|| তাসনিফ আবীদ ||
ইফতার রমজানের গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। ইফতার ইবাদত। মুসলমানদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের স্মারক। ইফতার নিজে করা যেমন সওয়াবের কাজ তেমনি যতজন রোজাদার ইফতার করাবে, ততটা রোজার সওয়াব আমলনামায় যুক্ত হবে। নবীজি বলেন, ‘যে ব্যক্তি রোজাদারকে ইফতার করালো, তারও রোজাদারের ন্যায় সওয়াব হবে; তবে রোজাদারের সওয়াব বা নেকি বিন্দুমাত্র কমানো হবে না।
বাংলাদেশসহ গোটা মুসলিম দুনিয়ায় ভ্রাতৃত্বের চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে মুসলমানরা ইফতারের আয়োজন করে থাকেন। ইফতার পালন মুসলিমদের জন্য একটি আনন্দঘন অনুষ্ঠান। আবহমান বাংলার চিত্রে দলমত নির্বিশেষে মোহনীয় এক অধ্যায় ইফতার। কিন্তু অপ্রত্যাশিতভাবে যুগ যুগ ধরে চলে আসা মুসলিম সমাজের এই রীতিনীতিতে নগ্ন হস্তক্ষেপ লক্ষ্য করা গেছে এ বছর। ঢাবিসহ বেশকিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে ইফতারের আয়োজনে বিধি-নিষেধ এবং হামলার ঘটনাও ঘটেছে। বিষয়টি কীভাবে দেখছে দেশের আলেম সমাজ?
খেলাফত মজলিসের নায়েবে আমির ও ইসলামি রাজনীতিবিদ মাওলানা আহমাদ আলী কাসেমি বলেন, এদেশে ধর্মীয় বিধান পালন করা প্রত্যেক নাগরিকের সাংবিধানিক অধিকার। ইফতার একটি ধর্মীয় ইবাদত। এটি একজন মুসলিম প্রতিষ্ঠান কিংবা বাড়ি সবখানেই স্বাধীনভাবে পালন করবে, এটাই প্রয়োজন ছিল। কিন্তু নিন্দনীয়ভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ নানা জায়গায় এই ইবাদতে বাধা সৃষ্টি করা হচ্ছে। হামলা হচ্ছে।
তিনি উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, এসব যারা করছে নিশ্চয়ই তারা তাদের বিদেশি কোনো এজেন্টকে খুশি করার জন্য করছে। তারা মানুষকে ধর্মহীন করতে চায়।
‘কিন্তু আপনারা লক্ষ্য করবেন, তাদের এই বাধার ফলে মানুষ এখন স্ব স্ব উদ্যোগে নানা জায়গায় গণ ইফতারের আয়োজন করছে। হামলা কিংবা বাধা তাদেরকে আটকে রাখতে পারছে না।’ –যোগ করেন তিনি
তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেন, এর মাধ্যমে আমরা বুঝতে পারি- তারা মানুষকে যতই ধর্মহীন করার চেষ্টা করুক কিন্তু কোনোভাবেই সফল হবে না ইনশাআল্লাহ।
এদিকে শিক্ষাবিদ ও গবেষক আলেম ড. আফম খালিদ হোসেন বলেন, এ দেশে বহু পুরনো আমল থেকে সরকারি ও বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় ইফতার পার্টির আয়োজন চলে আসছে। চলতি বছর ইফতার মাহফিলের আয়োজন নিয়ে বিতর্ক ও সঙ্ঘাত তৈরি হয়েছে, যা আগে কখনো হয়নি। ১৪ মার্চ থেকে শহীদ জিয়া মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালের ক্যাম্পাসের মসজিদের ‘ইফতার কার্যক্রম স্থগিত’ লেখা নোটিশ টাঙিয়ে দেয়া হয়। সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ও নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্তৃপক্ষ বিজ্ঞপ্তি জারি করে ক্যাম্পাসে ইফতার আয়োজন নিষিদ্ধ করে। সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষও ক্যাম্পাসে রমজানে ইফতার আয়োজন বন্ধ করে দেয়। এর আগে ১৩ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আইন বিভাগের ছাত্ররা ‘বঙ্গবন্ধু টাওয়ার’ ভবনের মসজিদে ‘প্রোডাকটিভ রমজান’ শীর্ষক আয়োজিত ইফতার মাহফিলে একদল দুর্বৃত্ত হামলা চালিয়ে কয়েকজন ছাত্রকে রক্তাক্ত করে। ফেনী সরকারি কলেজে ছাত্ররা ইফতারের আয়োজন করায় দুর্বৃত্তরা আয়োজকদের আটজনকে বেধড়ক পিটিয়ে আহত করে। এগুলো কোনোভাবেই মেনে নেওয়ার মতো নয়।
‘ইউনেস্কো ২০২৩ সালে মুসলিমদের ঐতিহ্যবাহী ধর্মীয় রীতি ইফতারকে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের আওতাভুক্ত করে। ইউনেস্কোর ভাষায়- ইফতার রমজান মাসে সব ধরনের ধর্মীয় বিধান মানার পর সূর্যাস্তের সময় মুসলিমদের পালনীয় রীতি। সংস্থাটি মনে করে, এ ধর্মীয় রীতি পরিবার ও সামাজিক বন্ধন দৃঢ় করে এবং দান, সৌহার্দের মতো বিষয়গুলো সামনে নিয়ে আসে।’ –যুক্ত করেন তিনি
ড. আফম খালিদ বলেন, এ দেশের যেকোনো নাগরিকের ধর্মশিক্ষা, ধর্মচর্চা, ধর্মীয় ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি লালনের সাংবিধানিক অধিকার রয়েছে। বাংলাদেশে সে অধিকারচর্চার উজ্জ্বল ইতিহাস আছে। চলতি সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ৭২টি এবং জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ৩৬টি মণ্ডপ স্থাপন করে সরস্বতীর পূজা করা হয় সমারোহে। মণ্ডপ তৈরিতে অনেক অর্থ ব্যয় হয়। তাহলে ক্যাম্পাসে সাদামাটা ইফতার আয়োজনে নিষেধাজ্ঞা কেন? এ প্রশ্ন সঙ্গত।
‘সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানের দেশে ইফতার মাহফিলে নিষেধাজ্ঞা জারি ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত। এ ধরনের নিষেধাজ্ঞা দেশে নতুন সঙ্কট সৃষ্টি করবে, যা বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করে দেশকে গভীর সঙ্কটে ফেলতে পারে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে সাহরিতে গরুর গোশত নিয়ে বিদ্বেষচর্চার সাম্প্রদায়িক ঘটনাসমূহ মুসলিম শিক্ষার্থীদের মধ্যে তীব্র অসন্তোষ সৃষ্টি করেছে। বাংলাদেশ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ। যেকোনো মূল্যে এ ঐতিহ্য ধরে রাখতে হবে। ধর্মবিশ্বাসী প্রতিটি নাগরিকের ধর্মীয় আচার অনুশীলনের অধিকার রয়েছে।’ –মত দেন তিনি