দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় মুসলমানদের ভবিষ্যত

আলতাফ পারভেজ:

দক্ষিণ এশিয়ার এথনো-পলিটিক্স নিয়ে পড়ালেখা করতে ভালোবাসি। ‘ফাতেহ-২৪.কম’-এর সমন্বয়ক ইফতেখার জামিল এটা জানেন। সে কারণেই হয়তো সম্প্রতি অনুরোধ করেছেন ‘দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মুসলমানদের ভবিষ্যত’ বিষয়ে কিছু লেখার জন্য।

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় পৃথকভাবে কেবল মুসলমানদের ভবিষ্যত খোঁজা এক দিক থেকে বিপজ্জনক— অন্যদিক থেকে আবার খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কেন এটা বিপজ্জনক এবং কেনইবা সেটা গুরুত্ববহ— তা নিয়ে আলাপের আগে আমরা পুরো এই অঞ্চলে মুসলমানদের সংখ্যাগত দিকটিতে নজর দিতে পারি। এই সংখ্যাগত দিকটা আলাপের দরকারি একটা পটভূমি হিসেবে কাজ করবে।

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মধ্যে আমরা যদি বার্মা থেকে আফগানিস্তান পর্যন্ত আটটি দেশকে ধরি তাহলে এর মধ্যে কেবল ৭৪ লাখ জনসংখ্যার ভুটানে মুসলমানদের সংখ্যা অতি নগণ্য। বাকি সাত দেশেই মুসলমান আছে কম-বেশি। পাকিস্তান, আফগানিস্তান ও বাংলাদেশে তারা ৯০ ভাগের ওপরে। ভারতে আছেন জনসংখ্যার ১৪ ভাগ। শ্রীলঙ্কায় ১০ ভাগ। বার্মা ও নেপালে আছেন ৪ শতাংশ করে। পুরো এই অঞ্চলে প্রায় ৫৮ কোটি মুসলমান আছে। পুরো দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় জনসংখ্যার এক তৃতীয়াংশই মুসলমান। এটা একটা খসড়া হিসাব। সামান্য কমবেশি হতে পারে।

উপরের এই জনমিতিটি মাথায় রেখে আমরা এখন আলোচনার শুরুর প্রশ্নটির মুখোমুখি হতে পারি আবার।

আমরা বলেছিলাম, পুরো এলাকার সকল সম্প্রদায়ের মাঝে কেবল একটা সম্প্রদায়ের ‘ভবিষ্যত’ খোঁজাটা বিপজ্জনক। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া পুরো জনপদ গণতান্ত্রিকভাবে খুব অবিকশিত। চরম অসাম্য রয়েছে এখানে, প্রতিটি দেশে। বিশ্বের বিরাট সংখ্যক দরিদ্র জনগোষ্ঠীর বাস এই আট দেশে। উপনিবেশিক স্বাধীনতার প্রায় পঁচাত্তর বছর পরও এখানে শাসন কাঠামো উপনিবেশিক ধাঁচেরই রয়েছে। বিপরীত দিকে এই অঞ্চলে সামরিকায়ন বাড়ছে। যেসব কারণে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় দারিদ্র্য, অসাম্য এবং গণতন্ত্রহীনতা— তার অনেকগুলো প্রায় সকল সম্প্রদায়ের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। ফলে এর মাঝে আলাদা করে কেবল একটা জনগোষ্ঠীর ভবিষ্যত খোঁজার মাঝে এক ধরণের বিদঘুটে সংকীর্ণতা আছে। এ ধরণের ‘খোঁজ’ একাডেমিক প্রয়োজনে হতেই পারে। কিন্তু এর ‘ব্যবহারিক ভবিষ্যত’ অতি সীমিত।

তারপরও আমি এখানে ‘মুসলমানদের ভবিষ্যত’ খোঁজাকে গুরুত্বপূর্ণও মনে করছি। দারুণ একটা ইতিবাচক ভবিষ্যত আছে এই খোঁজের মাঝে। সত্যিকারভাবে আন্তরিকতা ও পেশাদারিত্বের সঙ্গে যদি এই অঞ্চলের মুসলমানরা তাদের জন্য একটা ইতিবাচক রাজনৈতিক ভবিষ্যত খুঁজতে শুরু করেন, তাহলে সেটা পুরো অঞ্চলের গণতন্ত্রের সংগ্রাম এবং সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় অসামান্য— এমনকি বৈপ্লবিক ভূমিকা রাখতে সক্ষম। আমি তাই ইফতেখার জামিলের তাগিদকে ইতিবাচকভাবে নিয়েছি।

আমরা প্রথমে চুম্বক আকারে দেখতে পারি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার আটটি দেশে মুসলমানরা সাধারণভাবে কী কী চ্যালেঞ্জের মধ্যে আছে।

প্রথম চ্যালেঞ্জ হলো, কয়েকটি দেশে ধর্মীয় পরিচয়ের কারণে তারা বর্ণবাদী বঞ্চনা ও অর্থনৈতিক বৈষম্যের শিকার। বার্মার অবস্থা আমরা জানি। দেশটিতে বহু জাতির মুসলমান আছে। কিন্তু সকল জাতিসত্তার মুসলমানরাই সেখানে ধর্মীয় বিদ্বেষের শিকার হন। তাদের রাজনৈতিক অধিকারও সেখানে অস্বীকৃত। শ্রীলঙ্কা ও ভারতেও ধর্মবিদ্বেষের ব্যাধি আছে প্রবলভাবে। আছে ধর্মবিদ্বেষ থেকে সৃষ্ট বহুবিদ সামাজিক বঞ্চনা।

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মুসলমানদের সামনে দ্বিতীয় বড় সংকট হলো জাতিগত বিভিন্ন সম্প্রদায়ের সঙ্গে তাঁদের সম্পর্কটি স্বস্তিকর নয়। এই সম্পর্কটি এখনো গণতান্ত্রিকভাবে নির্দিষ্ট হয়ে ওঠেনি। সেখানে অস্বস্তির পাশাপাশি আছে উত্তেজনা, রক্তপাত, দাঙ্গাহাঙ্গামা। এই সমস্যার আবার বহু উপ-শাখা আছে। যেমন, শ্রীলঙ্কায় মূল জাতি সিংহলি বৌদ্ধদের সঙ্গে যেমন মুসলমানদের অস্বস্তিকর একটা সম্পর্ক চলছে— তেমনি উত্তরের তামিল-হিন্দুদের সঙ্গেও তার জলচল কম। অথচ মুসলমানরাও সেখানে তামিলভাষী। আফগানিস্তানে প্রধান দুই সম্প্রদায় পশতু ও হাজারা উভয়ে মুসলমান। কিন্তু তাদের পরস্পরের রক্তপাতের ইতিহাস চলমান। পাকিস্তানে বালুচরা মুসলমান হয়েও শাসক অপর মুসলমানদের তরফ থেকে বঞ্চনার শিকার মুখ্যত জাতিগত কারণে। পশতু ও পাঞ্জাবিদের সম্পর্কও সেখানে খুব স্বাভাবিক নয়। বাংলাদেশে বৌদ্ধ চাকমা-মারমা এবং বাঙ্গালি মুসলমানদের মধ্যে পাহাড়ি অঞ্চলে পারস্পরিক সম্পর্কে বড় রকমে অস্বস্তি আছে। পাশের আরাকানে রাখাইন ও রোহিঙ্গাদের বিভেদের কথা বিশ্ববাসীর জানা।

এসব দেশে মুসলমানদের সামনে তৃতীয় সামাজিক চ্যালেঞ্জ শ্রেণীগত। এই পুরো অঞ্চলেই মুসলমান সম্প্রদায়ের অভ্যন্তরে শ্রেণীভেদ আছে প্রবলভাবে। ফলে পুরো মুসলমান সম্প্রদায়ের আর্থ-সামাজিক সকল স্বার্থ একরকম নয়।  যেমন, বাংলাদেশে বাঙ্গালি-মুসলমান ১৯৭১ থেকে শাসকের আসনে থাকলেও এখানে হাজার হাজার টাকা পাচারকারী মুসলমান যেমন আছেন, তেমনি সরকারি হিসাবেই হতদরিদ্র মুসলমান আছেন প্রায় তিন কোটি। উভয়েই এরা মুসলমান। কিন্তু উভয়ের স্বার্থ, অস্তিত্বের সংগ্রাম এবং ভবিষ্যত নিশ্চয়ই একরকম নয়। হতে পারে না। পাকিস্তান, ভারত, শ্রীলঙ্কা সর্বত্রই মুসলমান সম্প্রদায়ের ভেতর উৎকট শ্রেণীভিন্নতা দেখতে পাবো আমরা।

আলোচনাকে যদি আমরা সংক্ষিপ্ত রাখি—দক্ষিণ এশিয়ার এই আট দেশের ৫৮ কোটি মুসলমানের সামনে প্রধান তিনটি চ্যালেঞ্জ দেখবো আমরা এমুহূর্তে:

এক. ধর্মীয় পরিচয়গত বঞ্চনা;

দুই. আন্তঃজাতি অস্বস্তি, বৈরিতা, হানাহানি;

তিন. শ্রেণীগত শোষণ ও বঞ্চনা।

এই তিনটি সমস্যারই অঞ্চলভেদে তীব্রতার রকমফের আছে। আঞ্চলিক স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য আছে। আবার তিনটির মাঝে কিছু কিছু আন্তঃসম্পর্কও আছে। ধর্মীয়ভাবে বঞ্চনার শিকার বলেই অনেক স্থানে মুসলমানরা দরিদ্র। আবার দরিদ্র বলে তার রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন হয়নি অনেক জায়গায়। আবার অনেক স্থানে রাজনৈতিক ক্ষমতা তাদের হাতে থাকলেও শ্রেণীগতভাবে সেটা কুক্ষিগত করে রেখে মুষ্টিমেয় কিছু মানুষ। এরকম আরও গভীর কিছু জটিল আন্তঃসম্পর্ক আছে উপরের তিনটি সমস্যায়। সেদিকটিতে আমরা আর বিস্তারিত যাচ্ছি না। এ পর্যায়ে বরং আমরা দেখতে চাই— উপরের চ্যালেঞ্জগুলোর মাঝে কোনটা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। কিংবা কোনটা আগে বিবেচনা করা দরকার।

আসলে আগে-পরের বিষয়টি স্থান-কাল-সময় অনুযায়ী বিবেচনা করতে হবে। বাংলাদেশে কিংবা পাকিস্তানে নিশ্চয়ই মুসলমানদের মাঝে ধর্মবিদ্বেষের সমস্যা প্রধান নয়। বরং এসব দেশে অন্য দুটি চ্যালেঞ্জের দিকে মনযোগ দেয়া জরুরি। আবার আরাকান বা গুজরাট বা শ্রী লঙ্কার পূর্বাঞ্চলে বর্ণ বা ধর্মীয় বিদ্বেষের বিষয়টা প্রবল। আসাম-ত্রিপুরা, কাবুল, মাজার-ই-শরীফ কিংবা জম্মুর মতো স্থানগুলোতে আবার আন্তঃজাতি সম্পর্ক পুনর্গঠনের সমস্যাটা অতি জরুরি।

অর্থাৎ কোন সমাজে মুসলমানরা কোন সমস্যাটা আগে ফয়সালা করবে সেটা সেখানকার মুসলমানদের আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক বাস্তবতার ওপর নির্ভর করছে। এর কোন যান্ত্রিক পূর্বানুমান বা সুপারিশ সম্ভব নয়। তবে এই তিনটি সমস্যা ও তার সমাধানের ওপর যৌথভাবে জড়িয়ে আছে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অন্যান্য সকল জাতিসত্তার স্বার্থ।

মুসলমানরা এই তিন চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় যতটা সফল হবে পুরো দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া গণতান্ত্রিক পুনর্গঠনের দিকে ততটাই এগোতে পারবে। আবার এও সত্য যে, এই তিন চ্যালেঞ্জ অতিক্রম করে একটা ন্যায্য-ভবিষ্যত নির্মাণে মুসলমানদের চেষ্টা কেবল তার একার আন্তরিকতার ওপরই নির্ভর করে না। সবগুলো দেশে আরও নানান উপাদান কাজ করবে এই সংগ্রামে। কিন্তু মুসলমান সমাজ সঠিকভাবে আগে চ্যালেঞ্জগুলো শনাক্ত করতে পারছে কি না— সেটা হবে তার সফলতার অন্তত অর্ধেক। আরো সরাসরি বললে, ভবিষ্যতের পথরেখা শনাক্ত করা হবে সেই পথে এগোবার অর্ধেক সফলতা।

প্রশ্ন উঠতে পারে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় মুসলমানরা উপরোক্ত চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবেলার ক্ষেত্রে তার প্রচেষ্টায় কোন ধরনের বাধা পাচ্ছে কি না। বাধা না পেয়ে থাকলে তার এগোতে সমস্যা কোথায়?

এর প্রথম উত্তরটি তিক্ত শোনাতে পারে। বর্তমান লেখকের বিবেচনায় উপরের তিনটি সমস্যা যৌথভাবে এখনো দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার কোন দেশে মুসলমানদের কাছে প্রধান আর্থ-সামাজিক এজেন্ডাই হয়ে ওঠেনি। অর্থাৎ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মুসলিম-উম্মাহ পুরো অঞ্চলের গণতান্ত্রিক পুনর্গঠনের জায়গা থেকে এখনও দূরে আছেন বা তাঁদের দূরে রাখা হয়েছে বা দূরে রাখা যাচ্ছে। এটা যেমন এই অঞ্চলে মুসলমানদের এক ন্যায়ভিত্তিক ভবিষ্যতের পথে একটা বড় বাধা, আবার এটা কায়েমী স্বার্থবাদীদের একটা বড় বিজয়ও বটে। সম্প্রদায়ের ভেতর-বাইর দুদিক থেকেই এই বাধা কার্যকর আছে।

উদাহরণ হিসেবে বাংলাদেশের কথাই ধরা যাক। বাংলাদেশে বহু রাজনৈতিক দল আছে। ‘ইসলামী’ পরিচয়ধারী দলও আছে অনেক। এর বাইরে এখানে নিয়মিত শত শত ধর্মীয় জলসা হয়। কেউ নিশ্চয়ই এসব জলসায় শুনিনি যে সেখানে শ্রেণী বঞ্চনা থেকে উত্তরণের উপায় নিয়ে কথা হচ্ছে। অথচ ইসলামের যে মৌলিক অন্তর্নিহিত নৈতিক শিক্ষা তা অসাম্যের সঙ্গে খাপ খায় না।

একইভাবে আমরা শুনতে পাই না অপর জাতিসত্তাগুলোর সঙ্গে মুসলমানদের একটা গণতান্ত্রিক বোঝাপড়ার কথাও। এও শুনবো না মুসলমানরা তাদের দিকে ধেয়ে আসা জাতিঘৃণা ও ধর্মঘৃণা থেকে রেহাই পেতে পারে কীভাবে— তার রাষ্ট্রনৈতিক পথ কী। হঠাৎ কোন কারণে সামাজিক পরিসরে এসব প্রশ্ন এলেও সেসময় এক ধরণের অস্পষ্ট, অ-ব্যবহারযোগ্য, অ-রাজনৈতিক কিছু সমাধানের কথা শুনতে হয়। কখনো কখনো ঘৃণার বিরুদ্ধে ঘৃণামূলক সমাধানের কথাও উঠে আসে। কখনো আবার পুরো বিষয়টি ‘উপরওয়ালার হাতে’ ছেড়ে দিয়ে শ্রোতাকে বিদায় দেয়া হয়।

কিন্তু এ সমস্যাগুলো দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মুসলমানদের জন্য বাস্তব সামাজিক সমস্যা এবং এগুলো রাজনৈতিকভাবে সমাধানযোগ্য। হয়তো দুরূহ। কিন্তু দুরূহ হলেও এগুলো সমাধানের চেষ্টা জারি রাখতে হবে সকল মুসলমানকে।

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মুসলমানরা যখনি এসব সমস্যার সমাধানে ইতিবাচকভাবে রাজনৈতিক পথ খুঁজবে তখনি তাদের এ অঞ্চলের অন্য সকল নিপীড়িত জাতির সঙ্গে একটা সংলাপের পরিসর গড়ে উঠবে। এটা অনিবার্যভাবেই ঘটবে।

পুরো অঞ্চলজুড়ে এরকম সংলাপের পরিসরগুলো এখানে কায়েমী স্বার্থবাদী শক্তিগুলোর ঐতিহাসিক একচেটিয়াত্বকে খর্ব করে পুরো অঞ্চলে রাজনৈতিক পুনর্গঠনের পথ সহজ করে তুলবে। এরকম রাজনৈতিক পুনর্গঠন ছাড়া এই অঞ্চল তার উপনিবেশিক অযৌক্তিক জেরসমূহ থেকে বের হতে পারবে না। ফলে শেষবিচারে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় মুসলমানদের ভবিষ্যতের সঙ্গে লেপটে আছে সমগ্র অঞ্চলের গণতন্ত্রায়নের ভবিষ্যতও।

লেখক: গবেষক 

 

 

আগের সংবাদকার্ল মার্কসের আফিমতত্ত্ব : একটি নির্মোহ পর্যালোচনা
পরবর্তি সংবাদপশ্চিমবঙ্গে কওমি মাদরাসার হালচাল