
আব্দুল্লাহ আল মাহী:
শিক্ষার সীমাপরিসীমা, শিক্ষা কাঠামো, শিক্ষাক্রম, পাঠ্যক্রম ও শিক্ষা পরিকল্পনা এবং সামগ্রিক শিক্ষা ও এর সুযোগ সুবিধা নির্ণয় নিয়ে বাংলাদেশে আলাপচারিতা জারি হয় ৭১ এর স্বাধীনতা পরবর্তী সময় থেকেই। এই দীর্ঘ ৫০ বছরে এখনতক ৮ টি শিক্ষাকমিশন গঠিত হয়। আসলে, একটিই হয়, পরবর্তীরা নিজেদের অদক্ষতাকে পূর্বসূরি প্রথম শিক্ষাকমিশনের জোড়াতালি দিয়ে ঢেকেছে মাত্র। নতুনভাবে নতুন দেশের সমস্ত মানুষ ও তাদের সামাজিক, আঞ্চলিক, অর্থনৈতিক সাংস্কৃতিক সহ আরও বিষয়গুলোকে একসাথে নিয়ে চিন্তা করে সীদ্ধান্ত প্রথম শিক্ষাকমিশন যেমন পুরোপুরি নিতে পারেনি, ঠিক পরবর্তী কমিশনগুলোও একই কাজ করেছে। এর জলজ্যান্ত প্রমাণ অত্র বছরে পাশ হওয়া নতুন শিক্ষাক্রমে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তর থেকে ধর্মশিক্ষার বিলুপ্তি। এই কাজটির সূচনা করেছিল বাংলাদেশের প্রথম শিক্ষাকমিশন। সেই কুদরতি খুদা শিক্ষাকমিশনে ধর্মশিক্ষার কোন রকম বালাই ছিল না। অথচ পরবর্তীদের কাজই হলো পূর্ববর্তীদের ভালো কাজের অনুসরণ ও সামগ্রীক বিবেচনায় ভুল ত্রুটির বিয়োজন৷
প্রথম শিক্ষাকমিশন ছিল কুদরতি খুদা শিক্ষাকমিশন৷ এই কমিশন পাঠ্যক্রম সাজিয়েছিল সংবিধানের চারটি মৌলনীতিকে সামনে রেখে; ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদ। এই উদ্দেশ্য সামনে রেখে প্রচলিত চার ধর্মের সমন্বয়ে তৈরি করা হয়েছিল নীতিশিক্ষার বই। মানে, ইসলাম শিক্ষা এবং নীতিশিক্ষা ভিন্ন জিনিস। খৃষ্টধর্ম ও নীতিশিক্ষা ভিন্ন জিনিস। বাকি ধর্মগুলোর ব্যাপারেও একই বিষয়ের প্রয়োগ হয়। তবে যৌক্তিক বিচারেই ইসলামের ব্যাপারটি অন্য ধর্ম থেকে ভিন্ন। সেই আলাপ আমাদের আজকের মৌল না। তবে এই কমিশন ইসলামকে ভেবেছিল আনুষ্ঠানিকতা সর্বস্ব একটি ধর্ম। আসলে, প্রতিটা ধর্মকেই এভাবে ভাবতে তারা বাধ্য হয়েছিল পশ্চিমা অনুকরণে অভ্যস্ত হওয়ায়। পশ্চিমের কপি-পেস্ট তারা করেছিল বটে, ধর্ম থেকে শিক্ষা ও জগতকে বাহির করার বৈশ্বিক সেক্যুলার প্রবণতা তাদের মাঝে এসেছিল আমেরিকা ও ইউরোপের বাহ্যিক জগতের রূপসৌন্দর্য্য ও চাকচিক্য দেখেই। কিন্তু পশ্চিমের এই চাকচিক্যের রুহ তো ভিন্ন কোথাও। আসলে, নকলের জন্য আকলের যে প্রয়োজন আছে এটাও ভেবে দেখেনি আমাদের শিক্ষাকমিশন মহোদয়। আলীয়া আলী ইজেতবেগোভিচের ভাষায় এরা হচ্ছে, Daddy’s sons. মানে, বাবা ডাকবে না। আব্বুও বলবে না। বলবে, ‘ডেডি’৷
আজকের আলাপ যেহেতু শিক্ষা বিষয়ক। তাই, আলাপটা শুরু করি জ্ঞানসম্রাট আলীয়া আলী ইজেতবেগোভিচের কথা দিয়ে। ‘
Iron chains are no longer necessary to keep our peoples in submission. The silken cords of this alien education have the same power paralyzing the minds and will of the educated. [1ibid]
আলীয়া মনে করেন, পশ্চিমে এই ধর্ম বিরোধিতা ও ধর্মকে জগত থেকে পৃথককরণ সেখানে যেরকম প্রগতি ও শাসনতান্ত্রিক ব্যাবস্থার জন্ম দিয়েছে মুসলিম জগতে তা কিন্তু গঠনমূলক কোন পরিবর্তন আনতে পারেনি। এখনতক ধর্মের বিরোধিতা ও জাতীয়তাবাদ কোন ইতিবাচক ফলাফল তৈরি হতে দেয়নি। বরং বিদেশ থেকে আমদানি করা ব্যবস্থাপত্র এখানকার আধ্যাত্মিক বন্ধ্যাত্বের চিহ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাছাড়া, পশ্চিমের আধুনিকতা ও বিশিষ্টতার রুহ তাদের নাইটক্লাব, ফ্যাশন, নাস্তিকতা ও বিশৃঙ্খল তরুণ সমাজ দিয়ে বোঝা যাবে না৷ তাদের বুঝতে হবে তাদের অসাধারণ পরিশ্রম, অধ্যাবসায়, জ্ঞান ও দায়িত্ববোধের মধ্য দিয়ে। আর এসবই সুন্নাতুল্লাহ বা জগতে স্রষ্টার রেখে দেয়া মিরাকল। যেই সমাজ ও রাষ্ট্র এই সুন্নতের অনুসরণ করবে সেই সফল হবে। একটুও দ্বিমত করবার অধিকার কারও না। এ কথা চরম সত্য, মুসলিমরা একটা সময় পরে ভাগ্যবাদি হয়ে গেছে। অর্থাৎ, হঠাৎ হয়তো পরিবর্তন হয়ে যাবে সব। ফিরে আসবে সেই গৌরবময় ইতিহাসের দিনগুলো। কিন্তু ইসলাম এটাকে সমর্থন করে না। ইসলামের শিক্ষানীতির দর্শনে এটার কোনই হকিকত নাই।
একটা সমাজে বিপ্লব রেনেসাঁ আনতে হলে শিক্ষিত সমাজের সাথে সাধারণ মানুষের সংযোগ ঘটাতে হবে৷ কিন্তু পশ্চিমাদের বিভাজননীতিই এটাকে অকার্যকর করে সবসময়। ইসলাম হচ্ছে সমাজের রুহ৷ দেহ থেকে যখন রুহকে পৃথক রাখা হয় তখন দেহ অকার্যকর ও নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে। কারণ, ইসলামী ব্যবস্থা হলো একই সাথে ধর্ম ও কানুন, আদর্শ ও বৈষয়িকতা, আধ্যাত্মিক সমাজ ও রাষ্ট্রের সমাহার। তাই ধর্মশিক্ষাকে সমাজিক অনুষ্ঠান না ভেবে এটাকে সমাজিক রুহ ভাবা তাদের জন্য একান্ত কর্তব্যই ছিল বটে। পাশাপাশি ৭১ এর হাঙ্গামা এই শিক্ষানীতিতে ইসলামের প্রবেশকে বাধাগ্রস্ত করেছিল কিংবা ইসলামকে চাচ্ছিল না। এর বড় কারণ হচ্ছে, ৭১কে অনেকেই ইসলাম এবং বিধর্মীদের (পড়ুন হিন্দুদের) যুদ্ধ হিশেবে দেখেছিল। ভারতীয় নথি ও অনেক গবেষকের লেখাজোকায় এই যুদ্ধকে পাক-ভারত যুদ্ধ হিশেবেও দেখা হয়েছিল। যেহেতু ধর্মের দোহাই দিয়ে ভারত ভাগ হয়ে পাকিস্তান হয়েছিল সেজন্য শিক্ষানীতি প্রবর্তনের ওপর এর আংশিক প্রভাব খুব করেই পড়েছিল। যদিও জাতীয়তাবাদী চিন্তার খোরাক থেকেই একটি সুন্দর চিন্তা করা হয়েছিল, প্রাথমিক শিক্ষা মাতৃভাষায় দেয়া হবে৷ কিন্তু নিজের শেকড় চিনতে ভুল করলে এই পাঁচটি বছর আরবি শিক্ষা না দিলে ভুল জায়গাতেই পানি ঢালার নামান্তর হবে বিষয়টি। অর্থাৎ আরবি শিক্ষার পাশাপাশি প্রাথমিক সমস্ত বই তারা মাতৃভাষাতেই প্রদান করতে পারতেন। তাছাড়া, আরবি বর্ণমালা শিক্ষা পুস্তকেই দিতে হবে এটাও জরুরি ছিল না বা এখনও নয়। বরং ভাষা শেখার ক্ষেত্রে মাতৃভাষা শেখার মেথডলজি এখানে প্রয়োগ করা জরুরি ছিল। অজান্তে-আনমনে-আরামসে শিখবে বাচ্চারা৷ কুদরতি খুদা শিক্ষাকমিশন এর ৫৭ নং পৃষ্ঠায় উল্লেখ ছিল- Madrasah education requires radical reform and appropriate reconstruction. The same primary education system will be introduced in the madrasahs as in all other educational institutions and Bengali will be the medium of instruction at all levels.
আর ধর্ম শিক্ষার ব্যাপারে বাধ্যতামূলক শব্দের প্রয়োগ ঠিকই করেছে। কিন্তু প্রাহসনিক ভাবেই করা হয়েছে। কারণ, এর শুরু ক্লাস ৬ থেকে—
Religious Instruction has been included as a compulsory subject in the syllabuses for classes VI to VIII.
আমাদের শিক্ষাকে সার্বজনীন করা এবং এককালীন শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করা প্রয়োজন। কিন্তু একই শিক্ষা সবার জন্য সমানভাবে প্রয়োজন কিনা সেটা ভেবে দেখাও জরুরি। এজন্য আরও জরুরি ছিল এথিক্স ও আখলাকি সংকট নিরসনের। এই কাজের জন্য প্রয়োজন অর্থনৈতিক নিরসন। আর যদি হিম্মত আরও শক্তিশালী করা যায় তাহলে আমাদের উচিত বাজেটের অর্ধেক বা এক তৃতীয়াংশ অথবা দুই তৃতীয়াংশ শিক্ষাখাতে বিনিয়োগ করা। যদি বিশ থেকে ত্রিশ বছরের লক্ষ্য নিয়ে আমরা কাজ শুরু করি তাহলে আমরা নিজেরাই মানবসম্পদ হয়ে ভ্যালু ক্রিয়েট করতে পারব। কিন্তু প্রতিটা সরকার-ই তার শেষ সময়ে এসে শিক্ষাক্রমে হাত দেন। যেন-তেন হাত না। সরাসরি বাম হাত। এমনকি, তত্বাবধায়ক সরকার, যার দায়িত্ব কেবল ক্ষমতা হস্তান্তর তাকে-ও এসে এই শিক্ষাক্রমে হাত ঠেলতে দেখা গেছে। নিজেদের অবস্থান জানান দেয়ার জন্য সকলের অবস্থানকে কোনঠাসা করার এথিকস একমাত্র এরকম অসুস্থ পলিটিক্সেই আছে৷ এথিক্সে ভরপুর ধর্মীয় শিক্ষার অনুপস্থিতি আমাদের এরকম অসুস্থ পলিটিক্স চর্চা করতে বাধ্য করছে। অথচ পলিটিক্স চর্চা ধর্ম চর্চারও একটি অংশ। অনেকাংশে ফরজ। [উসূলে ফিকাহ]
কুদরতি খুদা শিক্ষাকমিশন এর ধর্মবিষয়ক এই একটি ব্যাপার ছাড়া বাকিগুলো সময়োপযোগী পদক্ষেপ ছিল। একটি যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশকে গড়ে তোলার জন্য বঙ্গবন্ধুর এই উদ্যোগী ভূমিকা রাষ্ট্রপতি হিসেবে যেমন দায়িত্বশীলতার অংশ ছিল পাশাপাশি একাজে তিনি প্রশংসারও দাবিদার। কিন্তু যোগ্য উত্তরসূরী দ্বারা এর বাস্তবায়ন না করতে পারায় এ ব্যাপারে তার কাছে কৈফিয়ত চাইবো কি না সেটা ভুক্তভোগীদের ব্যাপার। একটা বিষয় স্পষ্ট করা প্রয়োজন, বঙ্গবন্ধুর সেক্যুলারিজমের ব্যাখ্যা সামগ্রিক ব্যাখ্যা থেকে ভিন্ন। অর্থাৎ তিনি একে ব্যাখ্যা করেছেন নির্দিষ্ট ছাঁচে না পড়া সামগ্রিক ভাবার্থ থেকে। যার অর্থ, ধর্মপালনে বাধ্যবাধকতা নেই। সকল ধর্মই সমান। রাষ্ট্র যেহেতু নিষ্ক্রিয় বস্তু, তাই এরও কোন ধর্ম থাকতে নেই। আপাত দৃষ্টিতে বিষয়গুলো সুন্দর ও মতানৈক্যহীন হওয়ায় এর প্রতি আকর্ষণ করা সহজ। সহাবস্থান এর পন্থা দারুণ। কিন্তু এর প্রায়োগিক দিকটাই সমস্যার উৎসমূল। কারণ, রাষ্ট্রীয় আমলাদের সবার প্রায়োগিক চিন্তা ধর্মীয় সহাবস্থান ও সহনশীলতা থেকে উৎসারিত হবে না। নিজ নিজ ধর্মের প্রতি আনুগত্যপ্রবণ হয়েই সিদ্ধান্ত আসবে এবং প্রয়োগ হবে। যেহেতু এটাই ধ্রুব সত্য। তাহলে এর সমাধানকল্পে ভিন্ন কোন যুক্তি দাঁড় না করিয়ে ধর্মের ভেতরেই সমাধান খুঁজে নেয়া বুদ্ধিমান মানুষের কাজ ছিল। তো যাইহোক, আমরা যেহেতু চিন্তা করি তাই আমাদের চিন্তার পুনর্গঠন করতে হলে চিন্তার উৎসেরও পুনর্গঠন জরুরি। আর চিন্তা যেহেতু পুরোপুরি মানবিক-ঐচ্ছিক কার্যাবলীর অংশ না, তাই, আমাদের কৃত চিন্তার বিশুদ্ধতা যাচাইয়ের জন্য এমন কিছুকেই মাপকাঠি নির্ধারণ করতে হবে যা শ্বাশত, চিরায়ত। আর এই পৃথিবীতে একমাত্র শ্বাশত চিরায়ত বিষয় হিশেবে স্রষ্টার বিধানের ওপর কিছু নেই।
শেষ কথা হচ্ছে, যেই ধর্মের শুরুর কথা- পড়ুন! সেই ধর্মকে শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তকে অগ্রাহ্য করা বোকামী। হয়তো, আমরা মুসলমান দেখে ইসলামের ফায়সালা করেছি। হ্যাঁ, এটা লজিক্যাল মিস্টেক। উসূলহীনতা। উচিত ছিল, ইসলামকে দেখা। সেজন্য নীতিনির্ধারক মহলের নিকট আবেদন থাকবে, বর্তমান পাঠ্যক্রমে ধর্ম শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করবেন তারা। রুহহীন দেহ সর্বস্ব পড়াশোনার প্রভাব শিক্ষার্থীদের জীবনে নীতিনির্ধারকবিহীন প্রশাসনের মতো।