দারুচিনি দ্বীপ : প্রবালে দোলে শৈবাল

ওমর আলী আশরাফ:

এটি আমার ২০২১ সালের প্রথম ট্যুর। ভাষা দিবসের ছুটি সামনে রেখে আমরা বেরিয়ে পড়লাম বাংলাদেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপটির উদ্দেশে।

যাত্রাপথে আমাদের বাসটি এক্সসিডেন্ট করে ফেলেছিল।

তুমুল বেগে টানছিল ড্রাইভার। সামনে একটা পিকআপ। ড্রাইভার একবার হর্ন দিয়েই পিকআপের পেছনে প্রচণ্ড ধাক্কা মেরে দিল। তারপর গতি ঠিক রেখে টেনে চলে গেল। চোখের পলকে ঘটে গেল ঘটনা। আমি শুধু ধাক্কায় পিকআপটা সটকে যেতে দেখলাম। সেটার ড্রাইভার বেঁচে আছে কিনা, আল্লাহ মালুম।

এই কোম্পানির বাসে এটা আমার দ্বিতীয় যাত্রা। এর আগে উনিশের ডিসেম্বরে চট্টগ্রাম গিয়েছিলাম এই পরিবহনে চড়ে। এসি বাস; চলছিল তুমুল বেগে। আমি ঘুমে। আচমকা প্রচণ্ড ধাক্কায় ঘুম ভেঙে গেল এবং বাঁ হাঁটুতে জখম পেলাম। গাড়ির ভেতরে কোথাও হাতল ভেঙে গেছে, সিট হয়েছে ক্ষতিগ্রস্ত। আমার পাশের যাত্রী ভালোই আহত হয়েছিলেন। মূলত ওই সিট আমার ছিল, জানালার পাশের যাত্রী না আসায় আমি ওটা ছেড়ে খালিটা দখল করে বসি এবং আল্লাহ বড় ধরনের আঘাত থেকে বাঁচিয়ে দেন।

এবারের ধাক্কা সবাই তেমন বুঝতে পারেনি। কারণ, ড্রাইভার ব্রেক করেনি। মেরে দিয়ে টানের ওপর চলে গেছে। মূলত ব্রেক কষলে ভেতরের যাত্রীরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

ভোরে গাড়ি আর চলতে পারছিল না; অথবা ড্রাইভারের ওপর প্রেশার আসায় সে মানসিক সংকটে ভুগছিল। আমাদের বাসে ৯ জনের একটা টিমের শিপে করে দারুচিনি দ্বীপ যাওয়ার (সেন্ট মার্টিন) টিকিট কাটা ছিল। সকাল ৮টায় শিপ (লঞ্চ)। তাদের তাড়া, অন্য যাত্রীদের বিরক্তি—সব মিলিয়ে আমাদের শাহাদাত ভাই সুপার ভাইজারকে ডেকে ধাতানি দিলেন। ড্রাইভার বাস থামিয়ে আমাদের দ্রুত পার করতে অন্য একটা গাড়ি ডাকল। আমরা নেমে দেখি এই গাড়ির সামনের বাঁ পাশ একদম তুবড়ে গেছে। দুর্ঘটনা ঘটেছিল চট্টগ্রামের শুরুর দিকে সম্ভবত। বাকি পুরো রাস্তা কানা বাবু এক লাইট দিয়ে দৌড়েছে!

যেতে যেতে যাত্রাপথে সবসময়ই একটা না একটা দুর্ঘটনা চোখে পড়েই। ফেনীতে গাড়ি জ্যামে পড়ল। জ্যাম ছাড়ার পর দেখি একটি বিধ্বস্ত বাস। আগুনে পুড়ে গেছে। পাশে ফায়ার সার্ভিসের অগ্নিনির্বাপক গাড়ি। সম্ভবত দুই ইউনিট কাজ করেছে। আরেকটু এগুনোর পর আবার বড়সড় জ্যামে পড়লাম। তাও দুর্ঘটনা। ফেরার দিন শুনলাম কক্সবাজারে দুর্ঘটনায় পড়ে কয়েকজন মারা গেছে। এভাবে মৃত্যুর মুখোমুখি হয়ে, মৃত্যু দেখতে দেখতে, মৃত্যুকে সঙ্গে করে আমাদের দুনিয়ার জীবন চলতে থাকে। হাদিস শরিফে এসেছে, ‘আস-সাফারু কিতউম মিনান নার’—সফর হলো আগুনের টুকরা। আগুন যেমন মানুষকে ক্লান্ত করে দেয়, সফরের কষ্টও মানুষকে কাহিল করে ফেলে। নবীজি যখন এই উক্তি করেছেন, তখন ছিল উট আর ঘোড়ার যুগ, রাস্তা ছিল রোদপোড়া মরুভূমি, খাবার ছিল সামান্য খেজুর। পানি ছিল না, মরুঝড় উঠলে বাঁচার উপায় ছিল না, পথ হারালে, বাহন মারা গেলে কিংবা ব্যাধিতে আক্রান্ত হলে বেঁচে ফেরা দুষ্কর ছিল। পথে পথে ছিল ডাকাতের ভয়। এখন এই আধুনিক কালেও সফর কেন আগুনের টুকরা? কারণ, যাত্রাপথে এক্সিডেন্ট হলেই আপনি ডেডবডি; কিংবা পঙ্গু। ব্যাগের ভেতর কেউ নিষিদ্ধ কিছু গুঁজে দিলে আপনার লাইফ শেষ। আরও নানাবিধ অনুষঙ্গ তো আছেই!

মজার ব্যাপার হলো, যাওয়ার সময় আমাদের বাসে কোনো নারী ছিল না। ৩৫জন যাত্রীর সবাই পুরুষ। ব্যাপারটা আমি টের পেলাম যখন অন্য একটা গাড়ি ডেকে আমাদের টেকনাফের উদ্দেশ্যে তুলে দেওয়া হলো। অল্প একটু এসে ৪জন নেমে গেলেন। তারা ঘুরবেন কক্সবাজার। বাকি ৩১জন মোট তিনটা টিম। একটু সিনিয়র বয়সী একদল আছেন, ১৪জন তারা। আমরা ৮জন। তৃতীয়টি লঞ্চের টিকিট কেটে লস খাওয়া ৯জনের দল।

আমাদের যিনি টিম লিডার ছিলেন, বিরাট পকপক ব্যক্তি। উঠেপড়ে লেগেছিলেন আগে থেকে টিকিট কেটে রাখতে। আমি এবং সাব্বির ভাই তাকে আটকিয়েছিলাম। টিকিট হলো চেয়ারের জন্য। আমরা ইয়াং, ঘুরব, চারপাশ দেখব, চেয়ার দিয়ে কী কাজ? শুধু শুধু ডাবল ভাড়া দিয়ে তো লাভ নেই!

আমরা টেকনাফ পৌঁছুলাম সোয়া দশটার পর। লঞ্চ সব ছেড়ে চলে গেছে। টেকনাফ থেকে দ্বীপের সব কয়টি লঞ্চই একত্রে ছাড়া হয়। দেরি করলেও খুব বেশি না। এটা জোয়ার-ভাটা জনিত কারণে কি না, জানি না। কিন্তু সাধারণ মানুষ খুব বিপাকে পড়ে। আমরা পৌঁছুবার কয়েক মিনিট আগেই নাকি শেষ লঞ্চ ছেড়ে গেছে। তারা আর দেরি করতে পারেনি; কারণ সামান্য দেরিতে কোস্টগার্ড বড় অংকের জরিমানা করে।
এখন আমাদের বিকল্প উপায় ট্রলারে যাওয়া। আমরা গাড়ির কাছে ফিরে এলাম ট্রলার ঘাটে যাওয়ার জন্য। বাংলাদেশের পর্যটন এলাকার বড় বৈশিষ্ট্য হলো, এরা যে যেভাবে পারে, আপনাকে চুষবে। এতক্ষণ যে গাড়ি আমাদের এই পর্যন্ত নিয়ে এসেছে, সে মাত্র অল্প কয়েক মিনিটের রাস্তা দেড় হাজার টাকার কমে যাবে না। অগত্যা আমাদের তাকে সন্তুষ্ট করতে হলো। সর্বোচ্চ ১০ টাকার ভাড়া আমাদের থেকে নিল গড়ে ৪৯ টাকা করে।

ঘাটের কাছে নামিয়েই সে পল্টি। আমাদের নানান ভয়-ভীতি দেখাতে লাগল। এখন ট্রলার পাবেন না, ভাড়া অনেক বেশি নেবে, সাগরে ট্রলার ডুবে যায় ইত্যাদি নয়-ছয়। তার গোপন উদ্দেশ্য, আমরা যদি এখন ফিরে যাই, সে ছাড়া এখানে আর বাস নেই। বড় অঙ্ক হাতানোর এই একটা সুযোগ।

ফ্যামিলি ট্যুর বা সঙ্গে নারী-শিশু থাকলে হয়তো আমাদের তাকে দ্বিতীয়বার আনন্দিত করতে হতো। কিন্তু আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম, ট্রলারে যাবই ইনশাআল্লাহ।

ট্রলার পেতেও গেল এক বিতিকিচ্ছিরি অবস্থা। ঠকবাজ আর দালালদের উৎপাত বড় বেতাল। শেষমেশ ৩টিমের ৩১জন আমরা ট্রলারে চেপে বসলাম। জলজ বনের ভেতর দিয়ে এগিয়ে নাফ নদী পার হয়ে ট্রলার পড়ল সাগরে। স্বচ্ছ সবুজ জল। এই জল দেখতে আমরা একবার সিলেট ট্যুরে শিডিউলের অতিরিক্ত একটি জায়গা ভ্রমণ করেছিলাম। লালাখাল নাম। নেত্রকোণার সুসং দুর্গাপুরেও গিয়েছিলাম চিনামাটির পাহাড় আর এই রকম সুন্দর জল দেখতে। বৃষ্টির কারণে সেদিন সেখানকার পানি তেমন সবুজ দেখায়নি। আজ সাগরে সবুজ জল চোখে লেগে গেল। সবুজ জল ভাঙছে দুলছে ঢেউ তুলছে, তাতে পড়ছে আকাশের শাদা মেঘের ছায়া, কী সে অপূর্ব দৃশ্য!

সাগরে বিশাল বিশাল ঢেউ বইছে। কুরআনে বর্ণিত নুহ আলাইহিস সালামের ঘটনার ‘ওয়া হিয়া তাজরি বিহিম ফি মাওজিন কাল জিবাল’ না হলেও একেকটা ছোটখাট টিলা সমান ঢেউ তো হবে! সেখানে পর্বতসম ঢেউয়ের ভেতর দিয়ে ইয়া বড় নৌকা চলছিল, এখানে টিলাসম ঢেউয়ের কোলে দুলে দুলে সাগরে সাঁতার কাটছে ছোট্ট এক ট্রলার। ঢেউয়ের তোড়ে সে দুলছে ক্ষুদ্র বেলফুলের মতো। চালক খুব শক্ত হাতেও বাঁটল ধরে রাখতে হিমশিম খাচ্ছে। দু পায়ের মাঝখানে চাপ দিয়ে তিরের মতো সোজা করে রাখল। না হয় ট্রলার ডানে-বাঁয়ে ফেরানোর পাতটি ঢেউয়ের মুখে তেরচা হয়ে গেলেই দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে।

আমাদের যারা লাইফ জ্যাকেট খুলে রেখেছিল, দ্রুত সবাই যে যারটা পরে নিল। সমুদ্রের তো কূল-কিনারা খুঁজে পাওয়া দায়। ভাসমান খড়কুটোও নেই যে ট্রলার তলালে আপনি সেটি আঁকড়ে বেঁচে থাকবেন! তবুও একটা সান্ত্বনা হিসেবে লাইফ জ্যাকেট।

ঢেউয়ের তোড়ে যখন ট্রলার দুলছিল, আমার মনে পড়ছিল একটি আয়াত:

‘তিনিই তোমাদেরকে স্থলে ও জলে ভ্রমণ করান। এমনকি যখন তোমরা নৌযানে থাকো এবং সেগুলো আরোহী নিয়ে বয়ে চলে অনুকূল বাতাসে, আর এতে তারা আনন্দিত হয়, ঠিক তখনই তাদের ওপর এল ঝড়ো হাওয়া এবং সব দিক থেকে সেগুলোর উপর আসতে লাগল উত্তাল তরঙ্গমালা, তখন তাদের ধারণা হলো যে, নিশ্চয়ই তারা সেগুলোর মাঝে পরিবেষ্টিত হয়ে গেছে, তখন তারা খাঁটি বিশ্বাসে আল্লাহকে ডেকে বলল, যদি আপনি আমাদের এ থেকে উদ্ধার করেন, তা হলে অবশ্যই আমরা কৃতজ্ঞদের অন্তর্ভুক্ত হব।’ (সূরা ইউনুস, ২২)

সফর সব সময়ই শিক্ষার। আপাত যদিও মনে হয় আপনি কিছুই শিখতে পারেননি, তবু আপনার অবচেতনে আপনার মনে সফর বিশাল পরিবর্তন নিয়ে আসবে। আপনার কাজের স্পৃহা তৈরি করবে, ক্রিয়েটিভ মানুষ হলে আপনার প্রোডাক্টিভিটি বাড়াবে, একদম গবেট ব্যক্তিটিও শরীরে দারুণ সতেজতা অনুভব করবে। আমার মনে হয়, আপনি কতটা সৃষ্টিশীল, এটা বোঝার একটা উপায় সফর। আপনি নিজেকে নিজে গ্রেড দিন, এই সফরে কতটা অর্জন আপনার হয়েছে, সে অনুযায়ী আপনার ভেতরের সৃষ্টিশীলতার পরিমাপ বুঝে নিতে পারেন।

সফরের কথা কুরআনে ও হাদিসে অনেকবার বলা হয়েছে। আল্লাহ তো বারবার বলেই দিয়েছেন সফর থেকে আমাদের কী কী বিষয়ে শিক্ষা নিতে হবে। আমাদের গাড়ি দুর্ঘটনা ও সাগরে দুলতে থাকা ট্রলারের কথা মাথায় রেখে উপরের আয়াতটিই দেখুন, এসবের শিকার ব্যক্তি সামান্য চিন্তা করলেই কিন্তু জীবনযাপনের চিন্তা ও গতিধারা অনেক বদলে যায়!

সফর প্রধানত পূর্ববর্তীতের কীর্তি ও পরিণাম থেকে শিক্ষা নেওয়ার জন্য। তারপর আল্লাহর কুদরতে মুগ্ধ হয়ে শোকর গুজারের জন্য। আমি ভাবলাম, আমরা এখন যেখানে যাচ্ছি—দারুচিনি দ্বীপ, দেড়শো বছরের বেশি সময় আগে থেকে মানুষ এখানে যাতায়াত করে। আরবের বণিকরা চট্টগ্রাম থেকে দক্ষিণ ও উত্তর এশিয়ায় যাতায়াতের সময় বিশ্রামের জন্য এই দ্বীপে উঠে আসত। তখনো তো ঢেউ ছিল! নিরাপত্তার এত আয়োজন ছিল না। যাতায়াতের আধুনিক যান-ব্যবস্থা ছিল না। পাল-তোলা নৌকায় দুলতে দুলতে উলটো বাতাসে হয়তো আছড়ে পড়ত অন্যকোনো দিগন্তে। ডুবে গেলে কেউ জানত না। তবুও কি তারা থেমে গেছে? জীবন তো থেমে থাকার নয়, ভয়ে মুষড়ে যাওয়ার জন্য আল্লাহ আমাদের দুনিয়ায় পাঠাননি, জীবন-পথে সফল হতে আমাদের উদ্যোগী ও উদ্যমী হতে হবে।

আমাদের এই সফর ছিল মূলত অফিস ট্যুর। ‘মহিমান্বিত কুরআন : শব্দে শব্দে অর্থ’-এর কাজ শুরুর আগে আমরা কক্সবাজার অফিস ট্যুর দিয়ে গিয়েছিলাম। সেটা ছিল ২০ সালের অক্টোবরের শেষাশেষি। এবার কাজ শেষে আরও কিছু কাজ গুছিয়ে ভাষা দিবসের ছুটিতে রিলাক্সের জন্য এই ট্যুর। আমার ঘাড়ে যখন কাজের ভীষণ ভার চাপে, আমি কী করি? কিছুই করি না, আচমকা ট্যুরে বের হয়ে যাই। এবারও ঘুরতে বের হওয়ার পর চাপ নেমে গেল।

ঘুরতে হয় বন্ধুদের সঙ্গে। অফিস ট্যুর, ফ্যামিলি ট্যুর, স্কুল ট্যুর খুব একটা সুখের হয় না। আমাদের লিডার যিনি, দারুচিনি নেমেই তিনি গাল বাঁকা করে বলতে লাগলেন, আগে শুনছি সেন্ট মার্টিন কী না কী! এখন দেখি সব হুদা। এই ভুয়া জায়গায় মানুষ আসে! আমি আর জীবনেও আসব না।

শুধু এই না, রাতে খেয়েদেয়ে দ্রুত তিনি ফেরার টিকিট কেটে ফেললেন। মানে অতি চমৎকার এই দারুচিনি দ্বীপে আমাদের ২৪ ঘণ্টাও থাকা হচ্ছে না!

তার কথা শুনে কাজ দেখে আমি মনে মনে হাসলাম। আমি আর আনোয়ার ভাই ঠিক করলাম, কে কী করবে জানি না, ফজরের পর থেকে আমরা হেঁটে পুরো দ্বীপ ঘুরব। ছেঁড়াদ্বীপ না গিয়ে থামব না।

সকালে সবাই একত্রে বের হলাম। জুতা ছাড়া খালি পায়ে। লিডার সাহেবের ডি-মোটিভেটেড কর্ম সাধন চলতে লাগল। তার কথা শুনে আরও তিনজন মজে গেল। আমরা দুইজন তার ভেঙানি সত্ত্বেও রওনা দিলাম। সঙ্গে যাহিদ ভাই আর সাঈদও চলল। সাগরের পার ধরে আমরা হাঁটতে লাগলাম। নগ্নপদে হণ্টন। ফোনে চার্জ নেই, পকেটে টাকা নিইনি। হুমায়ূন আহমেদের দেওয়া নাম দারুচিনি দ্বীপে ঘুরে বেড়াচ্ছি তারই সৃষ্ট চরিত্র হিমুর মতো খালি পায়ে।

দ্বীপটির নামকরণ নিয়ে আমি ফেসবুকে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম—

‘দারুচিনি দ্বীপ’ নামটি দিয়েছিলেন হুমায়ূন আহমেদ। এমন অদ্ভুত মায়ামাখা নাম বাংলাদেশে আর আছে কি না জানি না। দেড়শ বছর আগে যখন আরব বণিকরা এশিয়ায় যাতায়াতের সময় যাত্রাবিরতির জন্য এই দ্বীপে থামত, তারা দ্বীপটির নাম দিয়েছিল জিঞ্জিরা। পরবর্তীতে বাংলাদেশিরা মাছ ধরার জন্য এই দ্বীপে নিজেদের আবাসন তৈরি করে। মিষ্টি পানির জন্য তারা প্রচুর পরিমাণে নারকেলগাছ লাগায়। দ্বীপটি প্রসিদ্ধি পায় নারকেল জিঞ্জিরা নামে।

ব্রিটিশরা ভারতবর্ষ শাসন করতে এসে দ্বীপটি তাদের শাসিত অঞ্চলের অধীন করে নেয়। মার্টিন নামের একজন সাধু অথবা জেলাপ্রশাসকের নামে তারা দ্বীপটির নাম পরিবর্তন করে দেয় সেন্ট মার্টিন আইল্যান্ড। সব জায়গায় লিখিত আকারে এই নামটি পোক্ত ও প্রসিদ্ধ করে ফেললেও স্থানীয়রা এখনো নারকেল জিঞ্জিরা নামে জানে।

জিয়া আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নাম পরিবর্তন হয়ে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর হয়েছে, জিয়া উদ্যান হয়েছে চন্দ্রিমা উদ্যান। দেশের সন্তান হিসেবে আমরা বলতেই পারি, সরকার সেন্ট মার্টিন পরিবর্তন করে হুমায়ূন আহমেদের দেওয়া ‘দারুচিনি দ্বীপ’ নাম দিলে আশাকরি দেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপটি একটি উপযুক্ত নাম পাবে।

দারুচিনি দ্বীপ নাম দিয়ে হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস লিখে তা দিয়ে আবার ছায়াছবি বানালেও এই নাম সম্ভবত তিনি নজরুল থেকে ধার করেছিলেন। আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম ‘দূর দ্বীপবাসীনি’ নামে একটা গীতি লিখেছিলেন, শুরুর লাইনগুলো এই রকম—
‘দূর দ্বীপ–বাসিনী, চিনি তোমারে চিনি।
দারুচিনির দেশের তুমি বিদেশিনীগো, সুমন্দভাষিণী।’
হুমায়ূন যে নামটি এই গীতি থেকেই নিয়েছেন, ‘দারুচিনি দ্বীপ’ ছবিতে গানটির উপস্থাপন দেখে তা বুঝে নেওয়া যায়।

আমরা হাঁটছি। ভীষণ সুন্দর দ্বীপের সৌন্দর্য চোখে আনন্দ মেখে দিচ্ছে। এক পাশে কেওড়া বন, আরেক পাশে অথৈ জল। কাঁপছে ভাঙছে বাতাসে। মাঝখানে প্রবাল পাথর আর বালু। আমরা বালুর উপর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে অসাধারণ সব শামুক আর পাথর কুড়িয়ে খেলতে খেলতে এগিয়ে চললাম। কোথাও কেওড়ার ঝোঁপ ঘন হয়ে এসেছে। কেয়াফল ঝুলে আছে গাছে—দেখতে অনেকটা আনারসের মতো। আনারস হয় মাটিতে—সবজির মতো। কেয়া পেঁপের মতো ঝুলে আছে গাছের আগা কামড়ে।

হাঁটতে হাঁটতে আমরা সাগরের পার ছেড়ে গ্রামের ভেতর ঢুকলাম। স্থানীয়দের জিগ্যেস করে পথ চলতে লাগলাম। ভীষণ সুন্দর এক প্রাকৃতিক রূপ। আমি তাৎক্ষণিক ছোট্ট করে এর বর্ণনা লিখেছিলাম—

‘দ্বীপের মানুষদের জীবিকার মূল উৎস সাগর থেকে মাছ ধরা। তারপর পর্যটন ব্যবসা—হোটেল, পর্যটক পরিবহন, চড়া মূল্যে মাছ বিক্রি ইত্যাদি।
দ্বীপের আদি নাম নারকেল জিঞ্জিরা। গ্রামের ভেতর ঢুকে দেখি সারি সারি নারকেলগাছ মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে। ডাবের দাম এখানে অনেক বেশি।
গ্রামে জেলেদের ঘরবাড়ি একদম আদি বাঙালি ঘরগুলোর মতো। নারকেল-ঘেরা বাড়ি। বাঁশের বেড়া দিয়ে তৈরি ঘর। মাটির উঠোন, মাটির রাস্তা (মাটি বলতে দ্বীপের মূল উপকরণ চুনাপাথর আর বালু)।
জমিগুলোতে তরমুজ ফলে আছে। পর্যটকদের কাছে বিক্রি হচ্ছে চড়ামূল্যে। বে-মৌসুমী হলেও তরমুজগুলো খুব বিস্বাদ নয়। ক্ষিরা, মরিচ, ভুট্টাসহ আরও নানান সবজির চাষ হচ্ছে। সাগরের পানি লোনা—অতি বিস্বাদ। এই পানিতে চাষ করা যায় না। চাষিরা যে যার জমিতে কুয়া খনন করে সেখান থেকে পানি সেচ দিচ্ছেন।
অদ্ভুত সুন্দর মায়াময় সব ছবির এই দ্বীপ; কিন্তু সবকিছুর দাম একটু বেশি—বেশি হওয়াটা স্বাভাবিক; এক তো পর্যটন এলাকা, দ্বিতীয়ত মূল ভূখণ্ড থেকে জিনিসপাতি নিতে তাদের সময় ভাড়া শ্রম সবই একটু বেশিই বইতে হয়। হোটেলে মাছ আর মাছ, অন্যান্য তরকারি অতি সামান্য। আমরা গ্রামের পথে হেঁটে দেখি বাচ্চারা খেলছে, পর্যটকরা ময়লা ফেলছে। চাষিরা ফসলের পরিচর্যা করছে।’

গ্রাম শেষে আবারও সাগরের পার ধরে হাঁটতে লাগলাম। এক পাশে কেওড়াবন, অন্যপাশে সমুদ্র। মাঝে প্রবাল পাথর আর আমরা কয়েকজন। আকাশ আজ একটু ঘোলা। রোদ চড়চড় করছে না। সমুদ্র শান্ত, শীতল বাতাস বইয়ে দিচ্ছে। জেলেরা জাল মেরামত করছে। শুঁটকি শুকোতে দিয়েছে মাচায়। বালুর উপর ইতস্তত গড়াগড়ি খাচ্ছে কুকুরের দল। দ্বীপে এত কুকুর কোত্থেকে এল, আল্লাহ মালুম। আমরা হাঁটছি দেখছি মুগ্ধ হচ্ছি—মন শরীর সবই ভালো হয়ে যাচ্ছে।

ছেঁড়াদ্বীপে ঢোকার আগে বনবিভাগের সাইনবোর্ডে নোটিশ টাঙানো আছে, এই ক্ষুদ্র দ্বীপপুঞ্জে ভ্রমণ নিষেধ। কী কারণে তারা এই নিষেধাজ্ঞা লিখলেন, জানতে পারিনি। নোটিশ টাঙানো থাকলেও বাধা দেবার, নিষেধ করবার কিংবা নিরাপত্তা দেবার কাউকে দেখলাম না। মানুষ আসছে ঘুরছে আনন্দ করছে।

আমরা হেঁটে গেলাম, অনেক মানুষ আসছে বাইকে চড়ে, কেউ সাইক্লিং করে, ফ্যামিলিরা ইজিবাইকে বসে। অধিকাংশ আসছে ট্রলারে ভেসে। তারা গ্রামের সৌন্দর্য দেখতে পাচ্ছে না, সাগরের পার দিয়ে হাঁটার সুখ অনুভব করতে পারছে না। ভ্রমণ কি এত শৌখিন হওয়া উচিত?

পুরো দারুচিনি দ্বীপে তিনটা ভাগ। উত্তরপাড়া, দক্ষিণপাড়া, গলাচিপা। ছেঁড়াদিয়া বা ছেঁড়াদ্বীপটি দক্ষিণ পাশে—বাংলাদেশের শেষ দক্ষিণ বিন্দু এটি, এর পর বাংলাদেশের আর স্থল ভূখণ্ড নেই। সাগরে ভাটার সময় গেলে এখানে হেঁটে যাওয়া যায়, জোয়ারের সময় তলিয়ে যায় বলে নৌকায় যেতে হয়। আমরা ভাটার সময় গেলাম এবং তখন ছিল সকাল।

জোয়ারের সময় ছেঁড়াদিয়ার বেশির অংশই তলিয়ে যায়। প্রবাল তখন থাকে জলের তলে। ওই সময় শেওলাদের দুলতে দেখা গেলেও খুব একটা ঘুরে দেখার মতো স্পেস আর থাকে না মনে হয়। উপরের যে অংশগুলো উঁচু, সবগুলো কেওড়া বন, কোথাও জঙ্গল ঘন হওয়ায় যাওয়া যায় না।

ছেঁড়াদিয়া বা ছেঁড়াদ্বীপ হলো অনেকগুলো ছোট ছোট দ্বীপ পাশাপাশি প্রতিবেশি হয়ে সাগরের জলে মাথা উঁচিয়ে ফুলে আছে। মূল দ্বীপ থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ায় সম্ভবত এগুলোকে ছিঁড়ে যাওয়ার সঙ্গে মিলিয়ে ছেঁড়াদ্বীপ বলা হয়। ছেঁড়াদ্বীপ জোয়ারে তলিয়ে যাওয়ার কারণে এখানে ঘর তোলা নিষেধ। এ দ্বীপপুঞ্জের কয়েকটি শুধু পাথরের স্তূপ, আর কয়েকটিতে কেওড়াবন বা উদ্ভিদ আছে। আমরা পুরোটা হেঁটে ঘুরে বসে নেড়ে দেখলাম।

দারুচিনি দ্বীপ বিখ্যাত মূলত প্রবাল পাথরের কারণে। বাংলাদেশে এই একটি দ্বীপ শুধু প্রবাল পাথরের। প্রায় ৬৬ কিসিমের প্রবাল আছে এখানে। এছাড়াও শামুক, শৈবাল প্রভৃতিতে দ্বীপটি ভরপুর। আমি ছোট্ট করে এর বিবরণ নোট করেছিলাম তখন—

‘প্রবাল মূলত একটি সামুদ্রিক প্রাণী। এগুলো বয়সের একটা সময়ে এসে সাগরের শক্ত কোথাও স্থায়ীভাবে গেড়ে বসে। মৃত্যুর পর খোলস থেকে যায়। তার উপর এসে পড়ে আরেকটি প্রবাল, বাকি জীবন শেষ করে নিজের খোলস দান করে আগেরটার উপর আরেকটু বাড়ে। এভাবে প্রাণী থেকে তারা হয়ে যায় পাথর। কিছু পাথর এত বিশাল, কত শত হাজার বছর এবং কতগুলো প্রবালের আত্মাহুতিতে এই পাথরগুলো হয়েছে, আল্লাহ মালুম।

বাংলাদেশের একমাত্র প্রবাল পাথরের দ্বীপ এটি। ছোট দ্বীপটির তিন পাশ ঘিরে আছে পাথরে। কিছু আছে শুধু পাথরের স্তূপ।

এখানে ৬৬ রকমের পাথর আছে। এক ধরনের পাথর এত ধারালো এবং সুচালো, খালি পায়ে হাঁটা যায় না। এক রকমের পাথরের দল আছে ছোট ছোট গর্তের কারণে সেগুলোকে জালি পাথর বলা যায়। এগুলোও আবার কয়েক কিসিমের—দুধেল শাদা, ঘন কালো। কোনোটার ছিদ্র বড় বড়, জালি আছে এক কিসিম। হুমায়ূন আহমেদের ‘সমুদ্র বিলাস’ বাড়ির সামনের পাথরগুলো আরও অদ্ভুত। গোল বা জোঁকের মতো বিভিন্ন রকমের রিং হয়ে পুরো পাথর ভীষণ রকম হয়ে আছে। বিভিন্ন জায়গায় প্রচুর পরিমাণে শামুক-ঝিনুক মরে হয়ে গেছে পাথরের অংশ। টেনে তোলা যায় না। সেগুলোর উপর ধীরে ধীরে আস্তরণ পড়ে পাথর আরও বড় হচ্ছে।’

হাঁটতে হাঁটতে আমরা একদম শেষ প্রান্তে গেলাম। তার অনুভূতি লিখে পরে ফেসবুকে পোস্ট দিয়েছিলাম—

‘দেশের ভূখণ্ডের একদম শেষ স্থান। এরপর শুধু সবুজ রঙের অনন্ত জলরাশি।
সাধারণত বালুর কারণে সমুদ্রপারের পানি ঘোলা দেখায়। প্রবাল পাথরের এই দ্বীপটির চারপাশ একদম পরিষ্কার, স্ফটিক স্বচ্ছ জল। ছোট ছোট মাছ পাথরের ফাঁকে ফাঁকে লুকোচুরি খেলছে। শৈবাল দুলছে মৃদু ঢেউয়ের তালে। বিভিন্ন রকমের জলজ উদ্ভিদ পাথরে শেকড় গেঁড়ে দাঁড়িয়ে আছে মাথা উঁচিয়ে। ভাটার সময় সোনালি রঙের কয়েক কিসিমের কিছু উদ্ভিদ বা অ্যালগি (Algae) বালির উপর ইতস্তত পড়ে থাকে। এখন একটু একটু জল পেয়ে তারা জেগে উঠে সৌন্দর্য ছড়াচ্ছে। বিভিন্ন রকমের শামুক পাথরের গায়ে জিহ্বা-কামড়ে পিলপিল হাঁটছে। পাথর উলটালে দেখা যায় নানা প্রজাতির শামুক রীতিমতো সংসার পেতে বসেছে। কাঁকড়ারা ফুড়ুৎ করে দৌড়ে লুকিয়ে যায় পাথরের ফোঁকরে।

এখানে দাঁড়িয়ে দেশের দিকে মুখ করে আমি বললাম, বাংলাদেশ, তুমি ভীষণ সুন্দর, ভীষণের চেয়েও ভীষণ। মনে পড়ল আমার মায়ের কথা, মাকে আমি ভালোবাসি; বাবার কথা স্মরণে ভাসল, বাবাকে ভালোবাসি; ভাইবোন-বন্ধুবান্ধবের কথা ইয়াদে এল, তাদেরকে ভালোবাসি। বাংলার মাটিতে যারা জন্মেছে, সৎপথে যারা চলে, তাদের সবাইকে ভীষণ ভালোবাসি।’

ফেরার পথে ছোট দ্বীপগুলোর একটা থেকে আরেকটা হয়ে ঘুরে আসছিলাম। এবং জীবনে দ্বিতীয়বারের মতো ভয়াবহ অভিজ্ঞতার শিকার হলাম—

একটি মেয়ে-শিশু বালু দিয়ে খেলছে। তার সমবয়সী (সম্ভবত জময) ভাইটি কাঁদতে কাঁদতে সাগর পর্যন্ত বিস্তীর্ণ পাথররাশির উপর দিয়ে হেঁটে যেতে ছুটে গেছে। আশপাশে বড় কেউ নেই। খেলতে থাকা বাচ্চাটিকে জিগ্যেস করলাম তাদের বাবা-মা কই। বাচ্চা দেখিয়ে দিল। দুজন মহিলা আর একজন পুরুষ সেলফি তোলায় মহাব্যস্ত। এদিকে বাচ্চারা খেলছে, কেউ নিয়ে যায়, না ধারালো পাথরে পড়ে শরীর ক্ষত হয়, এ নিয়ে তাদের মোটেও দুশ্চিন্তা নেই। আমাদের চিল্লাচিল্লিতে পুরুষ বা বাচ্চাদের বাবা দৌড়ে আসতে লাগলেন। ধারালো পাথরের বিস্তীর্ণ অঞ্চল মাড়িয়ে আসতে তার বেগ পেতে হচ্ছিল। অথচ বাচ্চাদের জন্য সাধারণত জানপ্রাণ হয়ে থাকে মা, এটা সৃষ্টিগত প্রাপ্ত তাদের বৈশিষ্ট্য। এখানে দেখলাম বাচ্চার কান্নাতে বাবা ছুটে আসছে। মা তখনো দাঁত কেলিয়ে সেলফি তোলায় ব্যস্ত। আমাদের পেছন পেছন আসা একজন কুৎসিত করে বলল, মহিলা দেখছি লোকটাকে ইউজ করছে। বেচারা জামাই বিয়ে করে ফেঁসে গেছে। কেমন বজ্জাত মহিলা, বাচ্চাদের এই অনিরাপত্তায় রেখে যায়, আবার এখনো ওখানে দাঁড়িয়ে আছে! কোনো দয়া-মায়া আছে তো মনে হয় না!

বাচ্চার প্রতি খামখেয়ালি থেকে সেলফি তোলায় ব্যস্ত এই রকম আরেকটা জুটি দেখেছিলাম এর আগের বার কক্সবাজার ভ্রমণে। মাত্র সাড়ে তিন মাস আগে—গত অক্টোবরের শেষের দিকে। বাবা-মা বালুভর্তি বস্তার উপরে দাঁড়িয়ে সেলফি তুলছে, বাচ্চা মেয়ে নিচে দাঁড়িয়ে কাঁদছে আর উপরে উঠতে চেষ্টা করছে। আমরা প্রথমে দেখে বুঝতে পারিনি। পরে মেয়ে যখন দেখিয়ে দিল, আমরা একটু রাগী হয়ে বাবা-মাকে বললাম, সেলফি বড়, না সন্তান? সেলফি তোলার যেহেতু এত রোগ, বাচ্চাসহ তোলেন! নাকি এটা নিজেদের বাচ্চা না!

হুমায়ূন আহমেদের একটা ভ্রমণ গল্পে পড়েছিলাম, আমেরিকার একটি পর্যটন স্থানে তিনি পরিবার নিয়ে ঘুরতে গেছেন। সবার মতো তাদের সঙ্গেও তখনকার ডিজিটাল ক্যামেরা ছিল। সবাই ছবি তোলায় ব্যস্ত, আর তিনি ব্যস্ত প্রকৃতি দেখায়। ছবি তুললে যে সৌন্দর্য দেখার আবেদন হারিয়ে যায়, এই উপলব্ধির কথা তিনি গুছিয়ে বলেছিলেন সে লেখায়। আমি ছবি না তোলার কথা বলছি না। বাচ্চার খোঁজ নেই অথবা দূরে ফেলে রেখে ছবি তোলা, সারাক্ষণ ক্লিক করতে থাকা অবশ্যই ভালো লক্ষণ নয়। সত্যিকারের সৌন্দর্য পিপাসুরা ছবির প্রতি মনোযোগী থাকে না।

১৮ সালে শ্রীমঙ্গলের লাউয়াছড়া উদ্যানে ঘুরতে গিয়ে দেখি গেইট বন্ধ, এখনো খোলার টাইম হয়নি। আমাদের অপেক্ষা করতে বলা হলো। তখন গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি হচ্ছিল। বাতাস আর মেঘ খেলা করছে। সিএনজি করে দুজন নারী এলেন। দেখতে মা-মেয়ের মতো বয়সের তফাৎ। তারা বৃষ্টিমধুর আবহাওয়া দেখে হোক, অথবা অন্য কোনো কারণে হোক, গেইট বন্ধ দেখে ভেতরে ঢোকার কোনো গরজই দেখালেন না। সামনে দাঁড়িয়ে জিহ্বা বের করে, ঠোঁট বাঁকা করে, ঘাড় কাত করে কয়েকটা সেলফি তুলে চলে গেলেন। লাউয়াছড়া ভ্রমণ শেষ। এত সুন্দর একটা বন কীভাবে না ঘুরে মানুষ চলে যায়, তার অঙ্ক আমি এখনো মিলাতে পারি না। বন্ধুবান্ধবকে দেখানোর জন্য, ফেসবুকে আপলোডের জন্য ছবি তোলা-ই যখন আসল, ভ্রমণের মর্ম সেখানে নিজস্ব কোনো অর্থ রাখে না।

অনেক মানুষ ছবি তোলায় এত ব্যস্ত থাকে, প্রকৃতি তিনি ফোনের স্ক্রিনেই দেখেন। সরাসরি দেখার আর তার তাওফিক হয় না। শরীর তার এখানে, চোখ কিন্তু গ্লাসে, এই রকম মানুষদের ভ্রমণে না যাওয়াই উচিত! ন্যাশনাল জিওগ্রাফিতে বরং তিনি বাঘ-ভাল্লুক দেখে আফ্রিকা ভ্রমণের আনন্দ উপভোগ করতে পারেন!

দেখার দৃষ্টি সবার এক না। এই সফরেই আমরা তার কয়েকটি প্রমাণ পেলাম। একটা সাধারণ মতামত উল্লেখ করি। দ্বীপে যাওয়ার পথে সাগরের ঢেউয়ে আমাদের ট্রলার দোলার অনুভূতি জানতে চাওয়ার পর—
শাহাদাত : ভয় তো পাইছি। আমি লগে লগে ঘুমাই গেছি। এত ভয় পাওয়ার দরকার আছে?
তাওহীদ : ভয় পাইছি। আল্লাহ আল্লাহ করছি।
যাহিদ : আমার মজাই লাগছে। একটুও ভয় পাই নাই। কী সুন্দর ট্রলার দুলতেছিল, মজাই তো!
আনোয়ার : ভয় বেশি লাগে নাই। ডুবলেও সমস্যা আছিল না। সাঁতরাই পার হই যাইতাম। (এই অথৈ সমুদ্র তিনি কীভাবে পার হতেন, আল্লাহ মালুম।)

একটি ভ্রমণ থেকে কে কতটুকু নিতে পারব, এটা আসলে আমদের নিজেদের ওপর নির্ভর করে। আল্লাহ তো মৌলিক বিষয়গুলো বলে দিয়েছেনই কী কী শিখতে হবে। নবীজি ও সাহাবিরাও সফরের মাধ্যমে আমাদের অর্জন শিখিয়ে গেছেন। কোনো মহাবীরই ঘরে বসে থেকে অঞ্চল জয় করতে পারেননি। আমাদের বীরেরা যখন সাগর পাড়ি দিয়ে অঞ্চল জয় শুরু করলেন, আজকের মতো তখন জানা ছিল না সাগরের ওপাশে কী আছে! তারা দমে যাননি। রহস্যের পেছনে ছুটেছেন। আল্লাহর কালিমা ছড়িয়ে দিয়েছেন। একসময় বিভিন্ন বিশ্বাসে সাগর পাড়ি দেওয়াকে বাঁকাচোখে দেখা হতো। এটা তাদের ভয়াবহ কুসংস্কারগুলোর একটি। অথচ কুরআনে শুধু সাগর, নৌকা, জাহায নিয়ে অনেকগুলো আয়াত আছে—ঘটনা আছে, বিধান আছে, নিয়ামতের বর্ণনা আছে—শিক্ষা নেওয়ার উপদেশ দেওয়া হয়েছে।

লেখালেখি মূলত সত্তাগত শিল্প। সব শিল্পী লেখক না; কিন্তু সব লেখকই শিল্পী। আম-খাস মুতলাক আরকি! লেখকদের কয়েকটি কমন বৈশিষ্ট্য আছে। তারা ঘুরতে পছন্দ করেন, সঙ্গীত ভালোবাসেন, নতুন কিছু জানার কৌতূহল মিটিয়ে আনন্দ পান। প্রায় সবাই-ই ভ্রমণ ও সঙ্গীত নিয়ে নানান কথা লিখেছেন। কবি আল মাহমুদের জীবদ্দশায় এক বৃষ্টিমধুর সন্ধ্যায় তার বাসায় দেখা করতে গিয়েছিলাম। ভীষণ আড্ডায় ডুবে গিয়েছিলেন তিনি। ভ্রমণ প্রসঙ্গ আলাপে উঠলে তিনি আমাদের বলেন, ‘লিখতে হলে জানতে হবে, পড়তে হবে, দেখতে হবে। এবং এর জন্য দরকার ভ্রমণ। সফর আপনাকে অনেককিছু দেবে।’

একজন তরুণ লিখিয়ে ভাই—যার একটি বই বাজারে আছে—ফেসবুকে তিনি আমাকে জিগ্যেস করলেন, ‘সফরের মাধ্যমে আমরা কী অর্জন করতে পারি? কিংবা সফর আমাদেরকে ঠিক কী দেয়?’

আমার মনে হলো, এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়া উচিত। আমি রিপ্লাই দিলাম, ‘এটা আসলে নির্ভর করে ব্যক্তির ওপর। যার গ্রহণ ও ধারণ ক্ষমতা যেমন, সে তেমন অর্জন করতে পারে। আল্লাহ নিজেই তো কুরআনে বেশ কয়েকবার সফরের কথা বলেছেন এবং সেসবে বিভিন্ন শিক্ষা নেওয়ার কথাও উল্লেখ করে দিয়েছেন।’

ভ্রমণ আনন্দের, ভ্রমণ শিক্ষার; ভ্রমণ নিজেকে চেনার, ভ্রমণ অনুভূতিশীল হবার। আমি দারুচিনি দ্বীপ বা সেন্টমার্টিন আইল্যান্ড ভ্রমণের কয়েকটি টুকরো গল্প ও অভিব্যক্তি এখানে লিখেছি। এটা মূলত নিজের জন্যই তাজা তাজা নোট লিখেছিলাম। এই সফরের আরও অনেক গল্প আছে, সৌন্দর্যের বর্ণনা টাঙানো আছে মনের দেয়ালে, অন্যকোনো পরিসরে বিতং করে বলা যাবে সেসব, ইনশাআল্লাহ।

Omaraliashraf508@gmail.com

আগের সংবাদমরিয়ম
পরবর্তি সংবাদফিলিস্তিনের একগুচ্ছ কবিতা