পশ্চিমবঙ্গে কওমি মাদরাসার হালচাল

কাজী মনজুর আলম:

কওমি মাদরাসার কার্যক্রমের সংক্ষিপ্ত বিবরণ

উপমহাদেশের মুসলিমদের দীনি প্রয়োজনের সিংহভাগ, কওমি বা বেসরকারি মাদরাসা থেকেই যে পূরণ হয়ে থাকে এ বিষয়ে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই। ইসলামি শিক্ষা, সভ্যতা, সংস্কৃতি রক্ষার্থে নিঃসন্দেহে এই সমস্ত মাদরাসাগুলি দীর্ঘকালব্যাপী অবিস্মরণীয় এবং মজবুত ভূমিকা পালন করে আসছে। পশ্চিমবঙ্গও এর ব্যতিক্রম নয়। দীনি ছোটো-বড়ো বিষয়ের সঠিক দিকনির্দেশনা, আকাইদ, আহকাম ও আমল সংক্রান্ত নিত্য-নতুন বিভিন্ন কূট বা জটিল জিজ্ঞাসার উত্তর, কুরআন-হাদিসের সঠিক অর্থে গবেষণামূলক চর্চা ও তালিম, আত্মশুদ্ধিমূলক আলোচনা ইত্যাদি, এসমস্ত মাদরাসার সংশ্লিষ্ট বিভাগ ও এখান থেকে পাঠ শেষ করা আলিমদের পক্ষ থেকেই দায়িত্ব সহকারে ইখলাসের সাথে পালন করা হয়। তাই ইসলামের প্রাণশক্তি এবং শিক্ষা, সভ্যতা ও সংস্কৃতিকে অক্ষুন্ন রাখার ক্ষেত্রে এই মাদরাসাসমূহের কোনো বিকল্প নেই।

পশ্চিমবঙ্গে দ্বীনি শিক্ষা 

পশ্চিমবঙ্গের মুসলিম সমাজে মাদরাসার অবদানের কথা বলতে গেলে  সর্বপ্রথমে মাদরাসা আলিয়ার কথা বলতে হয়। ১৭৮০ সালে ইংরেজ আমলে প্রতিষ্ঠিত এই সরকারি মাদরাসা বর্তমানে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে উন্নীত। বর্তমানে সেখানে থিওলজি, আরবি ভাষা ও সাহিত্য ছাড়াও আধুনিক শিক্ষার আর্টস, সাইন্স, ইঞ্জিনিয়ারিং, ম্যানেজমেন্ট, নার্সিংয়ের মতো বিভিন্ন বিভাগ বিদ্যমান। দেশভাগের পর বৃহত্তর বাঙালি মুসলিম সমাজ পূর্ববঙ্গে (বাংলাদেশ) অবস্থান করায় মাদরাসা ঢাকাতে স্থানান্তরিত হয়। সাময়িকভাবে প্রায় দু বছর কলকাতার আলিয়া মাদরাসা বন্ধ থাকে। ১৯৪৯ সালে তৎকালীন ভারতের শিক্ষামন্ত্রী মাওলানা আবুল কালাম আযাদ ও হুসাইন আহমাদ মাদানি রহ. এই ব্যক্তিদ্বয়ের হস্তক্ষেপে মাদরাসা পুনর্বার চালু হয়। একসময়ে এই প্রতিষ্ঠান থেকেই ভূতপূর্ব আলিমে দীন ও আদর্শ সমাজ গঠনের অসংখ্য কারিগর গড়ে উঠেছে।

মাওলানা তাহির সাহেবের মতো দিকপাল পন্ডিত ব্যক্তিবর্গ এখানে অধ্যাপনা করেছেন এবং উপযুক্ত ছাত্র তৈরি করে সমাজের দীনি প্রয়োজন পূরণ করেছেন। তবে বর্তমানে দীনি প্রেক্ষাপটে বিচার করলে ব্যতিক্রম ব্যতীত এখান থেকে মৌলিক যোগ্যতাসম্পন্ন আলিম তৈরি হওয়া এবং তাদের দীনি খেদমতের কার্যক্রমের হার বেশ কম। অবশ্য বর্তমানে এখান থেকে যারা পড়াশোনা করছে, তন্মধ্যে এক শ্রেণির শিক্ষার্থীদের দীনি শিক্ষা অর্জনের পাশাপাশি অর্থনৈতিকভাবে একটু সুবিধাজনক জায়গায় অবস্থান করতে পারাটা এক বিশেষ প্রাপ্তি। যদিও সামগ্রিকভাবে সংখ্যাটা খুব যে উল্লেখযোগ্য তা নয়।

কওমি মাদরাসার পাঠ্যক্রম, বোর্ড পরিচিতি এবং পশ্চিমবঙ্গে কওমি মাদরাসার শ্রেণিভাগ 

ভারতীয় উপমহাদেশে মাদরাসা-ব্যবস্থার পত্তন দ্বাদশ শতাব্দীর কিছু পূর্বে হলেও প্রধানত এর বিস্তার অষ্টাদশ শতাব্দীর দ্বিতীয় অর্ধে দারুল উলূম দেওবন্দ প্রতিষ্ঠার পরেই ঘটে। মাঝের প্রায় এই ছশো বছরে পাঠ্যক্রমে একাধিকবার পরিবর্তন-পরিবর্ধন সাধিত হয়েছে। সতেরো শতকে দরসে নিজামির প্রণয়ন ও আঠারো শতকের দ্বিতীয় অর্ধে দারুল উলূম দেওবন্দে তার অন্তর্ভুক্তির পর থেকে এটি সর্বোচ্চ গ্রহণযোগ্যতা লাভ করে। তাই সঙ্গত কারণেই এই ধারার মাদরাসার এক বড়ো অংশ দারুল উলূম দেওবন্দকেই নিজেদের কেন্দ্র মনে করে ও তার নির্দেশনাতেই পরিচালিত হয়। ১৯৯৪ সালে দারুল উলূম দেওবন্দ এই উদ্দেশ্যে ‘রাবেতা মাদারিসে ইসলামিয়া আরাবিয়া’ (দীনি মাদরাসা সমন্বয় সমিতি) প্রতিষ্ঠা করে। উক্ত বোর্ড রাজ্যভিত্তিক ছাত্রদের শ্রেণিগতভাবে বার্ষিক পরীক্ষারও ব্যবস্থা করে থাকে।

দারুল উলুম দেওবন্দ-এর সামগ্রিক পাঠ্যক্রম প্রধানত চারটি ভাগে বিভক্ত। ১. প্রাথমিক— এই পাঠ্যক্রমে এখানে মূলত স্থানীয় ছাত্রদেরই ভর্তি নেওয়া হয়। পাঁচ বছরের এই কোর্স পাঁচ-ছয় বছর বয়সী শিক্ষার্থীদের উপযোগী করে প্রস্তুত করা হয়েছে। এই কোর্সে মূলত কুরআনের প্রাথমিক শিক্ষা, উর্দু-ফারসি ইত্যাদি শেখানো হয়। ২. মাধ্যমিক ৩. উচ্চতর— এই দুটি বিভাগ দরসে নিজামির মূল আট বর্ষকে সমান দুই ভাগে বিভক্ত করেছে। ৪. স্নাতকোত্তর স্পেশালাইজেশন—হাদীস, তাফসীর, ফিকহ, আরবি সাহিত্য ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয়ে নির্বাচিত স্বল্প কিছু শিক্ষার্থীদের নিয়ে এই বিভাগগুলি প্রতি শিক্ষাবর্ষে প্রতিষ্ঠা পায়। তবে সাধারণভাবে পশ্চিমবঙ্গে হিফজুল কুরআন, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক লেভেলের মাদরাসার সংখ্যাই বেশি। রাবেতার আওতাভুক্ত এক হাজারের অধিক মাদরাসার মধ্যে মাত্র বাইশটি মাদরাসায় উচ্চতর বিভাগ বিদ্যমান। রাবেতা-অন্তর্ভুক্ত বা বহির্ভূত গ্রামাঞ্চলের প্রায় শতভাগ মাদরাসাতে সাধারণত হিফজুল কুরআন ও প্রাথমিক লেভেলের শ্রেণিই থাকে।

১৯৯৪ সালে কেন্দ্রীয় রাবেতা বোর্ড গঠন হওয়ার পাঁচ বছর পর ১৯৯৯ সালে প্রতিষ্ঠিত পশ্চিমবঙ্গ রাবেতা বোর্ড বিগত দুই দশক যাবত নিজস্ব তত্ত্বাবধানে দীনিয়াত, আরবি প্রথম তিন বর্ষ ও হিফজের ছাত্রদের বাৎসরিক পরীক্ষার ব্যবস্থা করে আসছে। পরীক্ষায় কৃতী ছাত্রদের উৎসাহিত করার জন্য রাজ্য-রাবেতার বার্ষিক অধিবেশনে দারুল উলূম দেওবন্দের মুহতামিম বা শিক্ষা-অধিকর্তা, সর্বভারতীয় জমিয়ত-সভাপতি কারী উসমান মানসুরপুরি, সর্বভারতীয় রাবেতার সম্পাদকদের মতো ব্যক্তিদের হাত বরাবর তাদের পুরস্কার-বিতরণীর ব্যবস্থাও করা হয়।

বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন কওমি মাদরাসায় উক্ত শ্রেণিগুলিতে পাঠরত সতেরো হাজারের অধিক শিক্ষার্থী রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তের ৫৫-টি সেন্টারে তিন শতাধিক পরিদর্শকের তত্ত্বাবধানে উক্ত পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে। চলতি শিক্ষাবর্ষের হিসাব অনুযায়ী রাবেতা বোর্ডের আওতাভুক্ত ফারসি প্রথম, দ্বিতীয় বর্ষ, আরবি প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় বর্ষ ও হিফজ ছাত্রের সংখ্যা ১৭৭৭৬। তন্মধ্যে ৯০০০ হিফজ ও বাকি ৮৭৭৬ দীনিয়াত ও আরবি বিভাগের।

অবশ্য পশ্চিমবঙ্গের দেওবন্দি ধারার এই রাবেতা বোর্ডের আওতাভুক্ত মাদরাসা ছাড়াও হুগলি জেলার ‘ফুরফুরা সিলসিলা’ ও উত্তর চব্বিশ পরগণার বসিরহাট নিবাসী আল্লামা রুহুল আমীন রহ.-কে মান্যকারী-সমাজে বহু কওমি বা বেসরকারি মাদরাসা আছে। তবে এই সমস্ত মাদরাসা সাংগঠনিকভাবে পরিচালিত হয় না। পাঠ্যক্রমেও ভিন্নতা লক্ষ করা যায়। বসিরহাট-কেন্দ্রিক মাদরাসাগুলি মূলত মাওলানা রুহুল আমীন রহ. প্রণীত ‘আমীনী’ পাঠ্যক্রম অনুযায়ী চালিত হয়। পশ্চিমবঙ্গের বুকে দেওবন্দি ধারার মাদরাসার প্রভাব-প্রতিপত্তি তৈরি হওয়ার পূর্বে এখানে ইসলামের প্রচার-প্রসার মূলত পীর-সুফিদের হাতে হয়েছে।

যাদের মধ্যে ফুরফুরার পীর সাহেবগণ ও বসিরহাটের আল্লামা রুহুল আমীন রহ. বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তাই স্বাভাবিকভাবে আজও এই দুই ধারাকে মান্যকারী ব্যক্তিদের সংখ্যা নেহাত কম নয়। দেওবন্দি ধারার সাথে এঁদের আকিদা ও মাসলাকগত মৌলিক তেমন মতভেদ না থাকলেও আপোষের বিরোধিতা নেহাত কম বলা যেতে পারে না। কিছু ক্ষেত্রে ভুল বোঝাবুঝি ও একশ্রেণির স্বার্থান্বেষী মানুষের বিরোধ জিইয়ে রাখার ইচ্ছাই হয়তো এর মূল কারণ। আবার এই দুই দলের মধ্যে একাধিক উপদল তৈরি হয়ে পরিস্থিতি আরো জটিল হয়ে দাঁড়িয়েছে।

উভয়ধারার বেশিরভাগ বেসরকারি মাদরাসাতে দাওরা হাদিস বা পরিপূর্ণ আলিম কোর্স নেই। সে ক্ষেত্রে এইসব মাদরাসার শিক্ষার্থীরা এক পর্যায়ে পৌঁছে দাওরা হাদীস ক্লাস সম্বলিত মাদরাসাতে ভর্তি হয়। অন্য একটি বড়ো অংশ দারুল উলূম দেওবন্দ, মাজাহিরুল উলূম সাহারানপুর, দারুল উলূম নাদওয়াতুল উলামা লখনৌ-এর মতো খ্যাতিমান মাদরাসার উদ্দেশে যাত্রা করে। প্রতিবছর গড়ে পশ্চিমবঙ্গ থেকে প্রায় দেড় হাজার ছাত্র এই উদ্দেশ্যে উত্তরপ্রদেশে পাড়ি দেয়। দারুল উলূম দেওবন্দেই প্রতিবছরে বিভিন্ন শ্রেণিতে গড়ে দুই শতাধিক পশ্চিমবঙ্গের ছাত্র পড়াশোনা করে।

দারুল উলূম ওয়াকফ, দুই মাজাহিরুল উলূম ও নাদওয়াতুল উলামা যোগ করলে সংখ্যাটি প্রায় পাঁচশোর কাছাকাছি পৌঁছায়। উক্ত প্রতিষ্ঠানগুলির প্রবেশিকা পরীক্ষায় যারা অকৃতকার্য হয় তারা সাধারণত উত্তরপ্রদেশেরই অন্যান্য নামী-অনামী প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হয়ে পড়াশোনা শেষ করে। পশ্চিমবঙ্গের রাবেতা বোর্ডের আওতাভুক্ত ২২টি দাওরা হাদিস মাদরাসা থেকে বছরে গড়ে ৩৫০, ফুরফুরা ও বসিরহাট ধারার দাওরা হাদিস সম্বলিত মাদরাসাগুলি থেকে গড়ে ১০০ এবং উত্তরপ্রদেশের মাদরাসাসমূহ থেকে গড়ে ৩৫০; সর্বমোট প্রতি বছরে কওমি অঙ্গন থেকে গড়ে ৮০০ জন পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষার্থী স্নাতক বা আলিম হয়।

সরকারি দৃষ্টিতে মাদরাসা : একটি রিপোর্ট ও মাদরাসার পাঠ্যক্রমে আধুনিক বিষয়ের অন্তর্ভুক্তির সুপারিশ 

‘ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ এডুকেশনাল প্ল্যানিং এন্ড অ্যাডমিনিস্ট্রেশন’-এর তথ্য অনুযায়ী সরকারি মাদরাসা-সহ সমগ্র ভারতে মাদরাসা-ছাত্রের সংখ্যা শতকরা চার ভাগ। সরকারি হিসাব অনুযায়ী ভারতে ১৪ শতাংশ মুসলিম ধরলে সরকারি মাদরাসা-সহ  মাদরাসা পড়ুয়ার সংখ্যা সর্বমোট দাঁড়ায় ৭২ লক্ষের কিছু অধিক। ‘ন্যাশনাল কাউন্সিল অফ এডুকেশনাল রিসার্চ অ্যান্ড ট্রেনিং’ -এর একটি তথ্যকে সামনে রাখলে তন্মধ্যে আনুমানিক ২.৩ শতাংশ হারে ৪১ লক্ষের অধিক পড়ুয়া বেসরকারি মাদরাসার ও ১.৭ শতাংশ হারে প্রায় ৩১ লক্ষ সরকারি মাদরাসার শিক্ষার্থী।

উল্লেখ্য যে, পশ্চিমবঙ্গ, অসম, বিহার, উত্তরপ্রদেশ, ছত্তিশগড়, মধ্যপ্রদেশ ও আরো দু-একটি রাজ্য ব্যতীত অন্যান্য রাজ্যে সরকার পোষিত মাদ্রাসা নেই বললেই চলে। ২০১৭ সালের তথ্য অনুযায়ী উত্তরপ্রদেশে ৮,৫৮৪ টি মাদরাসায় শিক্ষার্থীর সংখ্যা ১৮,২৭,৫৬৬। যেখানে ২০১১-১২ সালের তথ্য অনুযায়ী পশ্চিমবঙ্গে ৬১১-টি সরকারপোষিত মাদরাসায় শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৫,৪৬,০৯৮। এর মধ্যে আবার ২০% অর্থাৎ ১,০৯,২১৯ জন হিন্দু।

সরকারি মাদরাসার পাঠ্যক্রমকে এককথায় স্কুল ও কওমি মাদরাসার পাঠ্যক্রমের এক সংক্ষিপ্ত সমন্বয় বলা যেতে পারে। পাঠ্যক্রমের বিচারে নিঃসন্দেহে উপযোগী। কিন্তু শিক্ষার্থীদের অধিকাংশই তা থেকে উপকৃত হতে পারে না। এই পাঠ্যক্রমের কয়েক বর্ষের ছাত্র হিসাবে আমার ব্যক্তিগত উপলদ্ধি যে, এখানে পাঠরত শিক্ষার্থীরা বিশেষত আরবি বিষয়াদিতে খুবই অপরিপক্ক হয়ে থাকে। অনেকের মতে, দুই নৌকায় পা দিয়ে চলার কারণেই নাকি এই অবস্থা! অবশ্য তার সাথে পরিকাঠামোগত বিভিন্ন সমস্যার কথাও যোগ করা যায়।

মাদরাসা-শিক্ষার্থী এই চার শতাংশ, বিশেষত ২.৩ শতাংশ কওমি বা বেসরকারি মাদরাসাপড়ুয়া সম্পর্কে সরকার খুব চিন্তিত! সেই সূত্রে ‘স্কিম ফর প্রোভাইডিং কোয়ালিটি এডুকেশন ইন মাদরাসা’, সংক্ষেপে (SPQEM) প্রকল্পের আওতায় ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ এডুকেশন প্ল্যানিং এন্ড অ্যাডমিনিস্ট্রেশন, জানুয়ারি, ২০১৮ তে একটি ১৪৭ পাতার রিপোর্ট তৈরি করে। সেখানে মূলত এই সমস্ত মাদরাসায় আধুনিক বিভিন্ন বিষয় পাঠ্যক্রমে যোগ করার উপর জোর দেওয়া হয়। এই মর্মে দারুল উলূম দেওবন্দকেও জরুরি নোটিশ পাঠানো হয়। তাতে ইংরেজি, হিন্দি, অংকের মতো কিছু বিষয় পাঠ্যক্রমে বাধ্যতামূলক করতে বলার পাশাপাশি ‘ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ ওপেন স্কুলিং’ বা সমমানের কোনো বোর্ডের মাধ্যমে সমস্ত ছাত্রদের মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক ইত্যাদি পরীক্ষার ব্যবস্থা সুনিশ্চিত করার বিষয়ে জরুরি পদক্ষেপও নিতে বলা হয়।

এই বিষয়ে ‘জমিয়তে উলামায়ে হিন্দ’ -এর সর্বভারতীয় সভাপতি কারী উসমান সাহেব মানসুরপুরি প্রেস কনফারেন্সের মাধ্যমে জানান যে, ‘রাবেতার আওতাধীন বেশ কিছু মাদরাসা ইতিপূর্বেই ‘এন.আই.ও.এস’ বা সমমানের বোর্ডের সাথে যুক্ত হয়েছে। সমস্ত মাদরাসাকে কিভাবে যুক্ত করা যায় সে ব্যাপারে আমাদের চিন্তাভাবনা চলছে।’ দারুল উলূম দেওবন্দের অফিশিয়াল কোনো বক্তব্য পাওয়া না গেলেও নির্ভরযোগ্য সূত্রের খবর যে, আরবি মাধ্যমিক স্তর (শারহে জামী) পর্যন্ত ইংরেজি, হিন্দি, অংকের মতো বিষয়গুলি খুব তাড়াতাড়িই পাঠ্যভুক্ত করা হবে।

সেদিক দিয়ে দেখলে বহু পূর্বেই পশ্চিমবঙ্গ রাবেতা বোর্ড, প্রতিষ্ঠার এক বছর পরেই মাধ্যমিক স্তরের কাফিয়া জামাতে ষষ্ঠ-সপ্তম-অষ্টম শ্রেণির ইংরেজি, বাংলা এবং প্রাথমিক পর্যায়ের বিজ্ঞান ও ভূগোল তাদের পাঠ্যক্রমের অন্তর্ভুক্ত করে রেখেছে। নিঃসন্দেহে এটি রাজ্য রাবেতা বোর্ডের পরিচালকদের দূরদর্শী সিদ্ধান্ত বলতে হয়। এর সাথে সাথে পশ্চিমবঙ্গের পরিবেশ ও প্রেক্ষাপটকে সামনে রেখে এখানকার ছাত্রদের স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে বাংলা ভাষার উপর আরও একটু বেশি চর্চার অবকাশ দরকার। সেই সাথে সমাজবিজ্ঞান, রাষ্ট্রবিজ্ঞানের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়সমূহের অন্ততপক্ষে প্রাথমিক পাঠগুলি নিজের চেষ্টায় আয়ত্ত করা প্রয়োজন।

পাঠ্যক্রমে রদবদল : একটি পর্যালোচনা 

দরসে নিজামির মূল সিলেবাস নিয়ে তো কোনো আপত্তি থাকতে পারে না। তবে সাপোর্টিভ কিছু বিষয় প্রয়োজন ও প্রেক্ষাপটকে সামনে রেখে পূর্বেও পরিবর্তিত হয়েছে, অদূর ভবিষ্যতেও হয়তো হবে। সে হিসেবে বলা যেতে পারে, একজন আলিমকে স্বয়ংসম্পূর্ণ ও আত্মনির্ভরশীল গড়ে তোলার জন্য মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত বিভিন্ন শ্রেণির পাঠ্যক্রমে মাতৃভাষা, ইংরেজি ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলির অন্তত প্রাথমিক পাঠ অন্তর্ভুক্ত করার বিষয়ে ভেবে দেখা যেতে পারে। এইসব বিষয়ে দক্ষ বা পারদর্শী করে তোলা কখনোই এই অন্তর্ভুক্তির উদ্দেশ্য না। বরং পাঠ্যক্রমে লজিক ও ফিলোসোফির মতো বিষয়গুলি যে উদ্দেশ্যে পড়ানো হয়, সে উদ্দেশ্যেই এগুলির অন্তর্ভুক্তির বিষয়ে ভাবা যেতে পারে।

এসব বিষয়ে বিশেষায়িত শিক্ষার জন্য তো দেশে হাজার হাজার স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় বিদ্যমান। অনুরূপ কেউ যদি উভয় সিলেবাসের সমন্বয়ে গঠিত কোনো সিলেবাস চান, সেক্ষেত্রে সরকারি মাদরাসাতে ভর্তি হতে পারেন। তবে আলেম-সমাজের পক্ষ থেকে সাধারণ শিক্ষায় শিক্ষিত ব্যক্তিদের ইসলামের মৌলিক ও প্রাথমিক বিষয়াদি সম্পর্কে অবহিত হওয়ার বিষয়ে যেমন তাকিদ করা হয়, ঠিক এমনই তাকিদ বা দাবি আলিম সমাজের উদ্দেশে করা যেতে পারে যে, তাঁরাও যেন সামাজিক ও ভাষাগত জ্ঞান অর্জনে সচেষ্ট হন। এতে তাঁদের দাওয়াত বা দ্বীনি খিদমতের কার্যক্রমই ত্বরান্বিত হবে।

মাদরাসার পাঠ্যক্রমের আমূল সংস্কার অপ্রয়োজনীয় কেন?

একজন আলেম একটি নির্দিষ্ট বিষয় বা দিক নিয়ে পড়াশোনা করে, পরবর্তীতে সেটিই তার ফিল্ড ও ক্ষেত্র হয়ে ওঠে। নিউটনের মহাকর্ষ সূত্র, আলোর গতি, মহাকর্ষীয় ধ্রুবকের মান বা কলম্বাসের আমেরিকা আবিষ্কারের তথ্য তাঁর জানা না থাকলে কী প্রভূত ক্ষতি হয়ে যাবে? সমাজের সাথে মিশতে গেলে, আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত সমাজের কাছে দীনের সঠিক প্রতিচ্ছবি তুলে ধরতে গেলে ভাষাগত ও  বেসিক কিছু বিষয়ের জ্ঞান থাকা চাই, ব্যস। এর বাইরে তাঁকে একাধারে আলেমও হতে হবে আবার বিজ্ঞান, ইতিহাসের পণ্ডিত বা যোগ্য ভূগোলবিদ হতে হবে, এমন চাওয়াগুলো একটু বাড়াবাড়ি বই কি!

আধুনিক শিক্ষার ক্ষেত্রে বিভিন্ন বিষয়কেন্দ্রিক বিভাগগুলোর যে বিভাজন তার সাথে তো আমরা সবাই একমত। অর্থাৎ একজন মেডিকেল সায়েন্সের ছাত্রের কাছে তো অর্থনীতির মার্জিনাল রিভিনিউ ও কস্টের নিখুঁত ডায়াগ্রাম বা এক্সপ্লিসিট, ইমপ্লিসিট কস্টের সংজ্ঞা বা ব্যাখ্যা আমরা কখনোই জানতে চাই না। অনুরূপ ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের কোনও ছাত্রের কাছে ফার্ডিন্যান্ড ম্যাগেলানের বিষয়ে তথ্যসমৃদ্ধ আর্টিকেলের আশাও আমরা করি না। বোঝা গেল, ব্যতিক্রমী ব্যতীত একজন ব্যক্তি একাধারে একাডেমিক্যালি কয়েকটি বিষয়ের পন্ডিত হতে পারে না, এটা আমাদের সকলের বিশ্বাস।

কিন্তু মাদরাসায় একটি দীর্ঘ সময় পরিপূর্ণ নজরদারিতে থেকে ও অধ্যবসায়ে অতিবাহিত করে ও একটি নির্দিষ্ট পাঠ্যক্রম শেষ করে যারা একাডেমিকভাবে যোগ্য আলেম, মুফতী তৈরি হচ্ছেন, তাঁদের ক্ষেত্রে একশ্রেণির এই বিশ্বাসে কোথাও যেন নোনা লেগে যায়! দাবি থাকে, ওই সমস্ত আলেম বা মুফতীদের অবশ্যই একাধারে ইতিহাস, ভূগোল, বিজ্ঞানে রীতিমতো পারদর্শী হওয়া উচিত। এর সম্ভাব্য কারণ নিচে উল্লেখিত দু’টির মধ্যে যে কোনও একটি হতে পারে। এক. মাদরাসায় পঠিত দীনি শিক্ষাকে একাডেমিক পার্টিকুলার শিক্ষাব্যবস্থা ভাবার মানসিকতা না থাকা। দুই. বাস্তবে মাদরাসা পড়ুয়া যে সমস্ত স্কলারদের দেখা যায়, তাত্ত্বিক বিষয়েও তাদের এক বড়ো অংশের অযোগ্যতা ও তাঁদের বিভিন্ন আচরণে বীতশ্রদ্ধ হয়ে পুরো শিক্ষাব্যবস্থার উপযোগিতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা ও পরিবর্তে সমাধানস্বরূপ তাদের আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত হওয়ার দাবি তোলা। প্রথম বিষয়টা যে মূলত চিন্তার ভ্রান্তিবিলাস, সে বিষয়ে কারোর দ্বিমত থাকার কথা নেই। দ্বিতীয় বিষয়ের উৎপত্তি, সমাজের অধিকাংশ মানুষের এমন ধারণা থেকে যে, মাদরাসায় কিছু সময় কাটালেই যোগ্য আলিম তৈরি হওয়া যায়।

বাস্তবে অনুশাসনের আওতায় না আসা ও মেধাহীন যত পড়ুয়া মাদরাসায় পড়তে আসে তার বহুগুণ বেশি স্কুল-কলেজে পড়ে। তবে অধিকাংশ মানুষ তাদের কাছ থেকে কোনো সার্ভিস নেওয়ার প্রয়োজন হলে, তাদের যোগ্যতা, মান ইত্যাদি সবকিছুর বিস্তারিত বিবরণ আগে জেনে নেওয়া নিজ কর্তব্য মনে করে। সে কারণে অজ্ঞতার কারণে তাদের পক্ষ থেকে কোনো বিষয়ে প্রতারিত হলেও এর জন্য তারা নিজেদেরই দায়ী করে। কিন্তু এই একই শ্রেণি দীনি বিষয়াদি যাচাইবিহীন-ভাবে যে কোনো ব্যক্তির কাছ থেকে গ্রহণ করে, এবং পরে পুরো আলেম সমাজকেই দোষারোপ করে! ডাবল স্ট্যান্ডার্ড!

একটু ভাবলে বোঝা যাবে, আমরা যে ভাষার মাধ্যমে শিক্ষাগ্রহণ করি, সেটা অজান্তেই এক পর্যায়ে আমাদের কথা-বলা ভাষারও অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে ওঠে। মাতৃভাষায় কথাবলাকালীন এটা এড়ানো খুবই কষ্টকর। আবার অনেক পরিভাষা এমন থাকে যার প্রতিশব্দ মাতৃভাষাতে পাওয়াও যায় না। কিন্তু স্কুল-কলেজ পড়ুয়াদের কথার ভাঁজে ইংরেজি শুনে সমাজ উৎফুল্ল হয়ে তাদের মহা শিক্ষিত ভাবে, আর মাদরাসা-জামিয়াতে পড়ুয়াদের কথার ভাঁজে আরবি-উর্দু শুনে বিমর্ষ হয়ে তাদের মহা মূর্খ ভাবে! পারফেক্ট ডাবল স্ট্যান্ডার্ড!

পশ্চিমবঙ্গের মুসলিমদের আর্থ সামাজিক, রাজনৈতিক ও দ্বীনি অবস্থার চিত্রায়ন 

আর্থসামাজিকভাবে পশ্চিমবঙ্গের মুসলিমদের অবস্থা মোটেই উল্লেখযোগ্য নয়। কৃষিকাজই মূলত এখানকার অধিকাংশ বাসিন্দার প্রধান জীবিকা। এবং এই জীবিকাতে গড়ে ব্যবসায়ী, পাইকারি-খুচরা বিক্রেতা থেকে রাজ্য-কেন্দ্র সরকার সবাই লাভবান হলেও কৃষকের ভাগ্যে শিকে ছেঁড়ে না। সামগ্রিকভাবে ছোটো ব্যবসায়ী ও বস্ত্রশিল্প-কেন্দ্রিক ব্যবসায়ীদের অবস্থাও বর্তমানে উল্লেখযোগ্য নয়। বিশেষত কেন্দ্রের কিছু নীতির কারণে এগুলো ইদানিং আরো তলানিতে ঠেকেছে।

রাজনৈতিকভাবে এই বঙ্গের মুসলিমদের অবস্থাও যথেষ্ট কোণঠাসা। শুরু থেকেই  এখানে মুসলিমরা ভোটব্যাঙ্ক হিসাবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। তিন দশকের বেশি সময় ধরে সামগ্রিক উন্নয়ন ও কর্মক্ষেত্রে একটি রাজনৈতিক দলের উপেক্ষার শিকার থাকার পর পরবর্তী সরকারের পক্ষ থেকে মুসলিম সমাজকে কিছুটা টেনে তোলার চেষ্টা করা হয়েছে সত্য, তবে কাজের চেয়ে প্রচারই বেশি হয়েছে। ইদানিং কেন্দ্রের শাসক দল হিন্দি বলয়ের হিন্দুত্ববাদের রাজনীতি এই বঙ্গে আমদানি করার পর  বছরখানেক আগে লোকসভা ভোটে তারা প্রায় পঞ্চাশ শতাংশ আসন লাভ করায় পরিস্থিতি আরো সংকটপূর্ণ আকার ধারণ করেছে। সঙ্গত কারণেই ২০২১ -এর বিধানসভা যে রাজ্যের বর্তমান শাসক দল এবং একইসাথে মুসলিমদের জন্য খুব কঠিন চ্যালেঞ্জ হতে চলেছে সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।

দীনি  দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখলে মাদরাসা-সমাজ ও সাধারণ শিক্ষায় শিক্ষিত-সমাজের সাথে কোনো যোগসূত্র না থাকা একটা বড়ো সমস্যা। এটা একাধারে দুই সমাজের ক্ষতি করে চলেছে। মুসলিমদের একটা বড়ো অংশ সংখ্যাগুরুর সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের শিকার। সাংবিধানিক ধর্মনিরপেক্ষতা ধর্মীয় সমন্বয়বাদ বোঝালেও, বাস্তব প্রেক্ষাপটে এখানে ধর্মনিরপেক্ষতা বলতে সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের সাংস্কৃতিক আগ্রাসনকে মেনে নেওয়া বা নিজস্ব সংস্কৃতিকে বিসর্জন দিয়ে তাদের সাথে তাল মিলিয়ে চলাকেই বোঝায়। শিক্ষার মতো গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে এখানে মুসলিম জাতির নিজেদের দোষে পিছিয়ে থাকার কথা যেমন সত্য, তেমনি এটাও সত্য যে, শিক্ষাসহ কর্মসংস্থান, অর্থনৈতিক, সামাজিক বিভিন্ন ক্ষেত্রে তারা চরম বৈষম্যের শিকার। আজও কথায় কথায় ‘জাতীয়তাবাদী’ হওয়ার প্রমাণ দিতে বাধ্য করা, রাস্তা-ঘাটে, বাসে-ট্রেনে সহ-নাগরিকদের পক্ষ থেকে উড়ে আসা অশালীন ও অসহনীয় তীর্যক মন্তব্য, দেশছাড়া করার হুমকি ইত্যাদি ইত্যাদি অবলীলায় চলে আসছে।

ফলস্বরূপ এক শ্রেণির মুসলিমের কাছে আজ মুসলিম পরিচয়টাই কাঁটা হয়ে উঠেছে। আর অন্য এক শ্রেণি মুসলিম পরিচয়ে কুণ্ঠাবোধ না করলেও সংখ্যাগুরুর মান্যতা, অনুকম্পা ও তাদের বন্ধুত্বের কৃপা পেতে ও ‘গুড মুসলিম’ সেজে ‘সমাজের মূলস্রোত’ -এ আসার লক্ষ্যে নিজস্ব স্বকীয়তা ও সংস্কৃতি বিসর্জন দিয়ে বসেছে। অতীব দুঃখের কথা যে, বর্তমান সময়ে আবার এগুলিকেই ‘সম্প্রীতি’ ও সহাবস্থানের সূচক ধারণা করা হচ্ছে।

পশ্চিমবঙ্গীয় উলামাদের সামাজিক ও অথনৈতিক অবস্থা 

সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে পশ্চিমবঙ্গের উলামা সমাজের অবস্থাও তথৈবচ। সামাজিকভাবে মুসলিম সমাজে যোগ্য আলেম শ্রেণির প্রভাব-প্রতিপত্তি খুবই কম। উলামা সমাজ ও সাধারণ শিক্ষায় শিক্ষিত শ্রেণির মধ্যে যোগসূত্র ও বোঝাপড়া না থাকা এবং এক শ্রেণির অপর শ্রেণির প্রতি অহেতুক বিভিন্ন নেতিবাচক ধারণা রাখাই এর মৌলিক কারণ বলে মনে হয়। তার উপর জনসংখ্যার নিরিখে একক এবং সমষ্টিগতভাবে সংস্কারমূলক কাজের যোগ্য উলামার সংখ্যাও এখানে নেহাত নগণ্য।

উলামা সমাজের একটি বড়ো অংশ মসজিদের ইমাম ও মাদ্রাসার শিক্ষক হিসাবে যোগদান করে। সেখান থেকে পাওয়া বেতনের অংক একজন শ্রমিকের রোজগারেরও অর্ধেক। তদুপরি সাধারণত মসজিদ ও মাদরাসা কর্তৃপক্ষের তরফে ইমাম ও শিক্ষকদের অন্য কোনো পেশা বা কাজ করার অনুমতি না থাকায় তাঁরা পুরোপুরি সামান্য এই বেতনের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েন। বিশেষত মাদরাসার একজন শিক্ষক তাঁর জীবনের স্বাভাবিক ছন্দ ও স্বাধীনতা সবকিছুই ১৬-১৭ ঘণ্টা ডিউটির বিনিময়ে কেবলমাত্র ৫০০০ -৭০০০ টাকা বেতনের পরিবর্তে হারিয়ে ফেলেন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে যার এক তৃতীয়াংশ, কোনও ক্ষেত্রে পুরোটাই ‘কালেকশন’ করে নিজেকেই আদায় করে নিতে হয়।

বর্তমান সমাজে সাধারণত একজন ২৫/২৬ বছরের যুবকের উপর পুরো একটা সংসারের ভার অর্পিত হয়ে যায়। বৃদ্ধ বাবা-মায়ের বিভিন্ন রোগের ওষুধের যোগান দিতেই তো বেতনের একাংশ খরচ হয়ে যায়। পশ্চিমবঙ্গের মাদরাসা কর্তৃপক্ষের হাতে পর্যাপ্ত টাকা থাকে না, এই তথ্য আংশিক সত্যি। ব্যতিক্রম যে নেই তা নয়। মুসলিম সমাজ এখনও প্রচুর পরিমাণে দান, সদকা, যাকাত ইত্যাদি প্রদান করে থাকে। তাদের পক্ষ থেকে বিভিন্ন খাতে আগত অর্থ বা সম্পদের যদি সঠিক ব্যবহার করা যায়, মনে হয় না এমন কোনও সমস্যা উদ্ভূত হবে। কেননা মাদরাসায় প্রদত্ত এই সমস্ত অর্থের শরিয়তের দৃষ্টিতে একমাত্র হকদার ছাত্রসমাজ। তাদের হিত হবে, এমন সব কাজেই সেগুলি খরচ করা যেতে পারে। কিন্তু তা না করে অহেতুক বিল্ডিংয়ের পর বিল্ডিং তৈরি করা, সেসবের সৌন্দর্যায়নের পিছনে রাশি রাশি টাকা খরচ করা, মুহতামিম সাহেবের বেতন প্রয়োজন মোতাবেক ধার্য করে সেই প্রয়োজনের সীমা লক্ষাধিক টাকা পর্যন্ত বিস্তৃত হওয়া, ইত্যাদি ইত্যাদি খাতে খরচ করলে সমস্যা তো হবেই।

প্রচলিত সমাজব্যবস্থা ও দ্বীনি দায়িত্ববোধ 

সমাজের সদস্য হিসাবে প্রত্যেকেরই যেমন একটা সামাজিক দায়বদ্ধতা থাকে, তেমনি মুসলিম হিসাবে দীনি কিছু দায়বদ্ধতাও সমাজের সকলের উপরে অর্পিত হয়। মসজিদকে কেন্দ্র করে দীনি সচেতনতা ও দীনি আদর্শভিত্তিক সমাজ বিনির্মাণের ক্ষেত্রে সবচেয়ে কার্যকরী ও উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে পারেন ইমাম সাহেব। কিন্তু তিন-চার হাজার টাকা বেতনে তেমন যোগ্য ইমাম কীভাবে পাওয়া যেতে পারে! মাদরাসাগুলিকে সাধারণত সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন একটা অংশ ভাবা হয়ে থাকে। অথচ মাদরাসা পরিচালনার জন্য অর্থের যোগান এই সমাজ থেকেই আসে। অর্থ সাহায্য করার পর দায়বদ্ধতা তো আরো বাড়ার কথা। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে এই শ্রেণির সাথে মাদরাসা কর্তৃপক্ষের সম্পর্ক শুধুমাত্র অর্থকেন্দ্রিক। দু’ পক্ষকেই এই বিষয়ে ভাবা দরকার।

সমস্যা ও সম্ভাব্য সমাধানের উপায় 

সংক্ষেপে পশ্চিমবঙ্গের প্রেক্ষিতে সামগ্রিকভাবে কওমি মাদরাসার শিক্ষার মান ও দীনি খিদমত সম্পর্কে যদি একটি নিরপেক্ষ জরিপ করা যায়, তাহলে বলতে হয় যে, বর্তমানে কয়েকটি বিষয়ে সেখানে বিশেষভাবে ঘাটতি থেকে যাচ্ছে। প্রথমত, মাতৃভাষায় অধিকাংশ ছাত্রের দুর্বলতা। দ্বিতীয়ত, সমাজ সম্পর্কে প্রয়োজনীয় ধারণা না থাকায় সমাজে দীনি-কার্যক্রম আঞ্জাম দিতে গিয়ে বাধার সম্মুখীন হওয়া। এ ছাড়াও ব্যতিক্রমী ছাত্র ব্যতীত দীনি বিষয়াদিতেও যে তারা যথেষ্ট দক্ষ হয়ে উঠছে এ কথা বলাও বেশ কঠিন। মৌলিকভাবে পর্যালোচনা করলে এসবের কয়েকটি কারণ উঠে আসে। যেমন, পর্যাপ্ত বেতন না থাকায় উপযুক্ত ও যোগ্য শিক্ষকের অভাব। শিক্ষকদের ওপর মুহতামিমদের অহেতুক কড়াকড়ির কারণে তাঁদের আন্তরিকতা থেকে ছাত্রদের বঞ্চিত হওয়া। পড়াশোনার মান নিয়ে কর্তৃপক্ষের কোনো সমীক্ষা না করা বা এ সম্পর্কে তাদের উদাসীন থাকা।

উপরে বর্ণিত রাজনৈতিক, সামাজিক ও দীনি এমন দৈন্যদশা থেকে উত্তরণের কোনও তাগিদ কিন্তু এই সমাজের পক্ষ থেকে নেই বললেই চলে। বৃহত্তর স্বার্থে একতাবদ্ধ হওয়ার ডাক নেই। দীনি ও আধুনিক উভয় শিক্ষার হারও এখনও উল্লেখযোগ্য ভাবে কম। তার উপর দুই ধারার শিক্ষিত শ্রেণির মধ্যে মেলবন্ধন ও যোগসূত্রের প্রচুর অভাব। মুসলিম সমাজকে উভজগতের কল্যাণের দিকে নিয়ে যেতে হলে যেটির প্রয়োজন অনস্বীকার্য। মুসলিমদের আসল প্রাণশক্তি হলো, ঈমানি শক্তি। ঈমানি শক্তির বলে বলীয়ান হয়েই একসময়ে তারা সারা বিশ্বে রাজত্ব করেছে। আধুনিক শিক্ষায় তাদের অবদানের কথা অনস্বীকার্য হলেও দুনিয়াজোড়া তাদের প্রভাব-প্রতিপত্তি মূলত ঈমানি শক্তির কারণেই ছিল। ঈমানি শক্তিসহ, আচার-আচরণ ও উচ্চারণে যদি নববি আদর্শ ফিরিয়ে নিয়ে এসে দীনি দাওয়াতের ব্যাপক প্রচলনের সাথে আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত শ্রেণিকে সাথে নিয়ে উম্মাহর দ্বীন ও দুনিয়া কেন্দ্রিক সমৃদ্ধি ও প্রগতির জন্য সঠিক অর্থে চেষ্টা করা হয়, তাহলে আশা করা যায় সেই চেষ্টা স্বীকৃতি পাবে এবং অচিরেই একটি ইনকিলাব তৈরি হবে।

লেখক: শিক্ষার্থী, ইফতা বিভাগ, দারুল উলূম দেওবন্দ। 

আগের সংবাদদক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় মুসলমানদের ভবিষ্যত
পরবর্তি সংবাদঅপারেশন আজারবাইজান: মা-ওয়ারাআন নাহারে দুঃসাহসিক অভিযান