এহতেশামুল হক:
হজরত মাওলানা আশরাফ আলী থানবি রহ. ছিলেন হাকিমুল উম্মত—উম্মতের চিকিৎসক। তার চিকিৎসার পেসক্রিপশন সহস্রাধিক পৃষ্ঠায় ‘তারবিয়াতুস সালেক’ নামে সংকলন ও সংরক্ষণ করা হয়েছে। তবে এগুলো ছিলো বিক্ষিপ্ত আকারে। পরে তারই প্রিয় খলিফা মাওলানা মুহাম্মদ ঈসা বিক্ষিপ্ত বিষয়গুলো গুছিয়ে সুলুকের একটি মৌলিক ও পাঠ্যবই রূপে উপস্থাপন করেন। থানবি রহ. সংকলকের নামানুসারে বইটির নাম রাখেন—আনফাসে ঈসা। তবে থানবি রহ. বলতেন, এটি চিকিৎসা শাস্ত্রের বইয়ের মতো। চিকিৎসকের কাছে চিকিৎসা না করিয়ে যদি চিকিৎসাশাস্ত্রের বই পড়ে চিকিৎসা করা হয়, তাহলে যেমন আরোগ্য লাভ অসম্ভব, তেমনি রূহানি চিকিৎসকের কাছে না গিয়ে শুধু সুলুকের বই পড়ে উপকৃত হওয়া অসম্ভব।
আত্মার রোগ নিয়ে থানবি রহ.-এর দাওয়াখানায় প্রতিদিন ভীড় জমতো রোগীর। বিনামূল্যে তিনি পেসক্রিপশন দিয়ে যেতেন। তিনি বলতেন, সুস্থ হতে হলে প্রথমেই লাগবে সাহস ও ইচ্ছাশক্তি। এটাই সব ধরনের আত্মশুদ্ধি এবং ইসলাহের মূল ভিত্তি। ইচ্ছে থাকলে সফলতা আসবে। তবে এই ইচ্ছের বাস্তবায়ন প্রথম প্রথম কঠিন লাগে। এই কাঠিন্যের চিকিৎসা হলো, কষ্ট সত্বেও ইচ্ছাশক্তি নিয়ে কাজ করে যাওয়া। ধীরে ধীরে কষ্ট সহনীয় হয়ে যাবে।
তার কাছে যারা আসতো, তারা ইচ্ছেশক্তি নিয়েই আসতো৷ কিংবা নিয়ে না এলেও তিনি আগে ইচ্ছেশক্তি তৈরী করতেন। তারপর বাতলে দিতেন ঔষধ। দুশ্চিন্তায় মুখ কালো করে কেউ তার কাছে আসতো। তিনি বলতেন, পরকালের শাস্তির ধ্যানই পৃথিবীর সমস্ত দুশ্চিন্তা থেকে মুক্তি দিতে পারে। এতে কষ্ট হয় না—ধ্যানমগ্নতার ফলে হৃদয় প্রশস্ত এবং নুরানি হয়। কারণ এই ধ্যানে আল্লাহ তায়ালার প্রতি অন্তরের মনোযোগ নিবদ্ধ হয়। সম্পর্ক তৈরী হয়। আল্লাহর সঙ্গে সম্পর্ক মানুষকে সব দুশ্চিন্তা থেকে মুক্তি দেয়।
তার দাওয়াখানায় কেউ আসতো কুদৃষ্টির রোগ নিয়ে৷ তিনি বলতেন, কুদৃষ্টির প্রথম ধাপ—ঝোঁক। এটা বান্দার ইচ্ছাবহির্ভূত বিষয়। এর পরের ধাপ—ঝোঁককে কাজে পরিণত করা। এটা ইচ্ছাকৃত বিষয়। এর জন্য জবাবদিহিও করতে হবে। কুদৃষ্টির চিকিৎসা হলো, নফসকে বাধা দেয়া এবং দৃষ্টি অবনত রাখা। এটা সাধ্যের কাজ; সাহস করে শুরু করলেই হলো। এতে নফস কিছুটা কষ্ট পাবে, পাক। জাহান্নাম থেকে বেশি কষ্ট পাবে না। কিছুদিন এই পেসক্রিপশন মেনে চললে ঝৌঁকও দূর হয়ে যাবে৷
গিবতের চিকিৎসায় তিনি বলতেন, যার ব্যাপারে গিবত করবে, তাকে বলে দিবে। কিছুদিন এভাবে করলে ইনশাআল্লাহ এই রোগ নির্মূল হয়ে যাবে। তবে ক্ষমা চাওয়ার সময় গিবতের পূর্ণ বিবরণ দেয়ার দরকার নাই। এতে সে কষ্ট পেতে পারে। তাই এতটুকু বললেই হবে, ভাই, আমার শোনা ভুলগুলো মাফ করে দিও। পাশাপাশি যাদের কাছে গিবত করেছে, তার কাছে গিয়ে প্রশংসা করবে। যার গিবত করা হয়েছে, সে মারা গেলে তার জন্য দোয়া ও ইসতেগফার করবে।এতটা দোয়া করবে, যেন তোমার মনে হয় সে তোমাকে ক্ষমা করে দিয়েছে।
কেউ অহংকারের রোগ নিয়ে এলে থানবি রহ. বলতেন, এর চিকিৎসা হলো সবসময় নিজের দোষত্রুটির কথা চিন্তা করা। অন্যদের যে দোষগুলো জানি, সেগুলো আমার ধারণাপ্রসূত। অহংকারের বাস্তব চিকিৎসা হলো, যাকে তুচ্ছ মনে জয়, তাকেও সম্মান দেখাবে। অভিজ্ঞতা দ্বারা প্রমাণিত, এই চিকিৎসা ছাড়া অহংকার দূর হয় না।
ক্রোধের চিকিৎসায় তিনি বলতেন, ক্রোধের সময় ভাববে, আমিও আল্লাহ তায়ালার নিকট অপরাধী। তিনিও যদি আমার উপর রাগান্বিত হন, আমি কোথায় যাব। তাকে ক্ষমা করে দিলে আল্লাহ আমাকেও ক্ষমা করে দিবেন। ক্রোধের সময় অন্য কাজে লিপ্ত হয়ে যাবে। বিশেষ করে কিতাব মুতালাআ করা যেতে পারে। আউজুবিল্লাহ পড়বে। পানি পান করবে। ওজু করবে।
মিথ্যা বলার চিকিৎসায় তিনি বলতেন, এর বাস্তব চিকিৎসা হলো, যার সঙ্গেই কথা বলবে, তাকে আগে বলে নিবে, ভাই, আমার মিথ্যা বলার অভ্যাস আছে। কিছুদিন এমন করলে ইনশাআল্লাহ, বদভ্যাস দূর হয়ে যাবে। অপব্যায় থেকে বাঁচতে তিনি বলতেন, আল্লাহওয়ালাদের মতো চলো। রুসুম-রেওয়াজের পেছনে পড়বে না। একান্ত প্রয়োজন ছাড়া ঋণ নিবে না, যদিও রুসুম রেওয়াজের বিপরীত কাজ করতে হয়।
এভাবে দরদমাখা কথা বলে রোগীদের চিকিৎসা করতেন আশরাফ আলী থানবি রহ.। আত্মিক সুস্থতা বজায় রাখতে থানবি রহ. পাঁচটি টোটকা দিয়েছেন। টোটকা পাঁচটি উল্লেখ করেই লেখাটা শেষ করছি। এক—রাসূল সা.-এর মহব্বত সফলতার মাপকাঠি। দুই—নিজের নফসের প্রতি সবসময় খেয়াল রাখবে এবং তার চিকিৎসা করাতে থাকবে। তিন—আমলের উপর অটল ও অবিচল থাকবে। এটা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। চার—ফলাফলের জন্য অস্থির হবে না। পাঁচ—বাদ আখলাকের চাহিদা অনুযায়ী না চলা।