কোরবানির চামড়া : কার পকেটে যাবে কত টাকা?

রাকিবুল হাসান নাঈম:

এবার ঈদুল আজহায় চামড়া সংগ্রহের দাম নির্ধারণ করে দিয়েছে সরকার। এতে গরুর চামড়ার দাম গতবারের চেয়ে ৭ টাকা এবং খাসির ৩ টাকা বেড়েছে। ঢাকার ট্যানারি ব্যবসায়ীদের এবার লবণযুক্ত প্রতি বর্গফুট গরুর চামড়া কিনতে হবে ৪৭-৫২ টাকায়; গত বছর এ দাম ছিল ৪০-৪৫ টাকা। ঢাকার বাইরে লবণযুক্ত প্রতি বর্গফুট গরুর চামড়ার দাম হবে ৪০-৪৪ টাকা, গত বছর যা ছিল ৩৩-৩৭ টাকা। এছাড়া সারা দেশে লবণযুক্ত খাসির চামড়া প্রতি বর্গফুট ১৮-২০ টাকা, আর বকরির চামড়া প্রতি বর্গফুট ১২-১৪ টাকা অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে। গত বছর খাসির চামড়ার দাম ছিল ১৫-১৭ টাকা।

চামড়া ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গরুর শরীর থেকে চামড়া খোলার পর সেটি কিনে নেয় মওসুমি চামড়া ব্যবসায়ীরা। চামড়াতে তখন লবন লাগানো থাকে না। লবনহীন চামড়াটি মওসুমি ব্যবসায়ীরা বিক্রি করেন আড়তদারদের কাছে। আড়তদাররা চামড়ায় লবন লাগায়। ওই লবনযুক্ত চামড়া কেনেন ট্যানারি মালিকরা। সরকারিভাবে ট্যানারি মালিকদের জন্য লবনযুক্ত চামড়ার দাম নির্ধারণ করে দেয়া হলেও তৃণমূল থেকে লবনহীন চামড়ার দাম নির্ধারণ করা হয়নি। ব্যবসায়ীরা বলছেন, লবনহীন চামড়া সাধারণত আন্দাজ করেই কেনা হবে। ফলে চামড়ার ন্যায্যমূল্য থেকে এবারও বঞ্চিত হওয়ার আশঙ্কা কোরবানিদাতাদের। এবারও পুরো লাভ হাতিয়ে নিবে আড়তদার, মৌসুমি ব্যবসায়ী ও ট্যানারি মালিকরা।

লবনহীন চামড়ায় সিন্ডিকেটের সুযোগ

বছরে বাংলাদেশে প্রায় ২২ কোটি বর্গফুট চামড়া পাওয়া যায়। এই চামড়ার ৬০ ভাগের বেশি সরবরাহ মেলে কোরবানির মৌসুমে। এর মধ্যে ৬৪ দশমিক ৮৩ শতাংশ গরুর চামড়া, ৩১ দশমিক ৮২ শতাংশ ছাগলের, ২ দশমিক ২৫ শতাংশ মহিষের এবং ১ দশমিক ২ শতাংশ ভেড়ার চামড়া। এবার ছোট-বড় খামারিদের উৎপাদিত গবাদিপশুর সংখ্যা বর্তমানে ১ কোটি ২১ লাখ ২৪ হাজার ৩৮৯টি। ঈদুল-আযহায় দেশে ৯৭ লাখ ৭৫ হাজার কোরবানির পশুর চাহিদা রয়েছে। কোরবানির জন্য চাহিদার চেয়ে প্রায় সাড়ে ২৩ লাখ পশু বেশি আছে। সাধারণত মাঝারি আকারের একটি গরুর চামড়ার আকার হয় ২৫ বর্গফুট পর্যন্ত। প্রতি বর্গফুট ৪০ টাকা করে ধরলে একটির দাম আসে ১০০০ টাকা।

তাহলে লবনহীন চামড়া কত করে কিনবেন, জানতে চাইলে বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের ভাইস চেয়ারম্যান এবং সমতা লেদার কপ্লেক্সের ডিরেক্টর মু. মিজানুর রহমান ফাতেহকে বলেন, ‘লবনহীন চামড়া ৬০০ থেকে ৬৫০ টাকার মধ্যে কেনা হতে পারে। তবে যারা আড়তদার এবং মৌসুমি ব্যবসায়ী, তারা যেটা ভালো মনে করেন, যেটা উপযুক্ত হয়, সেই দামেই কিনবেন।’

২৫ বর্গফুট একটি চামড়া ৬০০ টাকায় কিনলে প্রতি বর্গফুটের দাম পড়বে ২৪ টাকা। সরকারি সর্বনিম্ন দাম থেকে আরও ১৬ টাকা কমে। তবুও এই টাকায় কিনবে কিনা, সেটারও নিশ্চয়তা নেই। গতবার এই চামড়া বিক্রি হয়েছে ২০০-৩০০ টাকায়। সেই হিসেবে এবারও বিক্রি হলে প্রতি বর্গফুট দাম পড়বে ৮ টাকা করে। লবনহীন চামড়ার দাম নির্ধারণ না করে দেয়ায় মৌসুমি ব্যবসায়ী ও আড়তদাররা দাম কমিয়ে দেয়ার সুযোগ পেয়ে গেলো কিনা, এই প্রশ্নের জবাবে মিজানুর রহমান বলেন, ‘আমি সেটা মনে করি না। আমরা কিন্তু সরকারি দামেই কিনব। যেটাতে লবন নেই, সেটা আড়তদার ও মৌসুমি ব্যবসায়ীরা একটা আন্দাজ করে কিনেন। যেমন একটা চামড়ায় ৮ কেজি লবন লাগে। এখানে ১০০ টাকা খরচ আছে। লবন না লাগালে সেই খরচ কমে। এভাবেই একটা ধারণা করা হয়।

লাভ কত, যাচ্ছে কার পকেটে

ঈদুল-আযহায় দেশে ৯৭ লাখ ৭৫ হাজার কোরবানির পশুর চাহিদা রয়েছে। কিন্তু পশু প্রস্তুত আছে ১ কোটি ২১ লাখ ২৪ হাজার ৩৮৯টি। অর্থনীতিবিদ ও বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, লবনহীন চামড়ার দাম নির্ধারণ না করার কারণে দরিদ্র জনগোষ্ঠী কমপক্ষে ৫০০ কোটি টাকা সহায়তা পাওয়া থেকে বঞ্চিত হবেন। অন্যদিকে কম দামে চামড়া কিনতে পারায় এবং এখন কাঁচা চামড়া বিদেশে রপ্তানির অনুমতি মেলায় ৫০০ কোটি টাকার বেশি অতিরিক্ত লাভ হাতিয়ে নেবে আড়তদার, ব্যবসায়ী ও ট্যানারি মালিকেরা।  তবে ট্যানারি মালিকেরা এখনই কোনো হিসাব করতে নারাজ।

সমতা লেদার কপ্লেক্সের ডিরেক্টর মু. মিজানুর রহমান বলেন, ‘হিসাবটা এখনই এভাবে করা যাবে না। এটা কেউ করতে পারবে না। করাটা ভুল হবে। কারণ, এবার সবকিছুর দাম বাড়তি। কেমিক্যাল, লবন, মজুরি ভাড়া সব। তারপর অন্তর্জাতিক বাজার সংশ্লিষ্টরাও কিন্তু পর‌্যবেক্ষণ করেন, আমরা কেমন দামে কিনছি। সে দামের উপর ভিত্তি করে তারা আমাদেরকে দাম বলে। তারপর চুক্তিতে যাই। সুতরাং চামড়া কত দামে, কতটুকু বিক্রি করতে পারব , তা এখনই জানা যাবে না, বলা যাবে না।

অর্থমূল্য বিবেচনায় বাংলাদেশ থেকে রফতানি হওয়া শীর্ষ পাঁচ পণ্যের একটি হলো চামড়া। সরকারি পরিসংখ্যান বলছে, বিদায়ী ২০২১-২২ অর্থবছরের ১২ মাসে অর্থাৎ জুলাই-জুনের মধ্যে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রফতানি হয়েছে ১২৪ কোটি ৫১ লাখ ৮০ হাজার ডলারের। এর আগের অর্থবছরে রফতানি হয়েছিল ৯৪ কোটি ১৬ লাখ ৭০ হাজার ডলারের। এ হিসেবে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের রফতানি বেড়েছে ৩২ দশমিক ২৩ শতাংশ।

কোরবানির পশুর কাঁচা চামড়া কিনতে সরকারি-বেসরকারি ব্যাংক মিলে ব্যবসায়ীদের ৪৩৩ কোটি টাকা ঋণ দিচ্ছে। এসব ঋণের মধ্যে শুধু রাষ্ট্রায়ত্ত চার ব্যাংক (সোনালী, জনতা, অগ্রণী ও রূপালী) দেবে ২৫৮ কোটি টাকা। ব্যাংক সংশ্লিষ্টরা অভিযোগ করেছেন, ব্যবসায়ীদের মধ্যে চামড়া বাবদ ঋণ নিয়ে অন্য খাতে বিনিয়োগ করার প্রবণতা রয়েছে। এসব কারণে কোরবানিতে চামড়া কেনার সংখ্যা বাড়লেও ঋণের পরিমাণ কমে আসছে। মু. মিজানুর রহমান বলেন, ‘সরকার ৪৩৩ কোটি টাকা দিলেও খেলাপি ঋণ পরিশোধ করে আমরা পাব ১৬০ কোটি টাকার মতো।’

দাম বাড়বে নাকি থাকবে আগের মতোই

তবে এবার চামড়ার দাম গতবছরের তুলনায়  কিছুটা বাড়বে বলে ধারণা করছেন বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ হাইড অ্যান্ড স্কিন মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের কর্মকর্তারা। সম্প্রতি জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের কাঁচা চামড়ার গুণগত মান ঠিক রাখা, লবণের সরবরাহ ও মূল্য স্বাভাবিক রাখার লক্ষ্যে এক মতবিনিময় সভায় সংগঠনের সভাপতি আফতাব খান বলেন, ‘এবার চামড়ার দাম একটু বাড়বে। যদি লবণ ব্যবসায়ীরা কোনও সংকট তৈরি না করেন।’

দাম বাড়লেও সেটা কার্যকর করা কঠিন বলে মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের জেনারেল সেক্রেটারী মো. সাখাওয়াতুল্লাহ। তিনি বলেন, ‘বাণিজ্য মন্ত্রণালয়  কোরবানির গরুর প্রতিফুট চামড়ার দাম গতবছরের তুলনায় ৭ টাকা বেশি নির্ধারণ করেছে। সেই কারণে এবার দেশের বাজারেও গতবছরের তুলনায় বেশি দাম দিয়ে আমাদের চামড়া কিনতে হবে। এতে ব্যয় বাড়বে। পাশাপাশি চামড়া সংরক্ষণে লবণ লাগানো থেকে শুরু করে চামড়া ফিনিশিং পর্যন্ত ৯২ ধরনের কেমিক্যাল প্রয়োজন হয়। দেশি-বিদেশি প্রতিটি কেমিক্যালের দাম বেড়েছে। বাড়তি লবণের দামও। যে কারণে প্রতি বর্গফুট চামড়া প্রক্রিয়াজাতকরণের খরচ ৪৮ থেকে ৫২ টাকায় দাঁড়িয়েছে, যা আগে ৩০ থেকে ৩২ টাকার মধ্যে ছিল। প্রতিটি গরুর চামড়া প্রক্রিয়াজাতকরণে গড়ে ৮ কেজি লবণ লাগে। যে লবণের বস্তা (৬০ কেজি) সাড়ে চারশ’ টাকা ছিল, সেটা এখন ৮৭০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। সুযোগ পেলে এ দাম আরও বাড়াতে পারে অসৎ ব্যবসায়ীরা। এসব কারণে খরচ অনেক বেড়ে গেছে। তাই দাম ওঠা কঠিন।’

তবে চামড়ার সঠিক দাম পাওয়ার জন্য লবন লাগানো আবশ্যক বলে মন্তব্য করেছেন ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের এই নেতা। তিনি বলেন, লবন না লাগালে চামড়ার দাম পাওয়া যাবে না।

বাজার সংশ্লিষ্ট ও বিশ্লেষকরা বলছেন, চামড়ার দাম এবারও পড়তিই থাকবে। লবন, কেমিক্যাল ও মজুরি ভাড়া বাড়ার অজুহাত দেখিয়ে কেউ চামড়া কিনতে আগ্রহ দেখাবে না। কম দামে চামড়া কিনে লাভবান হবে আড়তদার ও মওসুমি ব্যবসায়ীরা। ব্যাংক থেকে দেয়া লোন দিয়ে চামড়া না কিনে অনেকে অন্যখাতে ব্যয় করেন। ফলে চামড়ার সংখ্যা বাড়লেও চামড়ার বাজারের কোনো উন্নতি হচ্ছে না।

আগের সংবাদচামড়া-সিন্ডিকেট : সরকার কী করতে পারে?
পরবর্তি সংবাদচামড়া-সিন্ডিকেট কাদের নিয়ন্ত্রণে?