[মাহমুদ দারবিশ ফিলিস্তিনের মানবতাবাদী কবি। তার কবিতার প্রতিটি বর্ণ স্বর্ণছোঁয়া। তিনি ছিলেন একজন প্রতিবাদী কবি। তার বেশিরভাগ কবিতাই ফিলিস্তিনকে ঘিরে আবর্তিত। শুধু ফিলিস্তিন নয়, গোটা আরবজুড়েই তার সুখ্যাতি। তিনি ছিলেন আরবি কবিতার উন্নয়ন প্রতিভূ।
ফিলিস্তিনের গালিলি প্রদেশের আল বিরওয়াহ গ্রামে এ কবির জন্ম, ১৯৪২ সালে। ১৯৪৮ সালে ইজরাইলিদের আক্রমণের ফলে মাত্র ছয় বছর বয়সে সপরিবারে লেবাননের পথে রওয়ানা করেন, গভীর রাতে। পেছনে ফেলে যান উপত্যকার উপর সবুজ সুন্দর গ্রাম, শৈশবের সোনামাখা দিনগুলির স্মৃতি। সেই থেকে শুরু তার উন্মূল উদ্বাস্তু জীবনের। আমৃত্যু কোথাও স্থির হতে পারেননি। ২০০৮ সালের ৮ আগস্ট চিরতরে বিদায় নেন কবি। কিন্তু তাঁর কবিতা, তাঁর প্রিয় দেশ, দেশের জন্য সংগ্রাম, সবই রয়ে গেছে। দারবিশের আফসোস, প্রিয় মাতৃভূমিকে স্বাধীন-শৃংখল-মুক্ত দেখে যেতে পারেননি।
কবির লেখালেখি ও কবিতা নিয়ে একটি সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছেন ফিলিস্তিনি আইনজীবি ও লেখক রাজা শাহাদাহ। সাক্ষাৎকারটি ফাতেহের পাঠকদের জন্য অনুবাদ করেছেন মুজীব রাহমান।]
রাজা শাহাদাহ : আপনি কি কখনো গদ্য লিখেছেন?
মাহমুদ দারবিশ : আমি গদ্য পছন্দ করি এবং আমি মনে করি, গদ্য কখনো কখনো কবিতার চেয়ে শক্তভাবে কাব্যিক মর্মভেদী রূপ ধারণ করে। কিন্তু সময় খুব দ্রুত চলে যাচ্ছে, কাব্য নিয়ে আমার যে পরিকল্পনা তা এখনো শেষ করতে পারিনি। গদ্য ও কবিতা নিয়ে আমার ভেতর দ্বন্দ্ব কাজ করে। তবে আমার পক্ষপাত কবিতার দিকেই।
রাজা শাহাদাহ: আপনি বৈরুতের অবরোধ ও পরবর্তী সময় সুন্দরভাবে পর্যবেক্ষণ করেছিলেন। তৎকালীন ও বর্তমান সময়ের মাঝে মিল কোথায়?
মাহমুদ দারবিশ: বৈরুতের অবরোধের দিনগুলো বর্তমান সময়ের চেয়ে আরো বহুগুণ ভয়ংকর ছিল। বাস্তবিক অর্থেই একটা যুদ্ধ ছিল। তখন বৈরুতের এমন কোন রাস্তা বাকি ছিল না যা ঝুঁকি মুক্ত ছিল। যারা এই যুদ্ধ থেকে প্রাণে বেঁচেছিল তারা ছিল সত্যিই ভাগ্যবান। বৈরুতের প্রত্যেকের জীবন ছিল তখন সংকটপূর্ণ। দফায় দফায় প্রত্যেককেই এ জীবন পার করতে হয়েছে। যা ছিল খুবই কঠিন ও বেদনাদায়ক।
এই দুঃখসময়ের এপ্রিল মাসে আমি তখন ইউরোপে ছিলাম। তাই এ অস্থির সময় আমি মিস করেছি, যখন প্রতিদিন বোমা হামলা ও গুলাগুলি অব্যাহত ছিল।এরপর তো অবরোধ রুটিনে পরিণত হয়েছে। লড়াই তেমন ছিল। কিন্তু মানুষ চরম উদ্বিগ্ন সময় পার করছে। কখন অবরোধ তুলে নেওয়া হবে? কখন ময়লা- আবর্জনা পরিষ্কার করা হবে? কখন তারা অফিসে যেতে পারবে? এ নিয়ে তারা খুবই দুশ্চিন্তায় ছিল। এসব বিষয় নিয়ে নিউজের আইটেম বনানোও নিষিদ্ধ ছিল।
রাজা শাহাদাহ: আপনি কবিতা লেখা শুরু করেন কখন?
মাহমুদ দারবিশ : ছোট বেলায় আমি শারীরিকভাবে অনেক দুর্বল ছিলাম। আমি কোন ধরণের খেলায় অংশগ্রহণ করতে পারতাম না। কুস্তি, ফুটবল বা অন্য কোন খেলাও খেলতে পারতাম না। তাই তখন থেকেই আমার সময় কেটেছে ভাষার সাথে। বড়দের সাথেও অনেক সময় কেটেছে। আমাদের বাড়িতে আমার দাদা প্রতিবেশীদের নিয়ে আরবী বিভিন্ন শ্লোক ও গল্পের আসর জমাতেন, আমিও সে আসরগুলোতে বসতাম। সে শ্লোকগুলো ছিল খুবই রোমান্টিক। আমি শব্দগুলো মনোযোগ দিয়ে শুনতাম। মর্মার্থ তেমন বুঝতাম না, তবুও শব্দের ঝংকার আমাকে খুব আলোড়িত করত। এসব অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়েই শব্দ ও ভাষার প্রতি আমার অনুরাগ সৃষ্টি হয়। আমি কবিতার প্রেমে পড়ে যাই। আমি তখন থেকেই একজন কবি হওয়ার স্বপ্ন দেখতে শুরু করি। আমি বিশ্বাস করি, কবিরা হচ্ছেন অতিমানবিক অনুষদের রহস্যময় মানবমূর্তি।
কিশোর বয়স থেকেই আমি কবিতা লেখা শুরু করি। তবে তখন আমি কবিতার নামে যা লেখেছি, তা আদৌও কবিতা হয়েছিল কিনা জানি না। আমার বাবা-মা ও শিক্ষকরা আমাকে কবিতা লেখতে উদ্বুদ্ধ করতেন। আমি যেহেতু খেলাধুলা করতে পারতাম না, তাই কবিতায় শ্রেষ্ঠ হওয়ার ইচ্ছা করলাম। তখন থেকেই ভাষা হয়ে যায় আমার রঙ্গভূমি। কবিতা হয়ে উঠে আমার অস্ত্র। এরপর কবিতাকে আমি আরো গুরুত্বের সাথে গ্রহণ করি।
রাজা শাহাদাহ : কখন থেকে গুরুত্বের সাথে নিজেকে কবি হিসেবে গ্রহণ করেছেন?
মাহমুদ দারবিশ : আমি জানি না। গুরুত্বের সাথে আমি যা গ্রহণ করি তাই কবিতা হয়ে যায়।
এক অর্থে ইজরাইলি মিলিটারি গভর্নর আমার প্রথম সাহিত্যসমালোচক, যিনি আমাকে কবিতাকে গুরুত্বের সাথে নিতে শিখিয়েছিলেন। আমার বয়স তখন বারো। আমাদের গ্রাম ছিল ইইজরাইলি মিলিটারী শাসনের অধীনে । আমি আমার ক্লাসের প্রথম ছিলাম । স্কুলে ইজরাইলের স্বাধীনতা উদযাপন অনুষ্ঠানে আমাকে স্বলিখিত কবিতা আবৃত্তি করতে বলা হল। আমি তখন যে কবিতাটি আবৃত্তি করেছিলাম তাতে আমাদের তৎকালীন পরিস্থিতি প্রতিফলিত হয়েছিল যে, আরবরা আমাদেরকে জোর করে ইজরাইলের স্বাধীনতা দিবস উদযাপন করাচ্ছে। পরের দিন মিলিটারি গভর্নর আমাকে তার অফিসে তলব করলেন এবং এমন কবিতা লেখার জন্য তিরস্কার করলেন। আমি উদ্বিগ্ন হয়ে গেলাম, আমি যা লেখেছি তা সত্য। আমি নির্দোষ। তবে আমি যা বলেছি তা কতটুকু ঝুঁকিপূর্ণ ছিল তখন সে ব্যাপারে আমার কোন ধারণা ছিল না। তবে এ ঘটনা আমাকে বিস্মিত করল যে, ক্ষমতাসীন রাষ্ট্র ইজরাইল আমার কবিতার কারণে মর্মাহত! এ ঘটনায় আমার অনুভব হল, কবিতা খুবই গুরুত্বপূর্ণ শিল্প।
রাজা শাহাদাহ : মিলিটারি গভর্নরের সাথে আপনি একাই দেখা করতে গিয়েছিলেন?
মাহমুদ দারবিশ : হ্যাঁ। আমি একাই গিয়েছিলাম।
রাজা শাহাদাহ: এ ঘটনায় আপনার পরিবারের প্রতিক্রিয়া কী ছিল?
মাহমুদ দারবিশ : তারা বিচলিত হয়ে যায়। তারা আমার ভবিষ্যত নিয়ে দুর্ভাবনায় পড়ে গেল।
এটা ঠিক যে, আমার লেখালেখির জন্য আমাকে চরম মূল্য দিতে হয়েছে তখন। ষোলো বৎসর বয়সে আমাকে জেলে যেতে হয়েছে। এরপরও কয়েকবার আমাকে জেলের ভেতর ও বাইরে থাকতে হয়েছে। কিন্তু আমার বাবা-মা আমার কার্যকলাপের জন্য কখনো আমাকে প্রতিরোধ করেননি। এই ঘটনা আমার ভেতর এমন ধারণা তৈরী করে যে, কবিতা কখনো কখনো দিনবদলের অস্ত্র হিসেবে কাজ করে। আমি আমার জীবনের উপসংহারে পৌঁছানোর আগে খুব গুরুত্বের সাথে অনুধাবন করি যে, কবিতা কিছুই পরিবর্তন করে না। মানুষ যেভাবে গ্রহণ করে প্রভাব তেমনই পড়ে। এর বাস্তব কোন প্রভাব নেই। এর দ্বারা কবি শুধু নিজেকে পরিবর্তন করতে পারে।
রাজা শাহাদাহ: এটা কি আপনার ব্যর্থতার ভয় থেকে বলছেন ?
মাহমুদ দারবিশ : না। এটা আমার পুনরাবৃত্তির ভয়। এমন প্রান্তে পৌঁছানোর ভয় যেখানে আমি আরও বিকাশ করতে অক্ষম। আমার বিশ্বাস, প্রত্যেক ব্যক্তিরই নিজেকে বিকাশের ক্ষমতার একটা সীমা থাকে। যখনই আমি কবিতার কোন আয়তন শেষ করি তখনই আমি অনুভব করি যে, এটাই আমার প্রথম এবং শেষ। প্রতিবারই লেখা শেষ করার পর আমার এমন হয়। এ পরিস্থিতি আমাকে খুব হতাশ করে তোলে। কখনও অনুভব হয়, আমি যা কিছু করছি, এসব কিছুই ব্যর্থতা। আমি কোন কিছুর ব্যাপারেই সুনিশ্চিত নই। প্রত্যেক সফলতা ও অর্জনের ক্ষেত্রেই আমি সন্দেহবাদী।
রাজা শাহাদাহ: আপনি যখন কবিতা লেখা শুরু করেন, কবিদের ব্যাপারে তখন আপনার অনুভুতি কেমন ছিল?
মাহমুদ দারবিশ : আমি যখন ছোট ছিলাম কবিদের তখন অপ্রাকৃতিক সত্তা মনে করতাম।
অনেক মানুষেরই ধারণা কবিরা রহস্যময় অথবা ভবঘুরে। তারা সাংসারিক নয়। সাধারণ মানুষদের নিয়ে তাদের কোন চিন্তা নেই। কবিদের ব্যাপারে মানুষের এমন অনুমান অবশ্য কিছু কবিদের কারণেই হয়েছে। তারপর সব কবিদের ব্যাপারে সত্য হিসেবে নিশ্চিত হয়ে গেছে। এগুলো সংকীর্ণ ধারণা; যা বাস্তবতার সাথে মিল নেই। আমি যখন কবি হয়েছি এবং অন্যান্য কবিদের সাথে পরিচিত হয়েছি তখন আবিষ্কার করেছি, এগুলোর কোনটিই সত্য নয়।
রাজা শাহাদাহ: কবিদের ব্যাপারে মানুষের এমন ধারণা আপনি কিভাবে দেখেন?
মাহমুদ দারবিশ : আমাকে সবচেয়ে বেশি বিরক্ত করে, কবিদেরকে জনসাধারণের সাথে পার্থক্য তৈরী করার ব্যর্থতা । মানুষ প্রায়ই বুঝতে ব্যর্থ হয় যে, আমাদেরও পৃথক ব্যক্তিত্ব আছে, যা অবশ্যই সম্মানিত এবং সুরক্ষিত। আমাকেওতো মাঝে মাঝে গুজবে ভুগতে হয়। কবিরা নাকি মাতাল হয় এমন ধারণা থেকে অনেকেই ধারণা করত, আমি মদ পান করি। কবি হিসেবে আমার জনপ্রিয়তা যত বাড়তে থাকে তার সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকে আমার নামে যতসব মিথ্যা গুজব। বাস্তবে আমি একজন সাদাসিধা মানুষ। আমার জীবনে আমি কোনদিন সরাইখানায় যাইনি। আমি ক্যাফেতে বসে আড্ডা দেই না। আমি কোন ভবঘুরে বা মাতালও নয়। আমি একজন গার্হস্থ্য মানুষ।
রাজা শাহাদাহ: বৈরুতে খেলার মাঠে প্রায় ২৫ হাজার দর্শক-শ্রোতার সামনে আপনি স্বরচিত কবিতা আবৃত্তি করেছিলেন। এত এত মানুষের সামনে কবিতা পাঠ করেছেন, তাদের মাঝে কোন আবেদন তৈরী করতে পারেন কিনা ভেবে নিজের ভেতর কোন চাপ অনুভব করেছিলেন?
মাহমুদ দারবিশ : শুরু থেকেই আমি আমার শ্রোতাদের সাথে মজবুত সম্পর্ক গড়ে তুলতে পেরেছিলাম। কবি হিসেবে আমার ভাবমূর্তি কয়েকটি রুপান্তরের মধ্য দিয়ে অতিবাহিত হয়েছে। আমি যখন কবিতা লেখা শুরু করি, তখন আবেগপ্রবণ ও মানবিক কবি হিসেবে পরিচিতি লাভ করি। আমার প্রথম বিখ্যাত কবিতাটি ছিল মাকে নিয়ে লেখা। এরপর জাতীয়তাবাদ নিয়ে কবিতা লিখে আরো প্রসিদ্ধি লাভ করি। আমি তখন লেখেছিলাম, “লিখে দাও আমি একজন আরব।’’ এ কবিতাটি খুব জনপ্রিয় হয়ে যায় তখন। এই কবিতার মাধ্যমে আমি মানুষের কাছে সজ্ঞায়িত হতে শুরু করি। তারা আমার এ কবিতাকে সাদরে গ্রহণ করে। আমি তাদের আস্থা অর্জন করে ফেলি। তারা আমার মানবতাবাদী বা জাতীয়তাবাদী নীতিসমূহের প্রতিশ্রুতি ত্যাগ না করে নান্দনিক বিকাশের ক্ষেত্রে আমার প্রতিশ্রুতিকে বিশ্বাস করে।
রাজা শাহাদাহ : আরব কবিদের মধ্যে যারা ক্রমাগত কাব্য ক্ষেত্রে নতুনত্ব নিয়ে আসছেন আপনি তাদের অন্যতম। আপনি নতুনত্ব কিভাবে তৈরী করেন?
মাহমুদ দারবিশ : উদ্ভাবন বলতে যা বোঝায় তা হলো, রূপ বা গঠনের পরিবর্তন। আমি সেই প্রথম কবি, যে নাকি একটি প্রচলিত পদ্ধতির বাইরে এমন কবিতা লেখেছে, যেখানে কোন কবিতা কোন একক অন্ত্যমিলে নির্মাণ করা হয়নি।
রাজা শাহাদাহ: কোন ঘটনা আপনাকে এমন কবিতা লেখতে প্রভাবিত করেছে?
মাহমুদ দারবিশ : ১৯৪৮ এর পরে আমরা ফিলিস্তিনিরা ইজরাইলরাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়ে সেখানে আমরা নিজেদেরকে পরাজিত অবস্থায় দেখতে পেলাম। এই সময়টা খুব বিভ্রান্ত সময় ছিল। কবিতার পুরোনো রূপগুলোতে এমন কিছু ছিল না, যা আমাদেরকে এমন রাষ্ট্রে প্রেরণ করতে সহযোগিতা করবে যেখানে আমরা নিজেদেরকে খুঁজে পাবো। তাই তখন বিপ্লবী কাব্যগ্রন্থের জন্য একটি বিপ্লবী রূপ প্রকাশের প্রয়োজন দেখা দেয়। এগুলো আমাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরের অনেক ঘটনার স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিক্রিয়া ছিল। ইচ্ছাকৃত কোন অধ্যয়নের প্রতিক্রিয়া ছিল না।
রাজা শাহাদাহ: অশান্তিকর সময়ও কখনো সঠিক বিপরীত ফলাফল নিয়ে আসতে পারে। কারণ সময়গুলো এত অনিশ্চিত ছিল যে, আপনি প্রচলিত ঐতিহ্যকে অবলম্বন করতে পারতেন, তাই না?
মাহমুদ দারবিশ : হ্যাঁ, এটাই স্বাভাবিক।
রাজা শাহাদাহ: তাহলে এমনটা হয়নি কেন?
মাহমুদ দারবিশ : আমাদের সম্প্রদায়ের মধ্যে রাজনৈতিক রূপান্তরের পক্ষে দুটি প্রতিক্রিয়া ছিল। একদল ছিল রক্ষণশীলদের। যারা ১৯৪৮ এর পর আমাদের সম্প্রদায়ের সাথে যা ঘটেছিল তাতে তাদেরকে প্রভাবিত বা ক্ষুব্ধ বলে মনে হয় নি। তারা ইজরাইলিদেরকে সহযোগিতা করেছিল এবং তাদের সাথে স্বাধীনতা দিবস উদযাপন করেছিল। তাদের মধ্যে যারা কবি ছিল তারা গতানুগতিক শ্লোক রচনা করেছিল। যারা ইজরাইল রাষ্ট্রের বিরোধী ছিল তারা গতানুগতিক ধাঁচ প্রত্যাখ্যান করেছিল এবং কবিতা লেখার জন্য নতুন ফর্ম তৈরী করে নিয়েছিল।
রাজা শাহাদাহ: আপনি আপনার কাব্যিক প্রক্রিয়া এককথায় কিভাবে বর্ণনা করবেন?
মাহমুদ দারবিশ : আমি যখন কোন কবিতায় কাজ করি তখন আমি জানি আমি কী করছি। আমি বুঝতে পারি, কীভাবে আমার শিল্পের বিকাশ ঘটছে। বৃহত্তর প্রকল্পের একেকটি অধ্যায় কিভাবে এগিয়ে চলছে। পুরো প্রক্রিয়া ও পথের প্রকৃতি যদিও আমার কাছে পরিষ্কার নয়।
রাজা শাহাদাহ: আপনি বলেছিলেন এটা সত্য নয় যে, কবিতা পরিবর্তনের বাহন হতে পারে। আচ্ছা, আপনি কি মনে করেন, ফিলিস্তিনিদের জাতীয় সংগ্রামে আপনর অবদান আছে?
মাহমুদ দারবিশ : শুরুর দিকে আমার কিছু কবিতা ফিলিস্তিনিদের পরিচয় বিকাশের ক্ষেত্রে অবদান রেখেছিল। কবি তার জাতির ভাষার উন্নয়নে অবদান রাখতে পারেন। তিনি মানুষকে ক্ষমতায়িত, মানুষকে আরও মানবিক এবং জীবনের দুঃখ কষ্ট সহ্য করাতে সক্ষম করতে পারেন। আমার কবিতা শোক ও উদযাপনের সময়ও পড়া হয়। আমার কবিতা মানুষকে আনন্দও দেয়। আমার কিছু কবিতা গানে রূপান্তরিত হয়েছে, তা লোকসান এবং পরাজয়ের ক্ষতিপূরণের অনুভূতি দেয়। তবে আমার প্রধান দুর্ভাবনা হল, আরবি কবিতার উন্নয়নে আমার কবিতা যে পরিমাণ অবদান রেখেছে তা।
রাজা শাহাদাহ: ফিলিস্তিনের বাহিরে আরববিশ্বে বা অন্য কোন দেশে কবিতা পড়লে আপনার কেমন লাগে?
মাহমুদ দারবিশ : আরব বিশ্বের ক্ষেত্রে আমি অনুভব করি, জায়গাটি অনেক বড়। ফিলিস্তিনে মানুষের উদযাপনের স্থান নেই। নিপীড়ন ও দখলের মধ্যে তো কবিতা হয় না। আরববিশ্বে এর থেকে আলাদা। বৈরুতে আমি পঁচিশ হাজার মানুষের সামনে কবিতা পড়েছি। এখানেতো মানুষের এক শহর থেকে অন্য শহরে, এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে যাতায়াতই নিষেধ।
রাজা শাহাদাহ: কোনো কবিতার ফাইল শেষ করতে আপনার কতদিন সময় লাগে। কবিতা প্রকাশের আগে কি কারো সাথে কবিতার খসড়াগুলো ভাগ করেন?
মাহমুদ দারবিশ : সাধারণত প্রতি দুই থেকে তিন বছরে আমার কবিতার এক ফাইল লেখা সম্পন্ন হয়।
আমি সাধারণত তিনটি খসড়া তৈরী করি। প্রথমে আমি সবকিছু লিখে রাখি। এরপর কাঠামো নিয়ে ভাবতে শুরু করি। পরিপূর্ণ তৃপ্তি অর্জন হয় শেষ খসড়াতে, যখন চূড়ান্ত রুপান্তরকরণ এবং সম্পাদনা সমাপ্ত হয়। আমি চূড়ান্ত ফাইলটাও একজন কবি, একজন সাহিত্যসমালোচক ও একজন এমন কাউকে পড়তে দেই সাহিত্যের সাথে যার সম্পর্ক নেই।
রাজা শাহাদাহ: যদি আপনার কোন কবিতার বই সম্পন্ন করতে এক বছরের বেশি সময় লাগে এবং এই সময়ের মধ্যে আপনি নিজের লেখা অন্যদের সাথে ভাগ না করেন, তার মানে এই যে পুরো এক বছর আপনি সম্পূর্ণ একা বিচ্ছিন্ন থেকে কাজ করছেন।
মাহমুদ দারবিশ : হ্যাঁ। কারণ বিচ্ছিন্নতা কবিতা লেখার অন্যতম শর্ত। বিচ্ছিন্নতা ছাড়া শৈল্পিক কাজ সুন্দরভাবে সমাপ্ত করা যায় না।