মুনশী নাঈম:
১৭ শতকে তুরস্কের শহর ইজমিরে আবির্ভূত হওয়া দলটির নাম দুনমা। এটি ইহুদিবাদী আন্দোলনের পথ প্রশস্ত করে। এই দলটিই প্রথম দল, যারা জেরুজালেমকে রাজধানী করে একটি ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দাবি জানায়। এই দলটি অটোমান সাম্রাজ্যের অর্থনীতি এবং মিডিয়াতে বেশ আধিপত্য বিস্তার করে। তুর্কি সমাজে ছড়িয়ে দেয় ধ্বংসাত্মক সব ধারণা। যেই ধারণাগুলো পরবর্তীতে খিলাফতকে উৎখাত করার পেছনে ভূমিকা রেখেছিল।
নামকরণ
দুনমা শব্দটি Dönmek নামক তুর্কি শব্দ থেকে নির্গত। যার অর্থ প্রত্যাবর্তন, ফিরে আসা। এই সম্প্রদায়ের অনুসারীরা তাদের ধর্ম ত্যাগ করার ভান করে ইসলামে ধর্মান্তরিত হয়েছিল। তাই মানুষ তাদেরকে এই নামে ডাকে। এই অর্থে যে, তারা সত্য ধর্ম থেকে ফিরে গেছে অথবা তারা প্রকৃত মুসলিম ছিল না।
তুর্কি সংস্কৃতি অনুসারে, যে সত্যিকার অর্থে ইসলাম গ্রহণ করে তাকে ‘মুহতাদি’ বলা হয় এবং যে বাহ্যিকভাবে ইসলাম গ্রহণ করে তাকে বলা হয় ‘মুনাফিক’। কিন্তু এই দলটির জন্য ‘দুনমা’ নামটিই নির্দিষ্ট। এর প্রতিষ্ঠাতা সাবাতাই জেভি। সেই সূত্রে দলটিকে ‘সাবাতিয়া’ও বলা হয়।
প্রতিষ্ঠাতা এবং আধ্যাত্মিক পিতা
সাবাতাই জেভির হাতে এই দলটির জন্ম। তিনি ১৬২৬ সালের জুলাই মাসে তুরস্কের ইজমির শহরে জন্মগ্রহণ করেন। ১৫ শতকের শেষের দিকে, স্পেনে ইসলামী রাষ্ট্রের শেষ দুর্গের পতনের পরে যখন ধর্মীয় নিপীড়ন এবং ইনকুইজিশন শুরু হয়, তখন তার বাবা-মা তুরস্কে চলে আসে। মোর্দেচাই জেভির ৩ সন্তানের মধ্যে সাবাতাই ছিলেন কনিষ্ঠ। সাবাতাইয়ের বাবা ছিলেন একজন সচ্ছল ব্যবসায়ী।
তার মা তাকে চোখে চোখে বড় করেছিলেন। কারণ, তার মা ছেলের ধর্মীয় বই পড়ার প্রতি আগ্রহ দেখে ভাবতেন, এই ছেলে একদিন বড় ইহুদি রাব্বি হবে। তিনি ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী, চতুর, সতর্ক। তিনি পড়েন তাওরাত এবং তালমুদ। তিনি ছিলেন রূপক ব্যাখ্যায় পারদর্শী। তিনি কাব্বালা নামে পরিচিত অধ্যায়গুলো অধ্যায়নে নিজেকে নিমগ্ন করেছিলেন। এই অধ্যায়গুলোতে যে আধ্যাত্মিক এবং দার্শনিক বিশ্বাস ও শিক্ষার বয়ান রয়েছে, সেগুলো ছিল তাওরাতের গুপ্ত ব্যাখ্যার উপর নির্ভরশীল। সাবাতাই এই বিশ্বাসগুলোই ধারণ করেন।
বড় হয়ে তিনি একজন তিনি একজন রাব্বি হয়েছিলেন। তিনি অধ্যাপনাও করতেন। তার বয়ান ও লেকচার মানুষকে মুগ্ধ করতো।
শেকড় ও বেড়ে ওঠা
সাবাতাই উচ্চাকাঙ্ক্ষী ছিলেন। তিনি কিছু পুরোহিতের কাছে জানতে পারেন, ১৬৪৮ সালে যিশু খৃস্টের মাসিহ হিসেবে আবির্ভাব হবে। তাই তিনি নিজেকে মাসিহ হিসেবে প্রস্তুত করতে শুরু করেন। তিনি এমন আচার-অনুষ্ঠান করতে শুরু করেন যার সাথে ইহুদি ধর্মের কোনও সম্পর্ক নেই। টানা উপবাস করতেন, ঘন ঘন স্নানে যেতেন। ২২ বছর বয়সে তিনি এক মহিলাকে বিয়ে করেন। তবে প্রতিশ্রুত মাসিহের প্রস্তুতির অজুহাতে ওই মহিলাকে তিনি স্পর্শও করেননি।
তিনি কিছু হিব্রু ধর্মীয় গ্রন্থেরও সদ্ব্যবহার করেছিলেন, যা বিশ্ব শাসনকারী নতুন মাসিহের সুসংবাদ দেয়। তার চারপাশে অনেক ছাত্র জুটে যায়। তারা তার কথা মুগ্ধ হয়ে শুনতো। ১৯৪৮ সালে তিনি দাবি করে বসেন, তিনিই প্রতিশ্রুত মাসিহ, যিনি জেরুজালেমকে ইহুদি রাষ্ট্রের রাজধানী হিসাবে গ্রহণ করবেন।
তিনি নিজেকে ‘ঈশ্বরের প্রথমজাত পুত্র’ এবং ‘যিহোবার প্রথম একমাত্র পুত্র’ বলে পরিচয় দিতেন। তিনি ইহুদিদের আইন অনুসারে নিষিদ্ধ অনেক জিনিসের অনুমতি দিয়েছিলেন। উল্টে দিয়েছিলেন অনেক ইহুদি আইন। তাই ইজমিরের ইহুদি সম্প্রদায়ের প্রধান রাব্বি জোসেফ স্কাপা ঘোষণা করেছিলেন, সাবাতাই ইহুদি আইনের বহির্ভূত জিনিস পালন করছে। এবং রাব্বিরা তার মৃত্যুদণ্ডও দেয়।
ইজমিরে বিপদ টের পেয়ে তিনি ইস্তাম্বুলে চলে যান। সেখানে ইহুদি মুক্তির ধারণা প্রচার করতে শুরু করেন। অনেক মানুষ তাকে বিশ্বাসও করতে শুরু করে। এমনকি ইজমির, রোডস, প্রুশিয়া, সোফিয়া, এডিরনে, গ্রীস এবং জার্মানি থেকে তার নিকট প্রতিনিধি দলও আসে। তারা তাকে ডাকতো ‘রাজাদের রাজা’ বলে।
তাকে বিশ্বাসকারী ইহুদিরা অপেক্ষা করছিল প্রতিশ্রুত মুক্তির দিনের। তারা নিজেদেরকে শুদ্ধ করার জন্য পৃথিবীর সব আনন্দ ত্যাগ করেছিল। কাজ এবং ব্যবসা ছেড়ে দিতে শুরু করেছিল। রাতে তারা মোমবাতি হাতে সাবাতাইকে ডাকতে ডাকতে পথে বেরিয়ে পড়তো। ইহুদিদের এই পাগলামির সুযোগ নিয়েছিলেন সাবাতাই। তিনি প্রবাসী, যাযাবর ইহুদিদের সমর্থন জয় করার চেষ্টা করেন। তিনি বলেন, তিনি তাদের সমস্ত শত্রুদের কাছ থেকে ইহুদিদের প্রতিশোধ নেবেন এবং তিনি তার ইহুদি রাজ্য থেকে বিশ্ব শাসন করবেন। তার আহ্বান জেরুজালেমে ইহুদিদের জড়ো হওয়ার স্বপ্নকে সুড়সুড়ি দিয়েছিল। ইহুদিরা সলোমান টেম্পল পুননির্মাণ করে। হ্যামবুর্গ, আমস্টারডাম এবং পোল্যান্ডের রাস্তায় রাস্তায় খ্রিস্টের আবির্ভাব এবং পরিত্রাণের আসন্নতায় আনন্দ উদযাপন করে।
তখন ইজমিরের ধর্মগুরু এবং ইহুদি রাব্বিরা অটোমান সাম্রাজ্যকে সাবাতাই থেকে দূরে থাকার পরামর্শ দেন। সাবাতাই তখন তার সঙ্গীদের নিয়ে থেসালোনিকি শহরে পালিয়ে যান এবং সেখানে 8 বছর বসবাস করেন। একসময় তিনি ঘোষণা দেন, তাওরাতের সাথে তার বিয়ে হয়েছে। এ ঘোষণার পর ইহুদি ধর্মীয় আদালত তাকে কাফের এবং তার মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা দেয়। তখন তিনি এথেন্সে পালিয়ে যান। তারপর ইজমিরে এবং সেখান থেকে আবার ইস্তাম্বুলে ফিরে আসেন।
তিনি ১৬৬৩ সালে জেরুজালেম পরিদর্শন করেন। ঘোড়ার পিঠে চড়ে শহরের চারপাশে প্রদক্ষিণ করেন ৭ বার। তিনি ঘোষণা দেন, তার হাতেই ইহুদির মুক্তি ঘটবে। এবার মিশরের ইহুদি সম্প্রদায়ের প্রধান রাফেল ইউসেফ চালাবি তাকে বিশ্বাস করেন। তার পেছনে ব্যয় করেন বিপুল অর্থ। তাকে বিশ্বাস করেন গাজার জার্মান বংশোদ্ভূত ইহুদি নাথান হালেভি। হালেভি মানুষের কাছে নিজেকে সাবাতাইয়ের বার্তাবাহক বলে পরিচয় দিতে শুরু করেন।
কিছু খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের মধ্যে জনপ্রিয় ছিল, মসিহ আসবেন ১৬৬৬ সালে। সাবাতাই এই সুযোগটিও গ্রহণ করেন। তিনি সারা নামে একটি পোলিশ মেয়ের সাথে পরিচিত হন, যে মেয়ে ইহুদিদের মধ্যে একটি গুজব ছড়িয়েছিল, ১৬৬৬ সালে একটি আলো জ্বলবে এবং সে এই আলোর মালিককে বিয়ে করবে। এই মেয়েকে সাবাতাই ১৬৬৪ সালে এই মেয়েকে বিয়ে করে নেন। কিন্তু এই মেয়েকে তিনি স্পর্শও করলেন না।
ইসলাম গ্রহণ
সাবাতাই এবং ইহুদি রাব্বিদের মধ্যে দ্বন্দ্ব তীব্র হয়। কারণ তার ইহুদি উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত বিশ্বাসের লঙ্ঘন, কাল্পনিক গল্প ছড়িয়ে দেওয়ার প্রবণতা। কাল্পনিক গল্পগুলোকে তিনি প্রচার করতেন মুজেযা বলে। রাব্বি নেহিমা কোহেন অটোমান সুলতানকে জানালেন, সাবাতাই অটোমান সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ এবং ইহুদিদের জন্য তার ব্যয়ে একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করছেন।
অটোমান কর্তৃপক্ষ তাকে বন্দী করে বিচারের মুখোমুখি করে। নিজেকে নবি দাবি করার অভিযোগে তার মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। তাই সাবাতাই নিজেকে এবং তার শিষ্যদের বাঁচানোর সিদ্ধান্ত নেন। তিনি ১৬৬৬ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর ইসলাম গ্রহণের ঘোষণা দেন। সুলতান মুহাম্মদ চতুর্থ তাকে ক্ষমা করে দেন এবং রাজপ্রাসাদে চাকরিও দেন। সাবাতাই তার নাম পরিবর্তন করে মুহাম্মদ আজিজ এফেন্দি রাখেন। জুব্বা-পাগড়ি পরেন।
বলা হয় যে, তিনি তুর্কি ভাষায় সাবলীল ছিলেন না। সুলতানের ডাক্তার মুস্তফা হায়াতি, যিনি একজন প্রাক্তন ইহুদি ছিলেন, ট্রায়াল কমিটি এবং সাবতাইয়ের মাঝে দোভাষীর কাজ করতেন। সাবাতাই কথা বলতেন স্প্যানিশ ভাষায়। ডাক্তার যখন দেখলেন, সাবাতাইয়ের বিচার তার মৃত্যুদন্ডের দিকে যাচ্ছে, তিনি সাবাতাইকে পরামর্শ দিলেন ইসলাম গ্রহণ করার। তাই তিনি ইসলাম গ্রহণ করে ফেলেন।
তার ইসলাম গ্রহণে অনেক ইহুদি হতাশ হয়েছিল। কারণ তাদের ত্রাণকর্তা কাঙ্ক্ষিত ইহুদি স্বপ্ন অর্জনের পরিবর্তে ইসলাম গ্রহণ করেছিল। সাবাতাই তাদেরকে জানালেন, তার ইসলাম গ্রহণ একটি আনুষ্ঠানিকতা মাত্র। এই জুব্বা-পাগড়ির নিচের সাবাতাই মসিহ হতে চলেছেন।
সাবাতাই প্রস্তাব জানালেন, তিনি ইহুদিদের ইসলামের দিকে দাওয়াত দিতে চান। অটোমান সরকার তাকে অনুমতি দেয়। তিনি একটি বৃহৎ সংখ্যক ইহুদিকে ইহুদি ধর্মের সাথে মিল রেখে ইসলামের সাথে পরিচয় করিয়ে দেন। তারা বাহ্যিকভাবে ইসলামিক ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান পালন করতে শুরু করে। নাম পরিবর্তন করে। কিন্তু তারা গোপনে তাদের প্রত্যেকের একটি বিশেষ ইহুদি নাম রাখে এবং তাদের নিজস্ব পোষাক প্রথা বজায় রাখে। তাদের নিজস্ব স্কুল এবং কবরস্থানও ছিল। তবে সাবাতাই বলে দিয়েছিলেন, তুর্কি মুসলিমদের আচার-অনুষ্ঠান বেশ মন দিয়ে পালন করতে হবে, যেন কেউ সন্দেহ করতে না পারে।
এই জেভি আন্দোলন একটি ব্যাপক গতি পায়। উরোপ এবং উত্তর আফ্রিকার দেশগুলিতে ছড়িয়ে পড়ে। অটোমান সাম্রাজ্য তাদের প্রজাদের ধর্মীয় স্বাধীনতা থাকার কারণে তাদের কার্যকলাপকে বাধা দেয়নি। রাষ্ট্রের কিছু কর্তা আসন্ন বিপদ টের পেতে শুরু করেন। কারণ, এর আগেই অটোমান গোয়েন্দা সংস্থা বেশ কয়েকটি প্রতিবেদনে জানিয়েছিল, এরা ইসলামের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে।
সাবাতাইয়ের ইসলাম গ্রহণের ১০ বছরেরও বেশি সময় পরে এটি স্পষ্ট হয়ে যায় যে, তিনি কেবলমাত্র দেখানোর জন্য ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। তার লক্ষ্য ছিল ইসলামকে ভিতর থেকে আঘাত করা। তাই তাকে তার কিছু অনুসারীসহ গ্রেপ্তার এবং আলবেনিয়ায় নির্বাসিত করা হয়। তিনি সেখানে ৫ বছর অবস্থান করেন, দূর থেকে তার অনুসারীদের সাথে যোগাযোগ রাখেন।
দুনমা সংবিধান
সাবাতাই কিছু রীতি তৈরী করেন, যার উপর দুনমা আন্দোলনের ভিত্তি রাখা হয়। এরমধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল:
১. এই বিশ্বাস রাখতে হবে, ইজরাইলের ঈশ্বরই সত্য ঈশ্বর।
২. ঈশ্বরের মসিহ প্রকৃত মসিহ। তিনি ছাড়া কোনো মুক্তিদাতা নেই।
৩. সাবাতাই তাদের নেতা, তাদের রাজা। তিনি দাউদের বংশধর।
৪. একটি সম্প্রদায় থেকে অন্য সম্প্রদায়ে খ্রিস্টের রহস্যের প্রেরণ ব্যাখ্যা এবং অধ্যয়ন করতে হবে।
৫. বিশ্বাস রাখতে হবে, তাওরাত সত্য তাওরাত। এতে কোনো পরিবর্তন হয়নি।
৬. মৃত্যুকে বিশ্বাস করতে হবে।
৭. ইহুদি বছরের নবম মাস কিলসেফের ১৬ তারিখ তার অনুসারদের একত্র হতে হবে।
৮. মুসলিমদের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া যাবে না।
৯. একাধিক বিয়ে করা যাবে না।
১০. জন্মের অষ্টম দিন খতনা করাতে হবে।
সম্প্রদায়ের ধারাবাহিকতা এবং তার বিভাজনের প্রকাশ
সাবাতাইয়ের মৃত্যুর পর দুনমার কার্যক্রমের কেন্দ্র ১৯২৪ সাল পর্যন্ত থেসালোনিকিতে থাকে। এরপর তাদের বেশিরভাগই ইস্তাম্বুলে বসতি স্থাপন করে। কেউ কেউ ইজমির, আঙ্কারা এবং বুর্সার মতো অন্যান্য শহরে চলে যায়।
তারা মূল দল ছাড়াও আরও দুটি দলে ভাগ হয়ে যায়:
এক. জ্যাকোবাইটস
সাবাতাই তার মৃত্যুর আগে তার স্ত্রীর ভাই জ্যাকব চালাবির কাছ থেকে প্রতিশ্রুতি নিয়েছিলেন, সে রাষ্ট্রপতি পদে তার উত্তরাধিকারী হবে। সাবাতাইয়ের মৃত্যুকে একটি শারীরিক পরিবর্তন হিসাবে ব্যাখ্যা করা হয়। বলা হয়, তার আত্মা জ্যাকবের মধ্যে উপস্থিত হয়েছে। এ দলে ছিল দুই শতাধিক পরিবার।
এই দলটি সাবাতাইয়ের শিক্ষার বিপরীত কিছু কাজ করে। যেমন তালাক নিষিদ্ধ ছিল। তারা সেটাকে অনুমোদন দেয়। তাদের একটি দল অটোমান সাম্রাজ্যে গুরুত্বপূর্ণ পদ গ্রহণ করে। এদের একটি দল ইসলামের কিছু আপাত বিধান মেনে চলতে অনিহা প্রকাশ করে এবং ১৬৮৯ সালে তারা জ্যাকবদের থেকে আলাদা হয়ে যায়। তারা বলে, সাবতাইয়ের আত্মা উসমানের মধ্যে এসেছে। উসমান সাবাতাইয়েল মৃত্যুর ৯ মাস পর জন্মগ্রহণ করে। সে যখন ৪০ বছর বয়সে পৌঁছে, নিজেকে মসিহ দাবি করে।
দুই. কাবাঞ্জিয়া
তারা এমন একটি গোষ্ঠী যারা সাবাতাইয়ের নীতিগুলিকে তাদের মতো করে প্রয়োগ করতে চেয়েছিল। তারা জ্যাকব এবং উসমানকে প্রত্যাখ্যান করে ১৮২০ সালে আলাদা হয়ে যায়। এই গ্রুপের অনুসারীদের ইউরোপে শিল্প, বাণিজ্য এবং ব্যাংকিং ব্যবসায় একটি উল্লেখযোগ্য কার্যক্রম ছিল। তারা শিক্ষার ক্ষেত্রে খুব মনোযোগ দিয়েছিল এবং তারা তাদের সন্তানদের শিক্ষিত করার জন্য স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছিল। তুরস্কের সুলতান আবদুল হামিদকে সিংহাসন থেকে নামানোর জন্য ইয়াং তুর্ক পার্টির যে অভ্যুত্থান হয়েছিল, তারা তাতে প্রধান ভূমিকা পালন করেছিল। এরপর দুনমা ইহুদিরা তুর্কি সমাজে অনুপ্রবেশ ও অনুপ্রবেশ করে দলে দলে। সমস্ত রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য প্রভাবও তৈরী করে ফেলে।
অর্থনৈতিক প্রভাব
দুনমা ইহুদিদের শিল্প, বাণিজ্য এবং ব্যাংকিং বিষয়ে অভিজ্ঞতা ছিল। তারা ইউরোপীয় এবং আমেরিকান ইহুদি কোম্পানি থেকে আর্থিক সহায়তাও পেয়েছিল। ফলে তারা তাদের লক্ষ্য এবং প্রচেষ্টা অর্জনের জন্য একটি অর্থনৈতিক শক্তিও গঠন করে ফেলে। তাদের মধ্যে এমন ব্যক্তিত্ব ছিলেন যারা তুরস্কের অর্থনীতিতে মৌলিক ভূমিকা পালন করেছিলেন। এদের প্রথম সারিতে রয়েছেন অটোমান সাম্রাজ্যের অর্থমন্ত্রী মুহাম্মদ জাভিদ বে। তিনি বাণিজ্যিক চুক্তি করতেন এবং ফিলিস্তিনে ইহুদিদের অভিবাসন সহজতর করার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ সরবরাহ করতেন। তিনি ইহুদিদের লক্ষ্য অর্জনের জন্য অটোমান সাম্রাজ্যের উপর অনেক চাপ প্রয়োগ করেছিলেন। অর্থনীতিতে মোশে আল-আতিনিরও একটি বিশিষ্ট ভূমিকা ছিল। তিনি তামাক, মদ এবং আফিম ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করতেন এবং রাজ্যের অনেক কোম্পানি নিয়ন্ত্রণ করতেন। ..
রাজনৈতিক প্রভাব
দুনমা ইহুদিরা অটোমান সাম্রাজ্যের গভীরে আঘাত হানতে একটি রাজনৈতিক শক্তি গঠন করেছিল। এরাই অটোমান সাম্রাজ্যকে দুর্বল করার জন্য কাজ করে এবং পতন ঘটায়। তাদের অনেকে অটোমান সাম্রাজ্যের গুরুত্বপূর্ণ পদও দখল করে। তারা সুলতান আব্দুল হামিদ দ্বিতীয়কে উৎখাত করতে এবং উসমানীয় খিলাফতের ধ্বংসাবশেষের উপর একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে চাওয়ার আন্দোলনে জড়িত থাকার মাধ্যমে তারা তাদের রাজনৈতিক প্রভাব প্রমাণ করে।
কামাল পাশা ইহুদী কবলিত দূনমা (প্রত্যাবর্তনকারী) সম্প্রদায়ের সদস্য ছিলেন। পরবর্তীতে এ সম্প্রদায়ের লোকেরা তুরস্কে Comittee of Union and Progressনামক দল গঠন করে। এ দলের সদস্যগণ অনেক তুর্কী যুবককে নিজ দলে অন্তর্ভুক্ত করে এবং সালতানাতের অনেক বড় পদ দখল করে। ১ম বিশ্বযুদ্ধের প্রাক্কালে দানিয়ুব প্রদেশের গভর্নর মাদহাত পাশা এবং ড. নাজেম, ফওজী পাশা, ছগুম আফেন্দী প্রমুখ গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিতে পরিণত হন। এসব ব্যক্তি তুর্কী সেনাবাহিনীতে একটি গোপন ইউনিট গড়ে তোলে এবং ১ম বিশ্বযুদ্ধের সময় উক্ত ইউনিট কামাল পাশার নেতৃত্বে তুর্কী সুলতানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে ও তুর্কী খেলাফত ধ্বংস করে। কামাল পাশা ইহুদীদের গোপন আন্দোলন ফ্রী ম্যাসন এর সদস্য ছিলেন। ইহুদীদের নির্দেশে সে তুরস্ক থেকে ইসলামকে উচ্ছেদ করার কর্মসূচি গ্রহণ করে।
ইমানুয়েল কারা সোউ ছিলেন অ্যাসোসিয়েশন ফর ইউনিয়ন অ্যান্ড প্রগ্রেসের একজন বিশিষ্ট সদস্য, থেসালোনিকির পার্লামেন্টের সদস্য, এর বাণিজ্য বিভাগের একজন ডেপুটি, তারপর ইস্তাম্বুলের সংসদের সদস্য। যে তিন সদস্যের প্রতিনিধি দল সুলতান আবদুল হামিদের কাছে তাকে উৎখাতের খবর পৌঁছিয়েছিল, তিনি ছিলেন তাদের একজন।
১৯২৩ সালে তুর্কি জাতীয় পরিষদ তুরস্কে প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেয় এবং মোস্তফা কামাল আতাতুর্ককে নির্বাচিত করে। ক্ষমতায় পৌঁছতে তাকে সাহায্য করেছিল দুনমা ইহুদিরা।
মিডিয়ার প্রভাব
দুনমা ইহুদিরা উসমানীয় সাম্রাজ্যের প্রধান সংবাদপত্র ও ম্যাগাজিনগুলোকে অর্থায়ন বা মালিকানাধীন করে নিয়ন্ত্রণ করত। যেমন ইসলাম বিরোধী ম্যাগাজিন ‘ইজতিহাদ’, ‘ইয়ং তুর্ক’ এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ থিসালোনিকি সংবাদপত্র ‘লুনার’।
ইহুদি পরিবারগুলো মিডিয়ায় তাদের ব্যাপক প্রভাবের জন্য বিখ্যাত ছিল। যেমন ‘কাব্বানজি’, ‘কাবার’ এবং ‘ইপেকি’ পরিবার। আর্থিক সহায়তার মাধ্যমে তারা তাদের লক্ষ্য অনুযায়ী তুর্কি মিডিয়াকে নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনা করতে সক্ষম হয়েছিল।
আধুনিক প্রজাতন্ত্রের আবির্ভাবের সাথে সাথে মিডিয়ার উপর ইহুদিদের নিয়ন্ত্রণ বৃদ্ধি পায়। যেমন ‘হুরিয়েত’ পত্রিকার মতো সর্বাধিক বিস্তৃত ম্যাগাজিন এবং সংবাদপত্রের মালিক ছিল দুনমা ইহুদি সাদাদ সিমাভি। এটি এটি তুরস্কের সবচেয়ে বিস্তৃত সংবাদপত্র এবং এর প্রচার প্রতিদিন এক মিলিয়ন কপি। এই প্রতিষ্ঠানটি একটি প্রকাশনা সংস্থা এবং বেশ কয়েকটি সাময়িকীর মালিক। এই মিডিয়া পত্রিকাটি ফিলিস্তিনের ভূমিতে একটি ইহুদিবাদী রাষ্ট্রকে মেনে নিতে তুর্কি জনমত তৈরি করে।
দুনমা ইহুদিদের মালিকানাধীন ‘কোয়ান আইদিন’ পত্রিকা তুরস্কের সর্বোচ্চ দ্বিতীয় প্রচারিত সংবাদপত্র। তুরস্কে প্রচারের দিক থেকে তৃতীয় স্থানে রয়েছে ‘তর্জুমান’। র্যাঙ্কিংয়ে চতুর্থ স্থানে রয়েছে ‘মালিত’। এই পত্রিকাগুলো আন্তর্জাতিক ইহুদি ধর্মের সেবক সামি কোহেনের নিবন্ধগুলোর জন্য বিখ্যাত।
তাদের প্রভাব শুধু লিখিত মিডিয়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না, বরং অডিও-ভিজ্যুয়াল মিডিয়াতেও প্রসারিত ছিল। তারা রেডিও এবং টেলিভিশন নিয়ন্ত্রণ করত। দুনমার অন্তর্গত অনেক লেখক এবং মিডিয়া পেশাদারের আবির্ভাব হয়। যেমন খালেদা আদিব, আহমেদ আমিন ইয়েলমান, আবদি ইবেকজি, ইসমাইল জাম এবং অন্যান্যরা। তারা দুনমার মালিকানাধীন বা পরিচালিত মিডিয়া চ্যানেলগুলির মাধ্যমে পাশ্চাত্য এবং মার্কসবাদী মতবাদ সম্প্রচার করতো।
তারা তুর্কি জাতীয়তাবাদের চেতনাকে উজ্জীবিত করতে, অটোমান সাম্রাজ্য এবং তার লোকদের ভাবমূর্তি বিকৃত করতেও অবদান রেখেছিল। কারণ তারা ধর্মনিরপেক্ষ তুর্কি রাষ্ট্রকে উন্নীত করেছিল। তারা ইহুদিদের ভাবমূর্তি উন্নত করতে, আরবদের প্রতি ঘৃণা ছড়াতে এবং অন্যান্য ধ্বংসাত্মক লক্ষ্যে কাজ করেছিল।
সূত্র : আল জাজিরা