নারীবাদ ও নারী অধিকার: কিভাবে পার্থক্য করবেন ?

খালিদ মুহাম্মাদ সাইফুল্লাহ:

বিশ্বব্যাপী ফেমিনিজমের সাংগঠনিক তৎপরতা চালু হবার পর থেকে একটা ভুল বোঝাপড়া জারি আছে অনেকের মনে; তারা ভাবতে শুরু করেছে যে, নারীবাদ হয়তো কমবেশি নারী অধিকারের প্রতিনিধিত্ব করছে। ফেমিনিজমের সঙ্গে নারী অধিকারের মৌলিক কিছু তফাৎ নিয়ে আমরা আলাপ করব সামনে–

সমাজের অ-ব্যবস্থাপনার প্রতি তীব্র অনাস্থা থেকে শুরু হয় নারীবাদের সফর; কিন্তু দিনশেষে তুরাস, উলামা এবং প্রতিষ্ঠিত চিন্তার প্রতি একরোখা জেদ হয়ে ওঠে তাদের মঞ্জিলে মকসুদ। ঊনবিংশ শতকের শেষদিকে, ভোটাধিকার সহ ইউরো-খৃষ্টীয় জুলুমের প্রতিবাদ হিসেবে ফেমিনিজমের সাংগঠনিক সূচনা হয়। কালক্রমে তাদের ইশতেহারে যুক্ত হতে থাকে বিচিত্র দাবি-দাওয়া। একটা নোক্তা মাথায় রাখতে হবে, নারীদের কিছু সংকট, সীমাবদ্ধতা এবং অপ্রাপ্তি আছে; আন্তরিক ভাবেই এগুলোর সুরাহা হওয়া জরুরি। তবে নারীবাদ প্রতিনিয়ত সংকট-সীমাবদ্ধতার যে সিলসিলা নির্মাণ করতেছে তা ‘নারী অধিকার’ না বরং ‘শ্রেণী-রাজনীতি’। Heywood বলেছেন, ‘Feminist thought’ can be broadly defined as the ideology of trying to advance the social role of women’ (১)

নারীবাদ রাজনৈতিক অভিলাষের সূক্ষ্ম চোরাবালিতে আটকে গেছে, যত দৌড়ঝাঁপ করবে ততো সংকটাপন্ন হয়ে পড়বে। বিপ্লবীদের মতো রাজনৈতিক অস্থিরতা ফেমিনিজমের প্রধান প্রেরণা হয়ে উঠছে। কেট মিলেটের sexual politics এর ভাষা ও বয়ান খেয়াল করলে দেখবেন, নারীবাদ খুব সূক্ষ্মভাবে পুরুষের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ হয়ে উঠছে; লৈঙ্গিক বৈষম্যকে পুঁজি বানিয়ে নিছক ক্ষমতায়ন না বরং পুরুষের সবধরনের কর্তৃত্বকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখাচ্ছে।

ফেমিনিজম তার বুদ্ধিবৃত্তিক রসদ উৎপাদন, যোগান ও সরবরাহ করে কখনো মার্ক্সীয় সাহিত্যের (class struggle) শ্রেণী-প্রশ্ন থেকে, কখনো সাঈদের ওরিয়েন্টালিজমকে ঘিরে।

সাম্প্রতিক সময়ে জাপানে ফেমিনিষ্টরা রাজনীতিতে নারীদের অংশগ্রহণকে গুরুত্বের সাথে নিচ্ছে, পুরুষ প্রতিনিধির বিপরীতে নির্বাচনে ভোট দিচ্ছে নারী-প্রার্থীদের। ফলে আইনসভায় নারীদের উপস্থিতি বাড়ছে নাটকীয় হারে। ওয়েলশ (Welsh) এসেম্বলিতে ৫০% নারী আইনসভায় জায়গা করে নিয়েছে। অন্যান্য এসেম্বলিতেও বাড়ছে সংখ্যা। (২) ফলে নারীবাদকে ‘নারী অধিকারের’ এজেন্ট ভাবলে ভুল করবেন। নারী অধিকার আর নারীবাদ এক জিনিস না। ফেমিনিজমের রয়েছে নিজস্ব আদর্শিক-রাজনৈতিক পরিচয়।

নিছক পুরুষতন্ত্রকে দোষারোপ করা ফেমিনিজমের স্বভাব; অথচ পুরুষতন্ত্রের সাথে নারী অধিকারের সত্তাগত কোন সঙ্ঘাত নেই। অন্যান্য সংকট-সমস্যার মতো নারী-সমস্যা একক-অবিমিশ্র কোন সূত্রের উপর দাঁড়িয়ে নেই যে, স্রেফ সংকটের ঐ নির্দিষ্ট সুত্রের সুরাহা করে ফেললেই নারীমুক্তি ঘটে যাবে। শিক্ষাব্যবস্থা, অর্থনীতি, রাষ্ট্র এবং ধর্মীয় ব্যাখ্যা স্ব স্ব অবস্থান থেকে সংকট উৎপাদন ও সুরাহার পেছনে কমবেশি ভূমিকা পালন করে। কিন্তু অধিকাংশ ফেমিনিষ্টরা এই নোক্তা ধরতে পারে না। এজন্য দেখবেন শুধু ইসলামিস্ট কেন, আদর্শবাদী সচেতন লোকজন নারীবাদরে ভালো চোখে দেখে না। মার্ক্সিস্ট-নিউ মার্ক্সিস্ট এবং প্রগতিশীল নারীও একে স্রেফ বিলাসিতা হিসেবে দেখে। ফেমিনিজম আদতে সমাজ জীবনে ‘এনার্কিজম’ (নৈরাজ্যবাদ) চর্চা করে। তাদের এই নৈরাজ্য অথবা তন্ত্রহীনতা ধীরে ধীরে রাজনৈতিক রুপ ধারণ করছে।

বিভিন্ন নৃগোষ্ঠী ও জাতির মধ্যে এখনও মাতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা চালু আছে; পেশা, পরিবেশ ও জীবনধারা হিসেবে হয়তো তা উপযোগী তাদের জন্য, সেখানে পুরুষরা সমতা পাচ্ছে না। তাদের কি উচিত পুরুষবাদ চর্চা করা ?

৩.

বার্ট্রান্ড রাসেল মার্ক্সবাদ নিয়ে তার power কেতাবে লিখছেন যে, ‘গোঁড়া অর্থনীতিবিদগণ ব্যক্তির অর্থনৈতিক স্বার্থকে সামাজিক বিজ্ঞানের মৌল প্রণোদনা হিসেবে অনুমান করেছেন। তাদের এ জাতীয় অনুমান ভূল। কার্ল মার্ক্সও এ দলের অন্তর্ভুক্ত।’ রাসেল মার্ক্সবাদের গোড়ার গলত নিয়ে কিছুদূর আলাপ করে যে নোক্তা দিলেন, সমাজ জীবনের একক স্বার্থকে মৌলিক ভাবা যাবে না, এই পয়েন্ট ধরে মার্ক্সরে খারিজ করলেন, সেই পয়েন্টে সে নিজেই পরাস্ত। তিনি নিজেও কার্ল মার্ক্সের মতো সামাজিক বিজ্ঞানের মৌল প্রণোদনা হিসেবে ‘ক্ষমতা-স্পৃহা’ এবং ‘ক্ষমতার অসম বন্টন’রে অনুমান করছেন। সামগ্রিকভাবে সমাজরে বিচার করতে পারেন নাই। ফ্রয়েড সাহেবও নিছক যৌনতাকে মৌলিক সংকট হিসেবে হাজির করেছেন। নারী অধিকার এবং ফেমিনিজমের মৌলিক তফাৎ মুলত এখানেই; অধিকার নিয়ে সেকুলার কিংবা ইসলামিস্ট সবাই আলাপ তুলতে পারে, অন্যদের সচেতন করতে পারে, কিন্তু একে মৌল প্রণোদনা ভেবে ‘শ্রেণীবিদ্ধেষ’ জাগিয়ে তোলা আর যা কিছু হোক, অধিকার সচেতনতা না।

ক্ষমতা এবং অর্থনীতি ইসলামের (كلي ) সামগ্রিক প্রস্তাবনার (جزء اضافي ) শাখাবিশিষ্ট একটা অঙ্গ। জুযঈ ইদাফি এজন্য যে, এর আনুষঙ্গিক বিষয় নিয়েও শাস্ত্রাকারে আলাপ করা যাবে। এজন্যই দেখবেন , ইসলামের ইকতেসাদ / economy নিয়ে শাস্ত্র হিসেবে পাঠ পর্যালোচনা হয়। ইভেন ইসলামের নিরঙ্কুশ শাখা (جزء حقيقي ) (যেমন যাকাত) নিয়েও বহু আলাপ আছে। ইসলামে সমাজ এবং (تدبير المنزل) গার্হস্থ্য বিজ্ঞানের মতো শাখা-শাস্ত্রে নারী-পুরুষ এবং পরিবার শৃঙ্খলা নিয়ে আলাপ করা হয়েছে, একে মৌল প্রণোদনা ভাববার সুযোগ নেই। বরং এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে মানুষের ধর্মীয়, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক মুক্তি। নারী-পুরুষের বৈষম্য দূর করে রাজনৈতিক দাসত্ব জিইয়ে রাখলে সেই মুক্তিকে মুক্তি বলে না।

ইসলামে নারীর অধিকার আছে, তবে বিশেষ শ্রেণীর অধিকার রক্ষার নামে বিভেদের রাজনীতি ‘আসাবিয়াতের’ অংশ। ইসলামে যেকোন সংকটের সুরাহা সঙ্গবদ্ধতা ছাড়া অসম্ভব, খারেজি-প্রচেষ্টা ফেৎনার দ্বার খুলে দেয়। এজন্য ইসলাম গরিবকে সহনশীলতা শেখানোর পাশাপাশি ধনীকে নির্দেশ দিয়েছেন যাকাতের। দানের প্রতি অনুপ্রাণিত করেছেন। নারীর যাবতীয় দায়িত্ব পুরুষের কাঁধে তুলে দিয়ে নারীকে পুরুষের ‘দায়িত্বশীলতার মূল্যায়ন’ করতে বলা হয়েছে। সমাজের যৌথ-প্রক্রিয়ায় কেউ স্বয়ংসম্পূর্ণ না, নির্ভরতা জরুরি।

৪.

নারী কেন নারীবাদকে অপছন্দ করে? ফেমিনিজম নারী অধিকারের প্রতিনিধিত্ব করে থাকলে, নারী তো স্বাধিকার বিরোধী হতে পারে না। এন্টি-ফেমিনিজম কোন নতুন জিনিস না, গত শতকের সত্তরের দশকে marabel morgan এর ‘The total woman’ বইটি বেষ্টসেলার হয়েছিল। কয়েক বছর আগেও পশ্চিমে ‘নারীবাদ বিরোধী প্ল্যাকার্ড’ নিয়ে সোসাল মিডিয়া উত্তাপ ছড়িয়েছিল নারীরা। তাদের প্ল্যাকার্ডে বিচিত্র বাক্য প্রদর্শিত হয়েছিল– “I don’t need feminism because I believe in equality not entitlement and supremacy । আবার কেউ লিখেছিল, I don’t need feminism because it reinforces the men as agent and women as victims dichotomy। বিশেষত, তারা নারীদের ঐতিহ্যিক প্রথার প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। তারা মনে করেন, মা হিসেবে ঘরে থাকার অধিকার ক্ষুন্ন করছে ফেমিনিজম, আমরা যথার্থ-মা হতে চাই; একটা সুস্থ পরিবার ও সমাজ গড়ে তুলবো। (৩)

৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ সালে BBC news ‘why so many young women don’t call themselves feminist’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল Dr Christina scharff এর তৈরিকৃত। তিনি আশ্চর্য হয়ে বলেন, “‘So it’s perhaps unexpected that the identity ‘feminist’ has not gained more popularity among young women in the western world” পশ্চিমা সমাজে ফেমিনিজম এখনও যুবতী নারীদের আকর্ষণ করেনি, মুসলিম সমাজে এটি ঢের বেশি জটিল। ইত্যাদি কারণে নারীবাদ এবং নারী অধিকারকে আলাদা করেই দেখতে হবে।

তথ্যসূত্র:

১. Assess the Impact of Feminist Thought on Contemporary Politics, Keith Smith, 2007
২. প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ২
৩. ‘Women against feminism’, Cathy young,2014

 

আগের সংবাদবাংলা ইসলামি গান ও জাতীয় কবির অবদান
পরবর্তি সংবাদবরিশালে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত বেড়ে ১০