রাকিবুল হাসান নাইম:
কওমি মহিলা মাদরাসায় ছাত্রীদের স্বাস্থ্য সচেতনতা নিয়ে শঙ্কায় আছেন শিক্ষকরা। সঠিক আবাসন ব্যবস্থার অভাব এবং ছাত্রীদের অবহেলার কারণে এই শঙ্কা দিনদিন বাড়ছে। শঙ্কা থাকলেও শঙ্কা নিরসনে তেমন উদ্যোগ নিচ্ছেন না মাদরাসা কর্তৃপক্ষ। মহিলা মাদরাসার শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।
তারা বলছেন, এখানে মাদরাসা কর্তৃপক্ষের যেমন অবহেলা রয়েছে, তেমনি ছাত্রীদেরও অবহেলা রয়েছে। দু পক্ষেরই এ বিষয়ে উদ্যোগের অভাব রয়েছে।
সমস্যা কোথায়?
এ প্রসঙ্গে কথা হয় মাদরাসাতুল মদীনা বগুড়ার প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক মুফতী মনোয়ার হোসেনের সঙ্গে। তিনি এক মহিলা মাদরাসায় স্বাস্থ্য ক্যাম্প পরিচালনাও করেছেন। তিনি ফাতেহকে বলেন, মহিলা মাদরাসায় স্বাস্থ্য সচেতনতা একদমই কম। প্রথমত, মাদরাসার পক্ষ থেকে ছাত্রীদেরকে কখনও স্বাস্থ্য সচেতনতা নিয়ে কথা হয় না। দ্বিতীয়ত, ছাত্রীরা পবিত্রতার আধুনিক পদ্ধতিগুলো জানে না। তৃতীয়ত, মাদরাসা কর্তৃপক্ষেরও কোনো পরিকল্পনা নেই, মেয়েরা তাদের মাসিকের সময় কীভাবে কোথায় থাকবে, পরিচ্ছন্ন হবে। দরকার হলে কোথায় প্যাড পাবে। এসব নিয়ে কোনো পরিকল্পনা নেই। চতুর্থত, মেয়েদের এই বাড়ন্ত বয়সে পুষ্টির দরকার হয় বেশি। কিন্তু তারা খাবারে সেই পুষ্টি পায় না। মাদরাসাও সরবরাহ করে না। ছাত্রীরা নিজেরাও খায় না। ফলে মাদরাসার ছাত্রীদের বিভিন্ন শারীরীক সমস্যা দেখা দেয়।
তিনি আরও বলেন, আমরা দেখেছি, ছাত্রীরা তাদের রোগের কথা পরিবারকেও বলে না, ডাক্তারদেরও বলে না। ফলে সমস্যা বাড়তে থাকে।
কথা হয় মুনীরুল ইসলাম আরাবির সঙ্গে। তিনি ফাতেহকে বলেন, আমি বালক মাদরাসার পাশাপাশি বালিকা মাদরাসায়ও কিছুদিন খেদমতে ছিলাম ৷ এসব ব্যাবস্থাপনা খুব কাছ থেকে দেখা এবং বুঝার সুযোগ হয়েছে৷ চান্দিনায় সবচে উন্নতমানের আবাসন ব্যাবস্থা ছিল আমাদের ৷ প্রথম বছর প্রায় দুইশো ছাত্রী ভর্তি হয় ৷ তার কারণ হলো, আমাদের বালক মাদরাসার লেখাপড়া এবং স্বাস্থ্যসম্মত আবাসন ব্যাবস্থার সুনাম ছিল ৷ অনেক অভিভাবককে দেখেছি, মেয়েদের ভর্তি করার পূর্বে তারা প্রতিষ্ঠানের আবাসন ব্যাবস্থা দেখতে আসেন ৷ তাদের কমন একটা অভিযোগ হলো, এর আগে যে মহিলা মাদরাসায় গিয়েছে কোথাও আবাসন ব্যাবস্থা ভালো পায়নি ৷ ফলে অনেক সচেতন অভিভাবক মহিলা মাদরাসা থেকে ফিরে আসেন ৷
তিনি আরও বলেন, মহিলা মাদরাসার সংখ্যা দিন দিন বাড়লেও লেখাপড়ায় গতি হারাচ্ছে স্বাস্থ্যসম্মত আবাসন ব্যবস্থা না থাকায় ৷ আমাদের কুমিল্লা চান্দিনা উপজেলায় চারটা দাওরা হাদীস মহিলা মাদরাসার পাশাপাশি প্রায় ৬৫টি মহিলা মাদরাসা আছে ৷ ছেলে মাদরাসা আছে ১১৮-এর অধিক ৷ এগুলো আবার থানা ভিত্তিক মাদরাসা সংগঠনের আওতাভুক্ত ৷ তার বাইরে বেহিসেবি আরো মাদরাসা আছে ৷ হাতেগোনা কয়েকটি স্থায়ী ক্যাম্পাস ছাড়া বাকি সবগুলো প্রাইভেট মাদরাসা। অধিকাংশ মাদরাসার আবাসন ব্যাবস্থা খুবই নাজুক ৷ অল্প জায়গায় অধিক ছাত্রী ভর্তি করার ফলে পড়ালেখার পাশাপাশি থাকা-খাওয়া ঘুমেও নানাবিদ সমস্যায় জর্জরিত ৷ আর এসব সমস্যা প্রকটভাবে ফুটে উঠে ঋতু পরিবর্তেনর সাথে সাথে ৷ বিশেষ করে গরমকালে এসব মাদরাসার অবস্থা হয় ভয়াভহ ৷ বিভিন্ন রোগ সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ে পুরো মাদরাসায় ৷
এসবের জন্য তিনি অনেকাংশে দায়ী করেন মাদরাসার পরিচালকদের। তার মতে, এসব সমস্যা দূর করতে কওমি মাদরাসার অভিভাবক বেফাক উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারে ৷ থানা কিংবা জেলায় জেলায় পরিচালকদের নিয়ে কাউংসিলিংয়ের ব্যাবস্থা করলে কিছুটা হলেও ফলপ্রসূ হবে বলে আমি মনে করি ৷ তবে পরিচালকদের সদিচ্ছা, দীর্ঘ মেয়াদী পরিকল্পনা, এবং খেদমতে মানসিকতা না থাকলে এসব থেকে উত্তরণ কখনো সম্ভব না ৷
শেরপুর জেলার ঝিনাইগাতি থানার এক মহিলা মাদরসার প্রাক্তন শিক্ষক আবু ইয়সির ফাতেহকে বলেন, মহিলা মাদরসায় খাদ্য সচেতনতা কম। ঢালাও ভাবে বেসিক কয়েকটি খাদ্য সারা বছর খাওয়ানো হয়। যেমন আলু , লাউ, বেগুন, শুটকি, পাংগাস, পল্টি মুরগি, তেলাপিয়া ইত্যাদি। এসব খাদ্যের মধ্যে যেই পুস্টিগুণ রয়েছে, সেগুলো ছাড়া বাকিগুলোর ঘাটতির কারণে বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়। তা ছাড়া বেশির ভাগ মেয়েদের মধ্যে অপরিস্কার থাকার মানসিকতা প্রবল। আমি যখন মহিলা মাদ্রাসার নাজেমে তালিমাত ছিলাম, এমন কোন দিন ছিল না যেদিন গড়ে ১০ জনকে হাসপাতালে নিতে হয়নি। আমার রুমে ছোট একটা ফার্মেসি দিয়ে রাখার পরেও।
সমস্যা নিরসনে পরামর্শ
মিরপুর ১২ নম্বরস্থ জামিয়া মিল্লিয়া মাদানীয়া আরাবিয়া আজমা মহিলা মাদরাসার ভারপ্রাপ্ত মুহতামিম মুফতি ইমরান কাসেমীর সঙ্গে কথা হয়। তার মাদরাসায় ১২০০ ছাত্রী রয়েছে। এ সমস্যা স্বীকার করে তিনি বলেন, করোনার পর আমার মাদরাসায় একজন ডাক্তার রেখেছিলাম। তিনি সপ্তাহে দুদিন এসে ছাত্রীদের ওষুধ দিতেন, কার কী সমস্যা শুনতেন। এখন আর নেই। করোনার পর থেকে এই সেবাটা বন্ধ। তবে সবসময় তিনি তৎপর আছেন।
তিনি বলেন, মেয়েদের বড় কোনো রোগ না হলে কর্তৃপক্ষের কাছে খবর আসে না। তাই কোনো শিক্ষিকাকে এটার জন্য নিয়োগ করতে হয়। আমি সেটা করেছি। তারা যেন খবর নিয়ে আমাকে জানায়। সব মাদরাসা কর্তৃপক্ষ নির্দিষ্ট একজন ডাক্তার রাখতে পারেন। সাপ্তাহিক কিংবা মাসিক চেকাপের ব্যবস্থা করতে পারেন। তাহলে সমস্যাটা সহজেই ধরা পড়বে। ছাত্রীরাও রোগ নিয়ে বসে থাকবে না।
আবাসন ব্যবস্থার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এটা ঠিক, অনেক মাদরাসা এখন এত সংকীর্ণ জায়গায় গড়ে উঠে, ছাত্রীদেরকে বড় কোনো স্পেস দেয়া যায় না। তাই চেষ্টা করতে হবে, যতটুকু জায়গা আছে, তা পরিস্কার রাখা। ছাত্রীদেরকে এবং মাদরাসা কর্তৃপক্ষকে এ ব্যাপারে যত্মবান হতে হবে। কারণ মেয়েরা এমনিতেই সংবেদনশীল। পুরুষের মতো অতটা শক্তপোক্ত নয়। তাই তাদেরকে কিভাবে পুষ্টিকর খাবার দেয়া যায়, তার চিন্তাও করতে হবে।