কেউ ফেরে খালি হাতে

আবুল ফাতাহ:

পাণ্ডববর্জিত এই এলাকায় প্রথম পা ফেলেই আমার মনে হলো—বড় ভুল করে ফেলেছি।

আবছা অন্ধকারে শোয়েব আমার দিকে তাকিয়ে সম্ভবত হাসি দিল। কারণ অন্ধকারে ওর উজ্জ্বল দাঁতের পাটি ঝিলিক ছাড়া আর কিছু নজরে এল না। আমিও ওর প্রতিউত্তর দিতে চাইলাম কিন্তু তা শেষমেশ কাষ্ঠহাসি হয়ে দাঁড়াল। অবশ্য শোয়েব তা দেখেছে বলে মনে হয় না।

‘কীরে, কেমন লাগছে?’ শোয়েব উচ্ছসিত ভঙ্গিতে বলল।

‘দারুণ!’ এদিক ওদিক তাকাতে তাকাতে অন্যমনষ্ক ভঙ্গিতে বললাম।

শোয়েব সম্ভবত আমার ব্যঙ্গটা ধরতে পারল না, উল্টো গদ-গদ কণ্ঠে বলল, ‘বলেছিলাম না!’ কথাটা শেষ করেই শোয়েব হাঁটা ধরল।

আমি শোয়েবের পিছু পিছু একটু দূরে দাঁড়ানো ভ্যানটার দিকে এগিয়ে গেলাম। ভ্যানচালক খুব সম্ভব শোয়েবের পূর্বপরিচিত। অন্ধকারে শোয়েবকে চিনতে পারামাত্রই একগাল হেসে আমাদের ভ্যানে উঠে বসার আমন্ত্রণ জানাল।

আমার কাছে তেমন কোন ব্যাগ-পত্র নেই, শুধু একটা মাঝারি আকারের ব্যাকপ্যাক। সেটা ভ্যানের পাটাতনে রেখে ভ্যানের দু’পাশে অবস্থিত ইঞ্চি ছয়েক চওড়া সিটে কোনোমতে পশ্চাৎদেশ স্থাপন করার সাথে সাথেই ভ্যানে টান দিল মাঝবয়সী চালক। উল্টে পড়তে পড়তে সামলে নিলাম।

শোয়েবদের বাড়ির উঠোনে যখন পৌঁছুলাম তখন আমার হাড়গোড় থেকে ব্যাচেলরের চৌকির মতো খটাখট আওয়াজ আসছে, এক্ষুণি হুড়মুড় করে খুলে পড়ল বলে! আধাপাকা রাস্তার অবস্থা ছিল তথৈবচ। জায়গা জায়গায় ইট সরে গিয়ে বিশাল বিশাল গর্ত তৈরি হয়েছে, তার এক একটাতে ভ্যানের চাকা পড়তেই মনে হচ্ছিল যেন বয়ামে ভরে ঝাঁকাচ্ছে কেউ।

অবশ্য এরপর আদর আপ্যায়নের কমতি হলো না। শোয়েবের ছোট ভাই খুবায়েব প্রায় জোর করেই আমার হাত থেকে ব্যাকপ্যাকটা নিয়ে নিল। শোয়েবের মা বড় একটা ঘোমটার আড়াল থেকে বলল, ‘আব্বা, হাত মুখ ধুইয়া আসেন, আমি খাবার দিতাছি।’ আব্বা ডাকটা শুনতেই ভেতরটা ঠাণ্ডা হয়ে গেল। আর বাহিরটা ঠাণ্ডা হলো কলতলায় গিয়ে। চাপকলের পানি যেন বরফজল। মুহূর্তেই ক্লান্তির আধেকটা ঝেটিয়ে বিদেয় করল।

ফ্রেশ হয়ে বারান্দায় রাখা একটা চৌকিতে গিয়ে বসলাম। শোয়েবও এসে পড়েছে। বাড়ির বাকি সবার খাওয়া হয়ে গেছে। আমরা না এলে এতক্ষণে একঘুম হয়ে যাবার কথা ছিল। শোয়েবের বাবা একটু অসুস্থ দেখে আর দেরি করেননি। চৌকির উপর মাদুর বিছানো। এখানেই বাড়ির খাওয়া দাওয়া চলে। আমরা বসতে না বসতেই শোয়েবের মা এবং অন্য এক মহিলা খাবার পরিবেশন করতে লাগল।

এই বেলা খাওয়া-দাওয়ার একটা বর্ণনা দেওয়া আবশ্যক মনে করছি। পদের মধ্যে মাছেরই আধিক্য। শোয়েবের বাবার দুটো বড় বড় পুকুর আছে। সেখান থেকেই নানা রকম মাছ পাওয়া যায় সারা বছর। নিজেরা খেয়েও বিক্রি করতে পারে প্রচুর। ওর বাবার মূল পেশা কৃষি। আগে এক সময় নিজে চাষ করলেও এখন সব জমি বর্গা দেয়া। মাছ ভর্তা, মাছের ঝোল, মাছ ভুনা—কয়েক রকম পদের পর এল মুরগি। শুরুতে দু’তিন রকমের ভাজাভুজি তো ছিলই। তবে আমার মনে থাকবে খাবারের শেষে জ্বাল দিয়ে হলুদ করে ফেলা ঘন দুধের পায়েস। মিষ্টি এবং এলাচির পরিমাণ ছিল যথাযথ। পায়েসে এলাচির ভূমিকা স্বর্ণের খাদের মতোই। একটু কম হলে মিষ্টি ঘ্রাণটা আসবে না আর বেশি হলে তো মুখে তোলারই জো নেই।

এমন রাজকীয় খাওয়া দাওয়ার বদৌলতে সারাটাদিন শোয়েব আমাকে দিয়ে যে পরিমাণ ভোগান্তি করিয়েছে তা মাফ করে দেয়া যায়। অবশ্য ওরই বা দোষ কোথায়? গাঁয়ের ছেলে, পরিশ্রম গায়ে লাগে না বড় একটা। আমার মতো শহুরে ননীর পুতুল তো আর না। আমার তেরো পুরুষের বাস শহরে। শুধু এক চাচার বাড়িই ছিল গ্রামে। ছোটবেলায় হাতে গুনে বার কয়েক গিয়েছিলাম। সে স্মৃতিগুলোও ঝাপসা হতে চলেছে। চাচা-চাচি মারা যাবার পর তার দুই ছেলে এখন ঢাকায় সেটল। ফলে গ্রামমুখী হবার বন্দোবস্ত এক রকম বন্ধ। এমন সময় শোয়েব যখন ওর গ্রামের বাড়ি থেকে দুটো দিন ঘুরে আসার প্রস্তাব দিল, ফেলে দিতে পারিনি।

শোয়েব আমার অফিস কলিগ। আমরা একই সাথে একটা আইটি কোম্পানিতে জব করি। বরাবর পোস্ট হবার কারণেই বোধহয় বন্ধুত্বের একটা সম্পর্ক তৈরি হয়ে গেছে আমাদের মধ্যে। বেশ কয়েকবার আমাদের বাসায়ও এসেছে। হপ্তায় শুক্র-শনি আমাদের ডে অফ। কিন্তু এবার সরকারি ছুটির মারপ্যাঁচে কীভাবে কীভাবে যেন টানা চার দিনের একটা লম্বা ছুটি পেয়ে গেলাম। ছুটির আগের দিন সন্ধ্যায় শোয়েব আমার কিউবিকলে এসে প্রস্তাবটা দেয়। ফলাফল, আজকের এই পাঁচ ঘন্টার জার্নি শেষে এখন লম্বা হয়ে আছি প্রত্যন্ত এক গ্রামে।

ভরপেট খাবার পর শরীর ছেড়ে দিয়েছিল। মনে হচ্ছিল মাদুর বিছানো চৌকিতেই শুয়ে পড়ি। শোয়েবেরও একই হাল। দেরি না করে শোয়েবের ঘরে চলে আসি আমরা। বড়-সড় কামরায় উল্লেখযোগ্য আসবাব বলতে গ্রামের চিরায়ত ঐতিহ্য ওই প্রমাণ সাইজের খাটটাই। দুজনে হাত পা ছড়িয়ে শোয়া যাবে। শুতেই চোখ লেগে এল। গ্রামীণ কাঁথা, হালকা শীতল আবহাওয়া আর বিশাল বিছানা আমার ঘুমের জন্য উস্কানিমূলক ভূমিকা পালন করল।

সকালের নাস্তা হলো পিঠাপুলি দিয়ে। বেশিরভাগ পিঠা এর আগে আমি কখনও চোখেও দেখিনি। ছেলের বন্ধু-তাও কলেজ ভার্সিটির ইয়ার দোস্ত না, কলিগই বলা চলে-তার জন্য এমন আদর আপ্যায়ন নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা মুশকিল। আতিথেয়তার সংজ্ঞা একমাত্র গ্রামের মানুষই রপ্ত করতে পেরেছে ।

খাওয়া সেরে বসে আছি বারান্দার চৌকিতে। শোয়েবের বাবার সাথে খাওয়ার সময়ই পরিচয় হয়েছে। প্রৌঢ় ভদ্রলোক বেশ দিলখোলা মানুষ। বাড়ির অন্যান্য সদস্যের মতই বাড়ির কর্তাও আমাকে এক দেখাতেই আপন করে নিয়েছেন। পরিচয় পর্ব শেষ হতেই একটা বাজারের ব্যাগ হাতে ছুটলেন।

তিনি বিদায় হতেই আমি শোয়েবের দিকে তাকিয়ে বললাম, ‘হ্যাঁ রে, তোর গ্রামে দেখার মতো কী আছে?’

শোয়েব একগাল হেসে বলল, ‘কী দেখতে চাস? সব পাবি। ধানক্ষেত, বিশাল বড় বটগাছ, পুকুর, খাল—কোনটা দরকার তোর?’

আমি খেকিয়ে উঠলাম, ‘আরে ব্যাটা! এসব তো সব গ্রামেই থাকে, তোর গ্রামের স্পেশালিটি কী? এমন কিছু বল যেটা অন্য গ্রামে নেই।’

শোয়েব যেন অকূলপাথারে পড়ে গেল। বেশ কিছুক্ষণ ঠোঁট কামড়ে, মাথা চুলকে ও যেটা বলল সেটা শুনে আমি বিষম খেতে বসলাম।

‘এক বাবা আছে।’

‘তোর বাবা গ্রামে থাকে সে তো জানিই।’

‘গাধা! ওই বাপ না রে!’ শোয়েব হেসে ফেলল, ‘ফকির দরবেশ টাইপ। গ্রামের মানুষ ভক্তি করে বাবা ডাকে।’

‘অ।’

আমি ঠোঁট ওল্টালাম দেখে শোয়েব বলল, ‘এভাবে তাচ্ছিল্য করিস না। অনেক কামেল লোক। দূর দূরান্তের গ্রাম থেকে মানুষজন তার কাছে তদবির নিতে আসে।’

আমি মাছি তাড়ানোর মতো শোয়েবের কথাটা উড়িয়ে দিলাম। ‘সব ভন্ড! পিটিয়ে এদের পাছার ছাল তুলে ফেলা উচিত।’

বলেই বুঝলাম, এতোটা রুক্ষ না হলেও পারতাম। হিন্দিতে একটা কথা আছে—গলির কুত্তা বাঘ হয়। এই বাবাও হয়তো এই গ্রামের বাঘ। লোকে সম্মান করে।

আমার কথায় যথেষ্টই আহত হয়েছে শোয়েব। তোম্বা মুখে বলল, ‘তুই না দেখে এভাবে বলতে পারিস না। তোর কি কোন পীর ফকিরের সাথে পারসোনাল শত্রুতা আছে নাকি!’

শেষের কথাটা শোয়েব হালকা চালে বললেও প্রসঙ্গটা এসে যাচ্ছে দেখে আমি তড়িঘড়ি বললাম, ‘সরি রে, এভাবে বলা ঠিক হয়নি। আসলে এসবে আমার বিশ্বাস নেই তো।’

শোয়েব এরপর একটু বিরতি নিয়ে বলল, ‘আমাদের গ্রামে না থাকলেও এক গ্রাম পরে একটা জমিদার বাড়ি আছে। যাবি নাকি?’

কাল অমন দুর্গম-গিরি-কান্তার-মরু পাড়ি দিয়ে এসে আজ আর পাশের গাঁয়ে যাওয়া পোষাবে না। আবার বেড়াতে এসে ঘরে বসে থাকতেও মন সায় দিচ্ছে না। অগত্যা বললাম, ‘না রে, তার চাইতে চল তোর দরবেশ বাবাকেই দেখে আসি। দেখি, কেমন কাবিল লোক!’

‘এক শর্তে নিতে পারি।’ শোয়েব শুকনো গলায় বলল। ‘ওখানে গিয়ে আউল ফাউল বকতে পারবি না।’

আমি হেসে ফেললাম।

দুই

শোয়েবদের বাড়ি থেকে বাবার দরবারে আসতে মিনিট পনেরো লাগল। গ্রামের এদিকটাতে ঘরবাড়ি পাতলা। মেঠোপথ ছেড়ে একটা পায়ে হাঁটা পথ বাঁ দিকে কিছুটা এগিয়ে একটা উঠোনে গিয়ে মিশেছে। উঠোনসহ বাড়ির চৌহদ্দি মাটি থেকে ফুট দুয়েক উঁচু। বারান্দাসহ মূল বাড়িটা টিনের। লাগোয়া রান্নাঘর। উঠোনে লম্বা করে কয়েকটা মাদুর বিছানো। সেইসব মাদুরে বসে আছে জনা বারো মানুষ। একটা বিষয় দেখে চমৎকৃত হলাম, উঠোনে কোনো মহিলা নেই। সবাই পুরুষ। আজ কি কোনো মহিলা আসেনি? না, তা হতে পারে না। বাংলাদেশের ভণ্ড পীরেরা যে দুটো খেয়ে পরে বেঁচে আছে তার বেশিরভাগ কৃতিত্ব নারীকে দিতেই হবে। মহিলারাই এদের প্রধান অডিয়েন্স। তাহলে এখানে কি মহিলাদের আসা নিষেধ নাকি তাদের বসার আলাদা ব্যবস্থা? যেটাই হোক, তাতে এই বাবা একটা সাধুবাদ পেতেই পারেন।

আমি শোয়েবের দিকে গলা বাড়িয়ে নিচু গলায় বললাম, ‘এখানে মহিলাদের আসা নিষেধ নাকি?’

‘হ্যাঁ, মহিলারা তদবির নিতে চাইলে বাড়ির পুরুষ মানুষকে পাঠাতে হবে।’

‘দারুণ ব্যাপার তো! কারণ কী, জানিস নাকি?’

‘হলফ করে বলতে পারব না কিন্তু শুনেছি বাবার বেগম নাকি মারাত্মক সুন্দরী। বউয়ের নিষেধ, মেয়েছেলের তদবির করা যাবে না।’

‘বাবার চেয়ে তো বাবার বউয়ের ক্ষমতা বেশি দেখা যাচ্ছে, লোকে তার থেকে তদবির নিলেই পারে!’ আমি দাঁত বের করে বললাম।

শোয়েব চোখ পাকিয়ে আমাকে ওর পিছু নিতে ইঙ্গিত করল।

শোয়েবের পিছু পিছু ঘরের সামনে এসে দাঁড়াতেই দেখলাম, বারান্দায় মিচকা টাইপের এক লোক চেয়ার পেতে বসে আছে। পরনে ওভার সাইজ পাঞ্জাবি, সবুজ লুঙ্গি আর মাথায় কিশতি টুপি। বুঝলাম, লোকটা বাবার কম্পাউন্ডার। সিরিয়াল অনুযায়ী এক এক করে রোগী ভেতরে পাঠাচ্ছে। আচ্ছা, এদের সবাইকে কি রোগী বলা যায়? না বোধহয়।

গ্রামে শোয়েবদের খানিক প্রভাব প্রতিপত্তি আছে বোধহয়। কম্পাউন্ডার আমাদের দেখামাত্রই উঠে দাঁড়াল। সালাম দিল।

‘গোলাম নবী, এ হলো আমার বন্ধু সোহেল। ঢাকা থেকে এসেছে। বাবার সাথে একটু দেখা করতাম। করা যাবে?’ শোয়েব বলল লোকটার উদ্দেশে।

‘যাইব না কেন, নিশ্চই যাইব। অ্যার পরেই আপনেগো সিরিয়াল।’ দাঁত বের করে বলল গোলাম নবী।

শোয়েব কথা না বলে হাসল। এই ফাঁকে আমার নজর চলে গেল রান্নাঘরের দিকে। সেখানে মাঝ বয়সী এক মহিলা রান্না করছেন। এ মহিলা অতি অবশ্যই হুজুরের বউ নন। সম্ভবত বাড়ির কাজকর্ম এই মহিলাই দেখাশোনা করেন। হুজুরের আমদানি নিশ্চয়ই মন্দ না। বউকে রাণির হালে রাখতেই পারেন।

আমাদের বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো না। মিনিট দশেক পরেই ভেতর থেকে একজন লোক বের হতেই গোলাম নবী আমাদের ভেতরে যেতে ইঙ্গিত করল।

‘আয়,’ বলে শোয়েব পা বাড়াল। আমি ওর পিছু নিলাম।

পর্দা সরিয়ে ভেতরে পা দিতেই আতরের কড়া গন্ধে মাথা ঝাঁ করে উঠল। বাইরের রোদ থেকে ভেতরে আসায় দৃষ্টি পরিষ্কার না। আমি চোখ পিট পিট করলাম। আস্তে আস্তে নজরে এল ভেতরের দৃশ্য। জায়গাটা বেশি বড় না। একটা চৌকি কোনোমতে বিছানো হয়েছে। জায়গাটা সম্ভবত শুধুমাত্র তদবিরের জন্যই ব্যবহৃত হয়, অন্দরমহল আরো ভেতরে।

চৌকির সামনে একটা চেয়ার পাতা দর্শনার্থীদের জন্য। বাবা নিজে পদ্মাসনে বসে আছেন চৌকিতে। ধবধবে সাদা জুব্বা বেয়ে আমার দৃষ্টি ভদ্রলোকের চেহারায় নিবদ্ধ হলো। একটা ছোট খাট ধাক্কা খেলাম। আমার ধারণা ছিল, বাবার বয়স নিদেনপক্ষে চল্লিশ তো হবেই, ধবলকেশ কোনো বৃদ্ধকে বসে থাকতে দেখলেও অবাক হতাম না। অথচ তার পরিবর্তে বসে আছে প্রায় আমাদেরই সমবয়সী এক… হ্যাঁ, যুবক বলা যায় তাকে। টেনেটুনে পঁয়ত্রিশ হবে হয়তো বয়সটা।

আমাদের দেখে বাবা… নাহ, এই ভাইয়ের বয়সী ভদ্রলোককে আর যাই হোক, বাবা বলা আমার পক্ষে কিছুতেই সম্ভব না। আমি বরং হুজুর বলেই সম্বোধন করি তাকে। হুজুর আমাদের দেখে স্মিত হাসলেন। আর ঠিক সেই মুহূর্তে আমার মাথার ভেতরে যেন কীসের বিস্ফোরণ ঘটল! হাসিটা আমার খুব পরিচিত। বিদ্যুৎচমকের মতো আমি চিনে ফেললাম আমার সামনে বসা মানুষটাকে। মাথায় একগাদা স্মৃতি মেইলট্রেনের যাত্রীদের মতো হুড়মুড় করে ঢুকে পড়ল।

বসে পড়তে পারলে ভালো হতো কিন্তু আর এক মুহূর্তও এখানে থাকার বিন্দুমাত্র ইচ্ছাও নেই। আমি তীরবেগে বেরিয়ে এলাম ঘরটা ছেড়ে। তার এক সেকেন্ড পর বিহ্বল শোয়েব আমার পথ ধরল।

তিন

আমি আর শোয়েব বসে আছি একটা গাছের নিচে। বেশ ফুরফুরে হাওয়া দিচ্ছে। ধাতস্ত হতে চনমনে বাতাস বেশ ভূমিকা রাখল।

আমাদের থেকে একটু দূরেই একটা মুদি দোকান। দোকানের টিভিতে মান্নার একটা ছবি চলছে। সামনের বেঞ্চিতে বসে থাকা চারজন দর্শক মুগ্ধ নয়নে মান্না কর্তৃক ডিপজলকে ফর্দাফাই হতে দেখছে।

‘চা খাবি?’ বসার মিনিট পাঁচেক পর শোয়েব প্রস্তাব দিল। আমি জবাব দেয়ার আগেই সে নিজেই কৈফিয়তের সুরে বলল, ‘চা কেমন জানি না।’

‘সমস্যা নেই, চলবে।’

আমি সায় জানাতেই শোয়েব উঠে গেল। একটু পরেই দুটো কাপে রং চা নিয়ে ফিরে এল। হাতে নিতেই দেখলাম, তেজপাতার টুকরো ভাসছে। চুমুক দিলাম। মন্দ না, মিষ্টি একটু বেশি।

ঠোঁট থেকে কাপ নামাবার আগেই অবধারিত প্রশ্নটা চলে এল শোয়েবের পক্ষ থেকে।

‘ওভাবে চলে এলি কেন? তোর ভাব দেখে মনে হচ্ছিল, বাবাকে তুই আগে থেকে চিনিস।’

‘বাবা বাবা করিস না তো।’ আমি ধমকে উঠলাম।

‘ঠিক আছে, আর করব না, বাবা …’ বলেই জিভ কাটল শোয়েব।

আমি ওর মুখের ভঙ্গি দেখে হেসে উঠলাম।

পরিবেশ খানিক হালকা হতেই শোয়েব আমাকে ক্যাঁক করে চেপে ধরল। একেবারে কচ্ছপের কামড়। ছাড়াছাড়ি নেই। অগত্যা হাল ছেড়ে দিলাম। তবে শোয়েবকে ঘটনা বলার আগে আমার কিছু তথ্য জানা দরকার।

‘আচ্ছা, বলছি। তার আগে বল তো হুজুরের নামটা কী? বাড়ি কি এখানেই?’

‘আরশাদ। আগে পরে কী আছে জানি না। নাম ধরে তাকে আর কেউ ডাকে না। ছোট বড় সবাই তাঁকে হয় ‘বাবা’ নয় ‘হুজুর’ বলে। হ্যাঁ, বাড়িও এখানেই। ওই বাড়িতেই তাঁর বাবা-মা থাকত। বাবা অনেক আগেই মারা গেছে। মা মারা যায় বছর দুই আগে।’

‘হুম, এতক্ষণে নিশ্চিত হলাম। একেবারে কংক্রিট প্রুফ। এবার আসল কথা বলি, তোদের আরশাদ হুজুর পাক্কা একটা ভণ্ড। জোচ্চোর।’

‘কী বলছিস এসব?’ আহত শোনাল শোয়েবের গলা। সারা এলাকার লোক মানুষটাকে ভক্তি করে। লোকের উপকার না হলে কি তেরো চোদ্দ বছর ধরে এই কাজ চালিয়ে যেতে পারে, তুই-ই বল?’

‘হুম, তার মানে ওই জোচ্চুরির পর সোজা এখানে এসে আস্তানা গেড়েছে।’

‘একটু ঝেড়ে কাশ তো, ভাই।’ চায়ে জোরে করে একটা চুমুক দিল শোয়েব। কণ্ঠের বিরক্তি প্রকাশ পেল রুক্ষ চুমুকেও।

‘আচ্ছা, শোন।’ আমি আর ভণিতার মধ্যে গেলাম না। ‘প্রায় পনেরো বছর আগে-তখন আমার বয়স কতোই বা হবে, এই ধর, সতেরো আঠারো-আমরা যে এলাকায় থাকতাম সেই এলাকার মসজিদের মুয়াজ্জিনের সাথে আমাদের বেশ ভালো খাতির ছিল। যখনকার কথা বলছি, তখন ওই বয়সী ছেলেপেলেরা নামাজ কালাম পড়ত মসজিদে। মুয়াজ্জিন সাহেবের বয়সও আমাদেরই মতো ছিল। হয়ত বছর দু’তিনের বড় হবে। এজন্যই একটা বন্ধুত্বের সম্পর্ক তৈরি হয়। সেই মুয়াজ্জিন সাহেব আবার টুকটাক তাবিজ কালামের পাশাপাশি এক মাদ্রাসায় ফাজিল প্রথম বর্ষে পড়াশোনা করত। তার কথায় একটু পর আবার আসছি, এখন রাকিবের কথা বলা যাক। রাকিব আমার খুব ঘনিষ্ট বন্ধু ছিল। ওর বাবা ফটো স্টুডিও চালাত। মাঝে মাঝে রাকিবও বসত দোকানে। ওখানেই আমরা বন্ধুরা আড্ডা দিতাম মাঝে মাঝে। তো একদিন আমি আর রাকিব বসে আছি। রাকিব ফটোশপে ছবি এডিট করছিল। আমি গল্প করতে করতে ওর কাজ করা দেখছিলাম। এমন সময় একটা ছবি দেখে আমার পিঠ খাড়া হয়ে গেল। এক অপূর্ব সুন্দরী কিশোরীকে স্ক্রিনে দেখতে পেলাম। বয়স আমাদের মতোই হবে, কিন্তু সারল্য এখনও যায়নি মেয়েটার চেহারা থেকে।

রাকিবকে বললাম, মেয়েটার পরিচয় বের করতে। রিসিট দেখে জানতে পারলাম মেয়েটার নাম সুমাইয়া। আমাদের করিম চাচার মেয়ে। এ কারণেই মেয়েটাকে আগে কখনও দেখিনি। করিম চাচা ছিলেন খুবই ধার্মিক মানুষ। এলাকাবাসী শুধু জানত তাঁর দুটো মেয়ে আছে কিন্তু কেউ কখনও দেখেনি। দুজনই কঠোর পর্দা করত। সুমাইয়া হলো তাঁর ছোট মেয়ে। সম্ভবত কোনো অফিশিয়াল কাজের জন্য কন্যার ছবি তোলার দরকার হয়ে পড়েছিল।

আমি রাকিবকে বললাম, ছবির একটা কপি আমাকে দিতে। ও তো কিছুতেই দেবে না। ওর বাবা জানতে পারলে ওকে নাকি স্রেফ কেটে ফেলবেন। ঘটনা সত্য। ওর বাবা রাগী মানুষ ছিলেন। কিন্তু ছবি তো আমার চাই। পকেটে যা ছিল, সব বের করে কোনোমতে ওকে রাজি করালাম একটা পাসপোর্ট সাইজের ছবি দিতে।

ছবি তো পেলাম কিন্তু আমার মাথা খারাপের মতো হয়ে গেল। দিন রাত ছবিটা বুক পকেটে রাখতাম। মাঝে মাঝে লুকিয়ে চুরিয়ে দেখতাম। মনে হতো, সুমাইয়াকে না পেলে আমি বাঁচব না। খুব অস্থির লাগত। এই অবস্থা থেকে আমাকে উদ্ধার করল রাকিবই। বলল, আমাদের মুয়াজ্জিন সাহেব তো তাবিজ কালাম করেন। তার কাছে নিশ্চয়ই বশীকরণ টাইপ কোনো টোটকা থাকবে। আমার কাছে পরিকল্পনা খুব একটা জাতের মনে না হলেও আর কোনো রাস্তা ছিল না। অগত্যা একদিন আছরের নামাজের পর মুয়াজ্জিন সাহেবকে সব খুলে বললাম। তিনি বললেন, করা যাবে কিন্তু একটু বেশি খরচাপাতি হবে। পাঁচ হাজার। সাথে যাকে বশ করব তাঁর পাসপোর্ট সাইজের একটা ছবি।

শুনে আমার বুক শুকিয়ে গেল। না, ছবির জন্য না। ছবি তো ছিলই কিন্তু পাঁচ হাজার টাকা আমি কোথায় পাব? আমি তখন নিতান্তই কিশোর। হপ্তায় পকেট খরচা পাই সাকুল্যে একশ টাকা। জমানো সবটাই গেছে রাকিবের থেকে ছবিটা খসাতে। বুঝে ফেললাম, সুমাইয়াকে আমার আর পাওয়া হবে না। কিন্তু মন তো আর সায় দেয় না। আমার অস্থিরতা আরো বেড়ে গেল। ঠিকমতো খাওয়া দাওয়া করতাম না। বাবা মা ভাবল আমার অসুখ করেছে। ডাক্তার-ফাক্তার দেখানো হলো। কিন্তু অসুখটা যে কোথায়, তা তো আমি জানি!

প্রায় মাসখানেক পর ঘটনাটা ঘটল। একদিন খাটের নিচে বল খুঁজতে গিয়ে মায়ের একটা স্বর্ণের আংটি খুঁজে পেলাম যে আংটি অনেক আগেই হারিয়ে গেছে বলে ধরে নেয়া হয়েছে। যখন হারায় তখন পুরো বাড়ি তন্ন তন্ন করে ফেলা হলেও আংটিটা খুঁজে পাওয়া যায়নি। সেই আংটি আমি কীভাবে পনেরো টাকার টেনিস বল খুঁজতে গিয়ে পেলাম, সে রহস্যের কিনারা আজও হয়নি।’

আমি দম নেয়ার জন্য একটু থামলাম। শোয়েব চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। নিশ্চয়ই ভাবছে, কোথাকার কোন সুমাইয়া আর আংটির সাথে আরশাদ হুজুরের সম্পর্ক কী!

আমি আবার খেই ধরলাম।

‘এরপরের ঘটনা বুঝতেই পারছিস। আংটিটা আট হাজার টাকায় বিক্রি করি। সেদিন বিকালেই আমি টাকা আর ছবি নিয়ে হাজির হই মুয়াজ্জিন সাহেবের দরবারে। মুয়াজ্জিন সাহেব সব দেখে শুনে বললেন, এক সপ্তাহের মধ্যে কাজ হয়ে যাবে। শুনে আমি নাচতে নাচতে বাড়ি ফিরলাম।

এরপরের ঘটনা সংক্ষিপ্ত। পরদিন শুনতে পেলাম, মুয়াজ্জিন সাহেব চাকরি ছেড়ে দিয়ে চলে গেছে। সাথে নিয়ে গেছে আমার পাঁচ হাজার টাকা আর সুমাইয়াকে বশ করার স্বপ্ন।’

‘সবই বুঝলাম, এর সাথে আরশাদ হুজুরের সম্পর্ক… দাঁড়া, এক মিনিট… তারমানে তুই বলতে চাচ্ছিস, তোদের মুয়াজ্জিন সাহেবই আরশাদ হুজুর?!’

আমি শুধু হাসলাম। শোয়েব জবাব পেয়ে গেল।

‘আনবিলিভেবল! আমি বিশ্বাস করি না। ছোটবেলা থেকে আমি আরশাদ হুজুরকে দেখে আসছি। অনেক দারিদ্রতার মধ্যে বড় হলেও কখনও অন্যায় কিছু করতে দেখিনি। সেই মানুষ তোর পাঁচ হাজার টাকা মেরে দেবে?’

‘বন্ধু, যখনকার কথা বলছি তখন পাঁচ হাজার টাকা অনেক ছিল। আর বিশ্বাস-অবিশ্বাস সম্পূর্ণ তোর উপর। আমি কিছু চাপিয়ে দিচ্ছি না তোকে।’

শোয়েব ধন্দে পড়ে গেল। আমাকে চেনে ও। জানে, এ ধরনের মিথ্যা আমি কখনই বলব না। অপরদিকে আজীবন ধরে বিশ্বাস করে আসা একজন মানুষকে মিনিটের ব্যবধানে জোচ্চর বলেও মেনে নিতে পারছে না।

হঠাৎ ঝপ করে দাঁড়িয়ে গেল শোয়েব। কঠিন গলায় আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘চল।’

আমি অবাক হয়ে গেলাম ওর কণ্ঠ শুনে। ‘কোথায়?’

‘হুজুরের বাড়িতে।’

‘দেখ, আমি আগেই বলেছি…।’

‘তোর কথা আমি শুনতে চাই না,’ আমাকে থামিয়ে দিল শোয়েব, ‘আমি তোদের দুজনকেই অনেক বিশ্বাস করি। দুজনের মধ্যে কেউ তো অবশ্যই মিথ্যা বলছে। আমার নিজের স্বার্থেই ব্যাপারটা পরিষ্কার হওয়া দরকার। নইলে তোদের দুজনকেই আমি বাকিটা জীবন অবিশ্বাসের চোখে দেখব। দুজনকে অবিশ্বাস করার চাইতে একজনকে বিশ্বাস করা ভালো।’

আমি মাথা নেড়ে রাজি হয়ে গেলাম। না হবার কারণ নেই। আমি জানি, এইমাত্র যে ঘটনা আমি বলেছি তাতে এক রত্তি মিথ্যা নেই।

চার

আজকের দিনে দ্বিতীয়বারের মতো প্রবেশ করলাম আরশাদ হুজুরের দরবারে।

দুপুরের খাবারের সময় হয়ে গেছে এজন্যই বোধহয় দর্শনার্থী আর নেই। আমরা যখন ঢুকি, আরশাদ হুজুর তখন তার গদি ছেড়ে উঠতে যাচ্ছিলেন। আমাদের দেখেই থমকে গেলেন। অস্বস্তিকর কয়েকটা সেকেন্ড পেরিয়ে যাবার পর সেই স্মিত হাসিটা ফিরে এল তাঁর ঠোটে। হাসিটা মুখে ঝুলিয়েই তিনি আমাকে স্বাগত জানালেন।

‘কেমন আছো, সোহেল?’

আমি না তাকিয়েও শোয়েবের অবস্থা বুঝতে পারলাম। আরশাদ হুজুরের এই সম্ভাষণই বুঝিয়ে দেয়, তিনি আমাকে খুব ভালোমতোই চেনেন। বিজয়ীর হাসি ফুটে উঠল আমার ঠোঁটে।

শোয়েব কঠিন গলায় কিছু বলতে যাচ্ছিল, হাত তুলে ওকে থামিয়ে দিলেন আরশাদ হুজুর।

‘খাবারের সময় হয়ে গেছে। আমার কেন যেন মনে হচ্ছিল, তোমরা আবার আসবে। এজন্য খাবার একটু বেশি করে রাঁধতে বলেছি। আসো, খেতে খেতে আলাপ করি।’

হাহ! স্টান্টবাজি আর কাকে বলে! আমি মনে মনে বললাম। এসব স্টান্টবাজি দেখিয়েই গ্রামের সহজ সরল মানুষগুলোকে ভাঙিয়ে খাচ্ছে ভণ্ড হুজুরটা। আমরা যে ফিরে আসব, সেটা বোঝার জন্য নাসার সায়েন্টিস্ট হতে হয় না। তবে মুখে কিছু বললাম না। হুজুরের আমন্ত্রণ রক্ষার্থে ভেতরের ঘরে প্রবেশ করলাম আমি আর শোয়েব। ভেতরে তিনটে কামরা। তারই একটার মেঝেতে মাদুর বিছিয়ে খাবারের ব্যবস্থা। আটপৌরে আয়োজন, গত দুবেলা গুরুপাকের পর এই খাবার দেখে বসে পড়তে দেরি করলাম না।

হুজুর নিজেই সব এগিয়ে দিতে লাগলেন। এরমধ্যেই শোয়েবের সাথে কুশল বিনিময় হলো। তিনজনের পাতে খাবার পৌছুতেই শুরু করার ইঙ্গিত করলেন আরশাদ হুজুর। আমি করলা ভাজিটা দিয়ে ভাত মাখিয়ে মুখে তুলতে যাবার আগেই আসল কথা পাড়লেন তিনি।

‘আমার উপর রাগ করে আছো, তাই না সোহেল?’

আমি মৃদু হেসে বললাম, ‘সত্যি করে বললে, না। ওসব কথা অনেক আগেই ভুলে গেছি। আজ আপনাকে এভাবে হুট করে দেখতে পেয়ে মাথাটা গরম হয়ে গেছিল। একটু ওভার রিয়াক্ট করে ফেলেছি। আপনি শোয়েবকে সত্যিটা বলে অন্যায় স্বীকার করে নিলে আর কোনো খেদ থাকবে না। গ্রামের মানুষ আপনাকে শ্রদ্ধা করে, আমি সে শ্রদ্ধায় বাগড়া দেব না।’

আরশাদ হুজুর হাসলেন।

‘বলছি। তুমি যেদিন আমার কাছে সুমাইয়াকে বশ করার প্রস্তাব নিয়ে আসো, আমি ভেতরে ভেতরে খুব মজা পেয়েছিলাম। মানুষকে বশ করার বিদ্যা আমার জানা ছিল না, এখনও নেই। কিন্তু তোমাদের সাথে আমার সম্পর্ক ভালো ছিল তাই সরাসরি তোমাকে নিষেধ না করে ছবি আর টাকার শর্ত জুড়ে দিলাম। করিম সাহেবকে আমি জানতাম, তাঁর মেয়ের ছবি তোমার পক্ষে যোগার করা অসম্ভব বলেই ভেবেছিলাম। কিন্তু কে জানত, মেয়েটার ছবি পকেটে নিয়েই সেদিন আমার কাছে এসেছিলে। দ্বিতীয় বাধা ছিল—টাকা। ছবি যদি কোনোভাবে ম্যানেজ করতেও পারো, টাকাটা যে পারবে না সেটা এক প্রকার নিশ্চিতই ছিলাম।

কিন্তু একমাস পরে যখন ছবি আর টাকা নিয়ে আমার কাছে এলে, আমি খুবই চমকে যাই। কীভাবে তোমাকে ফিরিয়ে দেব বুঝতে পারছিলাম না। তাই এক সপ্তাহ সময় নিলাম। ভেবেছিলাম এরমধ্যে কিছু একটা বলে তোমাকে মানিয়ে নিতে পারব। টাকাটাও ফেরত দিয়ে দেব। কিন্তু সেদিন রাতেই খবর পাই, আমার বাবা মারা গেছেন। আমার কোনো ভাই বোন নেই। এই বাড়িতে শুধু বাবা মা-ই থাকতেন। বাবা মারা যাবার পর মা’র একা একা এখানে থাকা অসম্ভব। তাই সেদিনই আমি চাকরি ছেড়ে একেবারে গ্রামে চলে আসার সিদ্ধান্ত নেই। সব কিছু এত দ্রুত ঘটে যায়, অন্য কোনো চিন্তাও মাথায় আসেনি। ভেবেছিলাম, তোমার টাকাটা মসজিদের ইমাম সাহেবের কাছে রেখে আসব। কিন্তু সেই মুহূর্তে আমার টাকার খুব প্রয়োজন ছিল। তাছাড়া টাকাটা অন্য কারো হাতে দিলে তোমার ফ্যামিলির জেনে যাবার সম্ভাবনা ছিল। সাত-পাঁচ ভেবে টাকাগুলো নিয়েই চলে আসি। তুমি হয়তো জানো না, এর মাসদুয়েক পরে আমি আবারও তোমাদের এলাকায় যাই। টাকাটা ফিরিয়ে দেবার জন্য। তোমাদের বাসায় গিয়ে জানতে পারি, তোমরা এলাকা ছেড়ে চলে গেছো।’ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে থামলেন আরশাদ হুজুর।

আমি আড়চোখে শোয়েবের দিকে তাকিয়ে বুঝলাম, তার বুক থেকে বিশাল এক পাথর নেমে গেছে। এতক্ষণ ধরে নিশ্চয়ই ভাবছিল, আজকের পর থেকে আমি অথবা আরশাদ হুজুরের মধ্যে থেকে একজনের সাথে ওর সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যাবে, আমাদের মধ্যে কেউ একজন অবশ্যই মিথ্যা বলছে। ভাবতে পারেনি, একই সাথে আমরা দুজনেই যার যার জায়গায় সঠিক হতে পারি।

কিন্তু আমি শোয়েবের মতো অতো নির্ভার হতে পারছি না। এক ধরনের মিশ্র অনুভূতির মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি। এতোদিন যাকে জোচ্চোর বলে ভেবে এসেছি, মুহূর্তের মধ্যে তাকে ফেরেশতা ভাবতে মন সায় দিচ্ছে না। হয় এমন। মানুষ দীর্ঘদিনের ভাবনা এক লহমায় ছুঁড়ে ফেলে দিতে পারে না। কিন্তু আরশাদ হুজুরের কথা অবিশ্বাসও করতে পারছি না। খাপে খাপে মিলে যাচ্ছে সব। এতোদিনের ঘৃণার আসন থেকে মানুষটাকে সরিয়ে দেবার আগে শেষ একটা ধাক্কা দেয়ার লোভ সামলাতে পারলাম না। বাঁকা হেসে বললাম, ‘ঠিক আছে, সবই মেনে নিলাম। কিন্তু আপনার যে আসলে কোনো ক্ষমতা নেই সেটা কিন্তু স্বীকার করে নিলেন। অর্থাৎ এখানে যা করছেন সেটা এক ধরনের লোক ঠকানো।’

আরশাদ হুজুর হেসে উঠলেন। এবার খানিকটা শব্দ করে।

‘মানুষ বশ করার ক্ষমতা হয়তো নেই কিন্তু আল্লাহ’র কাছে চাইবার ক্ষমতা তো আছে। এটা সবারই থাকে কিন্তু সবাই চাইতে জানে না। আমি হয়তো কিছু কিছু জানি।’

‘তাহলে সুমাইয়ার ব্যাপারে চাননি কেন? আর কিছু না হোক, একটু দোয়া তো অন্তত করতে পারতেন আমার জন্য।’

‘কে বলল চাইনি? দোয়ার পাশাপাশি দাওয়ারও ব্যবস্থা করেছিলাম। বাবা মারা যাবার দু’মাস পরে তোমাদের এলাকায় আমার যাওয়ার মূল উদ্দেশ্যই ছিল সুমাইয়ার বাবাকে বিয়ের প্রস্তাব দেয়া।’ একটু বিরতি দিয়ে শান্ত স্বরে আরশাদ হুজুর বললেন, ‘তোমার দেয়া ছবিটা দেখে আমিও তোমার মতোই মেয়েটার প্রেমে পড়ে যাই। সুমাইয়াকে আমি খুব করে চেয়েছিলাম। তবে তোমার জন্য না, সোহেল, আমার নিজের জন্য।’

আমার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল।

এরমধ্যেই আরশাদ হুজুর হাঁক ছাড়লেন, ‘খালাকে দিয়ে পায়েসের বাটিটা পাঠিয়ে দাও তো, সুমাইয়া!’

আগের সংবাদফ্লোরেন্তিনো: এক অলোক পরিণতি
পরবর্তি সংবাদদখল