ইফতেখার জামিল:
বিশ্বায়নের বিস্তারের দরুণ ধর্মীয় বক্তব্য গঠন ও উপস্থাপনের মধ্যেও ব্যাপক প্রভাব পড়েছে। ধর্মীয় ব্যক্তিত্বরা বক্তব্য গঠনের ক্ষেত্রে স্থানীয় ও ধর্মীয় সূত্রের বাইরের অনেক মূল্যবোধ ও অবস্থানে প্রভাবিত হচ্ছেন, পাশাপাশি বক্তব্য উপস্থাপনের ক্ষেত্রেও শুধু মুসলিম দর্শকদের কথাই মাথায় রাখছেন না, ধর্মনিরপেক্ষ ও অমুসলিমদের আলোচনা ও সমালোচনার বিষয়টিও সেখানে গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে থাকছে। এভাবে ধর্মীয় বক্তব্য গঠন ও উপস্থাপনে অনেক ক্ষেত্রে, খোদ ধর্ম ও ধর্মীয় জনগোষ্ঠী ভরকেন্দ্রের একক গুরুত্ব হারাচ্ছে।
মুসলিম জনপদে ক্ষমতার পালাবদল ও রাজনৈতিক মেরুকরণে ধর্মনিরপেক্ষ ও পশ্চিমা প্রভাবিত গোষ্ঠীগুলোর কাছে ক্ষমতার ভাগ চলে যাচ্ছে। পাশাপাশি শিক্ষাব্যবস্থা ও গণমাধ্যমকে কেন্দ্র করে ধর্মহীন মূল্যবোধ, শ্লোগান ও ব্যক্তিত্বদের প্রভাব বাড়ছে। এই অসম ক্ষমতা-কাঠামোতে ধর্মীয় ব্যক্তিত্বরা বক্তব্য গঠন ও উপস্থাপনে ধর্মহীনদের প্রভাব থেকে মুক্ত থাকতে পারছেন না। নিছক তাদের সমর্থন লাভের আশায় বা বিরোধিতায় পাল্টে দিচ্ছেন ধর্মীয় ব্যাখ্যা। ধর্মহীনতা নিছক প্রেক্ষাপট ও প্রসঙ্গে সীমিত থাকছে না, সেটা হয়ে উঠছে বক্তব্য গঠনের উপাদান।
এই পরিস্থিতিকে আরও জটিল করেছে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে পরিচালিত ‘সন্ত্রাস-বিরোধী অনন্ত যুদ্ধ’। পশ্চিমা স্বার্থ ও দেশগুলোতে কিছু বিচ্ছিন্নতাবাদী আক্রমণের প্রেক্ষিতে তারা ঘোষণা দিয়ে বসেন ক্রুসেড যুদ্ধের। জর্জ ডব্লিউ বুশের ভাষায় নতুন ‘আস ভারসাস দেম’ㅡ তুমি হয়তো আমাদের পক্ষে থাকবে, নয়তো বিপক্ষে, এখানে কোন নিরপেক্ষতার সুযোগ নেই। বুশের প্রতিপক্ষদের অনেকের অবস্থান এমনইㅡতাদের কাছেও এখানে দ্বিমতের কোন সুযোগ নেই, পক্ষে না থাকলে আপনি হয়ে যাবেন তাদেরও প্রতিপক্ষ।
এভাবে মুসলিম ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব ও জনগোষ্ঠীর নিজস্ব বক্তব্য গঠন ও উপস্থাপনের সুযোগ সীমিত হচ্ছে। এখান থেকে তৈরি হচ্ছে পক্ষ-বিপক্ষের নতুন সমীকরণ : ইসলামের চরম ও শিথিলপন্থী বয়ান। দুই দিকের চাপে অনেকে নিজেদের বক্তব্য সংকুচিত করছেন, অনেকে চুপ থাকছেন, আবার অনেকে বিরোধিতায় তালগোল পাকিয়ে বসছেন। এই জটিলতার সমাধান হওয়া জরুরী। এই লেখায় আমরা এই দুই ধারণার প্রয়োগ ও অপপ্রয়োগ নিয়ে কিছু কথা বলবো।
ধর্মের সহজ ও কঠোর ব্যাখ্যার স্বরূপ
প্রথমেই বলে রাখা ভালো, ইসলামে সহজীকরণের প্রতি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। ‘আল্লাহ তোমাদের জন্য সহজ করতে চান, তোমাদের ওপর জটিলতা চাপিয়ে দিতে চান না।’ (সূরা বাকারা: ১৮৫)। ‘আল্লাহ তোমাদেরকে অসুবিধায় ফেলতে চান না।’ (সূরা মায়েদা :৬)। ‘আল্লাহ তোমাদের সক্ষমতা অনুযায়ী দায়িত্ব আরোপ করেছেন। ( সূরা বাকারা: ২৮৬ )। ‘আল্লাহ ধর্মীয় বিষয়ে কঠোরতা আরোপ করেননি। ( সূরা হাজ্জ :৭৮)। ‘তোমরা তোমাদের সক্ষমতা অনুযায়ী আল্লাহকে ভয় করো। (তাগাবুন: ১৬)। ‘হে আহলে কিতাবগণ, তোমরা দ্বীনের ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করো না। (নিসা: ১৭১)
নবিজি সা. পুরো বিষয়টি আরও স্পষ্ট করে বলেছেন, ‘দীন সহজ, কেউ দীনি বিষয়ে কঠোরতা করলে দীন তাকে কাবু করে ফেলে। তাই তোমরা মধ্যপন্থা অবলম্বন করো, পূর্ণতার কাছাকাছি যেতে চেষ্টা করো এবং সুসংবাদ গ্রহণ করো।’ (বুখারি, ৩৯)। অন্য হাদিসে নবিজি সা. বলেন, তোমরা সহজপন্থা অবলম্বন করো, কঠিনপন্থা অবলম্বন করো না, মানুষকে সুসংবাদ দাও, বিরক্তি সৃষ্টি করো না। (বুখারি, ৫৯)। নবিজিকে যদি দুটি কাজের মধ্যে যে কোন একটি গ্রহণের অনুমতি দেয়া হতো, তবে তিনি সহজ কাজটি বেছে নিতেন, যতক্ষণ না এটাতে কোন গুনাহ হতো। (শামায়েলে তিরমিজী, ২৬৭)।
এক বেদুঈন মসজিদে দাঁড়িয়ে পেশাব করা শুরু করলে সাহাবায়ে কেরাম তাঁকে ঘিরে ধরল। নবিজি সা. এই দৃশ্য দেখে বলেন, তাকে ছেড়ে দাও এবং পেশাবের উপর এক বালতি পানি ঢেলে দাও। তোমাদেরকে (মানুষের জন্য) সহজপন্থা অবলম্বনকারী হিসেবে পাঠানো হয়েছে, কঠোরতা সৃষ্টিকারীরূপে নয়। (বুখারি ৪৯১)। নবিজি সা. বলেন, তোমরা ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করো না, তোমাদের পূর্বের উম্মতগণ বাড়াবাড়ি করেই ধ্বংস হয়েছে। ( জামে সাগির, ২৮৯৪)
তবে সহজীকরণের পাশাপাশি আল্লাহ হারাম থেকে দূরে থাকতে নির্দেশ দিয়েছেন। হারাম কাজ তো করাই যাবে না, তার কাছেও যাওয়া যাবে না বলে নির্দেশনা দিয়েছেন। ‘ তোমরা ব্যাভিচারের কাছেও যেয়ো না। (বনী ইসরাইল: ৩২)। যে কোন মুসলিম ভাইয়ের দিকে অস্ত্র তাক করে, ফেরেশতারা তাকে লা’নত করতে থাকে। ( মুসলিম, ৪৪৬)। ব্যাভিচার ও হত্যা দূরে থাকুক, তার কাছেও যাওয়া যাবে না। অর্থাৎ সহজীকরণের নামে হারামে লিপ্ত হবার পথ খোলা যাবে না।
নবিজি সা. এই ব্যাপারটি দৃষ্টান্ত দিয়ে বুঝিয়েছেন : ‘হালাল স্পষ্ট এবং হারামও স্পষ্ট। আর এ দু’য়ের মাঝে রয়েছে বহু সন্দেহজনক বিষয়– যা অনেকেই জানে না। যে ব্যক্তি সেই সন্দেহজনক বিষয় হতে বেঁচে থাকবে, সে তার দীন ও মর্যাদা রক্ষা করতে পারবে। আর যে সন্দেহজনক বিষয়সমূহে লিপ্ত হয়ে পড়ে, তার উদাহরণ সেই রাখালের ন্যায়, যে বাদশাহ্ সংরক্ষিত চারণভূমির আশেপাশে নিজের পশু চরায়, অচিরেই সেখানে ঢুকে পড়ার আশংকা রয়েছে সেগুলোর। জেনে রাখো যে, প্রত্যেক বাদশাহ্রই একটি সংরক্ষিত এলাকা রয়েছে। আরো জেনে রাখো যে, আল্লাহর যমীনে সংরক্ষিত এলাকা হলো তাঁর নিষিদ্ধকৃত কাজসমূহ। ( বুখারি, ৫২)
মোটকথা, সহজীকরণের কথা বলে হারাম কাজ করা যাবে না। অনুমোদনের গণ্ডির মধ্যে থাকতে হবে। ফিকহের ভাষায় বলা যায়, ‘আল আমরু ইজা দাকা ইত্তাসাআ, ইজা ইত্তাসাআ দাকা’ অর্থাৎ জটিলতা তৈরি হলে কিছুটা সহজ করা হবে, শিথিলতা তৈরি হলে কিছুটা কঠোর করা হবে। তবে যেহেতু জটিল ও শিথিল আপেক্ষিক বিষয়, তাই ধর্মীয় নীতিমালার ভিত্তিতেই সহজ ও কঠোর করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে। এখানে এ ছাড়া অন্যকিছুকে মানদণ্ড হিসেবে গ্রহণ করা যাবে না।
আল্লাহ তাআলা বলেছেন, তোমরা ইনসাফের সাথে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করো। (নিসা: ৫৮)। শত্রুর সাথেও ইনসাফ করতে হবে, ‘শত্রুতা যাতে তোমাদেরকে অন্যায় করতে প্ররোচিত না করে। (মায়েদা: ৮)। সর্বোপরি সিদ্ধান্ত গ্রহণের মূল মানদণ্ড হবে ইসলামㅡ ‘ন্যায় ভিত্তিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে তোমরা নিজেদের খেয়াল-খুশীর অনুসরণ করো না।’ ( নিসা: ১৩৫)। ‘আহলে কিতাবদের অনুসরণ-প্রভাবে পড়ে তোমরা আল্লাহর বিধান থেকে সরে যেতে প্ররোচিত হয়ো না।’ ( মায়েদা: ৪৯)। ‘তোমরা কি আল্লাহর বিধান ছেড়ে জাহেলি চিন্তা-চেতনা-বিধান অনুসরণ করতে চাও?’
‘মূল ভরকেন্দ্রে থাকবে ধর্ম‘
পূর্বের আলোচনায় স্পষ্ট হয়েছে, ইসলামের মানদণ্ডের ভিত্তিতেই সহজ ও কঠোর ব্যাখ্যা করতে হবে, এক্ষেত্রে অন্য কোন কিছুকে মানদণ্ড হিসেবে গ্রহণ করা যাবে না। পাশাপাশি কেউ ব্যাখ্যায় শিথিলতা করলে ইসলামের ভিত্তিতেই তাকে গ্রহণ বা বর্জন করতে হবে। ইসলামের ভিত্তিতে তার ব্যাখ্যায় কোন ত্রুটি না থাকলে, পশ্চিমা ষড়যন্ত্রতত্ত্বের কথা আনা যাবে না যে, এই ব্যাখ্যা গ্রহণ করলে তো পশ্চিমারা সুযোগ পেয়ে যাবে। পাশাপাশি ইসলামের ভিত্তিতে ব্যাখ্যায় শিথিলতার সুযোগ না থাকলে প্রেক্ষাপট ও বাস্তবতার সাপেক্ষে সহজ করার দাবী জানানো যাবে না। পশ্চিমা ষড়যন্ত্র বা প্রেক্ষাপটের অজুহাত দেখালে ধর্ম আর মূল মানদণ্ড ও ভরকেন্দ্র হিসেবে কায়েম থাকছে না।
নবিজি সা. একটি মূলনীতির মাধ্যমে বিষয়টি ব্যাখ্যা করেছেন। নবিজি সা. বলেন, ‘রাগের অবস্থায় বিচার কাজ চালানো যাবে না।’ কেননা রাগের অবস্থায় বিচার কাজ চালালে অন্যায় ও অন্যায্য সিদ্ধান্ত গ্রহণের আশঙ্কা আছে। ইবনে দাকীকুল ঈদ রহ. এর ব্যাখ্যায় বলেন, ‘রাগের অবস্থায় মানুষ যথাযথভাবে চিন্তা করতে পারে না, ফলে সঠিকভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা থাকে না। স্বাভাবিক চিন্তায় ব্যাঘাত সৃষ্টি করে এমন সবকিছুই এই নিষেধাজ্ঞার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত। যেমন প্রচণ্ড ক্ষুধা, পিপাসা ও ঘুমের চাপㅡ এভাবেও মানুষের স্বাভাবিক চিন্তার প্রক্রিয়া বাঁধাগ্রস্থ হয়।’ (ফাতহুল বারী)
ঠিক তেমনিভাবে অনেকে রাজনৈতিক চাপের প্রেক্ষিতে স্বাভাবিকভাবে চিন্তা করতে অক্ষম হয়ে যান। রাজনৈতিক নির্যাতনের শিকার হয়ে নির্বিচারে তাকফীর করার প্রবণতাও সৃষ্টি হয়ে যায়। যারা তাদের সাথে দ্বিমত করেন, তাদেরকেও তারা ‘দালাল-মুরতাদ’ আখ্যা দেন। অপর পক্ষে পশ্চিমা ও ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক চাপের প্রেক্ষিতে অনেকে পশ্চিমা অনুকরণ, নতজানুতা ও শিথিলতার পক্ষে কথা বলেন। যারা তাদের মতো শিথিলতাকে সমর্থন না করেন, তাদেরকে চরমপন্থী বা উগ্র বলে ট্যাগ দেন। তাদেরকে কোণঠাসা করতে পশ্চিমা-জালেম সরকারের সাহায্যও গ্রহণ করেন।
বস্তুত উল্লেখিত দুই প্রান্তিকতা তৈরি হবার মূল কারণ, ধর্ম তাদের চিন্তা ও বিচারের মানদণ্ড ও ভরকেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত নয়। তারা রাজনৈতিক পরিস্থিতির শিকার হয়ে স্বাধীনভাবে চিন্তা করার ক্ষমতা হারিয়েছেন। বস্তুত এই কারণেই নবিজি সা. প্রভাবিত অবস্থায় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে নিষেধ করেছেন। কেউ হয়তো রাজনৈতিকভাবে প্রভাবিত হচ্ছেন, কেউ সাংস্কৃতিকভাবে, আবার কেউ প্রভাবিত হচ্ছেন অর্থনৈতিকভাবে। কেউ প্রভাবিত হচ্ছেন অন্ধ সমর্থনে, কেউ প্রভাবিত হচ্ছেন অন্ধ বিরোধিতায়।
প্রশ্ন হচ্ছে, আমরা জটিল পরিস্থিতিতে আছি, এখন প্রভাব এড়ানোর কোন সুযোগ আছে?
‘ধর্মের দুই শাখা : ধার্মিকতা ও রাজনীতির মধ্যে সম্পর্ক‘
আগেই আমরা ফিকহি সূত্র বর্ণনা করেছিㅡ ‘আল আমরু ইজা দাকা ইত্তাসাআ, ইজা ইত্তাসাআ দাকা’ অর্থাৎ পরিস্থিতিতে জটিলতা তৈরি হলে কিছুটা সহজ ব্যাখ্যা করা হবে, পরিস্থিতিতে শিথিলতা তৈরি হলে ব্যাখ্যায় কিছুটা কঠোরতা করা হবে। তবে যেহেতু জটিলতা ও শিথিলতা আপেক্ষিক বিষয়, তাই ধর্মীয় নীতিমালার ভিত্তিতেই সহজ ও কঠোর করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে। এক্ষেত্রে নিজের খেয়াল-খুশী বা বিধর্মীদের প্রভাবে কোনো ব্যাখ্যা গ্রহণ করা যাবে না। অর্থাৎ ইসলাম এমন কোন অচল কাঠামো নয়, পরিস্থিতির পরিবর্তনে যার ব্যাখ্যায় পরিবর্তন আসবে না, আবার ইসলাম এমন কোন লঘু কাঠামোও নয়, যেখানে খেয়াল-খুশী মতো পরিবর্তন করা যাবে, অন্যের অনুকরণ করে ধর্মের মূল বৈশিষ্ট্য বিকৃত করা যাবে।
ধর্মীয় বিষয়ে ‘ছাবেত’ ও ‘মুতাগায়ের’ তথা স্থিরতা ও পরিবর্তনের মাত্রা কীভাবে নির্ধারিত হবে, সেটা আমাদের মূল আলোচ্য বিষয় নয়। তবে এখানে আমরা তার মূল প্রকৃতি ও বৈশিষ্ট্য নিয়ে কয়েকটা কথা বলতে চাই। আদতে ধর্ম পরিস্থিতিতে প্রভাব তৈরি করবে, নাকি পরিস্থিতির মাধ্যমে প্রভাবিত হবে, সেটা যাচাইয়ের জন্য আমাদেরকে ধার্মিকতা ও রাজনীতির সম্পর্কের বিষয়ে জানতে হবে। ধর্ম যেভাবে মানুষের সামনে আল্লাহর পরিচয় তুলে ধরতে চায়, মানুষকে আল্লাহর অনুগত বানাতে চায়, তেমনিভাবে মানুষের মাধ্যমে পৃথিবীতে হক ও ইনসাফ কায়েম করতে চায়। আল্লাহর সাথে মানুষের সম্পর্কের অংশকে বলে ইবাদত বা ধার্মিকতা, আর মানুষের সাথে মানুষের সম্পর্কের অংশকে বলা হয় খেলাফত-মুয়ামালাত-সিয়াসাতㅡ সহজ করে বললে রাজনীতি। এখন ধর্মের দুই শাখা বা ধার্মিকতা ও রাজনীতির মধ্যে সম্পর্ক কেমন হবে, কে কেন্দ্রে থাকবে?
হজরত নূহ আ. সহ অনেক নবী তাবলীগের কাজ করেও রাজনৈতিকভাবে সফল হতে পারেননি। ঠিক যেমন রাজনৈতিকভাবে সফল হননি হাসান ও হুসাইন রাদি.। উলামায়ে কেরাম তাই বলেন, ধর্মের মূল উদ্দেশ্য ধার্মিকতা ও ইবাদত। আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কোরআনে বলেন, আমি মানব ও জীন সম্প্রদায়কে আমার ইবাদতের জন্য সৃষ্টি করেছি। (সূরা জারিয়াত: ৫৬) তবে ধর্মীয়ভাবে রাজনীতিও গুরুত্বহীন নয়। আল্লাহর সাথে মানুষের সম্পর্ক স্থাপনের বড় উদ্দেশ্যই হল মানুষ পার্থিব জীবনে আল্লাহর বিধান অনুযায়ী জীবন যাপন করবে, মানুষকে সে পথে দাওয়াত দিবে ও প্রচেষ্টা-পরিশ্রমে আল্লাহর আহকাম বাস্তবায়ন করবে। এখন রাজনীতিতে ধর্মের প্রভাব তৈরির চেষ্টা না করলে ধর্ম পার্থিব অর্থে অকার্যকর বিষয়ে পরিণত হয়।
ঠিক একইভাবে রাজনীতিকে কেন্দ্র বানিয়ে ধর্মের বিধিবিধানে পরিবর্তন আনলেও পরিস্থিতির প্রভাবে খেয়াল খুশীতে আল্লাহর বিধান পরিবর্তন হয়ে যায়। তখন রাজনীতিতে আর ধর্মের প্রভাব থাকে না, নীতিনৈতিকতার বালাই থাকে না, ধর্ম পরিণত হয় মানুষের খেয়াল-খুশীর ঘুটিতে। পরিস্থিতি বা প্রয়োজনের দোহাই দিয়ে পরিবর্তন হয়ে যায় আল্লাহর বিধান। আর যারা আল্লাহর বিধান পরিবর্তন, বিকৃত ও স্থগিত করে, তাদের প্রতি রয়েছে আল্লাহর কঠোর হুঁশিয়ারী।
আগেই যেমন বলেছি, এই ধমকি প্রভাবিত সকালের ওপর প্রযোজ্যㅡ চাই তারা পরিস্থিতি ও প্রয়োজনের কথা বলে শিথিলতা করুক বা কঠোরতা করার চেষ্টা করুক।
ধর্মীয় ব্যাখ্যায় দুই প্রান্তিকতা : ইরজা ও খুরুজ
ইসলামী ইতিহাসে চরম ও শিথিলপন্থার বিতর্ক ইরজা ও খুরুজের শিরোনামে আলোচিত হয়েছে। এর মূল কথা হচ্ছে, ধর্ম কাকে বলেㅡ ইসলামে বিশ্বাস স্থাপন ও প্রকাশ্যে এর স্বীকৃতি দানের পর ইসলামের বিধিবিধান অনুযায়ী আমল করাটা কতটা জরুরী? ইরজাপন্থীরা মনে করে, আমল করা ঐচ্ছিক ব্যাপার, অত জরুরী কিছু নয়। আর খুরুজপন্থীরা মনে করে, আমল না করলে ঈমানই থাকবে না।
অর্থাৎ যারা মনে করে, আমল অপরিহার্য নয়, তাদের মতে রাজনীতি ধর্মের অন্তর্ভুক্ত নয়, তাই খেয়াল-খুশী অনুযায়ী প্রয়োজনে ধর্মীয় বিধানে পরিবর্তন আনা যাবে বা নিজেরা পরিবর্তন না করলেও অন্যদের বিকৃতি মেনে নেওয়া হবে। আর যারা মনে করে, আমল না করলে ঈমানই থাকবে না, তাদের মতে রাজনীতি অটল ও কেন্দ্রীয় ব্যাপার। যতই পরিবর্তন হোক, রাজনৈতিক কৌশলে পরিবর্তন করা যাবে না। রাজনীতি ঠিক না থাকলে ঈমানই ঠিক থাকবে না। রাজনৈতিক সফলতার জন্য ধর্মীয় বিধানে পরিবর্তন আনা যাবে।
ইরজা ধারার অনুসারীরা শিথিলপন্থার লোক আর খুরুজ ধারার লোকেরা চরমপন্থার লোক। কারো মধ্যে ইরজা ধারার গুণ পাওয়া গেলেই কেবল তাকে শিথিলপন্থী বলা যাবে। পাশাপাশি কারো মধ্যে খারেজি ধারার গুণ পাওয়া গেলে তাকে চরমপন্থী বলা যাবে। এর বাইরে কোন বিশেষ ধর্মীয় বা রাজনৈতিক অবস্থানের কারণে শিথিল বা চরমপন্থী বলা যাবে না। তাতে বিতর্ক ও জটিলতা বাড়বে বৈ কমবে না।