গুরুত্ব হারাচ্ছে ধর্মীয় শিক্ষা : যা ভাবছে ধর্মীয় মহলগুলো

রাকিবুল হাসান নাঈম:

দেশের শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন ব্যবস্থায় বড় রকমের পরিবর্তন এনে প্রণয়ন করা প্রাক্-প্রাথমিক থেকে উচ্চমাধ্যমিক স্তরের নতুন শিক্ষাক্রমের রূপরেখার আনুষ্ঠানিক অনুমোদন দেওয়া হয়েছে চলতি বছরের ৩০ মে। রূপরেখার কোনো স্তরে ধর্মশিক্ষার ব্যবস্থা রাখা হয়নি। নতুন শিক্ষাক্রমে প্রাক্-প্রাথমিক থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত ১০ ধরনের শেখার ক্ষেত্র ঠিক করা হয়েছে। এগুলো হলো ভাষা ও যোগাযোগ, গণিত ও যুক্তি, জীবন ও জীবিকা, সমাজ ও বিশ্ব নাগরিকত্ব, পরিবেশ ও জলবায়ু, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি, শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য এবং সুরক্ষা, মূল্যবোধ ও নৈতিকতা এবং শিল্প ও সংস্কৃতি। প্রাক্-প্রাথমিকের শিশুদের জন্য আলাদা বই থাকবে না, শিক্ষকেরাই শেখাবেন। সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, আগামী বছর থেকে বিভিন্ন শ্রেণিতে নতুন শিক্ষাক্রম পর্যায়ক্রমে চালু হবে। এর মধ্যে ২০২৩ সালে প্রথম, দ্বিতীয়, ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণি; ২০২৪ সালে তৃতীয়, চতুর্থ, অষ্টম ও নবম শ্রেণি; ২০২৫ সালে পঞ্চম ও দশম শ্রেণিতে চালু হবে নতুন শিক্ষাক্রম। এরপর উচ্চমাধ্যমিকের একাদশ শ্রেণিতে ২০২৬ সালে এবং দ্বাদশ শ্রেণিতে ২০২৭ সালে নতুন শিক্ষাক্রম চালু হবে।

ধর্মীয় মহল বলছেন, নতুন এই শিক্ষাক্রমে মূল্যবোধ ও নৈতিকতা শিরোনামে ধর্মীয় শিক্ষা রাখা হলেও মূলত তা কোনোক্রমে ধর্মশিক্ষা নয়। বরং দীর্ঘদিন ধরে জাতীয় শিক্ষাক্রম থেকে ইসলাম শিক্ষা বাদ দেয়ার যে পরিকল্পনা চলছিল, এ শিক্ষাক্রম তার সফল বাস্তবায়ন। ২০১০ সালে প্রণীত সর্বশেষ জাতীয় শিক্ষানীতি ধর্ম, বিজ্ঞান ও কারিগরি শিক্ষাকে বিশেষ প্রাধান্য দিয়ে তৈরী করা হয়েছিল। কিন্তু তারপর আর সেই শিক্ষানীতি কেউ অনুসরণ করেননি। ২০১২-এ একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণীতে ইসলামী শিক্ষাকে উপেক্ষা করা হয়েছিল। বিজ্ঞান ও ব্যবসায় শাখা থেকে ইসলামী শিক্ষাকে পুরোপুরি বাদ দেয়া হয়েছিল। মানবিক বিভাগে ইসলাম শিক্ষাকে করা হয়েছিল ঐচ্ছিক। তারপর জাতীয় শিক্ষাক্রম রূপরেখা ২০২০-এ ‘ইসলাম ও নৈতিক শিক্ষা’ বিষয়টিকে দশম শ্রেণীর বোর্ড পরীক্ষা থেকে বাদ দেয়া হয়েছিল। আর ২০২২ সালে এসে ইসলাম শিক্ষাটাকেই বাদ দেয়া হয়েছে।

আলেম লেখক ও গবেষক ড. আ ফ ম খালিদ হোসেন বলেন, দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে বিভিন্ন সময়ে সাতটি শিক্ষা কমিশন গঠিত হয়েছে। প্রতিটি শিক্ষা কমিশন রিপোর্টে সুস্পষ্টভাবে ধর্মীয় শিক্ষাকে সংকুচিত করা হয়েছে। বর্তমান শিক্ষানীতি প্রণয়ন কমিটি ১৯৭৪ সালের কুদরত-এ-খুদা শিক্ষা কমিশন, ১৯৯৭ সালের শামসুল হক শিক্ষা কমিশন এবং জাতীয় শিক্ষানীতি ২০০০ কমিটির প্রতিবেদনকে বিশেষভাবে বিবেচনায় নিয়েছেন। অথচ কুদরত-এ-খুদা শিক্ষা কমিশনের প্রস্তাব ছিল ধর্ম, ধর্মীয় শিক্ষা ও ইসলামের প্রতি অবজ্ঞা ও উপহাসের বহিঃপ্রকাশ। আসলে কুদরত-এ-খুদা শিক্ষা কমিশন ইসলামী আদর্শ বিরোধী এক কালো দলিল। ধর্মীয় মূল্যবোধ ও আদর্শিক নৈতিকতা থেকে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের দূরে সরিয়ে রেখে একটি ধর্মবিবর্জিত ‘ইহ-জাগতিক রাজনৈতিক পরিমণ্ডল’ তৈরির উপযোগী জনবল সৃষ্টিই বর্তমান শিক্ষা কমিটির অন্যতম উদ্দেশ্য।

এই নতুন শিক্ষাক্রমে জাতীয় শিক্ষানীতি উপেক্ষা করা হয়েছে মন্তব্য করে এই আলেম লেখক বলেন, জাতীয় শিক্ষানীতিতে সুস্পষ্টভাবে এ কথা উল্লেখ ছিল, ‘শিক্ষার উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য হচ্ছে, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে শিক্ষার্থীদের নিজ নিজ ধর্ম ও নৈতিক শিক্ষার মাধ্যমে উন্নত চরিত্র গঠনে সহায়তা করা’। কিন্তু নতুন শিক্ষানীতিতে উল্লিখিত শিক্ষার উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য অমান্য ও অগ্রাহ্য করা হয়েছে। জাতীয় শিক্ষাক্রমে সম্পূর্ণভাবে ‘ইসলামী শিক্ষা’ বিষয়টিকে বাদ দেয়া হয়েছে। শিক্ষানীতিতে ঘোষিত শিক্ষার্থীদের নিজ ধর্ম ও নৈতিক শিক্ষার মাধ্যমে উন্নত চরিত্র গঠনের যে কথা বলা হয়েছে, সেটিও জাতীয়ভাবে বন্ধ হয়ে গেল। অর্থাৎ স্কুল ও কলেজে ‘ইসলামী শিক্ষা’ বিষয়ে পড়াশোনার আর কোনো সুযোগ থাকলো না।

নতুন শিক্ষানীতি বাংলাদেশের একটি কুচক্রী মহলের স্বপ্নের বাস্তবায়ন বলে মন্তব্য করেছেন শাইখ যাকারিয়া ইসলামিক রিসার্চ সেন্টারের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক মুফতি মিজানুর রহমান সাঈদ। তিনি বলেন, শিক্ষাক্রম যখন তৈরী করা হয়, তখন দাবি জানিয়েছিলাম কমিটিতে আলেমদের রাখা হোক৷ কিন্তু সেখানে আলেমদের রাখা হয়নি। ফলে অনেকদিন ধরে ক্রমশ গুরুত্ব হারিয়ে ফেলা ইসলামশিক্ষা এবার বাদই পড়ে গেলো। এই শিক্ষাক্রম বাস্তবায়িত হলে দেশের স্কুল-কলেজে ধর্মশিক্ষাহীন একটা প্রজন্ম গড়ে উঠবে। অথচ এদেশের মানুষের যাবতীয় স্পিরিটের একমাত্র উৎস ধর্ম৷ ধর্মীয় শিক্ষা আছে বলেই বিপদে-দুর্দিনে মানুষ মানুষের প্রয়োজনে এগিয়ে যাচ্ছে। এই শিক্ষাটা হারিয়ে গেলে মানবতা থাকবে না, নৈতিকতা থাকবে না।’

ইসলাম নামটি বাদ দেয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘ইসলাম নামটি বাদ দিয়ে মূল্যবোধ ও নৈতিকতা শিক্ষা রেখে মূলত দুষ্ট চক্রটি চোখে ধূলো দিতে চায়। তারা বলতে চায়, ইসলাম শিক্ষা বাদ দেয়া হয়নি। আমার প্রশ্ন, ইসলাম বাদ দেয়া না হলে ইসলাম শব্দটি কেন বই থেকে বাদ দেয়া হলো। এই শব্দটি কী এমন ক্ষতি করেছে। একটি বিষয় ঐচ্ছিক করে দেয়া মানে, বিষয়টি তুমি পড়লেও পারো, না পড়লেও পারো। একটি বিষয় পরীক্ষা থেকে বাদ দেয়া মানে, বিষয়টির গুরুত্বই অস্বীকার করা। শুধু ইসলামটাই কেন পরীক্ষা থেকে বাদ দিতে হবে। এটা সুস্পষ্ট ষড়যন্ত্র।

বিভিন্ন পদ্ধতিতে এই শিক্ষাক্রমের বিরুদ্ধে আলেমদের প্রতিবাদ জানানো উচিত বলে মনে করেন মুফতি মিজানুর রহমান সাঈদ। তিনি বলেন, আলেমদের উচিত এখন লেখায়, বলায় এই শিক্ষাক্রমের বিরুদ্ধে সচেতনতা তৈরী করা। জনগণকে জানানো। শিক্ষা কমিটির সঙ্গে বসে আলাপ করা। সরকারের উর্ধ্বতন মহলের সঙ্গে এই বিষয়ে মতবিনিময় করা। পরিসংখ্যান মতে, ২ কোটি ৫০ লাখ শিক্ষার্থী স্কুল-কলেজে যায়। এরা যদি ইউনিভার্সিটিতে পা রাখার আগে ধর্মীয় শিক্ষা না পায়, তাহলে আগামীর বাংলাদেশটা ধর্মহীনতায় ছেয়ে যাবে। তাই আলেমদেরকেই দায়িত্ব নিয়ে কাজটি করতে হবে।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উর্দু বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মাওলানা হুসাইনুল বান্না বিষয়টিকে দেখছেন শিক্ষাকমিটির অজ্ঞতার ফলাফল হিসেবে। তিনি বলেন, ইসলাম শব্দটাই ইসলামের দাওয়াত। কর্তৃপক্ষ ভাবছেন, মূল্যবোধ ও নৈতিকতা বললে ইসলামের চেয়ে ব্যাপক কিছু হবে। কিন্তু এটা ত সম্ভব না। ইসলামের চেয়ে বেশি মূল্যবোধ ও নৈতিকতা আর কেউ শিক্ষা দিতে পারেনি। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এই দেশে ধর্মীয় শিক্ষার বই ইসলাম শব্দটি বাদ দেয়া একদমই অনুচিত। আমি এটার প্রতিবাদ করছি।

শিক্ষাক্রম প্রণয়ন কমিটিতে আলেমদেরকে অন্তর্ভুক্ত করার প্রয়োজনীয়তা উল্লেখ করে তিনি বলেন, কমিটিতে আলেমদের রাখার দরকার ছিল। কওমি মাদরাসার শিক্ষাবোর্ড রয়েছে। সেখান থেকে কাউকে কমিটি এবং ধর্মীয় বই সম্পাদনা পরিষদে রাখলে ভালো হতো। কাউকে রাখা হয়নি। এতে বইয়ের শুদ্ধাশুদ্ধি নিয়েও প্রশ্ন উঠবে। আমি সরকারের কাছে দাবি জানাই, ধর্মীয় শিক্ষাটা যেন প্রপার পায় শিক্ষার্থীরা, তার ব্যবস্থা করা হোক। বইয়ের নামে ইসলামি শব্দটি যুক্ত করে ভেতরের কন্টেন্ট আলেমদের হাতে সম্পাদনা করানো হোক।

শিক্ষাক্রমে ধর্মীয় শিক্ষা সংকোচনের প্রতিবাদে শুরু থেকে সরব ইসলামী রাজনৈতিক দলগুলো৷ এসএসসি পরীক্ষায় যখন ধর্মীয় শিক্ষা বাদ দেয়া হয়েছিলো, তখনই প্রায় সব ইসলামি দল প্রতিবাদ জানিয়েছিলো। চলতি বছরের পয়লা এপ্রিল অনুষ্ঠিত হয়েছিলো ইসলামী আন্দোলনের জাতীয় মহাসমাবেশ। এতে প্রধান পাঁচটি দাবির অন্যতম একটি ছিল—শিক্ষাক্রমে ধর্মীয় শিক্ষা সংকোচন বন্ধের দাবি। কুরবানীর ঈদের পর শিক্ষাক্রম নিয়ে ধারাবাহিক আন্দোলন শুরু করবে বলে জানান দলটির ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সভাপতি মাওলানা ইমতিয়াজ আলম। তিনি বলেন, শুরু থেকেই আমরা নতুন এই শিক্ষাক্রমের বিরুদ্ধে কথা বলছি। ইসলামী আন্দোলনের জাতীয় সমাবেশ থেকে শুরু করে প্রতিটি সমাবেশে শিক্ষাক্রমে ধর্মীয় শিক্ষা সংকোচনের প্রতিবাদ জানানো হচ্ছে। আমাদের জাতীয় শিক্ষক ফোরাওমও এ বিষয়ে সরব। সরকারের উর্ধ্বতন মহলে আমরা মেইল, স্মারকলিপি দিয়েছি। তাতে কাজ হয়নি। তাই মাঠে ময়দানে কথা বলা শুরু করেছি। ইনশাআল্লাহ, কুরবানি ঈদের শুধু শিক্ষাক্রম নিয়ে আমরা আলাদাভাবে আন্দোলন করব। চেষ্টা করব, সবাই যেন যার যার জায়গা থেকে প্রতিবাদে যোগ দেয়।

 

আগের সংবাদ১১৬ আলেমের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান হচ্ছে না: দুদক সচিব
পরবর্তি সংবাদপদ্মা সেতুর দুয়ার খুললো