
রাকিবুল হাসান নাঈম
ধর্ম অবমাননার ঘটনা প্রায়ই ঘটে থাকে। বিশেষ করে ইসলামের অবমাননা। মুসলমানদের প্রাণ হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে নিয়ে মাঝে মাঝেই বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন রকম কটুক্তি করা হয়। তাকে ব্যঙ্গ করে তৈরী করা হয় কার্টুন, ফিল্ম। বিশ্বজুড়ে তখন জেগে উঠে প্রতিবাদের জোয়ার। কিছুদিন পর সবাই আবার নিশ্চুপ হয়ে যায়। কিন্তু ইসলাম অবমাননার প্রতিরোধ কি শুধু রাস্তায় নেমে প্রতিবাদেই সম্ভব? নাকি অন্য কোনো পন্থাও আছে? এক্ষেত্রে ইসলাম অবমাননার প্রতিরোধে ড. ইউসুফ কারজাবি কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাবনা দিয়ে গেছেন। এই লেখায় তা-ই তুলে ধরব।
নবী-রাসূলদের কটূক্তির প্রাচীন রীতি
কারজাবির মতে, সব প্রাচ্যবিদ রাসুলের বিরুদ্ধে মিথ্যা বলে, রাসুলকে ব্যঙ্গ করে এমন নয়। অনেকে করে, অনেকে করে না। তবে, নবী-রাসূলদেরকে নিয়ে কটূক্তি করার ঘৃণ্য কাজটা পৃথিবীর শুরু থেকেই হয়ে আসছে। সূরা আনআমের ৩১ নং আয়াতে নবীজিকে আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেছেন, ‘আপনার পূর্ববর্তী রাসূলদেরকেও মিথ্যাবাদী প্রতিপন্ন করা হয়েছে। তারা সহ্য করেছে; তাদের নিকট আমার সাহায্য আসা পর্যন্ত তাদেরকে কষ্ট দেয়া হয়েছে। কষ্ট দেয়া হয়েছে তাদের পরিবার-পরিজন, সাহাবি- সঙ্গীদের। নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং তার পরিবার ও সাহাবিদেরকে তিন বছর শিআবে আবি তালেবে কার্যত বন্দী করে রাখা হয়েছে। তাদের কাছ থেকে কেউ কিছু ক্রয় করতো না, তাদের কাছে কিছু বিক্রয় করত না। খাদ্যসঙ্কটে এক সময় তারা গাছের পাতাও খেয়েছেন। নবীজিকে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, ‘প্রত্যেক নবীর জন্যই আমি শত্রু তৈরী করে রেখেছি (সূরা ফুরকান; আয়াত ৩১)।
অথচ নবীজি কাউকে কখনো মারেননি, কাটেননি, বিশ্বাস ভঙ্গ করেননি। যুবক বয়সে আরবে উপাধি পেয়েছিলেন আল আমিন বলে। নবুওয়ত লাভের পর মক্কায় যে ১৩ বছর কাটিয়েছেন, আঘাতের কোনো প্রতিঘাত করেননি। সাহাবিরা আঘাত সহ্য করতে করতে ক্লান্ত হয়ে এসে মিনতি করতো দরবারে রিসালাতে, প্রতিবাদ এবং প্রতিঘাত করার অনুমতি দিন ইয়া রাসূলাল্লাহ! নবীজি তাদের প্রতিঘাতের অনুমতি না দিয়ে ধৈর্য্য ধারণের নির্দেশ দিতেন। অথচ আল্লাহ রাসুলকে প্রতিরোধ করার অনুমতি দিয়েছিলেন, ‘যুদ্ধের অনুমতি দেয়া হল তাদেরকে যাদের সাথে কাফেররা যুদ্ধ করে; কারণ তাদের প্রতি অত্যাচার করা হয়েছে। আল্লাহ তাদেরকে সাহায্য করতে অবশ্যই সক্ষম (সুরা হজ:৩৯)। রাসুল কেবল নিজের সুরক্ষা করেননি, বরং সকল ধর্মের সুরক্ষা করেছেন। আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, ‘আল্লাহ যদি মানবজাতির একদলকে অপর দল দ্বারা প্রতিহত না করতেন, তবে (খ্রীষ্টানদের) নির্ঝন গির্জা, এবাদত খানা, (ইহুদীদের) উপাসনালয় এবং মসজিদসমূহ বিধ্বস্ত হয়ে যেত, যেগুলাতে আল্লাহর নাম অধিক স্মরণ করা হয় (হজ:৩৯— ৪০)।
তবুও কেনো কাফেররা, মুনাফিকরা তাকে কষ্ট দিতো? কারজাবি সূরা বাকারার ১১৮ নং আয়াত উল্লেখ করে বলেন, ‘তাদের অন্তর ছিল বিভ্রান্তিপূর্ণ।’ রাসূলের রওনক ও রওশন তাদেরকে স্পর্শ করতে পারেনি। ওই বিভ্রান্তির মায়াজালে পড়ে রাসূলকে কষ্ট দিতো। এই কারণটি ঠিক আজও অবিকল আছে। মানুষের হৃদয় এখন আরও বিভ্রান্তিকর। নবীজির কাল থেকে অনেক দূরে আমাদের বসবাস, প্রযুক্তি ও হাজার মতবাদের ধোঁয়াশায় সত্যটা এখন সুদূর পরাহত অনেকের কাছে। সুতরাং তাই এখনো বিভিন্ন মাধ্যমে রাসূলকে নিয়ে ঘৃণা ছড়ানোর চেষ্টা করে অনেকে। রাসূলকে কাফের এবং ইহুদিরা যেমন কষ্ট দিয়েছে, তেমনি মুনাফিকরাও কষ্ট দিয়েছে। কাফের এবং ইহুদিরা কষ্ট দিতো সরাসরি, মুনাফিকরা কষ্ট দিত লুকিয়ে, আলোর বাইরে গিয়ে আঁধারে, বিশ্বাসে মোড়কে অবিশ্বাসের খুন্তি মেরে। মুনাফিকদের আঘাতেই সবচে বেশি কষ্ট পেতেন রাসূল। কিন্তু এখন যারা নবীজিকে নিয়ে কটূক্তি ছড়ায়, তারা আসলে নবীজিকে নয় বরং নবীজির উম্মতকে কষ্ট দিতে চায়। কারণ নবীজি মুসলমানদের কাছে প্রাণের চেয়েও প্রিয়; তাই নবীজিকে নিয়ে কিছু বললে, মুসলমানরা কষ্ট পাবেই।
রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ
বিভিন্ন দেশে রাসুলকে ব্যঙ্গ করে তৈরী করা হয় কার্টুন, ফিল্ম। বিশ্বজুড়ে তখন জেগে উঠে প্রতিবাদের জোয়ার। সবাই নেমে আসে রাস্তায়। কোথাও কোথাও বিক্ষোভে সহিংসতাও ঘটে। কারজাবির মতে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পুরো মুসলিম উম্মাহর প্রাণের সঙ্গে জড়িয়ে আছেন। অস্তিত্ব ও আবেগের সঙ্গে মিশে আছেন। তাকে নিয়ে যখন কটূক্তি করা হয়, রাগ করার শতভাগ অধিকার মুসলিম উম্মাহর আছে। কিন্তু কথা হচ্ছে সেই রাগটুকু পরিমিত মাত্রায়, পরিকল্পিত কৌশলে বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে হবে।
তিনি বলেন, মুসলমানরা যখন এমন প্রতিবাদে রাস্তায় নামে, তাদের সঙ্গে অনেক সহিংসতাকারীও রাস্তায় নামে। তারা এই বিক্ষোভকে রাজনৈতিকভাবে কাজে লাগানোর চেষ্টা করে। দেখা যায়, এমন ব্যক্তি প্রতিবাদে আসছে, যারা মুসলিমই না, ইসলামের সঙ্গে যাদের কোনো সংযোগ নেই। তারা ইসলামের সুরক্ষায় প্রতিবাদে আসে না, আসে অসৎ উদ্দেশ্য চরিতার্থে। তারা মুসলমানদের বিক্ষোভকে সরকারবিরোধী বিক্ষোভে রূপ দিতে চায়। এ ব্যাপারে মুসলমানদের সতর্ক থাকতে হবে। রাসুলকে কটূক্তি করার প্রতিবাদে রাস্তায় নেমে সহিংসতা শুরু করে দিলে হিতে বিপরীত হয়। মিডিয়াগুলো তখন তাদেরকে প্রতিবাদকারী হিসেবে না দেখিয়ে বরং দেখাতে শুরু করে সহিংসতাকারী হিসেবে। তাই আন্দোলনে রাস্তায় নামা যাবে, শতভাগ অধিকার আছে মুসলিমদের, কিন্তু আগুন জ্বালানো, ভাঙচুর করা যাবে না। শান্তি বজায় রাখতে হবে।
কারজাবি বলেন, ‘নবীজিকে নিয়ে কটূক্তির প্রতিবাদে রাস্তায় নেমে মানুষ উত্তেজিত হয়ে পড়ে। উত্তেজনার সময় মানুষ নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে। তাই মানুষকে জানাতে হবে প্রতিবাদের তরিকা ও পদ্ধতি। তাদের সামনে তুলে ধরতে হবে প্রতিবাদের প্রতিবাদের নিয়ম ও কৌশল। মানুষের কাছে বিষয়টি তুলে ধরার দায়িত্ব আলেমদের, দাঈদের, লেখকদের। রাসুলের প্রতি ভালোবাসায় মানুষ রাস্তায় নেমে আসে, প্রতিবাদ করতে উদ্বুদ্ধ হয়। এই ভালোবাসা যেন মার না খায়। সঠিক পন্থায় প্রতিবাদ জানিয়ে যেন ভালোবাসার জয় হয়।
বুদ্ধিবৃত্তিক প্রতিবাদ
ইউসুফ কারজাবি মনে করেন, বর্তমানে রাসুল অবমাননার বুদ্ধিবৃত্তিক প্রতিবাদ হতে পারে সিরাতচর্চা। রাসূলের ভালোবাসায় এই কাজটি আমাদের লেখকদের এবং আলেমদের করতে হবে। তা হলো—লিখে যতভাবে পারা যায় রাসূলের সিরাতকে মানুষের সামনে তুলে ধরা। আধুনিক ভাষায়, মনোরম সাহিত্যের মোড়কে, ফিকশনের আঙ্গিকে—সব মাধ্যমেই সিরাত চর্চার ধারা চালু করা সময়ের প্রয়োজন। মানুষ যে আঙ্গিকে পড়তে চায়, সেই আঙ্গিকও ব্যবহার করতে হবে মুসলিম সিরাত লেখকদের। তাহলে মানুষ পড়বে, মানুষের হৃদয় স্পর্শ করবে। সাহাবিগণ কেউ মুহাজির হয়ে, কেউ আনসার হয়ে রাসূলের সাহায্য করেছেন। এই এতকাল পর আমরা আমাদের রাসূলকে ‘সিরাত চর্চা’র মাধ্যমেই কেবল সাহায্য করতে পারি। সিরাত যারাই পড়বে, তারাই আলোকিত হবে।
সিরাত লেখার ভাষা হতে পারে আরবি, ইংরেজি, স্পেনিশ কিংবা আরও বিভিন্ন ভাষা। এক ভাষায় যা লেখা হচ্ছে, তাকে অন্য ভাষায় রূপান্তর করা যেতে পারে। পৃথিবীতে মানুষ তো এক ভাষাভাষী না। শত শত ভাষা আছ। সব ভাষাতেই কাজ করতে হবে। কারজাবি বলেন, বলছি না রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ করা যাবে না। বরং বলছি, আমাদের প্রতিবাদ যেন কেবল রাস্তার প্রতিবাদের সীমাবদ্ধ না হয়ে যায়।
কারজাবি বলেন, আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনে আল্লাহ এবং রাসুলকে সাহায্য করার নির্দেশ দিয়েছেন। সাহাবিগণ সঙ্গে থেকে, জিহাদ করে আল্লাহর দ্বীন এবং রাসুলকে সাহায্য করেছেন। এখন আমরা যেভাবে রাসুলকে সাহায্য করতে পারি, তা হলো সিরাতচর্চা। পুরো পৃথিবীতে রাসুলের আলোচনা ছড়িয়ে দেয়া। যেন মানুষ তাকে চিনতে পারে। সিরাত প্রচারণায় যদি কোনো ভিজ্যুয়াল মাধ্যমও লাগে, তা ব্যবহার করতে হবে, তাতে ইনভেস্ট করতে হবে, কৃপণতা করা যাবে না।
প্রতিবাদের রকমফের
ইসলাম অবমাননাকে আজকাল রাসুলের অবমাননাতেই সীমাবদ্ধ করে ফেলা হচ্ছে। রাসুল অবমাননা হলেই কেবল মুসলমানরা প্রতিবাদে নামছে। অথচ, পৃথিবীর দিকে দিকে যে মসজিদ গুড়িয়ে দেয়া হচ্ছে, নিরপরাধ মুসলমানদের হত্যা করা হচ্ছে, ইসলামের বিভিন্ন নিদর্শন তুচ্ছ করা হচ্ছে, সেগুলোর ক্ষেত্রে কারো কোনো তেমন প্রতিবাদ নেই। ইউসুফ কারজাবি বলেন, শুধু নবীজি নয়, ইসলামের প্রতিটি নিদর্শন আমাদের প্রিয়। কোরআন, মসজিদ, কাবা, মক্কা, মদীনা, রওজা, হাজরে আসওয়াদ, মিনা, আরাফা—আমাদের শ্রদ্ধার একেকটি আয়োজন। ইসলামের যে নিদর্শন নিয়েই কটূক্তি করা হোক, আমাদের প্রতিবাদ জানানো উচিত। চীনে মসজিদের পর মসজিদ গুড়িয়ে দেয়া হচ্ছে, গাজায় শত শত মুসলিমকে হত্যা করা হচ্ছে, ভারতে মসজিদের জায়গায় মন্দির নির্মাণ করা হচ্ছে—এইসবও আঘাত। এইসব আঘাতেও রক্তক্ষরণ হয় ঈমানদারদের কলিজায়। এইসব ক্ষেত্রেও প্রতিবাদ প্রয়োজন।