রাকিবুল হাসান নাঈম:
লিঙ্গ পরিবর্তন এবং বিপরীত লিঙ্গের সাদৃশ্য ধারণ করা হারাম বলে ফতোয়া দিয়েছে দেশের শীর্ষ ইফতা বিভাগগুলো। চলতি বছর নতুন কারিকুলামে তৈরী পাঠ্যপুস্তকে লিঙ্গপরিচয় বিকৃতির ইস্যুতে যখন ধর্মীয় মহল প্রতিবাদে সরব, তখনই গুরুত্বপূর্ণ এ ফতোয়া এলো।
ফতোয়ায় বলা হয়েছে, লিঙ্গ পরিবর্তন হারাম। এই বিষয়টিকে শিথিল করে দেখার সুযোগ নেই। পাশাপাশি বিপরীত লিঙ্গের সাদৃশ্য ধারণ করাও হারাম এবং গর্হিত কাজ।
ফতোয়া সংগ্রহ
পাঠ্যক্রম ইস্যুতে নিয়মিতই প্রতিবেদন প্রকাশ করে আসছে ফাতেহ টুয়েন্টি ফোর। এরই ধারাবাহিকতায় বিভিন্ন ইফতা বিভাগে ‘লিঙ্গ পরিবর্তন’ বিষয়ক ফতোয়া চেয়ে পাঠায় নিউজ পোর্টালটি।
মোটাদাগে সবার কাছে প্রশ্ন করা হয়—লিঙ্গ পরিবর্তন করা জায়েজ কিনা। পুরুষ হয়েও নিজেকে নারী ভাবা, নারী হয়ে নিজেকে পুরুষ ভাবা—বিষয়টি নিয়ে ইসলাম কী বলে?
ইতোমধ্যে ফাতেহের কাছে ৭টি লিখিত ফতোয়া এবং পাঁচটি মৌখিক ফতোয়া এসেছে। লিখিত ফতোয়া দিয়েছে—জামিয়া কুরআনিয়া আরাবিয়া লালবাগ, আল জামিয়া আল ইসলামিয়া পটিয়া, আল জামিয়াতুল আহলিয়া দারুল উলুম মুঈনুল ইসলাম হাটহাজারী, জামিয়া ইসলামিয়া দারুল উলুম মাদানিয়া যাত্রাবাড়ী, জামিয়া রাহমানিয়া আজিজিয়া বছিলা, জামিআ আবু বকর সিদ্দীক, উত্তর কাজলা, জামিয়া আরাবিয়া হাজি সাইজুদ্দিন আনওয়ারুল উলুম মাদ্রাসা।
মৌখিক ফতোয়া দিয়েছে—মারকাযুদ দাওয়াহ আল ইসলামিয়া, মারকাযুল ফিকরিল ইসলামী (ইসলামিক রিসার্চ সেন্টার) বসুন্ধরা, ছারছিনা দারুসসুন্নাত কামিল মাদ্রাসা, সোনাকান্দা দারুল হুদা বহুমুখী কামিল মাদ্রাসা, মাদরাসাতুল হাদীছ, নাজিরবাজার।
লিখিত ফতোয়ায় কী বলা হয়েছে?
লিঙ্গপরিবর্তন হারাম ফতোয়া দিয়ে জামিয়া কুরআনিয়া আরাবিয়া লালবাগ বলেছে, ‘অস্ত্রোপচার করে শুধু দৈহিক অবয়বে যৎসামান্য পরিবর্তন আনা যায়। অর্থাৎ পুরুষের লিঙ্গ কেটে নারীর লিঙ্গ স্থাপন করা যায় বা নারীর লিঙ্গ কেটে পুরুষের লিঙ্গ স্থাপন করা যায়। কিন্তু মৌলিকভাবে ব্যক্তিসত্তার পুরুষত্বকে নারীত্বে কিংবা নারীত্বকে পুরুষত্বে পরিবর্তন করা যায় না। কারণ, সৃষ্টিগতভাবে পুরুষের ক্রোমোজমকে নারীর ক্রোমোজমে কিংবা নারীর ক্রোমোজমকে পুরুষের ক্রোমোজমে পরিবর্তন করা যায় না।’
ফতোয়ায় আরও বলা হয়েছে, ‘লিঙ্গ পরিবর্তন মূলত আল্লাহর সৃষ্টিতে পরিবর্তন। আল্লাহর ফায়সালাকে অস্বীকার করা। শরীয়তের আহকামে সংকট সৃষ্টি করা। কারণ, শরীয়তের বিভিন্ন আহকামে নারী-পুরুষের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। এখানে সংকট হলো—পুরুষের দৈহিক অবয়ব হতে নারীর দৈহিক অবয়বে রূপান্তরিত ব্যক্তিটি শরীয়তের কোন বিধান মতে চলবে? মৌলিকভাবে সে পুরুষ। সে কি পুরুষের বিধান মতে চলবে? বাহ্যিকভাবে সে নারী। সে কি নারীর মতো চলবে? এভাবে নিজ সত্তার পরিচয় সঙ্কট তৈরী হয়। ফলে সামাজিক সত্তার পরিচয়েও জটিলতার সৃষ্টি হয়।’
ফতোয়ায় বলা হয়, ‘এমনিভাবে নারী যদি নিজেকে পুরুষ ভেবে পুরুষের সাদৃশ্য অবলম্বন করে, কিংবা পুরুষ নিজেকে নারী ভেবে নারীর সাদৃশ্য অবলম্বন করে, এটাও জায়েজ নেই।’
লিঙ্গ পরিবর্তন হারাম ফতোয়া দিয়ে আল জামিয়া আল ইসলামিয়া পটিয়া বলেছে, ‘অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে সুস্থ মানুষ লিঙ্গ পরিবর্ত করা (পুরুষ থেকে নারী হওয়া কিংবা নারী থেকে পুরুষ হওয়া) সম্পূর্ণ নাজায়েয৷ এমনটি করা অভিশাপের শামিল৷ আল্লাহর সৃষ্টিকে বিকৃত করা, তার সাথে চ্যালেঞ্জ করার নামান্তর৷ শয়তানী প্ররোচনা ছাড়া আর কিছুই নয়৷ ইসলামি শরীয়তে এমন গর্হিত কাজের কোন সুযোগ নেই৷ কুরআনুল কারীমে এসেছে, আল্লাহর সেই ফিতরত অনুযায়ী চলো, যে ফিতরতের উপর তিনি মানুষকে সৃষ্টি করেছেন। আল্লাহর সৃষ্টিতে কোনো পরিবর্তন সাধন সম্ভব নয়। এটাই সম্পূর্ণ সরল দ্বীন। কিন্তু অধিকাংশ মানুষ জানে না ( সূরা রুম: ৩০)।’
ফতোয়ায় আরও বলা হয়েছে, ‘আল্লাহ তাআলা পুরুষ ও নারীকে চেনার জন্য পৃথক পৃথক আলামত দিয়ে দিয়েছেন৷ আল্লাহর সে নিদর্শনকে অবজ্ঞা করে যার যার ইচ্ছে মত চলার কোনো সুযোগ নেই৷ লিঙ্গ স্বাধীনতা বলতে ইসলামে এ ধরণের কোন কিছুর অবকাশ নেই৷ কেননা হাদীস শরীফে আল্লাহর সৃষ্টির পরিবর্তনকারীদের উপর অভিশাপ এসেছে৷ সহীহে মুসলিমে হযরত আবদুল্লাহ রাদি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, মানুষের শরীরে চিত্র অঙ্কনকারিণী ও চিত্র অঙ্কন প্রার্থিনী মহিলা, কপালে ভুরুর চুল উৎপাটনকারিণী ও উৎপাটন প্রার্থিনী এবং সৌন্দর্য সুষমা বাড়ানোর জন্যে দাঁতর মাঝে (সুদৃশ্য) ফাঁক সুষমা তৈরিকারিণী- যারা আল্লাহ্র সৃজনে বিকৃতি সাধানকারিণী- এদের আল্লাহ তা‘আলা অভিশাপ করেন (সহীহ মুসলিম: হাদীস নং: ২১২৫)। উক্ত হাদীসে যেসব বিষয়ে লানত এসেছে এগুলো ছোট পরিবর্তন মাত্র৷ লিঙ্গ স্বাধীনতা ও পরিবর্তন নামে যা করা হচ্ছে তা আরো বহুগুণে মারাত্মক৷ এগুলোতে আরো ভয়ানক অভিশাপ হবে৷ তাই এমন গর্হিত কাজ থেকে সকলকে বিরত থাকা চাই৷ এটা শুধু মাত্র শয়তানী কর্মকাণ্ড ও মুক্তমনা আচরণ ছাড়া আর কিছুই নয়৷ যারা শিক্ষা সিলেবাসে এসব প্রবেশ করিয়েছে তারা ইসলামারে বিরুদ্ধে কঠিন শড়যন্ত্রে লিপ্ত৷’
জামিয়া ইসলামিয়া দারুল উলুম মাদানিয়ার ফতোয়ায় বলা হয়েছে, ‘অপারেশন বা কোনো ঔষধ ব্যবহারের মাধ্যমে লিঙ্গ পরিবর্তন করা শরিয়তের বিধান ‘আল্লাহর সৃষ্টি পরিবর্তন’এর অন্তর্ভুক্ত। যা সম্পূর্ণ হারাম ও পরিত্যাজ্য। আর পুরুষ হয়েও নিজেকে নারী ভাবা বা নারী হয়ে নিজেকে পুরুষ ভাবা শরিয়তের দৃষ্টিতে নিষিদ্ধ কাজ। আল্লাহ ও তার রাসুল; এমন নারী-পুরুষের ওপর লানত করেছেন। তাই এসব কাজ এবং চিন্তা থেকে বিরত থাকা আবশ্যক।’
একই ফতোয়া দিয়েছে জামিয়া রাহমানিয়া আজিজিয়া, জামিয়া আবু বকর, দারুল উলুম মুঈনুল ইসলাম হাটহাজারি, জামিয়া আরাবিয়া হাজি সাইজুদ্দিন।
লিঙ্গ পরিবর্তনের তালিম দেয়া জায়েজ নেই
এ প্রসঙ্গে কথা হয় মারকাযুদ দাওয়াহ আল ইসলামিয়ার মুহাদ্দিস মাওলানা মুহাম্মদ ইয়াহইয়া সাহেবের সঙ্গে। ফাতেহকে তিনি বলেন, ‘লিঙ্গ পরিবর্তন হারাম। যারা আজকাল জেন্ডার স্বাধীনতার কথা বলে, বলে পুরুষ হয়েও নিজেকে নারী ভাবা যাবে, নারী হয়েও নিজেকে পুরুষ ভাবা যাবে, ইসলামে এর কোনো জায়গা নেই। এগুলো চিন্তার বিকৃতি। পশুত্বসুলভ আচরণ। কোনো সুস্থ মানুষ এসব করতে পারে না।’
একই কথা বলেছেন মারকাযুল ফিকরিল ইসলামী (ইসলামিক রিসার্চ সেন্টার) বাংলাদেশ-এর মুহতামিম মুফতি আরশাদ রহমানী। ফাতেহকে তিনি বলেন, ‘লিঙ্গ পরিবর্তন মানে আল্লাহর সৃষ্টিকে পরিবর্তন। এটা সরাসরি হারাম। কুরআনেই বলা হয়েছে। আধুনিক সময়ে জেন্ডার স্বাধীনতার নামে যেসব চিন্তা ছড়িয়েছে, সেসব বিকৃতি। ইসলামে এগুলোর কোনো জায়গা নেই।’
পাঠ্যপুস্তকে লিঙ্গপরিচয় বিকৃতি ইস্যুতে কথা বলার জন্য মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হয় ছারছীনা দারুস সুন্নাত কামিল মাদরাসার অধ্যক্ষ আলহাজ্ব ড. মাওলানা সৈয়দ মুহা: শরাফত আলীর সঙ্গে। তিনি ফাতেহকে বলেন, ‘লিঙ্গ পরিবর্তন হারাম। এটা কোনোভাবে শিথিল করা যাবে না। এটা সরাসরি আল্লাহর সৃষ্টিকে পরিবর্তন। যে জিনিস হারাম, সে জিনিসে অভ্যস্ত হওয়ার পাঠ তো আমরা শিক্ষার্থীদের দিতে পারি না। যারা চিন্তার বিকৃতি শেখায়, আল্লাহ তাদের হেদায়াত দান করুন।’
সোনাকান্দা দারুল হুদা মাদ্রাসার ফতোয়া বোর্ডের সহ-সভাপতি এবং সোনাকান্দা দরবার শরীফের খলিফা মাওলানা আবূ তাহের মুহাম্মাদ ছালেহ উদ্দিনের সঙ্গে কথা হয় প্রতিবেদকের। ফাতেহকে তিনি বলেন, ‘কোনোভাবেই কোনো সুরতেই লিঙ্গ পরিবর্তনকে জায়েজ করা যাবে না। এটা সরাসরি আল্লাহর সৃষ্টিতে বিকৃতি। নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম গায়ে একটা ট্যাটু আঁকতে নিষেধ করেছেন। আর আমরা জেন্ডার স্বাধীনতার কথা বলে লিঙ্গ পরিবর্তনের কথা বলি। এটা আমাদের অধঃপতন। শিক্ষা ব্যবস্থায় এটা ঢুকানো হয়েছে, এটা শিক্ষা ব্যবস্থারও অধঃপতন।
রাজধানীর নাজিরবাজার মাদরাসাতুল হাদীছের প্রিন্সিপাল আবূ আব্দুল্লাহ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ খান মাদানীর সঙ্গে কথা হয় প্রতিবেদকের। তিনিও একই কথা বলেছেন। তিনি ফাতেহকে বলেন, ‘লিঙ্গ পরিবর্তন হারাম। আর পুরুষ হয়েও নিজেকে নারী ভাবা বা নারী হয়ে নিজেকে পুরুষ ভাবাও হারাম। যারা পুরুষ হয়ে নারীর সাদৃশ্য অবলম্বন করবে, কিংবা নারী হয়ে পুরুষের সাদৃশ্য অবলম্বন করবে, তাদেরকে নবিজি লানত দিয়েছেন।’
উল্লেখ্য, আত্মপরিচয়ের অধীনে লিঙ্গ পরিবর্তন ও ট্রান্সজেন্ডার মতবাদকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করা হয়েছে নতুন কারিকুলামের বইগুলোতে। ট্র্যান্স হল এমন কেউ যার শারীরিক কোন ইস্যু নেই, কিন্তু সে মনে করে সে ভিন্ন লিঙ্গের মানুষ। অর্থাৎ কোনো পুরুষ মনে করলো সে নারী। এটা মানসনোক অসুস্থতা। যৌন বিকৃতি। বইতে এটাকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করা হয়েছে। ৭ম শ্রেণীর বইতে বলা হয়েছে, আত্মপরিচয় কত রকম হতে পারে? সেখানে বলা হয়েছে, নারী-পুরুষ ফিক্সড কোনো পরিচয় না। পুরুষাঙ্গ থাকলেও শরীফ যদি মনে করো সে শরীফা, তাহলে সে শরীফা-ই। এটাই আত্মপরিচয়। জৈবিক পরিচয়ে সামাজিক পরিচয়ে সে আবদ্ধ না, আত্মপরিচয়ই তার পরিচয়। পুরুষ হলেই পুরুষের মতোই জীবনযাপন করতে হবে, এমন না। সে যদি নিজেকে মেয়ে মনে করে তাহলে সে মেয়েই।
সব ঘরানার আলেমদের বক্তব্য হলো, পাঠ্যপুস্তকে লিঙ্গপরিচয়ের যে বিকৃতিকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করা হয়েছে, তা অত্যন্ত নিন্দনীয়। বইগুলোতে যেভাবে লিঙ্গ পরিচয় শেখানো হয়েছে, তাতে পরিচয় তো স্পষ্ট হবেই না, বরং পরিচয় নিয়ে আরও জটিলতা তৈরী হবে। সামাজিক জীবনে যেমন জটিলতা তৈরী হবে, তেমনি ধর্মীয় জীবনেও জটিলতা তৈরী হবে। শিশুদের আত্মপরিচয়কে এভাবে জটিলতার মুখে ফেলে দেয়া মানে তাদের ধ্বংস ডেকে আনা। তাই পাঠ্যপুস্তক থেকে বিকৃত লিঙ্গ পরিচয়ের পাঠ বাদ দেয়ার জোর দাবি জানিয়েছেন এসব আলেমরা।