আব্দুল্লাহ আল মাহী
তরিকায়ে মোহাম্মদিয়া, উপমহাদেশের প্রথম স্বাধীনতা আন্দোলন। এই আন্দোলন ছিল একই সাথে একত্ববাদের প্রতি সহমর্মিতা ও মমতা মিশিয়ে আহ্বান। মোঘল আমলের শেষ দিনগুলোতে ধারাবাহিকতা বজায় রেখে চরমে পৌঁছা বিদাআত ও কুসংস্কার সমূহের চূড়ান্ত দুঃস্বপ্ন। সুন্নতের পোশাকে হাজির থাকা সুন্নত নয় এমন বিষয়গুলোর জটিল সমীকরণ দূর করে নববী সুন্নতের বাস্তবিক চিত্র ফুটিয়ে তোলার প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা এবং শরিয়ত ও হকিকতকে উসূলের আলোকে এক বাস্তবিক প্রয়োগের মাধ্যমে সামগ্রিক এক বৈপ্লবিক প্রচেষ্টা। সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য যালেমে পরিনত হওয়া গোষ্ঠী সমূহের বিরুদ্ধে শরয়ী জিহাদ।
তরিকায়ে মোহাম্মদিয়া, ১২ শত বছরে একটিবারও এই নাম কেউ শুনেনি। মুজাদ্দিদের কাজ হয় নিয়মমাফিক নিয়ম করে প্রচলিত নিয়ম ভঙ্গ করা। সাইয়েদ আহমেদ শহীদ র. ঠিক এই কাজটাই করলেন। প্রসিদ্ধ চার তরিকার একটিতেও বায়াত নিলেন না কারও। সংস্কার জরুরি সমাজের। তিনি শুধু পোশাক পরিবর্তন করলেন। পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ হতে থাকা ভারতীয় সমাজ এই তরিকার আহ্বানকে সাদরে গ্রহণ করেন, ফলে তরিকায়ে মোহাম্মদিয়ার কার্যক্রম ছড়িয়ে পড়ে পুরো ভারত জুড়ে। দলে দলে ও একাকী এবং নিরবে, নিভৃতে ও সরবে অনেকেই এই আন্দোলনের সাথে নিজের জুড়িয়ে দেন। যদিও এই তরিকার প্রধান উদ্দেশ্য, তাওহিদের প্রচার-প্রসার। তথাপি দেখা যায়, অনেক বিধর্মী এই তরিকার আন্দোলন পদ্ধতির সাথে একাত্মতা প্রকাশ করে সে-সময়। ব্যাপারটা বৈপরীত্যপূর্ণ মনে হলেও কাওয়ায়েদে ফিকহের উসূল হচ্ছে, তাওহিদের আহ্বানের সময় বিধর্মীর কোনভাবেই আনুকুল্য পাবার সুযোগ থাকছে না। তবুও নিয়ম হচ্ছে, তাওহিদের ফলাফল তথা, স্বস্তি পাবার জন্য এখন ‘আজিমত’—কাঠিন্যতার পথ ছেড়ে দিতে হবে। তাদের আপন করে নিতে হবে। এটা শরিয়তের “রুখসত” ও সহজতার প্রকাশ। ঠিক এই বিষয়টাই ঘটেছে তৎকালীন সময় ও সমাজে।
এই তরিকার ব্যবহারিক ও প্রায়োগিক বিষয়গুলোর প্রতি লক্ষ্য করলে চারটি ভাগে পুরো তরিকার আমলকে আমরা বুঝে নিতে পারবো।
০১-তাওহিদ,
০২-বিদআত,
০৩-সুন্নাত
ও ০৪-জিহাদ
০১—তাওহিদ
তরিকায়ে মোহাম্মদিয়ার তাওহিদের আহ্বান ছিল মূলত তৎকালীন কুসংস্কারকে ঝেঁটিয়ে বিদায় করার জন্য। যখন কুফর ও শিরক এর সাথে কুসংস্কারের অবস্থান ছিল যৌগিক। সেজন্য নতুন করে, ছোট-বড় সমস্ত শিরক থেকে বের হয়ে তাওহিদের প্রতি সার্বজনীন আহ্বান ছিল তরিকায়ে মোহাম্মদিয়ার কার্যকরী পদক্ষেপ এর বিরাট এক অংশ। অদেখা ও অত্যাশ্চার্য হয় এমন বিষয়গুলোর প্রতি বিশ্বাস এতটাই তীব্র হয় যে, সাইয়্যেদ আহমদ বেরলভি’র মূলনীতিগুলোর একটি ছিল– “আল্লাহর বন্দেগি করা এবং একমাত্র আল্লাহরই সন্তুষ্টি ভিক্ষা করা। যেখানে কোন মানবীয় আচার বা অনুষ্ঠানের মধ্যবর্তিতা একেবারেই নেই। ফেরেশতা, জ্বীন, পরী, পীর-মুরিদ, আলেম, সাগরেদ, রাসূল বা ওলী মানুষের দুঃখ-দূর্দশা দূর করার ক্ষমতা কারোরই নেই।”
দ্বিতীয় মূলনীতি—“ সত্য ও অবিকৃত ধর্ম হচ্ছে, প্রাত্যহিক জীবনে ওইসব কাজই করা যা রাসূলে কারীম সা. করে গিয়েছেন। সুতরাং সমাজের যেখানেই বিদআত ও কুসংস্কার আছে সবগুলোর মূলোৎপাটন করা৷ এবং সেখানে তাওহিদের বীজ বপন করা চাই৷”
একটি ঐতিহাসিক প্রশ্ন হচ্ছে, মুহাম্মদ বিন কাসিম থেকে শুরু করে গজনীর সুলতান মাহমুদ এবং তাদের পরে যারা বৃহত্তর বাংলায় রাষ্ট্রীয় ভাবে ইসলাম নিয়ে এসেছিলেন তারা খাঁটি ইসলাম নিয়েই এসেছিলেন। তাহলে পরবর্তীতে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে কীভাবে এই ইসলামের বিকৃতি সাধন করা হলো? নাকি রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়াই ইসলামের নাম নিয়ে অন্য কোন সংগঠন এই অতি প্রাকৃত কাজ করেছে? আর তারা ইসলামের নামে কাজ করে থাকলেও এক্ষেত্রে তাদের উদ্দেশ্য দ্বীন ধর্মের খেদমত ছিল নাকি ভিন্ন কোন মতলব লালন করত এসব দল?
তাওহিদ; উপমহাদেশে শিয়া চিন্তার ঐতিহাসিক প্রসার।
ভারত বর্ষে রাষ্ট্রীয় ভাবে শিয়া তোষণ শুরু হয় মোঘল সম্রাট হুমায়ুনের আমলে। শের শাহের হাত থেকে রাজ্য পুনরূদ্ধারের জন্য তিনি পারস্য সম্রাটের দ্বারস্থ হন৷ মিশরের সম্রাটদের উপাধি যেমন “ফারাও” বা “ফেরাউন” তেমনি পারস্যের সম্রাটদের উপাধি “শাহ”৷ পারস্যের সম্রাট তখন শাহ তামাম্প। তিনি ছিলেন শিয়া ইমামিয়া মাজহাবের একনিষ্ঠ অনুসারী এবং প্রচারক৷
ইরানের তখনকার সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা ও বিচারক কাজী জাহানের হাতে সম্রাট হুমায়ুন শিয়া ইমামিয়া মতবাদ গ্রহণ করেন৷ এর বিনিময়ে শাহ তামাম্প তার এক ছেলে সহ বার হাজার সৈনিক সম্রাটকে প্রদান করেন, এবং শাহের এক ভাগ্নের মেয়েকে হুমায়ুনের হাতে সমর্পণ করে আত্মীয়তার বন্ধনে আবদ্ধ করেন। এই বার হাজার লোকের মাঝে উপদেষ্টা, ধর্ম প্রচারক এবং চিত্রকরও ছিলো। ভারতবর্ষে চিত্রকলার আগমন হুমায়ুনের হাত ধরে। এখানে পাঠকদের মনে রাখা প্রয়োজন, ছবি আঁকার ব্যাপারে সুন্নী আলেমগণের বিধি-নিষেধ আছে৷ (তাজকিরাতুল ওয়াকিয়াত; লেখক: সম্রাট হুমায়ুনের পানি বাহক জওহর আফতাবচী ৷ স্যার হুমায়ুন আহমেদের “বাদশাহ নামদার” এর প্রকাশনা উপলক্ষ্যে প্রকাশিত সাক্ষাতকার ৷)
সম্রাট হুমায়ুনের শিয়া মতাদর্শ গ্রহণ ছিলো রাজনৈতিক কৌশল। রাজ্য পুনরূদ্ধারের পর তিনি আবার সুন্নী মতবাদে ফিরে আসেন। কিন্তু যে জীবাণু তিনি সাথে করে নিয়ে এসেছিলেন তা ততদিনে চতুর্দিকে সংক্রমিত হয়ে গেছে ৷ সম্রাট হুমায়ুনের মৃত্যুর পর সম্রাট আকবর যার তত্ত্ববধানে বড় হন, সে বৈরাম খাঁ ছিলো একজন শিয়া৷ সম্রাট আকবর বৈরাম খাঁর কাছ থেকে রাজনৈতিক এবং সামরিক শিক্ষা লাভ করলেও নিরক্ষর ছিলেন ৷ সম্রাট আকবরের শাসনামলে ইরানে “মোলহেদ” নামে শিয়াদের আরেকটি আক্বীদার উৎপত্তি হয় ৷ সুন্নীদের মাঝে যেমন ওহাবী, সালাফী, হানাফী, মালেকী ইত্যাদি বিভাজন তৈরি করে একদল আরেক দলকে ভ্রান্ত প্রমাণ করতে ব্যস্ত শিয়াদের মাঝেও তেমন ৷ ইমামিয়া শাহ এদেরকে ভ্রান্ত আখ্যা দিয়ে এদের বিরূদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করলে এরা দলে দলে ভারতে আশ্রয় গ্রহণ করে ৷
এদের একদল সম্রাট আকবরের সাথে দেখা করে তাকে বলে, আমরা জানি প্রতি এক হাজার বছরে একজন মোজাদ্দেদ বা ধর্ম প্রচারক পৃথিবীতে আসে ৷ আমরা যাচাই-বাছাই করে দেখেছি আপনিই হতে যাচ্ছেন সেই মহান ব্যক্তি ৷ উল্লেখ্য সম্রাট আকবরের জন্ম আরবী ৯৪৯ হিজরীতে৷ যেহেতু ধর্মীয় জ্ঞান ছিলো না এবং তিনি চাটুকারিতা পছন্দ করতেন৷ তাই এদের অনেককে রাজদরবারে আশ্রয়। আকবরের “দীন-ই-এলাহি” তৈরির পেছনে এদেরও প্ররোচনা ছিলো ৷ (ইতিহাসের ইতিহাস, গোলাম আহমেদ মোর্তজা ৷)
আর বাংলায় ইংরেজদের আগমন পর্যন্ত যেসব শাসক ছিলেন তাদের অধিকাংশ ছিলেন শিয়া মতাবলম্বী। আলীবর্দি খাঁ থেকে শুরু করে সিরাজুদ্দৌলা এবং তার বিশ্বাসঘাতক মীর জাফর। ওদিকে মহিসুরের সুলতান টিপুর বিশ্বাস ঘাতকও ছিলেন শিয়া। তাদের এসব রাজনৈতিক কার্যকলাপকে ছাপিয়ে তাদের ধর্মীয় পরিচয় প্রকাশ পেয়েছে কম আমাদের কাছে। কিন্তু সেসময় থেকেই শিয়া সুন্নী কোন্দল ছিল। শিয়াদের কুসংস্কার ও এসব তাওহিদ বিরোধী কার্যকলাপের বিবরণ তৎকালীন সময়ে রচিত কিতাবাদী ও উপন্যাস ভরপুর পাওয়া যায়। তাদের এই ঐতিহাসিক এপ্রোচকে প্রতিরোধ করতেই নিজ সময়ে কুসংস্কারকে ঝেঁটিয়ে বিদায় করার তাগাদা নিয়ে মাঠে ছিলেন সাইয়েদ আহমদ শহীদ র.। এবং এর উল্লেখযোগ্য প্রমাণ পাওয়া যায় শাহ ওয়ালি উল্লাহ এর লিখিত কিতাব ইসনা আশারিয়্যাতে।
তাওহিদ প্রতিষ্ঠা; শাহ ওয়ালি উল্লাহ থেকে সায়্যেদ আহমদ বেরলভি
১৭০৩ সালে শাহ ওয়ালি উল্লাহ এর জন্ম। মারা যান ১৭৬৪ সালে। দীর্ঘ এই ৬১ বছরের জীবনে আওরঙ্গজেব সহ দশ সম্রাটের সময়টা প্রত্যক্ষ করেছেন। মুসলিম শাসনের এই ক্ষয়শীল জামানায় তিনি জ্ঞান ও বুদ্ধিবৃত্তির অভিনব রাজ্য নির্মাণ করেন। শাহ ওয়ালি উল্লাহ সাধনার ধারায় সমাজ, রাষ্ট্র, বৈশ্বিক বাস্তবতা বিশেষত ভারতীয় মুসলিম জীবনের চলমান আত্মধ্বংস থেকে মুসলিম উম্মাহর সুরক্ষায় তিনটি বিষয় একান্ত অবিকল্প। প্রথমত, যুক্তি ও দর্শন। দ্বিতীয়ত, আধ্যাত্মিকতার সংস্কার। তৃতীয়ত, ইলম বির রিওয়ায়াহ তথা শরিয়ার বর্ণনাজাত ইলমের ব্যাপক প্রচার প্রতিষ্ঠা।
বার বছর যাবৎ আলোচনা পর্যালোচনা ও গবেষণার পর সংস্কারের ব্যাপক প্রক্রিয়াকে তাঁর বিপ্লবী আন্দোলনের কর্মসূচি হিসেবে গ্রহণ করেন। দুটি বিষয়ের ওপর তিনি অধিক গুরুত্বারোপ করেন। এক, আকিদার সংস্কার, সমাজ, রাষ্ট্র, শিক্ষাব্যবস্থা, সাংস্কৃতিক পরিস্থতির অবক্ষয়গ্রস্থ অবস্থাকে ভেঙেচুরে নতুন নির্মিতির উচ্চারণ এবং দ্বিতীয়ত, কুরআন হাদিসের মৌলিক শিক্ষার দিকে প্রত্যাবর্তনের প্রখর আহ্বান ছিল তার কন্ঠে।
একটি শক্তিশালী তাত্ত্বিক ভিত দাঁড় করিয়ে দিয়েছিলেন শাহ ওয়ালি উল্লাহ। এটাকে আরও মজবুত করেন তার পরবর্তী বংশধরেরা। আর এই চিন্তার এক নিষ্ঠ প্রচারক হিশেবে পুরো ভারতজুড়ে তবলীগ করে বেড়ান সাইয়েদ আহমদ বেরলভি ও তার নাতী শাহ ইসমাইল শহীদ র.।
সাইয়েদ আহমেদ শহীদ র. তাসাউফ এর প্রচলিত চার তরিকার ওপর বায়াত নিতেন না। বলতেন, মোহাম্মদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরচেয়ে বড় কোন পীর নাই। তার ইত্তিবা— অনুসরণের ওপর বায়াত গ্রহণ করো তোমরা। ওয়ালিউল্লাহি চিন্তার চর্চাকে প্রায়োগিক রূপ দিতে এবং এর নতীজা বের করার লক্ষ্যে তিনি ভারতব্যাপী সফর করেন। এবং তরিকায়ে মোহাম্মদিয়ার ওপর সবার কাছ থেকে বায়াত নেন। কিছু কিছু ক্ষেত্রে দেখা যাবে শাহ ওয়ালি উল্লাহ এর কোন একটি সীদ্ধান্তের বিপরীত কোন মন্তব্য পাওয়া যাচ্ছে সাইয়েদ আহমদ থেকে। এর উল্লেখযোগ্য কারণ হচ্ছে, ইংরেজদের আধিপত্য বিস্তার এর বিষয়টা শাহ ওয়ালি উল্লাহ পর্যন্ত ঠিকঠাক পৌঁছেনি। এবং তাদের কূটচাল প্রকাশ পাওয়ার পূর্বেই তিনি ইন্তেকাল করেন। পক্ষান্তরে সাইয়েদ আহমদ বেরলভি ইংরেজদের কূটচাল দেখেই বড় হোন। তাই, সাইয়েদ আহমদ বেরলভি’র জিহাদি আন্দোলনের মৌলিক উদ্দেশ্য ছিল ভারতবর্ষ, যা ক্রমান্বয়ে ইংরেজদের দখলে চলে যাচ্ছিল। এক চিঠিতে তিনি লিখেছেন, “এই যুদ্ধ (সীমান্ত ও পাঞ্জাব) থেকে অবসর হওয়ার পর এই অধম পুণ্যবান মুজাহিদগণের সঙ্গে কুফর ও দাম্ভিকতার মূলোৎপাটনের নিয়তে ভারতের প্রতি মনোযোগী হবে। কেননা এটাই মূল লক্ষ্য।”
তরিকায়ে মোহাম্মদিয়ার তাওহীদ চিন্তার যুগোপযোগীতা
যুগোপযোগীতা শব্দের ব্যবহার হয় দুই অর্থে। এক, যা বর্তমান সময়কে ধারণ করে। আরেকটি হচ্ছে, যা অতীতকালের ‘বর্তমান’কে ধারণ করে। তারিকায়ে মোহাম্মদিয়া অতীতের বর্তমানকে যথাযথই ধারণ করেছিল। কিন্তু তাদের তাওহিদ প্রতিষ্ঠার মাধ্যম ও ওসিলাগুলো ছিল কাঠিন্যতার মাঝে সুন্দরতম সরলতা। যে কারণে, ঐতিহাসিকভাবেই তারা বিভিন্ন ক্ষেত্রে ধোঁকাগ্রস্থ হয়েছেন। রাজনীতির কূটচালে হারতে হয়েছে তাদের। তাছাড়া, মওদুদীর ভাষায়, তারা জমিন নরম করার আগেই চাষ শুরু করেছিলেন। অর্থাৎ জনমনে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে পারলেও শাসকশ্রেণির কাছে নিজেদেরকে শক্তিশালী রূপে পেশ করতে ব্যর্থ হয়েছিলেন তারা। তবে পরবর্তী সময়ে এই সংকট কিছুটা কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হন বালাকোটের উত্তরসূরীরা।
০২—বেদাত
শিয়া সম্প্রদায়কে রাষ্ট্রীয়ভাবে পৃষ্ঠপোষকতা ও তাদের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া কুসংস্কার ছিল তখনকার ধর্মানুভূতি। অতিরঞ্জিত এসব আচার-অনুষ্ঠান মুসলিম সমাজে প্রভাব ফেলছিল বাজে ভাবে। হিন্দু সম্প্রদায় থেকে ভিন্নতর কিছু ছিল না এসব অনুষ্ঠানে। সেজন্য তখন এসব অনুষ্ঠানে হিন্দুরাও দলেদলে যোগ দিয়ে উপভোগ করত। এ ক্ষেত্রে উদাহরণ হিশেবে ইসমাইল হোসেন সিরাজী’র উপন্যাসগুলো উল্লেখযোগ্য। ইসলাম নয় এমন কিছুকে ইসলাম বলা হচ্ছে যুগযুগ ধরে। এসবের সংস্কারকল্পেই এসে হাজির হন শাহ ওয়ালি উল্লাহ ও তার আধ্যাত্মিক উত্তরসূরী সাইয়েদ আহমদ শহীদ র.।
তরিকায়ে মোহাম্মদীয়ার সংস্কারমূলক উসূল
প্রথমত, জ্ঞান কেন্দ্রিক সমাজ ও জাতি গঠন।
দ্বিতীয়ত, জ্ঞানের প্রচার এবং প্রচার পদ্ধতিতে বৈচিত্র্য আনয়ন।
তৃতীয়ত, সামাজিকভাবে কুসংস্কারের প্রতি সচেতনতা তৈরি।
চতুর্থত, সচেতনতা বৃদ্ধি ও ঘৃনার পরিবেশ তৈরি করণ।
পঞ্চমত, অনুন্যপায় অবস্থায় কঠোর হস্তে দমন পদ্ধতির প্রবর্তন।
সংস্কার পদ্ধতি; হার্ড কর্ণার এবং সফট কর্ণার
সংস্কারক মাত্রই জানেন, কীভাবে তাকে কার্যোদ্ধার করে নিতে হবে। এক্ষেত্রে হুজুর সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে একটু উসূল বা মূলনীতি বর্ণিত আছে, তিনি বলেন, “কোন অপছন্দনীয় কাজ দেখলে প্রথমেই যদি দমন (সংস্কার) করতে পারো তবে হাত দিয়েই করে নিবে। যদি হাতের ব্যবহার সম্ভব না হয় তবে মুখে বলে দেখবে। এটাও যদি অসম্ভব হয় তবে মনে মনে কাজটিকে ঘৃণা করবে।”
সাধারণত প্রতিটা ফেরকা এই হাদিসকেই তাদের সংস্কারকাজের মূলনীতি হিশেবে বিবেচনা করে থাকে। কিন্তু হাদিসের টেক্সট কখন, কোথায়, কীভাবে, কোন পদ্ধতিতে প্রয়োগ করতে হবে, সেটা শারে’-শরিয়ত প্রণেতা হুজুর সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং আল্লাহর চাওয়া মাফিক হয় না। এর সমাধান হচ্ছে, মাকাসিদুশ শারিয়ার অধ্যায়ন। ও রুচিবোধ তৈরি করা। এখান থেকেই সংস্কার পদ্ধতিতে তৈরি হয় দুটি ধারার। এক, হার্ড কর্নার। দুই, সফট কর্নার। মানে, অতি যযবাতি। এবং সহজিয়া ধারা।
বিদআত নিরসনে মোহাম্মদিয়া তরিকা জীবিত?
প্রতিটা বিপ্লব তার কর্মপন্থা পরবর্তীদের মাঝে রোপণ করে যায়। যা একবার সৃষ্টি হয় তার বিলুপ্তি ঘটে না। তার রূপান্তর ঘটে। তরিকায়ে মোহাম্মদিয়ার বিদআত নিরসনের পদ্ধতি সে যুগ অনুযায়ী উপযোগিতা পেয়েছিল। কিন্তু পুরোনো ছাই খুঁচিয়ে আশপাশ নোংরা না করে সেখান থেকে ধিকিধিকি জ্বলতে থাকা আগুন নিয়ে নতুন পদ্ধতিতে কার্য পরিচালনা করা জরুরি। যা পুরোনোকেই নতুন করে সহযোগীতা করা।
০৩—সুন্নাত
নবী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে দুইভাগে আমাদের ভাগ করে নিতে হয়। এক, তিনি নবী। দুই, তিনি মানুষ। নবী হওয়ার দৃষ্টিকোণ থেকে তার কাজগুলো আমাদের পালন করতে হবে শরিয়ত প্রণেতার চাহিদা মাফিক। নবী হওয়ার দৃষ্টিকোণ থেকে তার কাজের স্তরবিন্যাসগুলো উসূলে ফিকাহ এর মাধ্যমে যাচাই বাছাই করে আমাদের পালন করা জরুরি। আর এগুলোর জন্য আবশ্যকীয় ভাবে জ্ঞান জরুরি। নতুবা মানুষ হিশেবে নবীর কাজকে আমরা সুন্নাত হিশেবে বিবেচনা করতে শুরু করব। এবং এটাই হচ্ছে এখন। সর্বোপরি এটি জ্ঞানীদের ক্ষেত্র। অজ্ঞরা হয়তো শিখে আসবে। নয়তো জ্ঞানীদের অনুসরণ করতে হবে তাদের।
কুসংস্কারপন্থিরা এই কাজটিই খুব সুচারুরূপে করেছে। ফলে মুসলিম শাসনের শেষ সময়ে এসে জ্ঞানের মুখোশে মূখতার হাজারো ধারা উপধারা তৈরি হয়। আর এটাই ছিল ১৯ শতকে সুন্নাতের সামাজিক অবস্থান ও পরিস্থিতি।
সুন্নাতের পুনর্জাগরণে তরিকায়ে মোহাম্মদিয়ার ভূমিকা
মাকাসিদুশ শারিআহ বা শরিয়তের উদ্দেশ্য বোঝার মেথডলজি হারিয়ে যাওয়ার ফলে মুসলিমদের মাঝে শরিয়তকে বৈপরিত্যমূলক লাগছিল। শাহ ওয়ালি উল্লাহ এসে এখানে দুটি কাজ করেছিলেন। এক, শরিয়তের খুঁটিনাটি সমস্ত বিষয়ের প্রয়োগে কী কী ফায়দা, উদ্দেশ্য ও উপকার নিহিত আছে তিনি তার হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগা কিতাবেও উল্লেখ করেন। এবং এর ব্যাখ্যা কর্মে ও এর প্রয়োগে তরিকায়ে মোহাম্মদিয়ার তথা, সাইয়েদ আহমেদ শহীদ, শাহ ইসমাইল শহীদ, মাওলানা আব্দুল হাই প্রমুখ ও তার পরবর্তী খলিফারা এর প্রচার প্রসারে কাজ করে যান। মাওলানা হায়দার আলী রামপুরী টুঙ্কি সিয়ানাতুন নাস গ্রন্থে লিখেছেন, তার হেদায়েতের নূর সূর্যের মতো পূর্ণ ক্ষিপ্রতা সাথে বিভিন্ন শহর-নগর ও মানুষের অন্তরে উদ্ভাসিত হয়। চতুর্দিকে থেকে ভাগ্যবান লোকজন পরকালের প্রতি মনোযোগী হয়ে শিরক বিদআত ইত্যাদির নিষিদ্ধ কাজগুলো থেকে তওবা করে তাওহিদ ও সুন্নতের শাশ্বত পথ অবলম্বন করতে থাকে। আর প্রায়ই হযরতের পুণ্যাত্মা খলিফাগণ নানা স্থান সফর।করে করে লাখ লাখ মানুষকে দিনে মোহাম্মদির সরল সঠিক পথ বাতলে দেন। যাদের জ্ঞান বুদ্ধি ছিল এবং আল্লাহর অনুগ্রহ যাদের সাহায্য করেছে, তারা এই পুণ্যের পথে চলেন।
সাইয়েদ আহমেদ শহীদ র এর হাতে ৪০ হাজারের অধিক হিন্দু কাফের মুসলমান হয়েছে। ৩০ লাখ মুসলমান তার হাতে বায়াত গ্রহণ করেছে।
মাওলানা ইসমাইল শহীদ এর ব্যাপারে রশিদ আহমদ গাঙ্গুহী বলেন, “মাওলানা ইসমাইল এর জীবদ্দশায়ই প্রায় আড়াই লাখ মানুষ সংশোধন হয়ে গিয়েছিল।”
শাহ আব্দুল আজিজ র. এক পত্রে তাকে হুজ্জাতুল ইসলাম উপাধিতে ভূষিত করেন। তার ছিল জ্ঞানের সতেজতা, প্রমাণদানের সূক্ষ্মতা, তাত্বিকতা, সুস্থ রুচিশীলতা, কুরআন হাদিসের বিশেষ বুৎপত্তি এবং উপস্থিত বুদ্ধি ও বাগ্মিতা।
আলী নদবী বলেন, শাহ ইসমাইল এর বড় বৈশিষ্ট্য হলো, তিনি নিজ গণ্ডী থেকে বাইরে ও ঊর্ধ্বে পদক্ষেপ নিয়েছিলেন।
০৪—জিহাদ
রাতের আবেদ, দিনের মুজাহেদ
তরিকায়ে মোহাম্মদিয়ার অনুসারীরা জিহাদের কাজে যে অঞ্চলেই প্রবেশ।করতে।সেখানে সংস্কারকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতেন। তাদের দ্বারা সেই অঞ্চলের কোন নারী সতিত্ব হারিয়ে মাতম করেনি। তাদের সাথে কোন ব্যান্ড দল থাকতো না। তাদের সাথে থাকতো না পতিতা-দের পল্টন।
এই জিহাদের মাধ্যমে তাদের মহান মালিকের শাসন প্রতিষ্ঠা ছাড়া ভিন্ন কোন উদ্দেশ্য ছিল না। অস্ত্র ধারণ করতেন আল্লাহর নামে। প্রথমে জিজিয়া চাইতেন। এরপর অস্ত্র ধারণ করতেন। অস্ত্র ধারণের পর ইসলামের বিধান অনুসারে তার ব্যবহার করতেন। জুলুম নির্যাতন করতেন না। একটি ক্ষুদ্র এলাকায় স্বল্প পরিসরে কিছুদিন তাদের রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব পালন করার সুযোগ হয়। তখন খিলাফাহ আলা মানহাজিন ননুওয়্যাহ—নববী পদ্ধতিতে রাষ্ট্র শাসন করেন তারা। তাদের সিপাহিরা দিনের বেলা ঘোড়ার পিঠে আর রাতের আঁধারে জায়নামাজে থাকতেন।
আঞ্চলিক জিহাদ থেকে গ্লোবাল জিহাদ; তরিকায়ে মোহাম্মদিয়া
তরিকায়ে মোহাম্মদিয়ার পুরোধা ব্যক্তি সাইয়েদ আহমেদ শহীদ র মনে করতেন, সীমান্তের এই যুদ্ধ সাময়ীক। শিখদের বিরুদ্ধে তাদের এই যুদ্ধ মূলত ইংরেজদের পাঠানো কিছু প্রস্তুতিমূলক যুদ্ধ। আসল যুদ্ধ ভারতবর্ষ ইংরেজদের হাত থেকে রক্ষা করে সেখানে মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠা করা। সাইয়েদ আহমেদ শহীদ এক পত্রে উল্লেখ করেন— “এই যুদ্ধ (সীমান্ত ও পাঞ্জাব) থেকে অবসর হওয়ার পর এই অধম পুণ্যবান মুজাহিদগণের সঙ্গে কুফর ও দাম্ভিকতার মূলোৎপাটনের নিয়তে ভারতের প্রতি মনোযোগী হবে। কেননা এটাই মূল লক্ষ্য।”
সাইয়েদ আহমেদ শহীদ র এর জিহাদের কনসেপ্ট থেকে বুঝে আসে অঞ্চল ভিত্তিক সমস্যার সমাধান বের করে এরপর রাষ্ট্রীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে জিহাদকে জরুরি মনে করতেন তিনি। পরবর্তীতে তার অনুসারীদের মাঝে এই ব্যপারটি লক্ষ্য করা গেছে।
সাইয়েদ আহমেদ র. শহীদ হয়ে যাবার পরে তৎকালীন সমাজের উলামায়ে কেরাম তরিকায়ে মোহাম্মদিয়ার নেতৃত্ব দেন। ইসলামী আদর্শের ভিত্তিতে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা না গেলে ইসলামকে সুপ্রতিষ্ঠত করা সম্ভব নয়, এই চিন্তাধারার ওপর তারা জিহাদ পরিচালনা করে যান। ১৮৯০ সালেও সীমান্তে ঘাটি ছিল বলে সংবাদ পাওয়া যায়। এক ভাইকে শাস্তি দিলে আরও তিন ভাই এই তরিকায় যোগ দিয়ে জিহাদে অংশগ্রহণের কথা জানা যায়। এই ধারাবাহিকতা বাজায় ছিল ভারত ব্যাপী। রেশমি রুমাল আন্দোলন এরই প্রভাব। সাইয়েদ আহমেদ র শাহাদাত এর কয়েক বছর পরই তার রীতি অনুসরণ করে মুজাহিদ বাহিনী গঠন করেছিলেন শায়েখ শামেল। ২৫ বছর তারা রাশিয়ার জার সরকারকে নাস্তানাবুদ করে রেখেছিলেন।
সাইয়েদ আহমেদ র শাহাদাত এর ৪০ বছর পর তার রীতি অনুসরণ করে সুদানের মৃত প্রায় জাতিকে জাগিয়ে ইসলামী চেতনায় জাগ্রত করে তোলেন শায়েখ মোহাম্মদ সুদানী।
রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা
তৎকালীন ভারতের উত্তর-পশ্চিম সীমান্তের অন্ধ্রপ্রদেশ থেকে শুরু করে মর্দান পর্যন্ত এ বিশাল অঞ্চলে তিনি ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে ইসলামি শাসনব্যবস্থা চালু করেন
বালাকোট ট্রাজেডির পর এই রাষ্ট্রের অস্তিত্ব সম্পর্কে তেমন কিছু জানা যায় না।
তরিকায়ে মোহাম্মদীয়ার উদয়াস্ত
তরিকায়ে মুহাম্মদিয়া একটি আদর্শ। নবী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জীবন্ত সুন্নত ও আদর্শের এর জাগরনী তরিকাকে সামনে রেখে যার নাম রাখা হয়। তাওহিদ ও একত্ববাদ, সুন্নত ও সুন্দরতম আদর্শ, বিদাআত ও কুসংস্কার নিধনে সামগ্রিক জিহাদ— ভঙ্গুর প্রায় একটি জাতির জাগরণের জন্য যেই পথ ও মতের যুগের সামনে দৃঢ়চেতা হাজিরা প্রদান সব সময়ই প্রাসঙ্গিক হয়ে আছে। আমরা হয়তো ছাই পাব। আমাদের কর্তব্য হবে, খুঁচিয়ে ধুলো না উড়িয়ে একটু সরিয়ে নিভু নিভু আগুন নিই।
যেকোন আন্দোলনের সফলতা হচ্ছে, তাঁকে শত বছর পরও জীবন্ত দেখতে পাওয়া। যদিও সেটি লাশ হয়। হুজুর সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, “স্বাদ বিনষ্টকারী মৃত্যুকে স্মরণ করো বেশি বেশি।” অর্থাৎ কোন কাজই প্রতিক্রিয়াবিহীন হয় না। তরিকায়ে মোহাম্মদিয়াও একটি ঐতিহাসিক বাস্তবতা। এবং বর্তমানের লাশ।
তথ্যসূত্র:
সংগ্রামী সাধকদের ইতিহাস-আলী নদভী
ইযা হাব্বাত রিহুল ইমান- আলী নদভী
চেতনার বালাকোট- শেখ জেবুল আমিন দুলাল
কালামদর্শন- মুসা আল হাফিজ
হুজ্জাতুলাহিল বালিগা- শাহ ওয়ালি উল্লাহ
হাদিসউ
ইকিপিডিয়া