জাতিরাষ্ট্র প্রশ্নে সমকালীন মুসলিম ইজতিহাদ

ইফতেখার জামিল:

সমকালীন মুসলিম চিন্তা ও সংস্কৃতিতে রাষ্ট্র-প্রস্তাব গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন আকারে হাজির ছিল ও আছে। সমকালীন বলতে আমরা ঊনিশ শতকের দ্বিতীয় ভাগ ও তার পরবর্তী কালপর্বকে নির্দেশ করছি। এই কালপর্বে মুসলিম বিশ্বের রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যাপকভাবে নৈতিক ও ঐতিহাসিক বিপর্যয়ের মুখোমুখি হয়। মুসলিম বিশ্বের অনেক অঞ্চল পশ্চিমারা দখল করে ফেলে; মিসর, আলজেরিয়া ও ভারতবর্ষ পশ্চিমাদের উপনিবেশের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়। বিচ্ছিন্ন সামরিক প্রতিরোধও স্তিমিত হয়ে পড়ে। পাশাপাশি পশ্চিমা শিক্ষা, সংস্কৃতি ও চিন্তাও প্রভাবশালী হয়ে ওঠে।

খোদ উসমানি খেলাফত যদিও তখনো টিকে ছিল, তবে খেলাফতের মধ্যেও অস্থিতিশীলতা শুরু হয়েছিল। দানা বাঁধছিল নানা রকমের বিপর্যয়, সংকট মোকাবেলায় আধুনিক ও পশ্চিমায়নের দাবি জোরালো হচ্ছিল। উসমানি খেলাফতের অধীনস্থ আরব রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে শুরু হয়েছিল জাতীয়তাবাদী আন্দোলন। এককথায় মুসলিম বিশ্বে পশ্চিমা সামরিক ও সাংস্কৃতিক হামলার মোকাবেলায় রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যর্থ হচ্ছিল। ব্যর্থতা, দুর্নীতি ও স্বৈরাচারে প্রতিষ্ঠানগুলোর নৈতিকতা ও ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতা নিয়ে নানা রকম প্রশ্ন ওঠা শুরু হয়েছিল। যার সুসংবদ্ধ রূপকেই আমরা রাষ্ট্র প্রশ্ন বলে আখ্যা দিচ্ছি।

ইসলামি ইতিহাসে মুসলিম রাষ্ট্রচিন্তা কখনোই এমন প্রবল প্রশ্নের মুখামুখি হয়নি। আগে অনেক বিপর্যয় সংঘটিত হলেও প্রচলিত কোনো সমাধানের মাধ্যমেই সংকটের সমাধান মিলেছে। এই প্রথম ব্যাপকভাবে প্রচলিত ব্যাখ্যার বাইরে সমাধান অনুসন্ধান করতে হয়েছে। এখন কী করা যাবে; বর্তমান খেলাফত বাতিল করে দিতে হবে, নতুন আরেকটা খেলাফত কায়েম করতে হবে, নাকি খেলাফতের বাইরে নতুন কোনো রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান অনুসন্ধান করতে হবে? এমন সমস্যাকে আমরা ফিকহের ভাষায় রাজনৈতিক নাজিলাহ বলে আখ্যায়িত করে থাকি। নাজিলাহ মানে এমন প্রশ্ন, যার সরাসরি সমাধান পূর্বে আলোচিত হয়নি। সে যাই হোক, আলোচ্য নাজিলাহর বিস্তারিত বিবরণ ব্যাখ্যা করা যাক।

বিপর্যয়ের ‘উমুমুল বালওয়া’ : সমাধানে পরস্পর-বিরোধী ‘ইজতিহাদ’

সমকালীন কালপর্বে মুসলিম বিশ্ব যেমন সর্বব্যাপী বিপর্যয়ের মুখোমুখি হয়েছিল, তেমনি পরস্পর-বিরোধী সমাধানে সংকট বাড়ছিল। ছাড়াছাড়ি, বাড়াবাড়ি ও অনৈক্যে সমাধান আরও জটিল হয়ে উঠছিল। বিপর্যয় ‘উমুমুল বালওয়া’র রূপ পেয়েছিল। ‘উমুমুল বালওয়া’ মানে এমন ব্যাপক বিপর্যয়, যার থেকে বাঁচার সহজ কোনো সমাধান নেই। একে চারটি বৈশিষ্ট্যে চিহ্নিত করা যায়।

ক) দুর্বল খেলাফত ও মুসলিম বিশ্বে জাতীয়তাবাদী প্রবণতা

ঊনিশ শতকের দ্বিতীয় ভাগ থেকে মুসলিম বিশ্বে জাতীয়তাবাদী প্রবণতা শুরু হয়। অর্থাৎ, অনেকে মনে করতে থাকে, আমরা আমাদের অঞ্চলের মুসলমানদেরকে নিয়ে স্বতন্ত্র রাষ্ট্র করতে চাই। খেলাফত আমাদের অঞ্চলের সমস্যার সমাধান করতে সক্ষম হচ্ছে না। বিদেশি আক্রমণ থেকে রক্ষা ও আর্থসামাজিক উন্নয়নে অংশগ্রহণ করতে পারছে না। আবার আমাদেরকেও সক্রিয় হতে দিচ্ছে না, তাই আমরা খেলাফত থেকে আলাদা হয়ে যেতে চাই। আলেমদের দৃষ্টিতে এটি মারাত্মক ও ঝুঁকিপূর্ণ প্রস্তাব ছিল। কেননা খেলাফত থাকা অবস্থায় তার থেকে কোনো রাষ্ট্র পূর্ণ স্বাধীনতা চাইতে পারে না, রাজনৈতিক ও নৈতিকভাবে এর কোনো বৈধতা নেই।

খ) স্বাধীনতা আন্দোলন : জাতীয়তাবাদ যখন মুক্তির পয়গাম

১৯২৪ সালে খেলাফতের পতন হয়ে গেলে পশ্চিমারা মুসলিম বিশ্বের অধিকাংশ অঞ্চল দখল করে ফেলল। আগে থেকেই যেসব অঞ্চল পরাধীন ছিল, সেসব অঞ্চলের মুক্তির পথ হয়ে গেল আরও অন্ধকার। এখন বিদেশিদের থেকে স্বাধীনতা আনতে হবে। তারা অঞ্চলগুলোকে ছোট ছোট ভাগে বিভক্ত করে ফেলেছিল। ডিভাইড অ্যান্ড রুল। এখন রাষ্ট্র করতে হলে জাতীয়তাবাদী রাষ্ট্র করতে হবে বা পরাধীন থাকতে হবে। কেননা মুসলিম অঞ্চলগুলোর কারও কাছেই এত বৃহত্তর শক্তি ছিল না, যাতে তারা বিস্তৃত অঞ্চল ও শক্তি নিয়ে খেলাফত নির্মাণ করতে পারে। পাশাপাশি রাজনৈতিক মূল নেতৃত্ব ছিল পশ্চিমা চিন্তা ও সংস্কৃতিতে প্রভাবিত অংশের কাছে। ফলে তাদের কাছে জাতীয়তাবাদই হয়ে উঠল মুক্তির মহান পয়গাম। আলেমদের সামনে এটিও একটি শক্ত প্রশ্ন ছিল; এর শরয়ি ভিত্তি কী হবে, তারা ইসলামি ইতিহাসে কখনো খেলাফত বা মুলুকিয়াত-বিহীন জাতিবাদী রাষ্ট্র হতে দেখেননি।

গ) জাতিরাষ্ট্রের নতুন বাস্তবতা : ‘সামগ্রিক কেন্দ্রীভূত রাষ্ট্র’

ইতিমধ্যে অধিকাংশ মুসলিম রাষ্ট্র যুদ্ধ বা সন্ধিতে স্বাধীনতা লাভ করল। প্রতিষ্ঠিত হলো জাতিবাদী রাষ্ট্র বা জাতিরাষ্ট্র। জাতিরাষ্ট্রের নতুন কিছু বৈশিষ্ট্যও আছে, যেগুলো খেলাফতের মধ্যে ছিল না। এই রাষ্ট্রগুলো সামগ্রিক রাষ্ট্র, এদের নিজস্ব আইন, বিচার, অর্থ, শিক্ষা ও নিরাপত্তাব্যবস্থা আছে। বিশাল সেনা ও নিরাপত্তা বাহিনী আছে। অথচ খেলাফতের মধ্যে আইন, বিচার, শিক্ষা ও অর্থব্যবস্থা অনেকাংশে আলেমদের হাতে ছিল। অনেক ক্ষেত্রে বাস্তবায়নের নির্বাহী ক্ষমতা তাদের হাতে না থাকলেও অন্তত নীতিনির্ধারণ ও বেআইনি আখ্যা দেওয়ার নৈতিক ও রাজনৈতিক বৈধতা ছিল।

এখন সৌদি ছাড়া কোথাও আলেমদের এই বৈধতা ও প্রভাব বাকি নেই; কিছু জায়গায় আংশিকভাবে আছে, আলজেরিয়া ও তুরস্কে একেবারেই নেই। বাংলাদেশেও নেই বললেই চলে। আগে সামাজিক শক্তিগুলো সেনাবাহিনী ও মিলিশিয়া তৈরিতে সাহায্য করত। এখন দেখা গেল, সরকারের আর মিলিশিয়ার প্রয়োজন পড়ছে না। আগে রাষ্ট্র নানাভাবে ইসলামি প্রতিষ্ঠানগুলোর সাহায্য করত, এখন বরং হুমকি মনে করা শুরু করল; সহযোগিতা দূরে থাকুক, নানারকম বিধিনিষেধ আরোপ করতে লাগল। এই সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করেছিল গত শতকের পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে। জাতিরাষ্ট্রের এই সামগ্রিক কাঠামোর মধ্যে আবার দুর্নীতি, অস্থিতিশীলতা, স্বৈরাচার ও পরিবারতন্ত্রের মুসিবত হাজির হলো।

ঘ) গণতন্ত্রায়ন : ‘টার্গেট এবার পরিবার ও ব্যক্তি’

স্নায়ুযুদ্ধের সমাপ্তিতে, বার্লিন ওয়াল ও সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনে বিশ্বব্যাপী আমেরিকান প্রভাব বাড়তে লাগল, যাকে কথিত ‘গণতান্ত্রিক বিস্তৃতি’ বলে আখ্যা দেওয়া হয়। এই গণতন্ত্রায়নে রাষ্ট্রীয় স্বৈরাচার ও সামগ্রিকতার বদলে ব্যক্তি ও পরিবারব্যবস্থা নিয়ে প্রশ্ন ও সংশয় তৈরি করা শুরু করল অর্থাৎ পশ্চিমা পণ্য, শিক্ষা, গণমাধ্যম ও মূল্যবোধের ব্যাপক প্রসার ঘটানোর প্রস্তাব ও প্রকল্প প্রচারিত হলো। তাদের দৃষ্টিতে ইসলাম ধর্মের নানা হুকুম-আহকামের ন্যায্যতা নিয়ে ‘মানবাধিকার ভিত্তিক প্রশ্ন’ আছে।

নারী-পুরুষের সমানাধিকার, ‘ইসলাম-বিদ্বেষের’ অধিকার, সংখ্যালঘু অধিকার, ফ্রি সেক্স ও এলজিবিটি অধিকারসহ নানান অধিকার নিয়ে মুসলিম সমাজে সংশয় ওঠানো শুরু হয়। এই সময়েই সেকুলারিজম, স্বাধীনতা, অধিকার ও মানবাধিকার প্রপঞ্চ নিয়ে ব্যাপক আলোচনা শুরু হয়। বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে যদি ভাবি, তাহলে এই সময় থেকেই ব্যাপকভাবে নাস্তিকতার পক্ষে ও বিপক্ষে আন্দোলন শুরু হয়। এগুলোও মূলত রাজনৈতিক ও আত্মপরিচয়ের সংকট।

উজর ও জরুরত : বিকল্পের অনুসন্ধান

ইবাদাতের মতো মুয়ামালাত বিষয়ক ফতোয়া নির্দিষ্ট হয় না, বরং স্থান, কাল ও পাত্রভেদে বিভিন্নতার সুযোগ ও দাবি রাখে। কেননা ইবাদাত ব্যক্তিগত আমল, মুয়ামালাত সামাজিক বাস্তবতা, সক্ষমতা ও সম্পর্কের সাথে সংশ্লিষ্ট। ফলে মুয়ামালাত, বিশেষত মুয়ামালাতের সিয়াসাত ও রাজনীতি অংশের ফতোয়ার মধ্যে বিভিন্নতা দেখা যায়। কোরআন ও হাদিস অনুসন্ধান করলে অনেক রাজনৈতিক মূল্যবোধের উল্লেখ পাওয়া গেলেও কাঠামোগত বর্ণনা কম। তাই ইবনে তাইমিয়া ও ইবনে খালদুন রহ.-সহ প্রখ্যাত আলেমগণ খেলাফতে কামেলার বাইরে খেলাফতে নাকেসা বা মুলুকিয়াতের বৈধতার কথা বর্ণনা করেছেন। পাশাপাশি অনেক আলেম অস্থায়ীভাবে আঞ্চলিক রাষ্ট্রের সমাধানের ব্যাখ্যাও দিয়েছেন। সমকালীন সময়ে যেসব সমাধান এসেছে, তার মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটির আলোচনা এখানে করা হলো।

ক) প্যান-ইসলামিজম ও ইসলামিক কমনওয়েলথ

অব্যাহত জাতীয়তাবাদী প্রবণতার মোকাবেলায় আলেম সমাজ ও মুসলিম রাজনীতিবিদদের দিক থেকে উম্মাহ ও আন্তর্জাতিকতার পক্ষে সমর্থন জানানো হয়। খেলাফতের ভেতরে কথিত ‘তুর্কি কর্মকর্তাদের’ প্রভাব বৃদ্ধি ও মুসলিম বিশ্বে জাতীয়তাবাদী প্রবণতায় মুসলিম চিন্তাবিদগণ বিকল্প প্রকল্প নিয়ে ভাবা শুরু করেন। তাদের প্রস্তাবে খেলাফতের অধীনে স্বায়ত্তশাসিত ঐক্যবদ্ধ মুসলিম অঞ্চলগুলোর পারস্পরিক যোগাযোগ শত্রুদের মোকাবেলায় কার্যকর ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে। এক রাষ্ট্রের ভেতরেই সব মুসলমান থাকবে, তাই জাতীয়তা ও আঞ্চলিকতার বিভেদে দুর্বলতা সৃষ্টি হবে না, পাশাপাশি স্বায়ত্তশাসিত একতার ফলে জাতীয়তাবাদী অভিমান জাগ্রত হতে পারবে না। জামাল আফগানি, মোহাম্মদ আবদুহু, আবদুর রহমান কাওয়াকেবি, ইবরাহিম ফাসি ও দেওবন্দি উলামায়ে কেরামগণও এর পক্ষে আপ্রাণ চেষ্টা চালান।

খেলাফতের পতন হয়ে গেলে স্বাধীন মুসলিম দেশগুলোর প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে গঠিত আন্তর্জাতিক ফোরাম গঠনের প্রস্তাব উত্থাপিত হয়। এই মুসলিম আন্তর্জাতিক ফোরাম ক্রমবর্ধমান সংকট সমাধানে বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারে। এর মধ্যে আবদুর রাজ্জাক সানহুরি রহ.-এর নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। যেহেতু খেলাফতে উসমানির আদলে আর খেলাফত সম্ভব না, তাই আমরা একটু ভিন্নভাবে ভাবতে পারি। মুসলিম অঞ্চলগুলো সীমিত পর্যায়ের স্বাধীনতা পাবে, তবে একটা কেন্দ্রীয় ফোরামও থাকবে, যে ফোরামে সকল অঞ্চলের প্রতিনিধিরা থাকবেন, মুদ্রা ও পররাষ্ট্রনীতি এক থাকবে। অনেকটা বর্তমান ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের মতো। আসলে এসব চিন্তার থেকেই ওআইসির জন্ম হয়েছিল, যদিও ওআইসি এই স্বপ্ন পূরণে ব্যর্থ হয়েছে। এটা ছিল সানহুরির পিএইচডি থিসিস।

খ) ইসলামি পরিচয় ও আইন

প্যান-ইসলামিজমের প্রস্তাব সফল না হওয়াতে, ওজর ও জরুরতে, উম্মাহ-প্রশ্নের চেয়ে আত্মপরিচয় ও আইনের প্রশ্ন গুরুত্ব দিয়ে দেখা শুরু হয়। ইসলামে রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের মূল ভিত্তি কী হবে? আলেম সমাজ প্রস্তাব করেন, ইসলামি পরিচয় ও আইন মানলেই সেটা ইসলামি শাসন বলে বিবেচিত হবে। চাই সেটাই খেলাফত হোক বা না হোক। এই প্রস্তাবনাকে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ মনে না হলেও পরিস্থিতি বিচারে একে বৈপ্লবিক বলে আখ্যা দেওয়া জরুরি। কেননা উম্মাহর নেতৃত্ব গ্রহণ ও বিস্তৃত ভূমিতে দখল না করলে খেলাফত ও মুলুকিয়াতের সংজ্ঞা গ্রহণ করা মুশকিল।

নতুন ব্যাখ্যা গ্রহণ না করলে মুসলিম বিশ্বে যেসব রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে, তাকে অবৈধ আখ্যা দেওয়া জরুরি হয়ে ওঠে, পাশাপাশি ‘ধর্মীয় সমাজ’ অবৈধ নাগরিক হিসেবে বিবেচিত হতে থাকে, যা অত্যন্ত আত্মঘাতী প্রবণতা। এই প্রস্তাবনাকে ইসলামি হুকুমত বা হাকেমিয়াত নামে আখ্যা দেওয়া হয়। এই প্রস্তাব ও প্রকল্পের মধ্যে অনেক মতভিন্নতা আছে। কেউ কেউ একে একমাত্র ইসলামি রাষ্ট্র হিসেবে ব্যাখ্যা করলেও অধিকাংশ আলেমের মতে এটি ওজর ও জরুরত; অক্ষমতা ও আপদকালীন ব্যবস্থা। মজার বিষয় হচ্ছে, স্নায়ুযুদ্ধের পূর্বে মুসলিম দেশগুলোতে জাতীয়তাবাদীরাও বৈধতার এই নিক্তি অনেকাংশে মেনে নিয়েছে। হয়তো তাদের পরিচয় ও আইন ব্যাখ্যার সাথে ইসলামপন্থীদের ব্যাখ্যার পার্থক্য ছিল, পার্থক্য ছিল না মূল নিক্তিতে।

গ) ইসলামি পরিচয়, সার্বভৌমত্ব, রাজনৈতিক বৈধতা ও মূল্যবোধ

জাতীয়তাবাদী আন্দোলন ও খেলাফত পতনের প্রায় পৌনে দুইশ বছর হতে চলল। ইতিমধ্যে জাতিবাদী রাষ্ট্রগুলো ঐতিহাসিক বাস্তবতা হয়ে দাঁড়িয়েছে। একে অস্বীকার করা অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে। স্বৈরাচার, পশ্চিমা সামরিক সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক শক্তি; ধর্মমুক্তায়ন (সেকুলারাইজেশন) ও গণতন্ত্রায়ন মুসলিম দেশগুলোতে ইসলামি আইনকে বৈধতার মাপকাঠি থেকে সরাতে সচেষ্ট হয়েছে। ফলে এখন ইসলামি আইন বাস্তবায়ন বা শরিয়া কায়েম নিয়ে রাজনৈতিক প্রস্তাবনায় কিছু ঝুঁকি তৈরি হয়েছে; ইসলামফোবিয়া, অধিকার ও টেররিজমের প্রশ্ন। যার মোকাবেলায় আলেম সমাজ ও ইসলামপন্থীরা ইসলামি পরিচয়, সার্বভৌমত্ব, রাজনৈতিক বৈধতা ও মূল্যবোধে জোর দিচ্ছেন।

তুরস্ক, মালয়েশিয়া, মরক্কো ও তিউনিসিয়া, এর উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। ইসলামপন্থীরা মনে করছেন, আমাদের ইসলামি পরিচয় ও রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্ব এখন হুমকির মুখোমুখি। যে জাতীয়তাবাদীরা জাতিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছেন, তারাই ক্ষমতার জন্য ইসলামি পরিচয় ও সার্বভৌমত্ব বিকিয়ে দিতে আগ্রহী হয়ে উঠেছেন। ইসলামপন্থীরা এখন বলছেন, শরিয়ার আগে রাজনৈতিক বৈধতা দরকার। তারা বরং আইনের পরিবর্তে এখন নৈতিকতায় জোর দিচ্ছেন। আইন মানে নির্দিষ্ট একটা ধারা ও ব্যবস্থা, ওজর ও জরুরতে এখন ইসলামপন্থীরা মনে করছেন, ইসলামি পরিচয় ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার পাশাপাশি রাজনৈতিক বৈধতা ও মূল্যবোধ বাস্তবায়িত হলেই তারা সন্তুষ্ট হবেন। তবে এই মতের বিরুদ্ধে ব্যাপক সমালোচনাও হাজির আছে।

তাদের ইজতিহাদ বিভিন্ন বাস্তবতায় বিভিন্ন রকম হয়েছে। তবে ধর্ম সবসময় কেন্দ্রে থেকেছে। কেননা তারা মনে করেন, রাজনীতি ধর্মমুক্ত হতে পারে না, তবে রাজনীতি ও ধার্মিকতাও আবার এক নয়। খেলাফতের পতনের মুহূর্তে মুহাম্মদ আবদুহু রাজনীতিকে ধার্মিকতার অংশ বা আকিদা হিসেবে আখ্যা দিলেও অধিকাংশ আলেমের মতে রাজনীতি শাখাগত বিষয়। তাই স্থান, কাল ও পাত্র ভেদে তারা উপযোগী ভিন্ন ভিন্ন ইজতিহাদ করার চেষ্টা করেছেন। অনেক প্রশ্ন থাকতে পারে, তবে মুসলিম সমাজের মতো আর কোনো সভ্যতার ধর্ম ও রাজনীতির সম্পর্ক নিয়ে এতো ব্যাপক ইজতিহাদের পরীক্ষা চালানো হয়নি। ইজতিহাদে ভুল হয়, হতে পারে, তবে চেষ্টায় আছে মূল্যায়ন ও প্রতিদান, নিশ্চয় আল্লাহ সৎকর্ম সম্পাদনকারীদের বঞ্চিত করবেন না।

সূত্র:

১) নাশআতুল ফিকরিস সিয়াসি আল ইসলামি ও তাতাওউরুহু, মুহাম্মদ জাবরুন
২) মাফহুমুদ দাওলাহ আল ইসলামিয়াহ : আযমাতুল উসুস ও হাতমিয়াতুল হাদাছাহ। মুহাম্মদ জাবরুন
৩) আল আযমাহ আদ দাসতুরিয়াহ ফিল হাদারাতিল ইসলামিয়াহ, মুহাম্মদ মুখতার শানকীতী
৪) আদর্শ রাষ্ট্র ও রাজনীতি, মুফতি ফজলুল হক আমিনী

আগের সংবাদমুক্তিযুদ্ধে ইসলামপ্রশ্ন, পিনাকী ভট্টাচার্যের অনুসন্ধান
পরবর্তি সংবাদজাতীয় স্মৃতিসৌধে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর শ্রদ্ধা নিবেদন