নাকবা-পূর্ব বায়তুল মুকাদ্দাস কেমন ছিল

মুজাহিদুল ইসলাম:

পৃথিবীর নিয়ম অনুযায়ী যার সম্পদ যত, তার নিরাপত্তা তত গুরুত্বপূর্ণ। সম্পদ হতে পারে আত্মিক ও অর্থনৈতিক। তদ্রুপ বায়তুল মুকাদ্দাসের আত্মিক মূল্য অনেক বেশি। বায়তুল মুকাদ্দাস পৃথিবীর প্রাচীনতম সভ্যতার একটি। খ্রিস্টপূর্ব সময় থেকেই এই ভূমির নিয়ন্ত্রণ গ্রহণের জন্য বিভিন্ন জাতি আক্রমণ করেছে। হাতবদল হয়েছে একের পর এক। এক পর্যায়ে ওমর রা. এর সময় তা মুসলিম সভ্যতার গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে গণ্য হয়। ইতিহাসের বিভিন্ন বাঁকে সভ্যতার এই পাদভূমি মুসলিমদের হাতছাড়া হয়েছে। এই আত্মিক সম্পদ হারিয়ে সর্বশেষ চরম বিপয়ের মুখে পড়ে ফিলিস্তিনিরা।

ফিলিস্তিনিদের এই বিপর্যয়ের কারণ বয়ান করার পাশাপাশি বিপর্যয়-পূর্ব প্রিয় বায়তুল মুকাদ্দাস কেমন ছিল তা উঠে আসবে এক মিসরীয় প্রথিতযশা শিক্ষাবিদ ও কূটনীতিকের জবানিতে।

নাকাবা অর্থ বিপর্যয়। ফিলিস্তিনিরা প্রতিবছর নাকাবা দিবস বা বিপর্যয়-দিসব পালন করে। এই নাকাবা বা বিপর্যয়ের শুরু ১৯৪৮ সালের ১৫ মে থেকে। এর একদিন পূর্বে, ১৪ মে ইজরাইল ফিলিস্তিনিদের মাটিতে ইহুদিবাদি একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেয়। দখলদাররা তাদের ঘোষিত রাষ্ট্রের নির্ধারিত ভূমি থেকে আরবদের উচ্ছেদ করতে থাকে। আবার কিছু মানুষ প্রাণের ভয়ে পালিয়ে যায়। অন্যদিকে ঘোষণার সাথে সাথে শুরু হয় প্রতিরোধ-সংগ্রাম। আরবরা ইজরাইলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। ১৯৪৮-১৯৪৯ সালের এই যুদ্ধে আবররা আরো ভূমি হারায়। সাড়ে সাত লাখ ফিলিস্তিনি উদ্বাস্তু হয়ে পড়ে।  পরে ১৯৬৭ সালে আবার আরব-ইজরাইলি যুদ্ধে পশ্চিম তীর ও গাজার অনেক মানুষ বাস্তচ্যুত হয়। জাতিসংঘের হিসেবে প্রায় ৫০ লক্ষ মানুষ বাস্তচ্যুত। এরা দেশের ভেতরে ও বাইরে অবস্থান করছে।

নাকাবার ঠিক পাঁচ বছর আগে বায়তুল মুকাদ্দাসে যান মিসরীয় কূটনৈতিক কোরের সদস্য আব্দুল ওয়াহাব আযযাম। পারিবারিকভাবেই কূটনৈতিক বিদ্যার বীজ বপিত হয়েছির তার মধ্যে। তার পিতা ছিলেন আরব লীগের প্রথম প্রেসিডেন্ট।  আব্দুল ওয়াহাব একাধারে ইংরেজি, ফরাসি, তুর্কি ও উর্দু ভাষায় প্রাজ্ঞ ছিলেন। সৌদি ও পাকিস্তানে মিসরের প্রতিনিধিত্ব করেছেন। অবসরে গিয়ে সৌদির  আবেদনে কিং সাউদ ভার্সিটি বিনির্মাণে পূর্ণ দায়িত্ব গ্রহন করেন। ১৯৫৯ সালে কিং সাউদের ভাইস চ্যান্সেলর অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন।

ড. আযযাম বায়তুল মুকাদ্দাস থেকে ফিরে এসে ভ্রমণ-স্মৃতি লিখেন কায়রোর রিসালাহ পত্রিকায়। তিনি লিখেন— ‘বায়তুল মুকাদ্দাসে রমাদানে মসজিদুল আকসাতে ইশার নামাজ আদায় করলাম। সেই স্মৃতি কখনো আমি ভুলতে পারবো না; মসজিদের দূর মিম্বার থেকে ভেসে আসা মৃদু তাকবির ধ্বনি, যেন অদৃশ্য জগত থেকে কোন হৃদয় শীতলকারী আওয়াজ ভেসে আসছে। মসজিদের চারপাশ জুড়ে ঝুলছে লন্ঠন। বাতাসে হালকা করে আলো স্পন্দিত হচ্ছে। আলোর প্রতিবিম্ব মসজিদ ও মসজিদ চত্তরজুড়ে এক অপার্থিব দৃশ্যের তৈরী করছে। মসজিদের তাসবিহ, আলোর কম্পন ও চারপাশের গাছপালার ছায়ায় মসজিদের কম্পিত আলোর প্রতিবিম্বের অনুভূতি শুধু অনুভবযোগ্য।

মসজিদের সামনের বিশাল করিডোরে এবার হাঁটতে থাকি। বায়তুল মুকাদ্দাসের চারপাশজুড়ে বিশাল বিশাল দেয়াল ও বড় বড় ভবনগুলো যেন তাদের অতীত ও বর্তমানের কথা বলে চলছিল।  স্বচ্ছ আকাশে সিলভারের থালার মতো চাঁদ তখন। কুব্বাতুস সাখরার ওপর সেই চাদের দ্যুতি ঠিকরে পড়ছিল। দেয়াল ও গাছও তো চাঁদের দান থেকে মুক্ত নয়। গাছপালার ও বিল্ডিয়ের ফাঁক থেকে চাদের আলো যেন কোন এক রূপকথার উপ্যাখ্যান তৈরি করছিল। অথবা যেন তা কোন আয়াত লিখছিল। কখনো বা মনে হচ্ছিল ওরা ওদের কপাল দিয়ে সিজদা দিচ্ছে। বায়তুল মুকাদ্দাসের প্রকৃত দর্শক সত্যিই এমন দৃশ্য অনুভব করে। মসজিদের ভেতরে কোথাও দেখা যাচ্ছে কেউ একই আয়াত বা কোন কবিতার পক্তি বারবার আবৃত্তি করছে।

মসজিদ থেকে বেরিয়ে প্রাচীরের বাবুল আমুদ দিয়ে বাইরে এলাম। বাইরে থেকে মসজিদের চারপাশের দেয়াল দেখলাম। চাঁদের আলোতে দেয়ালের ওপরে নির্দিষ্ট দূরত্বে অবস্থিত গম্বুজগুলোকে মনে হচ্ছিল তরবারির খন্ডিত অংশ। বাবুল আমুদে কিছু বন্ধুদের নিয়ে গল্প করতে থাকি। রাতের আলোয় বায়তুল মুকাদ্দাস দেখে দৃপ্ত হয়নি আমার নয়ন।  দিনের আলোতে দেখার সিদ্ধান্ত নিলাম।

বায়তুল মুকাদ্দাস বিষয়ে বিশেষজ্ঞ প্রফেসর আব্দুল্লাহ সাহেবের সাথে কথা বললাম। আমরা একসাথে জুমার নামাজের পর সায়্যিদ মুজাদ্দিদি আফগান মন্ত্রীর সাথে দেখা করার সিদ্ধান্ত নিলাম। তিনি ‘কুববাতুস সাখরা’ এর চত্বরের একটি কামরায় ইতিকাফ করছিলেন।

বায়তুল আকসাতে এক জুমআ

বায়তুল মুকাদ্দাসের চত্বরে জুমার নামাজে ইতিপূর্বেও আমি অংশ নিয়েছি। এটা হতো এক বিশাল ইদ-সমাবেশ। নারী, পুরুষ ও শিশুরাও তাতে অংশ গ্রহণ করতো। বাবা-মা নামাজ পড়তে থাকতো। বাচ্চারা হারামের প্রশস্ত জায়গায় খেলাধুলা করতে থাকতো। এবার ১৯৪৩, ২৪ সেপ্টেম্বর (২৪ রমাদান) শুক্রবারের জামাতে আমরা হাজির হই। এ দিনের অনুভূতি ছিল ভিন্ন রকম। এটা ছিল কিছুটা ব্যতিক্রম। বায়তুল মুকাদ্দাস ও আশেপাশের সকল জায়গা থেকে মানুষ নামাজের জন্য তাদের গ্রাম ও শহরের ঐতিহ্যবাহী পোশাক পরে দলে দলে আসতে থাকে। আমরা বসলাম। কিন্তু আমার চোখ আটকে আছে মসজিদ প্রাঙ্গনে দলে দলে আসতে থাকা মানুষের দিকে। মানুষ আসছিল আর নামাজ আদায় করছিল। মনে হচ্ছিল, মসজিদে হারামের জামাতের মতো। বাহ্যিকভাবে মনে হবে, বিভিন্ন দল আলাদাভাবে একেক দিক ফিরে নামাজ আদায় করছে। কিন্তু নাহ! সবাই কাবার দিকে ফিরে নামাজ আদায় করছে। যখন মসজিদের ইমাম তাকবির দিলেন, দূর থেকে একের পর এক তাকবির আসতে থাকলো। সবাই নামাজে দাড়িয়ে গেল। বেশ সুন্দরভাবে সকলে কাতার কাতার করে দাঁড়ালো।

সে এক ভিন্ন দৃশ্য। ভিন্ন অনুভূতি। মসজিদজুড়ে বিভিন্ন কাতারের দিকে তাকাতে তাকাতে আমিও দাঁড়ালাম। আমার সামান্য দূরেই ছিল মহিলাদের জামাত। তারা দুটি আলাদা কক্ষে নামাজ আদায় করছিল। কক্ষ দুটির ওপর গম্বুজ ছিল।

দুই রাকাত পড়ে সালাম ফিরানোর পর আমার সাথিকে বললাম, আমি বাইরে গিয়ে এই জনস্রোত দেখতে চাই। জনস্রোত দেখা শেষ হলে বায়তুল আকসার জাদুঘরে আমাদেরক নিয়ে যাওয়া হয়। এটা একটি ইসলামি জাদুঘর। জাদুঘরের পিলারগুলোতে প্রাচীন সময়ের বিভিন্ন লেখা ও অংকন দিয়ে সাজানো। বিশাল প্রবেশকক্ষে রয়েছে অল্প কিছু প্রত্নতাত্মিক সম্পদ। জাদুঘরের একেকটি সম্পদ যেন এক একটি ইতিহাস। মরোক্কোর বনু মারিনের সুলতান আব্দুল হকের হাতে লিখিত কুরআন রয়েছে। তিনি নিজ হাতে লিখে মক্কা, মদিনা ও বায়তুল মুকাদ্দাসে পাঠিয়েছিলেন। রয়েছে ককেশাসের মুসলিম দেশ রক্ষার জন্য শাহাদাত বরণকারী  ইমাম শামিলের তরবারি।

গোলায় ছিদ্র আবাকাবা

মিউজিয়ামের দেয়ালে দেখেছি বিশেষ পোশাক ও পোশাকে থাকা বহু ছিদ্র। জামাটি ছিল মহান বীর ও স্বাধীনচেতা সুলতান পাশা আতরাশের। কোন এক বিপ্লবে তিনি যখন ফরাসিদের ট্যাংকের ওপর আক্রমণ করেন, তখন তাদের ট্যাংকের গোলায় তার পোশাকে তৈরি হয় এই ছিদ্র। আহ! এর থেকে কী কোন দামী ও মূ্ল্যবান পোশাক হতে পারে। এর থেকে কী কোন মহান সন্মানিত হতে পারে! সত্যি মহান এক কার্য তারা সম্পাদন করেছেন, যারা ইমাম শামিল ও আতরাশের আবাকে সংরক্ষণ করেছেন। সালাহউদ্দিন আইয়ুবির বিভিন্ন বাতি ও উসমানি সাম্রাজ্যের বড় বড় ডেক ছাড়াও আরো বহুকিছু সাক্ষ্য বহন করছে এই জাদুঘর।

পরিদর্শন বহিতে অনেকের স্বাক্ষর দেখতে পেলাম। বাদশাহ ফায়সাল সই দেয়ার পর এই আয়াত লিখেছেন, ‘যারা আল্লাহ ও কিয়ামাতের দিনের ওপর বিশ্বাস করে, নামাজ কায়েম করে, যাকাত আদায় করে এবং একমাত্র আল্লাহকে ভয় করে, তারাই একমাত্র আল্লাহর ঘরকে আবাদ করে।’

মিসরের তৎকালীন কূটনৈতিক আব্দুল ওয়াহাব যুগের এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে নিজের স্মৃতিচারণ করেছেন। চোখে আঙ্গুল দিয়ে পিতৃপুরুষের রেখে যাওয়া সম্পদ হারানোর বেদনা প্রকাশ করেছেন। প্রকাশ করেছেন বায়তুল মুকাদ্দাসে নামাজের অনুভূতি। আলোকিত রাতের অপার্থিব অনুভূতির কথা। স্বপ্নচারীদের দেখার ও ভাবার আহ্বান জানিয়ে তিনি লেখার ইতি টেনেছেন।

আগের সংবাদফিলিস্তিনে ঈদ: আনন্দ-বেদনার কথকতা
পরবর্তি সংবাদহাসান রোবায়েতের দুটি সনেট