থানবির রাজনৈতিক ফিকহ

খালিদ মুহাম্মাদ সাইফুল্লাহ:

ভূমিকা

আশরাফ আলী থানবি রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ছিলেন না। রাষ্ট্রনীতি তাঁর শাস্ত্রীয় বিষয়ও না। এজন্য নিরেট রাজনীতি সংক্রান্ত কোন রচনা থানবি থেকে পাওয়া যায় না। (১) তবে খানকাতে মুরিদদের দিকনির্দেশনা, প্রশ্ন ও চিঠিপত্রের জবাব হত বিবিধ বিষয়ে। তাসাউফ, বিবাহ-তালাক, উত্তরাধিকার, পারষ্পরিক সম্পর্ক, অর্থনৈতিক লেনদেন সহ সমকালীন রাজনৈতিক বিতর্কও বাদ পরেনি আলাপ থেকে। তাছাড়া অন্যান্য বিধি-বিধানের মত রাষ্ট্রের সঙ্গেও যেহেতু ধর্মের বিশেষ সম্পৃক্ততা রয়েছে, ফলে বিক্ষিপ্ত হলেও, থানবির রচনাবলী ও ওয়াজ-নসিহতে রাষ্ট্র ও রাজনীতি নিয়ে সংক্ষিপ্ত অথচ সামগ্রিক কিছু আলাপ হাজির হয়েছে। সেসব আলাপের ভিত্তিতে থানবির রাজনৈতিক ফিকহ নির্মাণের প্রয়াস চালাবো বিদ্যমান প্রবন্ধে।

শব্দগুচ্ছ

সেকুলারিজম, রাজনৈতিক ইসলাম, রাজনৈতিক ব্যাখ্যা, ওসিলা, দেওবন্দি, ইকামতে দ্বীন, খেলাফত ও হাকিমিয়াত, জাতীয় চেতনা, রাজতন্ত্র, পোপতন্ত্র, ব্যক্তিস্বাধীনতা, আমলাতন্ত্র, আহলুল হাল্লি ওয়াল আকদ, খুরুজ, দেশভাগ।

ইসলাম ও রাষ্ট্রের সম্পর্ক : থানবির পর্যবেক্ষণ

মোটাদাগে থানবির রাষ্ট্রচিন্তা সেকুলারিজম বিরোধী। ধর্মনিরপেক্ষ চিন্তার মোকাবেলায় তিনি রাজনীতিকে ইসলামিকরণের প্রস্তাব দিয়েছেন বটে, ইসলামের রাজনৈতিক ব্যাখ্যা হাজির করেননি; এখানেই থানবির বিশিষ্টতা, যা থানবি-চিন্তাকে রাজনৈতিক ইসলাম থেকে পৃথক করে রেখেছে। ইসলামের রাজনৈতিক ব্যাখ্যায় (ওসিলা) মাধ্যমকে বানানো হয় প্রধান উদ্দেশ্য, আর প্রধান উদ্দেশ্য তার মর্ম ও তাৎপর্য হারিয়ে ফেলে। এই ব্যাখ্যা-পদ্ধতি মুসলিম সমাজের সামাজিক ও ধর্মীয় চিন্তায় বিশেষ বিশেষ পরিবর্তন এনে দিয়েছে গত শতকে। ফলে মওদুদি পরবর্তী চিন্তার ইতিহাসে ‘রাজনৈতিক ইসলাম’ বিশেষ সচেতনতার সাথে আলোচিত ও সমালোচিত হয়েছে, দেওবন্দি এবং অ-দেওবন্দি উভয় সিলসিলায়। মনজুর নোমানীর ‘মাওলানা মওদুদি কে সাথ মেরি রেফাকাত কি সারগুযাশত’, মাওলানা মওদুদির ‘কুরআন কি চার বুনিয়াদি ইসতেলাহ’ কেতাবের খণ্ডনে আলি নদভীর লেখা ‘আত তাফসিরুস সিয়াসি লিল ইসলাম’ (ইসলামের রাজনৈতিক ব্যাখ্যা) এবং শামসুল হক ফরিদপুরীর ‘ভুল সংশোধন’ এ ধারার গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন। রাজনৈতিক ব্যাখ্যার প্রতি অনাস্থা থাকলেও ইখওয়ানুল মুসলিমিন নিয়ে নদভীর আশাবাদ ছিল গভীর। ইখওয়ানকে মুসলিম রাজনৈতিক ইতিহাসের সবচে সফল সংগঠন হিসেবে বিবেচনা করতেন। মোটাদাগের কয়েকটি প্রসঙ্গ বাদে নদভী মুলত ইখওয়ান ও জামায়াতের চেতনার সমর্থক ছিলেন।

দ্বিতীয়ত, থানবির রাজনৈতিক ফিকহ নিয়ে বিচার-বিশ্লেষণের পর তকী উসমানী বলেন, ব্যবসা-বাণিজ্যের মতো রাজনীতি ইসলামের একটা অংশ মাত্র। এর বহু বিধি-বিধানের সাথে ধর্মের সম্পর্ক রয়েছে। ব্যবসা-বাণিজ্য এবং হালাল উপার্জনের জরুরত ও তাৎপর্য নিয়ে কুরআন-হাদিসে বিবৃতি এসেছে বটে, কিন্তু ইসলামে এটি প্রধান এবং মৌলিক উদ্দেশ্য না।

আশরাফ আলী থানবি মনে করতেন, সেকুলারিজমের সাথে সাথে রাজনীতিকে ইসলামের প্রধান লক্ষ্য বানানোর প্রয়াসও সমান দোষে দুষ্ট। আদতে আল্লাহর সঙ্গে সম্পর্ক (তাআল্লুক) হচ্ছে ইসলামের প্রধানতম বুনিয়াদি লক্ষ্য ; এর প্রকাশ ঘটে ইবাদত ও আনুগত্যের ভেতর দিয়ে। আর ক্ষমতা ও রাজনৈতিক শক্তিমত্তা আল্লাহর সঙ্গে সম্পর্ক নির্মাণে ভূমিকা রাখবে। ফলে ইসলামে রাজনীতি নিরেট উদ্দেশ্য তো নয়ই, (ইকামতে দ্বীন) দ্বীন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রেও রাজনৈতিক সক্ষমতা একক ভূমিকা রাখে না। রাজনীতি ইসলামি উদ্দেশ্য অর্জনের একটি সহায়ক মাধ্যম মাত্র। এজন্য সহায়ক ও প্রতিশ্রুতিশীল রাষ্ট্র কিংবা রাজনীতিই ইসলামের কাম্য। যে রাজনীতি ইসলামের মৌলিক উদ্দেশ্যে ব্যাঘাত ঘটায়, ‘ইসলামি’ বিশেষণ থাকলেও সে রাজনীতি ইসলামসম্মত হয়ে উঠতে পারে না। (২)

বিংশ শতকে উপনিবেশ থেকে মুক্তি সংগ্রামের সিলসিলায়, রাজনৈতিক স্বাতন্ত্র্যের দাবিতে ‘খেলাফত’ এবং ‘হাকিমিয়াত’ কেন্দ্রীক ব্যাখ্যা-পদ্ধতি বিশেষ ভূমিকা রেখেছে। তবে ক্ষেত্রবিশেষে এ ধারার ব্যাখ্যা ও অনুশীলনে রাজনীতি হাজির হয়েছে ইসলামের মৌলিক লক্ষ্য ও প্রেরণা হিসেবে। এ ব্যাপারে থানবি-চিন্তার উত্তরসূরিদের মধ্যে বিশেষ সচেতনতা লক্ষণীয়। কিন্তু মৌলিক লক্ষ্য হিসেবে না হলেও ইসলামের রাজনৈতিক প্রেরণার প্রতি থানবি যথেষ্ট শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। (৩) ৪৭’ এর সক্রিয়তা থানবির রাজনৈতিক সচেতনতার স্বাক্ষর বহন করে। তিনি উপনিবেশের ছায়াতলে পূর্ণ-বিকশিত একটি হিন্দুত্ববাদী জাতীয় চেতনার সামনে মুসলিম স্বাতন্ত্র্যবোধকে ম্লান হতে দেননি।

গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা এবং থানবি

পোপতন্ত্র এবং সামন্তবাদের খোলস ছেড়ে ইউরোপ প্রবেশ করেছে গণতান্ত্রিক কাঠামোতে; সংখ্যাধিক্য-ই এখানে সত্যের মাপকাঠি। আমজনতার বিবেচনাহীন-মতামত তৃতীয় বিশ্বের রাজনীতিকে অস্থিতিশীল করেছে, পশ্চিম হাজির হয়েছে আরও বেশি কর্তৃত্ববাদী হিসেবে। সত্তর বছরে কমিউনিজমের নামে সোভিয়েত যে হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জুলুম তারচে অনেক বেশি নির্মম। এ ব্যাপারে নোয়াম চমস্কির গুরুত্বপূর্ণ কিছু আলাপ আছে।(৪) কিন্তু গণতন্ত্র দীর্ঘসময়ের উপনিবেশিক শাসন ও আধিপত্যের প্রভাবে হাজির হয়েছে শুরা-ব্যবস্থার বিকল্প হিসেবে, ‘ইসলামি গণতন্ত্র’ নামে চালু হয়েছে চর্চা ও অনুশীলন। আশরাফ আলী থানবি মুসলিম বিশ্বের রাজনৈতিক বাস্তবতাকে সামনে রেখে প্রশ্ন তুলেছেন, ‘সত্য ও উপযোগিতা নির্ণয়ে সংখ্যাধিক্য’ বিশেষ বিবেচনায় যথার্থ, তবে এ সংখ্যাধিক্য কি আম-জনতার? থানবি মনে করেন, স্বাভাবিকভাবে সংখ্যাধিক্যের মতামত স্থুল হয়, গভীরতা থাকে না। কারণ, পৃথিবীতে সচেতন লোকের তুলনায় অবিবেচকের সংখ্যা বেশি। তাই ইসলাম সংখ্যাধিক্যের সঙ্গে বিশেষজ্ঞতার শর্ত জুড়ে দিয়েছে, যা শুরা-ব্যবস্থাকে ‘গণতন্ত্র’ থেকে পৃথক অবস্থানে নিয়েছে। (৫) গণতন্ত্রের এই মৌলিক ত্রুটি নিয়ে পশ্চিমা তাত্ত্বিকরাও কলম ধরেছেন। বিশেষত, ‘the Substance of politics’ গ্রন্থে এডমন্ড বুরক (Burke) কিছু গুরুত্বপূর্ণ নোক্তা দিয়েছেন। তিনি বলেন, সংখ্যাধিক্যের মতামতকে আইনি মর্যাদা দেওয়ার মধ্যে গলতির পাশাপাশি উপযোগিতা ও পলিসিগত সংকটও প্রবল। (৬)

দ্বিতীয়ত, থানবির মতে গণতন্ত্রও দিনশেষে গণতান্ত্রিক থাকে না। ব্যক্তিতন্ত্রে রুপ নেয়। কেননা ব্যক্তিতন্ত্রের মৌলিক ও রুপক দু’ধরনের প্রকাশ রয়েছে দর্শনে ; রুপক ও চুড়ান্ত অর্থে সামষ্টিক সমাজও ব্যক্তিতন্ত্রের যৌথ প্রকাশ। সংসদে সংখ্যাধিক্যের মতামতের ভিত্তিতে যে আইন রচিত হয়, তা মুলত ব্যক্তির-ই অভিব্যক্তি। (৭) রাজতন্ত্রের বিপরীতে ডেমোক্রেসির সবচে সফল ও মুখরোচক বয়ান হচ্ছে ব্যক্তিস্বাধীনতা এবং ব্যক্তিস্বাতন্ত্র। থানবি বলেন, গণতান্ত্রিক কাঠামোতেও ব্যক্তি পূর্ণ মাত্রায় স্বাধীন না। প্রেসিডেন্ট কিংবা পার্লামেন্টের অধীনতা থেকে কেউ মুক্ত থাকে না। রাজতন্ত্রে একক কর্তৃত্ব থাকে, আমজনতা একজন রাজার অধীনতা মেনে নেয়, কিন্তু গণতন্ত্রে গোটা জাতিকে শতাধিক ব্যক্তির অধীনে ঠেলে দেওয়া হয়। আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে রাজনৈতিক দল এবং আমলাতন্ত্রের অরাজকতা, দুর্নীতি ও অপশাসন জনতাকে চরম মাত্রায় পরাধীন করে রেখেছে। যেসব সমস্যা ও সংকট এড়ানোর তাগিদে রাজতন্ত্র উচ্ছেদের যাত্রা শুরু হয়েছিল, গণতন্ত্র সেসব সমস্যাকে আরও গভীর ও তীব্রতর করেছে। এ ধরনের গণতান্ত্রিক কাঠামো ইসলামের লক্ষ্য না।

থানবির মতে, ইসলামের শাসন প্রক্রিয়া যৌথ নয়, বরং ব্যক্তিতান্ত্রিক। তবে এই ব্যক্তিতন্ত্র বেশকিছু জরুরি শর্ত মোতাবেক পরিচালিত হবে। প্রথমত, রাজতন্ত্রের মতো বংশানুক্রমিক নির্বাচন ইসলামে স্বীকৃত না। খলিফা বা আমীরুল মু’মিনীন পিতৃতান্ত্রিক পরিচয়ে নয়, বরং ‘আহলুল হাল্লি ওয়াল আকদ’ তথা : সৎ, বিচক্ষণ এবং রাজনৈতিক প্রজ্ঞার অধিকারী একদল লোকের (মশওয়ারা) পরামর্শের ভিত্তিতে গঠিত হবে। ফলে আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের সঙ্গেও সুস্পষ্ট তফাত লক্ষ্যণীয়, ইসলামি নির্বাচন পদ্ধতিতে নির্বিচারে সবার মতামত গৃহীত হয় না। দ্বিতীয়ত, ব্যক্তিতান্ত্রিক শাসন হলেও ইসলামি ফিকহে খলিফার জন্য কিছু জরুরি বৈশিষ্ট্য ও গুণাবলী নির্ধারিত রয়েছে। সেসব গুণাবলী নিশ্চিত হওয়া নেতৃত্বের বুনিয়াদি শর্ত। তৃতীয়ত, ব্যক্তিতান্ত্রিক শাসন হলেও ইসলামে ব্যক্তি হিসেবে নেতা বা খলিফা পূর্ণ স্বাধীন না। ঐশী আইনের সীমারেখা ও নীতিমালার শক্ত-বন্ধনে সংযত হতে হয় শাসককে।(৮) ন্যায়নিষ্ঠ, সংযত ও প্রজ্ঞাপূর্ণ ব্যক্তিতান্ত্রিক শাসনের উপযোগিতা নিয়ে রুশো তার the social contact বইয়ে আলোচনা করেছেন। (৯) সুতরাং, গণতন্ত্রের বিপরীতে ব্যক্তিতান্ত্রিক শাসন নেতিবাচক তো নয়ই, বিশেষ শর্তানুযায়ী তা উপযোগী।

রাষ্ট্রের সাথে আলেম সমাজের সম্পর্ক : থানবির অবস্থান

মুসলিম সালতানাতের ন্যায়নিষ্ঠ কিংবা জালেম-পাপাচারী শাসকের সঙ্গে আলেম সমাজের সম্পর্কের ব্যাপারটা তেমন ধোয়াশাচ্ছন্ন না থাকলেও, আধুনিক সেকুলার গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে এ প্রশ্নটি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। রাজনৈতিক ইসলামের প্রভাবে এ প্রসঙ্গে যুক্ত হয়েছে নতুন নতুন মাত্রা। উপনিবেশিক অস্থিরতার ভেতরে বসে আশরাফ আলী থানবি মুসলিম ঐতিহ্যে নজর দিয়েছেন, নির্মাণ করেছেন রাষ্ট্র ও আলেম সমাজের সম্পর্কের বুনিয়াদ। থানবি এবং থানবি-চিন্তার উত্তরসূরিদের সক্রিয়তা থেকে অনুমিত হয়, সেকুলার গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের শাসককে -সুস্পষ্ট কুফর প্রকাশিত হবার পূর্ব পর্যন্ত- সর্বোচ্চ (ফাসেক) পাপাচারী বলা যায়, কাফের না। থানবির রাজনৈতিক ফিকহে নসিহত তথা : ধর্মীয় দিকনির্দেশনা-ই রাষ্ট্র সংস্কারের অন্যতম হাতিয়ার। থানবির রচিত ‘আনফাসে ঈসা’ এবং মাজালিসে হাকিমুল উম্মতের বিভিন্ন স্থানে এসব নির্দেশনা এসেছে। এছাড়া ‘সৎ কাজের আদেশ অসৎ কাজ থেকে ফিরানো’কে রাষ্ট্র সংস্কারের জরুরি অনুষঙ্গ ভাবতেন থানবি। তিনি বলেন, প্রকাশ্যে মুসলিম শাসককে অবমাননার দ্বারা জনসমাজে বিশৃঙ্খলা তৈরি হতে পারে। বাহ্যত শাসকের সন্মান বজায় রাখা উচিত। (১০) প্রয়োজনে নিরব ও নির্লিপ্তে শাসককে সদুপদেশ দিতে হবে।

শাসক যদি ইসলাম বিরোধী সিদ্ধান্ত নেয়, কুফরকে বাস্তবায়ন করে, তবুও অবমাননা করা যাবে না? কিংবা বিদ্রোহাত্মক ভুমিকা পালন করবে না ওলামা-সমাজ ? এ ব্যাপারে আশরাফ আলী থানবির নির্দেশনা থেকে দু’ধরনের কর্মপন্থা পাওয়া যায়– প্রথমত, একটা সচেতন নৈতিক সমাজ তৈরি করতে হবে। তারা নিজেদের জন্য যোগ্য নেতৃত্ব নির্বাচন করে নেবে। এবং শরিয়া বিরোধী আইন, ব্যবস্থাপনা এবং সিদ্ধান্তকে কার্যত প্রত্যাখ্যান করবে। এভাবে তৃণমূল থেকে আলেমসমাজ বৈপ্লবিক ভূমিকা রাখবে। দ্বিতীয়ত, রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ (খুরুজ) বিদ্রোহ। থানবি বলেন, উপযুক্ত শর্ত এবং জরুরতের ভিত্তিতে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা যাবে।

রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ (খুরুজ) নিয়ে হাকিমুল উম্মতের একটি গুরুত্বপূর্ণ রিসালা আছে। এমদাদুল ফতোয়ার পঞ্চম খণ্ডে ‘জাযলুল কালাম ফি আযলিল ইমাম’ নামে প্রকাশিত হয়েছে। হাদিস এবং ফকিহদের বরাতে বিদ্রোহ বিষয়ে জরুরি আলাপ তুলে ধরেছেন থানবি। এখানে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ নোক্তা উল্লেখ করছি —প্রথমত, পাপাচার যদি শাসকের ব্যক্তিপরিসরে সীমাবদ্ধ থাকে, যেমন শাসক মদাসক্ত, তাহলে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির সম্ভাবনা না থাকলে তাকে বরখাস্ত করতে হবে। নতুবা ধৈর্য ধরতে হবে। দ্বিতীয়ত —পাপ ও জুলুমের প্রভাব যদি অন্যকে ক্ষতিগ্রস্ত করে, এবং তাতে যদি বৈধতার সম্ভাবনা থাকে, যেমন রাষ্ট্রীয় কল্যাণের নামে ট্যাক্স আদায়, এ সুরতে বিদ্রোহ বৈধ নয়। কিন্তু যদি তা অবৈধ হয়, তাহলে সুযোগ মত, জিহাদ করে হলেও নিজের থেকে জুলুম প্রতিহত করতে হবে। তবে সবর করতে পারলে কল্যাণ বেশি। তৃতীয়ত —শাসক যদি জনগণকে পাপাচারে বাধ্য করে, কুফর বা দ্বীনকে তুচ্ছ ভেবে না বরং প্রবৃত্তির প্ররোচনায়, তাহলে খুরুজ করা যাবে না। (ইকরাহ) পাপে বাধ্যকরণের বিধান আরোপিত হবে। কিন্তু যদি কুফর বা দ্বীনকে তাচ্ছিল্য করে মানুষকে পাপাচারে বাধ্য করে, তাহলে এটি স্পষ্ট কুফুরি। শক্তি-সামর্থ্য থাকলে এ ধরনের শাসককে বরখাস্ত করা ওয়াজিব। (১১) সংক্ষিপ্তভাবে তুলে ধরলাম। থানবির খুরুজ সংক্রান্ত আলোচনা বিস্তারিত পাবেন জাযলুল কালামে।

রাষ্ট্রে আলেম সমাজের ভূমিকা নিয়ে অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত অথচ জরুরি একটা নোক্তা থানবি দিয়েছেন তার এসলাহুল মুসলিমিন কেতাবে। তিনি বলেন, “রাসুল সা. এর মধ্যে দু’ধরনের প্রকাশ ছিল —নবুওয়তি এবং রাজনৈতিক। পরবর্তী খলিফাদের মধ্যেও এদু’টির যথাযথ সম্মিলন দেখা গেছে। কিন্তু বর্তমানে এ দুটি গুণের মেরুকরণ ঘটেছে। নববী গুণাবলীর প্রকাশ ঘটেছে আলেমদের মধ্যে। আর নেতৃত্বের চরিত্র যাহির হয়েছে মুসলিম শাসকদের মধ্যে। এজন্য রাষ্ট্র ও আলেমদের পারষ্পরিক সম্পর্ক এবং নৈকট্য ব্যতিত রাসূলের সা. আদর্শের পূর্ণাঙ্গ উপস্থিতি সম্ভব না। (১২)

দেশভাগ এবং থানবি-চিন্তার উপযোগিতা

দেশভাগে থানবির অবস্থানকে জাতিরাষ্ট্র কিংবা সাম্প্রদায়িক সিদ্ধান্ত হিসেবে দেখা এবং দেখানোর বিচিত্র সংকট আছে। মাদানীর উম্মাহ চেতনাকে সেকুলারিজমের সমীকরণে বিচার-বিবেচনা যেমন সরলতা, তেমনি পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আন্দোলনকে সাম্প্রদায়িকতা দিয়ে বোঝা যায় না। এ প্রসঙ্গে মুহাম্মদ কাসিম জামানের ক্রিটিক গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বলেন, This was also the view of Madani and the “nationalist”‘ulama.They did not deny that Muslims comprised a community distinct from the Hindus. But they posited a distinction between a religious community (the umma or milla), which comprised Muslims worldwide, and a nation (qawm), which was defined by territorial boundaries. Muslims of India were part of a universal umma but that scarcely precluded their full membership in the Indian nation.The position of the nationalist ‘ulama allowed them to enter into an alliance with the Congress, in joint opposition to the colonial regime and to Muslim communalism.Yet there were important ambiguities in this alliance, both on the side of the nationalist ‘ulama and on that of the Congress. (১৩)

আগেই ঈঙ্গিত দিয়েছি, উপনিবেশের ছায়াতলে পূর্ণ-বিকশিত একটি হিন্দুত্ববাদী জাতীয় চেতনা মুসলিম স্বাতন্ত্র্যবোধকে উসকে দিয়েছিল। স্বাতন্ত্র্যবোধের সঙ্গে জড়িয়ে ছিল উপমহাদেশে মুসলমানদের স্বার্থক অস্তিত্ব। কেননা হিন্দু প্রতিবেশীর কাছ থেকে ‘মুসলিম এলাকা’ হিসেবে চিহ্নিত সীমানা নির্ধারণের কাজটা ১৯৪৭ সালের আগ থেকেই চলে আসছিল এবং দেশবিভাগের পর তা আরও জোরদার হয়। এই উভয় কাজের যৌথ ফল হিসেবে দাঁড়ায় মুসলিমদেরকে একটা পৃথক, ঘনবসতিপূর্ণ গুচ্ছ এলাকা বা নির্দিষ্ট অঞ্চলে বসবাসের জন্য ঠেলে দেওয়া। (১৪)

দীর্ঘ মুসলিম শাসনে, নিজস্ব ধর্মীয়বোধ অটুট রেখে সহবস্থানের যে নজির তৈরি হয়েছিল, তা বিধ্বস্ত করার পেছনে নিছক হিন্দু সমাজ না, বরং মূখ্য ভূমিকা রেখেছিল উপনিবেশিক শাসন। তাদের শাসনেই হিন্দু সমাজে জাতীয় চেতনা বিকশিত হয়েছিল, গঠিত হয়েছিল জাতীয় আন্দোলন। হিন্দুদের এই জাতীয় চেতনা এবং হিন্দু-মুসলমানের ধর্মীয় ও সামাজিক ব্যবধানকে রাজনৈতিক বিরোধে পরিনত করেছে মুলত ইংরেজরা। (১৫) ফলে অত্যন্ত সচেতনভাবে থানবি দেখলেন, বিকশিত হিন্দুত্ববাদী চেতনার সামনে সহাবস্থানের প্রস্তাব দিনশেষে নিষ্ফল থেকে যাবে। ফলে দেশভাগের অন্তত দেড় যুগ আগেই থানবি মুসলিম জাতির কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের জরুরত অনুভব করেছিলেন। (১৬)

মোদ্দাকথা হচ্ছে, থানবি রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব না হলেও তার চিন্তাকে অল্প শব্দে ধারণ করা যাবে না। আধুনিক সেকুলার গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে থানবির চিন্তা ঘুরেফিরে আলোচিত হবে। অন্য অনেকের মত, থানবির রাজনৈতিক চিন্তাকে ‘রাজনৈতিক ইসলাম’ কিংবা প্রচলিত ‘ইসলামি রাজনীতি’ শিরোনামে পর্যালোচনার দায় অনুভব করিনি। থানবি বরং স্বতন্ত্র। কখনও কোথাও ইসলামি রাষ্ট্র ও রাজনীতির পূর্ণাঙ্গ খসড়া নির্মাণের দাবি কিংবা ওয়াদা থানবি করেননি। সুতরাং, থানবি জোরালো কিন্তু পূর্ণাঙ্গ না।

তথ্যসূত্র

১. তকি উসমানি, হাকিমুল উম্মত কে সিয়াসি আফকার, ৫১পৃ.
২. প্রাগুক্ত, ৫৮ পৃ. আশরাফুল জাওয়াব কেতাবের ৪৫৫ পৃষ্ঠায় থানবি বলেন, নিছক রাষ্ট্র ও নেতৃত্ব যদি উদ্দেশ্য হত, তাহলে ফেরাউন-নমরুদ প্রশংসিত হতো। কেবল তাআল্লুক এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি ছিল না জন্যে তারা প্রত্যাখাত।
৩. থানবি, আশরাফুস সাওয়ানেহ, ৪ খন্ড ২৮ পৃ.
৪. ভাবনার আগল ভাঙ্গো, নোয়াম চমস্কির সাক্ষাৎকার গ্রন্থ, ৪৭ পৃ.
৫. আশরাফ আলী থানবি, মাআরেফে হাকিমুল উম্মত, ২১৭ পৃ. , তাকলিলুল ইখতিলাত মাআল আনাম, ১৪ পৃ.
৬. The Substance of politics, Oxford University Press 9th edition. 1961 p. 133
৭. থানবি, তাকলিলুল ইখতিলাত মাআল আনাম, পৃ. ৩৫
৮. তকি উসমানি, হাকিমুল উম্মত কি সিয়াসি আফকার, পৃ. ৬৮
৯. Russian, the social contact, p. 127
১০. থানবি, আনফাসে ঈসা, ১ খন্ড ৩৭৫ পৃ.
১১. থানবি, এমদাদুল ফাতাওয়া, ৫ খন্ড ১২০ পৃ.
১২. Muhammad qasim zaman, Makers of the Muslim world : Ashraf Ali Thanwi, p. 46
১৩ . থানবি, ইসলাহুল মুসলিমিন, পৃ. ৫৩৬
১৪ . জয়া চ্যাটার্জি, দেশভাগের অর্জন : বাঙলা ও ভারত ১৯৪৭-১৯৬৭, পৃ. ২০০
১৫ . বদরুদ্দিন ওমর, সাম্প্রদায়িকতা, ১২ পৃ.
১৬. কাসিম জামান তার Makers of the Muslim world… গ্রন্থে লিখেছেন, “In the early 1930s,Thanawi had already spoken of the need for a Muslim “center” (markaz) through which Indian Muslim interests might be protected… p. 49

 

আগের সংবাদহোসনি দালানে বোমা হামলা মামলায় রায় ১৫ মার্চ
পরবর্তি সংবাদমাওলানা থানবির লেখালেখি