তানভীর আহমাদ:
বাংলার প্রাচীন রাজধানী গৌড় নগরী। বহু ভাঙা-গড়া এবং উত্থান-পতনের বিশাল ইতিহাসের পাদপীঠ এই নগরী। এই অঞ্চলের প্রতি ইঞ্চি মাটি নানান ইতিহাসের এক নীরব সাক্ষী। নানান রাজা, মহারাজা, সুলতান, সম্রাট শাসন করে গেছে এই নগরী। তাই কালের বিবর্তনে বিভিন্ন নাম ধারণ করেছে প্রচীন এই জনপদ। কখনো হয়েছে রামবতি, লক্ষ্মণাবতী, আবার কখনো হয়েছে লখনৌতি। আবার কখনো হয়েছে জান্নাতাবাদ, ফিরোজাবাদ, পান্ডুয়া, তান্দা ও টাড়া। এভাবে রাজধানীর নাম বহুবার পাল্টেছে। এই অঞ্চল এখন দুই দেশের মধ্যে ভাগ হয়ে গেছে। কিছু অংশ চাপাই নবাবগঞ্জ জেলার অন্তর্ভুক্ত ও বাকিটুকু ভারতের মালদা জেলায় পড়েছে।
এই অঞ্চলের ইতিহাস যখন পড়তাম, মনে মনে ভাবতাম কখন সেই নগরী দেখতে যাবো। মনের মধ্যে নানা প্রশ্নের জন্ম নিতো এই অঞ্চলের ইতিহাস পড়ার সময়। যদিও অনেকবার যাওয়ার চেষ্টা করেছি কিন্তু ব্যস্ততার কারণে ও ভিসা জটিলতার কারণে ভারতের অংশটুকু দেখতে যাওয়ার সুযোগ হয়ে উঠেনি।
গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে সেই সুযোগ এসে গেলো। আন্দামান থেকে কলকাতা এয়ারপোর্টে নেমেই চিন্তা করলাম এবার প্রাচীন বাংলার রাজধানী গৌড় পান্ডুয়া দিয়েই মাতৃভূমিতে প্রবেশ করবো। কিন্তু ইচ্ছে করলে হবে কী! সব কিছুইতো আর হাতের নাগালে না! তাই কলকাতা এয়ারপোর্ট থেকে সোজা শিয়ালদহ ষ্টেশনে চলে এলাম গৌড় যাবার উদ্দেশ্যে। বৃটিশদের বানানো সেই বিশাল শিয়ালদহ ষ্টেশন। পুরনো ভবনগুলোর দিকে তাকালে ব্রিটিশদের দুইশো বছরের শাসনের ইতিহাস মনে পড়ে যায়। এখানে যেনো কেউ কারো দিকে তাকানোর সুযোগ পায় না। ডিজিটাল বোর্ডে বিভিন্ন জায়গার ট্রেনের প্লাটফর্ম নাম্বার ভেসে উঠতেই সবাই ম্যারাথন দৌড় দেয়া শুরু করছে।
মালদাগামী ট্রেনের খোঁজ নিয়ে দেখলাম রাত ৭ টার আগে কোন ট্রেন নেই। আবার দীর্ঘ ৭ ঘন্টার সফর সিট ছাড়া দাঁড়িয়ে যেতে হবে। মহা মুশকিলে পড়ে গেলাম। যদিও আসাম, গৌহাটি, উত্তর দিনাজপুরের এই রুটের সকল ট্রেন এই মালদা জংশন ধরেই যায়। তারপরও একটা রিজার্ভেশন পেলাম না। তাই ডিজিটাল বোর্ডে মালদাগামি ট্রেনের প্লাটফর্ম নাম্বার ভেসে উঠতেই সকলের সাথে আমিও দৌড় শুরু করলাম। এবার ট্রনে উঠার জন্য যুদ্ধ শুরু হয়ে গেলো। অনেক কষ্টে অবশেষে ট্রেনে উঠলাম। উঠার পর আরেক কেয়ামত শুরু হলো। গাদাগাদি ঠেলাঠেলিতে দম যায় যায় অবস্থা।
কিছুক্ষণ পর দেখি কিছু লোক এক কার্নিশের সাথে আরেক কার্নিশে চাদর বেঁধে দোলনার মতো করে ঘুমিয়ে পড়ছে। অদ্ভুত এক দৃশ্য। হুড়োহুড়িতে অনেকেই পায়ের উপর পা চাপা দিয়ে আছে। কেউ কিছু বলার সুযোগ নেই। আমি তো নিজেই মসিবতে আছি। একদিকে ভিনদেশি অপরদিকে দাড়ি টুপি ওয়ালা হুজুর। ঝক ঝক করে ট্রেন ছুটে চলছে।
ট্রেন যখন পলাশি ষ্টেশনে থামলো, মনে পড়ে গেলো নবাব সিরাজুদ্দৌলার কথা। যতটুকু শুনলাম খুব বেশি দূরে নয় ঐতিহাসিক পলাশির ময়দান।
অবশেষে রাত তিনটা নাগাদ মালদা জংশনে ট্রেন থামলো। রাতের নিরবতা যেনো এখানে স্পর্শই করেনি। খুব ব্যস্ততা মুখর পরিবেশে ঘেরা এই মালদা টাউন জংশন। ট্রেন থেকে নেমেই ওয়েটিং রুমে গেলাম, রাত এখনো অনেক বাকি। ১০ টাকা দিয়ে পলিথিন কিনে বিছনা বানিয়ে আর কাধের ব্যাগ বালিশ বানিয়ে মাথা রাখতেই চোখ বুজে এলো। তবে চোখ বুজলে কী হবে! চোর আমাকে পাহারা দিবে না আমি চোর পাহারা দিবো এই চিন্তা করতে করতেই ফজরের নামাজের সময় হয়ে গেলো।
ভারতবর্ষের অনেক রেল ষ্টেশনে আমার নামাজ পড়া হয়েছে। যদিও আগ্রা ছাড়া কোথাও নামাজের জন্য আলাদা জায়গা দেখিনি।
ফজরের নামাজ পড়েই কয়েকজন রিক্সাওয়ালা ও স্থানীয় মানুষের কাছে জিজ্ঞেস করে নিলাম ঐতিহাসিক জায়গাগুলো কোথায় অবস্থিত?
বিদেশ সফরে আমি কয়েকজনের কাছে জিজ্ঞেস করি একই জায়গায় যাওয়ার জন্য। একজনের কথার উপর নির্ভর করি না। যেহেতু ভিনদেশ, ভুল হলে পেরেশানি বাড়বে।
মালদা টাউন স্টেশন থেকে বের হয়ে একটা অটো ঠিক করলাম। অটোওয়ালাকে আমি কোন কোন জায়গায় যাব বলার পরে সে একটা ম্যাপ করে দিলো আমাদের সফর শুরু কোথায় থেকে হবে আর শেষ কোথায় হবে। পাঁচ শত রুপি দিয়ে অটো ঠিক করে যাত্রা শুরুর প্রস্তুতি। মনের মধ্যে নানা উৎকন্ঠা ছিল। কেমন ছিল বাংলার প্রাচীন রাজধানী, কেমন ছিল তার শান-শওকত । এই চিন্তা করতে করতেই চলে এলাম পান্ডুয়ার আদিনা জামে মসজিদ।
সফরসূচির মধ্যে প্রথমে আমি গেলাম পান্ডুয়ার ঐতিহাসিক জামে মসজিদ। সকাল আটটার আগে আদিনা মসজিদের প্রধান ফটক খুলে না। যদিও এক সময় এই মসজিদের ফটক তার আল্লাহর বান্দাদের জন্য চব্বিশ ঘন্টাই খোলা থাকতো। কিন্তু আজ মুসল্লির অভাবে, নামাজি বান্দার অভাবে এভাবেই উপমহাদেশের সবচেয়ে বড় মসজিদ তালাবদ্ধ ভাবে পড়ে আছে।
সকাল ৮টা বাজার আগে যেহেতু কাজ নেই তাই নাস্তা করার জন্য হোটেল অভিমুখে রওনা দিলাম। কলকাতার ঐতিহাসিক লুচি পুরি আর চানা ডাল দিয়ে পেটপুরে খেয়ে নিলাম। নাস্তা করতে বসে নানান মানুষের নানান প্রশ্ন–দাদা কোথায় থেকে এসেছেন? বাড়ি কোথায়? পাসপোর্ট আছে তো? না এমনি এসেছেন? এমন নানা জাতীয় প্রশ্নের সম্মুখীন হলাম। অবশেষে পাসপোর্ট হাতে রাখতে বাধ্য হলাম যেনো মানুষ সন্দেহ না করে। যদিও এককালে মুসলমানদের পদচারণায় মুখরিত ছিল এই পান্ডুয়া। কালের বিবর্তনে আজ মুসলমানদের কোনো অস্তিত্ব নেই। একসময়ের ব্যস্ততম বাংলার রাজধানী পান্ডুয়া অজ পাড়াগাঁয়ে পরিণত হয়েছে।
আদিনা মসজিদ
আটটা বেজে গেলো। মসজিদে প্রবেশ করলাম। বিশাল বিশাল দেয়াল কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বুঝাই যাচ্ছে কত উঁচু ছিল মসজিদের ছাদ। মসজিদের প্রাচীরগুলো জায়গায় জায়গায় ভেঙে পড়েছে। মূল মসজিদের শতভাগের মধ্যে এক ভাগ অবশিষ্ট রয়েছে।
আদিনা মসজিদ বাংলায়ই নয়, গোটা উপমহাদেশের মধ্যে বৃহত্তম মসজিদ। এর পেছনের দেয়ালে প্রাপ্ত একটি শিলালিপি অনুসারে এটি ১৩৭৩ খৃস্টাব্দে ইলিয়াস শাহের পুত্র সিকান্দর শাহ কর্তৃক নির্মিত। সিকান্দর শাহের মতো সুলতানের পক্ষে, যিনি ১৩৬৯ খৃস্টাব্দে নিজেকে আরব ও পারস্যের সুলতানদের মধ্যে যোগ্যতম এবং পরে ‘বিশ্বাসীদের খলিফা’ বলে ঘোষণা করেছিলেন, এ ধরণের একটি মসজিদ নির্মাণ ছিল তাঁর সম্পদ ও প্রতিপত্তির স্বাভাবিক বহিঃপ্রকাশ। এ কথা বলাই বাহুল্য যে, একজন সুলতান যিনি নিজেকে দামেশক, বাগদাদ, কর্ডোভা অথবা কায়রোর খলিফাদের সঙ্গে তুলনা করেন, তিনি ওই সকল রাজধানী শহরের মসজিদগুলির আকার ও আড়ম্বরের সঙ্গে তুলনীয় একটি মসজিদই নির্মাণ করবেন। দামেশকের জামে মসজিদের নকশার আদলে সুলতান সিকান্দার শাহ এই মসজিদ বানিয়েছিলেন।
মসজিদের চারিদিকের আয়তন দেখে বোঝা যাচ্ছিল এক সময় হাজার হাজার মানুষ নামাজ পড়েছে এক সাথেই। বিশাল আঙ্গিনা ঘুরে ঘুরে দেখছি। ঘুরতে ঘুরতে মেহরাবের কাছে আসতেই থমকে গেলাম! আশ্চর্য লাগল মসজিদের মিম্বার বসানো গণেশের মূর্তি! একজনের মুখে শুনলাম, এই মূর্তি স্থাপন করা হয়েছিল বিজেপি সরকারের আমলে। অটল বিহারী বাজপেয়ী যখন প্রধানমন্ত্রী ছিলেন সেই সময়ের কতিপয় উগ্রবাদী হিন্দু এই কাজ করেছেন। গণেশের মূর্তি মসজিদের মেহরাবে স্থাপন নিয়ে অনেক দাঙ্গা পর্যন্ত হয়েছিল শুনলাম।
মসজিদের মিম্বার থেকে থেকে সর্বশেষ কবে খুতবা পাঠ করা হয়েছে এবং মসজিদের মিনার থেকে সর্বশেষ কবে আজান অত্র এলাকায় ছড়িয়েছিল তার সঠিক হিসাব কারো জানা নেই। সেই কবে শেষ নামাজ পড়া হয়েছে উপমহাদেশের এই বিশাল মসজিদে, তার সঠিক কোন তারিখ কারো জানা নেই।
মসজিদের পরিদর্শনের সময় চিন্তা করছিলাম, আজ এমন হলো কেন? যেখানে লক্ষাধিক মানুষ এক সাথেই নামাজ আদায় করতেন, সেখানে আজ তালা ঝুলছে কেন? যেই মসজিদের মেহরাব থেকে শতাব্দীর পর শতাব্দী তাওহিদের বাণী প্রচার হয়েছে, সেখানে আজ গণেশের মূর্তি কেন? মসজিদের মিনার থেকে শতাব্দীর পর শতাব্দী পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের সময় ‘হাইয়া আলাস সালাহ! হাইয়া আলাল ফালাহ!’ বলে মানুষকে আহ্বান করা হয়েছে, সেই মসজিদ শুধু দর্শনার্থীদের জন্য উম্মুক্ত, নামাজের জন্য উম্মুক্ত নয়, আজ এই দুর্দশার জন্য কে দায়ী?
আমি ভারতবর্ষের দিল্লি, আগ্রা, বেংগালুর, মহিশুর, ভেলুর, মুম্বাই, চেন্নাই, হায়দ্রাবাদসহ আরও অনেক জায়গায় শত শত মসজিদ এভাবে বিরাণ পড়ে থাকতে দেখিছি। দিল্লির লাল কেল্লাতে, আগ্রা ফোর্টের ভিতরে বাহিরে অসংখ্য মসজিদ আজ শূন্য পড়ে আছে। সত্যিকার অর্থেই এসব পরিস্থিতি দেখে আমার অন্তর হু হু করে কেঁদে উঠেছিল কয়েকবার। অবশেষে ভগ্নহৃদয় নিয়ে আমার পরবর্তী মঞ্জিলের উদ্দেশ্য বেরিয়ে পড়লাম।
ফিরোজ মিনার
আমার অটো ফিরোজ মিনারের সামনে থামতেই দিল্লির কুতুব মিনারের কথা মনে পড়ে যায়। যদিও দিল্লির কুতুব মিনার অনেক উঁচু ফিরোজ মিনারের থেকে।
বাংলায় এ পর্যন্ত টিকে থাকা মিনারগুলির মধ্যে অন্যতম বিখ্যাত মিনার এটি। শিলালিপির সাক্ষ্য অনুযায়ী আবিসিনীয় দাস বংশের দ্বিতীয় শাসক সাইফুদ্দীন ফিরুজ শাহ (১৪৮৮-৯০খ্রি.) এটি নির্মাণ করেন। মিনারটি দিল্লির কুতুব মিনারের সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ। লোকমূখে প্রচলিত মাজানা বা আজান দেয়ার স্থান এবং একই সাথে বিজয় মিনার হিসেবে মিনারটি নির্মিত হয়েছিল। একটা শিলালিপি পাওয়া গিয়েছিল মিনারের পাশেই। যার থেকে অনুমান করা যায় তৎকালীন সময়ে এখানে একটা মসজিদের অস্তিত্ব ছিল। শহরের কেন্দ্রস্থলে মিনারটির অবস্থান হওয়ায় এ স্থানটিতে সর্বদা জনসমাগম হতো এবং মিনারটির চূড়া থেকে শহরের দৃশ্য সুন্দরভাবে উপভোগ করা যেত। সেই সময়ে এই যায়গাটি খুব কোলাহলপূর্ণ ছিল। শহরের মানুষের এক প্রকার পানশালা ছিল বলেই ইতিহাস বলে।
নীল টালির কাজ করা বলে মিনারটিকে মাঝে-মধ্যে ফিরুজা মিনারও বলা হয়। এ মিনার ছোট পান্ডুয়ার মিনারের সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ। পান্ডুয়াতে আরেকটা বিজয় মিনার আছে। মহানন্দা নদীর তীরে অবস্থিত সেই ছোট মিনারটি। ছোট পান্ডুয়ার মিনারটিও একটি মাজানা ও বিজয় মিনার বলে ইতিহাসে লেখা রয়েছে।
ফিরোজ মিনার আজ আমাদের মনে করিয়ে দেয় কয়েক শতাব্দীর আগের ইতিহাস। আগের যুগে মুসলিম বাহিনী বিজয় লাভ করে এসে এখান থেকেই ঘোষণা করতেন। মিনার থেকে ঘোষণা দেবার পরেই মানুষ এসে জড়ো হয়ে যেতো । অজানা কত কিছুইনা ঘটেছে এই মিনারের আওয়াজে। মিনারের দেয়াল দুর্বল হয়ে পড়ার কারণে উপরে উঠার অনুমতি এখন আর দেয়া হয় না। উপরে উঠার গেটে সবসময় তালাবদ্ধ থাকে। আমাদের মত দর্শনার্থীরা বাহির থেকে দেখেই ফিরে যায়। আমি মিনারের চূড়া না দেখতে পেলেও মিনারের পাদদেশ দেখেই পরবর্তী মঞ্জিলের উদ্দেশ্য রওনা দিলাম।
দাখিল দরোজা বা সেলামী দরোজা
চারিদিকে আমবাগানের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে বিশাল একটি দুর্গের দরোজা। দেখে বুঝা যাবে না এক কালে কত আড়ম্বরপূর্ণ ছিল এই স্থান। বিদেশি অতিথি, আর সুলতানদের সম্মানার্থে কত তোপধ্বনির আওয়াজ বেরিয়েছে এর দরজার সামনে দিয়ে, তার কোন ইয়াত্তা নেই। এই দরোজা শুধুই এখন স্মৃতি। গৌড় নগরী কত জাঁকজমক ছিল আর কত শক্তিশালি ছিল ,তা এই ফটক দেখেই বুঝা যায়।
সুলতানি বাংলার স্থাপত্যের ইতিহাসে এটি সর্ববৃহৎ নিদর্শন। এটি ছিল মুসলিম শাসকদের কাছে লখনৌতি নামে পরিচিত গৌড়-দুর্গের প্রধান প্রবেশপথ এবং বাংলায় সর্বকালের সবচেয়ে সুদৃঢ় ও সুন্দর প্রবেশ-তোরণ। এই প্রবেশদ্বার কে তৈরি করেছিল তা নিয়ে মতভেদ রয়েছে। ১৪৩৫-১৪৫৯ সালে গৌড়ের নগরদুর্গ নির্মাণকালে এটি নির্মাণ করেছিলেন সুলতান নাসির উদ্দিন মাহমুদ। যদিও এটা নিয়ে মতভেদ রয়েছে। ১৫২১ সালে দরোজার সামনে একটি শিলালিপিতে একটি মসজিদের বর্ণনা পাওয়া যায়। এতে অনুমান করা যায়, বড় সোনা মসজিদের নির্মাতা সুলতান আলাউদ্দিন হোসেন শাহ এই প্রবেশপথ তৈরি করেছিলেন।
এই দরোজা দিয়েই বিজয়ী-বেশে মুসলিম শাসকগণ প্রবেশ করেছেন। তাদের অভ্যার্থনায় কত হাজার হাজার মানুষ আহলান সাহলান বলেছে তার হিসাব নেই। শাসকদের অভ্যর্থনায় কতইনা নয়নাভিরাম হয়ে উঠতো এক সময় এই সেলামি দরোজা বা দাখিল দরোজা! মুসলমানদের প্রাচীন স্থাপত্যেগুলো দেখলে এখন শুধু আফসোস ছাড়া আর কিছু করার থাকে না।
আমার পরবর্তী মঞ্জিলের উদ্দেশ্যে দাখিল দরোজা ত্যাগ করলাম।
বড় সোনা মসজিদ
আমার অটো এসে থামলো ‘বড় সোনা মসজিদ’ এর সামনে। সোনা মসজিদ নামে বাংলাদেশ এবং ভারতের দুটো মসজিদ আছে। বাংলাদেশের মসজিদটিকে ছোট সোনা মসজিদ বলা হয় এবং ভারতের মধ্যে অবস্থিত বর্তমানে সেটাকে বড় সোনা মসজিদ বলা হয়। সংস্কারের অভাবে এবং অবহেলা অযত্নে আজ ধ্বংসপ্রায় এই মসজিদটি। এ মসজিদে এসেও মনে পড়ে গেল, কত যুগ আগে এখানে নামাজ হয়েছে তার কোনো হিসাব নেই! আজ মসজিদের পিলারগুলো শুধু দাঁড়িয়ে আছে। দর্শনার্থীরা এসে শুধু দেখে যায় কিন্তু এখানে দু’রাকাত নামাজ পড়ার কোনো লোক নেই। যদিও এক সময় কত হাজার হাজার মানুষ এখানে নামাজ পড়েছেন আজ নীরব নিস্তব্ধ হয়ে কালের বিবর্তনে এই মসজিদ ধ্বংস!
মসজিদের নির্মাণ নিয়ে ইতিহাসবিদদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। কেউ বলেন, সুলতান নাসির উদ্দিন নুসরাত শাহ। আবার কেউ বলেন আলাউদ্দিন শাহ বাংলাদেশের মধ্যে অবস্থিত ছোট সোনা মসজিদ ও ভারতে অবস্থিত বড় সোনা মসজিদের মধ্যে অনেক মিল রয়েছে। ছোট সোনা মসজিদ আলাউদ্দিন হোসেন শাহের আমলে আলী মোহাম্মদ নামে এক ব্যক্তি তৈরি করেছিল। অনেক ইতিহাসবিদ বলেন, সুলতান আলাউদ্দিন হোসেনের আমলের শেষের দিকে তৈরি এই বড় সোনা মসজিদ করেছিলেন।
মসজিদের গম্বুজগুলোর উপর সোনালি রং এর আস্তরণ ছিল। এ থেকে মসজিদটির নাম হয় সোনা মসজিদ । গৌড় নগরীর উপকণ্ঠে ফিরোজপুর গ্রামে সোনালি রঙের আস্তরণ যুক্ত আরেকটি সোনা মসজিদ ছিল। সেটি ছিল আকারে ছোট। তাই এ মসজিদটিকে বলা হত বড় সোনা মসজিদ, আর ফিরোজপুরের টিকে বলা হত ছোট সোনা মসজিদ। যদিও এখন বাংলদেশে অবস্থিত মসজিদটিকে ছোট সোনা মসজিদ বলে। হতেও পরে তৎকালীন সময়ে বাংলাদেশে অবস্থিত মসজিদটির এলাকা নিয়ে পুরো এলাকাটিকে ফিরোজপুর নামে ডাকা হতো। তাই বাংলাদেশে অবস্থিত মসজিদ টিকে ছোট সোনা মসজিদ বলা হয়।এ মসজিদটি বারদুয়ারী নামেও পরিচিত ছিল। কিন্তু বাস্তবে মসজিদটির সম্মুখ ফ্যাসাদে এগারটি দরজা রয়েছে।
বড় সোনা মসজিদের ধ্বংসাবশেষ দেখে পরবর্তী মঞ্জিল লুকুচুরি দরোজার দিকে।
লুকোচুরি দরোজা
গৌড়ে অবস্থিত মোঘল স্থাপত্যের মধ্যে লুকুচুরি দরোজা অন্যতম। লুকোচুরি দরোজার মধ্য দিয়ে আজও রাস্তা বিদ্যমান। যদিও এক সময় ঘোড়ার গাড়ি বা টাংগা ছুটে চলেছে এর মধ্যে দিয়ে। কিন্তু আজ ফটো পার হচ্ছে এই লুকোচুরি দরোজা দিয়ে।
লুকোচুরি দরোজা গৌড়-লখনৌতি নগর দুর্গের গুমতি গেটের পাশেই। এটি সম্রাট শাহজাহানের পুত্র এবং বাংলার গভর্নর শাহ সুজা সতেরো শতকের মাঝামাঝিতে নির্মাণ করেছিলেন। এ দরোজার নির্মাণশৈলী পুরোটাই মোঘল ডিজাইনে।
আগ্রা দিল্লির বিশাল বিশাল স্থাপনার ডিজাইন আর এই দরোজার ডিজাইন একই। এই লুকোচুরিদরোজা নিয়ে অনেক কল্পকাহিনি আছে। যেমন বাদশাহর বেগমেরা এখানে লুকোচুরি খেলত। আবার অনেকে বলে থাকেন, ছোট বাচ্চারা এখানে লুকোচুরি খেলত, তাই একে লুকোচুরি দরোজা বলা হয়।
একলাখি সমাধি
সুলতান জালালউদ্দিন এবং তাঁর স্ত্রী-পুত্রের সমাধি রক্ষিত আছে। কথিত আছে, একলাখ মুদ্রা ব্যয়ে মতান্তরে একলাখ ইঁট দিয়ে এই সমাধি নির্মিত হয়েছিলো। তাই জালালুদ্দিনের কবর আজও এক লাখ সমাধি বলে পরিচিত।
ফতে খার সমাধি
সুলতান সুজা আওরঙ্গজেবের সঙ্গে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার আগে বঙ্গে আশ্রয় নেন। এখান থেকে ভ্রাতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। সুজা বাংলার সুবেদার ছিলেন। কথিত ইতিহাস আছে, আওরঙ্গজেব শাহজাহানকে নজরবন্দি করে যখন সম্রাট হলেন, খবর পেয়ে সুজা ভাইয়ের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী হয়ে উঠলেন। কথিত আছে, তাঁর বুদ্ধিদাতা পীর শাহ নিয়ামতুল্লাকে হত্যা করার জন্য বাদশাহ আওরঙ্গজেব তাঁর সেনাপতি দিলওয়ার খানের পুত্র ফতে খাকে পাঠিয়েছিলেন।
যদিও এই কল্পিত গল্পটি অনেকেই লিখেন, কিন্তু এর কোনো ভিত্তি নে-ই।
প্রাচীন বাংলার রাজধানী ঘুরতে ঘুরতে শরীরে ক্লান্তি ভাব এসে গেলো। ২২ গজ দেয়ালের পাশে এসে আমার অটো থামলো। এই প্রাচীন নগরী পরিদর্শনের সময় এটাই ভাবছিলাম, আজ থেকে একশো বছর আগে কেউ কি ভেবেছিল ঢাকা শহর এতো যানজট আর কোলাহলপূর্ণ শহর হবে? ১০০ বছর আগের ঢাকা নগরী আর এখনকার ঢাকা নগরী আসমান-জমিন ফারাক। এমনিভাবে গৌড়ে পান্ডুয়াতে আজ অজপাড়াগাঁয়ে পরিণত হয়েছে। কিন্তু আজ থেকে যদি আমরা ২০০ বছর আগে ফিরে তাকাই, তখনকার পান্ডুয়া জাঁকজমকপূর্ণ একটি নগরী ছিল। যেমনিভাবে ঢাকা শহর আজ ব্যস্ততম নগরে পরিণত হয়েছে।
গৌড় প্রাসাদ গৌড় নগর-দুর্গের অভ্যন্তরভাগে দক্ষিণ-পশ্চিম অংশে অবস্থিত। এ প্রাসাদ সুলতানি আমলে মুসলিম শাসকদের দ্বারা নির্মিত। বর্তমানে এটি ধবংসপ্রাপ্ত ও বিলুপ্ত প্রায়। প্রাসাদটি সুউচ্চ প্রাচীরবেষ্টিত এবং এ প্রাচীর লোকমুখে বাইশগজী প্রাচীর নামে পরিচিত। প্রাচীরটির বিশাল উচ্চতার জন্যই ‘বাইশ গজ’ প্রতীকী অর্থে এর এরূপ নামকরণ হয়েছে। প্রাচীরটি বর্তমানে চারটি খন্ডাংশে দাঁড়িয়ে আছে, পূর্ব দিকে তিনটি এবং উত্তর দিকে একটি।
এবার ফেরার পালা আমার। অটো সোনামসজিদ স্থল বন্দরের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। সোনামসজিদ স্থলবন্দরে যাওয়ার সময় রাস্তার ধারে কয়েকটি মসজিদ দেখতে পাওয়া যায়। এর নাম হচ্ছে মসজিদ টিনা পাড়া। মসজিদগুলো আজও দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু এই মসজিদগুলোর কিভাবে ধ্বংস হয়েছে, তার চুলচেরা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, ১৭৫৭ সালে ইংরেজদের হাতে এই মূলক পরাজিত হওয়ার পরেই প্রাচীন এই রাজধানীর আদিনা মসজিদসহ অন্যান্য মসজিদ ধ্বংস করা শুরু হয়ে যায়।
কোতওয়ালী দরোজা দিয়ে বাংলাদেশ বর্ডারে প্রবেশ করলাম। কোতওয়ালী দরোজা একটি প্রাচীন নিদর্শন। কোতওয়ালী দরোজাকে গৌড়ের সিংহ দ্বার বলা হয়। প্রাচীন গৌড়ের উপনগরী হতে মূল রাজধানীতে অনুপ্রবেশের একটিমাত্র মূল ফটক ছিলো এটি। নগর পুলিশের ফারসি প্রতিশব্দ ‘কোতওয়াল’ এর অনুকরণে নামকরণ করা হয়েছে। এখানে নগরপুলিশ (কোতওয়াল) গৌড় নগরীর দক্ষিণ দেয়াল রক্ষা করার কাজে নিয়োজিত ছিলেন।