
মুনশী নাঈম:
চায়ের দোকানটায় একটা জটলা। কয়েকজন তরুণ উবু হয়ে মোবাইলে ক্রিকেট খেলা দেখছে। দোকানজুড়ে তারই আলোচনা। খোদ দোকানিও চা বানাতে বানাতে খেলার খোঁজ নিচ্ছেন। সেজন্য আমাকে চা দিতে খানিক দেরীই হলো। দেখে মনে হলো, ফুটবল বিশ্বকাপ শেষ হলেও শেষ হয়নি তার রেশ। অলিতে-গলিতে এখনও খেলার আলোচনা। বিশ্লেষকরা বলছেন, কেবল ফুটবল বিশ্বকাপই নয়, বাংলাদেশে বিভিন্ন জনরার খেলা নিয়ে ক্রমশ উন্মাদনা বাড়ছে।
বিষয়টি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন দেশের আলেমরা। তারা বলছেন, খেলার উন্মাদনা সীমা ছড়িয়ে যাচ্ছে দিনদিন। এতে যেমন পার্থিব ক্ষতি হচ্ছে, তেমনি ক্ষতি হচ্ছে ব্যক্তিগত ঈমান-আমলেরও। এই ক্ষতিটা যখন প্রকট হয়ে প্রকাশ পাবে, সেটা হবে ভয়ংকর।
পার্থিব ও পরকালের ক্ষতি
এ প্রসঙ্গে কথা হয় মুফতি মিজানুর রহমান সাঈদের সঙ্গে। তিনি ফাতেহকে বলেন, ‘বিষয়টি ভয়ংকর উদ্বেগের। কারণ, ইসলাম খেলাধূলার অনুমতি দিয়েছে শর্তসাপেক্ষে। এই খেলার মাধ্যমে কারও কোনো ক্ষতি হতে পারবে না। রাসুল সা. এবং সাহাবিরা বিভিন্ন সময় তির এবং দৌড় খেলা খেলতেন। কুস্তি খেলা খেলতেন। রাসুল সা. হজরত আয়েশাকে সেই দেখাতেনও। কিন্তু বর্তমানে খেলা নিয়ে যে উস্মাদনা তৈরী হয়েছে, তা শরিয়তের সীমা ছাড়িয়ে গেছে। যেই খেলা ছিল মানসিক প্রশান্তির জন্য, তা আজ মানসিক প্রশান্তি বিনষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘খেলার উন্মাদনায় আমাদের আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে। যেমন আমরা গভীর রাতে খেলা দেখে দিনে অনেকেই দোকান খুলে না। জিজ্ঞেস করলে বলে, রাতে খেলা দেখেছি। তাই দোকান খুলতে দেরী হয়েছে। অনেকে প্রিয়দলের পতাকা টানিয়ে, বিভিন্ন আয়োজন করে টাকা উড়াচ্ছে। এই খেলাকে কেন্দ্র করে দেদারসে চলছে জুয়ার রমরমা বাজার। তারপর আবার প্রিয় দল খেলায় না জিতলে অনেকে হার্ট এট্যাক করে, কেউ আত্মহত্যা করে। অন্তত মানসিকভাবে কষ্ট পায় না, এম খুবই কম আছে। খেলা নিয়ে দ্বন্দ্বে অনেক জায়গায় ঝগড়া হয়, মানুষ শারীরীকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পার্থিব দিক দিয়ে তো ক্ষতি আর ক্ষতিই। লাভের কোনো দিক চোখ পড়ে না।’
মুফতি মিজানুর রহমান সাঈদ আরও বলেন, ‘শুধু পার্থিব ক্ষতি হচ্ছে না, ক্ষতি হচ্ছে ব্যক্তিগত ঈমান-আমলেরও। এসব খেলায় অনেকের সতর ঢাকা থাকে না। সেসব দৃশ্য আমরা দেখছি। দেখছি নারী-পুরুষের ফ্রি-মিক্সিংও। খেলার সময় নামাজের সময়ের খবর থাকে না। হারাম-হালালের কোনো তোয়াক্কা থাকে না। এমনকি খেলা দেখতে দেখতে ঈমান-আমলের কমতির অপরাধবোধও জন্ম নেয় না। এই খেলার উন্মাদনায় যে ফরজ নামাজ ছেড়ে দিচ্ছি, হারামে জড়িয়ে যাচ্ছি, তার কোনো অনুভূতি থাকে না। পাপের সবচে বড় ক্ষতিকর দিক হলো, মন থেকে পবিত্র অনুভূতিগুলো দূর করে দেয়। খেলা আমাদের সঙ্গে সেটাই করছে।’
‘কথিত’ বক্তাদের উসকানি
মাহফিলে বিভিন্ন বয়ানে কতিপয় বক্তা খেলা নিয়ে কথা বলেন। তাদের কথা বলার ভঙ্গি থাকে কৌতুকমূলক। তাদের কথা থেকেই নির্দিষ্ট দলের প্রতি তাদের পক্ষপাত বুঝা যায়। দেশে খেলার উন্মাদনা জিইয়ে রাখার পেছনে তাদের ভূমিকা আছে বলে মনে করেন মুফতি মিজানুর রহমান সাঈদ। তার মতে, এসব বক্তাদের কারণে খেলা নিয়ে ভয়ংকর উন্মাদনার বিষয়টি স্বাভাবিক হয়ে যাচ্ছে। তারা এমন হেসেখেলে খেলা নিয়ে কথা বলেন, মানুষ ভাবে, খেলা নিয়ে উন্মাদনা দেখানোই যায়। আমি ত নামাজ পড়ছি, রোজা রাখছি। এই খেলা আমার ক্ষতি করবে না।
তিনি আরও বলেন, ‘অনেকে আবার বেশি কঠিন করে ফেলেন। বয়ানে বসেই বলে দেন, খেলা হারাম। খেলা দেখাও হারাম। অথচ মূল বিষয়টি তো এমন নয়ত। খেলা তো ইসলামে জায়েজ। কিন্ত তা শরিয়তের সীমায় থেকে। শরিয়তের সীমা লঙ্ঘন করলে সেটা জায়েজ হবে না। জনগণকে এই নোক্তাটুকু বলে দিতে হবে। নয়ত জনগণ ভাববে, ইসলাম একটি নিরস ধর্ম। অথচ ইসলাম একটি স্বভাবজাত ধর্ম। বিনোদন ও উপভোগের শরিয়তসম্মত পদ্ধতি রয়েছে। এগুলোকে ইসলাম নিষেধ করেননি। কিন্তু ইসলাম যতটুকু অনুমতি দিয়েছে, ততটুকুই।’
নষ্ট হচ্ছে আবেগ
এ প্রসঙ্গে কথা হয় জামিয়া আরাবিয়া ইমদাদুল উলুম ফরিদাবাদ মাদরাসার সিনিয়র শিক্ষক মুফতি ইমাদুদ্দিন সাহেবের সঙ্গে। তিনি ফাতেহকে বলেন, ইসলামে খেলাধূলা মানসিক রিফ্রেশমেন্ট ও শরীর চর্চার একটি উপকরণ মাত্র। একজন মুসলিম শরীয়ার সীমানায় থেকেও তা থেকে উপকৃত হবেন। কিন্ত তা যদি হয়ে যায় উন্মাদনা, তাহলে সেটা ভয়ংকর। বর্তমানে আমাদের দেশের অবস্থা হচ্ছে, দেশে সংকটের অভাব নেই। তরুণদের সেসব নিয়ে ভাবনাও নেই। সে তার গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ আবেগ, উচ্ছ্বাস ও উদ্যম সব ব্যয় করছে খেলায়, খেলার বিশ্লষণে।
তিনি এই উন্মাদনার ক্ষতিকর দিক তুলে ধরে বলেন, খেলার উন্মাদনার ক্ষতিটা এক-দুইদিনে প্রকাশ নাও পেতে পারে। কিন্তু এর দীর্ঘমেয়দী প্রভাব আছে। দেখা যাবে কিছুদিন পর আমাদের ছেলেরা দেশের জরুরি রাজনৈতিক-ধর্মীয় জটিলতাগুলো নিয়ে ভাবছে না। আমরা একটা ঈমানী আন্দোলনের ডাক দিলে তারা আসছে না। ঈমানী আন্দোলনের গুরুত্বটাই অনুভব করতে পারছে না। এটা আমদের জন্য বিশাল ক্ষতি। আমাদের আগামী ভবিষ্যত তো তরুণ-যুবকদের হাতে। তারা যদি দেশ-ধর্ম নিয়ে না ভাবে, আর কে ভাববে?’
মুফতি মিজানুর রহমান সাঈদ বলেন, ‘আরেকটি ভয়ংকর দিক হলো, খেলা দেখে দেখে আমাদের তরুণরা খেলোয়ারদের অনুসরণ করছে। তাদের মতো চুল কাটছে, কাপড় পড়ছে। রাসুলের আদর্শ বাদ দিয়ে তারা খেলার মাঠের মানুষদের বানাচ্ছে আদর্শ। এই অনুকরণপ্রিয়তার মধ্য দিয়েই শুরু হয় সাংস্কৃতিক পতন। এই পতন ঠেকাতে রাষ্ট্রর সরকার, আলেম সমাজ এবং অভিভাবকদের ভূমিকা পালন করতে হবে। বিষয়টির ভয়াবহতা ফুটিয়ে তুলতে হবে। দেশের উন্নয়নে, দেশের মেধার উন্নয়নে এর বিকল্প নেই।’