জাতীয়তাবাদের বিবর্তন এবং একটি মুসলিম দরদি মন

মনযূরুল হক

 

মুসলিম সমাজে জাতীয়বাদের বীজাণু কী করে বাসা বাঁধলএই সময় এসে তার জন্য একটি পৃথক গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে। যদিও মুসলিম মেজরিটির ধারণাসমগ্র বিশ্বের মুসলিম এক জাতিভুক্তই বটে এবং তারা একই কিবলার মুখোমুখী হয়ে একই নিয়মে পাঁচপাঁচবার সালাত আদায় করে। তারা জাতির পিতা জ্ঞান করে নবি ইবরাহিম আলায়হিস সালামকে। তাই জাতীয় জাতিপ্রশ্ন নতুন করে প্রমাণের অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু ওই মাত্র ওইটুকুই। আরেকটু এগোলে হয়তো রক্তে মাটিতে মিশে যাওয়া আফগানফিলিস্তিনকাশ্মীর পীড়নের প্রতিবাদে রাজপথে গুলি খাওয়াএটাও তাদের একজাতি প্রমাণের বাস্তবিক রিফ্লেকশন হতে পারে। নইলে একই দেশেরএবং সেটা মুসলিম দেশই বটেজনগণও কি তাদের বিরোধীপক্ষের গুলির আঘাত কম খায়, নাকি সেগুলিতে বারুদ কম থাকে? যারা মারে এবং যারা মার খায়উভয় পক্ষই কি নিজেদের মুসলিম স্বীকারে কসুর করে? এমনকি যিনি লিখছেন ইসলামি নীতিতে বিশ্ব পরিচালনা সম্ভব, তিনি নীতিকেই উপস্থাপন করছেন, ব্যক্তিকে নয়। কেন নয়ব্যক্তির প্রতি আস্থা নেই তাই। এই আস্থার সংকট থেকেই বিভেদ, নতুন দল, নতুন মত, নতুন সমাজ গঠনের তিতিক্ষা, নতুন রাষ্ট্র গঠনের প্রত্যয়তারপরই আরেকটি মুসলিম দেশের অভ্যুদয়।

এক.

উমাইয়া খেলাফত থেকেই শুরু করা যাক। ইতিহাস লেখেন যাঁরা, তাঁদের প্রতি বিশ্বাস রাখলে নিশ্চয় বলা যায়, মুসলিম সমাজে জাতীয়তাবাদের যাত্রাটা সেখান থেকেই। মদিনায় যেই রাষ্ট্রকাঠামো রেখে গেছেন নবিজি সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম, সকলেই সেই কাঠামোকে অবিচল আস্থায় আঁকড়ে ধরতে চেয়েছেন ঠিকই, কিন্তু কাঠামোর পরিচালক কে হবেন প্রথমেই বিতর্ক শুরু হয়েছে সেখানে। যোগ্য কিংবা যোগ্যতর বিচার করতে গিয়েও লড়াই হয়েছে। রক্তও গেছে ক্ষয়ে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ইমানেও ধরেছে পোকা। খেলাফত তখন খোদাভীরুদের চোখের বালি। কেননা, সেখানে লোভী মানুষের বসবাস। নইলে কোরআনের নোকতা প্রচলনের মতো মহৎ কর্মে উত্তীর্ণ হাজ্জাজ কোন সুখে আবদুল্লাহ ইবনে জুবাইর রাদিয়াল্লাহু আনহুর গলায় ছুঁড়ি ধরে? অথচ এই হাজ্জাজই মুহাম্মাদ বিন কাসেম, মুসা বিন নুসাইর, ইউসুফ বিন তাশফিনের মতো দুর্জেয় বীরকে পৃথিবীর সামনে হাজির করেছে। তাহলে কোনটা ইসলামকোরআনে নোকতা দেওয়া নাকি খেলাফত রক্ষায় সাহাবিকে জবাই করা? ইসলাম খেলাফতের মধ্যখানে জাতীয়তাবাদের দেয়াল তুলে দিয়ে তারা আসলে কী হাসিল করতে চেয়েছেনকুফরের দমন, পার্থিব সমৃদ্ধি নাকি নিছকই ক্ষমতার লোভ?

যতদূর মনে হয়, সাহাবি সালাফদের একটা মূলনীতি ছিলদ্বিমত হলে নিজের মত জানিয়ে দেওয়া, ভুল মনে হলে প্রশ্ন তোলা এবং অন্যায় হলে প্রতিবাদ করা, কিন্তু মুসলমানের বিরুদ্ধে লড়াই না করা। সম্ভবত কারণেই আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর রা. উমাইয়াদের নিপীড়ন আয়েশবিলাসের অভিযোগ জেনেও খেলাফতের কোষাগারেই জাকাতের অর্থ দিতে আহ্বান করেছেন। কেননা, রাষ্ট্রীয় খরচের জবাবদিহিতা আল্লাহ রাষ্ট্রের পরিচালকদের থেকেই নেবেনজনসাধারণ থেকে নয়। কিন্তু অর্থের অভাবে খেলাফত দুর্বল হয়ে পড়লে মুসলিম জনগোষ্ঠী কুফরের অধীনে চলে যাবে এবং ইসলাম নিষ্প্রভ শক্তিহীন হয়ে পড়বে। এই সূত্রে এসেই সিফফিনের যুদ্ধে আয়েশা রা. আলী রা. সাংঘর্ষিক অবস্থান থেকে সরে এসেছেন এবং নিজেদের ঐক্য সমুন্নত রেখে ষড়যন্ত্রটা নষ্ট করে দিয়েছেন।

একটা মূলনীতি বিশেষভাবে স্মরণ রাখা দরকারসাহাবায়ে কেরাম রা. চেয়েছেন, আর যা হোক ইলম, ইবাদত হাদারত (জ্ঞান, বন্দেগি সভ্যতা) এই তিনটির উন্নয়নে যেন ভাটা না পড়ে। তাহলে খেলাফত যাদের হাতেই থাক, মুসলমানদের হারানোর কোনো উপায় আদতে থাকবে না। এর ফলাফলও হয়েছে বিস্ময়কর। উমাইয়া শাসনের শেষের দিকে এসে আব্বাসি ফাতেমি খেলাফত চাঙ্গা হলে যদিও ক্রুসেডারদের বিরুদ্ধে নিত্যনতুন রণাঙ্গনে অজুত রক্ত তাদের ঝরেছে, কিন্তু তারপরও আরেকটি সোনালি সময় তাঁরা উপহার দিতে পেরেছেন নির্বিবাদেই। লক্ষ করুন, ইসলামের প্রথম যুগ ছিল সাহাবিদের ত্যাগের মহিমা মানবতার উৎকর্ষের যুগ, দ্বিতীয় যুগ এসেছে হাদিস, ফিকহ মৌলনীতিমালা গঠনের সুবিশাল মহীরুহ হয়ে।

এরপরের এই যুগটাই হলো ক্রুসেডের, কিন্তু একই যুগ আবার বিজ্ঞান, প্রযুক্তি দর্শনের যুগ। ষষ্ঠ শতাব্দী থেকে এগারো শতাব্দী পর্যন্ত হিসাব করলে শত বছরের মুসলিম অবদান এত বিপুল যে, জাতীয়তাবাদ কখনও কখনও খেলাফতের চোখ অন্ধ করে দিলেও, এমনকি ভিন্নজাতি বিদ্রোহদমনের অজুহাতে মুসলিম খলিফা প্রশাসকদের নির্মম হাতে সাহাবি, তাবেয়ি, ফকিহ আলেমদের বিরাট একটি অংশ নিধনযজ্ঞের শিকার হওয়ার পরও মুসলিম সমাজের জ্ঞানের রথ থেমে যায়নি, ইবাদতের মুসল্লা গুটিয়ে যায়নি এবং আর্থসামাজিক উন্নয়নেও কোথাও কোনো ব্যঘাত ঘটেনি। খ্রিষ্টানদের সম্মিলিত চক্রান্ত লুণ্ঠনপ্রবণ যুদ্ধকে বিবেচনায় আনলে এই চ্যালেঞ্জ যে ছিল আরও শতগুণ বেশি, তা না বললেও চলে।

কিন্তু এই সুসময় বেশিদিন অক্ষত থাকেনি। অনেকেই এর প্রধান কারণ বিলাসিতা বলে চিহ্নিত করেছেন। আমরা মনে করি, দীর্ঘ সময় পরে হলেও জাতীয়তাবাদের শক্ত কামড়ই এর প্রধান কারণ। আর জাতীয়তাবাদ মাথাচাড়া দিয়ে ওঠার পেছনে মৌলিক ভূমিকা রেখেছে সাহাবা সালাফগণ যেই তিনটি উন্নয়নকে সমতালে চলমান রেখেছিলেন, অর্থাৎ ইলম, ইবাদত আর্থসামাজিক উন্নয়ন, তা কাঁধে কাঁধে মিলিয়ে চলতে ব্যর্থ হওয়া। বিলাসিতার মোহে সমাজের মানবিকতা নষ্ট হওয়াকে যদিও অগ্রাহ্য করা যায় না। কিন্তু বিলাসিতা করে তারা লক্ষ লক্ষ কিতাব কিনে লাইব্রেরিও করতেন, তবে পড়ার প্রয়োজন বোধ করতেন না। সোনায় মুড়িয়ে মসজিদ নির্মাণ করতেন, কিন্তু জামাতে শরিক হতেন না।

যার ফলে কালচারালি মুসলিম ঐতিহ্যের উত্থান ঘটেছে, কিন্তু সুস্থ দূরদর্শী জ্ঞানের অভাব এত প্রকট আকারে দেখা দিয়েছে যে, বিধর্মী রীতিনীতিও ইসলামিকরণের নামে মুসলিম সমাজে ইবাদতের মতো জেঁকে বসতে থেকেছে। কেননা, রাজদরবারের সঙ্গে হকপন্থী আলেমদের দূরত্ব বেড়েছে এবং তথাকথিত সুফিসাধকগণ সেস্থান দখল করেছেন। তোষামোদি কবিরাও সভাসদ হতে শুরু করেছেন। এই সুফি কবিরাই মানবপ্রেমের অজুহাতে মানুষের মধ্যে অশালীন প্রেমের জোয়ার উস্কে দিয়েছেন এবং খ্রিষ্টীয় প্যাগানিজমের মতো যৌনতায় খোদাপ্রেমের নিদর্শন খুঁজে ফিরেছেন। এবাদত হয়ে গেছে তখন কালচার। ধর্মীয় অবকাঠামোর উন্নয়নে জনগণের অর্থ প্রদান এতটাই মহিমান্বিত রূপ পেতে শুরু করেছে যে, অভুক্ত থাকাকেও মানুষ মহানব্রত ধরে সাধনা করেছে, তবু ক্ষুধার অভিযোগ করার গরজ বোধ করেনি। বাগদাদের সেলজুকি খেলাফত ধ্বংস হওয়ার পেছনে এইসব অনুসর্গ বিরাট ভূমিকা রেখেছিল বলে মনে করা হয়।

ওসমানি খেলাফতের উত্থানও এইসব অবিচারকে চ্যালেঞ্জ করতে পারেনি। বরং তারাও আর্থসামাজিক উন্নয়নে প্রণোদনা দিয়েছেন ঠিক এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে ইলমের উন্নয়নেও ভূমিকা রেখেছেন বটে, কিন্তু এবাদতকে কালচারাল স্তরে নামিয়ে এনে আল্লাহর বন্দেগি ব্যক্তির একান্ত ব্যক্তিগত বলে ছেড়ে দিয়েছেন; যেখানে রাষ্ট্রের করার কিছু নেই। সালাত জাকাতের পাবন্দ মানুষের সংখ্যা বেশ কমে এসেছে সেসময়টাতেই, যদিও বিরাট কাফেলা যেত রাজকীয় বহর নিয়ে হজের সফরে। ওসমানি খেলাফতের সবচেকরুণ দিকটি ছিল রাজপুত নিধন। শতাব্দী ধরে চলমান ওসমানি খলিফাদের এমন একজনকেও খুঁজে পাওয়া যাবে না, যিনি তাঁর সন্তান কিংবা ভাইকে উত্তরাধিকারীর পথের কাঁটা ভেবে হত্যা করেননি। বিচারের নামে প্রহসন এবং ক্ষমতালোভী গোত্রপ্রীতি এতটা প্রকটা আকার ধারণ করে সেসময় যে, স্বজাতির অন্যায়কে বহুক্ষেত্রে বীরত্ব বলেই সাবাশি দেওয়া হতে থাকে।

দুই.

উমাইয়া খেলাফত থেকেই যদিও মুসলিম শাসনে পারিবারিক জাতিগত প্রথার পালে হাওয়া লাগে, কিন্তু মানুষ সেটা মেনে নিয়েছে এই বিবেচনায় যে রাজশাসনের জন্য রাজরক্ত শরীরে প্রবাহিত থাকার বিকল্প নেই। এটা মধ্যযুগপরবর্তী সময়ে গ্রিকরোমানদের মতোই এই প্রথাবিশ্বাস মুসলিম সমাজে ফিরে এসেছে। এটা অনেকাংশে সত্যিও প্রমাণিত হয়েছে এবং দেখা গেছে রাজবংশীয় নেতৃত্বের অধীনে মানুষ যত তাড়াতাড়ি ঐক্যবদ্ধ হয়, অন্যক্ষেত্রে ততটা নয়। ওসমানি সালতানাতের মধ্যসময়ের আগেই ভারতীয় উপমহাদেশে খিলজিলোদি বংশের মুসলিম যোদ্ধারা ক্ষমতা কাড়াকাড়ি শুরু করে দেয়, মোঘল সম্রাটদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার আগ পর্যন্ত মুসলিম রাজরাজড়াদের মধ্যেই যুদ্ধ হয়েছে বেশুমার। ওসমানি খেলাফতের শেষদিকে তুর্কি শাসনের দুর্বলতার সুযোগে আরবের বিভিন্ন অঞ্চলের মুসলিম প্রশাসকগণও স্বশাসন প্রতিষ্ঠায় আগ্রহী হয়ে ওঠেন।

অষ্টদশ শতাব্দীতে বাহরাইন, হেজাজ, নজদ, দিরিয়া প্রভৃতি অঞ্চল খেলাফতের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে স্বগোত্রীয় শাসন চালু করার প্রয়াস পায়। সৌদ পরিবার, সুদাইরি পরিবার, রশিদি পরিবার বিভিন্ন সময় ওসমানি খেলাফতের বিরুদ্ধে যুদ্ধেও অবতীর্ণ হয়েছে বহুবার। অথচ এদের মেজরিটি পার্সেন্ট সৈন্যদলের পতাকায়ও কালেমা লেখা ছিল। এমনও হয়েছে যুদ্ধে অবতীর্ণ দুই প্রতিদ্বন্দ্বী পক্ষের পতাকায় সাদা কালো রঙ ছাড়া অন্যকোনো পার্থক্য চোখে পড়ত না। উভয় পক্ষের মুসলিম যোদ্ধাগণ আল্লাহর নামে জিহাদে ঝাঁপিয়ে পড়তে পেরেছেন বলে গৌরব করতেন। বহুক্ষেত্রে দেখা যেত বিপক্ষের লোকটিও মুসলিম, এটা স্বীকারেও তিনি কুণ্ঠিত নন, কিন্তু জাহেলি সমাজের মতোই নিজের কোনো ভাই, অথবা পিতার রক্তের প্রতিশোধ নিতে তাঁরা সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়েছেন। আমার মনে হয়, তখনই মুসলিম পরিচয় প্রশ্নবিদ্ধ আকারে পেখম মেলে।

জাতীয়বাদের এই যুদ্ধ আর থামেনিকিন্তু ওসমানি খেলাফত সমাপ্তির মাধ্যমে আমরা আরেকটি নতুন জাতীয়তাবাদী চেতনার তরঙ্গ দেখতে পাই, তা হলো সেক্যুলার মুসলিম জাতীয়তাবাদ। গোড়া মুসলিম চেতনার মানুষও অবশ্যই তখন ছিল। তবে দেশ বিভাজনে এবং নতুন নতুন রাষ্ট্র গঠনে এই ধরনের চেতনা খুব একটা কার্যকরী হয়নি, বরং ভাষা আঞ্চলিক সীমানার কর্তৃত্বই তখন বড় হয়ে দাঁড়ায়। উনবিংশ শতাব্দীতে ব্রিটিশ কলোনিয়াল শাসনের মৃত্যুঘণ্টা বেজে ওঠে।

মরক্কো, তিউনিস, লেবানন, সুদান, লিবিয়া প্রভৃতি রাষ্ট্র নিজ নিজ সীমানায় খুঁটি গেড়ে দেয়। ফিলিস্তিনইসরায়েল দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়ে। মিশর তো তুর্কিদের থেকে আলাদা হয়েই ভিন্ন রাষ্ট্র গঠন করে। জর্ডানও পৃথক থাকে। আরব আমিরাত, কাতার সৌদি ভিন্ন ভিন্ন রাজ্যে পরিণত হয় প্রায় একই গোত্রীয় লোকজনই নিজেদের মধ্যকার বিবাদ মেটাতে না পেরে। একটা সময় পরে ইয়েমেনকেও সৌদিরা ধরে রাখতে ব্যর্থ হয়। বাহরাইন সমুদ্র উপকূলের দ্বীপগুলো কুক্ষিগত করে রাখে। রুশদের থেকে মুক্তি পেয়ে তাজিক, উজবেক, কিরগিজ জাতিও নিজ নিজ সীমানায় বেড়া বসিয়ে দেয়। গোটা আরব, আফ্রিকা রাশিয়ান অঞ্চলে সেসময় মুসলিমদের জাতীয়তাবাদ নিরুপিত হয় দেশভিত্তিক কিংবা ভাষাভিত্তিক। দেখা গেছে একই দেশ কিংবা একই ভাষার মানুষ হওয়ায় ইহুদি, খ্রিষ্টান মুসলিমদের একই জাতি বলে চিহ্নিত করা হচ্ছে।

শাসন ক্ষমতা কোথাও ধর্মের সংখ্যাধিক্যের ভিত্তিতে ভাগাভাগি হচ্ছে, কোথাও আরও উদারনীতি অবলম্বন করে রাজনৈতিক কিংবা সামরিক শক্তিকেই শাসনক্ষমতা প্রাপ্তির যোগ্য বলে বিচার চলছে। এইভাবে মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিমদের মধ্যেই কোথাও আরব, কোথাও আফ্রিকান, কোথাও তুর্কি, কোথাও কুর্দি ইত্যাদি পরিচয় মুসলিম পরিচয়কে হারিয়ে দিয়েছে চিরতরে। কেননা, মুসলিম জনগোষ্ঠীতে সেক্যুলারমেজাজ এতটাই তীব্র আকার ধারণ করে যে, ইলম অর্জনকে ভিন্নজাতীয় জ্ঞান আখ্যায়িত করা হয় এবং ইবাদতকে ব্যক্তিগত আমল নির্ণয় করা হয়। শুধু আর্থসামাজিক উন্নয়নের মধ্যেই মানুষের মুক্তিএই অঘোষিত বাণীটি আগুনের মতো ছড়িয়ে পড়ে মুসলিম মানসের শিরায় শিরায়।

ভারতীয় উমহাদেশে এই সময়টাতে পাকিস্তান আন্দোলন গড়ে ওঠে। মুসলিম হিন্দু আলাদা জাতি বিবেচনা করা হতে থাকে। যদিও পাঞ্জাবিবাঙালিতামিল ইত্যাদি পরিচয়ও থেকে থেকে জেগে উঠছিল। কিন্তু দীর্ঘদিনের ইংরেজ শাসনে মুসলিমদের বঞ্চিত হতে হয়েছে বলে এবং হিন্দু জমিদারদের কাছে নিগৃহীত হয়ে মুসলিমরা অস্তিত্বহীন হয়ে পড়ার আশঙ্কায় স্বতন্ত্র একটি ভূখণ্ডর দাবি ক্রমশ উচ্চকিত হয়। কেউ কেউ খেলাফত প্রতিষ্ঠার কথাও অনুচ্চস্বরে বলেন। কেউ কেউ একই দেশের পরিচয়ে হিন্দুমুসলিম মিলনের কথা তোলেন। দেখা যায়, জীবনে কখনও ইসলামকে অধ্যয়নের চেষ্টা করেননি, কিংবা নিজেরাই সভাসমাবেশে বলছেন যে, ধর্মীয় বিষয়ে আমার জানাশোনা নেই, কিন্তু তিনিও মুসলিম জাতিকে রক্ষায় নিজের সর্বস্ব বিলিয়ে দিতে কুণ্ঠাবোধ করছেন না। হোসেন সোহরাওয়ার্দি, মোহাম্মাদ আলী জিন্নাহ, একে ফজলুল হক, খাজা নাজিমুদ্দিন, লিয়াকত আলী চৌধুরি, শেখ মুজিবর রহমানমুসলিমদের দরদে ভিন্ন দেশভাবনায় উন্মাতাল এইসকল নেতার দিকে তাকান, তাঁদের ভাবনা কী ছিল দেখুন। তাই বলে যে কি এই নেতাদের মুসলিম দরদকে অস্বীকার করা যায়?

কিন্তু একটা কথা স্পষ্ট বোঝা যায়, তাঁরা মানুষের মুক্তি চেয়েছেন সত্যইসলাম প্রতিষ্ঠা চাননি। মুসলিমদের আর্থসামাজিক উন্নয়নে তাঁদের ভাবনার অন্ত ছিল না, মুসলিমদের শিক্ষা ডেভেলপমেন্ট ঘটাতে তাঁদের কোশেশেরও কমতি ছিল না। এজন্য তাঁরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়া, শিক্ষার আধুনিকায়নে শ্রমঘাম ঢেলেছেন অঢেল; কিন্তু তাঁরা ঠিক ইলমের প্রসার চাইছিলেন না। কেননা, পূর্বচর্চিত ইলম যেহেতু মানুষের সভ্যতার চাবিকাঠি হতে ব্যর্থ হয়েছে এবং মানুষের আর্থসামাজিক মুক্তির পথ বাতলে দিতে অক্ষমতা দেখিয়েছে, তাই ততদিনে ইলম জ্ঞানের মধ্যে একটা বিরাট ফারাক তৈরি হয়ে গেছে। দোষটা হয়তো ইলমের নয়, যাঁরা ইলমের ধারক তাঁদের, কিন্তু এখানে দোষী নিরুপণের মাধ্যমে সমাধানে আসার আর সময় ছিল না। ইবাদতের কথা তো কারও ভাবনায়ই ছিল না। সালাতের ইমামতি কায়েমের জন্য ধর্মপ্রাণ মানুষ আর রাষ্ট্রের দিকে তাকিয়ে থাকেনি। রাষ্ট্র কেবল পুরাতাত্ত্বিক মসজিদের খুঁজে নেমেছে, মুসল্লির সন্ধানেও নয়।

ইসলাম প্রতিষ্ঠা যেহেতু চাননি, তাই পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার প্রাক্কালে মুসলিম জাতীয়তবাদকে এককথায়এন্টি হিন্দু মুসলিমজমআখ্যায়িত করা যায়। যদিও ইসলামের নামে বহু কৃতিত্ব দেখানোর চেষ্টা করা হয়েছে, আরবি হরফে বাংলা লিখিয়ে সোয়াব হাসিল করার পাঁয়তারা চালানো হয়েছে, মুসলিমলীগবিরেধিতাকে কুফরি ঘোষণা দিয়ে মুসলিমদের ঐক্য রক্ষার মেহনতি সংগ্রাম চালানো হয়েছে, কিন্তু এইসবই প্রয়োগ হয়েছে বিভ্রান্তিকরভাবে একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলের মানুষকে দমিয়ে রাখার বাসনায়। সুতরাং পূর্ববাংলার মেজরিটি মুসলিম মাইনরিটি হিন্দুদের নিয়ে বাঙালি জাতীয়তাবাদের উত্থানে আর দেরি হয়নি। নতুন রাজনৈতিক দল এসেছে নতুন জাতীয়তাবাদ নিয়েসকল মানুষেরমুক্তির জন্যমুসলমানের মুক্তির জন্য আর নয়।

তিন.

সকল মানুষ, শুধু মুসলমান নয়জাতীয় মূল্যবোধ বিশ্বে এখন অত্যন্ত জনপ্রিয়। বিষয়টাও ইসলামে অমোঘ সত্য। কিন্তু এর পেছনে একটি করুণ সত্য লুকিয়ে আছে। তা হলোএই মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য মুসলিমকে সচেতন করা নয়; বরং তাকে নিজ পরিচয় থেকে সরিয়ে দৈশিক জাতীয়তাবাদী পরিচয়ের পিরান পরানো। আর ইসলামে এর অর্থ ছিলকেবল অমুসলিম বলে কাউকে জুলুম করার অধিকার মুসলমানকে দেওয়া হয়নি; মানবিক বিচারে মুসলিমঅমুসলিম সকল মানুষ সমান। এই ভেলকি মুসলিম জনসাধারণ বুঝতে ভুল করেছে। ফলতঃ মুসলিম পরিচয় হারিয়ে তাদের মধ্যে যে দৈন্যদশার সৃষ্টি হয়েছে, তাতে এখন তারা পারস্পরিক শত্রুতায়ই শুধু আক্রান্ত নয়, বরং ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মুসলিম রাষ্ট্র নিজেদের উন্নয়নেও সফলতা দেখাতে না পেরে অমুসলিম উন্নত দেশগুলির প্রতি ঝুঁকে পড়েছে প্রবলভাবে।

কেননা, আর্থসামাজিক উন্নয়ন ছাড়া মুক্তির আর কোনো পথ তাদের জানা নেই। এমনকি মুসলিম দেশগুলির মধ্যকার সম্পর্কের হ্রাসবৃদ্ধিও ঘটে এখন সামরিক কিংবা অর্থনৈতিক উন্নয়নকে কেন্দ্র করেই। কেবল অমুসলিম দেশগুলিতে যেসব মুসলিম অভিবাসীর বসবাস, তারাই কিছুটা মুসলিম পরিচয় প্রকাশের সুযোগ পায় এবং কোথাও কোথাও উগ্রবাদিতার অভিযোগে প্রকাশ নাকরতে পারলেই বাঁচে। যদিও তাদের মধ্যে স্বদেশপ্রীতি জাতীয়তবাদী পরিচয় আরও বেশি জোরালো এবং নিজেদের মধ্যকার কালচারাল প্রোগ্রাম কিংবা রিইউনিয়ন অনুষ্ঠানে দেশীয় সংস্কৃতির প্রেজেন্টশনের প্রাধান্য থাকেমুসলিম সংস্কৃতির নয়। এটা একটা দুঃখজনক ঘটনা।

সূচনালগ্ন থেকে যেই মুসলিমরা নিজেদের ভূখণ্ডের দখল নিশ্চিত করতে অমুসলিমদের বিরুদ্ধে লড়েছে, ভিনদেশে কেবল ইসলাম প্রচারের জন্য নয় মানবতাকে মুক্তি দেবার তাড়নাতেই যারা অক্লান্ত ছুটে বেড়িয়েছে, এই মাত্র একশবছর আগেও ব্রিটিশ, ফ্রেন্স, রুশ সাম্রাজ্যবাদ থেকে মুক্তি পেতে যারা পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তরে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনও করেছে, তাও করেছে শুধু নিজেরাই নিজেদের মুসলিম জনগোষ্ঠীকে টিকিয়ে রাখার অভীপ্সায়, তারাই কেন নিজেদেরই মুক্তি উন্নয়নের নির্মাণ করতে পারল না, কেন তারাই এতটা হীনম্মন্যতার শিকার হলো যে, ভিনদেশের ভিনধর্মীদের বিদ্যানিকেতন থেকে প্রাপ্ত সার্টিফিকেটকেই মুক্তির একমাত্র সনদ বিবেচনা করতে বাধ্য হলো, এমনকি মুসলিম পরিচয়টুকুও তাদের কাছে গৌণ হয়ে পড়লএই প্রশ্নের উত্তর কোথায় আছে কে জানে।

 

তারপরও বলতে হয়, মুসলিম সংস্কৃতিসভ্যতার আলোচনা এখনও আছে। বিভিন্ন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ঊনবিংশ বিংশ শতাব্দীতে নতুন করে যাত্রাও করেছে ইসলাম পুনরুদ্ধারের আকাঙ্ক্ষা থেকে। এইসব প্রতিষ্ঠান ইলম বিলাতে কার্পণ্য করেনি বটে, ইবাদতের সুরতও বয়ান করেছে খাঁটি ইসলামি তরিকায়, কিন্তু হাদারত বা সভ্যতা গড়ার পথটি ভুলে গেছে বেমালুম। অবকাঠামোগত উন্নয়ন, অর্থনৈতিক সামরিক চাহিদা মেটাতে পারেনি কোনো অংশেই। মুসলিম জীবনের প্রতিটি কাজই ইবাদত এই বাণী ঘোষণায় তারা জানান দিয়েছে প্রাগৈতিহাসিক পন্থায় ব্যক্তিজীবন নিয়ন্ত্রণের উপায় হিসেবে। এটাই সামষ্টিক জীবনকে আক্ষরিক অর্থে পার্থিব জীবনের কাতারে নিয়ে গেছে তারা।

এই পন্থা একটি নতুন সম্প্রদায়ের জন্ম দিয়েছে, যারা বিভিন্ন দেশে মোল্লা, মৌলবি, হুজুর, শায়খ, আফি, এফেন্দি প্রভৃতি পরিচয়ে পরিচিতযাকে খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের দীক্ষিত পুরোহিত গোষ্ঠীর সঙ্গেই কেবল তুলনা করা মানানসই মনে হয়। যদিও মুসলিম দেশগুলোতে এরা সংখ্যালঘু এবং বাছা বাছা ধর্মীয় ইস্যু ছাড়া বৃহৎ মুসলিম জনগোষ্ঠীর সঙ্গে এদের সম্পর্ক ব্যক্তিগত ইবাদত শুদ্ধাশুদ্ধি যাচাইয়ের পরিসর পর্যন্ত সীমাবদ্ধ, তথাপি এর প্রতিক্রিয়া মুসলিম জাতীয়তাবাদী বিশ্বাস আরও বেশি বিভক্ত হবার সুযোগ করে দিয়েছে। ব্যক্তিগত আচরিত ইবাদতেও ফেরকার সংশ্লিষ্টতা ঘটেছে। উদার গণতন্ত্রের সুযোগে এইসকল প্রান্তিক বিভক্তি রাজনৈতিক শক্তিও পেয়েছে সীমাহীন। সুতরাং দেখা গেছে একজন ধার্মিক মানুষও কখনও কখনও নিজেকে মুসলিম পরিচয়ের চেয়েও দেওবন্দিনদভিআহলে হাদিস ইত্যকার পরিচয়ে সাচ্ছন্দ্য বোধ করছেন বেশি।

 

মুসলিম জনগোষ্ঠীর মধ্যে চরমপন্থা প্রবেশ অসম্ভবই হওয়ার কথা, যেহেতু ইসলাম সূচনালগ্ন থেকেই মিডিওকার। ইহুদিবাদের উগ্রতা খ্রিষ্টবাদের উদারতার মাঝামাঝিই ছিল ইসলামের অবস্থান। কিন্তু মুসলিম জাতীয়তাবাদ হারিয়ে যখন একজন মুসলিম বিভিন্ন রাজনৈতিক ফেরকা পরিচয়ে বেড়ে উঠছে, তখন একজন বিএনপিকর্মী দলীয় কারণে প্রচণ্ড ক্রোধে ফেটে পড়ছেন একজন আওয়ামী লীগারের ওপর এবং তাকে খুন করেই ক্ষান্ত হচ্ছেন, অথচ একবারও তিনি ভাবার ফুরসত পান না যে, নিহত লোকটাও মুসলিম এবং মুসলিমকে হত্যা করা কুফরির মতো মহাপাপ। এতে তাঁর নিজের মুসলিম পরিচয়ও হুমকির মুখে পড়তে পারে।


সবিশেষমুসলিম পরিচয়ের এখন আর কোনো পার্থিব ফায়দা নেই, লাভলোকসান যা হবার জাতি পরিচয়ের গুণেই হয়। জাতীয়তাবাদ ধর্মের মতো স্থান করে নিয়েছে বহু আগেই। বিভিন্ন দেশে ধর্মের মতোই নির্ধারিত জাতীয় রীতিনীতি পালনও জরুরি। শুধু মুসলিম পরিচয়ে কোনো দেশজাতি কাউকে স্বীকার করতে ইচ্ছুক নয়। মুসলিম পরিচয় হলেই কেউ তার তীর্থস্থানে গিয়ে হজ সারারও সুযোগ পাবে না, যতক্ষণ জাতীয় পরিচয় হিসেবে আপনি বাংলাদেশি কিংবা পাকিস্তানি পাসপোর্টে ভিসা লাগবেন। কেননা, শুধু মুসলিম পরিচয়ের কোনো ভূখণ্ড নেই। মুসলিম হওয়ার পরেও ফিলিস্তিনিদের কেউ নিজেদের ভূখণ্ডে জায়গা দেয়নি।

ইসরায়েল স্বাধীনতা ঘোষণার পরে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী গোল্ডামেয়ার ইতালির সাংবাদিক ওরিয়ানা ফালাচিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে একটা সত্যি কথা বলেছিলেন—‘আমরা সারা পৃথিবী থেকে ইহুদিদের এখানে আনছি, এমনকি প্লেগে আক্রান্ত হলেও। কিন্তু এতগুলো মুসলিম দেশ, কেউ তো ফিলিস্তিনিদের নিচ্ছে না।মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ বাংলাদেশেও কি রোহিঙ্গা মুসলিম গোষ্ঠী সাদরে বরিত হচ্ছে? হচ্ছে না। বরংরোহিঙ্গাপরিচয় তার মুসলিম পরিচয়ের চেয়েও বড় এবং এই পরিচয়ের সূত্র ধরেই সে দেশে উদ্বাস্তু সুবিধা পাবে, কখনও হয়তো মাতৃভূমিতে ফিরে যাওয়ার অনুমোদন পাবে, না পেলে তাকে মরতে হবে। এই সংকট থেকে বের হতে হলে মুসলিম জাতীয়তাবাদকেই আবারও সামনে আনতে হবে। মুসলিম পরিচয় যত শক্তিশালী হবে, মুক্তির তত নিকটে পৌঁছানো সম্ভব হবে আমাদের। ইসলামের প্রথমযুগের বিশ্বাস কর্মপন্থাই হবে একমাত্র পাথেয়। একেকটি মুসলিম দরদি হৃদয়ের উত্থান তাই একান্ত অপরিহার্য। আমাদের প্রত্যাশা প্রার্থনার সবটুকু আবেগ মিশে যাক সেখানেই। আমিন।

লেখক : তরুণ চিন্তাবিদ ও গবেষক

আগের সংবাদঈদ আনন্দ ও ইসলামের জীবনদর্শন
পরবর্তি সংবাদআগামীর মিডিয়া ও আমাদের ভাবনা