
আবদুল আযীয:
এক
উমাইয়া খেলাফতের তখন ক্রান্তিকাল। ক্ষমতার সলতে নিভু নিভু। জায়গায় জায়গায় চলছে আব্বাসীদের বেবাক প্রচার-প্রচারণা। উমাইয়ারা বুঝতে পারছে তাদের সামনে ধেয়ে আসছে মহাবিপদ। খেলাফতের আসনে তখন আসীন মারওয়ান বিন মুহাম্মদ। ইনিই ছিলেন উমাইয়াদের শেষ খলীফা। তারই একজন সামান্য সেনা অফিসার হলেন হানি বিন সাব্বাহ। মারওয়ানের সেনাবাহিনীতে বেশ সুনামের সঙ্গেই দায়িত্ব পালন করেন তিনি। তার জন্ম দিমাশকে। উমাইয়াদের রাজধানী শহরে। দিমাশকী হওয়ার সুবাদে খুব দ্রুতই তিনি প্রমোশন পেয়েছেন। তাকে এক প্লাটুন সৈন্য দিয়ে আহওয়াযের সীমান্তরক্ষী বাহিনীতে পাঠানো হলো। তার বিবাহের সময় ঘনিয়ে এসেছে। যৌবনের প্রচণ্ড তাড়া অনুভব করছেন হানি। আহওয়াযে থাকতেই তার পছন্দ হয়ে যায় এক সুদেহী নারীকে। নাম তার জোলবান। মহাসমারোহে জোলবান খাতুনের সঙ্গে তার বিবাহ সম্পাদিত হলো। জোলবান একজন সেনা অফিসারের স্ত্রী হিসেবে নিজেকে ভাগ্যবতীই মনে করলেন।
বছরখানেক পর এ দম্পতির ঘর আলো করে তাদের কোলজুড়ে এলো এক সুদর্শন শিশু। চোখেমুখে একটি দীপ্ত ঝলক লক্ষণীয়। বাবা-মা উভয়েই ভীষণ খুশি। তারা সন্তানের নাম রাখলেন হাসান। হাসান মানে হচ্ছে সুন্দর। নামে যেমন কাজেও তেমন। দু’বছর অব্দি আহওয়াযের সীমান্তশহরেই বেড়ে উঠলো শিশু হাসান। জন্মের পর থেকেই তার মধ্যে লক্ষ্য করা যাচ্ছিলো প্রতিভার দ্যুতি। হানি সীমান্তরক্ষার কাজে ভীষণ ব্যস্ত। জোলবান খাতুন বাচ্চার খেয়াল করলেও এতটা গভীরভাবে লক্ষ্য করতে পারেননি নিজের বাচ্চার মেধা আর প্রতিভার বিষয়টা।
দু’বছর পর আহওয়ায থেকে বসরার পথে রাওয়ানা করলেন তারা। বাবা হানি বদলি হলেন বসরায়। তিনি পুরো পরিবার নিয়েই হাজির হলেন সেখানে। সেনাবাহিনীর পরিবারে কোন স্থিতি থাকে না। আজকে তারা এখানে তো কাল আরেক শহরে। এভাবে তাদের এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় পালাবদল করে যেতে হয়। এদিকে রাজনৈতিকভাবেও ঘটে গেছে বিরাট বিপ্লব। উমাইয়াদের পতন হয়েছে আব্বাসীদের হাতে। সাফফাহের লোকদের হাতে প্রাণ হারিয়েছে উমাইয়া পরিবারের বহু সদস্য। অনেকে প্রাণ রক্ষায় পালিয়ে বেড়াচ্ছেন এক শহর থেকে আরেক শহরে। হানির জন্মভূমি দিমাশক তখন মৃত্যুপুরী। সে হিসেবে বসরায় বদলি হওয়ায় তার জন্য ভালোই হয়েছে।
দুই
বসরা তখন তারাদের হাট। জ্ঞানীদের বিশাল এক কাফেলা তখন বসরা দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। হাসান বসরী রাহিমাহুল্লার ছাত্ররা সমাজে ধর্মীয় বিষয়ে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। তাবে তাবেয়ীনের বিশাল এক দল সেখানে পাঠদানরত আছেন। সুফীদের একটি জামাতও এখানে আছেন। যারা ইবাদতের জন্য নিজেদের ওয়াকফ করে দিয়েছেন। ইবাদতই তাদের দিবানিশির নিমগ্নতা। আরবী ভাষাবিদদের দলও এখানে। মৌমাছির মতো ছাত্রের দল এখানের মহিরুহ শিক্ষকদের কাছ থেকে আহরণ করছে জ্ঞানসুধা। হানির শিশুপুত্র হাসানের বেড়ে ওঠা এ মহান শহরে। হাসান কুরআনের পাঠ গ্রহণ করলো বিখ্যাত কেরাতের ইমাম ইয়াকুব আল হাদরামীর কাছে। আরবী ব্যাকরণ শিখলো আবু যায়দ নাহবী নামের এক ভাষাশাস্ত্রীয় পণ্ডিতের কাছে।
এরপর হাসান শিখতে গেলো হাদিসশাস্ত্র। হাদিসশাস্ত্রের অনেক বড় বড় দিকপাল তখন বসরায়। হাসানের শিক্ষকদের মধ্যে কয়েকজনের নাম বলছি। বিখ্যাত ইমাম হাম্মাদ বিন যায়েদ, ইয়াহয়া বিস সাঈদ আল কাত্তান, আব্দুল ওয়াহেদ বিন যিয়াদ, মুতামির বিন সুলাইমান এবং আযহার বিন সা’দ আস সাম্মান সহ একটি জামাত। ইতিহাসের পাঠ গ্রহণ করলো ইমাম আবু ওবায়দ মা’মার বিন মুসান্না থেকে।
হাসান সিবওয়াইহের বিখ্যাত গ্রন্থ ‘আল কিতাব’ পাঠ করেছে অত্যন্ত অভিনিবেশে। এদের মতো মহান শিক্ষকদের সান্নিধ্যে হাসানের একটি ইলমি সত্তা তৈরি হয়ে গেলো। শৈশবের পবিত্র সময়টা সে কাটিয়েছে এ জ্ঞানের পরিবেশে। এখানকার লোকদের মধ্যে বিশুদ্ধ আরবী ভাষা চর্চা বেগবান থাকার ফলে এখানকার সাধারণ মানুষদের মধ্যেও গড়ে উঠেছিলো বিশুদ্ধ সাহিত্যরুচি। তারা স্বাভাবিক কথাবার্তাও বলেন সাহিত্যের রং মাখিয়ে। এখানেই গড়ে উঠেছে আরবী ব্যাকরণের অন্যতম স্কুল অফ থট বসরা স্কুল। আরবী ভাষার ছাত্ররা যাদের বসরী বলে চেনে। কুফী-বসরী তর্ক-বিতর্ক আরবী ভাষার ছাত্রদের অন্যতম আগ্রহের বিষয়। শিশু হাসান এ পরিবেশেই বড় হচ্ছে। তার ভেতর যে অবচেতনভাবে একটি কবিহৃদয় বেড়ে উঠছে এটা খোদ তারও জানা ছিলো না। শিশু হাসান ধীরে ধীরে বড় হচ্ছে। হাসানের মা জোলবান খাতুন তাকে একজন আতর ব্যবসায়ীর কাছে পাঠিয়ে দিলেন ব্যবসা শেখার জন্য। হাসান চলে গেলো তার কাছে। ব্যবসা আসলে তার ধাতে ছিলো না। তবু মায়ের কথা মান্য করে হাসান আতর ব্যবসায়ীর কাছে এসে ব্যবসা শেখায় মনোনিবেশ করেছে।
আল্লাহর ইচ্ছে ছিলো ভিন্ন। হাসানকে একদিন গভীরভাবে লক্ষ্য করলেন আবু ওসামা ওয়ালিবা বিন হুবাব নামে এক ভদ্রলোক। তিনিও মূলত একজন কবি। একজন কবিই প্রকৃতপক্ষে চিনতে পারেন অপর কবিকে। তরুণ হাসানের মধ্যে কাব্যপ্রতিভা আছে এ বিষয়টা এ কবি অনুভব করতে পারলেন অনায়াসে। কিন্তু তিনি থাকেন কুফায়। বসরায় এসেছেন সাময়িক কোন কাজে। ওয়ালিবার ইচ্ছে হলো এ তরুণ কবিকে তিনি কুফায় নিয়ে যাবেন। নিজের সঙ্গে রেখে হাত ধরে শিখিয়ে দেবেন কবিতা। আবু ওসামা এ ইচ্ছেটা শুধু মনে মনেই পুষে রেখে ক্ষান্ত হলেন না। একদিন তাকে বলেই ফেললেন, বাবা হাসান তুমি কি আমার সঙ্গে যাবে কুফায়? আমি তোমার চোখে অনেক কিছু দেখতে পাচ্ছি। তোমার কপালে আমি দেখতে পাচ্ছি প্রতিভার ঝলক। তুমি এ প্রতিভা সাধারণ ব্যবসার কাজে ধ্বংস করে ফেলো না। আমার মন বলছে, তুমি একদিন বিশাল কবি হবে। অবলীলায় রচনা করবে কালজয়ী সব কবিতা। চলো তুমি আমার সঙ্গে। কুফায় চলো। আমি নিজেই তোমাকে তত্বাবধান করবো। হাসান বললো, আপনি কে? কি আপনার পরিচয়? তিনি বললেন, আমি আবু ওসামা ওয়ালিবা বিন হুবাব। হাসান বললো, ওহ্ আমি তো আপনাকেই খুঁজছিলাম মনে মনে। আমার বহুদিনের ইচ্ছে, আপনার কাছ থেকে কবিতা শুনবো। কবিতা শিখবো। আমি কুফায় যেতে রাজি।
মায়ের কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে শিশু হাসান চললো কুফার পথে একজন কবির হাত ধরে। তার মনে বিশাল স্বপ্ন সে একদিন কবি হবে। কিন্তু না, তিনি কবি আবু ওসামার সঙ্গে চলে এলেন বাগদাদে। আব্বাসী খেলাফতের সূচনা হয়ে গিয়েছে। এর মধ্যে প্রশাসনিক রাজধানী যেমন বাগদাদে প্রত্যাবর্তন করেছে, ঠিক তেমনই জ্ঞানকাণ্ডেরও রাজধানী হয়ে উঠেছে বাগদাদ। এখানেই থাকতে চায় সে কবিতা শিখতে। এখন থেকে হাসানের স্থায়ী আবাস হয়ে উঠলো আরব্য রজনীর স্বপ্নের শহর বাগদাদ। আমৃত্যু হাসান এ শহরে বসবাস করেছেন। এখানেই হয়েছিলো হাসানের ইহলোকের সমাপ্তি। হাসান কি জানতো বড় হয়ে লোকে তাকে চিনবে বিখ্যাত কবি আবু নুওয়াস নামে?
তিন
এ হাসান বিন হানি-ই একদিন বিখ্যাত হয়েছিলেন আবু নুওয়াস নামে। আবু নুওয়াসের একেবারে শৈশবে রচনা করা কিছু পংক্তি এমন:
ভালোবাসা বয়ে বেড়ায় যে হৃদয়,
তাকে হালকা করতে পারে কেবল প্রিয়তমার মিষ্টি হাসি।
যদি সে কেঁদে ওঠে তবে সেটা বাস্তবেই কান্না
নয় কোন কৃত্তিমতা বা তামাশা।
প্রিয়া, তুমি হাসছো! অথচ প্রেমিক কেঁদে বুক ভাসাচ্ছে?
আমার বিমারি দেখে তুমি অবাক হচ্ছো? অথচ আমার সুস্থতাই তো বিস্ময়ের!
একেবারে শৈশবে রচিত এ পংক্তিগুলোই তার কাব্যিক প্রতিভার জানান দিচ্ছিলো। অপেক্ষা করছিলো একটি উজ্জ্বল ভবিষ্যতের। সময়ের পরিক্রমায় আবু নুওয়াস হয়ে ওঠেছিলেন বিখ্যাত কবি। তার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিলো পূব থেকে পশ্চিমে, উত্তর হতে দক্ষিণে। তার সমসাময়িকরাও মেতেছেন তার উচ্চ প্রশংসায়। অথচ সমকালীনদের স্বীকৃতি পাওয়া কতটা দুরূহ তা ভুক্তভোগী মাত্রই জানেন। আবু নুওয়াসের সমকালীন বিখ্যাত মনীষীদের কাছে তার সম্পর্কে কিছু মন্তব্য শুনে আসি তাহলে।
আরবি ভাষার কবিদের বেশ কয়েকভাগে ভাগ করেছেন পণ্ডিতরা। ইসলামপূর্ব জাহিলি যুগে যারা কবিতা লিখেছেন, রচনা করেছেন, তাদেরকে বলা হয় জাহিলিয়্যিন। ইসলাম আসার অব্যবহিত পর যারা কাব্যচর্চায় উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছেন, তাদের বলা হয় ইসলামিয়্যিন। এরপরের আরেক ক্যাটাগরি আছে, যাদের নাম দেওয়া হয়েছে মুওয়াল্লাদিন বা মুহদাসিন নামে। আবু নুওয়াস ছিলেন তৃতীয় ক্যাটাগরির। এটি প্রকৃতপক্ষে যুগবিবেচনায়। কাব্যের শিল্পগুণ বিবেচনায় নয়। তবু বাস্তবতার বিচারে জাহিলি যুগের কবিরা যে খাঁটি আরবি কবিতা রচনা করেছেন পরবর্তীরা তেমনটি পারেননি। কারণ জাহিলিযুগ পর্যন্ত আরবরা অন্য সংস্কৃতির স্পর্শে আসেনি খুব একটা। ইসলাম আসার পর অনারবদের প্রভাব সবকিছুতেই পড়েছে। ফলে খাঁটি ও পিউর কাব্য আর বাকি থাকেনি। জাহিলি যুগের কবিদের মধ্যে সবচে’ খ্যাতিমান ছিলেন কবি ইমরুল কায়েস। আবু নুওয়াসের শিক্ষক আবু ওবায়েদ মা’মার বিন মুসান্না মন্তব্য করেছেন, জাহিলি কবিদের মধ্যে ইমরুল কায়েসের যে অবস্থান ঠিক মুহদাসিন কবিদের মধ্যে আবু নুওয়াসের অবস্থান।
ইসমাইল বিন নুবখত বলেন, আবু নুওয়াসের চেয়ে সমৃদ্ধ জ্ঞানের অধিকারী আমি কাউকে দেখিনি। বইপত্রের স্বল্পতা সত্ত্বেও তার মতো স্মৃতিশক্তির অধিকারী আমি কাউকে পাইনি। মৃত্যুর পর আমরা তার ঘর তন্ন তন্ন করে খুঁজে দেখলাম। সেখানে আমরা কেবল বইয়ের একটি সিন্দুক পেলাম। যেখানে ছিলো বেশ কিছু বই ‘গরিবুল হাদিস’ ও ব্যাকরণ সংক্রান্ত। আর কিছু পাওয়া গেলো না।
বিখ্যাত আরবি সাহিত্যিক আবু উসমান আল জাহিয বলেছেন, আমি ভাষা সম্পর্কে আবু নুওয়াস থেকে বড় জ্ঞানী আর কাউকে দেখিনি। তার মতো অকৃত্তিম বিশুদ্ধ ও মিষ্টভাষী আর কাউকে পাইনি। জাহিয আরও বলেন, একদিন আমি নাযযামে মুতাযিলিকে দেখলাম আবু নুওয়াসের মদ বিষয়ক কোন কবিতা পাঠ করছেন। এরপর নাযযাম মন্তব্য করলেন, আমার মনে হয় এ লোকটার জন্য শব্দ ভাণ্ডার জমা করে রাখা আছে। আর সে সেখান থেকে বেছে বেছে কবিতা নির্মাণ করছে।
মাইমুন বলেন, একদিন আমি ইয়াকুব ইবনুস সিক্কিতকে অনুরোধ করলাম কবিদের কিছু নির্বাচিত কবিতা চয়ন করে দিতে। তখন তিনি বললেন, জাহিলি কবিদের মধ্যে ইমরুল কায়েস ও আ’শা, ইসলামিয়্যিনদের মধ্যে জারির ও ফারাযদাক এবং মুহদাসিনদের মধ্যে আবু নুওয়াসের কবিতা পাঠ করাটাই তোমার জন্য যথেষ্ট।
একবার আবু মুনাযির এলেন ইমামুল মুহাদ্দিসিন সুফিয়ান বিন উয়াইনার কাছে। সুফিয়ান তাকে লক্ষ্য করে বললেন, তোমাদের ঐ রসিক লোকটা সবচে’ বড় কবি। আবু মুনাযির বললেন, আপনি কার কথা বলছেন, আবু নুওয়াসের? তিনি বললেন হ্যাঁ। আবু মুনাযির বললেন, তার কোন কবিতা আপনাকে এ অনুভূতি দিয়েছে? তিনি আবু নুওয়াসের কিছু পংক্তি আওড়ালেন। যেগুলোর সারাৎসার হলো এরকম:
হে চাঁদ, আমি তাকে দেখেছি বন্ধুদের ভীড়ে শোকে কাঁদছে
শোকই তাকে বের করে এনেছে বাধ্য হয়ে। অথচ কত প্রহরী আর ধাত্রীদের প্রহরা ছিলো।
সে কাঁদছে যেনো চোখ হতে মুক্তা ঝাঁড়ছে। যেনো উন্নাব ফুল দিয়ে আঘাত করছে গোলাপের গায়ে।
তার বন্ধুদের সর্বদা অভ্যেস হলো মৃত্যু, আর আমার কাজই হলো তাকে নিবিড়ভাবে দেখা।
ইবনু আয়েশা বলেন, আমরা একবার গেলাম আবদুল ওয়াহেদ বিন যিয়াদের কাছে। আমাদের সঙ্গে আবু নুওয়াসও ছিলো। আবদুল ওয়াহেদ বললেন, তোমরা হাদিস জিজ্ঞেস করতে পারো। সবাই একে একে জিজ্ঞেস করলো। তারপর তিনি আবু নুওয়াসকে বললেন, হে তরুণ বলো তোমার হাদিস? আবু নুওয়াস কবিতার সুরে বলে উঠলেন: আমি বর্ণনা করি সাঈদ বিন আবু আরুবার সূত্রে। তিনি ক্বাতাদা থেকে, তিনি সাঈদ ইবনুল মুসাইয়াব থেকে, তিনি সা’দ বিন ওবাদা থেকে বর্ণনা করেছেন, নবীজী বলেন, প্রেমিক হয়ে যে মারা যাবে তার মৃত্যু হবে শাহাদাতের মৃত্যু।
আবদুল ওয়াহেদ এ ফাজলামি দেখে একেবারে রেগে গেলেন। বললেন, আমার সামনে থেকে দূর হয়ে যা খবিস কোথাকার। আমি তোমাকে জেনেশুনে কোন হাদিসই বর্ণনা করিনি। (এটা ছিলো মূলত তার রসিকতার প্রবণতা থেকে)
চার
আবু নুওয়াসের ঠাট্টা-রসিকতা ছিলো প্রবাদতুল্য। এমনকি ঠাট্টাকারী কবি হিসেবে খ্যাতি লাভ করেছিলেন তিনি। তাছাড়া তার ছিলো প্রত্যুৎপন্নিমতিত্বের গুণ। তাকে প্রশ্ন করে থামানো যেতো না। কৌতুক ছিলো তার রন্ধ্রে রন্ধ্রে। খলীফা হারুনুর রশিদের সঙ্গে তার পরিচয়পর্বটা ছিলো অদ্ভুত। ইশার নামায চলছিলো। নামাযে অংশগ্রহণ করেছেন স্বয়ং আমিরুল মুমিনিন হারুনুর রশিদ। ইমাম সাহেব পাঠ করলেন, কুল ইয়া আইয়ুহাল কাফিরুন। আবু নুওয়াস চিৎকার করে বলে উঠলো, লাব্বাইক। এর সরল অর্থ সেও কাফির। নামায শেষে লোকজন ঝাঁপিয়ে পড়লো তার ওপর। হুলস্থুল কাণ্ড ঘটে গেলো মসজিদ প্রাঙ্গণে। জিজ্ঞাসাবাদ করা হলে সবাই সাক্ষী দিলো তার কুফরের ব্যাপারে। তার বিষয়টি স্বয়ং খলীফার দরবারে উত্থাপিত হলো।
এরই মধ্যে ‘যিন্দিক দমন বাহিনী’র প্রধান হামদুয়াহ সাহেব তার ব্যাপারে প্রাথমিক তদন্ত সেরে ফেলেছেন। খলীফা তাকে দরবারে হাজির হবার নির্দেশ দিলেন। সাথে হামদুয়াহকেও। তারা যখন দরবারে প্রবেশ করলেন, সারা কক্ষজুড়ে পিনপতন নিরবতা। খলীফা হামদুয়াহকে জিজ্ঞেস করলেন আবু নুওয়াস সম্পর্কে। কী সমস্যা পেলে? হামদুয়াহ বিনীত কণ্ঠে বললেন, আমিরুল মুমিনিন, আমি তাকে খুব ভালো করে চিনি না। তবে আমার মনে হয়েছে সে ভাঁড় ও ফাজিল টাইপের লোক। যিন্দিক নয়। হারুনুর রশিদ বললেন, না আমাকে একটু পরীক্ষা করতে হবে বিষয়টা। একজন শিল্পীকে দিয়ে আবু নুওয়াসের একটি চিত্র আঁকা হলো। এরপর আবু নুওয়াসকে নির্দেশ দেওয়া হলো সেখানে থুতু ফেলতে। আবু নুওয়াস করে বসলো এক অদ্ভুত কাণ্ড। সে মুখে হাত ঢুকিয়ে দিলো বমি করার নিমিত্তে। কিন্তু তার বমি এলো না। এরপর বাধ্য হয়েই সেখানে শ্লেষ্মা ফেললো। হারুনুর রশিদ বুঝে ফেললেন এ আসলে কোন যিন্দিক নয়, গোপাল ভাঁড় টাইপের কেউ।
ঘটনাক্রমে তখন খলীফার দরবারে আরেকজন যিন্দিককে হাজির করা হলো। হারুনুর রশিদ তাকেও একই পরীক্ষার সম্মুখীন করলেন। যিন্দিক লোকটি বললো, কোন সম্ভ্রান্ত মানুষের কাজ নয় কোন ছবিতে থুতু নিক্ষেপ করা। খলীফা নির্দেশ দিলেন, উভয়কে ইবনে শাহিকের কাছে নিয়ে যেতে। সে যেন আবু নুওয়াসকে শিষ্টাচার শিক্ষা দিয়ে ছেড়ে দেয়, এবং ঐ যিন্দিককে তওবা করা পর্যন্ত বন্দী করে রাখে। উভয়কেই একটি ঘরে আনা হলো। পথে একজন কর্মচারীকে আবু নুওয়াস জিজ্ঞেস করলো, আমিরুল মুমিনিন কি নির্দেশ দিয়েছেন? সে হয়তো ফাজলামি করে বললো- তোমাকে বন্দী করতে আর ওকে শিষ্টাচার শিখিয়ে ছেড়ে দিতে। আবু নুওয়াস এ সুযোগ মোটেই ছাড়লো না। কষে একটা থাপ্পড় বসিয়ে দিলো ঐ কর্মচারির গণ্ডদেশে। আর বললো, ওহে ব্যভিচারিনীর বাচ্চা! আমিরুল মুমিনিন যা বলেছেন সেটা ঠিকভাবে করো।
খলীফার কাছে এ সংবাদ পৌঁছলে তাদেরকে আবার আসতে নির্দেশ করলেন। এরপর আবু নুওয়াসকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কেন ওকে মেরেছো? আবু নুওয়াস দ্বিধাহীন চিত্তে বললো, সম্মানিত আমিরুল মুমিনিন! এ লোকটি আপনার নির্দেশের পুরো উল্টোটা বলেছে। সে চেয়েছে আমাকে বন্দী করে ঐ যিন্দিকটাকে ছেড়ে দিতে। খলীফা তার কথা শুনে হেসে ফেললেন। বললেন, যাও তুমি মুক্ত।
আবু নসর বলেন, একবার আমি দেখলাম আবু নুওয়াস মসজিদ ঝাড়ু দিচ্ছে। আমি তো পুরাই অবাক। এ কাজ তো আবু নুওয়াসের মতো লোক কখনোই করবে না। আমি যখন কৌতূহলী দৃষ্টিতে তার দিকে তাকাচ্ছিলাম সে আমাকে বললো, আমি চাই আজ আকাশে একটি মজার সংবাদ পৌঁছুক। অর্থাৎ এটা খুবই মজার একটা ব্যাপার। আকাশে তথা আল্লাহর কাছে যেনো এ সংবাদ পৌঁছে।
একবার এক ভিক্ষুক এসে আবু নুওয়াসকে বললো, আপনার জুব্বাটা আমাকে দিয়ে দিন। আবু নুওয়াস বললো, আমার কাছে আর কিছুই নেই। এটা দিয়ে দিলে আমি একেবারে ফকির। তখন ফকির একটি আয়াত শুনিয়ে দিলো: ‘তারা নিজেদের ওপর অন্যকে প্রাধাণ্য দেয়, যদিও তারা নিজেরা অভাবগ্রস্ত হয়।’ আবু নুওয়াস তৎক্ষণাৎ বললো, এ আয়াত অবতীর্ণ হয়েছে জুলাই মাসে হিজাযবাসীদের উদ্দেশ্যে। এটি জানুয়ারী মাসে বাগদাদবাসীর ওপর অবতীর্ণ হয়নি। তার কথা শুনে ভিক্ষুক একেবারে চুপ।
পাঁচ
হারুনুর রশিদের পুত্র খলীফা আমিনের দরবার। দেশের বিশিষ্ট নাগরিকদের সম্মানে আয়োজন করা হয়েছে বিশেষ অনুষ্ঠান। খলীফার প্রায় সকল সভাসদই অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেছেন। জমকালো আয়োজন। এটি ছিলো খিলআত তথা শাহি পুরস্কার প্রদানের অনুষ্ঠান। প্রশাসনের বিভিন্ন সেক্টরে অবদান রাখার কারণে বিভিন্ন মানুষকে পুরস্কৃত করা হবে। সভাসদদের মধ্যে উপস্থিত আছেন কবি আবু নুওয়াসও। সবাই নিজ নিজ আসন গ্রহণ করেছে। একে অপরের সঙ্গে খোশগল্পে মেতে আছে সবাই। খলীফা এখনও আসেননি। একটা খুশি খুশি আমেজ সবার মধ্যে। একটু পরেই খলীফা আমিন হাজির হলেন মহাসমারোহে। আমিন সর্বোচ্চ সাজসজ্জা গ্রহণ করে একটি সিংহাসনে আরোহণ করেছেন। সে আসনটি বহন করে নিয়ে এসেছে তার সেবকরা। আবু নুওয়াস এ দৃশ্য দেখে এ আয়াত পড়তে শুরু করলো:
إن آية ملكه أن يأتيكم التابوت فيه سكينة من ربكم وبقية مما ترك آل موسى وآل هارون تحمله الملائكة.
এর অর্থ হচ্ছে, ‘তার রাজত্বের নিদর্শন হলো তোমাদের কাছে একটি সিন্দুক আসবে যেখানে থাকবে তোমাদের প্রতিপালকের পক্ষ থেকে প্রশান্তি, এবং মূসা এবং হারুনের পরিবারের কিছু অতিরিক্ত জিনিসপত্র’ আবু নুওয়াস যেনো বোঝাতে চাইলো এ সিংহাসন একটি সিন্দুক সদৃশ। সেখানে উপবিষ্ট আমিরুল মুমিনিন হলো জনগণের জন্য প্রশান্তি স্বরূপ। আবার তিনি তার পূর্বপুরুষ মূসা আল হাদি এবং হারুনুর রশিদের উত্তরাধিকারী। খলীফা আবু নুওয়াসের এ প্রত্যুৎপন্নমতিত্বে ভীষণ মুগ্ধ হলেন। অঢেল পুরস্কারে সম্মানিত করলেন তাকে।
ছয়
জিনান নামে একজন বাদী ছিলো। সাহিত্যিক, বুদ্ধিমতী এবং গল্পকার। সে ছিলো বিখ্যাত মুহাদ্দিস আবদুল ওয়াহহাব বিন আব্দুল মাজিদ আস সাকাফীর অধীনে। আবু নুওয়াস এ মেয়েটির প্রেমে পড়ে গেলো। তার প্রেমে একাকার হয়ে প্রচুর কবিতা লিখলো সে। মেয়েটি তাতে প্রেমে পড়লো কিনা বোঝা গেলো না। একবার আবু নুওয়াস খবর পেলো জিনান এবার হজের সফরে বের হবে। আবু নুওয়াস এ সংবাদ শুনে হজে যেতে প্রস্তুত হয়ে গেলো। আবু নুওয়াস বললো, এবার আমাকে হজ করতেই হবে। জিনানের সঙ্গ ত্যাগ করা যাবে না এ সফরে, যদি সে সত্যিই সফরের প্রতিজ্ঞা করে। লোকেরা ভেবেছিলো আবু নুওয়াস ঠাট্টা করছে। আবু নুওয়াস প্রতিজ্ঞা করে বসেছিলো। যখন নিশ্চিত হলো জিনান অবশ্যই বের হবে তখন দেখা গেলো আবু নুওয়াস জিনানের আগেই বের হয়ে গেলো হজের উদ্দেশ্যে। তার এ হজের সফরের একমাত্র অনুঘটক ছিলো এ জিনানের হজ। হজ করে আবু নুওয়াস যখন ফিরে এলো তখন চমৎকার কিছু পংক্তি রচনা করলো:
তুমি কি দেখো না আমি তাকে পেতে জীবন নিঃশেষ করে দিয়েছি,
তাকে পাওয়া সত্যিই ভীষণ কঠিন।
তাকে পাওয়ার কোন সূত্র যখন আমি খুঁজে পাচ্ছিলাম না,
সব সূত্রই আমাকে ব্যর্থ আর ক্লান্ত করে দিলো।
তখনই আমি জানতে পারলাম জিনানের হজের কথা। আমি হজ
করলাম। এই ছিলো আমাদের মিলনের সূত্র।
প্রত্যক্ষ্যদর্শীরা জানালো, আবু নুওয়াসের সঙ্গে একই কাফেলায় ছিলো জিনান। রাত যখন অন্ধকারে ছেয়ে যেতো, তখন আবু নুওয়াস ছন্দে ছন্দে অসাধারণ সুরে তালবিয়া পাঠ কতেন। আবু নুওয়াসের সে তালবিয়ার সারমর্ম এরকম:
হে প্রভু, কতোই না ন্যায়বান তুমি
সকল রাজাদের তুমি রাজা, বাদশাহদের বাদশাহ।
লাব্বাইক হে রব, আমি হাজির,
সকল স্তুতি তোমারই সকাশে নিবেদিত
সকল রাজত্ব তোমারই, নেই কোন অংশীদার
রাতের শপথ যখন সে ছেয়ে যায় দিগন্তজুড়ে
আকাশের যাত্রাপথে থাকা তসবিহপাঠে নিমগ্ন সহস্র তারকার শপথ
তোমার কাছে আশা রেখে ব্যর্থ হয়নি কোন বান্দা, যেখানেই সে গিয়েছে পেয়েছে তোমায়।
তুমি যদি না হতে হে রব, ধ্বংস হয়ে যেতো নবী আর ফিরেশতাকূল।
হে পাপী, কত উদাসীন তুই! দ্রুত ফিরে আয় সময়ের আগে;
শেষ যেন হয় তোর সর্বশ্রেষ্ঠ কাজে।
লাব্বাইক, আমি হাজির হে প্রভু।
সকল প্রশংসা ও অনুগ্রহ তোমারই দান,
নেই কোন অংশীদার, একমাত্র তোমারই প্রাপ্য সকল সম্মান।
স্বভাবে যতই রসিকতা আর ঠাট্টা থাকুক না কেনো; কবিতাগুলো ছিলো অসাধারণ। আরবী ভাষার রুচিবান পাঠকমাত্রই এর স্বাদ উপলব্ধি করতে পারবেন।
সাত
মাসলামা বিন হাদি। একবার তার সাক্ষাত হলো কবি আবুল আতাহিয়ার সঙ্গে। আবুল আতাহিয়াও বিখ্যাত কবি। মাসলামা তাকে হাতের কাছে পেয়ে দীর্ঘদিন ধরে মনের কোণে পুষে রাখা প্রশ্নটি করেই ফেললো। আচ্ছা বলুন তো সবচে’ বড় কবি কে? আবুল আতাহিয়া বললেন, জাহিলি কবিদের মধ্যে, না ইসলামি কবিদের মধ্যে না মুহদাসিনদের মধ্যে? মাসলামা বললেন, সবার মধ্যে। আবুল আতাহিয়া কারো নাম কোট না করে বললেন, এ পংক্তিদ্বয় যে বলেছে সেই আমার কাছে শ্রেষ্ঠ কবি। পংক্তিদ্বয় হলো:
إذا نحن أثنينا عليك بصالح+ فأنت كما نثني وفوق الذي نثني
وإن جرت الألفاظ منا بمدحه+ لغيرك إنسانا فأنت الذي نعني
অর্থ: যদি আমি তোমার কোন ভালো কাজের প্রশংসা করি,
তবে আমি মোটেই বাড়াবাড়ি করিনি বরং তুমি আমার প্রশংসার উর্ধ্বে
যদি আমার পক্ষ থেকে তুমি ছাড়া অন্য কারো স্তুতি বেরিয়ে পড়ে,
তবে মনে রেখো এর উদ্দেশ্য একমাত্র তুমিই।
দুনিয়বিমুখতা নিয়ে যে কবির মহান উচ্চারণ:
وما الناس إلا هالك وابن هالك+ وذو نسب في الهالكين عريق
إذا امتحن الدنيا لبيب تكشفت+ له عن عدو في ثياب صديق.
অর্থ: অর্থ মানবজাতি মাত্রই নশ্বর অথবা নশ্বরের সন্তান,
সম্ভ্রান্ত বংশের লোকটাও সে ধ্বংসশীলদের তালিকায়।
কোন বুদ্ধিমান যদি কভু পরীক্ষা করে এ তল্লাটকে
বন্ধুর কাপড়ে শত্রুবেশেই সে আত্মপ্রকাশ করে।
বলাই বাহুল্য, উভয় কবিতাই কবি আবু নুওয়াসের অমর কবিতাগুলোর অন্তর্ভুক্ত। ঠাট্টাচ্ছলেও এ কবি তুলে ধরেছেন বহু বাস্তব চিত্র। মাসলামা বলেন, এরপর আমি কবি আত্তাবীর সঙ্গে সাক্ষাত হলে তাকেও একই প্রশ্ন করি। তিনিও উত্তর দেন, সেরা কবি আবু নুওয়াস। তার শ্রেষ্ঠত্বের সাক্ষ্য দিয়েছেন স্বয়ং খলীফা মামুনুর রশিদ। খলীফা মামুনের সাহিত্যানুরাগ, কাব্যরুচি সর্বজনবিদিত। আব্বাসী খলীফাদের মধ্যে সবচেয়ে শিক্ষিত বলে যাকে স্বীকৃতি দিয়েছেন ঐতিহাসিকগণ। প্রতিভার কোন কমতি ছিলো না তার মধ্যে। তবে তার মধ্যে ঠাট্টা আর রসিকতা সবসময় প্রবল ছিলো। এ অভ্যাস তিনি ছাড়তে পারেননি। বলা হয়, তিনি মদও পান করতেন। তবে এ তথ্য বিশ্বাস করা কিছুটা কঠিন বটে। শুশ্রুহীন বালকদের প্রতি তার আগ্রহের কথাও ইতিহাসের বইপত্রে পাওয়া যায়। কবিরা এমনিতেই এরকম গাছাড়া ভাবের হয়ে থাকেন। সবকিছু ছাপিয়ে তাদের কাব্যপ্রতিভাই তাদের অমর করে রাখে ইতিহাসের পাতায়। দোষগুণের মিশ্রণেই মানুষ। তাই ব্যক্তিকে মাপতে হয় তার সৃজনগুণ দিয়ে। তার দোষের বিষয়টাকেও একেবারে এড়িয়ে যাওয়া যায় না।
আট
ইমাম আবু আবদিল্লাহ মুহাম্মদ বিন ইদরিস আশ শাফেয়ী। চার ইমামের একজন। যার অনুসারী ছড়িয়ে আছে সমগ্র পৃথিবীজুড়ে। ইমাম নিজেও ছিলেন একজন স্বভাব কবি। তবে তিনি কবিতাকে নিজের ব্যস্ততার বিষয় বানাননি। স্বতস্ফূর্ত কিছু কবিতা তিনি রচনা করে গিয়েছেন যা আজ অব্দি তার আবেদন হারায়নি। ইমাম শাফেয়ীর দিওয়ান তথা কাব্যসমগ্র আজও সহজলভ্য। শিক্ষিত মহলে রয়েছে এর যথাযথ মূল্য। ইমাম শাফেয়ী আবু নুওয়াসের মৃত্যুশয্যায় হাজির হলেন। ইমাম তাকে জিজ্ঞেস করলেন, এ দিনের জন্য তুমি কি প্রস্তুতি গ্রহণ করেছো? আবু নুওয়াস বলে উঠলেন:
সে অমর কবিতা যা আজও মুমিন হৃদয়কে তাপিত করে, আশার আলো দেখায়।
আমার কাছে মনে হয়েছে আমার পাপের বোঝা বড় ভারি, তবে যখন তোমার
ক্ষমার প্রশস্ততার কথা ভাবলাম হে রব, তখন আমি নিশ্চিত হলাম
আমার পাপের চেয়ে তোমার ক্ষমা যে অতি মহান।
রাশি রাশি পাপ তুমি অনুগ্রহ করে ক্ষমা করেছো সদা, আজও তা অব্যাহত।
তুমি যদি না হতে হে রব, কোন আবেদের শক্তি ছিলো না শয়তানের সামনে
টিকে থাকার, সে তো তোমার প্রিয় বান্দা আদমকেও ধোঁকা দিয়ে ছেড়েছে।
তার এ অমর পংক্তি আজও স্মরণীয়, বরণীয় হয়ে আছে। থাকবে আরও বহুদিন।
নয়
মুহাম্মদ বিন নাফে। তিনি ছিলেন আবু নুওয়াসের প্রাণজ বন্ধুদের একজন। তার মুখেই শোনা যাক গল্পটা। মুহাম্মদ বলেন, আমার আর ওর মধ্যে ছিলো গভীর বন্ধুত্ব। কিন্তু কোন এক কারণে আমার আর ওর মধ্যে সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এ অবস্থার মধ্যেই হঠাৎ একদিন আমার বন্ধুর বিয়োগ হয়ে যাওয়ার সংবাদ পেলাম। আমার মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে গেলো। পুরো দিন কেটে গেলো সীমাহীন বিষণ্নতায়। রাতে আমি ঘুমুতে গেলাম। যখনই চোখ লেগে গেলো এর কিছুক্ষণ পরেই আমার বন্ধু আবু নুওয়াসের সঙ্গে আমার সাক্ষাত হলো। আমি অবাক হয়ে বললাম, আবু নুওয়াস? সে বললো, এখানে উপনামের কোন দাম নেই। এভাবে কেউ কাউকে চেনে না। আমি বললাম, হাসান বিন হানি? সে বললো, হ্যাঁ আমি হাসান বিন হানি। আমি বললাম, বন্ধু, আল্লাহ তোমার সঙ্গে কেমন আচরণ করেছেন? হাসান বললো, মৃত্যুর আগমুহূর্তে আমি কিছু কবিতা বলেছিলাম। আল্লাহ সে উসিলায় আমাকে ক্ষমা করে দিয়েছেন। কবিতাগুলো আমার বালিশের নিচে রয়ে গেছে। এরপরই আমার ঘুম ভেঙ্গে গেলো।
পরদিন সকালে সোজা আমি আবু নুওয়াসের বাড়িতে চলে গেলাম। আবু নুওয়াসের পরিবারের লোকজন আমাকে আগে থেকেই চিনতেন। আমি যখন গেলাম, পরিবারের মহিলারা উচ্চস্বরে কাঁদতে শুরু করলো। তারা জানতো আমাদের মধ্যে সম্পর্কের গভীরতার কথা। আমি তাদেরকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করলাম। এরপর বললাম, ভাই কি মৃত্যুর পূর্বে কোন কবিতা বলে গিয়েছেন? তারা বললো, আমরা তো বলতে পারবো না। তবে মৃত্যুর কয়েক ঘন্টা পূর্বে কলম-দোয়াত আর কাগজ চেয়েছিলেন। কিছু লিখেছিলেন কিনা আমরা নিশ্চিত বলতে পারছি না। আমি বললাম, আপনারা কিছু মনে না করলে আমি আমার বন্ধুর বিছানাটা একটু দেখতে চাই। তারা সানন্দে অনুমতি দিলো। আমি ভেতরে ঢুকলাম। পুরো বিছানা তন্ন তন্ন করে খুঁজে দেখলাম। গঠাৎ করে বালিশের এক কোণে একটি কাগজের টুকরো পেয়ে গেলাম যেখানে কয়েকটি পংক্তি লেখা ছিলো:
يا رب إن عظمت ذنوبي كثرة + فلقد علمت بأن عفوك أعظم
إن كَانَ لا يرجوك إِلا محسن+ فمن الذي يدعو ويرجو المجرم؟
أدعوك رب كما أمرت تضرعا+ فإذا رددت يدي فمن ذا يرحم؟
مالي إليك وسيلة إِلا الرجا + وجميل عفوك ثم إني مسلم
হে আমার রব, আমার পাপ যদি হয় পরিমাণে বিশাল,
আমি জানি আপনার ক্ষমা আমার পাপের চে’ও অনেক বেশি বিশাল।
কেবল ভালো মানুষেরাই যদি আপনার সকাশে আশা রাখতে পারে,
তবে অপরাধী কাকে ডাকবে, কার কাছে সে আশা রাখবে?
আপনি যেমন বলেছেন, ঠিক তেমন কাকুতি-মিনতি করে আপনাকে ডাকছি,
আমাকে যদি আপনি খালি হাতে ফিরিয়ে দেন তবে কে আমায় দয়া করতে পারে?
আশা-উমিদ, আর আপনার উত্তম ক্ষমা ব্যতিরেকে আমার
নেই কোনো উসিলা, হ্যাঁ আমি মুসলিম হে আমার রব।
আহা কি চমৎকার হৃদয়োৎসারিত পংক্তিমালা! হৃদয়ের গহীন থেকে প্রকাশ হওয়া মিনতিভরা প্রার্থনা আমার রব কি না শুনে পারেন। আল্লাহ তাকে ক্ষমা করে দিন। আমাদেরও ক্ষমার চাদরে আবৃত করে নিন। আরবী ভাষার শক্তিমান এ কবি ১৯৫ হিজরিতে মাত্র ৫৮ বছর বয়সে ইন্তিকাল করেন।
তথ্যসূত্র:
(১) তারিখে বাগদাদ, হাফেজ খতীবে বাগদাদী কৃত ৮/৪৭৫
(২) ওফায়াতুল আইয়ান, আল্লামা ইবনু খাল্লিকান কৃত ২/৯৫
(৩) কিতাবুল আগানি, আবুল ফারাজ আল ইস্পাহানী কৃত, ২০/১৮