আবদুল্লাহিল বাকি:
দারুল উলুম দেওবন্দের পরিচয় ও আদর্শকে পরিচয় করিয়ে দেবার মত বিশেষ কোন ব্যাখ্যার প্রয়োজন নেই। তারা এমন কোন দল নয়, যারা মুসলিম জাতির অধিকাংশ অংশের বাইরে গিয়ে নতুন কোন মতবাদ বা দর্শন দাঁড় করিয়েছে। চৌদ্দশ বছর ধরে অধিকাংশ গ্রহণযোগ্য উলামায়ে কেরাম ইসলামের যেই ব্যাখ্যা দিয়ে এসেছেন, উপস্থাপনার ক্ষেত্রে যেই রীতি অবলম্বন করেছেন—সেটাই দেওবন্দের আদর্শ। ইসলাম ধর্মের উৎস হলো কুরআন ও সুন্নাহ। আর কুরআন সুন্নাহর শিক্ষাধারার সামগ্রিক পাঠই দেওবন্দের আলেমগণের ভিত্তিগত মূল।
শাইখুল ইসলাম আল্লামা তাকি উসমানী দা.বা. বলেছেন, ‘আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামায়াহর আকিদা বিষয়ক যেকোন গ্রহণযোগ্য গ্রন্থ তুমি হাতে তুলে নাও, পড়ো। সেখানে আকিদা সম্পর্কে তুমি যা কিছুই পাবে, সেটাই দেওবন্দের আলেমদের আকিদা। হানাফী মাজহাবের উপর লিখিত ফিকহ ও উসুলে ফিকহ বিষয়ক যত গ্রহণযোগ্য গ্রন্থ আছে, সবগুলোই দেওবন্দের আইনশাস্ত্র ও ব্যবহারতত্ত্বের উৎস। বিশুদ্ধ তাসাউফ ও ইসলামী নীতিশাস্ত্রের গ্রন্থাবলিতে যেসব দৃষ্টিভঙ্গি বিবৃত হয়েছে, সেটাই দেওবন্দের দৃষ্টিভঙ্গি—তাসাউফ ও পরিশুদ্ধির ক্ষেত্রে।’
কিন্তু তারপরও কেন তাদের পরিচয় আলাদা করে তুলে ধরতে হয়?
কারণ, প্রথমত বলা যায়, আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামায়াহ একটি মধ্যমপন্থি দল। সে হিসেবে দেওবন্দের মাঝেও এই মধ্যমপন্থার গুণটি বিদ্যমান। তবে মধ্যমপন্থার একটি বহিরাগত বিপদ আছে। একদিকে চরমপন্থি, অন্যদিকে প্রগতিপন্থিরা এর ভীষণ শত্রু হয়ে দাঁড়ায়। মধ্যমপন্থি সম্পর্কে তাদের ধারণা বিপরীতধর্মী প্রতিক্রিয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে থাকে। কারণ, প্রান্তিকদের কাছে মধ্যপন্থার কোন ধারণা নেই। এজন্যই চরমপন্থিরা দেওবন্দকে মনে করে প্রগতিশীল। আবার প্রগতিশীলরা একে মনে করে চরমপন্থি। এজন্যই এর পরিচয় স্পষ্ট করার জরুরত পড়ে।
তাছাড়া দেওবন্দের যারা প্রতিষ্ঠাতা মহাপুরুষ, তারা যেমন আহলুস সুন্নাহর আদর্শগত দিকে অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়েছেন, তেমনিভাবে কর্মের বাস্তবায়নও ছিল তাদের নিচ্ছিদ্র লক্ষ্য। এজন্য শুধুমাত্র পূর্ববর্তীদের কেতাবী উল্লেখে দেওবন্দের পরিচয় স্পষ্ট নাও হতে পারে। বর্তমান যুগের প্রেক্ষাপটে তাদের বাস্তবায়নের নমুনা কী ছিল, সেটাও সামনে আসা প্রয়োজন।
পরিচয় ও বৈশিষ্ট্য
সংজ্ঞা পেশ করতে গেলে অনেক ক্ষেত্রেই অস্পষ্টতা ও প্রান্তিকতার শিকার হতে হয়। তাছাড়া এতে মৌলিক বিষয়গুলোও উঠে আসে না সম্পূর্ণভাবে। এজন্যই দেওবন্দি চিন্তার স্বরূপ ও বৈশিষ্ট্য অনুধাবন করতে হলে কয়েকটি বিষয় বুঝে রাখা জরুরী।
‘দেওবন্দি’ শব্দটির সম্বন্ধ কেবলমাত্র তাদের সাথে নয়, যারা দারুল উলুম দেওবন্দের প্রতিষ্ঠা থেকে আজ অবধি সেটার গণ্ডিতে পাঠদান, পাঠ-গ্রহণ, ফতোয়া-প্রদান, লেখালেখি ইত্যাদির সাথে যুক্ত। বরং এর অধীনে আসবে সামাগ্রিকভাবে তারাই, যারা চিন্তা-ভাবনা, মনন-মানস গ্রহণ করে— মুজাদ্দিদে আলফে সানি আহমদ সেরহিন্দী রহ. (১৬২৪ ঈ.), ইমাম শাহ ওলিউল্লাহ দেহলবী রহ. (১৭৬২ ঈ.), ইমাম কাসেম নানুতবী রহ. (১৮৮০ ঈ.), ফকিহ রশিদ গাঙ্গুহী রহ. (১৯০৫ ঈ.), শায়খ ইয়াকুব নানুতবী রহ.(১৮৮৪ ঈ.) থেকে।
এক্ষেত্রে তারা সরাসরি দারুল উলূম দেওবন্দ থেকেও ফারেগ হতে পারে। অথবা উপরোক্ত পূর্বসূরীদের চিন্তার আলোকে পরিচালিত অন্য কোন মাদরাসা থেকে। এই চিন্তাকে ধারণ করার পর তাকে কেবল মাদরাসায়ই পাঠ-দান করতে হবে— এমন কোন আবশ্যকীয়তা নেই। হতে পারে তারা সামাজিক ও রাজনৈতিক ময়দানের কর্মী। ছড়িয়ে যেতে পারে তাবলিগের কাজ নিয়ে সারা বিশ্বে। হতে পারে সে কোন লেখক, সাহিত্যিক অথবা গবেষক। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে সকলেই দারুল উলুম দেওবন্দের আলেম।
‘দেওবন্দি অথবা ‘কাসেমী’ কোন দলীয় উপাধী নয়। যা কোন এক পার্টি অথবা জাতীয়তার অধীনে অর্জিত হয়। ‘দেওবন্দ’ সম্বন্ধটি একটি শিক্ষাগত সম্বন্ধ। তেমনিভাবে ‘কাসেমী’ সম্বন্ধটিকেও ধরা হয় একটা সনদের সিলসিলা হিসেবে। ব্যবহৃত হয় তাদের ক্ষেত্রে যাদের হাদিসের পরম্পরা কাসেম নানুতবীর সাথে যুক্ত। যেমনিভাবে আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়ালেখা শেষ করলে তাকে ‘আলিগড়ী’ বলা হয়। জামিয়া মিল্লিয়ায় পড়লে তাকে বলা হয় ‘জামেয়ী’ প্রভৃতি।
দেওবন্দের বৈশিষ্ট্যের ক্ষেত্রে বলা যায়, যেহেতু তারা আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামায়াতের অন্তর্ভুক্ত— তাই হাদিসে তাদের সম্পর্কে যেসব বৈশিষ্ট্য ও গুণাবলির কথা উল্লেখিত হয়েছে, সেসব হুবুহু দেওবন্দের উপর প্রতিফলিত হয়েছে। তবুও দেওবন্দের বৈশিষ্ট্যের জন্য সংক্ষিপ্তভাবে একটা পরিচয় দাঁড় করানো যায় এভাবে— কুরআন ও সুন্নাহর উপর আমল করা, তবে সালাফের ব্যাখ্যার আলোকে।
‘কুরআন ও সুন্নাহর উপর আমল করা’ এর ব্যাখ্যা হলো— দ্বীনের বিধান আহরণের ক্ষেত্রে তারা চারটি বিষয়কে ভিত্তি হিসেবে মেনে নিয়েছেন। এক. কুরআন। দুই. সুন্নাহ। তিন. ইজমা। চার. মুজতাহিদগণের ইজতিহাদ। প্রথম দুটি হলো মৌলিক। শেষের দুটি হলো শাখা। এভাবেই কুরআন সুন্নাহর উপর আমল করা হয়ে যাচ্ছে।
আর ‘সালাফের ব্যাখ্যার আলোকে’ অংশের ক্ষেত্রে বলা যায়, দেওবন্দের সালাফ চিন্তার নিজস্ব মানদণ্ড আছে। পূর্বের সকল আলেমই দেওবন্দের সালাফ নয়। যেসকল আলেম দেওবন্দ চিন্তার ক্ষেত্রে অনুকরণীয়— তাদের একটা উদাহরণস্বরূপ তালিকা পেশ করেছেন কারী তৈয়ব সাহেব রহ.। সেখানে যাদের নাম উল্লেখ করেছেন—
মুজতাহিদ আলেমগণ— আবু হানিফা, মালিক বিন আনাস, শাফেয়ী, আহমদ বিন হাম্বল রহিমাহুমুল্লাহ প্রমুখ।
মুহাদ্দিস আলেমগণ— বুখারী, মুসলিম, তিরমিজি, আবু দাউদ রহিমাহুমুল্লাহ প্রমুখ।
ফকিহ আলেমগণ— আবু ইউসুফ, মুহাম্মদ বিন হাসান শাইবানী, মুযানী, দাউদ তায়ী, যাআফরানী, ইবনুল কাসিম, ইবনে ওয়াহাব, ইবনে রজব হাম্বলী রহিমাহুমুল্লাহ প্রমুখ।
দর্শন ও তাত্ত্বিক জ্ঞানের ক্ষেত্রে— রাযী, গাযালী, শাতেবী, শাহ ওলিউল্লাহ দেহলবী রহিমাহুমুল্লাহ প্রমুখ।
উসুলুল ফিকহের ক্ষেত্রে— ফাখরুল ইসলাম বাযদাভী, আল্লামা দাবুসী রহিমাহুমুল্লাহ প্রমুখ।
তাসাউফের ক্ষেত্রে— জুনাইদ, শিবলী, মারুফ কারখী, বায়েজিদ বোস্তামী রহিমাহুমুল্লাহ প্রমুখ।
এখানে যেসকল আলেমদের কথা উল্লেখ করা হলো এবং তাদের মত চিন্তাধারার যাদের নাম উল্লেখ করা যায়নি— তারা সকলে দেওবন্দের পতাকাবাহীদের অনুকরণীয় ও সম্মানযোগ্য। তাদের সকলকে সমানভাবেই গ্রহণ করা হয়। তেমনিভাবে তারা যেসব জ্ঞানে ব্যুৎপত্তিমূলক যোগ্যতা অর্জন করেছেন— সে সকল জ্ঞানই চর্চা করে দেওবন্দের চিন্তায় অনুপ্রাণিত আলেমগণ। একটিকে ছেড়ে আরেকটিকে আবার অধিক অগ্রাধিকার দেয়না।
দেওবন্দ চিন্তা একইসাথে গুরুত্ব দেয় কিতাব ও কাতিব, গ্রন্থ ও গ্রন্থকের ব্যপারে। কারী তৈয়ব সাহেব রহ. এটাকে খোলাসা করতে গিয়ে বলেছেন—‘দেখা যাচ্ছে— দেওবন্দের আলেমগণের চিন্তাধারা কেবলমাত্র মৌলতন্ত্র (Fundamentalism) যেমন নয়, তেমনিভাবে ব্যক্তিকেন্দ্রিকও (Personalism) নয়। ইসলামের উপলব্ধি ও দীক্ষার জন্য তাদের ক্ষেত্রে যথেষ্ঠ নয় কেবল লিখিত বস্তু। বরং এর সাথে লেখক সত্ত্বারও সংমিশ্রণ জরুরী। নিছক অধ্যয়ন, পাঠদান, ব্যক্তিগত চিন্তা, ব্যক্তিগত কথা পৃথক পৃথকভাবে— দেওবন্দের চিন্তাধারায় একাত্ম হবার জন্যে যথেষ্ঠ নয়। দেওবন্দি চিন্তার বলয় গঠিত হয়েছে—যেমনিভাবে কিছু কানুন ও মূলনীতির মাধ্যমে, তেমনিভাবে কিছু ব্যক্তিত্বের সংস্পর্শে। সামগ্রিকতা, মধ্যপন্থা, ঐতিহ্যিকতা— দেওবন্দি চিন্তার সঞ্জীবনী শক্তি। তাদের কর্ম (Deed) ও আদর্শের (Idea) সূচনা কুরান হাদিস থেকে। পথের সহযোগী ফিকহ ও কালাম। সমাপ্তি ইহসান ও পরিশুদ্ধিতে। এটাই তাদের বৈশিষ্ট্য।’
রাজনীতি ও সামাজিকতা
রাজনীতি ইসলামের একটা গুরুত্বপূর্ণ শাখা। রাজনীতিই পরিপূর্ণ ইসলামের সর্বপ্রথম প্রকাশরূপ। কিন্তু আজ মুসলিম রাষ্ট্রগুলোতেও অস্তিত্ব নেই ইসলামী রাজনীতির। সেসব দেশে এখন প্রতাপ সেক্যুলার রাজনীতির।
তবুও দেওবন্দের উলামায়ে কেরাম এই সঙ্গিন পরিস্থিতিতেও মুখ ফিরিয়ে বসে থাকেননি রাজনীতি ও রাষ্ট্রের সাথে বোঝাপড়ার ক্ষেত্রে। বরং ইসলামের গণ্ডিতে অবস্থান করে—আরোপণমূলক নয়, বরং আত্মরক্ষামূলক রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করেছেন।
এরই পরিপ্রেক্ষিতে ১৮৫৭ সালে দারুল উলুম দেওবন্দের প্রতিষ্ঠাতা মাওলানা কাসেম নানুতবী রহ. অংশগ্রহণ করেছিলেন ব্রিটিশ-বিরোধী আন্দোলনে। এছাড়াও রাশিয়া-তুরস্কের যুদ্ধের সময়— ইসলামি খেলাফতের কেন্দ্রভূমি রক্ষার স্বার্থে, হিন্দুস্তানে আওয়াজ তুলে মুসলমানদের একত্র করেছিলেন। চাঁদা তুলে পাঠিয়েছিলেন হাজার হাজার রূপী। কিন্তু থেমে থাকেননি এখানেই। আপন ঘরের মূল্যযোগ্য যত সম্পত্তি ছিল, নিজের স্ত্রীর গহনাসহ— সব মুসলমানদের স্বার্থে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন তুরস্কে।
ইংরেজ উপনিবেশের পর যখন অধিকার আদায়ের প্রশ্নে প্রতিষ্ঠিত হলো কংগ্রেস, রশিদ আহমদ গঙ্গুহী রহ. সর্বপ্রথম ফতোয়া প্রদান করেন— সেখানে যুক্ত হওয়া বৈধ। ইংরেজদের বিরুদ্ধে রেশমি রুমাল আন্দোলনের সূচনা করেছিলেন মাহমুদ হাসান দেওবন্দি রহ. (মৃ. ১৯২০ ঈ.), সেই রুমাল রেশমের অক্ষরে সেজে উঠেছিল তার শিষ্য উবাইদুল্লাহ সিন্ধীর হাতে। এই আন্দোলনের দরুন মাহমুদ হাসান সাহেবকে মাল্টায় দেশান্তরিত করা হয়।
ইংরেজ বিরোধী আন্দোলন শক্তিশালী ভিত্তির উপর দাঁড়ানোর পর দেওবন্দ মাদরাসার সন্তান মুফতি কেফায়েতুল্লাহ রহ. ‘জমিয়তে উলামায়ে হিন্দ’ সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তীতে এর নেতৃত্বে ছিলেন হুসাইন আহমদ মাদানী রহ.।
স্বাধীন মুসলিম রাষ্ট্র হিসেবে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার সময় অনেক আলেম মুসলিম লীগের বিরোধিতা করেছিলেন। কিন্তু পরে ইসলামী আইন বাস্তবায়নের নকশা সামনে এলে দেওবন্দের আলেমদের থেকে আশরাফ আলি থানবী রহ. (১৯৪৩ ঈ.) ও শিব্বির আহমদ উসমানী রহ.(১৯৪৯ ঈ.) এর সমর্থন করেছেন। এবং কখনো পরোক্ষভাবে, কখনো আবার প্রত্যক্ষভাবে এর তদারকি করে গিয়েছেন।
একবার ভারত সরকারের গোপন সমর্থনে কিছু মুক্তমনা ভারতে ‘মুসলিম পার্সোনাল ল’-এর মধ্যে মর্জি-মাফিক রদবদল করতে চাচ্ছিল। এর বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলেন সর্বপ্রথম দেওবন্দের সপ্তম মুহতামিম কারী তৈয়ব সাহেব রহ.। তিনি দেওবন্দে আহ্বান জানান দেওবন্দের প্রাক্তন ছাত্রদের আর ভারতের গণ্যমান্য বুদ্ধিজীবিদের। তাদের সম্মতি ও সহযোগিতায় প্রতিষ্ঠা করেন ‘অল ইন্ডিয়া মুসলিম ল’ বোর্ড’।
কিতাব সুন্নাহর পাঠদানের পাশাপাশি উলামায়ে দেওবন্দের এরকম রাজনৈতিক সক্রিয়তা ছিল। এর মাধ্যমে তাদের সবচে বড় প্রচেষ্টা ছিল— প্রথমদিকে সাম্রাজ্যবাদী শক্তিকে প্রতিহত করা। সামগ্রিকভাবে সংখ্যালঘু মুসলমানদের ধর্মীয়, মানবিক ও সামাজিক জীবন-যাপনের অধিকার নিশ্চিতকরণ। এক্ষেত্রে তারা অনেকাংশেই সফল হয়েছিলেন।
আকিদা ও কালামের ক্ষেত্রে দৃষ্টিভঙ্গি
আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামায়াহর মাঝে পারস্পরিক মৌলিক আকিদাগত বিষয়ে কোন মতবিরোধ নেই। এসব ক্ষেত্রে সামগ্রিকভাবে ঐক্যমত্য লক্ষ্য করা যায়। কিন্তু এর বাইরে শাখাগত ও উদ্ভূত আকিদার ক্ষেত্রে পারস্পরিক মতভেদ আছে। এসব ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষরা নির্দিষ্ট কোন একটি গ্রহণযোগ্য আকিদা অনুসরণ করবে।
এসব বিরোধপূর্ণ বিষয়ে দেওবন্দি মাসলাক ও রুচি হলো— নিজে থেকে তারা কাউকেই বিরোধী বানিয়ে নেন না। তাদের প্রতি সম্মানার্থে— তাদের কথাকে সামঞ্জস্য দেবার চেষ্টা করেন কখনো। কখনো আবার সেটা সম্ভব না হলে, আদব রক্ষা করে প্রমাদ চিহ্নিত করেন।
ফিকহের ক্ষেত্রে তারা যেমন নির্দিষ্ট এক মাজহাবের অনুসরণ করেন, তেমনিভাবে কালাম ও আকিদা বিষয়েও তাদের পূর্বসূরী বিদ্যমান। তবুও তাদের মাঝে কাসেম নানুতবী রহ.-এর বিশ্লেষণী ধারা বিদ্যমান। তিনি— প্রত্যেকটি মাসআলা সম্পর্কে পূর্ববর্তী ইমামগণের বক্তব্য থাকার পরও, সেসবের উপর অধ্যয়ন, গবেষণাচালাতেন নতুনভাবে।
তার আরেকটি বৈশিষ্ট্য ছিল— এসব আকিদা ও কালামগত মাসআলার ক্ষেত্রে তিনি কাউকে আঘাত করে কথা বলতেন না। বিশেষত আশআরী আর মাতুরিদীর উপর তুলনামূলক বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে। তিনি তাদের মাঝে মৌলিক মতভেদের জায়গাগুলো এমনভাবে বর্ণনা করতেন— যেন এর মাঝে কোনই বিরোধ নেই। কেবলই শব্দগত পার্থক্য।
ইলমুল কালামের দৃষ্টিকোণ থেকে তারা কোন মাজহাব অনুসরণ করেন? এর উত্তর একটু জটিল। কারণ— এক্ষেত্রে কিছু অস্পষ্টতা বিদ্যমান।
দেওবন্দি ধারার সংজ্ঞায় তাদেরকে মাতুরিদী পরিচয়েই বিশেষায়িত করা হয়। তবে দেওবন্দি কিছু আলেম নিজেদেরকে আশআরি মনে করে থাকেন। এই দ্বিতীয় দলের যুক্তি দুটি—
১. শাহ ওলিউল্লাহ দেহলবী রহ. হলেন দেওবন্দি চিন্তাধারার আদর্শ পুরুষ। তিনি নিজেকে আশআরি বলে অভিহিত করতেন। তাই তারাও নিজেদের আশআরি আকিদায় বিশ্বাসী মনে করেন।
২. দেওবন্দের পাঠ্যসূচিতে তো আশআরি আকিদা নিয়ে পৃথক গ্রন্থের অস্তিত্ব আছে। যেগুলো সেখানে বেশ গুরুত্ব দিয়ে পড়ানোও হয়। তো সেই আকিদাকে গ্রহণ করে নিতে অসুবিধা কী?
এ বিবেচনায় দেওবন্দের আকিদাগত পরিচয় হলো— এমন মাতুরিদী দল, যাদের ঝোঁক আছে আশআরিদের দিকেও।
দেওবন্দী চিন্তার খোলাসা
শেষে তুলে ধরছি— কারী তৈয়ব সাহেবের পক্ষ থেকে দেওবন্দের চিন্তার সারনির্যাস। ‘উলামায়ে দেওবন্দ কা দীনি রুখ আওর মাসলাকী মিযাজ’ গ্রন্থের একেবারে শেষে তিনি দেওবন্দের মৌলিক বৈশিষ্ট্যগুলো সাতটি পয়েন্টে তুলে ধরেছেন।
১. শরীয়াহর জ্ঞান। এর অধীনে আছে— কুরান, সুন্নাহ, ইজমা, ইজতিহাদ। ‘সুন্নাহ’ শব্দের অর্থ শুধুমাত্র নবিজির কথা নয়। বরং এর অধীনে আবশ্যিকভাবে আসবে নবিজির কর্ম, সম্মতি, ইজতিহাদ।
২. আকিদাকে আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআতের ব্যাখ্যার আলোকে বোঝা। সেক্ষেত্রে তারা মাতুরিদী। ঝোঁকও আছে আশআরি আকিদার দিকে।
৩. তারা ফিকহী মাসআলায় মৌলিক ও শাখাগত বিষয়ে অনুসরণ করেন হানাফী মাজহাব। কিন্তু কোন অবস্থাতেই অন্য ফিকহের কোন মাসআলা অথবা কোন আলেমের বাণী নিয়ে উপহাস ও সমালোচনা বরদাশত করেন না তারা।
৪. তাসাউফ ও ইনসানের ক্ষেত্রে পূর্ববর্তী সালাফগণের পদাঙ্ক অনুসরণ। এ ক্ষেত্রে তাদের অভিজ্ঞতার আলোকে পথ চলা।
৫. প্রান্তিক ও বিভ্রান্ত ফেরকা সমাজে যেসব বিভ্রান্তি ছড়ায়— তা প্রতিহত করার প্রয়াসে রত থাকা, তাদের একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য।
৬. ইসলামের সকল বিষয়ে সামগ্রিক ভাবনা। মুসলমানদের মাঝে পারস্পরিক সম্প্রীতি ও দলবদ্ধতা রক্ষা।
৭. নিজেদের জীবনকে নবীজির জীবনাদর্শে অনুপ্রাণিত করা। জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে সুন্নতে নববীকে আঁকড়ে ধরা।