
আমাদের আয়ু ইসরায়েলি বোমায় খোদিত
পলিয়ার ওয়াহিদ
বেঁচে আছি
পায়ের জুতোরা এগিয়ে দিচ্ছে
জীবনের দিকে
যদিও এখনো বুঝতে পারিনি কাকে যুদ্ধ বলে
কিসের অপরাধে কারো ঘর ভেঙে দেয়া যায়
আমি হেঁটে যাচ্ছি
নিশ্চিত মরণের দিকে
কারণ আমাকে লক্ষ্য করে একটু পরেই বোমা ছোড়া হবে
কোথায় আমার বাবা-মা?
স্বজনেরা?
প্রতিবেশিরাই বা কোথায়?
আমাদের উঠোন কই?
খেলার মাঠ?
কীভাবে বাঁচতে হয়
কেমন করে মরতে হবে
আমি এখনও কিছু বুঝতে শিখিনি
আমি আসলে কোথায় যাচ্ছি ?
আমি ধ্বংস বুঝি না
না জন্মও
আমার কি ড্রিম আছে?
আমি কে?
আমি ফিলিস্তিনি শিশু
আমার বাঁচার অধিকার নেই!
দেখো আমার চোখ কত নিষ্পাপ
এবং ভয়ডরহীন
তবে কে আমার মুখে চুনকালি মাখিয়েছে?
দেখো আমার গেঞ্জির রঙ ঠিক তোমাদের
অবসরকালীন কফির মতো
কিন্তু আমাকে ব্যস্ত দেখাচ্ছে কেন?
আমি কাকে খুঁজছি আজ
চারিদিকে তো ভাঙা বাড়ি
সে সব ছবি ডিঙিয়ে
আমার শিশুতোষ চোখ কিছুই দেখতে পাচ্ছে না
আমি শুধু মাটিতে পা রেখে হাঁটছি
একটু পরেই সেই মাটিও গুড়িয়ে যেতে পারে
আমি উপরের দিকে তাকিয়ে হাটতে পারতাম
যেদিকে ঈশ্বরের বাড়ি বলে বাবা তসবি টিপাতেন
কিন্তু আমার মাতৃভূমি মাটিতে!
হে আকাশের মালিক
মৃত্যুই মানুষের সোনালি ভবিষ্যত
মৃত্যুর কোনো শিশু যুবক বৃদ্ধ নেই
কারণ আমরা ফিলিস্তিনের মানুষ
আমাদের আয়ু ইসরায়েলি বোমায় খোদিত!
আসমস্ত নিশ্চয়তা
শাহাদাৎ তৈয়ব
আমাদের কোথাও না কোথাও একটা ছাপ থেকে যাবে
পায়ের ছাপের মতো কিছু একটা নয়, নয়তো বা অদৃশ্য কিছু
আমাদের— শুধু থেকে যেতে হবে আমাদের ছাপহীন
যার দিকে রুজু হয়ে আছে ইচ্ছা নিরপেক্ষ আমাদের ঘর
ঠিকানা ও গতির সমাহার, তার পাশে কেউ কেন টেনে নিতে
আসে না আমাদের মাটি দাগ ও ক্ষত-বিক্ষত দেহ অপরাপর
জুলুমের বিশদ পাহাড়ের মুখে গ্রাস হতে হতে না বলিয়া
জহর প্রমাণ সত্য— আহা চলে যেতে হবে আমাদের
চলে যেতে হবে আওয়াজবিহীন মাটির কাছে, কোনো অদ্ভুত
কিছু পাওয়ার পর হয়ত এমন হয়েছে যে,
গভীর ও শব্দবিহীন আমাদের থেকে যেতে হবে এইখানে;
চাপহীন ছাপহীনতা আমাদের কে দিয়ে গেছে— জানা নাই
বহুবিধ অতি আচার ভোগ করার পর আরো কিছু
আমাদের ঘিরে আছে যাহা ভাবি যাহা ভাবিনা
তার সবকিছু আমাদের ভিতর রহিয়া চাপমুক্ত হইয়া আছে—
আমাদের থেকে যেতে হবে
প্রবল প্রতাপ— নিশ্চুপ থাকার আসমস্ত নিশ্চয়তা নিয়া।
রুহের মহাল
ফারুক আহমদ
হৃদয়জুড়ে বসে যখন প্রেমের মজমা
ধীরে ধীরে, অল্প অল্প অথবা খুব প্রখর
যেকোনো অবস্থায়
মনের পাড়ায় শুধু একই প্রতিধ্বনি :
তুমি আমার রুহের মহাল
জানি,
এমন সমাচার কানে পৌঁছালে
তোমার গয়রতে আঘাত হানবে
তুমি ভাববে, আমি উন্মাদ অথবা
শরাবের নেশায় প্রমত্ত হয়ে আছি
গওর না-দিলে এমনটা ভাবা স্বাভাবিক
অথচ, এ খবর শুধু বিধাতা জানে :
আমার বুকের ভেতর যে দরিয়া বয়ে গেছে
সেখানে এক উত্থাল ঢেউ, কিছুই টেকে না
তছনছ হয়ে যায় সব; শুধু বহাল তবিয়তে থাকে
তোমার কায়া, ছায়া ও মায়া; হে দিলদারা।
তারপর, একসময় ভাবি,
তবে কি আমিই তোমার মহাল?
প্রয়োজন নেই, তুমি এ-ও অস্বীকার করবে
এবং কোনো একদিন সব বেদখল হয়ে যাবে।
যে ডাক শুনতে পাই না
কিয়াস আহমেদ
প্রতি শুক্রবার
কবরস্থানের পাশ দিয়ে বাজারে যাই
কবরস্থান থেকে কেউ একজন আমাকে ডাকে,
আয়
আমার কাছে আয়
আমার কাছে এলে, তোকে আর বাজার করতে হবে না,
রোদে পুড়তে হবে না, বৃষ্টিতে ভিজতে হবে না।
বরফ পড়া শীতে
বাজার দর শুনে, তোকে আর ঘামতে হবে না,
প্রতিদিন আয় রোজগার নিয়ে ভাবতে হবে না,
মানুষের সাথে মানুষ সেজে সংসার করতে হবে না।
আয়
আমার কাছে আয়
আমি তোকে উড়তে শেখাবো, ডুবতে শেখাবো,
আমি তোকে মরে গিয়ে বাঁচতে শেখাবো,
আয়, আমার কাছে আয়।
কিন্ত আমি তার ডাক শুনতে পাই না,
কবরস্থানের দিকে তাকিয়ে দেখি, গাছের ছায়ায়
কবর গুলো ঘুমিয়ে আছে, কোনো সাড়াশব্দ নেই।
কবিবংশের শেষ পুরুষ
মুহিম মাহফুজ
কবিবংশের শেষ পুরুষ যখন মারা গেলেন
ঘাসের মতো পশম ভরা বুকের ভেতর
আমার রুহ ধুপধুপ করে কাঁপতে লাগলো
এক যুগ ধরে যে দীর্ঘশ্বাস জমিয়ে রেখেছিলাম
তাকে আরশের দিকে উন্মুক্ত করে দিয়ে মুখ নামিয়ে আনলাম-
বাংলাদেশ কাঁদছে
অথচ নিথর দেহের আতঙ্কে সন্ত্রস্ত ঢাকা তখনো সন্ত্রাসে তৎপর
সংকীর্ণ হতে হতে ঢাকা যখন এক হিংসার শহরে পরিণত হলো
আল মাহমুদকে ধারণ করার আর কোন জায়গা রইলো না
গাঁও-গেরামের লোক, সংকীর্ণ হতে শিখিনি তখনো
ঘন ঘাসের মতো বুকের পশম সরিয়ে
রুহের ভেতর আল মাহমুদের কবর খনন করে
বাইতুল মুকাররমে হাজির হলাম-
সমগ্র বাংলাদেশে থেকে সাদা সাদা ফেরেশতার দল
লাব্বাইক লাব্বাইক বলে আসতে লাগলো
আতাউল্লাহ হুজুর তাকবির দিলেন-`আল্লাহু আকবার`
এই সত্য শব্দ ঘোষণা করতে করতেই দ্বীধাহীন আল মাহমুদ
পৃথিবীর মানচিত্র অতিক্রম করে গেলেন
জানাজা শেষে উত্তর গেটে মানুষের কোলাহল
শীতল এ্যাম্বুলেন্সে তোলা হচ্ছে বাংলাদেশের লাশ
আমি তখন দক্ষিণ গেটে গিয়ে
বুকের কবরে কবিকে শুইয়ে দিলাম-
সেখানে ফররুখের শিয়রে নজরুল
নজরুলের শিয়রে কায়কোবাদ আলাওল প্রমুখেরা শুয়ে আছে
শেষ কবরটিতে নিচের জন্য জায়গা করে রেখে
পাঁজরের ঝাপ নামিয়ে উপরে উঠে এলাম
সাইরেন বাজিয়ে এ্যাম্বুলেন্সে ছুটে যাচ্ছে
পেছনে পড়ে থাকছে নিস্পৃহ প্রেসক্লাব, শিল্পকলা, বাংলা একাডেমি আর সবুজ শেওলা পড়া বঞ্চিত শহিদ মিনার
শিল্পের অচলায়তন অতিক্রম করে
আস্ত একটি দেশ কাফনে পুরে
শতবর্ষী ঈগলের ডানায় অনন্তের উদ্দেশ্যে উড়াল দিলেন আল মাহমুদ।
সময় ও শস্যমঞ্জরি
সুলাইমান সাদী
একজন বলিষ্ঠ কণ্ঠে গেয়ে উঠল, ও নীল দরিয়া—
একজন হাঁটা দিল হ্যামিলনের দিকে
একজন রাত গভীর হতেই খিঁচতে থাকল
গলায় শেকল জড়িয়ে চারদিকে হম্বিতম্বি করতে লাগল কেউ
গাঢ় লাল হতাশার মেঘ এসে নিমেষে সব ওলটপালট করে দিল
একটা বুনোফুল সাদা ও বেগুনি রঙের দোহায় দিয়ে গাইতে থাকল গান
কিসমতে যদি বসন্ত না থাকে বরষার উৎপাতই শহরে সহজিয়া গায়
একদিন একজন মনের সুখে কবিতা পাঠ করবে
একদিন একজন হ্যামিলন থেকে ফিরে আসবে
সুখনিদ্রায় জপতে থাকবে প্রেমিকার নাম
সংগ্রামী চিঠি ওড়াতে ওড়াতে আকাশের পথে যাত্রা করবে মুক্ত স্বাধীন
আমি তাওবা পারি না
রাকিবুল হাসান
আমার প্রার্থনায় অধিকাংশ সময় শব্দ থাকে না
থাকে অক্ষমতা, অসহায়ত্ব,
থাকে কিছু পুড়ে যাওয়া অনুতাপ, কয়লার মতো কালো দীর্ঘশ্বাস;
প্রার্থনায় বসলেই আমি বোবা হয়ে যাই, বধির হয়ে যাই হঠাৎ।
মা বলেন, ‘এ কেমন প্রার্থনা?’
আমি শ্বাস ফেলি, ‘কী করবো? এত মিনতি, এত চাওয়া শব্দে বাঁধা যায়!’
তাসবি দানায় মায়ের আঙুল চলে, ‘যতটুকু বাঁধতে পারিস।’
আমি এক চিমটি হাসি, ‘শব্দে যা বলা যায় না, চোখের জলে তা বলা যায়। জাহান্নামের আগুন নিভবে চোখের জলে, শব্দের আঘাতে নয়।’
আমি তাওবা পারি না;
জল ছলছল চোখে তাই তাকিয়ে থাকি, তাকিয়েই থাকি
পৃথিবীর সবচে বোকা মানুষটির মতো—
আমার শব্দহীন প্রার্থনা ভেসে যায় কান্নাজলে, ভেসে যায়;
আমি আমার সমস্ত অক্ষমতা নিবেদন করে বলি, ‘ক্ষমা করো প্রভু, ক্ষমা করো।’