ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে হিজাব-নিকাবে বাধা

রাকিবুল হাসান নাঈম:

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের পক্ষ থেকে শিক্ষার্থীদেরকে টিউটোরিয়াল প্রেজেন্টেশন, মিডটার্ম পরীক্ষা, চূড়ান্ত পরীক্ষা এবং মৌখিক পরীক্ষার সময় কানসহ মুখমণ্ডল দৃশ্যমান রাখার নোটিশ দেয়া হয়েছে। প্রথমে মৌখিক ঘোষণা দেয়া হলেও কোন কোন শিক্ষার্থী নিকাব খুলতে রাজি না হওয়ায় তাদের বিরুদ্ধে ভার্সিটির ‘বিধি মোতাবেক’ ব্যবস্থা নেবার কথা জানিয়ে লিখিত নোটিশ দিয়েছে ডিপার্টমেন্ট।

ইতিপূর্বে ২০২০-২১ সেশনের একজন শিক্ষার্থীকে নিকাবের জন্য ভাইবা দিতে না দেয়ার অভিযোগ উঠেছিল এই বিভাগের বিরুদ্ধে। পত্রিকা এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এ ব্যাপারে লেখালেখি করা হলে উল্টো ১৮.৯.২০২২ তারিখে মৌখিক এবং ৬.১২.২০২২ লিখিত নোটিশ দিয়ে মুখ খুলে পরীক্ষা দেয়াকে বাধ্যতামূলক করে দেয়া হয়।

এই ঘটনার মাধ্যমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে হিজাব-নিকাব পরিধানে বাধাপ্রাপ্ত হওয়ার বিষয়টি আবার সামনে এলো।

শিক্ষার্থীরা বলছেন, ‘হিজাববিদ্বেষ’

শিক্ষার্থীরা বিষয়টিকে হিজাববিদ্বেষ হিসেবে দেখছেন। ঢাবির আইন বিভাগের ছাত্রী সানজিদা আক্তার ফাতেহকে বলেন, ‘বাংলা বিভাগের এক ছাত্রীকে নিকাব পড়ায় ভাইবায় বসতে দেওয়া হয়নি কয়দিন আগে। বিষয়টি নিয়ে তখন পত্র-পত্রিকায় লেখালেখি হয়। তার প্রতিক্রিয়ায় ক্ষুব্ধ হয়ে এই সিদ্ধান্ত হয়েছে বলে মনে করছি। নয়ত ঢাবির আর সাতাশিটা ডিপার্টমেন্ট যদি নিকাবসহ পরীক্ষা নিতে পারে, বাংলা বিভাগ কেন পারবে না?’

সানজিদা আক্তার আরও বলেন, ‘ব্রিটিশদের প্রণীত আইনেও পর্দাশীলদের জন্য বিশেষ নিয়ম ছিল। বাংলাদেশের নিয়মেও ধর্মীয় রীতি পালনের অধিকার আছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মেও নিকাব খুলে রাখতে হবে এমন কোনো নিয়ম নেই। শনাক্তকরণের নিয়ম আছে। শনাক্ত তো ফিঙ্গারপ্রিন্ট, বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতেও করা যায়। ঢাবি প্রশাসন কত অনুষ্ঠানে কতটাকা খরচ করে। আধুনিক এই পদ্ধতিগুলো চালু করলেই পারে।’

এ প্রসঙ্গে কথা হয় ঢাবির আইন বিভাগের শিক্ষার্থী মোল্লা মুহাম্মদ ফারুক আহসানের সঙ্গে। ফাতেহকে তিনি জানান, ‘বাংলাদেশের সংবিধানে পূর্ণাঙ্গ ধর্মীয় অধিকার দেয়া হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সেটা দিতে বাধ্য। সিন্ডিকেটের অনুমোদন ছাড়া এমন গুরুত্বপূর্ণ একটি ধর্মীয় রীতির বিরুদ্ধে একটা বিভাগ নিয়ম করতে পারে না। পরিচয় শনাক্তের আধুনিক বিভিন্ন পদ্ধতি আছে। কর্তৃপক্ষ সেসব পদ্ধতি ব্যবহার করতে পারছে না, সেটা তাদের ব্যর্থতা। সেজন্য তারা ছাত্রীদের অধিকার খর্ব করতে পারে না।’

ঢাবিতে হিজাব সংশ্লিষ্ট ঘটনাবলী নিয়ে কাজ করছেন জামালুদ্দিন মুহাম্মদ খালিদ। তিনি বলেন, এগুলো বিধির অনুসরণ নয়, এগুলো একেকটি ক্রাইম। এক বছরের বেশি সময় ধরে ঢাবিতে হিজাব সংশ্লিষ্ট ঘটনাবলী নিয়ে কাজ করছি। বাংলা বিভাগের নোটিশটি সম্প্রতি ভাইরাল হলেও ঘটনাপ্রবাহ কয়েক মাস পূর্ব থেকেই অবজারভেশন করছি। আমাদের হাতে প্রায় শতের কাছাকাছি কেস জমা হয়েছে। যদি ভিকটিমদের পড়াশোনা হুমকির মুখে পড়ার আশঙ্কা না থাকত, তাহলে জমা হওয়া কেসের সংখ্যা কয়েকশ হত বলে আমরা নিশ্চিত। এই জমা হওয়া প্রতিটি ঘটনাই হিজাব নিয়ে কটুক্তি, হেনস্থা ও হুমকি-ধমকির। এর একটাও পরিচয় শনাক্তকরণ অথবা নকল ঠেকানোর প্রয়োজনে ঘটা কোন কেস নয়।’

তিনি আরও বলেন, ‘যে বোনটিকে কেন্দ্র করে সর্বশেষ স্টেপ নিল বাংলা বিভাগ, তাকে ফার্স্ট সেমিস্টারের ভাইবাতেও হেনস্থার শিকার হতে হয়েছিল। মূল্যায়ন করা হয়নি তার। দ্বিতীয় সেমিস্টারে যথাসম্ভব ভাইবা বোর্ডেই বসতে দেয়নি। অবশেষে সে পড়াশোনা ছেড়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে হল ছেড়ে চলে গেছে অলরেডি। আগামী ২৪ তারিখ বাংলা বিভাগের প্রথম বর্ষের পরীক্ষা। নোটিশের পর ওরা এখন কান্নাকাটি করে অস্থির।’

হিজাব-বিষয়ক ‘বিধি’টা কী?

ক্রিমিনাল অফেন্স সংক্রান্ত মামলা বিষয়ে ব্রিটিশরা ১৮৯৮ সালে যে আইন করেছিল,
তার নাম Code of Criminal procedure, সংক্ষেপে CrPC। ওই CrPC-ই পরবর্তীতে ভারত,পাকিস্তান ও স্বাধীন বাংলাদেশের আইন হিসাবে এখনও চলমান টুকটাক কিছু পরিবর্তন সাপেক্ষে।

CrPC এর ৪৮ নং ধারাতে বর্ণিত আছে, একজন আসামীকে ধরতে যাওয়ার সময় যদি উক্ত আসামী ঘরের দরজা জানালা বন্ধ করে রাখে এবং বলার পরও সেগুলো না খুলে প্রতিবন্ধকতা তৈরী করে রাখে, সেক্ষেত্রে জানালা কিংবা ঘরের কোনো অংশ ভেঙে পুলিশ ভেতরে প্রবেশ করে ওই আসামী ধরতে পারে। ঠিক ওই পরিস্থিতিতেও যদি এমন হয় যে, ওই ঘরে অভিযুক্ত ব্যক্তির সাথে এমন কোন নারী আছেন যিনি পর্দাশীল, তাহলে ওই ঘরের দরজা জানালা ভাঙার আগে অবশ্যই ওই পর্দানশীল নারীকে জানাতে হবে যে, রুমের ভেতর এইভাবে প্রবেশ করতে বাধ্য হচ্ছে তারা, তাই উনাকে সময় দেওয়া হচ্ছে যাতে করে উনি ওই সময়ের ভেতর নিজেকে সরিয়ে নিতে পারেন। যাতে করে তার ওই ধর্মীয় পর্দার কোন খেলাপ না হয়।

CrPC এর ৫২ ধারায় বলা আছে, কখনও যদি কোন নারীকে সার্চ করার দরকার হয়, অবশ্যই একজন নারী ব্যক্তি দিয়েই তা করাতে হবে এবং তা হতে হবে অত্যন্ত শালীনতা মেইনটেইন করে।

২০১০ সালে ফ্রান্স নিকাব পরা ব্যান করে একে ক্রিমিনাল অফেন্স হিসাবে ট্রিট করা শুরু করে। ফরাসি ওই আইন ধর্মীয় ও ব্যক্তি স্বাধীনতা হরণ করেছে বলে ফ্রান্সে বাস করা দুইজন মুসলিম নারী জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশন (UNHRC) এর দারস্থ হয়। ২০১৮ সালে এসে দীর্ঘ তদন্তের পর
জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশন এইমর্মে সিদ্ধান্ত দেয়, এটি ছিল ধর্মীয় স্বাধীনতা ও সমতার পরিপন্থী।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যে আইনে চলে সেই আইনটার নাম ‘ঢাকা ইউনিভার্সিটি অর্ডার ১৯৭৩’। এই আইনের কোথাও কোনো পরীক্ষার নিকাব-হিজাব পরা নিষিদ্ধ করা হয়নি। তবে এক্সাম কমিটির একটা নিয়ম আছে, পরীক্ষার্থী অরিজিনাল কিনা যাচাই করে দেখা। এর মানে, যদি নিকাব পরিহিত কারো সত্যতা যাচাই করার প্রয়োজন হয়, সেক্ষেত্রে তাকে যাচাই করা যেতে পারে।
সেই যাচাই করার মেথড হতে হবে শালীন।

আলেমরা কী বলছেন

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ড. আ ফ ম খালিদ হোসেন ফাতেহকে বলেন, এখন কোন বিশ্ববিদ্যালয় যদি বলে, একটা পর্দানশীল মেয়েকে পরীক্ষায় বসতে হলে তাকে শুধুমাত্র একজন ম্যাডাম নয়, বরং ওই বোর্ডের অন্য পুরুষ পরীক্ষক কর্তৃকও চেক করে দেখতে হবে, সেটা রীতিমতো অযৌক্তিক। পর্দানশীল কোন নারী শিক্ষার্থীকে পরীক্ষার হলে নিশ্চিত হওয়ার জন্য যদি মুখের নিকাব খুলে চেক করার প্রয়োজন পরে, সেক্ষেত্রে তাকে অন্য একজন নারী শিক্ষক কিংবা কোন নারী অফিসিয়াল স্টাফ দ্বারা চেক করে নিশ্চিত হওয়াটাই যথেষ্ট। আর কোন কর্তৃপক্ষের যদি নারী লোকবলের অভাব থাকে,তাহলে প্রযুক্তিগত বহু উপায় আছে, ফিঙ্গারপ্রিন্ট শনাক্তকরণ কোন প্রযুক্তি ব্যবহার করলেই হয়ে যায়।

তিনি আরও বলেন, ‘একজন মুসলিম মেয়ে হিজাব-নিকাব পরে পরীক্ষা দিতে পারবে না, কেমন কথা এটা। আমি মনে করি, এর বিরুদ্ধে সবার সজাগ হওয়া দরকার।’

সদুত্তর নেই কর্তৃপক্ষের

এ প্রসঙ্গে কথা হয় ঢাবি বাংলা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক কানিজ ফাতেমার সঙ্গে। তিনি ফাতেহকে বলেন, ‘পরিচয় শনাক্তকরণের জন্য এ নিয়মটি করা হয়েছে। অনেকে পরীক্ষার সময় ব্লুটুথ হেডফোন ব্যবহার করে। তাদেরকে চেক দেয়ার জন্যই এ নিয়মের প্রবর্তন।’

গণমাধ্যমের খবর হলো, ঢাবিতে ছেলেরাও প্রক্সি দিচ্ছে। তাহলে নিকাব না পড়লেও প্রক্সি দেয়ার সম্ভাবনা আছে। কানিজ ফাতেমা বলেন, ‘যে ডিপার্টমেন্টে ছেলে প্রক্সি দিয়েছে, এটা তাদের ব্যর্থতা।’

বিশ্ববিদ্যালয়ের বিধিতে শনাক্তকরণের জন্য তো নিকাব খুলে রাখার নিয়ম নেই। হয়ত সামান্য সময়ের জন্য খোলা যেতে পারে, তাও নারী শিক্ষকের সামনে। কানিজ ফাতেমা বলেন, ‘নিকাব খুলে রাখার নিয়ম নেই। আমরা ক্লাসে ত খুলে রাখতে বলছি না। শুধু পরীক্ষায় খুলতে বলেছি।’

নিকাব না খুলেও আধুনিক টেকনোলজি ব্যবহার করে শনাক্ত করা যায়। সেটা ব্যবহার করা হচ্ছে না কেন? কানিজ ফাতেমা বলেন, ‘সেটা ত আমরা করতে পারব না। করবে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। কর্তৃপক্ষ সেটা কেন করছে না, তাতো আমি জানি না।’

আগের সংবাদখেলা নিয়ে উন্মাদনা বাড়ছে, আলেম সমাজের উদ্বেগ
পরবর্তি সংবাদআ.লীগের সম্মেলনে যাওয়ার পথে দুর্ঘটনায় আহত ৫