হুজাইফা মাহমুদ:
বছর তিনেক আগে তুর্কি-বৃটিশ লেখিকা এলিফ শাফাকের The Forty Rules Of Love নামক বইটি একজন আমাকে উপহার দেন। এই সুযোগে উপহার দাতার প্রতি শুকরিয়া জ্ঞাপন করছি। এটি একটি Bio-fiction বা জীবনী ভিত্তিক উপন্যাস। তেরো শতকের বিখ্যাত সুফি দরবেশ মাওলানা জালালুদ্দীন রুমি এবং তার আধ্যাত্মিক গুরু শামস তাবরেযির জীবন ও দর্শন নিয়ে রচিত হয়েছে এই উপন্যাস। বইটি ইতোমধ্যেই বৈশ্বিক পরিসরে জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। ২০০৯ -এ প্রথম প্রকশিত হওয়ার পর এ পর্যন্ত পঞ্চাশটিরও বেশি ভাষায় অনূদিত হয়েছে, এবং বিশ্বব্যাপী কয়েক মিলিয়ন কপি বিক্রি হয়েছে। যথারীতি বাংলা ভাষাতেও একটি অনুবাদ নজরে এসেছে। এসব বই সম্পর্কে পূর্বাভিজ্ঞতা ও অনুমান থাকায় পড়তে তেমন আগ্রহবোধ করি নাই। তবু নিতান্ত অনিচ্ছা ও অনাগ্রহ থাকা সত্ত্বেও একসময় বইটি পড়া শুরু করি । কেননা, হাল যমানায় সুফিবাদ,মাওলানা রুমি, কিংবা অপরাপর সুফি দরবেশদের কেন্দ্র করে যে ধরণের ভাববাদী ট্রেন্ড তৈরী হয়েছে, এবং এই ইসলামের অতীব গুরুত্ত্বপূর্ণ এই ধারাটিকে তার শেকড় থেকে উপড়ে এনে একে নতুন অর্থে বিনির্মাণ করার যে প্রক্রিয়াটি চলছে , এর গতি প্রকৃতি ও প্রবণতা বুঝার জন্য এই বইটি পড়া জরুরী বলে মনে হলো। এবং সত্যই তাই, “নয়া যুগের ধার্মিকতার” হাল হাকীকত সন্ধানে এই বইয়ের জুরি নাই। বর্তমান লেখাতে আমি এই বিষয়েই কিছু খুচরো আলাপ একত্রিত করার চেষ্টা করবো।
উপন্যাসের মূল কাহিনীর সার সংক্ষেপ এমন- এলা রোবিন্সটেইন নামের একজন মধ্যবয়সী আমেরিকান ইহুদি গৃহবধূ,তার দন্ত-চিকিৎসক স্বামী এবং তিন সন্তান নিয়ে বসবাস করেন বোস্টনে। মিডলাইফ ক্রাইসিসে ভুগতে থাকা এলা সাংসারিক কাজের বিরক্তি ও একঘেয়েমি দূর করতে একসময় একটি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানে বই রিভিউয়ের কাজ নেন। সেই সুবাদে তার হাতে sweet blasphemy নামে একটি বই আসে, রিভিউয়ের জন্য। বইয়ের বিষয় মাওলানা রুমি ও শামস তাবরেযির জীবন ও তাদের মধ্যকার আধ্যাত্মিক সম্পর্কের ঐতিহাসিক বিবরণ। বইয়ের লেখক আযিয যাহারা নামক এক স্কটিশ পরিব্রাজক, যিনি মূলত নাস্তিক ছিলেন, কিন্তু তাঁর জীবনে ঘটে যাওয়া একটি বিশেষ ঘটনায় প্রভাবিত হয়ে সুফিবাদের দিকে আকৃষ্ট হন এবং এতে দীক্ষা নেন। এলা রোবেন্সটেইন এই বই পড়ে দারুণভাবে প্রভাবিত হন এবং লেখকের সাথে যোগাযোগ করতে উদ্যোগী হন। তাদের মাঝে ই-মেইল যোগাযোগ গড়ে উঠে এবং এই সম্পর্কের গভীরতা বহুদূর পর্যন্ত গড়ায়। এক পর্যায়ে স্বামী সন্তান ছেড়ে এলা রোবেন্সটেইন আযিযের সাথে দেশান্তরী হন। আযিয যখন তাকে আত্ম-অনুধাবন ও দুঃখ কষ্ট থেকে মুক্তির সন্ধান দেয়, তখন স্বামী, সন্তান, পরিবার একসময় সবকিছুই তার কাছে অর্থহীন মনে হতে থাকে। বলা বাহুল্য, তাদের মধ্যকার এই সম্পর্কটি বিবাহ বহির্ভূত এবং যেকোন আইনে তা বে-আইনি সম্পর্ক।
এলিফ শাফাক মূলত এই বইয়ে সমান্তরালভাবে সম্পূর্ণ ভিন্ন দুটি সময়, স্থান এবং চরিত্রের বিবরণ দেন, যথাক্রমে তেরো শতকের কোনিয়ায় রুমি-শামস এবং একবিংশ শতকের বোস্টনে এলা ও আযিয যাহারা। তবে তাদের মধ্যকার এই স্থান ও কালের যোজন পার্থক্য ঘুচিয়ে তারা মূলত একটি চেতনা বিন্দুতে এসে মিলিত হয়েছেন এবং তা হলো আধ্যাত্ম্য চেতনা। একদিকে শামস তার শিষ্য রুমিকে সুফিবাদের দীক্ষার মাধ্যমে একজন মামুলি ধর্মীয় পণ্ডিত থেকে আত্ম-অনুসন্ধান, বৈশ্বিক প্রেম ও আত্মিক শান্তির সর্বোচ্চ শিখরে পৌঁছে দিচ্ছেন। অপরদিকে আযিয যাহারা আমস্টার্ডামে বসে ই-মেইল যোগে এলাকে আধ্যত্মিক মুক্তি ও প্রেমের দিক্ষা দিয়ে যাচ্ছেন। তেরো শতকের কোনিয়াতে যেই শামস ও রুমির দেখা মিলে, একুশ শতকের বোস্টন ও আমস্টার্ডামেও আমরা একজন স্কটিশ শামস এবং একজন ইহুদি আমেরিকান মহিলা রুমির দেখা পাই। আমরা দেখবো, তাদের মধ্যকার এই প্রেম ও ভালবাসা মামুলি কোন প্রেম নয়, এই প্রেম রুপান্তরকামী। এই প্রেমের স্পর্শে রুমি কোন এক সাধারণ মাওলানা থেকে হয়ে উঠেন প্রবল আধ্যত্মিক শক্তি সম্পন্ন বিশ্ব-প্রেমিক সুফি সাধক, এবং এলা রোবেন্সটাইন একজন অতি সাধারণ সংসার ক্লান্ত গৃহবধূ থেকে হয়ে উঠেন মুক্ত স্বাধীন ও আত্ম অনুসন্ধানী এক সুফি সাধিকা। এই যে রুমি এবং এলার অন্য মানুষে পরিণত হওয়া শামস এবং আযিযের সংস্পর্শে এসে, এটাই এই উপন্যাসের মূল উপাদান—তথা, আত্ম-অনুসন্ধান মানব মনে এমন এক বৈপ্লবিক অনুভূতি সৃষ্টি করে যা মানুষকে তার জাগতিক সকল বন্ধন ও অর্গলকে ছিন্ন করে আধ্যাত্মিক মুক্তির দিকে নিয়ে যায়, এবং তুচ্ছ ক্ষুদ্র জীবনকে মহৎ ও মূল্যবান করে তুলে। এই বইয়ে এলিফ শাফাক সুফিবাদ এবং বৃহত্তর অর্থে ইসলামকেই রিপ্রেজেন্ট করতে চেয়েছেন, যেমনটা তিনি তার একাধিক সাক্ষাৎকার ও বক্তব্যে বলেছেন। রিপ্রেজেন্টেশন বা কোনকিছুর প্রতিনিধি হওয়া সর্বাংশে একটি রাজনৈতিক ব্যাপার। সুতরাং এলিফ শাফাকের এই প্রতিনিধিত্ত্বকেও মুসলিমদের নিজস্ব ডিসকোর্সের সাথে মিলিয়ে দেখাটা জরুরী।
পশ্চিমা পটভূমিতে মাওলানা রুমি
মাওলানা রুমির সাথে পশ্চিমের পরিচয় ঘটে সেই উনবিংশ শতকেই, জার্মান ও বৃটিশ প্রাচ্যবিদদের হাত ধরে। রুমির অল্প বিস্তর অনুবাদ শুরু হয় তখন থেকেই। বিশেষত R.A Nicholson (1868-1945) এবং E.H Whinfield(1836-1922) রুমি ও উমর খৈয়ামের অনুবাদক হিসেবে ব্যাপক প্রসিদ্ধি লাভ করেছিলেন। তবে এই পরিচয়ে্র গণ্ডি সীমাবদ্ধ ছিলো নিছক পণ্ডিত মহলেই। পশ্চিমের অনেক কবি সাহিত্যিক ও দার্শনিক রুমির কবিতা ও দর্শন দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন। তবে ব্যাপকভাবে পশ্চিমের গণ-পাঠকের সাথে রুমির পরিচয় ঘটেছে মাত্র কয়েক দশক আগে। ১৯৯৫ সালে Coleman Barks তার বিখ্যাত অনুবাদ The Essential Rumi প্রকাশ করেন। এই বই আমেরিকা ও বিশ্ব সাহিত্যের বাজারে হুলুস্থূল ফেলে দেয়। আজ দুনিয়া ব্যাপী যে “রুমি-উন্মাদনা” দেখা যায় এর একক “দায়ভার” দেয়া যায় কোলম্যান বার্ক্সের উপরই। কিন্তু তার এই অনুবাদকে অনুবাদ না বলে বরং শব্দান্তর বা বাক্যান্তর বলাই যথাযথ হবে। কেন না বার্ক্স নিজে আদৌ ফার্সী ভাষা জানেন না। তিনি মূলত তার পূর্বের হওয়া ইংরেজী অনুবাদগুলোরই শব্দ বাক্যের এদিক সেদিক ঘটিয়ে নিজের অসাধারণ কাব্য প্রতিভা ও সৃজনশীলতা খাটিয়ে সাধারণ পাঠকদের জন্য সহজবোধ্য ও তাদের সংস্কৃতির উপযোগী করে দিয়েছেন। বিশেষত R.A Nicholson এর করা স্কলারলি অনুবাদের (Mathnavi of Rumi-1925) উপরই কাজ করেছেন বার্ক্স।
তার এই “অনুবাদ কর্ম” কোনভাবেই টেক্সটের ভাষিক বিশ্বস্ততার প্রতি কোন দায় বহন করেনা। ফলে তিনি নিজে থেকে অত্যন্ত যত্নের সাথে দুটি কাজ করেছেন এই “ অনুবাদে”। প্রথমত, De-islamization বা বি-ইসলামিকরণ। অর্থাৎ, রুমির কবিতা থেকে ইসলামকে যতটা সম্ভব মুছে ফেলা এবং একে ধর্ম বর্ণ নির্বেশেষে সব মানুষের আধ্যাত্মিক টেক্সটে পরিণত করা। দ্বিতীয় কাজটি হলো Domestication। অর্থাৎ রুমির কবিতাকে পশ্চিমা/আমেরিকান সভ্যতা ও সংস্কৃতির ছাঁচে ফেলে দেয়া এবং পশ্চিমা জিওগ্রাফির টেক্সট হিসেবে পাঠ করা। বার্ক্স যে এই কাজগুলো করেছেন এটা তিনি নিজেও স্বীকার করেছেন এবং এর পেছনে বিভিন্ন অজুহাতও দাঁড় করিয়েছেন। তার অনুবাদ পড়লে আদৌ এ কথা মনে হওয়ার সুযোগ থাকেনা যে আপনি এমন একজন মুসলিম সুফির কবিতা পড়ছেন, যার দিন রাত্রির একমাত্র ভাবনা ছিলো আল্লাহর ভালোবাসায় নিজেকে বিলীন করে দেয়া এবং শরীয়তে ইসলামের পুঙ্খানুপুঙ্খ অনুসরণ করে আল্লাহর আরও নিকটবর্তী হওয়া! রুমি তার কবিতায় অসংখ্য আয়াত ও হাদিস ব্যবহার করেছেন। যে কারণে তাঁর মসনবিকে ফার্সি ভাষায় কুরআনের কাব্যিক তাফসির হিসেবেও আখ্যা দেয়া হয়। কিন্তু বার্ক্স এইসব আয়াত ও হাদিসকে বেমালুম গায়েব করে দিয়েছেন, তার অনুবাদের কারসাজি দিয়ে। এই যে প্রাচ্যের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একজন মুসলিম সুফি কবির কবিতাকে এই পর্যায়ের বিকৃত করা এবং তাঁর নিজস্ব আইডেন্টিটিকে নিশ্চিহ্ন করে দিয়ে পশ্চিমা আইডেন্টিটির পোশাক চাপিয়ে দেয়া নিঃসন্দেহে সাংস্কৃতিক সাম্রাজ্যবাদের সবচে ঘৃণ্য উদাহরণ হয়ে থাকবে।
দ্যা ফোর্টি রোলস অফ লাভ এর আলোচনায় কোলম্যান বার্ক্সের প্রসঙ্গ আবশ্যিকভাবেই আসবে। কেননা এলিফ শাফাক যে ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে ইসলাম, সুফিবাদ, শামস ও রুমিকে উপস্থাপন করতে চেয়েছেন, সেই ভিত্তির প্রতিষ্ঠাতা আর কেউ নন, স্বয়ং কোলম্যান বার্ক্স। কোলম্যান বার্ক্সের এই অনুবাদ-চাতুর্য্য নিয়ে আলাদা আলোচনার প্রয়োজন,বর্তমান লেখায় সেটা উদ্দেশ্য না যদিও।
নাইন-ইলেভেন পরবর্তী সময়ে মাওলানা রুমি
নাইন-ইলেভেন পরবর্তী সময়ে আমেরিকান পলিসি গুড মুসলিম ও ব্যাড মুসলিম এর ক্যটাগরিতে ফেলে সমস্ত মুসলিমকে দুইভাগে ভাগ করে ফেলে। এবং এই দুই ক্যটাগরির মানদণ্ড কী কী হবে সেটাও ঘোষিত/অঘোষিতভাবে নির্ধারিত হয়ে যায়। এই সময়ে ইসলামের সুফিবাদি ধারা ব্যাপকভাবে আলোচনায় আসে। ইতিপূর্বে পশ্চিমে সুফিবাদকে কেবলই “Mystical Islam” বলে ইসলামের একটি শাখা হিসেবে গণ্য করে আসলেও আমেরিকার নব্য গুড মুসলিম ডিস্কোর্সে সুফিবাদ সম্পূর্ণ নতুন এক অর্থ নিয়ে হাজির হয়। সুফিবাদকে তখন শান্তিপূর্ণ, আধুনিক, মধ্যপন্থী, সহনশীল, নমনীয়, সার্বজনীন ইত্যাদি নানান মুখরোচক অর্থে ব্যখ্যা করা শুরু হলো। এই সময়েই মাওলানা রুমি হয়ে উঠেন গুড মুসলিমের আদর্শ উদাহরণ।নাইন-ইলেভেন এর পূর্বেই কোলম্যান বার্ক্স রুমি নামক ঐতিহাসিক চরিত্রটিকে ধর্ম, বর্ণ,জাত ও জাতির সীমার উর্ধ্বে একজন বৈশ্বিক প্রেমিক ও শান্তিবাদি আধ্যত্মিক মানুষ হিসেবে নির্মাণ করেছেন। যিনি নাম পরিচয়ে মুসলিম হয়েও তথাকথিত মুসলিমদের মতো অক্ষরবাদী কট্টরপন্থি মুসলিম না, বরং তিনি প্রেম ও সর্ব ধর্মের মানুষের জন্য ভালোবাসার বাণী প্রচার করেছেন, ধার্মিকতার চেয়ে মানবিকতাকেই যিনি গুরুত্ত্বপূর্ণ হিসেবে বিবেচনা করেছেন। রুমির কবিতা নিয়ে তখন আমেরিকা ও ইউরোপের নামিদামি পত্রিকা, ম্যগাজিনগুলোতে ব্যাপকভাবে লেখালেখি শুরু হয়। তার ব্যাপারে বলা হচ্ছে – A Love That Conquers Barriers of Time And Culture.
ওয়াশিংটন পোস্টের এক নিবন্ধের বক্তব্য হলো – মৌলবাদীরা রুমিকে ঘৃণা করে, কারণ তিনি ছিলেন একজন কবি ও আধ্যাত্মিক মানুষ, তাদের মতো ধার্মিক নন। তিনি খুবই প্রগতিশীল মন মানসিকতার অধিকারী ছিলেন, মদ ও নাচ গানের বিরোধী ছিলেন না, বরং ধর্ম বর্ণ ও যৌন বৈষম্যের বিরোধী ছিলেন। আজকের যুগে মুসলিমদের মাঝে তাঁর মতো আরও মানুষ প্রয়োজন আমাদের।
এ থেকে বুঝা যায় তথাকথিত ইসলামী মৌলবাদের মোকাবেলায় মাওলানা রুমিকে, তথা তাঁর যে অসাম্প্রদায়িক ও লিবারেল চরিত্র নির্মাণ করা হয়েছে, তাকে দাঁড় করানো কী কারণে প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। একজন পারফেক্ট মুসলিম চরিত্র কেমন হওয়া উচিত, সেটাই যেনো বারবার দেখিয়ে দেয়া হচ্ছে। ঠিক এই সময়েই রুমিকে নিয়ে উপন্যাস লেখার হট ট্রেন্ড চালু হয় পশ্চিমা সাহিত্যাঙ্গনে। যেমন, chasing Rumi (2002) Abandon(2003), kimmya khatun( 2004), Rumi’s Daughter (2005), A moth in Flame (2006) এবং এরই ধারাবাহিকতায় ২০১০ সালে এলিফ শাফাকের The Forty Rules Of Love: A Novel Of Rumi উপন্যসাটিও আসে। এখানে লক্ষ্যণীয় বিষয় হলো সবগুলো উপন্যাসই নাইন-ইলেভেন এর পরে লেখা হয়েছে এবং সবগুলোর মাঝেই বিশেষ কিছু কমন প্রবণতা আছে, যা আমরা পূর্বে দেখিয়েছি। রুমিকে নিয়ে লেখা সবগুলো উপন্যাসের তুমুল জনপ্রিয়তার ব্যাপারটিও বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয়। এর মাধ্যমে বুঝা যায় আমেরিকা বা পশ্চিমের ধর্মবোধ ও চৈতন্যে ব্যপক একটি পরিবর্তনের আভাস দেখা দিচ্ছে। যে পরিবর্তন কে ডঃ ফাতেমা আর্তুন নব যুগের ধার্মিকতা বলছেন (New Age-Religiosity)।
আমাদের বর্তমান আলোচ্য উপন্যাসটি বিভিন্ন বিবেচনায় আলাদা মনোযোগের দাবী রাখে। এর মাঝে অন্যতম বিবেচনা হলো এই উপন্যাসটি আমেরিকা ও পশ্চিমা সমাজে নবযুগের ধার্মিকতা নামক ডিস্কোর্সের সকল প্রবণতা ও আলামতকে যথাযথভাবেই ধারণ করেছে। উপন্যাসটি লেখা হয়েছে আমেরিকার প্রেক্ষাপটে, আমেরিকার ভাষায় এবং আমেরিকান পাঠকদের উদ্দেশ্যেই। সুতরাং তিনি তার বইয়ে রুমিকে বার্ক্সিয় কায়দা অনুসরণ করে রুমিকে ঠিক সেভাবেই চিত্রায়িত করেছেন যেভাবে তাঁর পাঠকগণ দেখতে চায়। কোলম্যান বার্ক্স তার “অভাবনীয় অনুবাদ শৈলী” দিয়ে রুমি ও শামসকে যেভাবে চিত্রায়িত করেছেন, শাফাক তার উপন্যাসে এর ভিন্ন কিছু করেননি, চিত্রায়নের পরিসর বৃদ্ধি করা ব্যাতীত। বার্ক্স যেখানে রুমি এবং শামস পর্যন্তই সীমাবদ্ধ ছিলেন, শাফাক সেখানে সুফিবাদ এবং ইসলামকেও টেনে আনেন শামস এবং রুমির মধ্য দিয়ে। ডোমেস্টিকেশন (আমেরিকানাইজেশন) এবং ডি-ইসলামাইজেশন, বার্ক্সের যে দুই বৈশিষ্ট তা আমরা শাফাকের উপন্যাসেও পুরোপুরিভাবে উপস্থিত পাই। শাফাকের আমেরিকানাইজেশন প্রক্রিয়াটি বুঝা যায় তার রুমির পাশাপাশি একই কনটেক্সটে একজন আমেরিকান চরিত্রকেও উপস্থিত রাখার মাধ্যমে। আবার ভীনদেশি শামসের পাশাপাশি একজন ভিনদেশী আযিয যাহারাকে উপস্থিত রাখার বিষয়টিও স্পষ্ট। তবে বার্ক্স এবং শাফাকের মাঝে একটি পার্থক্যের দিক হলো, বার্ক্স শামস ও রুমিকে ইসলাম থেকে সম্পর্কহীন করতে চেয়েছেন। অর্থাৎ তারা নির্দিষ্টভাবে ইসলামের কেউ না, বরং প্রাতিষ্ঠানিক যেকোন ধর্মের গণ্ডি পেরিয়ে তারা এক বৈশ্বিক চৈতন্য লালন করেন, এবং ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সকলের জন্য মহাজাগতিক প্রেম ও ভালোবাসার উদাত্ত আহবান জানান। কিন্তু শাফাক এক্ষেত্রে কিছুটা চতুরতা দেখিয়ে শামস রুমিকে পুরোপুরি ইসলাম থেকে খারিজ করে দেননি, বরং তিনি দেখিয়েছেন এই রুমি এবং শামসই প্রকৃত ইসলামের ধারক বাহক। একজন পারফেক্ট মুসলিম কথা, কাজ ও ধর্মীয় চৈতন্যে কেমন হবে, সেটা রুমি এবং শামসের মাঝে পাওয়া যায়। এই দুই চরিত্রের মধ্য দিয়ে শাফাক তার কথিত “পারফেক্ট ইসলাম”কেই মূর্ত করে তুলেন।
উপরন্তু শাফাক নিজে “মুসলিম” এবং তুর্কী দেশি হওয়ায়, যা কিনা খোদ মাওলানা রুমির দেশ, ইসলাম ও সুফিবাদের প্রতিনিধিত্ত্ব করার একধরণের “বিশেষ অধিকার” লাভ করেন তার পাঠকদের কাছে।
স্পিরিচুয়াল, নট রিলিজিয়াস: নয়া যুগের ধার্মিকতা
আধুনিক মানুষ, বিশেষত পশ্চিমের মানুষ নির্দিষ্ট কোন আদর্শ, মতবাদ বা প্রাতিষ্ঠানিক কোন ধর্মের সীমায় আবদ্ধ থাকতে চায় না। ধর্মীয় বিধিবিধান তার মুক্তির পথে অন্তরায় বলে মনে হয়। সেই জায়গা থেকে তারা সুফিবাদকে আবিষ্কার করলো এমন এক উপায় হিসেবে যার মাধ্যমে তাদের ধর্মও পালন হয়, আবার মানবীয় প্রবৃত্তির অবাধ মুক্তির পথে কোন বাধা বিপত্তিও থাকেনা। এলিফ শাফাক এই নয়া সুফিবাদের উপাখ্যানই রচনা করেন তার বইয়ে।
শাফাক দেখাচ্ছেন, সুফিবাদ হলো ইসলামের সবচে গভীর, শান্তিবাদী, সহনশীল এবং সুরেলা ধারা, যেখানে কোন মারামারি হানাহানি নেই, নেই কোন হিংসা বিদ্বেষ কিংবা পরধর্মের প্রতি অশ্রদ্ধা। এক অদৃশ্য সত্ত্বার প্রতি অলৌকিক প্রেমের সাতারে মশগুল তারা। উপন্যাসের প্রধান দুই চরিত্র আযিয ও এলার মাধ্যমে এই নব্য-সুফিবাদের সাথে আমাদেরকে পরিচিত করান শাফাক। আযিয তার চিঠিতে সুফিবাদকে “সার্বজনীন আধ্যত্মিকতা”(Universal Spirituality) হিসেবে আখ্যায়িত করে। এই সুফিবাদ সার্বজনীন,অর্থাৎ ইসলাম কিংবা কোন প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের সাথে এর সম্পর্ক থাকাটা আবশ্যক না, যদিও এর উৎপত্তি ইসলামের মধ্য থেকেই। সেই দৃষ্টিকোণ থেকে আযিয নিজের ব্যাপারে বলে, আমি আধ্যাত্মিক, তবে ধার্মিক নই (spiritual,but not religious)। সুফি হওয়ার জন্য ধর্মের নিয়ম কানুন ও আচার অনুষ্ঠান মেনে চলাটা আবশ্যক না, বরং আত্মিক শুদ্ধিকেই সুফিগণ প্রাধান্য দিয়ে থাকেন। যে কারণে আমরা একজন “ইহুদি রুমির” দেখা পাই যিনি ইসলামের ভেতরে প্রবেশ না করেও, ইসলাম সম্পর্কে সামান্য পরিমাণ জানাশোনা না থাকা সত্ত্বেও একজন পূর্ণাঙ্গ সুফিসাধিকা হয়ে উঠতে পারছেন, আযিযের দিক নির্দেশনায়। যে আযিয নিজেও কোন অর্থেই মুসলিম না। শাফাক/আযিয ইসলামের সুফিবাদকে এভাবে আমেরিকার নব্য ধার্মিকতার ট্রেন্ডের সাথে সম্পৃক্ত করেন। এবং এটাই হলো সুফিবাদের ডোমেস্টিকেশনের সবচে বড় ধাপ। নব্য সুফিবাদ (Neo-sufism) হলো , সকল ধর্ম দর্শন ও মতবাদের উর্ধ্বে উঠে একধরণের বায়বীয় আধ্যাত্মিক চৈতন্য লালন করা, যা আসলে সাময়িক ফ্যান্টাসি বা কল্পিত শান্তিবোধ তৈরী করে , কিন্তু দিনশেষে এটি একটি সারমর্মহীন ফাঁকা বাক্যাবলী ও উচ্চমার্গীয় বাগ্মিতার বিলাসিতাতেই পর্যবসিত হয়। এই কল্পিত সুফিবাদকে পপ সুফিবাদ বা কালচারাল সুফিবাদ নামেও অভিহিত করা যায়।
পুরো উপন্যাসে একটা ব্যাপার সবচে বেশি লক্ষ্যণীয়- “সুফিবাদি ইসলাম” ও “অক্ষরবাদী ইসলামের” দ্বন্দ্ব ও বৈপরিত্য। উপন্যাসের প্রধান দুই চরিত্র শামস এবং আযিয যাহারার মাধ্যমে এই বিষয়টি বারবার বিভিন্নভাবে উপস্থাপন করেছেন। শাফাক দেখিয়েছেন, ইসলামের দুইটি ভার্সন বা প্রকার রয়েছে, একটি হলো সুফিদের চর্চিত ইসলাম, অন্যটি শরিয়তপন্থী, অক্ষরবাদি মুসলিমদের ইসলাম। এর মাঝে সুফিদের ইসলাম হলো সার্বজনীন প্রেম, ভালোবাসা ও শান্তিপূর্ণ ইসলাম। যে ইসলাম কুরআন হাদিস কিংবা শরিয়তের আক্ষরিক অনুসরণ করে না। ইসলামের প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো বা বাহ্যিক কোন আচার-আচরণ এবং বিধি-নিষেধের প্রতিও দায়বদ্ধ না। ইসলামের পুরো কাঠামোকে সুফিগণ তাদের ভাববাদি ধারায় রূপক অর্থে ব্যাখ্যা করেন। সুফিবাদি ইসলাম জাত-ধর্ম-বর্ণ-ভূগোল সবকিছুর উর্ধ্বে গিয়ে বৈশ্বিক, সার্বজনীন এবং অসাম্প্রদায়িক পরিচয় ধারণের কথা বলে। ধর্মের বাহ্যিক আচার-আচরণের পরিবর্তে তারা আত্মিক পরিশুদ্ধির কথা বলেন।
অপরদিকে শরীয়তপন্থী বা অক্ষরবাদী ইসলাম খুবই সীমাবদ্ধ, পশ্চাৎপদ এবং সার্বিকভাবে ঝামেলাপূর্ণ। তারা ইসলামকে সীমাবদ্ধ করে ফেলে কতক রীতি-নীতি আর আনুষ্ঠানিকতার মাঝে। অর্থাৎ যারা ইসলামকে ঠিক সেভাবেই বুঝতে চায় যেভাবে কুরআন ও হাদিসে বিবৃত আছে, সুফিদের ভাববাদি ব্যখ্যাকে গ্রহণ করে না, এবং ইসলামের “আধ্যাত্মিক” দিকটিকে গুরুত্ত্ব না দিয়ে যারা এর বিধি-বিধান ও আচার-আচরণকে গুরুত্ত্ব দেয়, তারাই হলো কট্টরপন্থী অক্ষরবাদী মুসলিম।
এর একটা উদাহরণ দেয়া যায়- ইসলামে জিহাদ একটি অতীব গুরুত্ত্বপূর্ণ বিধান। অবস্থা ও পরিস্থিতির বিচারে কখনও আক্রমণাত্বক জিহাদ, কখনও প্রতিরোধ জিহাদ, দুইটাই ইসলামের একেবারে মৌলিক বিধান। এ ব্যাপারে শাফাকের শামসকে বলতে দেখা যায়- আল্লাহর প্রেমে নিজেদেরকে বিলীন করে দেয়া এবং নিজের নফসের বিরুদ্ধে লড়াই করার পরিবর্তে ধর্মান্ধের দল মানুষের বিরুদ্ধেই লড়াই শুরু করে দিয়েছে। প্রেম ও ভালোবাসার পরিবর্তে ধর্মের নামে ভীতি ও শঙ্কার সমুদ্র তৈরী করেছে। কুরআনের গভীর সারমর্ম ও সামগ্রিকতাকে গ্রহণ করার পরিবর্তে ধর্মান্ধের দল নির্দিষ্ট এক/ দুই আয়াতের বাহ্যিক অর্থ নিয়েই ব্যাতিব্যস্ত হয়ে পড়ে।(পৃঃ ১৮১)
এখানে শামস স্পষ্ট করে বুঝিয়ে দিচ্ছেন যে, সুফিগণ এবং অক্ষরবাদী মুসলিমগণ ভিন্ন ভিন্ন ইসলাম পালন করেন, তাদের কুরআন পাঠও ভিন্ন। এবং এই দুই পাঠের পার্থক্যও দিন রাতের।
এভাবে পুরো উপন্যাসেই আমরা দেখি, শামস এবং আযিয উভয়েই এই তথাকথিত অক্ষরবাদীদের বিরুদ্ধে কামান দাগাচ্ছেন। প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের চর্চাকেই তারা সব অনিষ্ঠের মূল বলে মনে করেন। যেমনটা শাফাক নিজেও বলেছেন তার বিবিসির সাক্ষাৎকারে। যদিও সুফিদের ব্যাপারে বলা হচ্ছে তারা অন্যের ব্যাপারে জাজমেন্টাল নন, কিন্তু এ ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে তাদের বিরোধী পক্ষকে নাস্তানাবুদ করতে মোটেও পিছপা হচ্ছেন না। শাফাকের এই আলাপের সবচে জঘন্য দিক হলো, তার এই সুফিবাদী আলাপের শুরুই হয় একথা ধরে নিয়ে যে, দুনিয়াতে প্র্যাক্টিসিং মুসলিম মাত্রই বিপদজনক। সে যেকোন সময় সে শান্তির জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে।
সুফিবাদের এই নতুন ডাইমেনশন বুঝতে আবশ্যিকভাবেই আমাদেরকে পশ্চিমা লিবারেল সেক্যুলার ধার্মিকতার আইডিয়াকে সামনে রেখে বুঝতে হবে। কেননা সুফিবাদের এই হেজেমনিক বিনির্মাণ আদৌ এর বাইরের কিছু না।
শেষকথা :
এলিফ শাফাক এই উপন্যাসে উপস্থাপনের যে প্রক্রিয়া অবলম্বন করেছেন একে সেলফ-ওরিয়েন্টালিস্ট এপ্রোচ বলা যায়। অর্থাৎ,খোদ প্রাচ্যের কেউ যখন প্রাচ্যকে উপস্থাপন, বর্ণনা ও দেখার ক্ষেত্রে পশ্চিমা প্রাচ্যবাদী দৃষ্টিকোণ (perspectives) অবলম্বন করেন তখন তাকে সেলফ-ওরিয়েন্টালিজম বলা হয়। প্রাচ্যের ভেতর থেকেই তখন প্রাচ্যবাদ কাজ করে। এভাবে প্রাচ্যকে পশ্চিমের নিকটবর্তী করা হয়, প্রাচ্যবাদী প্রক্রিয়ায়, এবং তাকে আত্মিকরণ (Absorb)করে ফেলা হয়। বার্ক্স, শাফাকের মতো এলিট সেক্যুলারিস্টরা প্রাচ্যের ধর্ম, সংস্কৃতি ও সাহিত্য ছিনতাই(Cultural Apropriation)করতে উদ্যত হন। সুতরাং একথা নির্দ্বিধায় বলা যায় যে, এলিফ শাফাক যে রুমি, শামস এবং সুফিবাদকে তার বইয়ে উপস্থাপন করেছেন তার সাথে প্রকৃত রুমি শামস এবং সুফিবাদের দূরতম কোন সাযুজ্যও খুঁজে পাওয়া সম্ভব না।
এই রুমি এবং সুফিবাদকে আমেরিকার লিবারাল সেক্যুলার ফ্যাক্টরীতে সৃষ্টি করা হয়েছে পশ্চিমের, বিশেষত আমেরিকার ধর্মীয় ফ্যান্টাসীর চাহিদা মিটাতে, এবং পশ্চিমের আধিপত্যবাদী রাজনৈতিক এজেন্ডা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে। শাফাক তার বইয়ে সুফিবাদের মধ্য দিয়ে এবং প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মচর্চার বিরোধিতা করে যে সুখ সমৃদ্ধ শান্তি ও সৌহার্দ্যপূর্ণ পৃথিবীর চিত্র এঁকেছেন, একে এককথায় অলৌকিক স্বপ্নবিলাস বলা চলে। সে বিবেচনায় আমরা এই বইকে সুফিবাদের ইউটোপিয়া হিসেবে আখ্যায়িত করেছি। মাওলানা রুমি রহ. আসলে কে? এবং ইসলামে সুফিবাদ বলতে আসলে কী বুঝায়? সে অন্য এক আলোচনার বিষয়।
গ্রন্থ সহায়তা :
Rumi,The Poet Of Universal love: The Politics Of Rumi’s Apropriation in The West by Fatma B.cihan Artun
The Rumi Phenomenon by Elena Furlanetto
Spiritual consumption in the United States By Amira El Zain