পাপ

সাবের চৌধুরী:

গুনাহ বা পাপ নিয়ে কিছু লিখতে আমার অস্বস্তি হয়। নিজের ভেতরগত অবস্থা খুবই খারাপ, ফলে এ বিষয়ে কথা বলতে গেলে ভেতর থেকে শক্তি পাই না। বেশ লজ্জিত আর বিব্রতবোধ করি। তবু সাহস করে লিখতে বসলাম, কারণ, কথা বললে নিজের ভেতরে কিছুটা হলেও মানসিক চাপ তৈরী হয়। নিজের আমলহীনতার কারণে একটা অপরাধবোধ জাগে। এটা খুবই ভালো একটি দিক। আল্লাহ মাফ করুন। আমাদের আলোচ্য বিষয় ঠিক পাপ নয়; পাপের সাথে সংশ্লিষ্ট গুরুত্বপূর্ণ আরেকটি বিষয়—মুজাহারা। অর্থাৎ, প্রকাশ্যে পাপ করা বা পাপ করে তা প্রকাশ করা। বর্তমান সময়ে এ বিষয়টি আমাদের মাঝে মহামারীর মত ছড়িয়ে পড়েছে, সবখানে। লেখার উদ্দেশ্য— বিষয়টা যেন আমাদের সামনে পরিস্কার থাকে এবং সর্বত্র এর বিরুদ্ধে একটা প্রতিরোধ গড়ে উঠে।

পাপের ধারণাটি আসলে কী? আরবীতে সাধারণত তিনটি শব্দ দিয়ে একে ব্যক্ত করা হয়—ইসমুন, জানবুন, মা’সিয়াতুন। সবগুলোর মূলকথা একই—কথায়, কাজে, আচরণে বা যে কোনভাবে আল্লাহ তাআলার অবাধ্যতা করা। বাংলায় একে আমরা বলি পাপ বা গুনাহ। আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন, যেন সর্বদা আমরা তাঁর অনুগত হয়ে চলি। ছোট-বড় সকল ক্ষেত্রে তার আদেশে-নিষেধ, পছন্দ-অপছন্দ মান্য করে তার একান্ত বাধ্য হয়ে জীবন যাপন করি। আমরা যে বলি জীবনব্যাপী ইবাদত, তো, এর মর্ম আসলে এটিই। কুরআনুল কারীমের এক আয়াতে আল্লাহ তাআলা এই সর্বব্যাপী ইবাদতের কথাই বলেছেন—‘আমি সৃষ্টি করেছি জিন ও মানুষকে এজন্য যে, তারা আমারই ইবাদত করবে’(১)।

যদিও পাপ থেকে দূরে থাকার জন্য সকলকে আদেশ করা হয়েছে, তবু জগতের বাস্তবতা কী? নবীগণ ছাড়া আর কেউ কি পাপ থেকে পুরোপুরি বিরত থাকতে পেরেছে? পারেনি। কারণ, মানুষের ভেতরেই পাপ করার শক্তি দিয়ে দেওয়া হয়েছে। এর উপর-পেছনে রয়েছে আল্লাহ প্রদত্ত কল্পনাতীত শক্তি নিয়ে শয়তান ও তার বিশাল দলবল। এসব দিক চিন্তা করলে মানুষ বড় দুর্বল প্রাণী। মানুষের জাগতিক নানা সীমাবদ্ধতা যেমন রয়েছে, তেমনি পাপ থেকে দূরে থাকার ক্ষেত্রেও রয়েছে নানা নানা প্রতিকূলতা। এ কারণেই কুরআনুল কারীমে আল্লাহ তাআলা বলেছেন—‘মানুষকে সৃষ্টি করা হয়েছে দুর্বলরূপে’(২)। হাদীসে আছে—‘সকল মানুষই ভুলকারী’(৩)। ‘মুমিন মাত্রই ফিতনায় পতিত হয়’(৪)। ‍অতএব, পাপ মানুষ করবেই।

কিন্তু অপরদিকে পাপ থেকে দূরে থাকার জন্য মানুষকে নানা কৌশলও শিখিয়ে দেওয়া হয়েছে। দেওয়া হয়েছে বিপুল শক্তি ও লক্ষ্যভেদী অনেক অস্ত্র। মুহুর্তের মধ্যে পাপ ঝেড়ে পুতপবিত্র হয়ে নতুন করে জেগে উঠার জন্য দেওয়া হয়েছে তওবার অবাধ স্বাধীনতা। ছোট-বড়, শিরকি-কুফরী যাই করি না কেন, রাতে-দিনে যে কোন মুহুর্তে যে কোন বয়সে যে কোন অবস্থায় তওবার মাধ্যমে আমি পঙ্কিলতা থেকে শ্বেতশুভ্র হয়ে বেরিয়ে আসতে পারি। ‘মৃত্যুর সময়টি শুরু হওয়ার আগ পর্যন্ত আল্লাহ তাআলা বান্দার তওবা কবুল করবেন’(৫)। ‘তওবা কবুল করার জন্য তিনি দিনে রাতে বিশেষভাবে হাত বাড়িয়ে অপেক্ষা করেন’(৬)।

এই যে পাপের সাথে নিয়ত সংগ্রাম করে চলা, কখনো অক্ষম হয়ে পাপে লিপ্ত হয়ে যাওয়া, আবার তওবার মাধ্যমে আল্লাহর কাছে ফিরে ফিরে আসা—এটা মূলত চির অমলিন এক প্রেমের ধারা। বান্দা পাপ করে, ভেতরে অপরাধবোধ জাগ্রত হয়, অনুতপ্ততা আসে, আর চোখে করুণার অশ্রু নিয়ে প্রতিদিন সে আরো বেশি করে আল্লাহর মুখাপেক্ষী হয়—এ জিনিস আল্লাহ তাআলার খুবই ভালো লাগে। ফলে তিনি তাকে আরো বেশি করে ভালোবাসতে থাকেন। কেমন ভালো লাগে এটা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অদ্ভূতরকম সুন্দর এক গল্পে তুলে ধরেছেন। তিনি বলেছেন, ‘বান্দা তওবা করলে আল্লাহ কীরকম খুশি হন জানো? মনে করো এক লোক মরুভূমিতে গিয়ে তার উটটি হারিয়ে ফেলেছে। সাথে হারিয়েছে তার খাবার, পানি। একসময় সে হতাশ হয়ে একটি গাছের ছায়ায় ঘুমিয়ে পড়লো। সে ধরেই নিয়েছে তার আর বাঁচার কোন উপায় নেই। কিছুক্ষণ পর হঠাৎ দেখে উটটি তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। এটা দেখে আনন্দে সে দিশা হারিয়ে ফেললো আর বলতে লাগলো— হে আল্লাহ আমি আপনার প্রভু, আর আপনি আমার বান্দা’(৭)। পাপের রহস্য মূলত এখানেই। পাপের পিঠে তওবা আসে। তওবা হলো একটি সিঁড়ি। এ সিঁড়ি বেয়ে বান্দা আল্লাহর আরো কাছে গিয়ে উপনীত হয়। এ জন্যই হাদীসে বলা হয়েছে, ‘মুমিন মাত্রই ফিতনার শিকার হয়, কিন্তু সে তওবা করে। যখনই তাকে স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়, তখনই সে বিস্মৃতি ঝেড়ে সঠিক পথে ফিরে আসে’(৪)। অন্য হাদীসে আছে, ‘উত্তম ভুলকারী হলো যারা তওবা করে’(৩)। কুরআনুল কারীমে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘এবং যারা কোন অশ্লীল কাজ করে ফেললে অথবা নিজেদের প্রতি জুলুম করলে আল্লাহকে স্মরণ করে এবং নিজেদের পাপের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা কর। আল্লাহ ব্যতিত কে পাপ ক্ষমা করবে? এবং তারা যা করে ফেলে জেনে-শুনে তার পুনরাবৃত্তি করে না’(৮)।

এখানে কারো মনে হতে পারে—গুনাহ করা তাহলে বৈধ একটি কাজ? মানে গুনাহ আর তওবা দুটো করতে থাকলে আর কোন সমস্যা নেই? তাহলে তো ব্যাপারটা অনেক সহজ হয়ে এলো। আমরা সবকিছু করতে পারবো, শেষে শুধু তওবা করে নিলেই হলো। না। এটা একটা ভুল চিন্তা। এরকম করলে আল্লাহর সাথে মূলত তওবার নাম ধরে উপহাসই করা হবে। গুনাহ তো কোন বৈধ কাজ নয়। একে ঘৃণা করতে হবে এবং মনেপ্রাণে এ থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করতে হবে। কিন্তু গুনাহ হয়ে যাবে স্বাভাবিক। ফলে আপনাকে তওবা করতে হবে। আর তওবা মানে হলো— যা করেছেন তার ব্যাপারে আন্তরিকভাবে অনুতপ্ত হওয়া, গুনাহর কাজটি পরিত্যাগ করা এবং সামনে আর করবেন না এরকম দৃঢ় প্রতিজ্ঞা করা, এরপর আল্লাহ তাআলার কাছে বিনীতভাবে ক্ষমা চাওয়া। এভাবে তওবা করলেই কেবল আপনার তওবা কবুল হবে। অন্যথায় তওবাই তো হবে না। তো, এই যে বিনীত ও অনুতপ্ত হওয়া এবং সামনে আর না করার দৃঢ় প্রতিজ্ঞা করা—এটা করলে পেছনের সে চিন্তাটি আসার কোন পথ থাকবে না।

ইসলামের সঠিক কথাটি জানা না থাকার কারণে বা গাফিলতির কারণে আমাদের মধ্যে অনেক সময় অনেক ভুল দর্শন গড়ে উঠে। এরকম একটি দর্শন হলো—‘যুবক বয়স, এখন তো একটু আধটু এরকম করবেই। এসব কিছু না। বয়স হলে সব ঠিক হয়ে যাবে।’ দেখুন, যুবক বয়সে পাপ ও অপরাধের তাড়না বেশি থাকে, সত্য। এ কারণে তার থেকে পাপও বেশি হয়ে যেতে পারে। কিন্তু, একে একটা দর্শন হিসেবে গ্রহণ করে তার পাপকে সহজ ও সহনীয় করে কিছুটা বৈধতামত দেওয়ার চেষ্টা করা খুবই ভুল কাজ। ইসলাম এ দর্শনকে সমর্থন করে না। ইসলামের দর্শন হলো—যুবক বয়সে আরো বেশি করে পূণ্য করতে হবে। যুবক বয়সের আমল আল্লাহ তাআলার কাছে সবচে বেশি পছন্দনীয়। এ কারণে ‘আরশের ছায়ায় যারা স্থান পাবে তাদের একজন হলো- সেই যুবক যে ইবাদতের ভেতর দিয়ে বেড়ে উঠেছে’(৯)। ‘বার্ধক্য আসার আগেই যৌবনকালকে গণিমত হিসেবে গ্রহণ করার জন্য রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিশেষভাবে তাগিদ করেছেন’(১০)। আরেক হাদীসে আছে—‘কেয়ামতের দিন পাঁচটি প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার আগ পর্যন্ত কোন বান্দা তার পা সরাতে পারবে না। এর মধ্যে একটি হলো—সে তার যৌবনকাল কোথায় খরচ করেছে?’(১১)। এবং আপনি ইসলামের ইতিহাসের দিকে তাকিয়ে দেখুন, মুসলিম যুবকরা কীভাবে গড়ে ‍তুলেছে বিস্ময়কর গৌরবের ইতিহাস। এ জন্য এই ভুল দর্শন থেকে আমাদেরকে অবশ্যই বেরিয়ে আসতে হবে।

এখন প্রশ্ন হলো—তওবার মাধ্যমে কে কতটুকু এগুতে পারে? এটা নির্ভর করে আপনার তওবার গুনগত মানটি কেমন তার উপর। আপনি যদি সবসময় আমলের মধ্যে থাকেন, শরীয়তের গণ্ডির ভেতর চলার চেষ্টা করে যান, তখন আপনার ঈমান গভীর হতে থাকবে। আল্লাহর ভয় এবং তাঁর পরিচয় আপনার সামনে উন্মোচিত হতে থাকবে এবং নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ভালোবাসা আপনার অন্তরে বদ্ধমূল হতে থাকবে। এভাবে আপনি একজন নেককার মানুষে পরিণত হবেন। এবং ছোট ছোট গুনাহও আপনার কাছে পাহাড়সম বড় হয়ে দেখা দেবে। ফলে সামান্য গুনাহ হওয়া মাত্রই আপনি তওবার দিকে মনোযোগী হবেন। সে সময় আপনার তওবার ওজন হবে অনেক বেশি। এ তওবা আপনাকে অনেক দূর এগিয়ে নেবে। এর বিপরীতে, আপনি যদি গাফিলতির মধ্যে থাকেন, একের পর এক গুনাহের কাজে লেগে থাকেন, তাহলে আপনার হৃদয় মরে যেতে থাকবে। ফলে তওবার কথা আপনার মনে থাকবে না। কালেভদ্রে করলেও সে তওবায় প্রাণ থাকবে না। বড় বড় গুনাহও আপনার কাছে ছোট হয়ে দেখা দেবে। এক হাদীসে আছে—‘বান্দা যখন গুনাহ করে তখন তার হৃদয়ে ছোট একটা কালো দাগ পড়ে। এরপর যদি সে তওবা করে তাহলে তার হৃদয়টি চকচকে হয়ে যায়। কিন্তু যদি পাপ করতে থাকে তাহলে একসময় এটি কুচকুচে কালো হয়ে যায়’(১২)।

আরেক হাদীসে আছে—‘ছোট ছোট গুনাহগুলোর ব্যাপারে তোমরা সতর্ক থেকো। কারণ, এগুলো এমন, ধরো, একদল লোক কোন এক উপত্যকায় গিয়ে উপনীত হলো। এরপর এ আনে একটি কাঠ, সে আনে আরেকটি। এভাবে তারা অনেকগুলো লাকড়ি জমা করে সেগুলো দিয়ে নিজেদের রুটি পাক করে ফেলে। শোনো, ছোট ছোট গুনাহগুলোর ব্যাপারে যখন কাউকে ধরা হবে, তখন এগুলো তাকে ধ্বংস করে ছাড়বে’(১৩)। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাদি. বলেন, ‘মুমিন ব্যক্তি তার পাপগুলোকে অনেক বড় করে দেখে। তার কাছে মনে হয় সে যেন একটা পাহাড়ের নীচে বসে আছে, আর পাহাড়টি তার উপর পতিত হওয়ার জন্য উদ্যত হয়ে আছে। আর পাপিষ্ট ব্যক্তি নিজের গুনাহগুলোকে মাছির মত হালকা ও সাধারণ কিছু মনে করে, যে মাছিটি তার নাকের উপর দিয়ে উড়ে যায় আর সে হাত দিয়ে তাড়াতে চেষ্টা করে’(১৪)। এ জন্য কেউ যখন আমল থেকে দূরে চলে যায় এবং ধারাবাহিকভাবে পাপের সাথে লেগে থাকে তখন তার ভেতরে পাপ ও অপরাধবোধ কমে আসে। এই যে গুনাহকে ছোট মনে করা এবং উদাসীন থাকা এবং ভেতরে পাপবোধ জাগ্রত না হওয়া এটা অত্যন্ত বিপদজনক একটি অবস্থা। এটা মানুষকে ধ্বংস করে দেয়। আপনি ধীরে ধীরে আল্লাহ তাআলা থেকে দূরে যেতে যেতে একসময় পাপের পথে হারিয়ে যাবেন। এরকম করে হারিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক হাদীসে সতর্ক করে বলেছেন—যে সর্বদা নিজের আখেরাত নিয়ে ব্যস্ত তাকে, আল্লাহ তাআলা তার দুনিয়ার ব্যস্ততার দায়িত্ব গ্রহণ করেন, আর যদি দুনিয়ার বিষয়াশয় নিয়ে সে বিক্ষিপ্ত হয়ে পড়ে, তাহলে এর কোন উপত্যকায় গিয়ে সে ধ্বংস হলো আল্লাহ তার পরোওয়া করেন না(*)

এতক্ষণ আলোচনার দ্বারা আমার উদ্দেশ্য শুধু এটা দেখানো যে, শরীয়ত পাপকে কোন দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনা করে এবং একজন পাপীর মনোভাব ও আচরণ কী রকম হওয়া উচিত। এসব কথা আলোচনায় এসেছে আসল বিষয়টির গুরুত্ব অনুধাবন করার জন্য। যে বিষয়টি বলতে চাচ্ছি, তা হলো— পাপ মানে তো আল্লাহ তাআলার অবাধ্যতা ও তাঁর বিরুদ্ধাচরণ। তবু তিনি তওবার দরজা খোলা রেখেছেন। কিন্তু আল্লাহ তাআলা চান না পাপ ও অশ্লীলতার বিষয়গুলো সমাজে ছড়িয়ে পড়ুক। মানুষের কাজে ও চিন্তায় এগুলোর চর্চা হোক। এজন্য কুরআনুল কারীমে বলা হয়েছে— মন্দ কথার প্রচারণা আল্লাহ পছন্দ করেন না; তবে যার উপর জুলুম করা হয়েছে সে ব্যতিত(১৫)। এক হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম স্পষ্ট করে নির্দেশ দিয়েছেন—‘শোন, তোমরা এই সমস্ত অশ্লীল কাজ থেকে বেঁচে থেকো। ঘটনাচক্রে কেউ কিছু করে ফেললেও এর কথাটি গোপন রেখে তওবা করে নিও। নিজে থেকে আমাদের কাছে বলতে এসো না। কারণ, বলে দিলে তো আমরা কুরআনুল কারীমের বিধান তার উপর কার্যকর করবো’(১৬)।

এমনকি, অশ্লীলতা ছড়িয়ে দেওয়া তো দূরের কথা, কেউ যদি শুধু এসব ছড়িয়ে পড়ার কথা কামনা করে তাহলেই তাকে কঠিন শাস্তির মুখোমুখি হতে হবে। আল্লাহ তাআলা বলেন, যারা মুমিনদের মধ্যে অশ্লীলতার প্রসার কামনা করে তাদের জন্য রয়েছে দুনিয়া ও আখেরাতে মর্মন্তুদ শাস্তি(১৭)। অবস্থা যখন এই তখন কেউ যদি পাপ করার পর সে পাপের কথা লোকজনের কাছে আনন্দের সাথে বলে বেড়ায় তাহলে তার বিষয়টি কেমন হতে পারে? সে তো আল্লাহ তাআলার সাথে মূলত উপহাসে লিপ্ত। এর মাধ্যমে সে বরং আল্লাহর বিরুদ্ধে অনেকটা বিদ্রোহ করে বসে। ভাবটা এমন—পাপ, তার আবার তওবা! এই যে, আমি তো এ পাপকে উদযাপন করছি! সমস্যা কী? পাপের চেয়ে এ আচরণ আরো বেশি ভয়ংকর। তাদের ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সতর্কবাণী উচ্চারণ করে বলেছেন—‘আমার সকল উম্মত ক্ষমা পাবে, কিন্তু প্রকাশ্যে পাপকারী বা পাপ করে প্রকাশকারী ক্ষমা পাবে না। তিনি এর একটা উদাহরণও দিয়েছেন এভাবে—ধরো, রাতের আঁধারে কেউ গুনাহর কাজ করলা। কিন্তু আল্লাহ তাআলা তার সে পাপের কথাটি মানুষজন থেকে গোপনে রাখলেন। কিন্তু সকাল হওয়ার পর সে অমুক তমুককে ডেকে বলে, এই যে আমি, রাতের বেলা এ পাপটি করেছি। সকাল হওয়ার পর সে আল্লাহ তাআলার পর্দাকে এভাবে সবার সামনে উন্মোচিত করে ফেলে’(১৮)। আরেক হাদীসে আছে—‘কোন উম্মতের মাঝে যখন অশ্লীলতা ছড়িয়ে পড়ে, এবং এক পর্যায়ে তারা প্রকাশ্যে তা করতে থাকে, তখন অবশ্যই তাদের মধ্যে এমন মহামারী আর রোগ বালাই ছড়িয়ে পড়বে যা পূর্ববর্তী কোন উম্মতের মধ্যে দেখা দেয় নি’(১৯)।

এই যে পাপ প্রকাশকারীর ব্যাপারে এতো কঠোরতা, এটা কিন্তু এমনিতেই নয়; এর পেছনে যথেষ্ট কারণ রয়েছে। কারণ, এর মধ্য দিয়ে একদিকে যেমন আমি পাপ গোপন রাখার নির্দেশকে অমান্য করলাম, অপরদিকে এর মাধ্যমে আমি মূলত আরো অনেকগুলো অপরাধের সাথে জড়িয়ে পড়লাম। পাপ প্রকাশ করলে কী হয়? আমি যখন একটা উদযাপন ও উল্লাসের ভেতর দিয়ে একে প্রকাশ করালাম, তখন আমি মূলত আল্লাহ তাআলার সাথে বিদ্রোহে লিপ্ত হলাম। এর আরেকটা বিশেষ ক্ষতি হলো—একটা জিনিস যখন আমাদের সামনে বেশি বেশি ঘটতে থাকে, তখন এটা আমাদের চোখে সয়ে আসে। অনেককটা স্বাভাবিক হয়ে এর জঘন্যতা ও কদরর্যতার তীব্রতাটি হ্রাস পেয়ে যায়। ফলে পাপটি সমাজে এক ধরণের প্রতিষ্ঠা পায়। অন্যরা তাতে সহজে জড়িয়ে পড়ে। তাছাড়া এর মাধ্যমে অন্যকে সে কাজের দিকে ডাকা হয়। উৎসাহিত করা হয়। ‘আর যে ভ্রষ্টতার দিকে আহ্বান করে, তার আহ্বানে সাড়া দিয়ে কেউ এ কাজে জড়ালে, সে ব্যক্তির সমপরিমাণ গুনাহ আহ্বানকারীর ভাগেও আসে’(২০)। এমনিভাবে হাদীসে আছে, ‘কেউ মারা যাবার পর তার প্রতিবেশি থেকে চারজন লোক যদি তাকে ভালো বলে সাক্ষ্য দেয়, তাহলে আল্লাহ তাআলা তাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন’(২১)। কেউ যদি নিজের গুনাহের কথা প্রকাশ করতে থাকে, তাহলে তো প্রতিবেশীদের জন্য ভালো বলে সাক্ষ্য দেওয়ার কোন উপায় থাকবে না। তাছাড়া, আরেকটি বিষয় হলো—‘কেয়ামতের দিন আল্লাহ তাআলা বান্দার সাথে একান্তে আলাপ করবেন। বলবেন, বান্দা, তুই এমন এমন গোনাহ করে ফেলেছিলি? বান্দা লাজ্জিত হয়ে স্বীকার করবে, জি, আল্লাহ, আমি এগুলো করেছি। আল্লাহ বলবেন, যা, দুনিয়াতে এগুলো আমি মানুষ থেকে গোপন রেখেছিলাম, আজও ধরলাম না—মাফ করে দিলাম’(২২)। এখন, আল্লাহ যা গোপন রাখছেন, তা যদি আমি নিজেই ফাঁস করে দিই, তাহলে সেদিনকার সে বিশেষ সুযোগটি কি আমি মূলত হাতছাড়া করছি না? পাপ করলে এমনিতেই লজ্জাশীলতা কমতে থাকে। আর যে তা আনন্দ ও মুগ্ধতার সাথে অন্যকে বলে বেড়ায় তার থেকে এ জিনিস ধুয়ে-মুছে সাফ হয়ে যাবে। ফলে একসময় সে চরম নির্লজ্জ হয়ে পড়বে। আমাদের চারপাশে এমন মানুষের উদাহরণ তো কম নয়। অথচ লজ্জাশীলতা হলো একজন মুমিনের একান্ত সম্পদ। ‘ঈমানের বিশেষ একটি শাখা’(২৩)। ‘এই লজ্জাশীলতা সর্বদা কল্যাণকেই ডেকে আনে’(২৪)। এরকম একটি সম্পদ হাতছাড়া হয়ে যাওয়া তো খুবই দুর্ভাগ্যজনক।

মুজাহারা বা পাপপ্রকাশের এ বিষয়টি এতো ভয়াবহ ও বিপদজনক, অথচ আমরা সামান্য আনন্দের জন্য এ কাজটি অবলীলায় করে যাচ্ছি। এটা খুবই নির্বুদ্ধিতা। বর্তমান সময়ে ব্যাংক-বীমা ও সুদযুক্ত নানা লেনদেনের বিজ্ঞাপন প্রচারিত হচ্ছে নানাভাবে, রাস্তায় রাস্তায় মুসলিম রমণীরা পর্দাহীন হয়ে হাশিখুশি ঘুরাফেরা করছেন, নানা রকম অবৈধ জিনিস প্রকাশ্যে বেচাকেনা হচ্ছে, রাস্তার মোড়ে মোড়ে, দোকানে দোকানে অশ্লীল গান-বাজনা, অবৈধ খেলাধুলা, হরেক আয়োজনের আসর বসছে, গায়িকা ও নর্তকী ভাড়া করে এনে ঝলমলে স্টেজ সাজিয়ে মানুষ উন্মত্ত হচ্ছে, আমাদের তরুণরা কাফের-মুশরিক-ফাসেক লোকদের অনুকরণে চুল কাটছে, জামা পড়ছে, পত্র-পত্রিকায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোতে অবৈধ গল্প-কবিতা-প্রবন্ধ-নিবন্ধ-অনুভূতি লিখছে—এ সব কিছু মুজাহারার অন্তর্ভুক্ত। কিন্তু হতাশার কথা হলো—এটা যে মুজাহারা এবং খুবই নিকৃষ্ট একটি কাজ, এই অপরাধবোধও অনেকের ভেতর জাগছে না। বিশেষ করে এই সময়ে এসে ফেসবুকে এই বিষয়টি বাড়াবাড়ি রকমের ছড়িয়ে পড়ছে। কেউ হয়তো কোন গান শুনছে, কোন মুভি বা নাটক দেখছে, একটুপর ফেসবুকে এসে নিজের এই অপকর্মের কথা হাজার হাজার মানুষকে জানিয়ে দিচ্ছে। নিজের অবৈধ সম্পর্ক, খেলাধুলা সংক্রান্ত তথ্য-অনুভূতি ইত্যাদি অসীম মুগ্ধতা নিয়ে সবার সাথে শেয়ার করছে। স্টেডিয়ামে বসে সেলফি দেয়। প্রোফাইলে মেসি নেইমারের ছবি ঝোলায়। কমেন্টে-রিপ্লাইয়ে নিজের বিভিন্ন অপকর্মের কথা একধরণের ভাবলেশহীনভাবে প্রকাশ করে।

কারো কারো ভাবটা এমন—হ্যাঁ, করিই তো, কী হয়েছে? যা করি তা প্রকাশ্যেই করি। আরেহ্, দেখেছি। বহুত লম্বা বুযুর্গ, উপরে ভালো মানুষ সেজে বসে আছেন; কিন্তু তলে তলে সব চলে। ছ্যাহ, আমার মাঝে এইরকমের মুনাফিকি নাই। তো, এই অভিযোগের জবাবে আমি কী বলবো? পাপ করে সেটা গোপন রাখাকে যদি মুনাফিকি বলেন, তাহলে এ মুনাফিকিটুকু আপনাকে করতে হবে। এটাই নিয়ম। পেছনে তো এতক্ষণ এই গীতই গাইলাম। এর বাইরে আর কিছু বলার নেই মূলত।

শেষ একটি কথা বলে আমি আলোচনার ইতি টানছি। কথাটি হলো— কেউ যখন মুজাহারায় লিপ্ত হয় তখন কেউ কেউ নেক নিয়তে তাকে বোঝাতে যান। কিন্তু এ কাজ করতে গিয়ে তিনি অনেক সময় বুদ্ধিকে কাজে লাগান না। হয়তো তার ভাষাটি একটু রূঢ় হয়ে যায় বা কেমন বেমক্কা হয়ে যায়। তো, এটা ঠিক না। আল্লাহ তাআলা বলে দিয়েছেন—তুমি তোমার রবের পথে আহ্বান করো বুদ্ধির সাথে, উত্তম কথার দ্বারা।
কিন্তু আমি হতাশ হই এর জবাবে পাপকারী ব্যক্তিটির প্রতিক্রিয়া দেখে। অনেক সময় তো মুখের উপর বলে দেন—দেখেন ভাই, আমি অতো পাক্কা মুমিন-মুসলমান নই। দয়া করে আপনি আমার পিছে পড়বেন না। কথাটা তিনি হয়তো এক ধরণের অভিমান থেকে বলেন, তবু এটা অত্যন্ত অসঙ্গত একটি মনোভাব। একজন মুমিন থেকে এ ধরণের কথা ও মনোভাবের প্রকাশ অনাকাঙ্ক্ষিত। মুমিন তো এমন, ঘটনা যাই হোক, পাপের পক্ষে সে কোন যুক্তি দেখাতে পারে না। হাদীসে তো আছে, ‘যখনই তাকে স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়, বিস্মৃতি ঝেড়ে সাথে সাথে সে সঠিক পথে ফিরে আসে’(৪)। এ পৃথিবীতে মানুষের জন্য এখন খুবই খারাপ একটা সময় যাচ্ছে। আমাদের চারপাশে নানারকমের স্রোত তৈরী হয়েছে। ইচ্ছায়-অনিচ্ছায় আমরা অনেকে অনেক চোরা স্রোতে ভেসে যাচ্ছি। আমাদের উচিত, একটুখানি মাথা উঁচিয়ে দেখা আমি কোথাও ভেসে যাচ্ছি কিনা এবং আসলে ঠিক কোথায় যাচ্ছি।

সূত্র:

০১. জারিয়াত-৫৬
০২. নিসা-২৮
০৩. সুনানে তিরমিজি, সুনানে ইবনে মাজাহ।
০৪. সিলসিলা সহীহাহ এর সূত্রে তাবারানী
০৫. তিরমিজি, ইবনে মাজাহ
০৬. সহীহ মুসলিম।
০৭. সহীহ বুখারী, মুসলিম, তাবারানী।
০৮. আলে ইমরান-১৩৫
০৯. সহীহ বুখারী ও মুসলিম
১০. হাকিমকৃত মুস্তাদরাক ও বাইহাকিকৃত শুআবুল ঈমান
১১. তিরমিজি।
১২. সুনানে তিরমিজি, মুসনাদে আহমদ।
১৩. মুসনাদে আহমদ।
১৪. সহীহ বুখারী।
* ইবনে মাজাহ
১৫. নিসা—১৪৮
১৬. মুস্তাদরাকে হাকেম।
১৭. নূর-১৯
১৮. সহীহ বুখারী ও মুসলিম।
১৯. ইবনে মাজাহ।
২০. সহীহ মুসলিম।
২১. সহীহ বুখারী।
২২. সহীহ বুখারী
২৩. সহীহ বুখারী ও মুসলিম
২৪. সহীহ বুখারী ও মুসলিম

বি. দ্র. রচনাটিতে কুরআনুল কারীমের আয়াতের পাশাপাশি বেশকিছু হাদীস উল্লেখ করা হয়েছে। এগুলোর তরজমা করতে গিয়ে কোথাও কোথাও বিশেষ সুবিধার কথা বিবেচনা করে ভাবানুবাদের আশ্রয় নেওয়া হয়েছে।

 

 

আগের সংবাদশিল্প ও সুফ সুফি তাসাউফ
পরবর্তি সংবাদমুসলিম সভ্যতায় ঈদ উৎসব