মুনশী নাঈম:
কাতার বিশ্বকাপে ফিলিস্তিন ইস্যুটি বেশ শক্তিশালী সমর্থন এবং স্বীকৃতি পেয়েছে। যার প্রমাণ স্টেডিয়ামে স্টেডিয়ামে ফিলিস্তিনের পক্ষে জয়ধ্বনি। প্রতিটি ম্যাচের প্রতিটি সেকেন্ড-মিনিটে লাখো-কোটি মানুষের কণ্ঠে উচ্চারিত হয়েছে একটি নাম, ‘ফিলিস্তিন! ফিলিস্তিন’। স্বাধীনতার সংগ্রাম, বর্ণবাদবিরোধিতা ও উপনিবেশবাদের নিগড় থেকে মুক্তির লড়াইয়ে একাকার যে ভূখণ্ডের নাম–তারই পতাকা জড়িয়ে বিশ্বকাপের গ্যালারিতে হাজির হয়েছেন ফুটবল ভক্ত-সমর্থকরা। ম্যাচ যে দেশেরই হোক, গ্যালারিতে ভালোভাবে চোখ রাখলেই নজরে পড়েছে ফিলিস্তিনের পতাকা, পতাকার রঙের আর্মব্যান্ড ও ব্রেসলেট। কান পাতলেই শোনা গেছে ‘ফিলিস্তিন মুক্ত করো’ ধবনি। শুধু স্টেডিয়ামেই নয়, কাতারের রাস্তায় রাস্তায় ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে ফিলিস্তিনেরই জয়ধ্বনি। যা প্রমাণ করে, আরব শাসকরা যতই অবহেলা করুন বা ইসরাইলি কর্তৃপক্ষের ঘনিষ্ঠতা বাড়াক না কেন, আরব জনগণ এখনও ফিলিস্তিনের পাশেই আছে।
ফিলিস্তিনি সেন্টার ফর রিসার্চ অ্যান্ড সার্ভে স্টাডিজের একটি জরিপের ফলাফলে বলা হয়েছে, এই বিশ্বকাপের পর আরব জনগণের প্রতি আস্থা ফিরে পেয়েছে ফিলিস্তিনিরা। ইজরাইলের সঙ্গে আরব দেশগুলোর সম্পর্ক স্বাভাবিক করার মিছিল দেখে হতাশ হয়েছিল তারা। ৬৬ শতাংশ ফিলিস্তিনি এখন মনে করেন, তাদের আশা পুনরুদ্ধার হয়েছে। ২১ শতাংশ শতাংশ ফিলিস্তিনি মনে করেন, তাদের আশা কিছুটা পুনরুদ্ধার হয়েছে। ৫ শতাংশ ফিলিস্তিনি মনে করেন, এখনও তাদের আশা ফিরে আসেনি। ৪ শতাংশ ফিলিস্তিনি বলেন, এখনও আরব বিশ্বের প্রতি তাদের আস্থা নেই।
পশ্চিম তীর এবং গাজা উপত্যকার ১২০টি আবাসিক এলাকায় এই সমীক্ষা চালানো হয়। ৭-১০ ডিসেম্বরে এই জরিপ পরিচালনা করা হয়। এতে অংশ নেয় ১২০০ ফিলিস্তিনি।
জরিপের আয়োজকরা বলেছেন, কাতারে ফিফা বিশ্বকাপের ম্যাচগুলোতে ফিলিস্তিনের ব্যাপক সমর্থনে ফিলিস্তিনি জনগণ মনে করছে, তারা ন্যায়বিচার পাবে। তারা একা নয়। তারা সমস্ত সম্ভাব্য উপায়ে দখলদারিত্বের অবসান চায়। এটা তাদের অধিকার।
সমীক্ষায় কাতার নিয়ে একটি প্রশ্ন ছিল। ৬৮ শতাংশ ফিলিস্তিনি জনসাধারণ বিশ্বাস করেন, কাতারের আন্তর্জাতিক অবস্থান আগের তুলনায় অনেক উন্নত হয়েছে। ১৭ শতাংশ ফিলিস্তিনি জনসাধারণ বিশ্বাস করেন, কিছুটা উন্নত হয়েছে। ৮ শতাংশ ফিলিস্তিনি জনসাধারণ মনে করেন, বিশ্বকাপের আগে যেমন ছিল তেমনই রয়েছে।
সশস্ত্র প্রতিরোধের সমর্থন
জরিপের ফলাফলে বলা হয়েছে, ফিলিস্তিনি জনসাধারণ দখলদারিত্বের অবসান ঘটাতে সশস্ত্র পদক্ষেপের কার্যকারিতায় আরও বেশি বিশ্বাসী বলে মনে হচ্ছে। তারা দ্বি-রাষ্ট্র সমাধান চায় না এখন। ৭২ শতাংশ ফিলিস্তিনি জনগণ আল-আকসা শহীদ ব্রিগেডের সামরিক শাখা লায়ন্স ডেন গ্রুপকে সমর্থন করে। ২২ শতাংশ ফিলিস্তিনি এদের বিরুদ্ধে। ৮৭ শতাংশ মনে করেন, ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের এই সশস্ত্র গোষ্ঠীর সদস্যদের ইসরায়েলের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেওয়া থেকে বিরত রাখতে বা তাদের সুরক্ষা প্রদান করার জন্য তাদের গ্রেপ্তার করার কোন অধিকার নেই। ১০ শতাংশ ফিলিস্তিনি মনে করেন, এই গোষ্ঠীর সদস্যদের গ্রেপ্তার বা নিরস্ত্র করার অধিকার ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের রয়েছে।
৫৯ শতাংশ ফিলিস্তিনি মনে করেন, সশস্ত্র সংস্থাগুলো পশ্চিম তীরের অন্যান্য অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়বে। ১৫ শতাংশ ফিলিস্তিনি মনে করেন, ইসরাইল তাদের সদস্যদের গ্রেপ্তার বা হত্যা করতে সফল হবে।
দখলদারিত্বের অবসান এবং একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সর্বোত্তম উপায় সম্পর্কে করা এক প্রশ্নে ৫১ শতাংশ সশস্ত্র পদক্ষেপকে সমর্থন করে। ২১ শতাংশ আলোচনায় বিশ্বাসী। ২৩ শতাংশ শান্তিপূর্ণ জনপ্রিয় প্রতিরোধে বিশ্বাসী। ৬১ শতাংশ ফিলিস্তিনি মনে করেন, নতুন ইজরাইলি সরকার আরও চরম এবং আগ্রাসী হয়ে উঠবে। ৫৮ শতাংশ ফিলিস্তিনি মনে করেন, ইজরাইলের পরবর্তী সরকার আল-আকসায় স্থিতাবস্থা বজায় রাখবে না। সেখানে ইহুদিদের প্রার্থনা করার অনুমতি দিবে। ৬৪ শতাংশ ফিলিস্তিনি মনে করেন, শেখ জাররাহ পাড়া থেকে ইসরায়েলি সরকার ফিলিস্তিনি পরিবারগুলোকে বহিষ্কার করবে। ঠিক একই পরিমাণে জনগণ বিশ্বাস করে, জেরুজালেমের আশেপাশে বসবাসকারী ফিলিস্তিনি বেদুইনদের নির্বাসিত করবে। ৬৯ শতাংশ ফিলিস্তিনি মনে করেন, জর্ডান উপত্যকাকে ইসরায়েলের সাথে সংযুক্ত করবে।
অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি
সমীক্ষায় ফিলিস্তিনের নির্বাচন নিয়েও প্রশ্ন ছিল। তাতে দেখা গেছে, ৬৯ শতাংশ ফিলিস্তিনি নতুন করে আইনসভা এবং রাষ্ট্রপতি নির্বাচন সমর্থন করে। ৬৩ শতাংশ ফিলিস্তিনি মনে করেন, এই ধরনের নির্বাচন শীঘ্রই অনুষ্ঠিত হবে না।
রাষ্ট্রপতি মাহমুদ আব্বাসের কর্মক্ষমতা নিয়ে জন-অসন্তোষ বেড়েছে ৭৩ শতাংশ। ২৩ শতাংশ প্রকাশ করেছে সন্তুষ্টি। ৭৫ শতাংশ ফিলিস্তিনি বলেন, তারা রাষ্ট্রপতির পদত্যাগ চান। ২০ শতাংশ তার পদত্যাগ চান না। যদি আজ নতুন সংসদীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, তাতে অংশগ্রহণ করবে ৬৫ শতাংশ জনগণ। এতে হামাসের রয়েছে ৩৪ শতাংশ, ফাতাহের ৩৪ শতাংশ। এবং অন্যান্য তালিকা থেকে ১০ শতাংশ।
২৮ শতাংশ ফিলিস্তিনি মনে করেন, হামাস আজ ফিলিস্তিনি জনগণের প্রতিনিধিত্ব এবং নেতৃত্ব দেওয়ার সবচেয়ে যোগ্য। ২৫ শতাংশ ফিলিস্তিনি মনে করেন, রাষ্ট্রপতি আব্বাসের নেতৃত্বে ফাতাহ আন্দোলন সবচে সবচেয়ে বেশি যোগ্য। ৪০ শতাংশ ফিলিস্তিনি মনে করেন, এ দুটির কোনোটিই যোগ্য নয়।
ফিলিস্তিনিরা বহু বছর ধরে যে চ্যানেলগুলো দেখে আসছে, তার তালিকায় সবার আগে রয়েছে আল-জাজিরা। গত তিন মাসে ফিলিস্তিনিরা সবচেয়ে বেশি কোন টিভি দেখেছে, এমন এক প্রশ্নে ৩১ শতাংশ বলেছে তারা আল-জাজিরা টিভি দেখে। এটাই সর্বোচ্চ। ১৩ শতাংশ দেখে প্যালেস্টাইন টিভি। আল-আকসা টিভি দেখে ১১ শতাংশ। প্যালেস্টাইন টুডে দেখে ৯ শতাংশ। মা’ন ৬ শতাংশ, আল-আরাবিয়া ৬ শতাংশ এবং আল-মায়াদিন ২ শতাংশ ফিলিস্তিনি দেখে।
সূত্র : আল জাজিরা