তালিম ও তরবিয়ত: মদিনা হুজুরের শিষ্টাচার ভাবনা

জুবায়ের বিন আব্দুল কুদ্দুস:

হযরত মাওলানা আব্দুর রব মদীনা হুজুর রহ. অত্যন্ত উঁচু স্তরের এমন এক মহান ব্যক্তিত্ব ছিলেন, যার ব্যাপারে আমি কিছু লিখলে একেবারেই কম হয়ে যাবে। উপরন্তু তার মর্যাদা খাটো করা হবে। তারপরও খুব নিকট থেকে পিতৃতৃল্য শফীক উস্তাদ হযরতের স্মরণে দু’চারটি কথা লেখার নিয়ত করছি। আল্লাহ তাআলা কবুল করুন।

হযরত মদীনা হুজুর রহ. একদিকে যেমন বিদগ্ধ আলেম ছিলেন, তেমনি অপরদিকে নীতিবান-আদর্শবান একজন শিক্ষক ছিলেন। একদিকে যেমন ইলমে নববীর একজন বাহক ছিলেন, তেমনিভাবে সুন্নতে নববীর একজন মূর্ত প্রতীক ছিলেন। ছাত্রদেরকে যোগ্য এবং দক্ষ করে গড়ে তুলতে তিনি ছিলেন অতুলনীয়। শিক্ষার সাথে সাথে দীক্ষা, তালীমের সাথে তারবিয়ত তার কাছে সমান ছিল। উপরন্তু তরবিয়্যত তথা আদব-কায়দা শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে তিনি অনন্য ব্যক্তিত্ব ছিলেন। এক্ষেত্রে তিনি কখনো ভালোবাসা এবং স্নেহের চাদর বিছাতেন আবার প্রয়োজনে শাসনের লাঠি ঘুরাতেন। তার কাছে আদব শিষ্টাচার অনেক গুরুত্বের বিষয় বলে গণ্য হত। তিনি মনে করতেন আদবই সবচেয়ে বড় বিষয়। যে যত বেশী আদবের অধিকারী হবে, সে তত সৌভাগ্যশীল হবে। তার জীবনের কয়েকটি ঘটনা উপস্থাপন করছি। আশা করি এগুলো দ্বারা তাকে কিছুটা চেনা যাবে।

এক.

তিনি সকল মানুষের সাথে তার সম্মান অনুযায়ী আচরণ করতেন। বিশেষ করে তার উস্তাদগণের প্রতি তার অগাধ ভালোবাসা এবং সম্মান ছিল। তিনি নিজেই বর্ণনা করেন, আমি জীবনের শুরুতে দুই এক ক্লাস স্কুলে পড়াশোনা করেছিলাম। পরবর্তীতে মাদরাসায় পড়াশোনা করেছি। সাহারানপুরে পড়াশোনা সমাপ্ত করেছি। দেশে ফিরার পর একদিন আমার একজন হিন্দু শিক্ষককে রাস্তায় পেলাম। সাথে সাথে সম্মানের জন্য তার পায়ে পড়ে গেলাম। শরীরে পাঞ্জাবী, পড়নে পায়জমা, দাড়ি, টুপিসহ একজন মানুষ তার পায়ে ধরতে গেলে তিনি কিছুটা হতভম্ব হয়ে বললেন কে? কে ? আমি বললাম, আমি আপনার ছাত্র আব্দুর রব। আমি এত দিন হিন্দুস্থানে পড়াশোনা করতে গিয়েছিলাম। আপনি কেমন আছেন? তার সাথে কথাবার্তা বললাম। তিনি আমার জন্য অনেক দুআ দিয়েছেন।

প্রিয় পাঠক! দেখার বিষয় হচ্ছে, হযরত মদীনা হুজুর রহ. শিক্ষকের মর্যাদা দানে কোন ত্রুটি করেননি। যদিও শিক্ষক ছিলেন হিন্দু। কেননা শিক্ষকের দুআ ব্যতীত ছাত্রের জীবনে ইলমী সফলতা অর্জন সম্ভব নয়। তাই শিক্ষকের প্রতি শ্রদ্ধা, ভালোবাসা, ভক্তি রাখা অতি আবশ্যক।

দুই.

একবার এক ছাত্র তার কামরার দিকে পা মেলে ঘুমিয়ে পড়েছে। তিনি বিষয়টি দেখে খুবই বিষণ্ন হলেন। তাকে খুব রাগ-ধমক দিয়ে শাসন করলেন। অত:পর বললেন, উস্তাদের দিকে বা উস্তাদের কামরার দিকে পা প্রসারিত করে শয়ন করাও বে-আদবী এবং আদবের পরিপন্থী। সুতরাং তা পরিহার করা আবশ্যক। এ ঘটনা শুধু সে নয়; বরং আমরাসহ সকলে সতর্ক হতে পেরেছি।

তিন.

এক ছাত্রের দাড়ি কাটার অভ্যাস ছিল। আমি তাকে ধরে হযরত মদীনা হুজুরের কাছে নিয়ে গেলাম। তিনি কোন রাগ করলেন না, তাকে ধমকও দিলেন না; বরং কাছে টানলেন, তার দাড়িতে হাত লাগালেন। খুবই মায়া-মমতা ও স্নেহের সাথে বললেন, দাড়ি কাটলে মদীনার নবী কষ্ট পায়। মদীনার নবীকে কষ্ট দিয়ে ইলম শিক্ষা করা যায় না। এমন কাজ আর করবে না। এভাবেই তার সংশোধন হয়ে গেল। তারপর থেকে সে আর দাড়ি কাটত না।

চার.

আমরা আবু দাউদ শরীফ পড়েছি তাঁর কাছে। একবার আবু দাউদ শরীফের একটি হাদীস বুঝার জন্য তাঁর কাছে গেলাম। তিনি তখন শয়নের খাটে বসা ছিলেন। আমাকে বললেন, খাটে বস। আমি ইতস্তবোধ করলাম। তিনি বললেন, বেটা এটা হাদীসের সম্মান। বস। আমি বসলাম। তিনি হাদীস বুঝিয়ে দিলেন। এটা ছিল হাদীসের প্রতি তার ভালোবাসার একটি নিদর্শন।

তার জীবনী আলোচনা করতে গেলে অনেক দীর্ঘ সময়ের প্রয়োজন। এ সংক্ষিপ্ত পরিসরে আমি শুধু আদব-সম্মান সংক্রান্ত কয়েকটি ঘটনা উলে­খ করলাম। আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে তার মত আদবের অধিকারী হওয়ার তাওফীক দান করেন এবং তার কবরকে নূরে নূরান্বিত করে দেন। আমীন!

আগের সংবাদকরোনারোধে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের ৫ জরুরি নির্দেশনা
পরবর্তি সংবাদডব্লিউএইচও’কে আরও শক্তিশালী করার প্রস্তাবে বাধা যুক্তরাষ্ট্রের