থানবি: ইসলামের উপমহাদেশীয় ব্যাখ্যাতা

মুহিব্বুল্লাহ বিন বাশার:

ইসলাম জীবন ও মানুষের ধর্ম! মানুষকে ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন করতে যা লাগে ইসলাম সেসবের সমাহার ৷ জীবন কখনো একমুখো নয়, আঁকাবাঁকা বিভিন্নমুখী ৷ মানুষের মন মেজাজের রকমফের আছে, তাই আল্লাহ প্রেরিত একমাত্র মনোনীত ইসলাম সকল জাতিসত্তার বাউন্ডারির উর্ধ্বে, মহান ও বিস্তর ৷ ইসলাম কখনো কোনো জাতির সাথে মিশে যায়, একাকার হয়ে যায়, খুব আপন করে ফেলে ৷ ভূখণ্ডের মাটির সাথে মিলে গড়ে ওঠে মুসলিম জাতিসত্তা! তাই দেখা যায় বিভিন্ন জাতির কাছে নান্দনিক রূপ নিয়ে হাজির হয়েছে ইসলাম৷ যার একেকটি রূপ অন্যটির জন্য প্রতিবন্ধক নয় বরং পরিপূরক ৷ কেউ একটি নিদর্শনকে আকড়ে ধরে আছে কেউ অন্যটিকে ৷ এভাবে পৃথিবীর পথ হেঁটে হেঁটে ইসলাম ছড়িয়েছে নানা রূপে নানা রঙে ৷ তাই কালো রঙের মানুষ নির্দ্বিধায় বলতে পারে ইসলাম আমার ধর্ম৷ অপর দিকে সাদা মানুষেরও বিশেষ করে তফাত করে না এই ঐশী ধর্ম ৷ ইসলাম মানব ও মানবতার একমাত্র সুষ্ঠু জীবনব্যবস্থা ৷

প্রতিটি জাতিগোষ্ঠীর জন্য প্রয়োজন হয় একজন ধর্ম ব্যাখ্যাতার৷ যিনি, ধর্মকে নিজের জাতির কাছে আপন করে তুলে ধরেন, প্রাসঙ্গিক ও সমসাময়িক করে হাজির করেন৷ সেই থেকে সময়ে সময়ে বিভন্ন দেশভেদে তৈরি হয়েছে ধর্মীয় ছোট বড় জাতিগোষ্ঠী ৷ অবশ্য এই সূত্র ধরে অনেকে বেড়ে গেছেন ধর্মের সীমানাও, হারিয়ে ফেলেছেন হকের সিগনেচার— সেটা ভিন্ন কথা ৷ তবে ধর্ম ব্যাখ্যার আবেদন কখনো ফুরিয়ে যাওয়ার নয়৷ আর ইসলাম এই সরল বৈচিত্রের সমর্থন সবসময় করে আসছে।

ইতিহাসের নানান প্রেক্ষাপটে জন্ম নিয়েছেন সংস্কারক ও যুগের ধর্ম ব্যাখ্যাতাগণ। যারা ধর্মের সাথে সময় ও কালের সুক্ষ্ম সমন্বয় ঘটিয়েছেন ৷ এই উপমহাদেশে ইসলামের একাডেমিক চর্চা শুরু হয় ইলমের যৌবন ফুরিয়ে যাওয়ার পর৷ বলা যায় পৃথিবীতে যখন আর কোথাও ইলমের আনুষ্ঠানিক চর্চা প্রবলভাবে হচ্ছে না তখন ইসলাম চর্চার এই দায়িত্ব কাধে নেন এদেশের কিছু বিজ্ঞজন ৷ সেই থেকে একাডেমিক ধর্ম চর্চার হাতেখড়ি শুরু হয় এই উপমহাদেশে ৷ তার থেকে জন্ম নেয় ইসলামের এদেশীয় রূপ ৷ আর এই রূপদানের মহৎ দায়িত্ব যিনি পালন করেছেন তিনিই হলেন মাওলানা আশরাফ আলী থানবি৷ উপমহাদেশের ইসলামের প্রধান শক্তিশালী ব্যাখ্যাতা ৷ তিনি তার লেখালেখি ও বয়ান বক্তৃতায় দিয়েছেন ইসলামের সবক ৷ সমাজের প্রতিটি শ্রেণী পেশার মানুষকে নিয়ে তিনি ভেবেছেন ৷ ইসলামমতে সমাধান দিয়েছেন জীবনের নানা অধ্যায়ের ৷ দেশ জাতি ও জনসাধারণের হৃদয়ের উত্তাপ ও দুঃখ, বেদনা তিনি সমানভাবে ধারণ করেছেন ৷ সেজন্য ইতিহাসের মোড়গুলোতে নিনি অবস্থান নিয়েছেন খুবই সাবধানতার সাথে বিচক্ষণ অনুসরণীয় নেতা হিসাবে ৷ তাই ইসলাম ও জনতার কল্যাণে এমন কোনো পদক্ষেপ তিনি বাদ রাখেননি যেটা তার কাছে উপযোগী মনে হয়েছে৷ পীর-মুরিদি, দরস-তাদরিস, ওয়াজ-নসিহত মাহফিল-মজলিসসহ সব কিছুর মূলে ছিল তার ধর্মের প্রসার ও দেশীয় ব্যাখ্যা দান৷

এই কাজে প্রয়োজনের তাগিদে আমীর-উমারা ও শাসকশ্রেণীর কাছেও পৌছে গেছেন তিনি ৷ তাবলিগ, তাসনিফ, তাদরিস, তাহরিক ও তাসাউফের তরবিয়ত দিয়ে গড়ে তুলেছেন অনেকগুলো জাতির ভবিষ্যৎ প্রজন্ম ৷ তার আপ্রাণ চেষ্টা মেহনতে ইসলাম জাগরিত হয়েছে এই উপমহাদেশে ৷ তিনি যখন অনুভব করেছন, আরেফিন, সালেকিনদের পরবর্তী প্রজন্ম নিয়ে, উপহার দিয়েছেন ‘তারবিয়াতুস সালিক’ নামের অমীয় বাণী ৷ প্রথা কুসংস্কাকের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে রচনা করেছেন ‘ইসলাহুর রুসুম’ ৷ সাধারণকে দীনের শিক্ষা দিতে লিখেছন ‘তালিমুদ্দীন’ ও ‘হায়াতে মুসলিমীন’ ৷ খতিবদের জন্য তার অমূল্য তোহফা ‘খুতবাতুল আহকাম’এর সাথে তুলনীয় আর কোনো রচনা এখানে হয়নি ৷ সর্বসাধারণ, বিশেষত মা বোনদের জন্য যাপিত জীবনের সব রকম পরিস্থিতর সমাধান নিয়ে হাজির হয়েছে ‘বেহেশতি জেওর’৷ যার আবেদন শত বছর পরেও বেড়েছে বৈ কমেনি ৷ এই একটি বই উপমাদেশের ধর্মীয় ব্যাখ্যায় সবচেয়ে বেশি প্রয়োজনীয় গুরুত্বপূর্ণ করে তুলেছে হজরত থানবিকে ৷

আজকের দিনের দাওয়াতে তাবলিগ ও মজলিসে দাওয়াতুল হক তার চিন্তারই বাস্তব প্রকাশ ৷ তিনি নিজ হাতে মেহনত করে গড়ে তুলেছেন অসংখ্য ভক্ত শিষ্য ৷ যারা উপমহাদেশের আনাচে কানাচে তার চেতনা ও মতাদর্শ নিয়ে ছড়িয়ে পড়েছেন ৷ সেই ধারাবাহিকতায় তার হাতে গড়া ছাত্র ও মুরিদের মাধ্যমেই বাংলাদেশে ইসলাম চর্চার জোয়ার উঠেছে ৷ শামসুল হক ফরিদপুরী, মোহাম্মদুল্লাহ হাফেজ্জী হুজুর ও আব্দুল ওয়াহহাব পীরজী হুজুর স্বধীন বাংলার তিন পুরোধা পুরুষ ৷ তিনজনই তার ছাত্র ও তরিকার মুরিদ ৷ থানভীর চিন্তাধারা অবলম্বনে ইসলামের চতুর্মুখী খেদমত করে এই জাতিকে ইসলামমুখী করে তুলেছেন সদর সাহেব হুজুর তথা শামসুল হক ফরিদপুরী । ফরিদপুরীর হাত ধরে এদেশে গড়ে উঠেছে অনেক দ্বীনি পরিবেশ ও আন্দোলন ৷ পুরো বাংলাদেশে তিনিই সম্ভবত থানবীকে পুরোপুরি ধারণ করতে সক্ষম হয়েছিলেন এবং পুরো জীবন তা বাস্তবায়িত করেছেন। তারপর এখন আর কারো কর্ম ও আদর্শে একজন বহুমুখী থানবি বেঁচে নেই ৷ যদিও এদেশের দ্বীনি প্রতিটি মজলিসে এখনো থানবি খুবই প্রাসঙ্গিক, কিন্তু তা থানবির খণ্ডিত চর্চা ছাড়া কিছুই নয় ৷ এই উপমাদেশে থানবি কখনোই অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়বেন না৷ কারণ তিনি এই দেশ ও জাতির মস্তত্ত্ব পাঠ করে সে মতে ইসলামের ওষুধ সেবন করিয়েছেন। তাই উপমহাদেশের ধর্মীয় সংস্কারে থানবীর চিন্তাদর্শন চর্চা ও লালন করা খুবই জরুরি ও প্রাসঙ্গিক একটি টপিক।

আগের সংবাদহোসনি দালানে বোমা হামলা মামলায় রায় ১৫ মার্চ
পরবর্তি সংবাদমাওলানা থানবির লেখালেখি