ঐতিহাসিক মুসলিম স্থাপত্য: কর্ডোভা জামে মসজিদ

আবদুল কাদির ফারূক:

পৃথিবীর ইতিহাসে স্পেনে মুসলিম শাসনের সূত্রপাত হয়েছিল ‘মুর’ জাতির মাধ্যমে। তারা রাজধানী হিসেবে বেছে নিয়েছিল কর্ডোভা নগরীকে। ৭১১ থেকে ১৪৯২ সাল পর্যন্ত মুসলিম শাসনামলে সভ্যতার সর্বোচ্চ শিখরে পৌঁছায় স্পেন। এ সময় স্পেনে শিক্ষা-দীক্ষা, সাহিত্য-সংস্কৃতি ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের ব্যাপক প্রসার ঘটে। নির্মিত হয় অনেক লাইব্রেরি, দ্বীনি মারকায ও মসজিদ। অসাধারণ শিল্পনৈপুণ্যে তৈরি হয় অসংখ্য মুসলিম স্থাপনা। যেগুলো যেকোনো মানুষের দৃষ্টি কেড়ে নিতে সক্ষম। এসব স্থাপনার মধ্যে কর্ডোভা জামে মসজিদ অন্যতম।

১২শ বছর আগে খলিফা আবদুর রাহমান আদ দাখেলের আমলে ৭৮৪ থেকে ৭৮৬ সালে স্পেনের তৎকালীন রাজধানী কর্ডোভায় নির্মাণ করা হয় ঐতিহাসিক অনন্য ও অনিন্দ্য সুন্দর কর্ডোভা মসজিদ, যা ‘লা মেজকিতা’ কিংবা ‘দ্য গ্রেইট মসজিদ অব কর্ডোভা’ নামেও পরিচিত।

মসজিদ নির্মাণ ও নেপথ্যের ইতিহাস

বর্তমানে যেখানে কর্ডোভার মসজিদ অবস্থিত সেখানে রোমান পৌত্তলিকদের যুগে তাদের একটি উপসনালয় ছিল। স্পেনে খৃস্টধর্ম প্রচার-প্রসার লাভ করার পর খৃস্টানরা এটা ভেঙে তদস্থলে একটি গীর্জা নির্মাণ করে। কিন্তু কর্ডোভা যখন স্পেনের রাজধানী হিসেবে ঘোষিত হয় এবং জনবসতি খুব দ্রুত বাড়তে থাকে, তখন মসজিদের অংশটি নামাজিদের জন্য খুব সংকীর্ণ হয়ে যায়। অবশেষে আবদুর রহমান আদ দাখেল যখন ক্ষমতাসীন হন, তখন তাঁর সামনে কর্ডোভার মসজিদটি সম্প্রসারণের বিষয়টি তিনি আঁচ করতে পারেন এবং যুগোপযোগী একটি ইস্যু হয়ে দাঁড়ায়। মসজিদ সম্প্রসারণের জন্য পাশের গীর্জাটি মসজিদের সঙ্গে যুক্ত করার কোনো বিকল্প ছিল না, কিন্তু খৃস্টানদের দেওয়া প্রতিশ্রুতি, যে অর্ধাংশে গীর্জা রয়েছে তা যথারীতি বহাল রাখা হবে। আর তাদের সম্মতি ছাড়াও গীর্জাটিকে মসজিদের সঙ্গে সংযুক্ত করা সম্ভব ছিল না।

তাই আবদুর রহমান আদ দাখেল খৃস্টান নেতৃবৃন্দকে ডেকে গীর্জার জমি ক্রয় করার প্রস্তাব দেন এবং যত মূল্য চাইবে তা দিতে অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন। যেহেতু গীর্জার জমি বিক্রি করা তাদের বৈধ ছিল, তাই প্রস্তাব গ্রহণে কোনো প্রতিবন্ধকতা ছিল না। তবুও খৃস্টানরা গীর্জা স্থানান্তর করতে সম্মত হয়নি। আবদুর রহমান আদ দাখেল ছিলেন নাছোড়বান্দা, তিনি দীর্ঘদিন পর্যন্ত তাদেরকে সম্মত করানোর চেষ্টা অব্যাহত রাখেন। পরিশেষে তারা উচ্চমূল্যের পরিবর্তে এই শর্তে সম্মত হয়, ‘শহরের বাইরে তাদের যেসব গীর্জা জরাজীর্ণ হয়ে গেছে তা পুননির্মাণের অনুমতি দিতে হবে।’ আবদুর রহমান আদ দাখেল তাদের এ শর্ত মঞ্জুর করে নেন। এভাবেই গীর্জার অবশিষ্ট অংশ মসজিদের সঙ্গে সংযুক্ত করা হয়।

প্রশস্ত জমি পাওয়ার পর আবদুর রহমান আদ দাখেল মসজিদের কাজ নতুনভাবে শুরু করেন। দামেস্কের জনৈক অভিজ্ঞ স্থপতির মাধ্যমে এটি নির্মাণ করেন। এর অলঙ্করণ ও কারুকার্য ছিল খুবই জমকালো ও নয়নাভিরাম। বিরাট এ প্রকল্প সম্পূর্ণ করতে দীর্ঘ সময়ের দরকার ছিল, কিন্তু দু’বছর কাজ চলার পর আবদুর রহমান আদ দাখেল ইন্তেকাল করেন। মৃত্যুর পর তাঁর ছেলে হিসাম নির্মাণ কাজের ধারাবাহিকতা বজায় রাখেন এবং আশি হাজার দিনার ব্যয়ে মাত্র ছয় বছরে এর নির্মাণকাজ সমাপ্ত করেন। এরপর বনি উমাইয়ার খলিফাগণ একে সম্প্রসারণ ও সংস্করণ করতে থাকেন। এভাবে কর্ডোভার বিশাল মসজিদটি আটটি স্তর অতিক্রম করে পূর্ণতার শীর্ষে আরোহণ করে।

স্থাপনের পর প্রায় পাঁচশ বছরেরও বেশি সময় এ মসজিদে নামাজ আদায় করেন মুসলমানরা। সে সময় মসজিদটি ইসলামি শিক্ষা, শরিয়া আইন ও সালিস কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করা হত। তারপর ক্যাসলের রাজা তৃতীয় ফার্ডিন্যান্ড ও রাণী ইসাবেলা ১২৩৬ খৃস্টাব্দে মুসলমানদের পরাজিত করে স্পেন দখল করলে পাল্টে যায় কাহিনি।

মসজিদের অবকাঠামো

মসজিদটির অভ্যন্তর ভাগের প্রশস্ততা ও সৌন্দর্য বিশ্বব্যাপী অনন্য। মসজিদের ছাদযুক্ত অংশ এতো প্রশস্ত, সম্ভবত পৃথিবীতে এতো প্রশস্ত ছাদযুক্ত অংশ আর কোথাও নেই। অধিকন্তু বিস্তৃত মেঝের পুরোটাই থরে থরে বিন্যস্ত সুন্দর সুন্দর কক্ষ দিয়ে। এগুলোর ছাদ আবার গম্বুজ সদৃশ এবং উভয় দিকে মর্মর পাথরের স্তম্ভের সারি অনেক দূর পর্যন্ত বিস্তৃত। মুসলিম যুগে এ মসজিদের মোট স্তম্ভ সংখ্যা ছিল চৌদ্দশ সতেরটি ও মোট আয়তন ছিল তেত্রিশ হাজার একশ পঞ্চাশ বর্গ গজ।

কোনো কোনো ইতিহাসে পাওয়া যায়, এ মসজিদের ছাদে ৩৬০টি তাক ভাঁজে ভাঁজে এমনভাবে তৈরি করা হয়েছিল, সূর্যরশ্নি ক্রান্তি বলয়ে আবর্তন করে প্রতিদিন একটি ভাঁজে প্রবেশ করত। রাতে মসজিদে দু’শ আশিটি ফানুস জ্বালানো হত। এগুলোর জন্য দীপাধার ছিল সাত হাজার চারশো পঁচিশটি। মসজিদে যে লণ্ঠন জ্বলতো সেগুলোর বার্ষিক তেল খরচ হতো প্রায় ৩১৪ মণ। সাড়ে তিন মণ মোম এবং সাড়ে চৌত্রিশ সের সুতা মোমবাতি বানানোর কাজেই ব্যয় হতো। প্রতি জুমাবারে এ মসজিদে আধা সের চন্দন কাঠ ও এক পোয়া আম্বর জ্বালানো হতো।

বিরাট ও ঐতিহাসিক এ মসজিদটির স্তম্ভগুলো আজও দৃষ্টি কেড়ে নেওয়ার মত, কিন্তু মসজিদের সর্বত্র গুমট অন্ধকার ও সুনসান নীরবতা। খৃস্টানরা মসজিদটিকে যেভাবে বিকৃত করেছে, এতে বুঝা যায়, আসলে তাদের উদ্দেশ্য গীর্জার অভাব পূরণ করা নয় বরং তাদের আসল উদ্দেশ্য ইসলামি সভ্যতার নিদর্শন সমূহের বিকৃতি সাধন করা ও খৃস্টানি থাবায় মসজিদটিকে রঞ্জিত করা। তারা এ মসজিদটিতে তাদের ধর্মীয় গোঁড়ামির নগ্নতা মন খুলে প্রকাশ করেছে।

মসজিদের কোনো অংশই খৃস্টান ‘হায়নাদের’ কালো থাবা থেকে বাঁচতে পারেনি। চোখ ধাঁধানো কারুকার্যময় অনিন্দ্য সুন্দর মেহরাব ও মিম্বারে ধুলো বালুর আস্তরণ পড়ে ম্রিয়মাণ হয়ে পড়ে আছে। যেই মিম্বার থেকে এক সময় কাযি মুনযির ইবনে সাঈদের মতো খতিবের অনলবর্ষী খুতবা তরঙ্গ তুলতো ইথারে। আল্লামা কুরতুবি, আল্লামা ইবনে রুশদ এবং হাফেয ইবনে আবদিল বার রাহিমাহুমুল্লাহর মতো মহান মনীষী ও জ্ঞান সাধকগণ হয়তো এখানেই নামায পড়তেন। আর এখন খৃস্টানদের আগ্রাসী থাবার যাথাকলে পিষ্ট হচ্ছে, আমাদের মুসলিম সমাজের প্রাণকেন্দ্র মসজিদটি।

আগের সংবাদটিপু সুলতানের লাইব্রেরি
পরবর্তি সংবাদহৃদয়ের কথা হয়নি বলা