নিজের ঘরে অতিথি হয়ে আসি 

কাজী মাহবুবুর রহমান:

আমি বড় হয়েছি গ্রামে। একেবারে অজপাড়াগাঁ না। নব্বই দশকের শেষ অর্ধেকে আমার জন্ম। চোখ খুলেই ইলেক্ট্রিক বাতির আলো দেখেছি বলে শোনা গেছে। মসজিদের মাইকে আজানও শুনেছি। আমাদের মসজিদে আজান দিত একজন মধ্যবয়স্ক ইমাম সাহেব। তার নাম আব্দুস সালাম হুজুর। প্রতিদিন পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের ইমামতি করত। আর ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠত অনেক আগে। যখন ঘরের পাশে গরু, ছাগল ও মুরগীর খোয়াড়ে গবাদী পশুগুলিও চুপ করে থাকত। ইমাম সাহেব ঘরঘর মাইকের শব্দে ঘুম ভাঙার দোয়া পড়ত। তারপর নামাজ শেষ করে মসজিদের দরজা জানালা খুলে শিশুদের অপেক্ষায় সুর্যোদয় পর্যন্ত তসবিহর দানা গুনত। যেন পৃথিবীর চেয়েও লক্ষগুণ বড় সুর্যটিকে সে তসবিহর দানায় বেঁধে মসজিদের দুয়ার পর্যন্ত টেনে আনছে। গ্রামভর্তি শিশুরা দলবেঁধে বুকে সিপারা চেপে অপেক্ষমাণ আব্দুস সালাম হুজুরের কাছে কোরআন শিখতে যেত। আমিও সেই শিশু স্রোতটির একটি নগণ্য অংশ ছিলাম।

ফজরের পরে সূর্য সরাসরি চোখে আলো ফেলতে শুরু করলে ইমাম সাহেব মক্তব ছুটি দিয়ে দিত। মক্তবঘরটি মূলত মসজিদের বারান্দা ছিল।ভেতরের অংশে তখনো বর্ষীয়ান মুরুব্বীরা ঝুঁকে ঝুঁকে জিকির করত। আমরা বারান্দায় গলা উঁচু করে বহু দূর দূরান্তে জানান দিয়ে সূরা পড়তাম। আর অপেক্ষা করতাম, কখন সুর্য এসে টিনের বেড়ার ফাঁক গলে চোখে আলো ফেলবে। মনে পড়ে, ইমাম সাহেব সাদা পাঞ্জাবি পরে একটা চিকন বেত হাতে নিয়ে মাথা নিচু করে হাঁটত। তাকে সব সময় ওই এক ভঙ্গিতেই হাঁটতে দেখেছি। কোন এক অদৃশ্য ভারে সে অবনত ছিল।

আমাদের গ্রামজুড়ে শুদ্ধ কোরআন শরিফ পড়তে জানা কোন লোক ছিল না। ইমাম সাহেব সব সময় আফসোস করত। সে নিজেও হাফেজ ছিল না, কিন্তু তার ইচ্ছা ছিল একদা হিন্দুপ্রধান এই গ্রামে কোন একটি ছেলে হাফেজ হোক। বেশ কয়েকজনকেই সে নিজ হাতে পার্শ্ববর্তী থানার হিফজখানায় ভর্তি করে দিয়ে এসেছিল ; কিন্তু সকলেই ফিরে এসেছে। হুজুর সূত্রটি তখনও ধরে রেখেছিল। ফলে ক্রমান্বয়ে আমি তার লক্ষ্যে পরিণত হই এবং সে আমাকে পবিত্র কোরআনের শেষ দশটি সূরার বাইরেও সূরা ইয়াসিনের কিয়দাংশসহ আমপারার কতিপয় সুরা মুখস্ত করাতে উদ্যোগী হয়।

সূরা মুখস্থ করা হয়। এরপর অন্তত দুই বছর সকালবেলায় মক্তব এবং অবশিষ্ট দিন ফড়িংয়ের ডানায় সুতা বেঁধে দিন কেটে যায়।

তারপর হুজুরের পরামর্শ মত আমার বাবা আমাকে দিয়ে আসেন নুরানী মাদরাসায়। হজরত কারী বেলায়েত সাহেব প্রণীত সিলেবাসের নুরানী মাদরাসা। সূর্যোদয়ের পর থেকে বিকাল পর্যন্ত ক্লাস। বাড়ি ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে আসে। পুনরায় পরবর্তী দিনের পড়া প্রস্তুত করে ঘুমিয়ে যাওয়া –এমন এক বিচিত্র বৃত্তের চক্করে ঘুরপাক খাওয়ার জীবন শুরু হয়। তবে এর বিরুদ্ধে আমার কিছু বলার ছিলনা। চোখের সামনে দিয়ে জীবন থেকে আনন্দের উৎসগুলি নাই হয়ে গেছে এবং আমাকেও তা মেনে নিতে হয়েছে। শুধু সাহসের অভাবে প্রতিদিন ক্লাস করেছি।  সময়মত বাড়ি ফিরেছি। আমার সাহসী বন্ধুরা পড়ালেখা না করে মৌচাকে ঢিল মেরে সারা দুপুর গর্তে লুকিয়ে থেকেছে। সে অনুভূতি নিশ্চয়ই একটি যুদ্ধে অংশগ্রহণের সমান। আমি এসবের অনেককিছুই পাইনি। আফসোস রয়ে গেছে।  শৈশব ফিরিয়ে আনা গেলে আমি মাদরাসায় যাওয়ার পথ থেকে পালিয়ে ছৈয়ালবাড়ির বাগানে চলে যাব।

গ্রামের জীবনাচার ইনোসেন্সে ভরা৷ যদিও তারা মানুষগুলি বিশেষ ভাল ছিল না। তবে তাদের জীবন ধারণ খুবই নিষ্পাপ প্রকৃতির। সন্ধ্যা হলেই সবাই হাত পা ধুয়ে ঘরে এসে চৌকিতে বসে থাকে। শিশুরা কিছুক্ষণ গড়গড় শব্দে পড়াশুনা করে পড়ার টেবিলেই ঘুমে ঢলে পড়ে। এ জীবন স্বপ্নের মত। সারাদিন এক ঘেয়ে পড়ালেখার পর সন্ধ্যাবেলা অতি সহসাই আমারও ঘুম আসত। মা ঘুম ঘুম ভাব দেখলেই জোর করে ভাত খাইয়ে দিতে চেষ্টা করত। সর্বোচ্চ সাতটা অথবা সাড়ে সাতটা পর্যন্ত জেগে থাকতে পারতাম। নয়টা বাজতেই সমস্ত গ্রাম সুনসান নীরব। মাটির নীচে রাতজাগা পোঁকা আর বাদুড়ের ডানা ঝাপটানো ছাড়া কোন শব্দ নেই। প্রতিদিন একই নিয়মে সবকিছু ঘটত। সন্ধ্যা হলেই ঘুমিয়ে যেতাম। রাত্রিকালীন এই দীর্ঘ একটি সময় সম্পর্কে জন্মের পর থেকে বহুদিন পর্যন্ত আমাদের কোন ধারণা ছিল না। রাত আমাদের জন্য কেবলই ঘুম উস্কে দিত।

ঘুম ভেঙে যেতো ফজরের আগে। মনে আছে, প্রতিদিন আজান শুনতাম। আমাদের মসজিদে আজান দিত আব্দুস সালাম হুজুর। চোখ মেলে দেখতাম সব অন্ধকার। টিনের ফাঁক গলে বাহির থেকে বাতির আলো আসত ঘরে। চিকন একটি রেখা। দুই পাশে বাবা-মা এখনো ঘুমে। শীতের রাতে ঘুম ভেঙে গেলে লেপের নীচে হাঁসফাঁস লাগত। অন্ধকারে কতক্ষণ কেটে যেত জানিনা; তখনই ফজরের আজান হত। প্রতিদিন একই আজান। মাঝে মাঝে ব্যতিক্রম ঘটে। মাস দুই তিন অন্তর অন্তর আমরা নানুবাড়ি বেড়াতে যেতাম। নানুবাড়ি আমার ভালো লাগতো না। তাদের মুয়াজ্জিন ছিল অনেক বৃদ্ধ। গলার স্বরে বহুদিনের পুরানো শ্যাওলাপড়া বাগানবাড়ি রকমের একটা বিষয় ছিল। সুনসান ভোররাত্রে এমন কণ্ঠস্বর ভৌতিক লাগতো। নানুবাড়ির মুয়াজ্জিন ফজরের আগে অনেকক্ষণ দোয়া-দরুদ পড়ত। ঘুম ভেঙে আব্দুস সালাম হুজুরের আজানের পরিবর্তে ভিন্ন সুরের দোয়া-দরুদ শুনে বুকে কাঁপন ধরে যেতো। যেন হারিয়ে গেছি অনেক দূরে কোথাও। পাশে শুয়ে থাকা একান্ত মা-কেও অবিশ্বাস হতো।

আব্দুস সালাম হুজুরের পরিচিত আজান, নানুবাড়ির বিস্ময়, দ্বিধা ও বিভ্রমের জগত থেকে আমার সম্পূর্ণ বহিস্কৃতি ঘটে দুই হাজার ছয় সালে। নুরানী মাদরাসায় পড়ার দিন শেষ হয়। আব্বা আমার জন্য ভালো হাফেজী মাদরাসা খুঁজতে থাকে। প্রায় ত্রিশ কিলোমিটার দূরে আমাদের পার্শ্ববর্তী থানায় একটা মাদরাসা ছিল। আব্বার পরিচিত কিছু লোকের ছেলেরা সেখানে পড়ত। আমার বয়স তখন আট বছর। একমাত্র ছেলে হিসেবে আমার চেনাজানা জগত মা-বাবা আর তিন বোনের মধ্যে সীমাবদ্ধ। এর বাইরে কোথাও গেলে আমার চোখে পানি এসে পড়ে। হাত দিয়ে ভাত খেতে পারি না। সাঁতার জানি না। হলুদ মরিচের তরকারি খেলে ঝালে পর্যদুস্ত হই। আমার  আদর্শ খাবার ছিল দুধভাত। রিজিয়া নামক এক দূরসম্পর্কের নানী আমাদের বাড়িতে রোজ দুধ দিয়ে যায়। আব্বা যখন মাদরাসায় দিয়ে আসার কথা বলে, আমিও উৎসাহ পেয়েছিলাম। যেন বড় হয়ে গেছি। অতি পরিচিত এই ছোট গণ্ডি ত্যাগের দিকেই আমার প্রধান মনোযোগ ছিল ; কিন্তু নতুন সে জগতের প্রকৃতি সম্পর্কে ভাবার সক্ষমতা হয়নি তখনো। আমি আনন্দের সঙ্গেই বাড়ি ত্যাগ করলাম। মা কাথা বালিশ তোশক রেডি করে দিল। আব্বা আগের দিন বাজার থেকে স্টিলের ট্রাংক কিনে এনেছিল। সেটাও সঙ্গে গেল। প্রথমবারের মত বাড়ি থেকে এতদূর এসে একটি সরকারি গুদামঘরের মত লম্বা টিনশেড ঘর, একটা মসজিদ, কিছু নারিকেল গাছ আর একটা পুকুরবিশিষ্ট আবাসভূমির স্থায়ী বাসিন্দা হয়ে গেলাম।

আব্বা আমাকে ভর্তি করে রেখে চলে গেল। দুপুর পর্যন্ত কোনমতে কেটে গেল। বিশাল এক মসজিদে জোহরের নামাজ পড়লাম। এতবড় মসজিদ কোনদিন দেখিনি। নামাজ শেষে মাদরাসার দেয়ালঘেষা একটা ঘরে সবাই হুড়মুড় করে খেতে গেল। আমি ভীষণ বিপাকে পড়ে গেলাম। সকালে আব্বা অক্ষরে অক্ষরে বুঝিয়ে দিয়ে গেছে, খাবারের সময় হলে সবার সঙ্গে বোর্ডিংঘরে যেতে হবে। ওখানে সবাইকে একসঙ্গে খাবার দেয়া হবে। খুব অল্প সময়ের মধ্যে ঝটপট খেয়ে আসতে হবে। খেতে যেন দেরি না হয়। কিছু লাগলে বাবুর্চিকে বললেই দিবে। সব মনে আছে। তবু কিছুই করতে পারছিনা। জট পাকিয়ে যাচ্ছে। আড়ষ্ট লাগছে। সর্বশেষ আজকে সকালেও মার হাতে ভাত খেয়ে এসেছি। এখন আমাকে কয়েকশ মানুষের ভিড়ে নিজের খাবার খুঁজে নিয়ে খেতে হবে। আমি কিছুক্ষণ এদিক ওদিক ঘুরে খাবারের চিন্তা বাদ দিলাম। যে ঘরটিতে পড়তে বসেছিলাম, সেখানেই বসে রইলাম। খাওয়ার সময় ছেলেরা তুমুল হৈ চৈ করে। তাই একজন হুজুর বেত নিয়ে শাসিয়ে আসে। তারপর তারা নিঃশব্দে ভাত খায়। হুজুর শাসিয়ে এসে ক্লাস রুমে আমাকে দেখে বলল, এই ছেলে এখানে বসে আছো কেন? নাম কি তোমার?

আমি নাম বললাম।

সে বলল, আজকে সকালে ভর্তি হয়েছো তুমি সেই ছেলে না?

আমি বললাম, জ্বী।

সে বলল, খেতে যাও নাই কেন?

আমি জবাব দিলাম না। সে একটা ছাত্রকে ডেকে আমাকে খেতে নিয়ে যেতে বলল। ততক্ষণে খাবারের ঘরে ভিড় কমে এসেছে। অল্পকিছু ছেলে তখন খাচ্ছিল। বাবুর্চিসহ আরো দুয়েকজন স্টাফ ছিল। একজন বৃদ্ধ বাবুর্চী আমাকে ঝোল ঝোল রুই মাছ আর আলু তরকারি দিয়ে ভাত খেতে দিল। তার নাম আবুল হোসেন। সবাই আবুল চাচা ডাকে। ভদ্রলোক প্রয়োজন ছাড়া কথা বলে না। আমাকে ইশারায় জিজ্ঞাসা করল, আমার ডাল লাগবে কিনা। আমি দুইদিকে মাথা নেড়ে না করলাম এবং নিঃশব্দে রুই মাছের কাটা বাছতে থাকলাম। বাবুর্চী আবুল চাচা চেয়ার থেকে সামান্য ঝুঁকে এসেছিল। আবার আগের মত সোজা হয়ে বসল। সহসাই লক্ষ্য করলাম, আশেপাশের সবাই আঁড়চোখে আমার অনভ্যস্ত খাওয়ার ভঙ্গির দিকে তাকিয়ে আছে। ব্যাপারটা বুঝতে পেরে আমি লজ্জায় আরও জড়োসড়ো হয়ে গেলাম।

মাদরাসার শুরুর দিনগুলি আমার নিদারুণ কষ্টে গেছে। সবারই তাই যায়। তবে আমার চেয়ে বেশী কষ্ট কি আমার মা-বাবার হয় নাই? অনেকদিন পর মেজ আপা আমাকে বলেছিল, আমাকে ভর্তি করে দিয়ে আব্বা অফিসে চলে গেছিল। বাড়িতে ফিরতে ফিরতে রাত হয়ে যায়। আজ ঘরভর্তি খালি খালি লাগার দিন। আমি আমার তিনবোনের খেলনার মত ছিলাম। তাদের হাত খালি। মায়ের দারুণ অবসর। দুপুর গড়িয়ে বিকেল পর্যন্ত নানান গল্পে ভুলিয়ে কাউকে ভাত খাওয়াতে হয়না। সেদিন দুধ মাখা ভাত কাকে খায়। আব্বা রাতে ঘরে ফিরে ভাত খেতে বসল। মা সারাদিন অভুক্ত। আব্বা খেতে বসে বলল, ভাত খেতে ভাল লাগছেনা।

মা বলল, দুধ ভাত খাবেন? আব্বা জবাব দিল না। শব্দ করে কেঁদে ফেলল। মাকে বলল, কাল থেকে রিজিয়া খালাকে দুধ দিতে নিষেধ করে দিও।

মাদরাসায় আমি ভীষণ বিপাকে আছি। পদে পদে শুধু ভুল হয়। সবার শেষে অজু করে এসে বোকার মত দাঁড়িয়ে থাকি। হুজুরদের কথার হাঁ-বাচক উত্তরে ‘ জ্বী ‘ বলতে হয়। আমি হু হা বলি। সবাই নীচুস্বরে হাসে। জীবনের অন্যতম একটি দীর্ঘদিন শেষ করে ঘুমাতে গেলাম। কোন এক সময় ঘুমিয়েও পড়লাম। পুরানো অভ্যাস মত ফজরের অনেক আগে ঘুম ভেঙে গেল। সেদিন মনে হয় একটু বেশী আগেই ভেঙেছিল। অন্ধকারের ভেতর সময়ের অনুমান করতে পারছিলাম না।  কোথায় আছি তাও বুঝে উঠতে পারছিনা। শুধু একটা রাতজাগা হুতুমপেঁচা বিষণ্ন গলায় গুড়গুড় করে ডাকছে। হঠাৎ অনেক দূরের কোন মসজিদ থেকে কিছু পরিচিত দোয়া-দরুদের শব্দ শুনতে পেলাম।

তাৎক্ষণিক মনে হল, সম্ভবত নানুবাড়ি এসেছি। হাত বাড়ালেই গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন মায়ের স্পর্শ পাবো। বারান্দার চৌকির তলায় হারিকেনের আলো ম্রিয়মাণ করে ঘুমিয়ে আছে নানা। একটু পর বাড়ির পেছন দিয়ে রহিমদ্দিন খাঁ চড়া গলায় সবাইকে ডেকে ডেকে যাবে –’ উঠুন আল্লাহর বান্দারা সবাই নামাজ পড়তে উঠুন। ‘ এমন কিছুই হল না। সবকিছু মিথ্যা করে দিয়ে ইস্রাফিলের শিংগার মত ক্রিং ক্রিং শব্দে বেল বেজে উঠল। একটা বিশাল মশারির ভেতর থেকে শ’খানেক ছেলে পুনরুত্থান দিবসের মত আধোঘুম চোখে ধড়ফড় করে জেগে উঠল। তারপর একটা একটা করে বাতি জ্বলল। আমি বুঝতে পারলাম, আমি আসলে নানুবাড়িতেও নাই। আমি আছি অনেক দূরে। এত এত মানুষের ভিড়েও আমার চারপাশ অসীম শুন্যতায় ছেয়ে গেল।

প্রতিদিন একটু একটু করে শিখে ফেললাম নতুন জীবনের ভাষা। দুই পা তুলে খাওয়ার কৌশল। নতুন জীবন পুরান হল। এবং এই জীবনই আমার একমাত্র জীবনে পরিণত হল। তখনকার সারাদিনের একটা সংক্ষিপ্ত বিবরণ দেই। সকালে ঘুম থেকে উঠতে হত ফজরের আজানেরও আগে। ফজরের আগে আমাদের দুইজন হাফেজ সাহেব বিশাল ক্লাসরুমটির দুই পাশে বসত। ছাত্ররা পবিত্র কোরআনের নতুন যে অংশটুকু মুখস্থ করত, হুজুরদেরকে তা শুনিয়ে আসত। নতুন পড়া শুনানোর পর্ব চলত ফজরের পর পর্যন্ত। এটাকে হিফজখানার চলতি ভাষায় ‘সবক’ বলে। সবকের পর্ব শেষে সাড়ে সাতটায় সকালের খাবার। ঋতু পরিবর্তনের সঙ্গে খাবারের সময় আগপিছ হত। কখনো সাতটা কিংবা সোয়া সাতটা। খাবারের জন্য নির্ধারিত সময় আধাঘণ্টা। এরপর শুরু হত ‘সাতসবক’। এটাও হিফজখানার বিশেষ পরিভাষা। পবিত্র কোরআনের ত্রিশ পারার যে পারাটিতে ‘সবক’ চলমান, ওই পারা থেকেই ‘সবক’ পূর্ববর্তী সাত পৃষ্ঠা হুজুরকে শুনাতে হয়। ‘সাত পৃষ্ঠা’ সংখ্যাটি থেকেই কি এর নাম ‘ সাতসবক ‘?  সাতসবক অর্থ কী? সকাল –সাতসকাল এমন কিছু? আরবিতে ‘শাতি’ শব্দের অর্থ নদীর তীর। সবকের কাছ ঘেঁষা অংশ বলেই কি এর নাম সাতসবক? যেকোন কিছুই হতে পারে। আমি বিষয়টা তখনো জানতাম না। এখনো জানিনা।

সাড়ে নয়টায় ঘুম। দুপুর বারোটা পর্যন্ত। এরপর গোসল করে ‘আমুখতা’ শোনাতে হয়। আমুখতা ফার্সি শব্দ। শিখে ফেলা বিগত বিষয়কে আমুখতা বলে। আমুখতা শেষে জোহরের নামাজ। নামাজের পরে খাবার। খাবার শেষে আবার পড়া। আবার আছরের নামাজ। খেলার বিরতি। মাগরিবের নামাজ। নতুন পড়া মুখস্থ শুরু। এশার নামাজ। আবার পড়া। দশটা পর্যন্ত। এমন এক কর্মদিবস শেষে পুনরায় বিশাল মশারির নিচে একসঙ্গে ঘুমাতে যাই। একেকটা দিন অবিকল এমনই ছিল। এর বাইরে একদণ্ড শ্বাস ফেলার সুযোগ নেই। দৃষ্টি সীমার ভেতরে কোন আপনজনের ছায়া নেই। আছে অবিরাম জ্ঞান অন্বেষণের তাড়া।

আমি প্রথম একবছর নাজেরানা পড়লাম। নাজেরানা হল কোরআন দেখে দেখে মুখস্থের উপযোগী করে তোলা। দুইজন হাফেজ সাহেবের মধ্যে আমাকে দেয়া হল ছোট হুজুরের কাছে। তার বাড়ি ময়মনসিংহ। তাকে ছোট হুজুর ডাকা হলেও সে ছিল অনেক কঠোর। সবাই তাকে ভয় পেত বেশী। ছাত্রদের বড় বড় অপরাধের শালিস সে করত। আমাদের তেমন চাপ ছিল না। দেখে দেখে পড়া বলা তেমন কঠিন কিছুনা। কিন্তু যারা আমাদের বড় ছিল, মুখস্থ সবক দিত তারা খুবই চাপে ছিল। হুজুর ঘুমাত আমাদের সঙ্গেই। বড় ঘরটির একপাশে পর্দার আড়াল করে। ভোররাতে সে ডেস্কে এসে বসলে পর্দা তুলে দেয়া হত। তখন আমরা দেখতাম হুজুর ভীষণ গাম্ভীর্য নিয়ে বসে আছে। ফজরের আগে তার এই রুদ্রমূর্তি আমাদের অনেকদিন মনে থাকবে। প্রতিদিনই সেসময় হুলুস্থুল বেঁধে যেত। তার কাছে কোন লাইন পুনরাবৃত্তির সুযোগ ছিল না। একবার ভুলে গেলেই বেত্রাঘাত করে তাকে উঠিয়ে দিত। নির্ভুল শোনাতে পারার আগ পর্যন্ত এই প্রক্রিয়া চলতে থাকত। আমার নাজেরানা চলতেই থাকে। মাঝে মাঝেই হুজুর তাড়া দেয়। আরেকটু ভাল করে পড়তে পারলেই হিফজ শুরু করার আনুষ্ঠানিক অনুমতি দিবে। আমার একজন সঙ্গীও জুটে যায়। জুবায়ের। আমি ওর পরে এসেও ওকে ধরে ফেলেছিলাম। এই ব্যাপারে হুজুর কিছুটা প্রসন্ন ছিল। হুজুরও আমাদের মধ্যে একটা প্রতিযোগিতার মনোভাব জাগ্রত রাখার চেষ্টা করত। নাজেরানা শেষের দিকে। কিছুদিন পরেই হিফজ শুরু করব। এমন সময় আমি খুঁজে টুজে একজন আইডল জোগাড় করি। সায়েম ভাই। তার মেধা অসম্ভব ভাল। অনেক বেশী মুখস্থ করতে পারে। ভুল টুল হয় না। হুজুর তাকে মারে না। তবে আইডল হিসেবে তার দুর্বল দিক হল, তার চেহারা এবং শরিরের গঠন কিছুটা মেয়েলি। কথা বলে নীচু গলায়। প্রচুর হাসে। আমরা ছোটরা সবাই তাকে পছন্দ করতাম। হুজুর বেশী ব্যস্ত থাকলে ছোটদের পড়া সে শুনত। ১০ পৃষ্ঠার পরিবর্তে ৫ পৃষ্ঠা শুনে ছেড়ে দিত। আরেকজন ছিল সাইফুল ভাই। অনেকটা সায়েম ভাইর মত ঘটনা। তবে সে খারাপ ব্যবহার করত তাই তাকে বেশী পছন্দ করতাম না। হুজুর তাদের দুইজনকেই মারতো না। দুইজনকেই পছন্দ করতো। কিন্তু তারা পরস্পর কখনো কথা বলতো না। কখনো ঝগড়া হতে দেখিনি ; কিন্তু তাদেরকে কখনো কথা বলতে দেখিনি।

আমি ভর্তি হয়েছিলাম মাদরাসার শিক্ষাবর্ষের শুরুর দিকেই। রমজানের পরে। শাবান অথবা জিলকদ মাসে। পরের বছর রমজানের আগে আগে হিফজখানায় উত্তীর্ণ হই। আমার বন্ধু জুবায়ের আর আমি একসঙ্গে বিশাল কোরআন শরিফ ৩০ নম্বর পারা থেকে মুখস্থ করতে শুরু করি। জুবায়ের আমাকে হিংসা করতো। আমিও তাকে হিংসা করতাম। প্রতিদিনই আমরা পরস্পর একে অন্যকে পরাজিত করার চেষ্টা করতাম। কেউই হারতাম না। জিতেও যেতাম না। অনেকদিন আমরা সমান সমান ছিলাম। প্রায় ছয় মাস। ততদিনে আমাদের ৮ পারার মত মুখস্থ হয়ে যায়। এরপর আমি এই প্রতিযোগিতায় উৎসাহ হারিয়ে ফেলি। এবং নানাবিধ অসুখের ছুতায় এক মাস বাড়িতে এসে ডুব দিয়ে থাকি।

এক মাস পরে ফিরে গিয়ে চোখে অন্ধকার দেখি। ছোট হুজুর আমার পিছিয়ে পড়ায় বিরক্ত। তেমন পাত্তা দেয়না। কথা কম বলে। অল্প ভুলে বেশী পিটায়। জুবায়ের দেড় পারা আগে চলে গেছে। আমি প্রাণপণ খেটে পরের দুইমাসে ওকে ধরে ফেলি। হুজুর প্রসন্ন হয়। সবাই ভাল বলে। তখন আবার উৎসাহ হারিয়ে ফেলি। বাড়িতে এসে পনেরো দিন ডুব দিয়ে থাকি। পরীক্ষা কাছাকাছি চলে আসে। বাধ্যতামূলক আমাকে ফিরতেই হয়। আর পনেরো দিন পরে পরীক্ষা। সবক চলমান থাকবে সাতদিন। অবশিষ্ট সাতদিন পরীক্ষার প্রস্তুতি। এই সাতদিনে এক পারা পড়তে পারলে জুবায়েরের সঙ্গে কিছুটা সমতায় আসা যায়। আমার তখন বারো নম্বর পারায় পড়া। বিকাল থেকে রাত পর্যন্ত খেটেখুটে তিন পৃষ্ঠা মুখস্থ করি। এবং বিলম্বে ভুলে যাওয়ার ভয়ে ঘুম ভেঙে সবার আগে পড়া শুনানোর চেষ্টা করি। এমন এক ভোররাতে আমাদের ছোট হুজুর সবার অলক্ষ্যে মাদরাসাপ্রাঙ্গণ ত্যাগ করে। আমরা যখন ফজরের নামাজের জন্য মসজিদে যাই, তখন মাদরাসার পেছনে একটা রিকশা এসে দাঁড়ায়। সে রিকশা হুজুরকে বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত দিয়ে আসে।

হুজুরের এভাবে চলে যাওয়াটা অস্বাভাবিক ছিল। সারাদিন এই নিয়ে ছোট ছোট জটলা চলতে থাকল। বড় হুজুর ঝিম মেরে বসে রইল। সকাল পর্যন্ত সঠিক তথ্য জানার উপায় ছিল না।নাশতার ছুটিতে জানতে পারলাম, সায়েম ভাই এবং সাইফুল ভাই তাদের দুজনের সঙ্গেই ছোট হুজুরের সমকামিতার সম্পর্ক ছিল। আকাশ থেকে পড়ার মত কোন ঘটনা না। সবসময়ই এরকম কিছু কানাঘুষা চলে। মাদরাসার কমিটি বিষয়টা নিয়ে মিটিং করতে চেয়েছিল। তার আগেই হুজুর চলে যায়।

সবাই এটা নিয়ে হাসাহাসি করল। ওদেরকে ইঙ্গিত করে অশ্লীল কথা বলল। আমাদের লাভ হল, নির্দিষ্ট সময়ের দুইদিন আগেই সবক বন্ধ হয়ে পরিক্ষার প্রস্তুতিমূলক পড়াশুনা শুরু হয়ে গেল।

সেদিন সারাক্ষণ সবাই এই একটি বিষয় নিয়েই কথা বলল। সকালে ঘুমাতে গিয়ে সায়েম ভাইকে তার বিছানায় দেখলাম না। জায়গাটা ফাঁকা পড়ে আছে। সাইফুল ভাই গরমের মধ্যেও কাথামুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে ৷ ঘুমিয়ে গেছে কিনা বুঝা যাচ্ছে না। গল্প করতে করতে ঘুমের সময় অনেক গড়িয়ে গেল। ঘুমিয়ে যাব কিনা ভাবতে ভাবতে পেশাব চাপল। অল্প সময় বাকি আছে। ঘুমাতে চাইলে দ্রুতই ফিরে আসতে হবে। কিন্তু পেশাব করতে গিয়ে মাদরাসার চারপাশ প্রদক্ষিণ করে আসা আমার পুরান স্বভাব ছিল। রান্নাঘরের পেছনে গিয়ে দেখি সায়েম ভাই একটা নিচু দেয়ালের ওপর মাথা নিচু করে বসে ডোবার পানিতে ছোট ছোট পাথরের কণা ফেলছে।

৩ 

তখন তত্বাবধায়ক সরকার ফখরুদ্দীনের সময়। দেশের কোথায় কারা গুরুত্বপূর্ণ এসব তথ্য আমাদের কাছে ছিল না। একদিন শুনি, একজন ধর্ম অথবা শিক্ষাপ্রতিমন্ত্রী এনামুল হাসান অথবা আলী হোসেন এমন কেউ আমাদের মাদরাসার সামনে উপজেলা কমপ্লেক্সের মাঠে হেলিকপ্টারযোগে এসে অবতরণ করবে। সে আসার প্রায় দশদিন আগে এই সংবাদটি প্রচারিত হয় এবং সে চলে যাওয়ার পরেও বহুদিন পর্যন্ত আমাদের মনে সেই ঘটনার রেশ থাকে। উপজেলা কমপ্লেক্সের মাঠে একটি ইংরেজি বড় হাতের এইচ (H) অক্ষরের বিশাল আকৃতি আঁকা হয়। হেলিকপ্টার সম্বন্ধে আমার বন্ধুরা তাদের যাবতীয় অভিজ্ঞতার ঝুলি উল্টে দেয়। কেউ বলে হেলিকপ্টার যানটি চার চাকা বিশিষ্ট। কেউ বলে তিন চাকা বিশিষ্ট। তিন চাকা সম্পর্কে সে সিনেমার রেফারেন্স দেয়। আমরা প্রতিদিন আঙুলের কর গুনে অপেক্ষা করতে থাকি। অনেক কথা বলি, কিন্তু কিছুতেই এইচ (H) আকৃতিটির মীমাংসা হয় না। কিছুতেই হিসাব মিলে না ‘ দুই চাকার জন্য যদি দুই রেখা হয়, তাহলে এইচের মাঝখানের রেখার কি কাজ?

অবশেষে সত্যি সত্যিই আমরা সেই দিনে উপনীত হই, যেদিন উপজেলা কমপ্লেক্সের পুকুর পাড়ের সব নারিকেল গাছের মাথা এলোঝড়ে বিপন্ন করে দিয়ে একটি নীল রঙের ছোটখাটো লেজ বিশিষ্ট গাড়ির সমান হেলিকপ্টার নেমে আসে। সেদিন সকাল থেকে প্রচুর মানুষ ভিড় করেছিল। অনেক পুলিশ ব্যারিকেড তৈরি করে দাঁড়িয়েছিল। নেতার আগমনে মানুষ স্লোগানে মুখর হয়। হর্ষধ্বনি দিতে দিতে তার গাড়ির পেছনে ছুটতে থাকে। তাদের কোন আনন্দই আমাকে স্পর্শ করে না। প্রথমবারের মত হেলিকপ্টার দেখে আমি মনক্ষুণ্ন হই। প্রথমত, হেলিকপ্টারের কোন চাকা নাই। একটা এইচ আকৃতির লোহার পাতের ওপর দাঁড়িয়ে থাকে। দ্বিতীয়ত, কল্পনার হেলিকপ্টারের সঙ্গে এর কোন মিল নাই। ভেবেছিলাম বড় কিছু দেখব। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তা একটি সাধারণ গাড়ির চেয়েও ছোট ছিল।

অই সময়টাতে আমরা প্রতিদিন আছরের নামাজের পরে ক্রিকেট খেলতাম। সন্ধ্যা হওয়ার আগে আগে অজু করে মসজিদে এসে নামাজের জন্য অপেক্ষা করে বসে থাকতাম। এমনই এক সন্ধ্যার আগে —যখন আকাশ বিবর্ণ হয়ে তামাটে বর্ণ ধারণ করেছে — আমি জুবায়েরকে আউট করার জন্য প্রাণপণ বল ছুড়ে যাচ্ছি। জুবায়ের কিছুতেই আউট হয় না। মেজাজ প্রচণ্ড খারাপ হয়ে যাচ্ছে। আজকে সন্ধ্যার আগে আমার ব্যাট করতে পারার আর কোন সম্ভাবনা-ই নাই। সহসাই মসজিদের পাশ দিয়ে আমাদের বড় ভাই মনির দৌড়ে এসে সংবাদ দিল, বাবুর্চী আবুল চাচা মারা গেছে। মাদরাসার কাছেই তার বাড়ি। সবকিছু ঠিক ছিল। সবার সঙ্গে আছরের নামাজ পড়েছিল। বাড়িতে গিয়ে বুকে ব্যথা অনুভব হয়। এরপর একেবারে অল্প সময়ের মধ্যেই আবুল চাচা মরে যায়। আট কুঠুরি নয় দরোজা আর শত শত বাতায়ন খুলে এ এক অচীন পাখি অসীম মহাশূন্যের দিকে ডানা মেলে দেয়।

জুবায়ের দৌঁড়ে অজুখানার পানির ট্যাংকের পেছনে ব্যাট রাখল। আমি পাঞ্জাবির পকেটে বল নিয়ে দৌড়ে আবুল চাচার বাড়ির দিকে গেলাম। আমার অনেক বন্ধুরা সেখানে উপস্থিত ছিল। আবুল চাচার মাথার কাছে একটা জলচৌকিতে ইমাম সাহেব বসে আছে। কেউ গোসলের খাটিয়া আনতে মসজিদে গেছে কিনা এ নিয়ে উচ্চবাচ্য হল কিছুক্ষণ৷ আমি ভয়ে ভয়ে পায়ের কাছ দিয়ে উঁকি দিয়ে একবার দেখলাম। সারা শরীর ঢাকা। কেউ দেখতে চাইলে মুখের ওপর থেকে কাপড় সরিয়ে এক নজর দেখানো হয়। আমি কাউকেই তার মুখের ওপর থেকে কাপড় সরাতে বলি নাই। একটু পর একজন মুরুব্বি আসল। তখন মুখের কাপড় সরানো হল। ঘরে অপর্যাপ্ত বাতির আলো। তেমন কিছু দেখা যাচ্ছে না। শুধু দেখতে পেলাম, তার থুঁতনি অনেকক্ষণ যাবত একই জায়গায় স্থির এবং কিছুটা আকাশের দিকে উত্থিত। মনে হল, আবুল চাচার নিথর মুখ এখন অনেক শক্ত এবং সাদা। তারপর আবার পেছনে সরে এলাম। একটু পরই মসজিদ থেকে খাটিয়া আসল। লাশ খাটিয়ায় তুলে উঠানে এনে রেখে দিল এবং খাটের চারপাশে অনেকগুলি আগরবাতি জ্বেলে দিল।

মৃত বাড়িতে উপচেপড়া ভিড়। আবুল চাচা খুবই নিরীহ ধরণের মানুষ ছিল। সবাই তাকে পছন্দ করত। মাদরাসার ছাত্ররা তো ছিলই। তখন অন্ধকার হয়ে আসছিল। মসজিদে আজান হয়ে গেছে। আমার ভয় করতে শুরু করল। প্রথমবারের মত এত কাছ থেকে মৃত্যু দেখলাম অথবা আমার এত কাছের কেউ মারা গেল। আগে ভাবতাম, মৃত্যু হয় দূরের মানুষের। মৃত্যু সংবাদ কেবল মাইকেই শোনা যায়। অতি নিকটের আবুল চাচা মরে গিয়ে আমাকে সমৃদ্ধ করে গেল, কাছের মানুষেরও মৃত্যু হয়!

জুবায়েরের সঙ্গে পিছিয়ে পড়াটা দুঃখজনক  ছিল। একেবারে কানের কাছ দিয়ে শশব্দে ফসকে যাওয়ার মত। আফসোস লাগত। তবে এতটাও না, যা দিয়ে পুনরায় প্রতিযোগিতায় নামা যেতে পারে। পরের বছরের মাঝামাঝির দিকে জুবায়েরের যখন বিশ পারা হয়, তখন আমার হল ষোল পারা। এরপর পুরাপুরি ঢিল দিলাম। ঢিল দিলেই নিস্তার ছিল না। হুজুর আমাকে তার অনাস্থার কথা বলল, আমি যে এতটা ফাঁকিবাজি করব তা সে ভাবতে পারেনি কখনো। আমার বাবার কাছেও এই সংবাদ পৌঁছল। আমার এহেন ব্যর্থতায় সে বিস্ময় প্রকাশ করল। এটা আমার জন্য খুবই লজ্জাজনক ছিল। বলার মত কোন উত্তর খুঁজে পেলাম না। এই গ্লানি বয়ে বেড়ানোও কঠিন। তাই আমার নিজের পক্ষে একটা শক্তিশালী যুক্তির প্রয়োজন ছিল। চিন্তা ভাবনা করে দেখলাম, পিছিয়ে পড়ার যুক্তি হিসেবে জ্বীনে ধরাটাই সবচে ভাল। হাফেজী পড়া ছেলেদের জ্বীনে ধরাটা খুবই কমন সমস্যা।

কিন্তু আমাকে তো জ্বীনে ধরে নাই। জ্বীনে ধরা কোন রোগীও কাছ থেকে দেখি নাই। তবু আমি সম্পূর্ণ অজানা একটা চরিত্রে কোন রকম জানাশোনা ছাড়াই অভিনয়ের ঝুঁকি নিলাম। এক দৈব শক্তি আমাকে সাহায্য করল। কোন এক বৃহস্পতিবার রাতে সেই শিক্ষা অথবা ধর্মপ্রতিমন্ত্রী আলী হোসেন অথবা এনামুল হাসানের হেলিকপ্টারটি আমি পুনরায় স্বপ্নে দেখি। স্বপ্ন এতটাই বাস্তব ছিল যে, ঘুম ভাঙার পরেও হেলিকপ্টারের পাখা ঘোরার শব্দ শুনতে পাই। এই স্বপ্নটি কিছুতেই আমার মাথা থেকে মুছে যায়না, এবং সন্ধ্যা পর্যন্ত আমার বন্ধুদেরকে জানাই, আমি সর্বদাই আকাশে চলমান একটি দৈবযানের পাখা ঘোরার শব্দ শুনি। মাঝে মাঝে যানটি আমার এতটাই কাছে চলে আসে, মনে হয় মুখ ফেরালেই কানের সঙ্গে লেগে যাবে।  এবং মনে হয় কেউ আমাকে নিয়ে যেতে আসে।

তারা বিষয়টি নিয়ে ভাবে। হয়ত কিছুটা ভীত হয়ে পড়ে। এরবেশী কিছুই হয় না। একবার ভাবলাম, ক্ষ্যান্ত দিয়ে দেই। ভুলভাল বলে কী লাভ? যদি ধরা পড়ে যাই? কিন্তু বিষয়টা বেশ কিছুদিন ভেতরে লালন পালন করে এমন একটা অবস্থায় এসে দাঁড়ায়, আমার পক্ষে এর থেকে বের হওয়া দুরূহ হয়ে পড়ে এবং এর শেষ না দেখে কোন উপায় থাকেনা। তখন একদিন এশার নামাজের তৃতীয় রাকাতে কাতার ছেড়ে বের হয়ে আসি। অন্ধকারের ভেতর হাঁটতে হাঁটতে নারিকেল গাছের সারি অতিক্রম করে পুকুরের সবচেয়ে দুর্গম ঘাটে গিয়ে মূর্তির মত বসে থাকি। পুকুরের দুইটা ঘাট। একটা রাস্তার পাশেই। অপরটা এর সরাসরি উল্টা দিকে। একটা পরিত্যক্ত বাড়ির কাছে। জায়গাটা অন্ধকার। ভাঙা কয়েকটি সিড়ি। পথে পথে গরুর কাঁচা গোবর ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। অনেক দূরে উপজেলা অফিসারদের কোয়ার্টারের বাতি দেখা যাচ্ছে। গাছপালার আড়ালে আমাদের একতলা টিনশেড মাদরাসা ঘরটি ঢাকা পড়ে গেছে। দিনের বেলা বড় ঘাটে ভিড় থাকলে মাঝে মাঝে এখানে গোসল করতে আসি। কিন্তু কেবল সেইদিনটি ছাড়া আর কোনদিনই আমার পক্ষে রাতের বেলা সেখানে যাওয়া সম্ভব ছিল না।

নামাজের কাতার থেকে আমার বের হয়ে আসার বিষয়টা বন্ধুরা লক্ষ্য করেছিল। কিন্তু তারা এটাকে সামান্য অজুভঙ্গ জনিত ব্যাপার ভেবে আমলে নেয় না। অন্যদিকে আমি পুকুরঘাটের সিড়িতে অনেকখন একই ভঙ্গিতে বসে থাকলাম। মশা ছেঁকে ধরেছে। পা ব্যথা হয়ে গেছে। অন্ধকারে ভয় লাগছে। সত্যি সত্যিই যদি জ্বীন এসে আমাকে কোহেকাফ নগরে নিয়ে যায়। কোনদিন যদি ফিরে আসতে না পারি। ভেবেছিলাম, এখানে কিছুক্ষণ বসে থাকার পরেই ওদিকে হৈ চৈ পড়ে যাবে। সবাই আমাকে খুঁজতে আসবে। এবং তারা আমাকে একটি নির্দিষ্ট ভঙ্গিতে বসে থাকতে দেখবে। প্রথমে অনেকক্ষণ কোন কথা বলব না। তারপর স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বলব, পানির পিপাসা পেয়েছে৷ পানি খাব।

সব ভজঘট হয়ে যাচ্ছে। কেউ আসছে না। আমি একটা মানুষ মরেই গেলাম কিনা এই খবরও কারো নাই। হাতে কোন ঘড়ি নাই। কয়টা বাজে তাও জানিনা। পুকুরের অপরপাশে একজন এসে পা ধুঁয়ে গেল। তার হাতে সাদা আলোর টর্চ লাইট। একবার ভাবলাম, জোরে শব্দ করি যেন সে আমাকে নিয়ে যায়। কিন্তু কোথায় যেন আটকে গেলাম। ততক্ষণে সত্যি সত্যি ভয় আমাকে আচ্ছন্ন করে ফেলেছে। আমি চেষ্টা করলেও এই দূর্গম পথ অতিক্রম করে এখন আর ফিরে যেতে পারবনা। গলার স্বর ডুবে গেছে। পা জমে শক্ত হয়ে গেছে। এমন সময় মায়ের কথা মনে পড়ল। দুইচোখ পানিতে পরিপূর্ণ হয়ে গেলো।  এবং বুক ভেঙে কান্না আসল।

ভয়, দুঃখ, আর মশার উপর্যুপরি উপদ্রব ও কান্নায় ক্লান্ত হয়ে এক সময় নির্জন সিঁড়ির ওপর ঘুমিয়ে পড়লাম। আমার চিরকাল গাঢ় ঘুম। সেই ঘুমে ফজরের আজান হয়ে যেতে পারত। তার আগেই আমাকে উদ্ধার করা হল। ঘুমের ঘোরেই দেখতে পেলাম, বড় হুজুর মনির ভাইসহ আরও অনেকেই টর্চ হাতে দাঁড়িয়ে আছে। বড় হুজুর দোয়া পড়ে আমার মুখের ওপর ফুঁ দিল। তারপর মনির ভাই কাঁধে নিয়ে আমাকে মাদরাসায় নিয়ে আসল। তখন সময় কত জানিনা। বড়দের জন্য বরাদ্দ রুমটিতে আমাকে বিছানা পেতে শোয়ানো হল। মনির ভাই বলল, পানি খাবি? আমি বললাম, দেন। হুজুর পানি পড়ে দিল। রুমের সর্বত্র পানি ছিটানো হল। আমাকে খেতে দেয়া হল বনরুটি। দফায় দফায় ঝাড়ফুঁক চলল। তারপর মনির ভাই একটা গামছার এক অংশ তার হাতে এবং অন্য অংশ আমার হাতে বেঁধে ঘুমাতে গেল।

পরদিন আমাকে ক্লাসে যেতে হল না। হুজুর বিভিন্ন সময় আমার আশেপাশে থাকার জন্য বিভিন্ন জনকে নিয়োগ দিল। তারা আমাকে বিচিত্র সব প্রশ্ন করত। আমার দায়িত্ব ছিল তাদের প্রশ্নগুলি মনোযোগ দিয়ে শোনা এবং তাদেরকে সন্তোষজনক উত্তর দেয়া। এই পর্বে এতটাই সফল হলাম যে, মুখে মুখে কোহেকাফ শহর নির্মাণ করে ফেললাম। কোহেকাফের ঘরবাড়ি, বাজারঘাট এবং ফুল বাগানের অনুপুঙখ সব বিবরণ দিয়ে গেলাম। এক সময় আমার নিজেরই বিশ্বাস হতে শুরু করল সত্যিই আমি কোহেকাফ শহর ঘুরে এসেছি।

বড় হুজুর দুইদিন প্রস্তুতি নিল। তৃতীয় দিন সন্ধ্যার পরে নতুন ছোট হুজুর আর কয়েকজন ছাত্রকে সঙ্গে নিয়ে আমার কাছে আসল। আমার সামনে বসে অনর্গল দোয়া কালাম পড়তে পড়তে একটা দুই হাত সমান পাটের সুতায় অনেকগুলি গেরো দিতে থাকল। গেরো দেয়া শেষ করে আমাকে তার সামনে দুই হাত মেলে ধরতে বলল। আমি দুই হাত মেলে ধরলাম। হুজুর আমার দুই হাতের কনিষ্ঠাঙ্গুলি একসঙ্গে করে অনেকগুলি গেরো বিশিষ্ট পাটের সুতা দিয়ে বাঁধল। তারপর বলল, মনির বেত নিয়া আয়।

মনির ভাই বেত আনল।

তারপর বলল, মনির ওরে শক্ত করে ধর।

মনির ভাই আমাকে পেছন থেকে শক্ত করে ধরে রাখল।

হুজুর আমাকে বলল, চোখ বন্ধ কর।

আমি চোখ বন্ধ করলাম। সে গড়গড় করে সুরা জ্বীন পড়তে থাকল এবং আমি চোখ বন্ধ করে সত্যি সত্যিই হেলিকপ্টারের শব্দ শুনতে পেলাম। এরপরের ঘটনা আমার কাছে এখনো অস্পষ্ট। অন্যদের কাছে শুনেছি, আমি তিনজন জ্বীন এবং একজন পরির কথা স্বীকার করেছি। তারা এসে উপস্থিত হয়। গম্ভীর স্বরে আমার মুখ নিঃসরণ করে কথা বলে। তারা জানায়, তারা আমাকে পছন্দ করে এবং কোহেকাফ শহরে নিয়ে যেতে চায়। এক পর্যায়ে হুজুরের রুদ্রমূর্তি দেখে মাদরাসার সামনের নারিকেল গাছের পাতা দুলিয়ে চলে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়। এবং সকলেই তাদের প্রস্থানমূলক বাতাসের শব্দ শুনতে পায়।

৫ 

হিফজখানায় আমি সর্বমোট পাঁচ বছর ছিলাম। এক বছর নাজেরানা। আড়াই বছর হিফজ। আর দেড় বছর পুনরায় কোরআন শুনানো। এই পাঁচ বছরের গল্পে কোথাও আমার ভাইবোন, বাবা মা অথবা কোন আত্মীয়ের উপস্থিতি নেই। আমি হিফজখানায় থাকাকালীন আমার মেজ আপার বিয়ে হয়। পড়ালেখায় ক্ষতি হওয়ার অজুহাতে আমি সেই বিয়েতে আসতে পারিনি। অথচ আমার বয়স তখন এগারো। প্রতি তিন মাস পরপর বিভিন্ন ছুটিছাটায় বাড়িতে আসতাম। আমার সেই বাড়িতে থাকার দিন ছিল নেহাতই একজন অতিথির থাকা। আমি মাদরাসায় পড়ি, আমার যেন কোন ভুল না হয়ে যায় এমন সাবধানতা আমাকে সবসময় করতে হত। এমনকি আমার বাবা মায়ের কাছেও। মা আমার জন্য ঘরে অতিথি আসার মত রান্নাবান্না করত। এসব আমার ভালো লাগতো না। আমি কোন দোষ করলেও সবাই এমন দৃষ্টিতে দেখত — অনেকদিন পরে বাড়িতে এসেছি যেহেতু তাই আমার এসব অপরাধ ক্ষমা করা হোক।

চেষ্টা করলে হয়ত ভবিষ্যত পরিবর্তন করা সম্ভব। অতীত পরিবর্তনযোগ্য নয়। আমার যা কিছু অতীত ছিল, এতক্ষণ সেসবের কথা বললাম। এসবই। যা কিছু আনন্দ ও বেদনা সব এখানেই। এর বাইরে আমার আর কোন স্মৃতি নেই। বয়সের আগেই বৃদ্ধ হওয়ার এক জটিল ফাঁদে আমরা ধরা পড়ে গিয়েছিলাম।

শেষ অংশটি যেভাবে লেখার ইচ্ছা ছিল এখন আর মন তা সায় দিচ্ছেনা। আমি সমালোচনা তৈরি করতে পছন্দ করি না। তবে সুযোগ থাকলে অবশ্যই আমি আমার কিশোর বয়স বদলে দিতাম৷ একদিকে নিজের ঘরবাড়ি থেকে একটু একটু সুতা কেটে গেছে। সেখানে আর কোনদিন থিতু হতে পারিনি। আমি এখনো অতিথিই। অপরদিকে মাদরাসায় সর্বক্ষণ হুজুরদের এক অদৃশ্য হুলিয়া মাথায় নিয়ে ঘুরেছি। নাবালেগ বয়সে ফেরেশতারা পাপ-পূণ্য লিখতে বসার আগেই আমরা আমাদের অগনিত গুনাহের জন্য পাশবিক সব শাস্তির মুখোমুখি হয়েছি। আমি কাউকেই বলছি না, আপনি আপনার সন্তানের কথা পুনরায় ভেবে দেখুন। অথবা কোরআন মুখস্থের এই অস্বাভাবিক প্রক্রিয়াটি আপনারা বিবেচনা করুন। আমি সমাজের প্রতি ন্যূনতম কোন দায়িত্ব বোধ করি না, এবং সমাজ বদলানোর স্বপ্ন দেখি না।

 

আগের সংবাদমাদরাসাতুল মদিনার জীবন
পরবর্তি সংবাদগৌর বাংলায় মুসলিম পর্যটক