কার্ল মার্কসের আফিমতত্ত্ব : একটি নির্মোহ পর্যালোচনা

খালিদ মুহাম্মাদ সাইফুল্লাহ :

ইউরোপের আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক চিন্তার ইতিহাসে কার্ল মার্কসের বিপ্লবী ভূমিকার কথা অস্বীকার করার উপায় নাই। ফরাসি বিপ্লব পরবর্তী সময়ে ইউরোপের চিন্তার স্রোতে একটি পরিবর্তনবাদী পরিস্থিতির জন্ম দিয়েছিলেন কার্ল মার্কস। কিন্তু, ইউরোপের সীমান্ত পেরিয়ে বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে এসে কার্ল মার্কস কতোটা প্রাসঙ্গিক, সে প্রশ্ন আজও তাৎপর্যপূর্ণ। বিশেষত, ধর্মের প্রশ্নে অজ্ঞতা , উদাসীনতা ও বিরোধিতার কারণে কার্ল মার্কস বরাবরই বিতর্কিত। ধর্মের ব্যাপারে মার্কসের মূল্যায়ন উদ্ধারের ক্ষেত্রে একটি বহুল প্রচলিত উদ্ধৃতি ব্যবহার করা হয়, আলোচনার সুবিধার্থে প্রথমে তা উল্লেখ করছি , মার্কস বলেন – ”  Religion is the sigh of the oppressed creature, the heart of a heartless world, and the soul of soulless conditions. It is the opium of the people. অর্থাৎ ধর্ম হলো শোষিতদের মর্মযাতনা, হৃদয়হীন জগতের হৃদয়, আত্মাহীন অবস্থার আত্মা। শোষিত মানুষের কাছে ধর্ম আফিমস্বরূপ ।

এখানে ধর্ম সম্পর্কে মার্কসের যে মূল্যায়ন, তার শেষ অংশটুকু বহুল প্রচলিত। মার্কস সেখানে ধর্মকে আফিমের সাথে তুলনা করেছেন। তথা : শোষিত মানুষের ক্ষেত্রে ধর্ম আফিমের মতো কাজ করে। এখানে লক্ষ্যণীয় ব্যাপার হলো, বাক্যটি তাশবীহ বা উপমা হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে। আর উপমা জাতীয় বাক্যের স্বাভাবিক একটি প্রক্রিয়া হচ্ছে -অর্থের দ্বান্দ্বিকতা ও দ্বি-চারিতা। কোন বিষয়কে ভিন্ন একটি বস্তুর সাথে তুলনা করা হলে , তাতে বিভিন্ন অর্থের সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়। যেমন, আপনি যখন বললেন , ‘লোকটা বাঘের মতো’, তখন তুলনীয় দিক হিসেবে সাহসিকতা ও হিংস্রতা যেমন অন্তর্ভুক্ত, তেমনি গাঠনিক দিককেও তুলনীয় হিসেবে বিবেচনা করা যায়।

মার্কসের উপরোক্ত বহুল প্রচলিত উদ্ধৃতিটির ক্ষেত্রেও হুবহু ঘটনা ঘটেছে। মার্কসের এই আফিমতত্ত্বকে কিভাবে ব্যাখ্যা করা হবে , ধর্মের সাথে কমিউনিজমের ভাব ও ভালোবাসার পরিসীমা কিভাবে নির্ণীত হবে , তা নিয়ে মার্কসীয় চিন্তায় কমবেশী আলাপ করতে দেখা যায়। বেশকিছু বইও রচিত হয়েছে এসবের উপর। মার্কসের উদ্ধৃতির বিশ্লেষণে কমিউনিষ্টরা যে দুটি শিবিরে বিভক্ত হয়েছে, তার সামান্য পর্যালোচনা জরুরি।

প্রথমত, কমিউনিস্টদের একটি শিবির ধর্মের সাথে কোন প্রকার আপোষ বা বোঝাপড়ায় আসতে নারাজ। ধর্মকে তারা জুলুমের হাতিয়ার হিসেবেই বিবেচনা করে। মার্কসের আফিমতত্ত্বকেও তারা নেতিবাচক ব্যাখ্যায় হাযির করতে স্বচ্ছন্দ বোধ করে। এক্ষেত্রে লেনিনবাদীরা সম্ভবত অন্যদের চেয়ে বেশি সক্রিয়। কারণ, রাশিয়ায় ধর্মের ব্যাপারে লেনিন, স্টালিনদের ভূমিকা আগ্রাসী ও প্রতিক্রিয়াশীল ছিল। তাই তারা মনে করে, ধর্ম মানুষের বিপ্লবের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়, নিশ্চুপে নির্যাতন সহ্য করার শিক্ষা দেয়। একটা ঘোরমত্ততা ও মাদকতার মধ্যে ফেলে রাখে।

দ্বিতীয়ত , মার্কসীয় চিন্তাকে যারা নির্দিষ্ট বৃত্তের বাইরে এসে চর্চা করেছেন, যেমন , মিশেল ফুকো। তারা সাধারণত মার্কসকে সমালোচনার ঊর্ধ্বে ভাবেননি, তার চিন্তার অকাট্যতা ও সীমাবদ্ধতার দাবি তোলেননি। বরং , তারা মনে করেন যে, মার্কসের চিন্তার ক্রিটিক হতে পারে, শুদ্ধা-শুদ্ধির বিবেচনা করা যেতে পারে। এ প্রসঙ্গে মিশেল ফুকোকে প্রাসঙ্গিক বিবেচনা করা যায়। ফুকো যখন ইরানে গিয়েছিলেন তখন ইরানিদের কাছে প্রায়ই শুনতেন যে মার্কস ধর্ম সম্পর্কে ভুল বলেছেন যে, ‘ ধর্ম মানুষের জন্য আফিম’। ইরানিরা তাকে বলত, মার্কসের এই উক্তি যথার্থ না। ধর্ম আফিম সেটা পাশ্চাত্যে খ্রিস্ট ধর্মের জন্য হতে পারে, কিন্তু ইসলামে সেটা নয়। ইসলাম শুধু পরকালের ধর্ম নয়; নিছকই বেহেশত-দোজখ বা পরকালে শাস্তি ও পুরষ্কার নির্ণয়ের জন্য ইহলোকে ঈমান ও আমলের চর্চা নয়। ইসলাম একই সঙ্গে ইহলৌকিকতাকেও গুরুত্ব দেয়। দৈনন্দিনের মোনাজাতেই মুমিন আগে দুনিয়াতে ‘হাসানা’ চায় এবং তারপর আসে আখেরাতের কথা: ‘রব্বানা আতি না ফিদ্দুনিয়া হাসানাহ ওয়া ফিল আখেরাতি হাসানাহ’। এই ধরনের একটি ভারসাম্যপূর্ণ ধর্মকে কখনও আফিমের সাথে তুলনা করা যায় না। এটা পাশ্চাত্যের খ্রিস্ট ধর্মের সমস্যা, ইসলামের না।

তিনি ইরান বিপ্লবকে খুব নিকট থেকে দেখেছেন, জেনেছেন, ধর্ম একটি বিপ্লবে কিভাবে তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রাখছে তা নিয়ে গভীরভাবে ভেবেছেন। ইসলাম, শিয়া মতবাদ ও আলি শরিয়তির চিন্তা গবেষণাকে বিস্তর অধ্যয়নের পর ধর্ম সম্পর্কে তিনি ইতিবাচক অবস্থান নিয়েছেন, ধর্ম সম্পর্কে মার্কসবাদীদের চিরাচরিত চিন্তা কাঠামোর উপর প্রশ্ন ছুড়েছেন। শেষে তিনি বলেন, ‘মার্কসের এই বাক্যটির পর্যালোচনা হওয়া উচিৎ’।

মার্কসের উপরোক্ত উদ্ধৃতির পর্যালোচনায় দুটি ধারা জারি আছে ; . একধরণের পর্যালোচনা-পদ্ধতিতে দেখা যায়, ধর্মের ব্যাপারে , বিশেষত, প্রাচ্যদেশীয় ধর্ম- মার্কসের অজ্ঞতা ও উদাসীনতাকে আমলে নেওয়া হচ্ছে , ইসলামের ব্যাপারে মার্কসের অজ্ঞতাকে সমালোচনার মোক্ষম জায়গা বিবেচনা করা হচ্ছে। এবং মার্কসের আফিমতত্ত্ব ইসলামের ক্ষেত্রে যে খাটে না তা উচ্চ শব্দে প্রচার করা হচ্ছে। ইরানের মার্কসবাদী চিন্তক ‘আসিফ বয়াত’ যখন আলি শরিয়তির ‘Marxism and other western fallacies’ বইয়ের উপর ক্রিটিক করেছেন , তখন ইসলাম সম্পর্কে মার্কসের অজ্ঞতা নিয়ে শরিয়তির আপত্তিকে যথার্থ বিবেচনা করে বলেছেন, ‘এটা সত্য যে, মার্কসের ধর্ম সংক্রান্ত জ্ঞান খ্রিস্ট ও ইহুদি ধর্মের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। তিনি ইসলাম, হিন্দুধর্ম, তাওবাদ প্রভৃতি প্রাচ্যদেশীয় ধর্ম সম্পর্কে বিশেষ পরিচিত ছিলেন না। মার্কসের একটা মোক্ষম সমালোচনার জায়গা হতে পারে ধর্মীয় জগত সম্পর্কে তার সীমিত জ্ঞান।’

আদতে মার্কসের আফিমতত্ত্ব খৃস্টধর্মের ক্ষেত্রেও ততোটা খাটে না। কারণ, ধর্মকে যদি তাত্ত্বিক অবস্থান থেকে পর্যবেক্ষণ করা হয়, তাহলে এ কথা কবুল করতে হবে যে, ইতিহাস দিয়ে তত্ত্বের শুদ্ধা-শুদ্ধি মাপা যাবে না। তাই ইতিহাসে কখন, কে, কী করলো তার উপর ধর্মের প্রাসঙ্গিকতা নির্ভর করে না। বরং, তত্ত্বকে ওজন করতে হবে তত্ত্ব দিয়েই। এখন আমরা যদি তত্ত্বের পাটাতনে বাইবেলের ‘নিউ টেষ্টামেন্ট বা নতুন নিয়ম’ কেই রাখি , দেখা যাবে এখানে রাষ্ট্র-প্রশ্নকে খুব কমই হাযির করা হয়েছে। ঈসা আ . এর উত্থান পরবর্তী তিনশ বছরে খৃস্ট্রীয় সমাজ রাষ্ট্রের ব্যাপারে নির্মোহ ছিল। ফলাফলের বিচারে খৃস্ট্রধর্ম হচ্ছে একটি সামাজিক সংষ্কারধর্মী আন্দোলন, দয়া ,মানবতা , ও আত্মিক অগ্রগতি যার প্রতিপাদ্য। সর্বপ্রথম রাষ্ট্রে খৃস্ট্রধর্মকে স্থাপিত করেছেন ‘কনষ্টান্টাইন’ ; আর সে কোন যাজক বা পুরোহিত ছিল না, সে ছিল নব দীক্ষিত খৃস্টান। সুতরাং, আপাতদৃষ্টে পুরোহিততন্ত্র বা থিওক্রেসিকে খৃস্ট্রীয় তত্ত্ব দিয়ে মাপা যাচ্ছে না। ষোড়শ শতকে যা হয়েছে, তার দায় ইতিহাসের, খৃস্ট্র মন্ডলীর বা চার্চের;  চার্চ একটি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান মাত্র। আর প্রতিষ্ঠানকে ধর্মের অবস্থানে বিবেচনা করার সুযোগ কোথায়? !

. আরেক ধরণের পর্যালোচনা-পদ্ধতিতে ধর্ম সম্পর্কে মার্কসের অজ্ঞতা ও উদাসীনতার প্রশ্নকে নিশ্চুপে ও নির্লিপ্তে এড়িয়ে যাওয়া হয়। সেখানে মুলত মার্কসের আফিমতত্ত্ব তথা ‘ধর্ম হচ্ছে শোষিত মানুষের কাছে আফিম স্বরুপ’ উক্তিটির তুলনা ও তুলনীয়ের মাঝে মুনাসাবাত বা সম্পর্কের অনুসন্ধান করা হয়। অর্থাৎ, এখানে কোন বিবেচনা থেকে মার্কস ধর্মকে আফিমের সাথে তুলনা করলেন, ইতি নাকি নেতিবাচক বিবেচনায় ইত্যাদি ইত্যাদি। এ প্রসঙ্গে সম্প্রতি কমরেড মুজাহিদুল ইসলাম সেলিমের একটি ফেবু স্ট্যাটাস এখানে উল্লেখ করা খুবই প্রাসঙ্গিক মনে হচ্ছে, তিনি সেখানে আফিমতত্ত্বের ব্যাখ্যা দিচ্ছেন যে,

‘‘শো‌ষিত মানু‌ষের কা‌ছে ধর্ম আফিম স্বরুপ।’ কার্ল মার্কস এই উক্তিটির মাধ্যমে ধর্ম‌কে আফিমের সা‌থে তুলনা ক‌রে‌ছি‌লেন। কিন্তু কেন ?

এই বিষয়‌টির গভী‌রে না গি‌য়ে মোল্লা, পু‌রো‌হিত,ধর্ম ব্যাবসায়ীর দল বু‌ঝে কিংবা না বু‌ঝে এক‌রৈ‌খিকভা‌বে সরল মানুষগু‌লোর কা‌ছে উপস্থাপন ক‌রে মানুষ‌কে ক‌মিউনিস্ট (সমাজতন্ত্রী) বি‌দ্বেষী হ‌য়ে উঠ‌তে উদ্বুদ্ধ ক‌রে, এমন‌কি অনেক ক‌মিউনিস্ট (সমাজতন্ত্রী) কর্মীও এই বিষয়‌টির স‌ঠিক মর্মার্থ উদ্ধার কর‌তে ব্যার্থ হয়ে পু‌রো বিষয়টি‌কেই লে‌জে গুব‌রে ফে‌লেন।

আস‌লে মূল বিষয়‌টি হ‌চ্ছে, আজ‌কালকার ম‌তো তখনকার সম‌য়ে আফিম কোন নেশাদ্রব্য ছিল না, তখনকার চি‌কিৎসকরা ব্যাথা বা চেতনা নাশক হিসা‌বে আফিমকে ব্যাবহার করতেন। আর মার্কস নি‌পীড়িত, শো‌ষিত মানু‌ষের কা‌ছে ধর্ম আফিম স্বরুপ বল‌তে এটাই বোঝা‌তে চে‌য়ে‌ছি‌লেন যে- সমাজ থে‌কে প্রাপ্ত যাবতীয় দুঃখ, যন্ত্রণা, কষ্ট, অন্যায়, নির্যাতন লাঘবের চেষ্টায় যখন ‌কোন ব্যা‌ক্তি ব্যর্থ হয়, তখন সৃ‌ষ্টিকর্তার কা‌ছে সমস্ত অন্যা‌য়ের বিচা‌রের ভার সে অর্পন ক‌রে।

ধর্ম‌কে আশ্রয় ক‌রেই তার সকল যন্ত্রণা লাঘ‌বের চেষ্টা ক‌রে ‌কিংবা ভুলে থা‌কে। নি‌জে যখন বদলা নি‌তে ব্যর্থ হয় তখন সে ম‌নে ক‌রে এক দিন না এক‌দিন তার প্রতি এ অন্যা‌য়ের বিচার সৃ‌ষ্টিকর্তা কর‌বেন-ই। এ প্রেক্ষাপ‌টেই মার্কস এ উক্তিটি করে‌ছিলেন।’’

মার্কসের আফিমতত্ত্বের ব্যাখ্যা হিসেবে এই উক্তিকে যদি যথার্থও বিবেচনা করা হয়, তবুও তা হালে জল পাবে না। কারণ, এখানে খুব সন্তর্পণে ইসলামের বিপ্লবের ইতিহাস, জলুমের বিরুদ্ধে ইসলামের ইনসাফের ঘোষণাকে উপেক্ষা করা হচ্ছে। পৃথিবীতে মানুষ আল্লাহর খলিফা। আর তার খিলাফতের প্রধান প্রেরণাই তো পৃথিবী থেকে অন্যায়, অবিচার ও জুলুমকে নির্মূল করে সুস্থ-সুন্দর পরিবেশের অবতারণা করা। এবং রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা।

মার্কসের আফিমতত্ত্বে যারা ইতিবাচক ব্যাখ্যার আশ্রয় নেয়, তাদের একটি স্বাভাবিক প্রবণতা থাকে ঐক্য। যেসব প্রশ্নে কমিউনিস্টরা ইসলামকে ইতিবাচক ভূমিকায় কল্পনা করে, ঐক্যের ভাবনা প্রচার করে, তার মধ্যে সাম্রাজ্যবাদকে অতি অবশ্যই বিবেচনা করা যায়। কারণ, সাম্রাজ্যবাদ বলতে কমিউনিস্টরা সাধারণত আমেরিকাকে গুরুত্ব দেয়। গত শতকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে, চল্লিশের দশকের মাঝামাঝি থেকে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও আমেরিকার মাঝে চলমান স্নায়ুযুদ্ধের প্রভাব এক্ষেত্রে অতি প্রাসঙ্গিক। কারণ, এখানে সোভিয়েত রাশিয়া সমাজতন্ত্রের প্রতিনিধিত্ব করছিল , অন্যদিকে পুজিঁবাদের তরজুমানি করছিল আমেরিকা। ফলে তাদের পারষ্পরিক বিবাদটা আদর্শিক রুপ লাভ করেছিল। এদিকে ইসলাম ও মুসলমানরা যেহেতু সাম্রাজ্যবাদ প্রশ্নে অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক ভূমিকা পালন করছে এবং সাম্রাজ্যবাদ প্রশ্নে ইসলামের প্রাসঙ্গিকতা আরো বেশি প্রকট হয়েছে তথাকথিত ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধের’ কালে। ফলে সাম্রাজ্যবাদ মোকাবেলায় ইসলাম ও কমিউনিজম অবশ্যই দুটি কেন্দ্রীয় শক্তি।

সুতরাং, এই বিবেচনায় ঐক্যের আলাপটা গভীর হতে পারতো। কিন্তু, এই পর্যায়ে কমিউনিস্টদের পক্ষ থেকে ঐক্যের আলাপটা অনেকাংশেই ছেলেখেলা। কারণ, প্রথমত, যৌবন বা উত্থানকালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ধর্মকে প্রতিপক্ষ হিসেবেই বিবেচনা করেছে। রাশিয়ায় সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের পর লেনিনের লিখিত পুস্তক থেকে একটি উদ্ধৃতি দিচ্ছি। সমাজতান্ত্রিক রাশিয়ায় ধর্ম প্রশ্নকে কিভাবে হাযির করা হবে লেনিন তার বর্ণনা দিচ্ছেন। লেনিন বলছেন, ‘ধর্ম আধ্যাত্মিক পীড়নের অন্যতম প্রকার বিশেষ। চিরকাল অন্যের জন্য খাটুনি, অভাব ও নিঃসঙ্গতায় পীড়িত জনগণের উপর সর্বত্রই তা চেপে বসে। শোষকদের বিরুদ্ধে শোষিত শ্রেণীর সংগ্রামের অক্ষমতা থেকেই অনিবার্য ভাবে উদ্ভুত হয় মৃত্যু-পরবর্তী জীবনের প্রত্যয়। যেমন, প্রকৃতির বিরুদ্ধে সংগ্রামে আদিম মানুষের অক্ষমতা থেকে উদ্ভূত হয় ঈশ্বর, শয়তান, অলৌকিকত্ব ইত্যাদিতে বিশ্বাস। যারা সারাজীবন খাটে আর অভাবে নিমজ্জিত থাকে , ধর্ম  এ পৃথিবীতে তাদের নম্রতা ও সহিষ্ণুতার শিক্ষাদান করে স্বর্গীয় পুরষ্কারের সান্ত্বনা দেয়। কিন্তু, যারা অন্যের শ্রমশোষক , ধর্ম তাদের পার্থিব জীবনে বদান্যতা অনুশীলনের নির্দেশ দেয়। এভাবেই শোষক হিসেবে নিজেদের অস্তিত্বের ন্যায্যতা প্রমাণের জন্য ধর্ম খুবই সস্তা সুযোগ দেয়  ও পরিমিত মূল্যের টিকিটে স্বর্গ বাসে তাদের স্বাচ্ছন্দ্য বিধানের ব্যবস্থা করে। ধর্ম জনগণের পক্ষে আফিম স্বরুপ।’

এই যে জুলুম বা অন্যায়ের বিরুদ্ধে ধর্মের প্রাসঙ্গিকতাকে খাটো করে দেখার প্রবণতা, যা পরবর্তীতে ইসলামের ক্ষেত্রেও প্রয়োগ করতে দেখা গেছে, এর জন্যেও ইসলামের সাথে তাদের সম্পর্কটা সঙ্ঘাতপূর্ণ হয়েছে। এই সঙ্ঘাতের সবচেয়ে তিক্ত অভিজ্ঞতা প্রতিফলিত হয়েছে আফগানিস্তানের দখলদারিত্বের প্রশ্নে। শুধুমাত্র ইসলামকে অপরাপর ধর্মের সাথে শ্লেষ করে , বৈষম্যের হাতিয়ার ভেবে নির্মূল করার চাহিদা তৈরি হয়েছিল তখন। এবং আফগানিস্তানকে ইসলাম মুক্ত করে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র কায়েমের খায়েশ জেগেছিল। আফগানিস্তানে আজকের সাম্রাজ্যবাদীতার পেছনে সোভিয়েত ইউনিয়নের দায় অস্বীকার করার জো নাই কারো। তারাই তো আফগানিস্থানকে অধীনতার জালে আটকে রাখা শুরু করলো, ধারাবাহিক নাটকের নিকৃষ্ট সূচনা করলো।

দ্বিতীয়ত, সাম্রাজ্যবাদের সাথে ইসলামের মোকাবেলা মূলত আদর্শের, সভ্যতার। টেরর বা সন্ত্রাসের না। আরো সুস্পষ্ট শব্দে বললে ইরাক এবং ফিলিস্তিনে আমেরিকার আগ্রাসনকে যদি আপনি পররাষ্ট্রনীতি বলে উপেক্ষা করেন, তদ্রুপ আফগানিস্তানে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদকে কেউ যদি ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধ’ হিসেবে বিবেচনা করে , তাহলে সেটাকে চিন্তার অক্ষমতা ছাড়া কিছু বলার সুযোগ নেই। কারণ, মুসলিম বিশ্বে সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের প্রধান ও মুল উদ্দেশ্য-ই হচ্ছে ইসলামি সভ্যতা ও আকিদা-বিশ্বাসকে নির্মূল করা ; যেই আকিদা-বিশ্বাস পাশ্চাত্য সভ্যতার ঘোরতর বিরোধী।

সুতরাং, সাম্রাজ্যবাদ মোকাবিলার প্রশ্নে আদর্শিক প্রশ্ন বিবেচনা না করে ইসলাম ও কমিউনিস্টদের ঐক্যের প্রসঙ্গ টেনে আনা সম্ভব হবে না। আর এটা অত্যন্ত সুস্পষ্ট ব্যাপার যে, আদর্শের বিচারে ইসলাম ও কমিউনিজমকে এক করা সম্ভব না। অতএব, সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী অবস্থানের ক্ষেত্রে মুসলিমরা তাদের স্বাতন্ত্র্য বা স্বকীয়তাকে উপেক্ষা করবে না। এবং উপনিবেশ বিরোধী সংগ্রামে মুসলিম রাষ্ট্রগুলো যেভাবে নিজস্ব প্রচেষ্টাকে গুরুত্ব দিয়েছে , কারো কোন সহযোগিতার অপেক্ষা করতে হয়নি , তেমনি  আপাতত সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী লড়াইয়েও মুসলমানদের এমন কারো সহযোগিতার প্রয়োজন নেই, যারা একসময়ে নির্যাতকের ভূমিকা পালন করেছিল। তবে যদি আদর্শিক প্রশ্নের নয়া বিবেচনা হাজির করা হয়, তাহলে হয়তো নতুন সম্ভাবনা গড়ে উঠতে পারে।

আগের সংবাদদেওবন্দের পরিচয়, আদর্শ ও দর্শন
পরবর্তি সংবাদদক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় মুসলমানদের ভবিষ্যত