নিঃশব্দে ভালোবাসা যায় না : ভা লো বা স লে শ ব্দ হ য়

মুহিম মাহফুজ:

ইউসুফ। আমাদের বন্ধু। রক্ত সম্পর্কে চাচাতো ভাই। শৈশবের ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের মধ্যে ইউসুফই একমাত্র, যার সাথে আমাদের কখনো ক্ল্যাশ তৈরি হয়নি। আমাদের শৈশবের বন্ধুমহলে ইউসুফ ছিলো সবচেয়ে নিরীহ। চারজনের দলে আরো ছিলো চাচাতো ভাই মামুন। ফুফাতো ভাই সাগর। আর আমি। বয়সে আমিই সর্বকনিষ্ঠ। বাকিরা আমার তুলনায় আড়াই বা তিন বছরের জেষ্ঠ্য। কিন্তু বয়সের ব্যবধান সরিয়ে বন্ধুত্বে আমরা সমান।

আশ্চর্যের ব্যপার, চারজনের মধ্যে ইউসুফ ছাড়া বাকি তিনজনের নামই বর্তমানে বদলে গেছে। মামুনের আকিকা করা নাম ছিলো সিদ্দিক আহমাদ মামুন। হেফজখানা পার হয়ে কিতাবখানা পর্যন্ত সে নামই বহাল ছিলো। গোল বাঁধলো গিয়ে দাখিল পরীক্ষার রেজিস্ট্রেশনে। সমস্ত ডকুমেন্টস ঠিকঠাক সাবমিট করার পরও নিজের নাম ভুল আসলো। সিদ্দিক আহমাদ মামুন হয়ে গেলো আমীরুল ইসলাম। পরীক্ষার আর মাত্র কয়েকদিন বাকি। অধ্যক্ষ সাহেব বললেন, পরীক্ষার পর ঠিক করে দেওয়া হবে। অগত্যা পরীক্ষা দিয়ে দিতে হলো।

দাখিল দেয়া হলো। পরিবর্তনের চেষ্টা করা হলো। কিন্তু কাজ হলো না। দেখতে দেখতে আলীম এসে গেলো। অধ্যক্ষ সাহেব যথারীতি বললেন, পরীক্ষার পর ঠিক করে দেওয়া হবে। আলীমও দেওয়া হলো। নাম আর বদলানো গেলো না। যেটুকু করা গেলো, তা হলো, আমীরুল ইসলামের সাথে মামুনকে জুড়ে দেয়া। সেই থেকে সিদ্দিক আহমাদ মামুন হয়ে গেলো আমীরুল ইসলাম মামুন।

আল্লাহর শোকর, আমার সমস্ত নাম-ঠিকানাই ঠিকঠাক ছিলো। কোনো জটিলতা হয়নি। তবে যেটুকু রদবদল হয়েছে, সেটা সম্পূর্ণ স্বেচ্ছায় স্বজ্ঞানে এবং সর্বোপরি বিনা প্ররোচনায়!

টুকুটাক যখন লিখতে-টিখতে শুরু করলাম, দেখলাম লোকজন কী সুন্দর সুন্দর নাম ব্যবহার করে। পরে জানলাম, এসব নাম নিজেদের নেয়া। বাবা-মার দেয়া আকিকা করা নাম নয়। বিভিন্ন লেখকের নানান বইপত্র পড়ার মধ্য দিয়ে আরো জানলাম, লেখালেখিতে নিজস্ব পছন্দসই নাম বা ছদ্মনাম নেয়া অনেক পুরোনো রীতি। বিশ্ব সাহিত্যসহ বাংলা সাহিত্যের বহু লেখক নিজেই নিজের জন্য নাম নির্বাচন করেছেন। আবার অনেকেই সাময়িক বা স্থায়ীভাবে বিভিন্ন ছদ্মনামও ব্যবহার করেছেন। সেই ভরসায় নিজে নিজেই একটু মাতব্বরি করে লিখতে শুরু করলাম-মহিম মাহফুজ। বছর দশেক এই নামই চললো। তবে বছর দশেক বাদে কিঞ্চিত সমন্বয় যেটা হয়েছে, সেটা হলো, মহিম-এর ম আগে নিঃসঙ্গ ছিলো এবং শব্দ বেচারা ছিলো বাঙালি। এখন তার নিচে একটা হ্রস্ব উ যুক্ত করে শব্দটিকে আরব করে তোলা হয়েছে। বাঙালি মহিম এখন আরব মুহিম হয়ে গেছে। তবে ‘মাহফুজ’ বহাল তবিয়তেই আছেন।

সাগর ভাই বয়েসে আমাদের সবার বড়। বাড়িতে সাগর ডাকলেও, মাদরাসায় ভর্তির সময় ‘ভালো নাম’ রাখা হলো তাওহীদুল ইসলাম। আমরা যেহেতু আগে থেকেই সাগর-এ অভ্যস্ত, আমারা সাগরেই থাকলাম।

কিন্তু তাওহীদুল ইসলাম টিকলো অল্পকাল মাত্র। আমাদের পরের বছর সাগর ভাই দাখিল পরীক্ষার জন্য রেজিস্ট্রেশন করলেন। সেই থেকে তার নাম নিয়ে ভোগান্তির শুরু। রেজিস্ট্রেশন কার্ড যখন হাতে আসলো, দেখা গেলো বাবার নাম এসেছে ভুল। আর নিজের নাম হয়ে গেছে সাইফুল ইসলাম। হায় মাবুদ!
পরীক্ষার আর বেশিদিন বাকি নেই। এখন নাম সংশোধন করবেন নাকি পরীক্ষার প্রস্তুুতি? অধ্যক্ষ সাহেবের দ্বারস্থ হলে তিনি অভ্যস্ত ভঙ্গিতে যথারীতি বললেন, পরীক্ষার পর ঠিক করে দেওয়া হবে। সে আশা নিয়ে আমাদের সাগর ভাই ওরফে সাইফুল ইসলাম পরীক্ষার পিঁড়িতে বসে পড়লেন। পরীক্ষার পর চেষ্টা-চরিত্র কম হলো না। বাবার নাম ঠিক করা গেলেও নিজের আর বদলানো গেলো না। কিন্তু অধ্যক্ষ সাহেব নিরাশ হলেন না। বললেন, হয়ে যাবে। চিন্তা করো না।

সেই নাম নিয়েই তিনি ঢাকা কলেজে ইন্টারে ভর্তি হলেন। পড়াশোনা চলছে আর চলছে নাম সংশোধনের তোড়জোড়। দেখতে দেখতে ঢাকা কলেজের সময় শেষ হলো, কিন্তু বোর্ড অফিসের দৌড় শেষ হলো না। সে অবস্থায়ই অনার্সে এডমিশন নিলেন। বছর দুয়েক সম্ভবত ধারাবাহিকতা বজায় রাখলেন। কিন্তু তার পরই রণে ভঙ্গ দিলেন। আর এগুলেন না। মাদরাসা থেকে দেয়া সেই নামও সার্টিফিকেটে আর ফেরত পেলেন না। সাগর থেকে তাওহীদুল ইসলাম হয়ে জীবনের যে সফর শুরু হয়েছিলো, সাইফুল ইসলামে এসে তার সমাপ্তি হলো।

ব্যতিক্রম শুধু আবু ইউসুফ। আমাদের আবু ইউসুফ এখনো আবু ইউসুফই রয়ে গেলো। নামের কোনো হেরফের হলো না। ইউসুফের ব্যক্তিত্বের মতো ইউসুফের নামও যেনো নির্বিরোধী। সমান্তরাল গতিতে পথ চলাতেই তার আনন্দ।

আমি আর মামুন একই বছর একই মাদরাসা থেকে দাখিল পরীক্ষা দিই। সরকারি মাদরাসা। আমরা বলি ‘আলিয়া মাদরাসা’। পাশাপাশি বেসরকারি মাদরাসায়, মানে কওমি মাদরাসায় সে বছর আমি ‘মেশকাতে’। সম্ভবত ‘কাফিয়া’য় থাকতেই মামুনকে মাদরাসা ছেড়ে দিয়ে চাকরিতে ঢুকতে হয়েছে।

ততোদিনে আমরা বিক্রমপুর থেকে সপরিবারে ঢাকায় চলে এসেছি। গাজিপুর থেকে যাত্রাবাড়ি হয়ে তখন আমাদের বাসা কামরাঙ্গীর চরে। মামুনের পরিবার তখনো বিক্রমপুরে। কয়েকজন কলিগ মিলে একটা ‘ব্যাচেলর বাসা’ নিয়ে থাকে ওরা। আমরা থাকতাম পাশাপাশি মহল্লার কাছাকাছি দুটি বাসায়। সকালে চাকরিতে গিয়ে সন্ধার পর বাসায় ফেরে মামুন। দুজনের পড়াশোনার সুবিধার্থে আমি তখন বেশির ভাগ সময় ওর বাসায়ই থাকি। সারাদিন নোট ঘাঁটাঘাটি করে, সাজেশন মিলিয়ে নিজেদের জন্য শর্ট থেকেও শর্টেস্ট সাজেশন তৈরি করি। সন্ধার পর মামুন এলে দুজনে মিলে ফাইনালাইজ্ড করি। এতো পেরেশানির কারণ ছিলো, আমাদের রেজিস্ট্রেশন যখন কনফার্ম হয়, তখন পরীক্ষার আর মাত্র এক মাস দশ দিন বাকি। টেস্ট পরীক্ষা হয়ে গেছে আরো মাস দুই আগে। এর আগে আমাদের না কোনো কোচিং। না কোনো প্রাইভেট। ক্লাস তো দূরের কথা। তার ওপর আমাদের ব্যাকগ্রাউন্ড কওমি মাদরাসা। বাংলা-ইংরেজি-অংক তো আমাদের জন্য একেকটা দুর্লঙ্ঘ পাহাড়। আল্লাহর ওপর ভরসা ছিলো। আর মাদরাসার পড়ার ফাঁকে ফাঁকে লুকিয়ে লুকিয়ে নিজেরা যতোটুকু পড়তে পেরেছিলাম, তার ওপর কিছুটা বিশ্বাস ছিলো। এই সম্বল পুঁজি করেই সাহস করলাম। তবে অংক বিষয়ে আমাদের অভূতপূর্ব সহোযোগিতা করেছিলেন কামরুল মামা। সম্পর্কে ভাগনি জামাই। অসম্ভব মেধাবী এবং নিরহংকারী একজন মানুষ। তার কাছে মাত্র ঊনিশ দিন ঊনিশ ঘন্টা ক্লাস করেছি অংকের। মামা বলেছিলেন, আপনারা যদি পাশ করেন, আমার জীবনে এটা রেকর্ড হয়ে থাকবে। আলহামদু লিল্লাহ। তার জীবনে রেকর্ড হয়েছিলো। আমরা ব্যর্থ হইনি। সন্তোষজনক নাম্বার নিয়েই পাশ করেছিলাম।

আব্দুল্লাহ স্যার আমাদের দুলাভাই। আমার চাচাতো বোন এবং মামুনের আপন বড় বোনের জামাই। ঢাকার একটি বিখ্যাত প্রাইভেট স্কুল এন্ড কলেজের শিক্ষক। মেধাবী ও যোগ্য নিঃসন্দেহে। রেজিস্ট্রেশনের পর পরামর্শ ও সহযেগিতা নিতে মামুন তার কাছে গেলো। এতো সুনামী শিক্ষক, নিশ্চয় পরামর্শ ও সহযোগিতা দিয়ে উৎসাহিত করবেন। চাকরির পাশাপাশি তার একটা কোচিং সেন্টারও ছিলো তখন। বেশ সুনাম। শহরভরা এতো এতো মানুষকে পড়ান, তার সামান্য সহযোগিতা পেলেই তো আমাদের হয়, অবুঝ মনে তখন কতো আশা। কিন্তু তিনি সহযোগিতার প্রসঙ্গ বাদ দিয়ে পরীক্ষা না দেওয়ার পরামর্শ দিলেন। বললেন, শোনো শ্যালক, পাশ করতে পারবে না। অযথা সময় নষ্ট করো না।

কথাটা যদিও মামুনকে বলা, যেহেতু আমরা তখন একই নৌকার যাত্রী এবং বিপরীত স্রোতের পথিক, তাই আমার গায়েও কথাটা লাগলো। আমরা তার কথায় দমে গেলাম না। আল্লাহর ওপর ভরসা করে পড়া শুরু করলাম। একমাস দশ দিনের ‘অমানুষিক’ পরিশ্রমের পর প্রথম পরীক্ষার দিন যখন প্রশ্নপত্র হাতে পেলাম, আমি শাব্দিক অর্থেই বেকুব বনে গেলাম। মনে হলো, যতো খারাপ পরীক্ষাই দিই না কেন, আমার পক্ষে ফেল করা সম্ভব না। আলিয়া মাদরাসার পড়াশুনার আসল চিত্রটা চোখে ধরা পড়লো। আব্দুল্লাহ স্যারের মুখটা তখন মনে পড়লো। এবং মনে পড়লো কামরুল মামার কথা।

যথাসময়ে পরীক্ষার রেজাল্ট আউট হলো। আমি সেদিন রেজাল্ট জানতে কোনো চেষ্টাই করিনি। সত্যিকারার্থে আমি ছিলাম নির্ভার। নিজের সঙ্গে নিজের যতোটুকু বোঝাপড়া ছিলো, তাতে ভালো রেজাল্টের ব্যপারে একপ্রকার নিশ্চিতই ছিলাম বলা চলে। আল্লাহ হতাশ করেননি। পরীক্ষার আগে আব্বা যদিও ঘোরতর আপত্তি করেছিলেন, এবং ছিলেন আমাদের এই পরীক্ষাযুদ্ধের সম্পূর্ণ বিরোধী। অবশ্য তার কারণও হয়তো ছিলো।

আমাদের ঘরে স্কুলে পড়া একপ্রকার অলিখিতভাবে নিষিদ্ধ ছিলো। বলা ভালো, কওমি মাদরাসাই ছিলো আমাদের পারিবারিক সিলসিলার একমাত্র শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। আমাদের জ্ঞাতি-গোষ্ঠী তো বটেই, আশপাশের দশ গ্রামের মধ্যে আব্বাই ছিলেন প্রথম হাফেজ-আলেম। আব্বার মাদরাসায় পড়া, হাফেজ হওয়া, দূরদূরান্তে গিয়ে ‘সবিনা’ পড়া ইত্যাদি তখন খুব আলোচনার বিষয় ছিলো। অনেক দূর থেকে ‘হাফেজ সাবের বাড়ি’ বললো লোকজন একডাকে চিনে ফেলতো।

আমার বড় ভাইও হাফেজ হয়েছেন কওমি মাদরাসায়। স্কুলের পথ মাড়াননি। যেহেতু তখন মহিলা মাদরাসার এতো চল ছিলো না, সম্ভবত তাই আমার বড় চার বোনের মাদরাসায় পড়া হয়নি। বাড়ির দু’শো গজের আওতায় যে প্রাইমারি স্কুল ছিলো, বাধ্য হয়ে সেখানেই পড়তে হয়েছে। তবে ও পর্যন্তই। প্রাইমারিতে প্রায় সবাই সিরিয়ালের ছাত্রী ছিলেন। মেধাবী ছাত্রী হওয়ায় হাই স্কুলের জন্য স্যাররা খুব অনুরোধ করেছেন। কিন্তু দূরের হাই স্কুলে আব্বা তার কোনো মেয়েকেই পাঠাননি। সেই ঘরের ছেলে হয়ে আমি দুম করে পরীক্ষা দিয়ে ফেলছি! তাও আবার কওমি মাদরাসায় এক বছর ড্রপ করে! কোনোভাবেই আব্বা মানতে পারছিলেন না। আর তখন, দু’ হাজার নয় কি দশ সালে, কওমি মাদরাসায় এখনকার মতো এতো ব্যাপক হারে পরীক্ষার প্রবণতা ছিলো না। পারিবারিক রক্ষণশীলতার পাশাপাশি কওমি মাদরাসার নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গীও হয়তো আব্বাকে প্রভাবিত করে রেখেছিলো। সম্ভবত আমাদের কাছাকাছি সময়েই কওমি মাদরাসায় ছোট পরিসরে এই ঢেউ উঠতে শুরু করেছিলো। এখন সেটা ফুঁলে-ফেঁপে কতো বিরাট আকৃতি নিয়েছে।

আব্বার ছিলো অনেক আশঙ্কা। আমি আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে আব্বাকে আশ্বস্ত করতে পেরেছিলাম। আশঙ্কার কিছু নেই। আপনার ছেলে এখন ভালো-মন্দ বুঝতে শিখেছে। পথ হারাবে না। যদিও পরে জানতে পেরেছিলাম, আব্বা নিজেও দাখিল পরীক্ষা দিয়েছিলেন। তবে সত্তুর দশকের আলিয়া আর এখনকার আলিয়া ‘আসমান-জমিন’ তফাৎ। সবগুলো পরীক্ষা হয়তো আব্বা দিতে পারেন নি। পরীক্ষার হল থেকেই চলে গিয়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিংয়ে। সে গল্প অন্য দিনের জন্য তোলা রইলো।

রেজাল্টের দিন আব্বা অস্থির হয়ে গেলেন। ছুটোছুটি করে মোবাইলে রেজাল্ট জানলেন। তার ছেলে ‘ফার্স্ট ক্লাস’ পেয়েছে, এতে তিনি যারপরনাই আনন্দিত। আমাকে ফোন করে বললেন, ওই চোট্টা, আজকে না তর রেজাল্ট দিবো। কই গেছোস তুই?

আব্বা সম্ভবত ভেবেছিলেন, ফেলের আশঙ্কায় আমি হয়তো দূরে কোথাও আত্মগোপনে আছি। আমাদের ফেলের বিষয়টা কি এতোটাই নির্ঘাত ছিলো!
সেদিন আমি দূরে গিয়েছিলাম নিশ্চয়, তবে ফেলের আশঙ্কায় নয়। পাশের নির্ভরতায়। রেজাল্টের হাঙ্গামা শেষ হলে বাসায় ফিরেছিলাম রাত করে।
পরীক্ষার প্রস্তুতিকালীন সময়ে পরিবারের লোকদের হাত গুটিয়ে নেয়া, আমার সাথে আব্বার কথা বন্ধ করে দেয়া, এসব কারণে কি আমার সেদিন সামান্য দুঃখ লেগেছিলো? আমি কি সেই দুঃখের শোধ নিতেই তাদের রেজাল্টের অস্থিরতায় ফেলে দিয়েছিলাম? এসব প্রশ্নের উত্তর আমি দেবো না। শুধু বলবো, আব্বার আনন্দ আমাকে ছুঁয়ে গেছে। আব্বার সামনে আমার মার গোপন গর্ব আমার পদক্ষেপকে আরো মজবুত করেছে। আমার ঘাড়-গর্দান আরো সোজা এবং শক্ত করেছে।

রেজাল্টের পর, যতোটুকু মনে পড়ে, মিষ্টি নিয়ে কামরুল মামার বাসায় গিয়েছিলেন। ইচ্ছে ছিলো, প্রথম মিষ্টি নিয়ে যাবো আব্দুল্লাহ স্যারের বাসায়। গিয়েছিলাম কি? ইচ্ছে যদিও ছিলো। তবু ইচ্ছে করেই যাইনি। পৃথিবীর বাতাসে কথারা মিলিয়ে যায়। কীর্তিগুলো ইতিহাস যতœ নিয়ে লিখে রাখে।

‘পৃথিবী এক নষ্ট জাদুর দেশ
হৃদয়ের কাছ থেকে আমি তারে খুব দূরে রাখি
আমি তারে সন্দেহ করি নিঃশর্ত’

মটুকপুর মাদরাসাই আমাদের চারজনের প্রথম মাদরাসা। আমার বয়স যখন পাঁচ কি ছয়, কিংবা আরো কম, তখনই আব্বা একদিন ক্লাস ওয়ানের বই এনে দিলেন। অবশ্য তার আগেই, যতদূর মনে পড়ে, মার কাছে ঘরে থেকেই পড়তাম। আদর্শলিপি শেষ হয়েছিলো। সম্ভবত বানান করে বাংলা পড়তেও পারতাম। আরবির হরফ চেনাও হয়েছিলো ততোদিনে। কিছু কিছু দোয়া, বেশ কিছু সুরা এবং হাদিসের টুকরো অংশও সম্ভবত মুখস্থ ছিলো। মুখস্থ ছিলো সপ্তাহের সাত দিন ও বারো মাসের ইংরেজি নাম ইত্যাদি।

মাদরাসাটি আমাদের বাড়ির মুখোমুখী। বাড়ির পূবে ছিলো আমাদের গোসলের পুকুর। তারপরই মাদরাসার মাঠ আর একতলা লম্বা একটা সাদা ভবন। ঘরের জানালা দিয়ে তাকালে মাদরাসার জানালা দিয়ে আমরা দেখতে পেতাম, ছাত্ররা ঝুলে ঝুলে পড়ছে। বাচ্চারা যখন জোরে জোরে মাখরাজ মুখস্থ করতো, চল্লিশ হাদিস মুখস্থ করতো, ঘরের বারান্দা বা বাড়ির উঠোন থেকেই সেই শব্দ শুনতে পেতাম।

আব্বা ছিলেন মাদরাসার প্রিন্সিপাল। মাদরাসার পরিভাষায় বলা হতো ‘বড় হুজুর’। ছিলেন অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। মনে পড়ে, যেদিন বই আনলেন, দুপুরে ঘরের পূবপাশের খোলা জায়গায় মাটিতে পাটি বিছিয়ে বই নিয়ে বসেছিলাম। বইয়ের প্রচ্ছদে নিচের দিকে লেখা ছিলো- বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশ (বেফাক)। সম্ভবত তিনটা। বাংলা ইংরেজি আর অংক। প্রায় সারাটা দুপুর কয়েকজন মিলে সেই বইগুলো নাড়াচাড়া করছিলাম। বানান করে করে পড়ছিলাম। সুন্দর সুন্দর ছবিগুলো বারবার দেখছিলাম।

তিন বছরে ওয়ান টু থ্রি শেষ হলো। আমার প্রাতিষ্ঠানিক বাংলা পড়ারও ইতি ঘটলো। তারপরের বছর উঠে গেলাম নাজেরা বিভাগে। আমপারা শেষ হলে যারা হেফজ পড়তে চায়, তারা নাজেরা পড়ে। মানে কুরআন শরিফ দেখে দেখে পড়ে তিলাওয়াত শুদ্ধ করা এবং দ্রুত পড়তে পারার যোগ্যতা তৈরির ক্লাশ। গড় হিসেবে একবছর মেয়াদী হলেও কারো আরো কম সময়ে পুরো কুরআন বিশুদ্ধ ও দ্রুত পড়ার যোগ্যতা হয়ে যায়। তারা ‘হেফজখানায়’ উঠে যায়। কারো আবার একবছরের বেশিও লাগে। আমার, যতোদূর মনে পড়ে, এক বছরের কিছু কম লেগেছিলো।

আমি আর মামুন একই দিনে মাদরাসায় ভর্তি হয়েছিলাম। এই মাদরাসাই ছিলো আমার জীবনের প্রথম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। স্কুলে যাওয়া আমার হয়নি। মামুন কয়েক ক্লাশ স্কুলে পড়েছিলো। তবে মাদরাসায় আমরা ছিলাম একই ক্লাসে। কথা ছিলো, আমরা একই সাথে ‘হেফজখানা’য় উঠবো। হেফজের সবক নিবো। কিন্তু থ্রি বা নাজেরা, কোনো এক বছর আমার জন্ডিস ধরা পড়লো। বেশ কিছু দিন মাদরাসায় গেলাম না। বাড়িতেই থাকলাম। চিকিৎসা চলতে থাকলো। বলতে গেলে, সে এক মজার সময় ছিলো আমার জন্য। ছয় বোন আর তিন ভাইয়ের বড় সংসার আমাদের। ভাইদের মধ্যে মেজো হলেও আমার বড় তখন চার বোন। এক ভাইয়ের পর পরপর চার বোন কিনা, তাই একটা ভাইয়ের জন্য সবার আকাঙ্ক্ষা ছিলো তীব্র। সেই তীব্র আকাঙিক্ষত সময়ে আমার জন্ম। তাই ঘরের সবাই স্বভাবতই আমার প্রতি একটু বেশি আদুরে ছিলেন। আর যখন অসুখে পড়লাম, তখন তো আদরের আতিশয্য।

প্রায় প্রতিদিন সকালে ডাবের পানি খেতে হতো। থানকুনি পাতার ঝোল, শিং মাছের ঝোল, এসব ছিলো আমার নিত্যদিনের খাবার। আর বিশেষ যে বস্তুটা গলধকরণ করতে হতো, সেটা হলো অর্জুন গাছের ছাল ভেজানো পানি। রাতে ভিজিয়ে রাখা হতো। লাল ছাল সারারাত ভিজে গিয়ে পানিকে কিছুটা লাল করে তুলতো। সেই পানিতে গুড় গুলিয়ে পান করতে হতো রোজ সকালে। এসব স্বাস্থ্যকর খাবার এখন কতো তত্ত্ব-তালাশ করে জোগাড় করতে হয়। কিন্তু তখন ছিলো দুচোখের বিষ। আবার মাঝেমধ্যে বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে গ্রামীণ বাংলার প্রাচীন পদ্ধতিতে মাথা ধুইয়ে জন্ডিসের চিকিৎসা করাতে হতো। এই পদ্ধতির কার্যকারিতা নিয়ে আমি এখনো পশ্নবিদ্ধ। মাথায় চুন মেখে ধুয়ে ফেললে কি সত্যি সত্যিই জন্ডিস কমতে পারে? জন্ডিস কি মানুষের মাথায় থাকে?

মানুষ হিসেবে আমরা খুব সামান্যই জানি। আমাদের জানার বাইরে পৃথিবীর কতো জ্ঞান আর রহস্য রয়ে যাচ্ছে!

বছরের প্রায় অনেকটা সময় চলে গেলো সুস্থ হতে। এর মধ্যে আমি এক বছর পেছনে পড়ে গেলাম। মামুন আমার একবছর আগেই ‘হেফজখানা’য় উঠে গেলো। মাসুম ভাই, হাবিব ভাই, মজনু ভাই, জাকির কাক্কু, রাসেল ভাই- সম্ভবত এরা সবাই একই সাথে বা কাছাকাছি সময়ে হেফজ নিলেন। আমি আর ইউসুফ নিলাম তার পরের বছর।

যেদিন প্রথম সবক নিবো, দুজনে ঠিক করলাম, মিষ্টি খাওয়াবো সবাইকে। সম্ভবত এমন একটা চল তখন ছিলো। এখনো হয়তো আছে, সঠিক করে বলতে পারছি না। ইউসুফ বাড়ি থেকে টাকা আনলো। আমিও আব্বার থেকে টাকা নিলাম। বাজার টাইমে দুজনে রওনা করলাম সিদ্ধেশ্বরী বাজার। মটুকপুর থেকে সিদ্ধেশ্বরী বাজার সোজাসুজি দক্ষিণে। এক মাইল দূরত্বে। মাঝখানের এক মাইল জুড়ে বিশাল আলুর বিল। তখন সম্ভবত আলু তোলা শেষ। খালি বিলের ধুসর জমিনে এলোপাথাড়ি পড়ে আছে নাড়ার কাড়ি। অথবা আলু তোলা তখনো হয়নি। বিলভরা সবুজ আলুগাছ। আমরা বিল পাতালে হেঁটে হেঁটেই বাজার ধরলাম।

তখন মিষ্টির সের ছিলো সম্ভবত চল্লিশ টাকা। তবে ইউসুফের স্মৃতি বলছে, পরিমাণটা হবে ষাট কি সত্তুর। আর দুধের সের ছিলো ষোলো বা বিশ। ডিমের হালি আট কি দশ। এখন যেমন সবকিছু কেজির হিসেবে পরিমাপ করা হয়, তখন গ্রামের দিকে প্রচলন ছিলো সেরের। অন্তত আমাদের ওদিকটাতে- যেটা এখনকার মুন্সিগঞ্জ আর তখনকার বিক্রমপুর। সময়টা সম্ভবত ১৯৯৮ বা তার কাছাকাছি। দুজন মিলে বাজার থেকে তিন বা চার সের মিষ্টি কিনলাম। দুইজন দুই ব্যাগ নিয়ে আবার বিল পাতালে হেঁটে হেঁটে মাদরাসায় আসলাম। আসতে আসতে সম্ভবত দুপুর হয়ে গিয়েছিলো। সবাইকে মিষ্টি বিতরণ করা হলো জোহরের নামাজের পর। সেদিন থেকে শুরু হলো আমাদের হেফজখানার সফর।

হেফজখানায় আমরা বসতাম দুই সারিতে লম্বা হয়ে। মাঝবরাবর একপাশে ছোট্ট তোশকের গদির উপর ডেস্ক নিয়ে বসতেন হুজুর। হেফজখানার হুজুরদের বলা হতো ‘হাফেজ সাব হুজুর’। আমি প্রথম যে হুজুরকে পাই, তার নাম ছিলো নুরুল ইসলাম। ছিলেন লম্বা এবং বেশ স্বাস্থ্যবান। আমাদের তখনকার ছোট ছোট চোখে তাকে অনেক লম্বা আর অনেক মোটা মনে হতো। সম্ভবত সে কারণেই, সবাই তাকে বলতো ‘ভুট্টু হুজুর’। সামনাসামনি তো প্রশ্নই ওঠে না। আড়ালে আবডালে আর কি।

নুরুল ইসলাম হুজুর ছিলেন আমাদের জন্য ‘সরাসরি আজরাইল’। তার ‘মাইর’-এর ভয়ে সবাই সবসময় তঠস্ত থাকতো। আর মারতেন যে, বিলকুল বে-রহম। লম্বা মোটা আর শক্ত হাতে ঘাড় ধরে ডেস্কের ওপর রেখে পিঠে যখন বেত চালাতেন, নড়াচড়ার শক্তি থাকতো না কারো। ভয়েই কলিজা গলে যাবার উপক্রম। তার কাছে সবক নিয়ে যাওয়া মানে হলো, যেচে গিয়ে আজরাইলের সামনে হাজির হওয়া। তাকে তির্যকভাবে ‘ভুট্টু হুজুর’ বলার পেছনে এই অতি মারধরও কি একটি অন্যতম কারণ ছিলো না?

হুজুরের বাড়ি ছিলো ময়মনসিংহের গফরগাঁও। বিক্রমপুরের আঞ্চলিক ভাষা ছাড়া অন্য কোনো উচ্চারণ আমি তখনো শুনিনি। হুজুরের মুখ থেকেই প্রথম শুনেছিলাম, অক্করে মাইরালবাম, খাইয়ালবাম, কইরালবাম জাতীয় ভাষা। বুঝলাম, গফরগাঁওয়ের লোকেরা এভাবে কথা বলে। আমাদের জন্য এই ভাষা ছিলো একেবারে নতুন আর ভীষণ কৌতুককর।

আমরা প্রতিদিন যে পরিমাণ সামনের পড়া মুখস্থ করে শোনাতাম, হেফজখানার পরিভাষায় সেটাকে বলা হতো ‘সবক’। আমার সবক শুরু হয়েছিলো সম্ভবত ত্রিশ নাম্বার পারা থেকে। তারপর ঊনত্রিশ আটাশ হয়ে সাতাশ পর্যন্ত। প্রথম দিন থেকে আমি সবক দিতাম আধা পৃষ্ঠা করে। কে একজন যেনো আমাকে বলেছিলেন, বেশি করে সবক দিয়ে সামনে চলে গেলে পেছনের পড়া ভুলে যাবো। সেই ভয়ে কিছুদিন আধা পৃষ্ঠা করেই চললো। কিছুদিন পর আমি লক্ষ্য করলাম, এশার নামাজের আগেই আমার আধা পৃষ্ঠা মুখস্থ হয়ে যাচ্ছে।

তখন নিজে নিজেই চেষ্টা করলাম একপৃষ্ঠায় উঠে আসতে। বেশ পারলাম। আলহামদু লিল্লাহ। তখন থেকে একপৃষ্টাই চলতে থাকলো। শুরু থেকেই আমার পাশে যে বসতো, তার নাম আব্দুল হামিদ। পাশাপাশি বাড়ির ছেলে আমরা। বয়সে আমার চেয়ে বেশ কয়েক বছরের বড়ই হবে। মাগরিব নামাজের পর থেকে আমরা সবক মুখস্থ করতে শুরু করতাম। এশা পর্যন্ত সময় পেতাম দেড় থেকে দুই ঘন্টা। এশার পর আবার ঘন্টাখানেক। তারপর খাবার-দাবার। তারপর ঘুম।
ঘুম থেকে উঠতে হতো তাহাজ্জুদের সময়। আজানেরও প্রায় ঘন্টা দেড়েক আগে। হেফজখানার সবচেয়ে কষ্টের সময় সম্ভবত এটাই। ঘুম থেকে উঠেই একের পর এক সবক শোনোতো। অধিকাংশ দিন ফজরের আগেই শেষ হয়ে যেতো। কোনো দিন কেউ বাকি থাকলে, ফজরের পর।

আব্দুল হামিদ আমাদের মধ্যে সবচেয়ে কম সবক শোনোতো। কোনোদিন পাঁচ লাইন কি কোনোদিন আট লাইন। কোনেদিন আরো কমে তিন লাইনে গিয়েও ঠেকতো। আর ভুট্টু হুজুরের মাইর প্রায় প্রতিদিনই খেতে হতো। এর মধ্যে যদি কোনো ভুল হয়েই যায়, সেদিন আর মাইর দেখে কে।

আমি যখন ত্রিশ পারায়, আব্দুল হামিদের সবক তখন সাতাশ পারায়। প্রতিদিন আব্দুল হামিদের সাথে বসে সবক মুখস্থ করার ফলে আমার এক বিশেষ লাভ হয়ে গেলো। ওর সবক ছিলো সুরা আর রহমানে। যেহেতু ও অল্প অল্প করে সবক দিতো এবং মুখস্থ’ করার জন্য একই আয়াত বারবার আর বারবার করে পড়তো, সেই সুযোগে ওর পড়া শুনতে শুনতে সুরা আর রহমানের প্রায় পুরোটাই আমার আধাআধি মুখস্থ হয়ে গেলো। তার পরের সুরা ওয়াকিয়া তো আগে থেকেই মুখস্থ ছিলো। সাতাশ পারায় সবক যাওয়ার আগেই আমার প্রায় সেই পারার ছয় পৃষ্ঠা মুখস্থ হয়ে গেলো। সেই সুযোগ আমি কাজে লাগালাম যথাসময়ে।

যেদিন সুরা আর রহমানে সবক আসলো, আমি পূর্বপ্রস্তুতি মতো এক দাগের ছয় পৃষ্ঠা খুব ভালোভালো ‘ইয়াদ’ করলাম। সবক দিতে গিয়ে নিয়মের ব্যতিক্রম ঘটিয়ে এক পৃষ্ঠার জায়গায় দুই পৃষ্ঠা পড়লাম। হুজুরকে খুশি মনে হলো। তারপর তিন পৃষ্ঠা। হুজুর হয়তো মনে মনে ভাবলেন সুরা আর রহমান শেষ করবো। শেষ করলাম বটে। থামলাম না। পরপরই সুরা ওয়াকিয়া শুরু করলাম। হুজুর একটু অবাক হলেন। আমি পড়তে থাকলাম। চার পাঁচ ছয় শেষ করে তবে থামলাম। হুজুর খুব অবাক হলেন এবং ভীষণ খুশি হলেন। আমি যতোখানি খুশি হয়েছিলাম, তার চেয়ে বেশি হয়েছিলাম ভীতিমুক্ত।

সবক শেষ করে যখন উঠবো, পকেট থেকে পাঁচ টাকা বের করে দিলেন। হুজুরের পক্ষ থেকে পুরস্কার। একসঙ্গে ছয় পৃষ্ঠা সবক দিয়ে যতোটা না খুশি হয়েছিলাম, তারচেয়ে হাজার গুণ বেশি খুশি হলাম হুজুরের হাত থেকে এই পাঁচ টাকা পুরস্কার পেয়ে। অন্য কোনো হুজুর হলে আলাদা কথা, নুরুল ইসলাম হুজুর! বিশ্বাসই করা যায় না! সেই পাঁট টাকাই সম্ভবত আমার জীবনের প্রথম পুরস্কার, যেটা কোনো হুজুর আনফরমালি আমাকে দিয়েছিলো। আর তিনি ছিলেন আমাদের সাক্ষাত আজরাইল, আমাদের আতঙ্কের একনাম।

সেই কতোদিন আগের কথা! হুজুর এখন কোথায় আছেন, জানি না। হুজুরকে একবার দেখতে খুব ইচ্ছে করে। আড়ালে আবডালে না বুঝে কতো দুষ্টুমি করেছি। সেই ছোট্ট বাচ্চাটি এখন বড় হয়ে গেছে। একবার কি ক্ষমা চেয়ে নিতে পারবো? হুজুর নিশ্চয় এখন বুড়ো হয়ে গেছেন। আমাদের কি চিনতে পারবেন আর? আমাদের না হয় নাই বা চিনলেন, ছবির মতো সুন্দর একটি গ্রাম মটুকপুর কি এতো সহজে ভুলে যেতে পারবেন? বিশ্বাস করুন হুজুর, না চিনলেও আমাদের এখন খারাপ লাগবে না। আপনি আমাদের মনে রাখবেন, তেমন কিছু কি আমরা তখন করতে পেরেছিলাম?

আমরা যে দুষ্টুমি করে আপনাকে কী সব নামে ডাকতাম, সেসব তো আপনিও জানতেন। কিন্তু কিছুই বলতেন না। আপনার মারমুখী চেহারার আড়ালে এই সহনশীল চেহারাটা কখনোই আমরা চিনতে পারিনি। আমরা এখন বয়েসে কিছুটা বড় হয়েছি। আমাদের অনেকেই এখন শিক্ষক। আমাদের ছাত্ররাও হয়তো আরো অনেক অপ্রকাশ্য নামে আমাদের ডাকে। হুজুর, আপনি জেনে রাখুন, আমরা ওদের কিছুই বলবো না। আপনিও তো আমাদের কিছু বলেননি।

‘প্রত্যাখ্যান আমাকে বিনির্মাণ করতে শেখায়
প্রত্যাখ্যানের প্রতিটি গল্পই আমার পূণর্জন্মের ইতিহাস
ডিঙোতে-না-পারা সিঁড়িগুলো উপর ধেকে আমাকে দেখে
আমি তখন লাভ করি নিচ থেকে প্রদর্শিত হবার জ্ঞান

না-উপর না-নিচ যে বাতাস মধ্যপন্থা দখল করে থাকে
তারও তো ইতিহাস আছে
আমাকে সে প্রশ্ন করে ভবিষ্যৎ
ভবিষ্যতের সাথে জয়-পরাজয়ের যে সুতো আমরা বেঁধে দিয়েছিলাম
আমি তা নিঃশব্দে কেটে দিয়ে তার দিকে তাকাই
বুঝতে পারি, শব্দ হয়েছে

নিঃশব্দে ভালোবাসা যায় না
ভালোবাসলে শব্দ হয়’।

আগের সংবাদহেজাযের পথে পথে
পরবর্তি সংবাদএক তরুণ শিক্ষকের ডায়েরি