
রাকিবুল হাসান নাঈম:
ওয়াকফ এস্টেটগুলো মূলত জনস্বার্থে এবং আল্লাহর রাস্তায় উৎসর্গকৃত সম্পত্তি। ১৯৬২ সালের বাংলাদেশ ওয়াকফ আইন অনুসারে এগুলো পরিচালিত হয়ে থাকে। ওয়াকফ সম্পত্তি বিক্রি এবং হস্তান্তরের বিধান অবৈধ ঘোষণা করেছিলেন হাইকোর্ট। কিন্তু এই রায়কে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে চলছে বিক্রি, হস্তান্তর, জবরদখল এবং ভোগ-দখল। দেশে ওয়াকফ আইন ও কাগজে-কলমে একটি ওয়াকফ প্রশাসন সক্রিয় থাকা সত্ত্বেও এসব আইন ও প্রশাসন ওয়াকফকৃত সম্পত্তি রক্ষায় তেমন কোনো কাজে আসছে না। ওয়াকফ এস্টেটের একশ্রেণির দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা, স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তি, ধূর্ত সমাজপতি পরস্পর যোগসাজশে নানা কৌশলে হাতিয়ে নিচ্ছেন শত শত কোটি টাকা মূল্যের ওয়াকফ সম্পত্তি।
দেশের আলেমগণ বলছেন, ওয়াকফকৃত সম্পত্তি রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব ওয়াকফ প্রশাসনের। এসব সম্পত্তি দখলদারিত্ব মুক্ত করতে হবে৷ তাদের দাবি, দখল হয়ে যাবার কারণে এসব সম্পত্তি ধর্মীয় কিংবা জনস্বার্থে ব্যবহার করা যাচ্ছে না।
দখলের কবলে ৯০ শতাংশ
চলতি বছরের এক হিসাব অনুসারে, বাংলাদেশ ওয়াকফ প্রশাসনের তালিকায় স্থাবর-অস্থাবর মিলিয়ে দেশে সাড়ে ৩ লাখ ওয়াকফ এস্টেটের মধ্যে ৩ লাখ ২৯ হাজারই বেদখল হয়ে গেছে। প্রায় ১ লাখ ৯৩ হাজার একর ওয়াকফ জমির মধ্যে ১ লাখ ২২ হাজার একরই এখন দখল হয়ে গেছে।
ধর্ম মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভায় উত্থাপিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, ক্রমে জেঁকে বসা দুর্নীতির কারণে ওয়াকফ এস্টেটের প্রায় ৯০ ভাগ সম্পত্তিই এখন অবৈধ দখলদারদের করায়ত্তে। সারাদেশে যার পরিমাণ ১ লাখ একরের বেশি। ওয়াকফ প্রশাসনের অধীন প্রায় ৫ হাজার ওয়াকফ এস্টেট প্রশাসকের কোনো কার্যক্রম নেই।
এর আগে বিদ্যমান বাস্তবতায় ধর্ম মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি তীব্র অসন্তোষ এবং ক্ষোভ প্রকাশ করে। পরে বেহাত হওয়া ওয়াকফ সম্পত্তি পুনরুদ্ধারে বেশ কয়েকটি উপ-কমিটি করে দেয় সংসদীয় কমিটি। তবে উপ-কমিটি গত কয়েক বছরে কি কাজ করেছে- সে বিষয়ে কোনো তথ্য পাওয়া যায় না।
ওয়াকফ হস্তান্তর নিষেধ
২০১৩ সালের ওয়াকফ হস্তান্তর ও উন্নয়ন আইনের তিনটি ধারা (৩,৪,৮) ও একটি দফা (১২) অবৈধ ও বাতিল ঘোষণা করে রায় দেয় হাইকোর্ট। এর ফলে ওয়াকফ প্রশাসক এখন থেকে সম্পত্তি হস্তান্তর, বিক্রি বা রিয়েলস্টেট কোম্পানিকেও দিতে পারবেন না।
২০১৩ সালে আইনজীবী এ বি এম নুরুল ইসলাম ওই আইনের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে জনস্বার্থে রিট আবেদন করেছিলেন। ২০১৯ সালে এ সংক্রান্ত এক শুনানির পর গণমাধ্যমকে বলেন, রাসূল সা.-এর জীবদ্দশায় ওয়াকফের বিধান চালু হয়েছে। এটা কুরআন নির্দেশিত পন্থা। যার অঢেল সম্পত্তি রয়েছে, তিনি আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য ওয়াকফে তার সম্পত্তির কিছু অংশ দান করে থাকেন। ওয়াকফ সম্পত্তির আয় থেকে তিনটি উদ্দেশ্যে ব্যয় করা যাবে। যথা: ধর্মীয়, দাতব্য ও মানবহিতৈষী কাজে। অন্য কোনো কাজে এ সম্পত্তি হস্তান্তরযোগ্য নয়। কিন্তু ২০১৩ সালের সরকার বিশেষ আইন ওয়াকফ (সম্পত্তি হস্তান্তর ও উন্নয়ন) প্রণয়ন করে। এ আইনের ৩ ধারায় আইনটিকে সব আইনের থেকে প্রাধান্য দেয়া হয়। পাশাপাশি ওয়াকফ সম্পত্তি হস্তান্তরের বিধান রাখা হয়। আইনে প্রদত্ত ক্ষমতাবলে প্রশাসক-ওয়াকফ ফলে গত পাঁচ বছরে উন্নয়নের নামে অনেক ওয়াকফ সম্পত্তি হস্তান্তর হয়ে গেছে।
তিনি জানান, হাইকোর্ট রুল নিষ্পত্তি করে আইনের তিনটি ধারা ও একটি উপধারা বাতিল ঘোষণা করেছেন। ফলে এখন থেকে ওয়াকফ প্রশাসকের ক্ষমতা খর্ব হলো। তিনি আর সম্পত্তি হস্তান্তর করতে পারবেন না।
কী বলছেন আলেমরা
এ প্রসঙ্গে কথা হয় জামিয়া আরাবিয়া এমদাদুল উলুম ফরিদাবাদ মাদরাসার মুহাদ্দিস মুফতি ইমাদুদ্দিন সাহেবের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘ওয়াকফ খুব কঠিন একটি জিনিস। ওয়াকফ করা হয় একমাত্র আল্লাহ তায়ালার জন্য। এটা এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় স্থানান্তর করা যায় না। যেমন কবরস্থানের জন্য ওয়াকফকৃত জায়গা মসজিদের জন্য ব্যবহার করা যায় না। অথচ এখন দেদারসে ওয়াকফ সম্পত্তি দখল করে নিচ্ছে মানুষেরা।’
ধর্মীয় কাজ ব্যাহত হবার প্রসঙ্গ তুলে তিনি বলেন, ‘এসব ওয়াকফকৃত সম্পত্তি ব্যবহার হবার কথা ছিল ধর্মীয় কাজ কিংবা জনস্বার্থে। কিন্তু এগুলো দখল হয়ে যাবার কারণে ধর্মীয় কাজ ব্যাহত হচ্ছে। ৯০ ভাগ সম্পত্তি দখল হয়ে গেলে আর থাকে কি।’
বাস্তব চিত্র তুলে তিনি বলেন, ‘আমাদের কাছে অনেক ফতোয়া আসে এ সংক্রান্ত। ওয়াকফ সম্পত্তি বিক্রি হয়ে যাচ্ছে৷ বা হস্তান্তর করার কারণে দখল হয়ে যাচ্ছে। এসব কাজে অনেক সময় ওয়াকফ বোর্ডের কর্মকর্তারাও জড়িত থাকেন। বিষয়টা আশঙ্কাজনক।’
এসব দখলকৃত জমি পুনরুদ্ধারের দাবি জানিয়ে এই আলেম চিন্তাবিদ বলেন, ‘এসব দখলকৃত জমি পুনরুদ্ধার করা এখন আবশ্যক। নয়ত যতটুকু আছে, তাও থাকবে না। যারা দান করেছিলেন এসব জমি, করেছিলেন ধর্মীয় কাজের জন্য। একমাত্র আল্লাহ তায়ালার জন্য। সুতরাং জমিগুলো উদ্ধার করে সঠিক খাতের জন্য উন্মুক্ত করতে হবে।’
এ ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় জনবল, আইনগত ও প্রশাসনিক সহায়তা নিশ্চিত করা সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলোর দায়িত্ব বলেও মন্তব্য করেন তিনি। বলেন, লাখ লাখ একর ওয়াকফ সম্পত্তি দখলমুক্ত করা সম্ভব হলে এসব হাজার হাজার কোটি টাকার জমি থেকে প্রাপ্য সম্ভাব্য আয় শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ দরিদ্র ও সুবিধাবঞ্চিতদের কল্যাণে ব্যয় করা হলে তা সামাজিক উন্নয়নে বড় ধরনের মাইলফলক হয়ে উঠতে পারে। প্রভাবশালী মহলের হাত থেকে ওয়াকফ সম্পত্তি পুনরুদ্ধারে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়ার বিকল্প নেই।