার ভাবি, আরেকটু অপেক্ষার প্রহর ফুরিয়ে যাবার পর তোমাকে সঙ্গী করে রাখি। না না, এ বেলায় আর হবে না বোধহয়। আমার যাতনা কেবল দীর্ঘায়িত হতে থাকে।
কিন্তু, যখন ঘুমোতে যাবার প্রস্তুতি নিতে যাই—তখন সমস্ত বিষাদ, একাকিত্ব তুলে রাখি বেডসাইড টেবিলে—টিকটিক ঘড়ির কাটায়। যেনবা আমার আয়ু ঘুমের বনে ফুরিয়ে গেল৷
তুমি ঘুমিয়ে গেলে আমি একা হয়ে যাই—আমি ঘুমিয়ে গেলে তুমি শীতার্ত ঘুঘু হয়ে যাও৷ এদিকটায় যেন খুব খুব নিঃসঙ্গতা, খুব খুব অবদমিত হাহাকার, এভাবে বারবার ঘুমিয়ে গেলে কিভাবে হয় মেহেরুন—এসো, আমরা জেগে থাকি চোখের সমুদ্রে। পরস্পরের চোখ পাঠ করে শ্রান্ত হয়ে যাই৷
তারপর, নিজেকে মুক্ত করতে হলে একটা কথা জানা দরকার—মন খুলে ভালোবাসো, যেন তোমাকে খুঁজে পায় অহর্নিশ হাওয়ার দল। ছাতিমের তলায় দেখে এসেছি মেহেরুন, বিষণ্ণ ময়ূর শুয়ে আছে যেন অবক্ষিপ্ত নীরবতায়।
এইযে ক্লান্তি ঝরে পড়েছে সমস্ত অবলোকনের গহিনে—তার কি মানে, তার কি কথা দুপুরের সাথে! এখানে বিস্ফুরিত হয়ে যাচ্ছে আবার, অনিমেষলোচনে তবু চেয়ে থাকি দীর্ঘ চুলের চাদরে।
কোথাও যেয়ো না—অশোক কাননে তোমাকে রেখে এলাম। তুমি তার কাছেই নিরাপদ আশ্রয়ে থেকো। আমার ফিরে আসার প্রতীক্ষায় চেয়ে থাকো সুদীর্ঘ মহাপ্রস্থানের দিকে। দৃশ্যের বাইরে যা ঘটে যায়, তা জানার আকুলতা নেই আমার৷ সব ঠিক হয়ে যাবে, সব আমার আনুকূল্যে—কিন্তু, আকাশ ফুরিয়ে গেলে ভীষণরকম একা হয়ে যাই।
কোনোদিন নিশ্চয়ই আমার টুকরো টুকরো হাহাকার চোখের জলে ভেসে যাবে। তপোবন আশ্রমের সেই বাগানবিলাসের মতোই আমার জীবন—যা শুকাতে শুকাতে শেষে মৃত্যু পথের যাত্রী হয়ে গেছে।
তুমি সুদূরবর্তী আকাশের মেঘে চেয়ে আছো—আমি চেয়ে আছি উদাসীন রোদ্দুরে, তুমুল মন খারাপের দিনে।
একদিন, সমস্ত সত্যগুলো তোমার সম্মুখে তুলো হয়ে উড়বে। সেদিন শিমুলবাগানে ফুটে উঠবে বহু পরাজয়ের স্মৃতি। একটি সরলরৈখিক জীবনের সমাপ্তি কেবল। ইথে তুমি এলে না, ইথে তুমি এলে না বলেই আকাশ তার স্বতঃস্ফূর্ততা বেচে দিয়েছে নীল মেঘের কাছে।
এদিকটায় যেন খুব রোদ ফুটেছে আজ। কেন তোমার ঘুম আসে এমন সময়—কেন তুমি অবহেলিত বসন্তবাউরির কোলে! মনে রেখো পাতাকুড়ানি, পাতার আয়ুকাল।
মেহেরিমা মেহেরুন শুধু জানে—কিভাবে পরিযায়ী পাখিদের ডানায় অজস্র চিঠি উড়ে আসে। সেই চিঠি পড়ে আমার মন খারাপ হয়। তখনও আকাশে খুব মেঘ জমে আছে, নীল-সাদা মেঘ।
আমার মনের ভেতর তুমি বাসা বাঁধতে জানো মেহেরুন?
এ যেন মূর্ত পদার্থের মতো একটি জীবন—দুপুরের পায়ে হেঁটে হেঁটে সমস্ত অতীত আছড়ে পড়েছে শিরীষের শুকনো ডালে। আমি ভুলে যেতে পারি না, যাকিছু ঘটে গেল সেদিন। ভীষণ রংচটা দিনে পিপাসার্ত দোয়েল বলে গেল জীবনের নগ্ন অধ্যায়।
মনের ভেতর নিহিত স্বপ্ন—তোমাকে বলা হলো না যেদিন এপাড়ায় তুমুল উদ্বিগ্নতা ছড়িয়ে পড়েছে। সবার মন তখন পেঁজা তুলো হয়ে উড়ে গেছে ফাগুনের হাওয়ায়।
কখন জানি মন কাঁদে, নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে থাকার মানে অনেক কথা বলতে না পারা। শুধু চোখের পলকে প্রেম ভেসে উঠে নিমগ্ন দুপুর গড়িয়ে যাবার পর—ততক্ষণে ফুরিয়ে গেছে অজস্র কথার আয়ু।
এদিকে অনেকটা ছায়ার মতো বিস্তারিত হয়ে আছে জীবন। বহু বছর পর বিষণ্ন দিন ফিরে এলো—শাল্মলিদের নগ্নতা দেখে ফেলার পর আরও বিপুল সংখ্যক মন খারাপ জেকে বসে এখানে। কিছু যাতনা সযত্নে তুলে রাখা হয়েছে—তোমাকে বলব বলে একটি সমুদ্র নিভৃতে শুকিয়ে যাচ্ছে।
এই জনারণ্যে অকুণ্ঠ জলের গান—দুপুরের একান্ত নির্জীবতায় ঘুমিয়ে আছে সহস্র পাতার আয়ু। আজ ঠিক মনে নেই—কেমন কাঠফাটা রোদ, চশমার ফ্রেমে ঝুলে আছে সমস্ত অতীত। যেনবা বসন্তের শিমুল ফুটে উঠেছে চিলতে মেঘের কোলে।
ঠিক যেন হঠাৎ দেখা, বহুদিন নির্বিকার থাকার পর। তোমাকে পেয়ে গেলে এ জীবন সমর্পিত হয়ে যেতো তিনশ বছর বয়সী বৃক্ষের ডালে। নিরঙ্কুশ হাহাকারে সেদিন তোমাকে বলেছি—আমার সমূহ প্রাক্তন মৃত। তুমিও যেন এবার মৃত বলে বিবেচিত হলে—আহা জীবন! বেদনায় পরিপুষ্ট হয়ে গেছে আজ কতকাল।
আমরা হেঁটে হেঁটে কথা বলি, যেহেতু বহুদিন কথা হয়নি আমাদের। তবু সেই প্রথম প্রণয়ের দিন ফিরে এলো। কত যে বাগান পেরিয়ে হেঁটে যাই, বাগানবিলাস জড়িয়ে শিশু-ফুলগুলো আকাশের দিকে চেয়ে আছে।
বৃষ্টি তার ভালো লাগে কি না এই মর্মে একটা চিরকুট লিখেছিলাম মেহেরুন সমীপে। সে বলেছিল ‘আমার বৃষ্টি ভালো লাগে’ বৃষ্টি এলেই আমি স্মৃতিকাতর হয়ে যাই এবং আপনাকে মনে পড়ে মোহন’। আমি বারংবার তোমাকে মনে রাখি, বৃষ্টির রাতে বহুদূরের শহর হেঁটে আসি চলো।
এইতো, আমি মোহন কুমার—তুমি মেহেরুন নেসা। এইখানে এতোটাই নির্বিবাদে বসে আছি, যেন তোমাকে না পাওয়ার কোনো উদ্বেগ নেই আমার। কেননা, অশোক বলেছিল—আমার পৃথিবীজুড়ে কেবল তোমার পরিক্রমণ। তোমার পৃথিবীজুড়ে আমার একলা আকাশ।
কখনো ভীষণ মন খারাপ হলে চলে এসো। আমি তোমার একশো তারার রাজা। তোমার ঘুম ঘুম বিষণ্নতার পরিব্রাজক—যদি বলো, আমি তোমাকে নিয়ে চলে যাব অফুরন্ত হলুদ প্রজাপতির ডানায়। দূর দূর দিগন্তের নিলীন আকাশের ভাঁজে।
আজ যেখানেই যাই—শুধু শুধু বিষাদ, তুমি নেই বলে বিপুল অরাজকতা সৃষ্টি হয়েছে এইসব বিমূর্ত দুপুরবেলার গল্পে।
তোমার মায়া আমাকে এমনভাবে জড়িয়ে আছে—তোমার চোখে এতো অদ্ভুত সরলতা, আমাকে কোথাও যেতে দিচ্ছে না। পৃথিবীময় এতোসব অরাজকতার মাঝেও কিভাবে যে অজস্র লাল-নীল ফুলের ঘ্রাণে ঘুমিয়ে পড়ি! সব যেন তোমার ভাবনায় তাড়িত, সব যেন উন্মুখর রাত্রির নিসর্গ উপকূলে তোমাকে ফেলে আসার স্মৃতি রোমন্থন।
প্রিয়তম ফুল, চিঠির ভাঁজে শুকিয়ে যাচ্ছ তুমি। যদি আরেকটি বার এদিকটায় চোখ ফিরে, খুঁজে নিও অসুস্থ সন্ধ্যার কতক কাগজের পাহাড়। যেখানে স্মৃতির মলিনিমা ঘুমিয়ে আছে সহস্র পাতার গায়ে।
যে পথে অনেক সুন্দর হাওয়া—সে পথেই হেঁটে যাই। যে পথে দূরাগত মোহ-সুখ, সেখানেই ফিরে আসে সমস্ত অতীত। সারাটাদিন এমন উদাসীন কেটে গেল, বিকেল হলেই অজস্র অন্ধকারে চারপাশ হেসে ওঠে। তখন যেন গভীরতম নিশ্বাস ফুরিয়ে যায়, ফুরিয়ে যায় অনিমেষ জীবন।