আবু ত্বোয়াহা
১৯৪৭ সালে বাঙলা চিরতরে ভাগ হয়ে যায় দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে। যদিও, বাঙলা ভাগের জন্য মুসলমানরাই দায়ী, এরকম একটা ন্যারেটিভ ১৯৭১ সালের স্বাধীনতার পর থেকেই এদেশের বুদ্ধিজীবী মহলে চালু আছে। কিন্তু নব্বইয়ের দশকে জয়া চ্যাটার্জির ‘বেঙ্গল ডিভাইডেড’ প্রকাশিত হলে, বেরিয়ে পড়ে বাঙলা ভাগের পেছনে ভারত রাষ্ট্র ও কোলকাতার উচ্চবর্ণের হিন্দুদের ভূমিকা। আধুনিক সময়ের গবেষণাগুলোতে দেখা যায়, বাঙলাভাগের পেছনে দ্বিজাতিতত্ত্বই শুধু নয়, বড় ভূমিকা রেখেছিল কোলকাতার উচ্চবর্ণ হিন্দুদের জাত্যাভিমানও।
দেশভাগের পরেও, বাঙলার দুই অংশেই থেকে গিয়েছিল হিন্দু ও মুসলমান সংখ্যালঘুদের বড় একটা অংশ। দেশভাগের সময়কার দাঙ্গা, বাড়িঘর লুটপাট, উদ্বাস্তু হয়ে দেশত্যাগ–এসব স্মৃতি আছে দুই বাঙলারই, দুই ধর্মেরই অসংখ্য মানুশের। কিন্তু, ওপার বাঙলার সাহিত্য, সিনেমা, গান বা কবিতায় বাঙালি মুসলমানের দেশভাগের যাতনার স্মারক কি যথেষ্ট পরিমাণে আছে? পশ্চিমবঙ্গে তো বটেই, স্বাধীনতার পরে বাঙলাদেশেও দেশভাগ বা বাঙলাভাগের আলোচনা মূলত ও মূখ্যত আবর্তিত হয়েছে বাঙালি হিন্দুর দেশত্যাগের স্মৃতি, ক্ষয়ক্ষতি ও বেদনা নিয়ে। কিন্তু দেশভাগের এই আখ্যানটিতে অদ্ভুতভাবে অনুপস্থিত বাঙালি মুসলমানের কথা। বাঙলাদেশে বাঙালি হিন্দু যেহেতু সংখ্যালঘু, তাই রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিসরে তাদের অধিকার ও কষ্টের বর্ণনা বারবার এসেছে ঘুরেফিরে। কিন্তু বাঙলাদেশে তো বটেই, এমনকি পশ্চিমবঙ্গের প্রেক্ষিতেও, পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি মুসলমানের দুঃখ-দুর্দশা ও দেশভাগজাত কষ্ট-বেদনার আখ্যান ও গল্পগুলো বরাবরই উপেক্ষিত থেকেছে এই অঞ্চলের রাজনৈতিক ও সামাজিক গবেষণায়। পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি মুসলমান সমাজ কেমন আছে? এই প্রশ্নের উত্তর প্রথম পাওয়া গেল ২০০৬ সালের সাচার রিপোর্টে। বিস্ময়ের সাথে দেখা গেল, দেশভাগের আগে বাঙলার রাজনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক-অর্থনৈতিক পরিমণ্ডলে ক্রমবিকাশমান মুসলমানরা মানবেতর জীবন কাটাচ্ছে পশ্চিমবঙ্গে।
বাঙলায় মুসলমান
মোটামুটি ত্রয়োদশ শতাব্দীর সময় থেকে বাঙলায় ইসলামের পদার্পণ । উনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে ব্রিটিশ লক্ষ করে যে বাংলার পূর্ব প্রান্তের গ্রামাঞ্চলে মুসলমান জনসংখ্যার ঘনত্ব অস্বাভাবিক রকমের বেশি । ১৮৭২ সালের সেন্সাস পরবর্তী চমকে দেওয়ার মত মুসলমান জনসংখ্যার তথ্য এবং তার ফেনমেনা বিষয়ে ব্রিটিশ গবেষণা করতে শুরু করে। এই যে বিপুল পরিমাণ মুসলমান জনসংখ্যা কেন এবং কিভাবে তা ব্যখ্যা করতে উঠে আসে মূলত চার ধরনের মতামত। প্রথমত অভিবাসনের তত্ত্ব, দ্বিতীয়ত তরবারির ক্ষমতায় ইসলামে পরিবর্তনের মতামত, তৃতীয় মতামত অনুসার সামাজিক মুক্তির ধর্ম হিসাবে বাংলার নিন্মবর্গের ইসলামকে স্বীকৃতি দান এবং চতুর্থত মুসলমান শাসকদের পৃষ্ঠপোষকতার কারণে ইসলামের প্রসার বিষয়ক তত্ত্ব।
অভিবাসন তত্ত্ব অনুসার ভারতের অধিকাংশ মুসলমান বিভিন্ন সময় ধরে এদেশে আসা মূলত বিদেশী মুসলমান জনসম্প্রদায়ের বংশধর । সন্দেহ নেই দক্ষিণ এশিয়ার সে সমস্ত ভূখণ্ড যেখানে ইরান বা মধ্যপ্রাচ্য ভূমি পথের মাধ্যমে সংযুক্ত অথবা আরবসাগরের রাস্তায় আসা সম্ভব সেখানে ইসলাম ধর্ম প্রসারে এই বিদেশী মুসলমান অভিবাসীগণ সাহায্যকারীর ভুমিকা পালন করেছেন । তবে এই তত্ত্ব কেরালা, গুজরাত, কাশ্মীর অথবা উত্তর ভারতের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হলেও বাংলার পূর্ব প্রান্তের গ্রামাঞ্চলে বিপুল পরিমাণ মুসলমান জনসংখ্যার কারণ ব্যাখ্যা করতে পারে না। ইরান এবং আরব সাগর থেকে বহুদূরের এই ভূখণ্ডের ৯৯% মুসলমান স্থানীয় জনগোষ্ঠী। তাদের ভাষা, সংস্কৃতি এবং শারীরিক গঠন আরব বা ইরানের অধিবাসীদের তুলনায় সম্পূর্ণ পৃথক ।
তরবারির ক্ষমতায় ইসলামের বিস্তারের তত্ত্ব ক্রুসেড-পরবর্তী পশ্চিমী চিন্তা জগত উৎসাহের সঙ্গে মেনে নিলেও বা অটোম্যান সাম্রাজ্যের এবং বিভিন্ন মূলসমান সাম্রাজ্যের বিস্তারের সাথে সাথে ইসলামের বিস্তারের এক যোগসূত্র হিসাবে ধরে নিলেও ভারতে ইসলামের বিস্তারের সাথে এই তত্ত্বের খুব একটা যোগসূত্র নেই । যদি সত্যই রাজনৈতিক অথবা সামরিক শক্তির বলে ভারতে মুসলমান ধর্মে পরিবর্তনের ঘটনা ঘটে থাকত তাহলে সে সমস্ত অঞ্চল দীর্ঘ কাল ধরে মুসলমান শাসনের অধীন ছিল সেখানে বা তার আশেপাশে মুসলমান জনসংখ্যা এতদিনে সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়ার কথা অথচ ঘটনা বা বাস্তব তার বিপরীত। ভারতের যে সমস্ত অঞ্চলে মুসলমান জনসংখ্যা সংখ্যাগুরু যেমন বাঙলার পূর্বের জেলাগুলিতে,পশ্চিম পাঞ্জাবে সেই সমস্ত অঞ্চলে মুসলমান শাসকের তরবারির ক্ষমতা ছিল দুর্বল । এই সমস্ত প্রান্তিক অঞ্চলে পাশবিক বল ছিল সব থেকে কম প্রভাবশালী। বাংলার পূর্ব প্রান্তে এবং পশ্চিম পাঞ্জাবে যেখানে প্রথম সেন্সাস তথ্য অনুযায়ী ৭০-৯০% মুসলমান সেখানে গঙ্গার অববাহিকায় এবং উত্তর ভারতে মুসলমান জনসংখ্যা মাত্র ১০-১৫%। অন্য অর্থে ভারতীয় উপমহাদেশে যে সমস্ত অঞ্চলে মুসলমান রাজনৈতিক এবং সামরিক শক্তি দুর্বল ছিল সেই সমস্ত অঞ্চলে মুসলমান ধর্মাবলম্বী জনসংখ্যা তুলনামূলক অধিক এবং যে সমস্ত অঞ্চলে দীর্ঘ কাল যাবত মুসলমান রাজনৈতিক এবং সামরিক শক্তি বলবত ছিল সেই সমস্ত অঞ্চলে মুসলমান ধর্মাবলম্বী জনসংখ্যা তুলনামূলক ভাবে কম। বর্তমান পশ্চিমবঙ্গের মালদা এবং মুর্শিদাবাদ প্রায় সাড়ে চারশো বছর ধরে মুসলমান নবাবদের রাজধানী হওয়া স্বত্বেও রাজশাহী , দিনাজপুর এবং নদীয়ার তুলনায় এই সমস্ত জেলাতে মুসলমান জনসংখ্যার হার আনুপাতিক হারে কম ছিল। সুতরাং তরবারির ক্ষমতায় ভারতে, বাঙলায় বা পশ্চিম পাঞ্জাবে ইসলাম বিস্তার লাভ করেছে তথ্যগত ভাবে তা সত্য নয়।
এই পরিপ্রেক্ষিতে উঠে আসে ইসলাম অবলম্বন করে সামাজিক মুক্তির তত্ত্ব। ব্রিটিশ ইতিহাসবিদগণ এবং এথনগ্রাফার্স’রা ভারতীয় উপমহাদেশে ইসলামের প্রসারের কারণ হিসাবে ইসলামের প্রগতিশীলতা, জাতিভেদ প্রথা না থাকা এবং হিন্দু ধর্মের জাতিভেদ প্রথা থেকে মুক্তির উপায় হিসাবে বিপুল সংখ্যক নিন্মবর্গিয় হিন্দুদের ইসলাম অবলম্বনের অন্যতম কারণ হিসাবে উল্লেখ করতে থাকেন। এই তত্ত্ব অনুসার হিন্দুধর্মের চূড়ান্ত জাতিভেদ প্রথা এবং সেই কারণে বিচ্ছিন্ন নিম্নবর্ণের হিন্দু ইসলামের সামাজিক সমতার দর্শনে আকর্ষিত হয়ে দলে দলে ধর্ম পরিবর্তন করে মুসলমান হয়ে যেতে থাকেন। বাঙলায় এবং ভারতে এই তত্ত্বের সত্যতা যথেষ্ট দুর্বল, শুধু তাই নয় এই তত্ত্ব ভারতীয় উপমহাদেশের ধর্মীয় ভূগোলের সাথে অসামঞ্জস্যপূর্ণ। ১৮৭২ সালের সেন্সাসের তথ্য অনুসার ভারতে সর্বাধিক মুসলমান জনঘনত্ব বাংলার পূর্বের জেলাগুলি, পশ্চিম পাঞ্জাব, বালুচিস্তান এবং নর্থ ওয়েস্ট ফ্রন্টিয়ার এলাকায়। এই প্রত্যেকটি এলাকাই হিন্দু হার্ট ল্যান্ড থেকে বহু দুরে। এই সমস্ত এলাকায় হিন্দু এবং বৌদ্ধ ধর্মের নিয়ন্ত্রণ এবং প্রভাব ছিল তুলনামূলকভাবে কম। মনুর বিধান ছিল প্রায় অজানা। বিশেষত বাংলায় মুসলমান ধর্মে পরিবর্তিত জনজাতি মূলত রাজবংশী, পোদ, চণ্ডাল, কোচ এবং অন্যান্য স্থানীয় ক্ষুদ্র সম্প্রদায় এই সম্প্রদায়ের ওপর ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতির প্রভাব ছিল অতি নগণ্য। অনুরূপভাবে পশ্চিম পাঞ্জাবেও বিভিন্ন জাট গোষ্ঠী মূলত মুসলমান ধর্মে পরিবর্তিত জনজাতি। তাই হিন্দু ধর্মের জাতিভেদ প্রথা থেকে মুক্তির উপায় হিসাবে ইসলাম অবলম্বন এই তত্ত্বও বাঙলায় মুসলমান ঘনত্বর কারণ হিসাবে ঠিক প্রযোজ্য নয়।
অনেকে বলেন, অতি ধীরে ধীরে এই পরিবর্তন বাঙলার কৃষি এবং রাজনৈতিক সীমান্তে ঘটেছে। বাঙলার গ্রামীণ আঞ্চলিক সংস্কৃতির সাথে ইসলাম এমনভাবে মিশে গেছে যে স্থানীয় অধিবাসীদের ইসলামকে বিদেশী ধর্ম হিসাবে কখনো মনেই হয়নি। বাঙলার পূর্বের প্রদেশগুলিতে কৃষি এবং কৃষিজীবী সম্প্রদায়ের বিস্তারের সাথে সাথে কৃষিজীবী গ্রামীণ জনতার স্বাভাবিক ধর্ম হয়ে গেছে ইসলাম। ইসলাম বাংলার গ্রামীণ আঞ্চলিক সংস্কৃতির সাথে মিশে তার আরবিয়ানা হারিয়ে এক বিপুল সংখ্যক জনতার ধর্মে পরিবর্তিত হয়ে গেছে–তার সাথে রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা ,তরবারির ক্ষমতায় ধর্ম পরিবর্তন অথবা হিন্দু ধর্মের জাতিভেদ প্রথা থেকে মুক্তি পাওয়ার আকাঙ্ক্ষায় ইসলাম অবলম্বন এর কোনটাই বাঙলায় বিশেষত বাঙলার পূর্বের জেলাগুলিতে ৭০-৯০% মুসলমান জনসংখ্যার অস্তিত্বের কারণ হিসাবে ব্যাখ্যা করতে পারে না ।
বাঙলার মুসলমানদের সামাজিক বিভেদ
ধর্মীয়ভাবে হিন্দুদের মত কাস্ট সিস্টেম না থাকলেও বাঙলার মুসলমানদের মধ্যে সামাজিক শ্রেণীবিভেদ ছিল। এই শ্রেণীবিভেদ গড়ে উঠেছিল মূলত অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবস্থানের উপর ভিত্তি করে। আবার, এ অঞ্চলের স্থানীয় হিন্দু জনগণ, যারা পরবর্তীতে মুসলমান হয়েছিল, এবং বিদেশী অভিবাসী মুসলমান , উত্তরভারতীয় মুসলমান বনিক এবং উচ্চ শ্রেণীর হিন্দু পরবর্তীতে ইসলাম-অবলম্বী সম্প্রদায়ের মধ্যেও গড়ে উঠেছিল এক ধরণের আর্থ-সামাজিক বিভেদ।
বাঙলায় সব থেকে উচ্চ শ্রেণীর মুসলমানেরা হলেন–আশরাফ অথবা শরীফ। এঁরা মূলত জমিদার, ভূস্বামী, শিক্ষক, উচ্চপদাধিকারী ইত্যাদি। বিদেশী অভিবাসী মুসলমান, উত্তরভারতীয় মুসলমান বণিক এবং উচ্চ শ্রেণীর হিন্দু পরবর্তীতে ইসলাম-অবলম্বী সম্প্রদায়ের বংশধর বাঙলার মুসলমান সমাজের উপরের স্তরের এই গোষ্ঠীর অধিকাংশের উপাধি সৈয়দ, শেখ, পাঠান, মালিক, মির্জা ইত্যাদি। মুসলমানদের মধ্যে দ্বিতীয় সামাজিক অবস্থানে আছেন আজলাফ অথবা আতরাপ/আতরাফ। এই শ্রেণীর অধিকাংশ অপেক্ষাকৃত নিম্নবর্গ হিন্দু থেকে মুসলমানে পরিবর্তিত হওয়া জনসম্প্রদায়। সৈয়দ বা শেখেদের চোখে নিচু শ্রেণীর মুসলমান। পেশাগতভাবে জোলা (তন্তুবায়) হাজাম (নাপিত), ধুনকর, নিকারি, ধোপা, ক্ষুদ্র ব্যবসাদার ইত্যাদির অধিকাংশ এই আতরাফ শ্রেণীর মুসলমান। এদের উপাধি প্রায় হিন্দুদের মতই–মণ্ডল, সরকার, বিশ্বাস, সর্দার ইত্যাদি।
হিন্দু সমাজের শূদ্রদের মতই সবথেকে নীচের স্তরের সামাজিক অবস্থানের মুসলমানেরা হলেন–আরযুল। মূলত পতিত, দলিত এবং নমশূদ্র সমাজ থেকে মুসলমানে পরিবর্তিত জনগোষ্ঠীর অংশ। হিন্দু অন্ত্যজ গোষ্ঠীর সমগোত্রীয় এই আরযুল মুসলমানেরা তাড়ি বা মদ বানানোর পেশাতে যুক্ত, কসাই, মেথর, চামার, জিপসি ইত্যাদি। সামাজিকভাবে প্রায় প্রান্তিক এই মুসলমানদের সাথে ওপরে বর্ণীত দুই মুসলমান সমাজের মধ্যে প্রকৃত অর্থে কোন সামাজিক, বৈবাহিক যোগসুত্র অবর্তমান। বাঙলায় মুসলমান সমাজের মধ্যেও কাস্ট এবং তার কুফল যথারীতি বর্তমান। আশরাফ এবং আতরাপ/আতরাফদের মধ্যে বৈবাহিক সম্পর্ক বর্তমান অথবা পেশা পরিবর্তন এবং সম্পদ সংগ্রহের মাধ্যমে ওপরের গোত্রের মুসলমান হিসাবে উন্নীত হওয়ার সম্ভাবনা বর্তমান। যেমন একজন আতরাফ মুসলমান বলতে পারেন ‘গত বছরে আমি জোলা ছিলাম, এই বছর আমি শেখ হয়েছি, যদি এই বছর ভালো পাটের দাম পাই তাহলে আগামী বছর আমি সৈয়দ হয়ে যাব।’ কিন্তু আরযুল অথবা একদম নিচের শ্রেণীর মুসলমান এই বৃত্তের বাইরে, মুসলমান সমাজে তাদের স্থান আমাদের দলিত সম্প্রদায়ের মতই সামাজিক এবং অর্থনৈতিকভাবে উপেক্ষিত এমনকি কোন কোন ক্ষেত্রে তাঁদের জন্য আলাদা কবরস্তান বর্তমান। বাঙলার বিপুল পরিমাণ মুসলমানদের মধ্যে ১৮৭১ সালের সেন্সাসে দেখা যাচ্ছে মাত্র ১-১,৫% মুসলমান আশরাফ অর্থাৎ সৈয়দ, শেখ, পাঠান, মালিক, মির্জা ইত্যাদি, বাকি ৯৯% হয় আতরাপ/আতরাফ অথবা আরযুল। এই ৯৯%-এর মাতৃভাষা বাঙলা। সাংস্কৃতিক এবং সামাজিক ঐতিহ্য, আচার-আচরণ-পোশাক প্রায় হিন্দুদের মতই। নিজেদের মধ্যে কাস্ট সিস্টেম সূক্ষ্ম মাত্রায় বর্তমান। গ্রামের পূজা আর্চায় অংশগ্রহণকারী, ঢাকি, মালাকার ইত্যাদি। এদের মধ্যে অধিকাংশ কৃষিজীবী অথবা তন্তুবায়, মাঝি, মাছুয়া, ধুনকর, নাপিত, চামড়ার কাজ এবং বিভিন্ন পেশার সাথে যুক্ত মূলত নিম্নবর্গের হিন্দু এবং বৌদ্ধ সমাজ থেকে মুসলমানে পরিবর্তিত জনসমাজ।
দেশভাগের পূর্বের অবস্থা
বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিক থেকে বাঙলার মুসলমান সমাজে এই স্থবির সামাজিক অবস্থানের বিপুল পরিবর্তন হতে শুরু করে। সব থেকে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তনটি ঘটে চিরাচরিত কৃষিভিত্তিক পেশার পরিবর্তে মধ্যবিত্ত শিক্ষিত মুসলমান বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়ের উদ্ভব। শিক্ষা, চাকরী, সংস্কৃতি এবং রাজনীতিতে এই মুসলমান সম্প্রদায়ের উপস্থিতি ক্রমশ লক্ষিত হতে থাকে। ১৮৭০/৭১ সালে বাঙলার উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মাত্র ৪% ছাত্র ছিল মুসলমান অথচ ১৯২০/১৯২১ সালে সেই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় প্রায় ১৪-১৫ %-এ। বাংলার কোন কোন অঞ্চলে যেমন ঢাকা, হুগলী এমনকি প্রেসিডেন্সি কলেজে মুসলমান ছাত্রদের সংখ্যা হিন্দু ছাত্রদের সংখ্যার সমপরিমাণ এমনকি কোথাও কোথাও বেশি হয়ে দাঁড়ায়। আবার কোলকাতার আলিয়া মাদ্রাসাকেন্দ্রিক মাদ্রাসাশিক্ষিত শ্রেণীও এসময় দেশের রাজনীতি, সাহিত্য-সংস্কৃতি ও অন্যান্য ক্ষেত্রে অবদান রাখতে শুরু করে। আর এই নব্য শিক্ষিত মুসলমান মধ্যবিত্ত শ্রেণী পরবর্তীতে বাঙলার রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তার করতে শুরু করে। মুসলমানদের এই অভাবনীয় অগ্রগতি তাদের হিন্দু কাউন্টার পার্টের সাথে প্রতিযোগিতা একই সাথে মুসলমান জনসংখ্যার বৃদ্ধি ক্রমে বাঙলায় হিন্দু জনসংখ্যাকে পেছনে ফেলতে শুরু করে। ১৯৩১ সালে বাঙলায় মুসলমান জনসংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৫৪.২৯%-এ।
অপ্রত্যক্ষভাবে এই সংখ্যাগরিষ্ঠতার বলে বলীয়ান, হিন্দুদের সাথে বিভিন্ন সুবিধা নিয়ে দর কষাকষি, রিজার্ভ সিট, মুসলিম কোটার অধিকারের মাধ্যমে বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিক থেকে হিন্দু আধিপত্যের সাথে মুসলমানদের সূক্ষ্ম সংঘাতের সূত্রপাত হতে শুরু হয় । ১৯৩২ সালে ম্যাকডোনাল্ডের সম্প্রদায়ভিত্তিক রোয়েদাদের ফলে প্রদেশে নাটকীয়ভাবে ক্ষমতার ভারসাম্য পরিবর্তিত হয়ে যায়। প্রায় একই সাথে ঘোষিত হয় পুনা প্যাক্ট, প্রাদেশিক আইনসভায় হিন্দুরা সংখ্যালঘু হয়ে পড়ে, ‘মুসলমানদের কাছে তাদের চিরস্থায়ীভাবে অধীনতা সম্ভাব্য ভবিষ্যতের ছবি হয়ে পড়ে’। বাঙলায়, সিন্ধে, পাঞ্জাবে এবং আসামে মুসলমান জনসংখ্যার ঘনত্বের কারণে এবং মধ্যবিত্ত শিক্ষিত মুসলমান বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়ের রাজনৈতিক নেতৃত্বে কংগ্রেস মুসলিম লীগের হাতে পরাজিত হয়। অবিভক্ত বাঙলার শাসন ক্ষমতার শেষ দশ বছর ছিল মুসলিম লীগের সরকার। স্বাধীনতার ঠিক পূর্বে ১৯৪৬ সালে সুরাবর্দির নেতৃত্বে বাঙলার সরকার সেই সময়ে সারা ভারতে একমাত্র মুসলিম লীগ সরকার।
১৯৩০ সালের সময় থেকেই বাঙলায় পরিস্কার মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রতিষ্ঠিত। প্রদেশের ক্ষমতায়ও ছিল মুসলিম লীগের নেতৃত্ব। শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতিতে ততদিনে মুসলমান বুদ্ধিজীবী সমাজ স্বাতন্ত্রের বলে বলীয়ান হয়ে গড়ে তুলতে চাইছেন নতুন কৃষ্টি। বুদ্ধদেব বসুদের শ্লেষের জবাব সমানতালে দিচ্ছেন আবুল মনসুর আহমেদরা। ঠিক এই প্রেক্ষিতেই, কংগ্রেস ও হিন্দু মহাসভা পাঞ্জাব ও বাংলা হারাবার ভয়ে, এই দুই প্রদেশ ভাগ করার দাবি তোলে। সোহরাওয়ার্দি, আবুল হাশিম, শরৎ বসু আর কিরণ শঙ্করদের অখণ্ড বাঙলার রূপরেখা ও দাবি কীভাবে হারিয়ে যায় সাম্প্রদায়িক জাতীয়তাবাদে জারিত হিন্দু মহাসভা ও সেক্যুলার মুখোশপরা কংগ্রেসের কম্যুনাল ভেদবুদ্ধির তলে, সে বর্ণনা আমরা পাই জয়া চ্যাটার্জির ‘বেঙ্গল ডিভাইডেড’, আহমদ রফিকের ‘দেশবিভাগ : ফিরে দেখা’ বা বিমলানন্দ শাসমলের ‘ভারত কী করে ভাগ হল’ বইতে। চিত্তরঞ্জন দাশ বাঙলায় হিন্দু-মুসলিমের সহাবস্থানের স্বার্থে সর্বশেষ যে উদ্যোগটি নেন, সেটি এখন ‘বেঙ্গল প্যাক্ট’ (১৯২৩) নামে পরিচিত। কিন্তু সেক্যুলারিজমের মুখোশ পরা কংগ্রেস নেতাকর্মীরা সেদিন এই ‘বেঙ্গল প্যাক্ট’ মানে নাই। তারা এটিকে মুসলমানদের কাছে পরাজয় আখ্যা দিয়ে, চিত্তরঞ্জনের মৃত্যুর পরপরই বেঙ্গল প্যাক্ট বাতিল করেন। মাওলানা আবুল কালাম আজাদের মতে, এটিই ছিল দেশবিভাগের প্রথম বীজ (ইণ্ডিয়া উইনস ফ্রিডম, পৃঃ ২১)।
সোহরাওয়ার্দি এবং শরৎ চন্দ্র বসু বাংলার কংগ্রেস এবং মুসলিম লীগের এক কোয়ালিশন সরকার গঠন করে বাংলার জনতাকে সাম্প্রদায়িক লাইনে বঙ্গভঙ্গের বিরোধিতা করার জন্য উৎসাহিত করতে থাকেন। ২৭ সে এপ্রিল ১৯৪৭ সালে সোহরাওয়ার্দি দিল্লীতে এক প্রেস কনফারেন্সে এই স্বতন্ত্র অবিভক্ত বাংলার পরিকল্পনা পেশ করেন। ২৯ সে এপ্রিল আবুল হাসিম কোলকাতায় সমরূপ ইচ্ছা প্রকাশ্য করে এক বিবৃতি প্রকাশ করেন। একই সময়ে ১৯৪৭ সালের ২১ এপ্রিল খ্যাতিমান বাঙালি নিম্নবর্ণ নেতা এবং তৎকালীন ভারতের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মন্ত্রী যোগেন্দ্রনাথ মন্ডল প্রকাশ্যে বিবৃতি দিয়ে জানান, বাঙলার নিম্নবর্ণ হিন্দুরা বাঙলা ভাগের প্রস্তাবের বিরোধী।
মুসলিম লীগের এক বিপুল অংশ এবং বাঙলার নিম্নবর্ণ, মূলত নমঃশূদ্র হিন্দুরা বাঙলা ভাগের প্রস্তাবের বিরোধী হলেও, কংগ্রেস, হিন্দু মহাসভা এবং কমিউনিস্ট পার্টি অব ইন্ডিয়ার বেঙল শাখার আগ্রহে, নেহেরু-প্যাটেল লবির কাছে শরৎ চন্দ্র বসু, সোহরাওয়ার্দি, কিরণ শঙ্কর রায়, আবুল হাসিম, সত্য রঞ্জন বক্সী এবং মোহাম্মদ আলি চৌধুরীদের স্বতন্ত্র বাঙলার স্বপ্ন পরাজিত হয়। অবশেষে ২০ জুন ১৯৪৭ সালে বাঙলার লেজিসলেটিভ অ্যাসেম্বলিতে বাঙলা ভাগের পরিকল্পনা গৃহীত হয়। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ রোধে বাঙলার যে শিক্ষিত হিন্দু জাতীয়তাবাদী অংশ নেতৃত্ব দিয়েছিলেন মাত্র ৪ দশকের ব্যবধানে বাঙলার সেই শিক্ষিত হিন্দু জাতীয়তাবাদী অংশ দেশভাগের পূর্বে ধর্মের ভিত্তিতে প্রদেশকে ভাগ করার পক্ষে সংঘবদ্ধ আন্দোলন চালায় এবং প্রায় সর্বসম্মতিক্রমে বাঙলা ভাগ মেনে নেয়।
বাঙালি মুসলমানের একটা বড় অংশ পশ্চিমবঙ্গে সংখ্যালঘু হয়ে পড়ে। দেশভাগের আগে ক্রমঃউদীয়মান মুসলমানদের পতনের ইতিহাস শুরু হয়।
কেমন আছেন পশ্চিমবঙ্গের মুসলমানরা
দেশভাগের পরে বিভিন্ন সময়ে পশ্চিমবঙ্গ থেকে কত মুসলমান নিরুদ্দেশ হয়েছেন, তার সঠিক সংখ্যা নিয়ে গবেষণা বড় অপ্রতুল, জানাচ্ছেন জয়া চ্যাটার্জি ( Joya Chatterji, ‘The Spoils of Partition: Bengal and India’, (1947-1967), Cambridge University Press, 2007)। জয়া চ্যাটার্জির গবেষণাতেই আছে যে ১৯৫১ সালের পরিসংখ্যানে দেখা যায় পশ্চিমবঙ্গে ৩৪% মুসলিম কমে গেছে। এই শতাংশকে আমলে নিলে কেবল পশ্চিমবঙ্গ থেকেই ১৫ লক্ষের উপর মানুষ পাওয়া যায় না। এর সাথে রয়েছে বিহার থেকে আসা মুসলমানরা। প্রফেসর কামাল উদ্দিনের গবেষণা মতে ১৯৬৪ সালের দাঙ্গার পর ৮ লক্ষ মানুষ আসে পশ্চিমবঙ্গ থেকে। এছাড়া বিহার রাজ্যের পরিসংখ্যান দেখাচ্ছে ১৯৪১ সালের তুলনায় ১৯৫১ সালের পরিসংখ্যানে ৬০ লক্ষ মানুষ কম! এত মানুষ কোথায় গেল? বিহারীদের বড় একটা অংশ গেছে পাকিস্তানের সিন্ধু প্রদেশে, আরেকটা অংশ এসেছে বাংলাদেশে। সব ডাটাগুলোকে আমলে নিলে একথা বলা অতিরঞ্জিত হবে না যে, আনুমানিক ৪ মিলিয়ন বা ৪০ লক্ষ ভারতীয় বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে ১৯৪৭ থেকে ১৯৬৪ সালের মধ্যেই। ১৯৬৪ সালের পরেও ভারত থেকে প্রচুর মুসলমান এসেছে। এই পেইজেই এক পাঠক মন্তব্য করেছেন ১৯৭১ সালের স্বাধীনতার পরেও ভারত থেকে তাদের গ্রামে প্রচুর মুসলমান এসে বসবাস শুরু করেন। সেসব নিয়ে গবেষণা না হওয়ায় তাদের প্রকৃত সংখ্যা কত জানা সহজ নয়। কেমন আছে পশ্চিমবঙ্গের মুসলমানেরা? ২০০৬ সালে বিচারপতি সাচারের রিপোর্ট হইচই ফেলে দিয়েছিল পশ্চিমবঙ্গ তথা ভারতে। কী ছিল সেই রিপোর্টে? এ রাজ্যে দারিদ্রসীমার নীচে বাস করেন ঠিক কত জন মুসলমান? সেটাও প্রায় ৮০ শতাংশ। যাঁদের মধ্যে অধিকাংশ (৯৪.৯ শতাংশ) বিনামূল্যে খাদ্যশস্যও পান না। অথচ যা পাওয়া তাঁদের অধিকারের মধ্যে পড়ে। ৬২ শতাংশ মুসলমানের নিজস্ব কৃষিজমি নেই। সরকারি চাকরি করেন মাত্র দুই শতাংশ মুসলিম। গ্রামের ৫৪.৬ শতাংশ এবং শহরের ৬০ শতাংশ মুসলিম কোনও দিন স্কুলে যাননি। নারীশিক্ষার হাল আরও খারাপ। স্বাস্থ্যব্যবস্থার কথা যত কম বলা যায়, তত ভাল। এ রাজ্যে ৩৬১টি ব্লকের মধ্যে ৬৫টি ব্লকে মুসলমানরা সংখ্যায় বেশি। আর সেই সব জায়গাতেই হাসপাতালের অবস্থা বাকি ব্লকের চেয়ে দ্বিগুণ খারাপ। মুসলিমপ্রধান এলাকায় স্কুলসংখ্যাও হিন্দুপ্রধান এলাকার চেয়ে বহু-বহু গুণ কম।
সাচার কমিটির রিপোর্ট যখন প্রকাশিত হয়, তখন পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রন্ট ক্ষমতায়। এরপর কতটা পাল্টেছে পশ্চিমবঙ্গের মুসলমানদের জীবনযাত্রার মান? ২০১৬ সালে প্রকাশিত হয় আরেকটি গবেষণা। অ্যাসোসিয়েশন স্ন্যাপ, গাইডেন্স গিল্ড এবং প্রতীচী ইনস্টিটিউটের তৈরি ‘পশ্চিমবঙ্গে মুসলিমদের জীবনের বাস্তবতা : একটি প্রতিবেদন’ নামের ওই গবেষণাটি যখন প্রকাশিত হয়, তখন পশ্চিমবঙ্গের ক্ষমতায় তৃণমূল কংগ্রেস। কিন্তু গবেষণাটিতে দেখা গেল, পশ্চিমবঙ্গের মুসলমানদের জীবনযাত্রার মান প্রায় একইরকম আছে। সেই গবেষণায় দেখা যায়, পশ্চিমবঙ্গে মুসলিমেরা তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি বঞ্চিত। এ রাজ্যের প্রায় ৮০ শতাংশ মুসলিম দারিদ্রসীমার নীচে বাস করেন। ৩৮.৩ শতাংশ পরিবারের মাসিক আয় দারিদ্রসীমার অনেক নীচে। এই রিপোর্টে আরো প্রকাশিত হয়, এক হাজার বা তার বেশি জনসংখ্যাবিশিষ্ট মুসলমান-অধ্যুষিত গ্রামের তিন শতাংশতে কোনও বিদ্যালয় নেই। মুসলমান-অধ্যুষিত এলাকার বিদ্যালয়গুলিতে ছাত্র–শিক্ষকের অনুপাত (৩৭) রাজ্যের গড়ের (২৭ )থেকে অনেকটা বেশি। মুসলমান-অধ্যুষিত এলাকাগুলিতে স্বাস্থ্য পরিষেবাও বেহাল: প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিষেবা পেতে ৩৫ শতাংশ গ্রামের মানুষকে অন্তত চার কিলোমিটার ও ১২ শতাংশ গ্রামের মানুষকে ৮ কিলোমিটার দূরে যেতে হয়। সমীক্ষা-কৃত গ্রামের ৪৫ শতাংশ হাতের নাগালে আধুনিক চিকিৎসার অভাবে হাতুড়েদের উপর নির্ভর করতে বাধ্য হয়। স্বাস্থ্য পরিষেবার সঙ্গে রাস্তার সম্পর্ক নিবিড়; সে ক্ষেত্রেও দেখি ১৮ শতাংশ গ্রামের রাস্তা কাঁচা, সাইকেল চালানোও কঠিন। গর্ভবতী মহিলার প্রসববেদনা এই রাস্তায় দ্বিগুণ হয়, তাই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বাড়িতেই বাচ্চা প্রসবের ব্যবস্থা করা হয়, ফলে রাজ্যের স্বাস্থ্য কেন্দ্রে বাচ্চা জন্মানোর হার কম থাকে।
২০১৬ সালে আনন্দবাজার পত্রিকায় ‘সাচার কমিটি রিপোর্টের দশ বছর পরে’ শীর্ষক একটি লেখায় দেখানো হয়, সাচার কমিটির রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০০৭ সালে রাজ্যের সরকারী কর্মিদের মধ্যে মুসলমানদের অনুপাত ছিল ৪.৭%, ২০১৫ তে সেটা হয়েছে ৫.৪৭%; ২০০৭ সালে কোলকাতা পুলিশে মুসলমানের অনুপাত ছিল ৯.১৩%, ২০১৫ তে সেটা ‘বেড়ে’ দাঁড়িয়েছে ৯.৪৪%; ২০০৭ সালে কোলকাতা পৌরসভায় মুসলিম কর্মচারী ছিল ৪.৪৭%, ২০১৫-তে সেটা হয়েছে ৪.৭৯%! লেখাটি আরো বলছে, পশ্চিমবঙ্গের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে মুসলিম শিক্ষার্থীর সংখ্যা মাত্র ৪-৫%! দেশভাগের আগে, সেই উনবিংশ শতকের শেষদিকে কোলকাতার মুসলমানদের শিক্ষার অবস্থা যা ছিল, ঠিক তাই রয়ে গেছে এই ২০১৫ সালেও।
এখন বর্তমান
এখন ২০১৯ সাল। মোদির নেতৃত্বধীন বিজেপি সরকার দ্বিতীয়বারের মত ক্ষমতায়। মমতা ব্যানার্জিও পশ্চিমবঙ্গে দ্বিতীয়বারের মত ক্ষমতায়। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের মুসলমানদের উন্নতি হয় নাই তেমন। বরং বিজেপির সাম্প্রদায়িকীকরণ প্রক্রিয়ার ভেতর উন্মাদ ভারতে জয় শ্রীরাম ধ্বনির সাম্প্রদায়িকতা থেকে রেহাই পাচ্ছে না পশ্চিমবঙ্গের মুসলিমরাও। যারা কথায় কথায় দেশভাগের সাথে হিন্দু জনগোষ্ঠীর ত্যগ ও বঞ্চনার ইতিহাস হাজির করেন, তারা কি এদেশে পশ্চিমবঙ্গের মুসলমান জনগোষ্ঠীটিকে নিয়ে কিছু বলবেন? বোধহয় না। তাদের জন্য বললে যদি আবার সাম্প্রদায়িকতার তকমা লাগে? বছরের পর বছর, যুগের পর যুগ আমরা পশ্চিমবঙ্গের মুসলমানদের ব্যাপারে চুপ করে আছি। অথচ, এমনকি দলিতদের চাইতেও খারাপ অবস্থা সেখানকার মুসলমানদের। দেশভাগের ফলে সবচাইতে ক্ষতি যদি কারোর হয়, সে পশ্চিমবঙ্গের মুসলমানদের। আমরা নতুন দেশ গড়ে, অসাম্প্রদায়িকতার বুলি আওড়ে তাদের নিয়ে কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছি, আর সেখানকার সামাজিক ইতিহাসেও তাদের কোন স্বীকৃতি নেই। পশ্চিমবঙ্গের মুসলমানদের এই দুর্দশা কি ফুরাবার নয়?
লেখক : ছাত্র, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়