
মূল : ড. রিম তুর্কমানি ও প্রফেসর আয়দিন সায়িলি
তর্জমা : মুরসালাত ইসলাম সাবিত ও মওলবি আশরাফ
প্রারম্ভ কথা
আর তিনিই সৃষ্টি করেছেন রাত ও দিন এবং সূর্য ও চন্দ্র, প্রত্যেকেই আপন অক্ষে সাঁতার কাটে। (সুরা আম্বিয়া, আয়াত ৩৩)
শতসহস্র বছর ধরে রাতের আকাশ ও তারকারাজির জগৎ অনুপ্রাণিত করে আসছে কবিতা, গান, দর্শন এবং বিজ্ঞানে। আজ থেকে এক হাজার বছর আগে মুসলিম সভ্যতাতেও এর ব্যতিক্রম ছিল না।
বিস্ময়ের আধার মহাকাশ মুসলিমদের অনুপ্রাণিত করেছিল বারো শ বছর আগে প্রথম সফল মানুষ্যবাহী মহাকাশযান উদ্ভাবনে, যখন অন্যেরা কেবল তারা গুণতে চোখ রাখত রাতের আকাশে। মুসলিমদের মহাকাশ পর্যবেক্ষণে মনোযোগী হওয়ার প্রথম কারণ ছিল নামাজের সময়সূচী নির্ণয়, যা সূর্যের অবস্থানের ওপর নির্ভর। তারপর প্রয়োজন ছিল পৃথিবীর যেকোনো স্থান থেকে পবিত্র কাবার দিকে ফিরে নামাজ আদায় এবং চাঁদের আবর্তন তথা চান্দ্রমাস অনুসারে সিয়াম সাধনার। এসবের কারণে মুসলিমদের উদ্ভাবন করতে হয়েছে কিছু যুগান্তকারী আবিষ্কার, এর মধ্যে রয়েছে—
আমাদের আকাশগঙ্গার বাইরের তারকা আবর্তনের প্রথম তথ্য সংগ্রহ, চাঁদের গতির তৃতীয় অসমতা, এবং তারা তৈরি করেছিলেন এমনসব যন্ত্র যার ভিত্তিতে স্থাপিত হয়েছে আধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞান। এর মধ্যে আছে:
Celestial globe
Armillary sphere, Universal Astrolabe
Sextants
এ সব কিছু শুরু হয়েছিল অষ্টম শতাব্দীতে, প্রথম মানমন্দির এবং নিখুঁত জ্যোতির্বিদ্যার ছকের মাধ্যমে।
আজও নক্ষত্রবিদেরা অন্যান্য মুসলিমদের মতো তাদের প্রতিমুহূর্তে স্মরণ করে, কারণ তারা দেখতে পায় Moon bearএর এরিয়া ও ১৬৫এর বেশি নক্ষত্রের নাম আরবি ভাষায়, যা তখনকার মুসলিম নক্ষত্রবিদগণ নির্ণয় করেছিলেন।Moon bear
জ্যোতির্বিজ্ঞান ও জ্যোতির্বিজ্ঞানী
কেন মুসলিমরা আকাশের দিকে তাকিয়ে এত সময় ব্যয় করত? কারণ, প্রথমত এর একটি নিত্যনৈমিত্তিক প্রয়োজন ছিল, প্রয়োজন ছিল সারাবছর নামাজের সময়সূচি নির্ধারণ করার— সুবহে সাদিক, মধ্যপ্রহর, বিকেল, সূর্যাস্ত এবং সন্ধ্যেবেলা সূর্যের অবস্থান ছিল এর ওপর নির্ভরশীল। মুসলিমদের আরও জানতে হতো কিবলার দিক, এবং এটা নির্ণয় সম্ভব হতো চাঁদ এবং সূর্যের অবস্থান পর্যবেক্ষণ করে। এছাড়াও কোরআনে রয়েছে মহাকাশ পর্যবেক্ষণের স্পষ্ট দিকনির্দেশনা, যার ফলেই তৈরি হয় দিনপঞ্জিকা।
মুসলিমদের অনুসৃত দিনপঞ্জিকা চাঁদনির্ভর, মানে মাস পরিবর্তন হয় চাঁদের অবস্থানের ওপর নির্ভর করে। প্রতিটি মাস শুরু হয় শুক্লপক্ষের প্রথম চাঁদ থেকে। বিশেষত এটি গুরুত্বপূর্ণ পবিত্র মাস রমজানের জন্য, মুসলিমরা তখন গোটা মাস জুড়ে রোজা পালন করে।
এসকল প্রকার ধর্মীয় প্রেরণায় হাজার বছর আগে মুসলিম বিজ্ঞানীদের প্রধান চিন্তা হয়ে উঠেছিল জ্যোতির্বিজ্ঞান, এবং এর ফলে তারা যা উদঘাটন করেছিলেন তা শতশত বছর ধরে চলছিল আলোকবর্তিকা হয়ে। পঞ্চদশ শতকে রনেসাঁসের সময় বিখ্যাত গণিতবিদ এবং জ্যোতির্বিদ রিজিওমনতেনাস তার তত্ত্বের জন্য মুসলিম জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের বইগুলোর ওপর নির্ভর হয়েছিলেন, কারণ তিনি নিকোলাস কোপারনিকাসের বই On the Revolutions of the Heavenly Spheresএ বারবার একাদশ শতকের স্পেনীয় অ্যাস্ট্রলজার আজ জারকলি ও দশম শতাব্দীর তুর্কি জ্যোতির্বিজ্ঞানী আল বাত্তানির নামের উল্লেখ দেখেছিলেন।
জ্যোতির্বিজ্ঞান সংক্রান্ত বেশিরভাগ শ্রেষ্ঠ আবিষ্কার হয়েছিল প্রাচ্যের মানমন্দিরগুলোতেই। কিন্তু স্পেনে মুসলিম শাসনামলে টলেডোতে নতুন মানমন্দির তৈরি করা হয়, যা তখন হয়ে উঠেছিল সারা দুনিয়ার জ্যোতির্বিজ্ঞান চর্চার কেন্দ্র। মুসলিমদের পতনের পর ইউরোপ তা গ্রহণ করে তাতে আরও উন্নতি যোজন করে।
নবম শতকে বাগদাদের খলিফা আল মামুন ‘দর্শনালয়’ (the House of Wisdom) নামে একটি জ্ঞানচর্চাকেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত করেন, যার উদ্দেশ্য ছিল বিভিন্ন ভাষার জ্ঞানবিজ্ঞানের বইপত্র ও পাণ্ডুলিপি আরবিতে অনুবাদ করা। যে বইগুলো অনূদিত হয়েছিল তার মধ্যে ছিল আলেকজান্ডারের সময়কার জ্যোতির্বিদ টলেমির ‘গ্রেট ওয়ার্ক’ আলমাজেস্ত—যেখানে মহাবিশ্বের ধারণা এরকম দেয়া হয়েছে যে, পৃথিবী স্থির আর চাঁদ সূর্য গ্রহরাশি ও নক্ষত্রমণ্ডলি পৃথিবীর চারদিকে ঘোরে। পরবর্তী পাঁচশ বছরের জন্য এই ‘আলমাজেস্ত’ নামক বইটি হয়ে উঠল আরবি বিজ্ঞানীদের কাছে কসমোলজির (সৃষ্টিতত্ত্ব) ভিত্তিস্বরূপ। একই সময় মুসলিমরা উন্নত হয় এবং এই শাস্ত্রে গ্রিক গাণিতিক তত্ত্ব সংশোধন করে এগিয়ে যায়। বিশেষত ত্রিকোণমিতির ক্ষেত্রে মুসলিমরা প্রয়োজনীয় তত্ত্ব ও যন্ত্র উদ্ভাবন করেছিল, যা পরবর্তীতে ইউরোপের সভ্য হওয়ার আমলে জ্যোতির্বিজ্ঞানে উৎকর্ষতা সাধনে ভূমিকা রাখে।
মুসলিমদের মধ্য থেকে এমন অসংখ্য জ্যোতির্বিদ জন্ম নিয়েছেন যাদের মহাকাশ গবেষণায় রয়েছে বিশাল অবদান এবং তারা ভবিষ্যৎ জ্যোতির্বিদদের ভিত্তি স্থাপনে ভূমিকা রেখেছেন। তবে আমরা যুগান্তকারী কয়েকজনকে এখানে নিয়ে আলোচনা করব।
আল বাত্তানি : পশ্চিমাদের কাছে তিনি পরিচিত Albategnius নামে। মৃত্যু ৯২৯ সালে। তিনি আল জিজ উল সাবি (The sabian Tables) লিখেছিলেন, যা তার মৃত্যুর কয়েকশ বছর পরেও বেশ প্রভাব বিস্তার করেছিল। তার কৃতিত্বের মধ্যে ছিল নতুন চাঁদ ওঠার সময় গণনা, সৌর ও নাক্ষত্রিক বছরের দৈর্ঘ্য পরিমাপ করা, চন্দ্রগ্রহণের অনুমান, এবং আলোর লম্বন। তিনি জ্যোতির্বিজ্ঞানে এত বেশি অবদান রেখেছেন যে, যদি তিনি আজতক ব্যবহৃত প্রথম ত্রিকোণমিতিক রেশিওর আবিষ্কার না করতেন, এবং টলেমির থিওরির কিছু গুরুতর পরিবর্তন না আনতেন, যা তখন পর্যন্ত জ্যোতির্বিজ্ঞানের সেরা কাজ বলে বিবেচিত হতো, তবু বিশ্বসভ্যতায় তার ঋণ যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ হতো। তিনি আরও আবিষ্কার করেছিলেন সূর্যের গতির অপভূ, অর্থাৎ তারকাদের মধ্যে সূর্যের সাথে পৃথিবীর সর্বোচ্চ দূরত্ব, যা টলেমির সময়ও সঠিক ছিল না। গ্রিক জ্যোতির্বিদগণ সূর্যের দ্রাঘিমা পরিমাপ করেছিলেন পঁয়ষট্টি ডিগ্রি, আল বাত্তানি তা বিরাশি ডিগ্রিতে সংশোধন করেন। এই দূরত্বের অমিল পরিমাপে অনেক বড় গড়মিল তৈরি করতে পারত, আজ আমরা বিষয়টি বুঝি কারণ আমরা জানি পৃথিবী সূর্যকে কেন্দ্র করে প্রদক্ষিণরত আর সৌরজগৎ পরিভ্রমণ করছে মহাকাশে, অথচ ওই সময় টলেমির এ মতবাদ বিশ্বাস করা হতো যে পৃথিবী মহাবিশ্বের কেন্দ্র।
আল বাত্তানি বলেন, ‘আমার জীবনের সুদীর্ঘ সময় এ বিজ্ঞানের জন্য কাজ করে আমি খেয়াল করলাম যে, প্রতিটি গ্রহের গতিবিধি ধারাবাহিকভাবে একে অপরের থেকে ভিন্ন। এবং পূর্ববর্তী অনেক জ্যোতির্বিজ্ঞানের লেখক তাদের পর্যবেক্ষণ পদ্ধতির ভুলের কারণে ভুল নিয়ম প্রতিষ্ঠা করতে গিয়েছেন। আমি আরও দেখেছি যে, সময়ের সাথে সাথে যে বর্তমান এবং পূর্বের পর্যবেক্ষণের মধ্যে গ্রহগুলোর অবস্থানের পরিবর্তন হয়; যা হয় সৌর অয়নবৃত্তের বক্রতার জন্য, যা বছর গণনা এবং গ্রহণের গণনায় প্রভাব করে। যে পর্যবেক্ষণ আমাকে নিয়ে গেছে বিজ্ঞানের এত কাছে যা নিখুঁত এবং নিশ্চিত।’
আল বেরুনি : জীবনকাল ৯৭৩ হতে ১০৫০ সাল। তিনি বলেছিলেন, ‘সূর্য নিজের অক্ষের চারদিকে ঘুরে’, এছাড়াও তিনি পৃথিবীর পরিধি পরিমাপ করেছিলেন এবং বৈজ্ঞানিকভাবে পৃথিবীর যেকোনো প্রান্ত থেকে কিবলা নির্ধারণ করেছিলেন। তিনি প্রায় দেড়শ প্রবন্ধ লিখেছিলেন, যার মধ্যে পঁয়ত্রিশটি ছিল বিশুদ্ধ জ্যোতির্বিজ্ঞানের, কিন্তু কেবল ছয়টি বর্তমানে পাওয়া যায়।
ইবন ইউনুস : ৯৭৭ সাল থেকে প্রায় ত্রিশ বছর সময়কাল একটি বিশাল অ্যাস্ট্রোল্যাব নিয়ে পর্যবেক্ষণ করেছিলেন যার ব্যাস ছিল প্রায় ১.৪মিটার (৪.৬ ফুট)। তিনি এ কয়েক দশকে দশ হাজারেরও বেশি সূর্যের এন্ট্রি নির্ণয় করেন।
আবদুর রহমান আস সুফি : দশম শতকের পারস্যবাসী জ্যোতির্বিদ।
আল ফারগানি : তিনি ছিলেন খলিফা আল মামুনের রাজকীয় জ্যোতির্বিদ। তিনি অ্যাস্ট্রোল্যাবের গাণিতিক তত্ত্বের ব্যাখ্যা লিখেছিলেন এবং এর কেন্দ্রীয় চাকতির ত্রুটিপূর্ণ জ্যামিতিক কাঠামো ঠিক করেছিলেন, যা বর্তমানেও অপরিবর্তনীয়। তার কসমোগ্রাফির (সৃষ্টিতত্ত্ব) ওপর সবচেয়ে বিখ্যাত বই ‘কিতাবু ফি হারাকাতিল সামাওয়িয়াহ ও জাওয়ামি ইলমিন নুজুম’ (Book on Sun Movement and Encyclopedia of Star Science)-এ ত্রিশটি অধ্যায় আছে, যেখানে পৃথিবীতে বসবাস অযোগ্য স্থানসহ এর আয়তন, এবং পৃথিবী থেকে জ্যোতিষ্কমণ্ডলের দূরত্ব এবং তাদের আয়তন বর্ণিত আছে।
আজ জারকলি : ইউরোপে পরিচিত Arzachel অথবা Azraquiel নামে। ১০৮৭ সালে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তিনি বিখ্যাত ‘তলেদো ছক’ (Toledan Tables) তৈরি করেছিলেন এবং তৈরি করেছিলেন আরও বেশি ব্যবহারযোগ্য অ্যাস্ট্রোল্যাব, যা পৃথিবীর যেকোনো স্থান থেকে ব্যবহার করা যেত। এটি পরিচিত ছিল ‘সাফিয়া’ নামে, এবং তিনি বিশাল ব্যাখ্যাপূর্ণ নোট এর সাথে সংযুক্ত করেছিলেন।
জাবির ইবন আফলাহ : মৃত্যু ১১৪৫ সনে, তিনি ছিলেন প্রথম ব্যক্তি যিনি কিনা মহাকাশের স্থানাঙ্ক নির্ণয়ের জন্য বাহনযোগ্য Celestial sphereএর নকশা করেছিলেন। তিনি বিশেষত প্রসিদ্ধ তার গোলাকার ত্রিকোণমিতির ওপর কাজের জন্য।
ইবন রুশদ : দ্বাদশ শতকের মুসলিম স্পেনের রাজধানী কর্ডোভার অধিবাসী। পশ্চিমে তিনি আভেরস নামে পরিচিত। তিনি কর্ডোভার বিখ্যাত দার্শনিক ছিলেন, পাশাপাশি জ্যোতির্বিদও ছিলেন এবং তিনি মনে করতেন সূর্যে Sunspot আছে।
ইবন আল শাতির : চতুর্দশ শতকের একজন জ্যোতির্বিদ। চাঁদের গতিবিধি গণনায় তিনি টলেমিকে সংশোধন করেছিলেন। টলেমির কল্পিত চাঁদ বাস্তব চাঁদ থেকে পৃথিবীর অনেক বেশিই কাছে চলে এসেছিল, এটি দেখার পর গ্রিক ও তার পূর্ববর্তী জ্যোতির্বিদদের গ্রহতত্ত্বের ভুলত্রুটিগুলো তার নজরে পড়ে। ইবন আল শাতির বলেছিলেন, ‘আমি এরপর সর্বশক্তিমান আল্লাহর কাছে প্রেরণা ও মডেল তৈরির সাহায্য প্রার্থনা করলাম, যা না হলে সামনে এগোনো সম্ভব ছিল না। মহান আল্লাহ যাঁর প্রতি সকল প্রশংসা এবং কৃতজ্ঞতা— তিনি আমাকে তৌফিক দিয়েছেন গ্রহের গতির দ্রাঘিমাংশ, অক্ষাংশ এবং গতির অন্যান্য লক্ষণীয় বৈশিষ্ট্যের একটি সর্বজনীন মডেল উদ্ভাবন করতে, যে মডেলটি আগের মডেল থেকে অনেক বেশি উন্নত ও সংশয়মুক্ত ছিল।’
মধ্যযুগীয় মুসলিম জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের উত্তরাধিকার এখনো আমরা ভোগ করে যাচ্ছি। Zenith, Azimuth এবং সামার ট্রায়াঙ্গল, ভেগা, আলতাইর, দেনেব— অঞ্চলের সবগুলো তারার নামের ব্যুৎপত্তি আরবি ভাষা থেকে। আজ হাজারো মুসলিম জ্যোতির্বিজ্ঞানের পাণ্ডুলিপি অপাঠ্য অবস্থায় পড়ে আছে, তবে এই হাজার বছরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জ্যোতির্বিদগণ— যারা তাদের সারাটি জীবন আকাশের দিকে তাকিয়ে কাটিয়েছেন, অবশেষে এখন তারা ধীরে ধীরে পরিচিতি লাভ করছেন।
মানমন্দির
মানবসভ্যতার শুরু থেকে কৌতূহলী মানুষ আশ্চর্য হয়ে দেখত তারাকারাজির বিস্ময়কর শামিয়ানা এবং মহাকাশে তাদের গতিবিধি। স্পষ্টতই বোঝা যেত তাদের এই গতিশীলতার কোনো নিয়মবিধি আছে। তখন থেকেই মানুষ চেষ্টা-ফিকির করত এই শৃঙ্খলার ক্রমনির্ণয়ের।
এরপর একসময় মানুষ তৈরি করে মানমন্দির। এই মানমন্দিরগুলোর মাধ্যমেই বদলে যায় আমাদের জীবনব্যবস্থা, সূচিত হয় ভবিষ্যতের বিজ্ঞানের। এখন যে আমরা আকাশে সূর্যের অবস্থান, চাঁদের অবস্থান, গ্রহণের সময়সূচি, গ্রহ এবং তারকাদের অবস্থানের পরিবর্তণ গণনা করতে পারি— সবই এর কারণে সম্ভব হয়।
এমন নয় যে মুসলিমরাই প্রথম জ্যোতির্বিজ্ঞান চর্চা শুরু করে, কিন্তু তারাই প্রথম বৃহত্তর পরিসরে মানমন্দিরগুলোতে বিশাল যন্ত্রপাতির সাহায্যে চর্চা শুরু করেছিল। জ্যোতির্বিজ্ঞানের গবেষণা ব্যয়বহুল, তাই প্রয়োজন ছিল দামি যন্ত্রপাতির এবং অনেক জ্যোতির্বিদদের সহযোগিতা। ছোট আকারের বাহনযোগ্য যন্ত্র দ্বারা এর আগেও ভালো ভালো কাজ সম্পাদন করা হয়েছিল এবং টলেমি তার পর্যবেক্ষণ সংক্রান্ত কাজগুলো এসব দ্বারাই সম্পন্ন করেছিল।
আব্বাসীয় খলিফা আল মামুন, যিনি ৮১৩ থেকে ৮৩৩ সাল বাগদাদের মসনদে ছিলেন, তিনিই ছিলেন জ্যোতির্বিজ্ঞানকে মুখ্য বিজ্ঞানরূপে তৈরির প্রথম গুরুত্বপূর্ণ পৃষ্ঠপোষক এবং প্রেরণাদাতা। তিনিই প্রথম সুবৃহৎ মানমন্দির তৈরি করেছিলেন— বিশাল এবং অপরিবর্তনযোগ্য যন্ত্রের একটি স্থায়ী ঠিকানা, যেখানে জ্যোতির্বিদদের সাথে বিজ্ঞানমনস্ক কর্মীরা একসাথে কাজ করবে, এবং তৎসঙ্গে অভিজাতকূল বিজ্ঞানপ্রিয় পৃষ্ঠপোষক ও সরকারি কর্মকর্তারাও থাকবেন। মুসলিম জ্যোতির্বিদদের আগে এমন মানমন্দিরের তুলনাযোগ্য কোনো উল্লেখ পাওয়া যায় না। খলিফা আল মামুন কেবল মুসলিমদের মধ্যেই প্রথম মানমন্দির স্থাপন করেননি, বরং তর্কসাপেক্ষে পৃথিবীর ইতহাসের প্রথম মানমন্দির স্থাপন করেছিলেন। আল মামুন একজন প্রজ্ঞাবান শাসক ছিলেন, যিনি কিনা দর্শনালয় (House of Wisdom) প্রতিষ্ঠায় মূখ্য ভূমিকা পালন করেছিলেন, যা ছিল ইতিহাসের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বুদ্ধিবৃত্তিক অ্যাকাডেমি।
প্রথম দিককার মানমন্দির ছিল বাগদাদের আশ শামমাসিয়া অংশে এবং দামেশকের কাসিউন পাহাড়ে, সেখান থেকেই বিশেষজ্ঞদের যৌথ কাজের একটি স্থায়ী জায়গার প্রয়োজন অনুভব হয়। এ মানমন্দিরগুলোর একটি মুখ্য কাজ ছিল জ্যোতির্বিদ্যার ছক তৈরি করা যা গ্রহের অবস্থান, চাঁদের গতিবিধি, গ্রহণ এবং ক্যালেন্ডারের তথ্য সংগ্রহে সাহায্য করেছিল। এখানে হতো জ্যোতির্বিজ্ঞানের যন্ত্রপাতির ব্যাখ্যার আলেখ্য। এছাড়াও এখানে সূর্য ও চাঁদের অক্ষপথের ছক তৈরি করা হয়েছিল এবং সাথে ছিল একটি তারকারাজির তালিকা ও কিছু গ্রহের পর্যবেক্ষণ।
আশ শামমাসিয়াতে জ্যোতির্বিদরা সূর্য, চাঁদ, গ্রহ এবং কিছু নির্দিষ্ট তারকা পর্যবেক্ষণ করত। এ পর্যবেক্ষণের ফলস্বরূপ যে বইটি প্রকাশিত হয় তার নাম মুমতাহান জিজ বা Verified Tables, যার লেখক বলা হয় ইবন আবি মানসুরকে।
পৃথিবী জুড়ে মুসলিমরা আরও অনেক মানমন্দির তৈরি করেছে, এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো :
• হুলাগু খান প্রতিষ্ঠিত মারাগা মানমন্দির
• উলুগ বেগ প্রতিষ্ঠিত সমরকন্দ মানমন্দির
• ইস্পাহানের শাসক মালিক শাহর মানমন্দির
• গাজান খান প্রতিষ্ঠিত তাবরিজ মানমন্দির
১২৬৩ সালে পারস্যদেশের তাবরিজের দক্ষিণে মারাগা মানমন্দির তৈরি হয়, এবং এর ভিত্তিপ্রস্তরে ধ্বংসাবশেষ এখনো সেখানে বিরাজমান। মারাগা মানমন্দিরের বিজ্ঞানীরা জ্যোতির্বিদ্যার নতুন ছক তৈরি করেন এবং চল্লিশ হাজারেরও বেশি বই সমৃদ্ধ একটি জ্যোতির্বিজ্ঞানের লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠা করেন। এখানকার বিশিষ্ট জ্যোতির্বিদদের মধ্যে ছিলেন নাসিরুদ্দিন আত তুসি ও কুতুবুদ্দিন আস সিরাজি— যিনি রঙধনু তৈরির প্রকৃত কারণ উৎঘাটন করেছিলেন। নাসিরুদ্দিন আত তুসি তৈরি করেছিলেন ‘ইলখানিদ ছক’ এবং স্থির তারকার ক্যাটালগ— যা কয়েকশ বছর পর্যন্ত সারা বিশ্বে ব্যবহৃত হয়েছিল। মারাগা মানমন্দিরের এক জ্যোতির্বিদকে চীনে পাঠানো হয়েছিল শুধু এটা দেখার জন্য যে, য়ুহান রাজবংশের একজন জ্যোতির্বিদ কীভাবে চীনের মহাপ্রাচীরে মহাকাশ পর্যবেক্ষণের যন্ত্র স্থাপনের নকশা করেছিলেন।
উলুগ বেগ ছিলেন তৈমুর রাজবংশের পঞ্চদশ শতকের শাসক, যার রাজ্য পরে মধ্য এবং দক্ষিণ-পশ্চিম এশিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছিল। স্বাধীন সুলতান হওয়ার পাশাপাশি তিনি ছিলেন একজন জ্যোতির্বিদ ও গণিতবিদ, তাই তিনি সমরকন্দে চন্দ্র, সূর্য ও গ্রহরাশি পর্যবেক্ষণের জন্য তিন তলাবিশিষ্ট একটি মানমন্দির তৈরি করেছিলেন।
সমরকন্দের মানমন্দির ছিল বিশাল মাধ্যাহ্নিকসহ একটি বিস্ময়কর দালান, নামজাদা রাজমিস্ত্রীদের হাতে নির্মিত টেকসই মানমন্দির। পাহাড়ে খনন করা হয়েছিল প্রায় দুই মিটার (৬.৬ ফুট) প্রশস্ত একটি পরিখা, মাধ্যাহ্নিকের চিহ্ন বরাবর, এবং এর মধ্যেই যন্ত্রের রেখাংশগুলো বৃত্তাংশে স্থাপিত ছিল। মাধ্যাহ্নিক তোরণের ব্যাসার্ধ ছিল ইস্তাম্বুলের আয়া সোফিয়া মসজিদের গম্বুজের সমান, যা প্রায় পঞ্চাশ মিটার (১৬৪ ফুট)। এটি তৈরি করা হয়েছিল সূর্য এবং গ্রহের পর্যবেক্ষণের জন্য, এর মধ্যে ছিল পৃথিবীসেরা যন্ত্রপাতি, যেগুলোর মধ্যে ৪০.৪ মিটার (১৩২.৫ ফুট) ব্যাসার্ধের একটি ফাখরি সেক্সট্যান্ট ছিল— যেটি ছিল এই ধরনের যন্ত্রের মধ্যে সারা দুনিয়ায় লাজওয়াব বৃহত্তর। এর প্রধান কাজ ছিল মৌলিক জ্যোতির্বিজ্ঞানের বিষয়বস্তু ঠিকভাবে জানা, যেমন ক্রান্তীয় বছরের দৈর্ঘ্য মাপা। আরও ছিল আর্মিলারি গোলক ও অ্যাস্ট্রোল্যাব।
উলুগ বেগের কাজ, তার সময়কার তুলনায় অনেক অগ্রসর এবং আশ্চর্যজনকভাবে সঠিক ছিল। তার গণনা অনুযায়ী সৌরবর্ষ যে ৩৬৫ দিন, ৬ ঘন্টা, ১০ মিনিট এবং ৮ সেকেন্ড দীর্ঘ— যা বর্তমান হিসাবের চেয়ে মাত্র ৬২ সেকেন্ড বেশি : ০.০০০২ শতাংশ নিখুঁততা সেই সময়ের প্রযুক্তিতে আসলেই চমকপ্রদ।
মানমন্দিরগুলো ছিল বিশাল, যেখানে প্রতিনিয়ত পর্যবেক্ষণের কাজ চলায় প্রয়োজন ছিল প্রশাসনিক সংগঠন ও দক্ষতার, তাই জ্যোতির্বিদ ও তাদের কাজে সম্পৃক্ত অন্যান্য কর্মীরা পরিচালিত হতো সরাসরি সরকারিভাবে। পরবর্তীতে জানা গেছে যে, মানমন্দিরগুলোতে প্রশাসক, কোষাধ্যক্ষ, কেরানি, লাইব্রেরিয়ান ও প্রশাসনিক কর্মকর্তারাও স্বতঃস্ফূর্তভাবে বিজ্ঞানীদের সাথে কাজে অংশ নিতেন।
যদিও আশ শামমাসিয়ার কাসিউন পাহাড়ে আল মামুনের মানমন্দিরের প্রধান কাজ ছিল জ্যোতির্বিদ্যার ছক তৈরি করা, অন্যান্য যুগান্তকারী আবিষ্কারও ফলস্বরূপ পাওয়া গেছে, উদাহরণস্বরূপ সৌর অপভূর অবস্থানের পরিবর্তন।
ষোড়শ শতকে তাকিউদ্দিনের জন্য জাঁকজমকপূর্ণ কিন্তু অল্প কিছুদিনের জন্য একটি মানমন্দির তৈরি হয়েছিল। তাকিউদ্দিন ছিলেন মুসলিম বিশ্বের এক অন্যতম উল্লেখযোগ্য বিজ্ঞানী। তিনি সদ্য ক্ষমতার মসনদে আসীন তুর্কি সুলতান তৃতীয় মুরাদকে রাজি করিয়েছিলেন ইস্তাম্বুলের মানমন্দির তৈরিতে তহবিল দানের জন্য, যা ১৫৭৭ সালে সম্পূর্ণ হয়।
দুইটি অসাধারণ ভবন— যা স্থাপিত হয়েছিল সুউচ্চ এক পাহাড়ের ওপর, যেখান থেকে ইস্তাম্বুলের ইউরোপিয়ান সেকশন দেখা যায়, সেখান থেকে রাতের আকাশের অবাধ দৃশ্য পর্যবেক্ষণ করা যেত। আধুনিক মানমন্দিরের মতো এখানকার মূল ভবনে ছিল একটি লাইব্রেরি ও কর্মীরা পরিচালিত হতো সাংগঠনিকভাবে, আর ছোট ভবনে ছিল তাকিউদ্দিনের নিজের হাতে তৈরি চিত্তাকর্ষক যন্ত্রের সংগ্রহ। এর মধ্যে ছিল গ্রহের অবস্থান ও গতি নির্ণেয়র জন্য একটি বিশালাকৃতির আর্মিলারি গোলক ও যান্ত্রিক ঘড়ি।
তাকিউদ্দিন চেয়েছিলেন পুরানো জ্যোতির্বিদ্যার ছককে হালনাগাদ করতে, যেখানে গ্রহগুলোর, সূর্যের এবং চাঁদের গতির বিবরণ থাকবে। কিন্তু ব্ল্যাক ডেথের সাথে সম্পর্কিত কিছু সামাজিক-রাজনৈতিক কারণে এবং প্রাসাদ অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের ফলে তার মানমন্দির ধ্বংস করে ফেলা হয়। এতসব অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার পরেও তাকিউদ্দিন রেখে গেছেন জ্যোতির্বিদ্যা, গণিত এবং ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ওপর বিশাল বইয়ের সম্ভার।
প্রথম সুবৃহৎ মানমন্দিরের সাথে সাথে মুসলিমদের ছিল নবম শতকের একজন স্পেনীয় নেতা, যিনি তৈরি করেছিলেন প্ল্যানেট্যারিয়াম। মানমন্দির থেকে ব্যতিক্রম এই প্ল্যানেট্যারিয়াম হচ্ছে এমন একটি কক্ষ যেখানে তারকারাজি, গ্রহ এবং অন্যান্য মহাজাগতিক বস্তুর ছবি আঁকানো থাকে। উড্ডয়নের গবেষণার জন্য প্রসিদ্ধ ইবন ফিরনাস তার প্ল্যানেট্যারিয়ামে একটি কাচের ঘর তৈরি করেছিলেন, যেখান থেকে রাতের আকাশ যেমন ছিল তেমনই দেখা যেত। এটি এখনকার প্ল্যানেট্যারিয়ামের সাথে অনেকটাই সাদৃশ্যপূর্ণ ছিল, এমনকি এটির সাথে তিনি কৃত্রিম বজ্রধ্বনি ও বিদ্যুচ্চমক পর্যন্ত যুক্ত করেছিলেন।
যন্ত্র-প্রকৌশল
মহাকাশ পর্যবেক্ষণ ও গবেষণার জন্য মুসলিমরা নানা কিসিমের যন্ত্র-প্রকৌশল উদ্ভাবন ও নকশা করেছিলেন। এর মধ্যে বেশ কিছু বিশালাকৃতির যন্ত্র তাদের পরিমাপে ভুলের শতকরা হার কমিয়ে এনেছিল। দামেশকের মানমন্দিরে ছিল একটি ৬ মিটার (২০ ফুট) কোয়াড্র্যান্ট ও একটি ১৭ মিটার (৫৬ ফুট) সেক্সট্যান্ট— যা প্রায় চারটি আস্ত ট্যাক্সিগাড়ির সমান। মারাগা মানমন্দিরেও ছিল অনুরূপ অনেক বড় বড় যন্ত্র, ছিল সুবৃহৎ কোয়াড্র্যান্ট, আর্মিলারি গোলক ও অ্যাস্ট্রোল্যাব।
অন্যান্য যন্ত্রের মধ্যে ছিলো সেলেসটিয়াল গ্লোব, ক্যোয়াড্র্যান্ট ও সেক্সট্যান্ট। মানমন্দিরে ব্যবহৃত এসকল যন্ত্রগুলোকে খুবই নিখুঁত হতে হতো, কেননা মানমন্দিরের সুনাম বাঁধা ছিল তাদের প্রকাশিত ফলাফলের ওপর।
দ্বাদশ শতকে স্পেন অধিবাসী জাবির ইবন আফলাহ ছিলেন প্রথম ব্যক্তি যিনি নভঃস্থিত স্থানাঙ্ক মাপার জন্য একটি বহনযোগ্য সেলেস্টিয়াল গ্লোবের নকশা করেছিলেন (যাকে বলা হতো Torquetom), কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এর মূল নকশা করেছিলেন দশম শতকের ইরাকি জ্যোতির্বিদ আল বাত্তানি। তিনি এই গ্লোবের পর্যবেক্ষণীর যন্ত্র হিসেবে নয়, বরং চেয়েছিলেন সেলেসটিয়াল ডাটা যথাযথভাবে সংগ্রহ করতে। এই যন্ত্রের বিবরণে তিনি উল্লেখ করেন— এটি হবে পাঁচটি রিং দিয়ে আটকানো, আর মাঝের গোলক হবে ডিম্ব আকৃতির, তাই এর নাম দিয়েছিলেন ‘আল বাইদাহ’ বা ডিম। তার এই বিষয়ক প্রবন্ধে ১০২২টি তারকার অবস্থান বিস্তারিত বিবৃত ছিল। প্রবন্ধটি বেশ তথ্যবহুল ও কাজের ছিল, এর সাহায্যে গ্লোবে কোথায় কোন তারকাটি থাকবে তা চিহ্নিত করা যেত। প্রবন্ধটি তিনি লিখেছিলেন সেসময়কার যন্ত্র প্রস্তুতকারীদের কেমন মানের গ্লোব প্রস্তুত করা উচিৎ তার উদহারণ দিতে গিয়ে।
আল বাত্তানির গ্লোব টলেমিপূর্ব সেলেস্টিয়াল গ্লোবের ডিজাইন থেকে অনেকখানি ভিন্ন ছিল, যেখানে ব্যবহৃত হতো পাঁচটি সমরূপ বিষুবরেখার বলয় ও ঋক্ষ রূপরেখা। এর বদলে আল বাত্তানির গ্লোবে ছিল সৌর অয়নবৃত্ত ও বিষুবরেখা নির্ণয় মাধ্যমে নক্ষত্রপুঞ্জ ছক করার আরও নিখুঁত পদ্ধতি, এবং একে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশে ভাগ করার কৌশল। আল বাত্তানির তত্ত্ব অনুসরণে নক্ষত্ররাজির সঠিক স্থানাঙ্ক পাওয়া সম্ভব হয়েছিল, এবং মহাকাশ হয়ে উঠেছিল আরও বেশি স্পষ্ট।
মুসলিমরা ছিল দক্ষ পরিশ্রমী ও যন্ত্র কারিগর। আবদুর রহমান আস সুফি ছিলেন একজন সেরা সেলেসটিয়াল গ্লোব কারিগর। তিনি সেলেসটিয়াল গ্লোবে ঋক্ষমণ্ডলের নকশার ওপর একটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন, যা মুসলিমবিশ্বের সাথে সাথে ইউরোপেও বেশ প্রভাব ফেলেছিল। অ্যাস্ট্রোল্যাব এবং সেলেসটিয়াল গ্লোবের ব্যবহারবিধি নিয়েও তার বেশ কয়টি গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ আছে।
ষোড়শ শতক পর্যন্ত তৈরি অনেক গ্লোব আজতক সংরক্ষিত আছে, তবে একাদশ শতকের আগে তৈরিকৃত গ্লোব এখন আর পাওয়া যায় না। অনেক বিজ্ঞানীই জ্যোতির্বিদ্যার যন্ত্রপাতি নিয়ে লিখেছেন এবং এখানে অল্প কয়েকজনের কথা উল্লেখ করা হলো :
সিরিয়ার অধিবাসী আবু বকর ইবনুস সাররাজ আল হামাউয়ি (মৃ. ১৩২৯) তার আবিষ্কৃত কোয়াড্র্যান্ট ‘আল মুকানতারাতুল য়ুসরা’ নিয়ে কাজের সময় তিনি বেশ কিছু বই লিখেছিলেন বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি এবং জ্যামিতিক সমস্যা নিয়ে। তিনি প্রচুর সময় ব্যয় করেছিলেন কোয়াড্র্যান্ট ও তার বই Treaties on Operations with the Hidden Quadrant ও রত্নভাণ্ডারতুল্য সমৃদ্ধশীল কাজ ‘আদ দুররুল গারিব ফিল আমাল বিদাইরাতিত তাইয়িব’ (Rare Pearls on Operations with the Circle for Finding Sines)এর পেছনে। তবে দুঃখের বিষয়, তার বৈজ্ঞানিক যন্ত্র নিয়ে এখন পর্যন্ত কোনো গবেষণা হয়নি।
আরেক সিরিয়ান, আলেপ্পোর অধিবাসী আহমাদ আল হালাবি (মৃ. ১৪৫৫) যন্ত্র-প্রকৌশলের ওপর লিখেছিলেন গুরুত্বপূর্ণ বই ‘বুগায়াতুত তুলাব ফিল আমাল বির রুবিল আসত্রুলুব’ (Aims of Pupils on Operations with the Quadrant of Astrolabe)
আল হালাবির সমসাময়িক ইজ্জুদ্দিন আল ওফায়ি ছিলেন প্রথমত একজন গণিতবিদ, তারপর কায়রোর বনু উমাইয়ার মসজিদের মুয়াজ্জিন ও মুওয়াক্কিত (নামাজ রোজা ইত্যাদির সময় নির্ণায়ক)। তিনি পাটিগণিত ও ষষ্ঠিক অনুপাতের ক্রিয়া (Sexagesimal ratio) নিয়ে লিখেছিলেন বিস্ময়কর চল্লিশটি গদ্য, এর মধ্যে বিশাল সংখ্যার কাজ যন্ত্রপাতির ক্রিয়া সম্পর্কে। তার গবেষণার সংকলনের নাম ‘আন নুজুমুজ জাহিরাত ফি আমালি বির রুবিল মুকানতারাত’ (Brilliant Stars on Operations with the Almucantar Quadrant)
সেক্সট্যান্ট এবং কোয়্যাড্র্যান্টগুলো ব্যবহৃত হতো দিগ্বলয়ের ওপর নাক্ষত্রিক বস্তুর উচ্চতা নির্ণয়ের জন্য। বিশেষ করে তাদের হাতে কোয়্যাড্র্যান্ট খুব বেশি ব্যবহৃত হতো, যেগুলোর নকশা খুব চমৎকারভাবে তারাই করেছিল।
মুসলিম জ্যোতির্বিদরা নানা প্রকারের কোয়াড্র্যান্ট উদ্ভাবন করেছিল। জ্যা কোয়াড্র্যান্ট (Sine Quadrant) ব্যবহার করা হতো জ্যামিতিক সমস্যা সমাধানের জন্য, যা উদ্ভাবিত হয়েছিল নবম শতকের বাগদাদে। ইউনিভার্সাল কোয়াড্র্যান্ট ব্যবহৃত হতো যেকোনো অক্ষাংশের যেকোনো সমস্যার সমাধানের জন্য, যা উদ্ভাবিত হয়েছিল চতুর্দশ শতকের সিরিয়ায়। ঘন্টাসংক্রান্ত কোয়াড্র্যান্ট (Horary Quadrant) ব্যবহৃত হতো সূর্যের সাহায্যে সময় নির্ণয়ের জন্য। আর আল মুকানতার কোয়াড্র্যান্ট— এটি অ্যাস্ট্রোল্যাবের সাথে সংযুক্ত থাকে, এবং এর সাথেই ব্যবহৃত হয়।
ক্রাঁতিবৃত্তের বক্রতা নির্ণয়ের জন্য, পৃথিবীপৃষ্ঠের বিষুবরেখা এবং সূর্যের ক্রাঁতিবৃত্তের মধ্যকার কোণ নির্ণয়ের জন্য ৯৯৪ সালে আল খুজানদি একটি যন্ত্র ব্যবহার করেন, যা তার ভাষ্যমতে তিনি নিজেই উদ্ভাবন করেছিলেন। একে বলা হতো ‘ফাখরি সেক্সট্যান্ট’, কারণ এর পৃষ্ঠপোষক ছিলেন ইস্পাহানের বুওয়াহিদ শাসক ফাখরুদ্দৌলা। আল খুজানদি দাবি করেছিলেন তিনি গবেষণায় আগে ব্যবহৃত যন্ত্রগুলোকে হালনাগাদ করেছেন, কারণ সেগুলো শুধুমাত্র ডিগ্রি এবং মিনিটে গণনা করতে পারত, যেখানে তার উদ্ভাবিত যন্ত্র সেকেন্ডের হিসাবও করা যেত।
এই যন্ত্রটিতে একটি ষাট ডিগ্রি পরিধির দেয়ালে উত্তর-দক্ষিণ লাইনে মাধ্যাহ্নিকের সাথে শ্রেণিবদ্ধভাবে লাগিয়ে স্থাপন করা হয়। আল খুজানদির যন্ত্র আগে ব্যবহৃত যন্ত্র থেকে বেশ বড় ছিল, এর ব্যাস ছিল প্রায় ২০ মিটার (৬৫.৬ ফুট)।
ষোড়শ শতকের তুর্কি জ্যোতির্বিজ্ঞানী তাকিউদ্দিন অবশ্য আল খুজানদির ‘ফাখরি সেক্সট্যান্ট’ থেকে বেশি পছন্দ করতেন একটি পঞ্চম ধরনের কোয়াড্র্যান্ট— যাকে বলা হতো মুরাল কোয়াড্র্যান্ট। এই কোয়াড্র্যান্টে ছিল দুটি বিভাজ্য পিতলের উপবৃত্ত, যার পরিধি ছিল মাত্র ৬ মিটার (১৯.৭ ফুট), আশ্চর্যভাবে আল খুজানদির কোয়াড্র্যান্ট থেকে অনেক ছোট, এটি মাধ্যাহ্নিকসহ দেয়ালের স্থাপিত ছিল। যেকোনো পরিমাপ নেওয়ার জন্য, জ্যোতির্বিদরা সেলেসটিয়াল বডিসমেত কোয়াড্র্যান্টের নল অথবা কর্ডটি মহাকাষীয় বস্তুটির সোজাসুজি করতেন, এবং মুরাল কোয়াড্র্যান্টের অ্যাঙ্গেল দিয়ে নক্ষত্ররাজি পরিমাপ করতেন।
এই বৃহদাকার জ্যোতির্বিদ্যার পর্যবেক্ষণযন্ত্র বর্তমান সময়ে উল্লেখযোগ্যভাবে কমে গেছে, কিন্তু তাদের প্রযুক্তি ভিত্তিস্থাপন করেছে আধুনিককালের পোর্টেবল সেক্সট্যান্ট ও গ্লোবাল পজিশনিং সিস্টেম(জিপিএস)এর। মুসলিম জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের উদ্ভাবিত যন্ত্রগুলোই ছিল এসবের আগে দিকনির্ণয়ের প্রধান যন্ত্র।