পিতামাতার আনুগত্য : ধর্ম বনাম প্রচলিত সামাজিক সংস্কৃতি

আহসান জাইফ:

`গুনাহ ও অপরাধ না হলে পিতামাতার আনুগত্য করা আবশ্যক, যদিও তারা ফাসেক হয়। আনুগত্য হবে সেক্ষেত্রে, যেখানে তাদের ও সন্তানের উপকার রয়েছে এবং সেই আনুগত্যের দ্বারা সন্তান প্রকৃতভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হবে না।’

 শায়খুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া

মুসলমান মাত্রই বিশ্বাস করেন যে, আল্লাহর বিধান কখনোই ফাসাদ তৈরি করে না। যদি ফাসাদ তৈরি করে, তাহলে ধরে নিতে হবে অবশ্যই সেই বিধান ও নৈতিকতার বুঝাবুঝিতে সমস্যা রয়েছে অথবা উক্ত বিধানের প্রয়োগ গলদভাবে হচ্ছে। এখানে আমরা শরিয়ার যে বিধান নিয়ে আলোচনা করব, তা হচ্ছে পিতামাতার আনুগত্য ও তাদের সাথে সদ্ভাব বজায় রাখার নিয়মকানুন—কিছুক্ষেত্রে এই অতি গুরুত্বপূর্ণ বিধানের অপপ্রয়োগ ও গলদ বুঝাবুঝি।

বাবা-মায়ের আনুগত্য ঈমানের এমন একটি শাখা, যা শরিয়ার শীর্ষ ও অতি গুরুত্বপূর্ণ বিধানের একটি। কুরআন ও সুন্নাহর অসংখ্য জায়গায় এই মহান দায়িত্ব ও বিধানের কথা উল্লেখ আছে। একজন মুসলমান মাত্রই এই নৈতিক দায়িত্বকে সম্মান ও পালন করতে বাধ্য। এ এক এমন বিধান, যা শরীয়ার মৌলিক জরুরী নৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির সাথে যুক্ত; এর প্রতি অবহেলা ও অবাধ্যতার ব্যাপারে আল্লাহ তায়ালা কঠোর শাস্তিরও ধমকি দিয়েছেন। এমনকি বাবা-মা যদি কাফিরও হন, তাহলেও তারা সম্মান ও সদ্ভাব পাওয়ার উপযুক্ত— সন্তানের জন্য তাদের হক আদায় করা ও  বৈধ বিষয়ে তাদের আনুগত্য করা ওয়াজিব।

আল্লাহ তায়ালা বলেন,  وإن جاهداك على أن تُشرك بي ما ليس لك به علم فلا تُطعهما وصاحبهما في الدنيا معروفًا”

‘তারা (বাবা-মা) যদি তোমাকে শিরক করতে বাধ্য করে, যে বিষয়ে তাদের জ্ঞান নেই, তাহলে তাদের সে বিষয়ে আনুগত্য করো না। কিন্তু দুনিয়ায় তাদের সাথে উত্তম আচরণ করো‘

আল্লাহ তায়ালা বাবা-মায়ের আনুগত্য ও তাদের সাথে সদ্ভাব করার আদেশ দিয়েছেন তাদের অধিকার, সম্মান, জাগতিক কল্যান ও সামাজিক উপকারিতার দিকে লক্ষ্য রেখে। তবে আমরা যদি দেখি বাবা-মায়ের প্রতি আনুগত্য অন্য কারো অধিকারকে বিনষ্ট করছে, জীবনকে ক্ষতিগ্রস্থ করছে ও সমাজে ফাসাদ তৈরি করছে, তাহলে বুঝতে হবে এই বিধানকে আমরা যথাযথভাবে বুঝতে পারিনি—আমরা একে সঠিক ও সুন্দরভাবে প্রয়োগ করতে পারছি না।

বাবা-মায়ের আনুগত্য ও তাদের প্রতি সদ্ভাব কোন নিয়মকানুন ছাড়া নিরংকুশভাবে আবশ্যক করা হয়নি; নিয়মকানুন বলতে কেবলই গুনাহের কাজে আনুগত্য করা যাবে না এতটুকুতেই সীমিত নয়, যেমনটা অনেকেই মনে করেন।  আনুগত্য করার অর্থ এই নয় যে, সন্তান প্রকৃত অর্থে ক্ষতির মুখোমুখি হলে বা আনুগত্যে কষ্টের সঞ্চার হলেও সবকিছু মেনে নিতে হবে । এমনকি যদিও বাবা-মা কোন বিষয়ে নিতান্ত খামখেয়ালিভাবে বা স্বেচ্ছাচারিতার আদেশ দেয় অথবা এমন কিছু করতে আদেশ  করে, যা একজন সুবিবেচক লোকের কাজ হতে পারে না কিংবা দ্বীনদারিতা-সততার বিপরীত কিছুর নির্দেশ— এসবে আনুগত্য নয়। আনুগত্য আবশ্যক করার পেছনে এসকল ফাসাদ কখনোই ইসলামের মাকসাদ নয়।

এ বিষয়ে বিস্তারিত আলাপে যাবার আগে কিছু বিষয় আমাদের মাথায় রাখা জরুরি। কোন সমস্যার এক দিক নিয়ে আলাপ-আলোচনার মানে অন্যদিককে খাটো করা নয়। যেমন আমরা এখানে বাবা-মায়ের আনুগত্যের  সীমা, পরিসীমা ও অপপ্রয়োগ নিয়ে আলোচনা করছি—তার মানে এই নয় যে আমরা সমাজে বিস্তরভাবে সংঘটিত বাবা-মায়ের হক নষ্ট করা, তাদের প্রতি দুর্ব্যবহার ও অমানবিক আচরণ—তাদের সাথে ব্যবহারের অন্য প্রান্তিকতাকে অস্বীকার করছি বা খাটো করে দেখছি। আমাদের সমাজে এগুলো নিয়ে যেমন আলোচনা ও সচেতনতা তৈরির কাজ হচ্ছে, আমরাও এখানে তেমনি এর ঠিক বিপরীত দিক নিয়ে আলোচনা করার চেষ্টা করছি। পাশাপাশি বাবা-মায়ের আনুগত্য ও অধিকার প্রয়োগের ক্ষেত্রে যে কোন ধরনের প্রান্তিকতার দায় কেবল বাবা-মায়ের ওপরেই বর্তাবে না, সন্তানকেও দায় নিতে হবে।  কেননা কর্মের ভার বর্তায় কর্তা ও গ্রহীতা উভয়ের ওপরেই। তাই আমাদের সকলকেই এক্ষেত্রে সতর্ক হতে হবে ও সচেতন ভূমিকা পালন করতে হবে।

বাবা-মায়ের আনুগত্যের সঠিক বোঝাপড়া ও প্রায়োগিকতাকে আমরা এভাবে সাজাতে পারি।

এক.

শরিয়া বাবা-মায়ের আনুগত্য আবশ্যক করার সাথে সাথে এও বলে দিয়েছে, সেই বাবা-মা যদি মুমিন হয়, তাহলে তারা যেন আল্লাহর বিধানকেও একইভাবে সম্মান করে । ফলে তারা কোন গুনাহের আদেশ দেবে না। ঠিক তেমনিভাবে আদেশের ক্ষেত্রে সন্তানের ক্ষতি ও উপকারের দিকে সঠিকভাবে খেয়াল রাখবে ও স্বেচ্ছাচারিতা করবে না। অধিকারের ক্ষেত্রে স্বেচ্ছাচারিতা হলো, বৈধ অধিকারকে অবৈধ ক্ষেত্রে ব্যবহার করা। যেমন সন্তানকে গুনাহের কাজে আদেশ করা, অথবা কল্যান ও মাসলাহাতের চাহিদার বিপরীত কিছু আদেশ করা ।

আমাদের সমাজে দেখা যায় অনেক ক্ষেত্রে বাবা-মায়ের আদেশ রক্ষা করতে গিয়ে অন্যের অধিকার বিনষ্ট করা হয়। যেমন অনেক সময় মায়ের আদেশে স্ত্রীকে প্রহার ও অন্যায়ভাবে শাসন করা হয়, যা রীতিমত জুলুম ও হক বিনষ্ট করার মতো হারাম কাজ। অথচ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, অন্যায় কাজে কোন আনুগত্য নেই, আনুগত্য তো কেবল ভালো কাজে। কিছুক্ষেত্রে শুনেছি যে, মা নাকি সন্তানকে জুতো এগিয়ে দিচ্ছে স্ত্রীকে প্রহার করার জন্য আর সন্তান তার কথামতো স্ত্রীকে জুতো দিয়ে প্রহার করেছে। এটা রীতিমত জাহেলি জুলুম ও কবীরা গুনাহ। এ ধরনের কাজ ইসলামি সমাজে নৈতিকভাবে ও আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ।

আমি একবার জনৈক নিকটাত্মীয়ের কাছে শুনেছিলাম—আল্লাহ তাকে ক্ষমা করুন ; তিনি মোটামুটি দ্বীনদ্বার নামাজি ও দ্বীনি তৎপরতার সাথে যুক্ত—তিনি বলছিলেন, যদি আমার স্ত্রীর সাথে আমার বাবা-মা এ ধরনের অন্যায় আচরণ করে, তাহলে বিনিময়ে আমি তার প্রতি সন্তুষ্ট হয়ে যাব। আশ্চর্য—আল্লাহর বান্দা একে তো জুলুমের সমর্থন ও সহযোগিতা করছে এবং হক বিনষ্ট করছে, উপরন্তু এমন বিষয়ে রাজী হওয়ার কথা বলছে, যে বিষয়ে রাজী বা অরাজি হওয়াতে কোন কিছু যায় আসে না। বরং রাজি ও সন্তুষ্টি তো সেখানে, যেখানে তার অধিকার রয়েছে। অপরকে জুলুম করার সুযোগ দানের মাঝে তো কোনরুপ অধিকার বা নূন্যতম বৈধতা নেই।  ভালো বিষয় হচ্ছে, আমার অভিজ্ঞতায় আলেম পরিবারে এ ধরনের জাহালত খুবই কম। বিভিন্ন দ্বীনি মারকাযের এসব হুকুক ও আদাব রক্ষায় দ্বীনদার সাধারণ মানুষকে আরও বেশি বেশি সচেতন করা উচিত।

দুই

একই নিয়মের ব্যত্যয় ঘটবে না যদি পিতামাতা কাফির হয়। সন্তানের সাথে নৈতিক আচরণ, তার সুবিধা-অসুবিধা এবং ধর্মের বৈশিষ্ট্যের প্রতি শ্রদ্ধা দেখানো পিতামাতার বিশেষ কর্তব্য। পিতামাতা যদি পাপাচারে উৎসাহ দেয় বা আদেশ করে, নৈতিকভাবে অসৎ হয় ও তার সেই অসততা সন্তানের জীবনেও প্রভাব রাখে, অথবা আদেশ নিষেধের ক্ষেত্রে স্বেচ্ছাচারি হয় অথবা নিতান্ত নির্বোধ হয়, সেক্ষেত্রেও শরীয়া নিরংকুশভাবে তাদের অন্ধ আনুগত্য ও সদ্ভাবের কথা বলে, এ ধরনের চিন্তাভাবনা নিঃসন্দেহে শরীয়া বিরোধী।

কেননা আনুগত্য ধারণাটাই এখানে ভালো কাজ ও ন্যায়সঙ্গত হবার সাথে শর্তযুক্ত। এখানে ন্যায়সঙ্গত হবার মানে কেবল সরাসরি ও সুস্পষ্ট গুনাহ থেকে মুক্ত হওয়াকেই বোঝায় না, বরং এমন সকল ক্ষতি, অন্যায় এবং স্বেচ্ছাচারিতা থেকেও মুক্ত হওয়াকেও বুঝায়, যেগুলোর খুটিনাটি ও বিস্তারিত বিষয়সমূহ পৃথকভাবে গুনাহর কাজ হিসেবে শামিল না। আল্লামা শাতেবি রহ. তার আল মুওয়াফাকাত কিতাবে বলেন, কোন কোন কাজ পৃথকভাবে ও আংশিক বিচারে বৈধ হয়, কিন্ত সামগ্রিক ও সামষ্টিকভাবে তা গুনাহের কাজে পরিণত হয়। ঠিক তেমনিভাবে কোন কোন আদেশ তার আপন বিচারে পৃথকভাবে বৈধ হতে পারে, কিন্তু যদি সামষ্টিকভাবে তা কোন একটি গুনাহের সাথে সম্পৃক্ত হয়ে যায়, তখন সামষ্টিকভাবে সেটিও গুনাহ বা অন্যায় কাজে পরিণত হবে। যেমন ধরা যাক, পিতামাতা কোন গ্রহণযোগ্য কারণ ব্যতিরেকেই সন্তানকে কোন মুবাহ কাজে নিষেধ করল, আংশিক বিচারে সেই মুবাহ কাজ ত্যাগ করার ফলে যদি দারিদ্র, যিনা, জীবনের আশংকা ও অন্যের অধিকার বিনষ্ট করা ইত্যাদিতে জড়িয়ে পড়ার প্রবল সম্ভাবনা থাকে, যা শরিয়ার মাকসাদ ও চাহিদার সম্পূর্ণ বিপরীত, তাহলে সে সকল আদেশ নিছক স্বাভাবিক, বৈধ ও আবশ্যকীয় আদেশ হিসেবে বাকি থাকবে না।

শরিয়া কাফির পিতামাতার ক্ষেত্রে আদেশ দেয়, তাদের বাতিল অবস্থান সত্বেও তাদের সম্মান করা ও তাদের হক আদায় করা জরুরী। এই বিষয়ে তাদের কুফর কোন প্রভাব রাখে না। তবে এর দ্বারা এটা মনে করা উচিত নয়, পাপাচারী, অন্যায়কারী ও স্বেচ্ছাচারী পিতামাতার আদেশ আবশ্যকীয়তার ক্ষেত্রে কোন প্রভাব রাখে না, বরং কুরআনের উক্ত আয়াতটি বরং এটাই বলে যে, যে সকল মন্দতা তাদের রয়েছে, তা তাদের সাথে সদ্ভাবের আদেশে যেমন প্রভাব রাখবে না, ঠিক তেমনিভাবে তাদের  মন্দতা ও স্বেচ্ছাচারী  আদেশ মান্য না করা সেই সদ্ভাব ও আনুগত্য করার আদেশে  প্রভাব রাখবে না।

তিন

আনুগত্যের বিপরীত অবাধ্যতা। অবাধ্যতার সংজ্ঞা ও গতি-প্রকৃতি নিয়ে ফুকাহায়ে কেরাম বিভিন্ন আলাপ করেছেন। এখানে আমি তাদের ঐক্যমত হওয়া বিষয়সমূহ সংক্ষিপ্তভাবে দেখাব। একটা বিষয় স্পষ্ট, ফুকাহায়ে কেরামের কেউ-ই অবাধ্যতাকে সাধারণ ও নিরংকুশভাবে বোঝেননি, যেভাবে আমরা অনেকেই বুঝে থাকি। ফুকাহায়ে কেরাম বাবা-মাকে কোন প্রকার কষ্ট দেয়াকে অবাধ্যতা হিসেবে ধরেছেন। এটা নিঃসন্দেহে অকাট্যভাবে হারাম অবাধ্যতা হিসেবে ধর্তব্য হবে। এ ব্যাপারে ইজমা রয়েছে। এর মানে ‘উফ’ বলা থেকে যে কোন প্রকার শারীরিক আঘাত ইত্যাদি। এসব কিছুই হারাম ও কবিরা গুনাহের অন্তর্ভুক্ত। কোন অবস্থাতেই পিতামাতার সাথে এ ধরনের আচরণ করা যাবে না, একমাত্র যদি (আল্লাহ মাফ করুন) খুন অথবা যৌন নির্যাতন থেকে আত্মরক্ষা করার মতো অতি জরুরি অবস্থা না হয়ে থাকে।

এছাড়াও হারাম অবাধ্যতা হিসেবে ধর্তব্য হবে এমন সব আদেশ পালন না করা, যাতে তাদের ও সন্তানদের দ্বীনি ও দুনিয়াবি উপকারিতা রয়েছে। যেমন নামাজ পড়া, তাদের হজ্ব করানো, তাদের ঘুরতে নিয়ে যাওয়া, তাদের খেদমত করা, দান করা, ডাক্তার দেখানো ইত্যাদি ইত্যাদি। এগুলো মান্য করা আবশ্যক। এছাড়াও এমন আদেশ পালন না করাকেও অবাধ্যতা বলা হবে, যাতে সন্তানের ব্যক্তিগত সহনশীল ক্ষতি রয়েছে, কিন্তু আদেশ মান্য করায় যদি তাদের  সামগ্রিক উপকার বেশি হয়, তাহলেও আবশ্যক হচ্ছে এসকল বিষয়ে পিতামাতার আনুগত্য করা। কিন্তু আদেশ যদি এমন হয়, যা মান্য করার ফলে সন্তানের অসহনশীল ও মৌলিক অধিকার বেশ ভালোভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়, তাহলে সে আদেশ মান্য না করা অবাধ্যতার আওতায় পড়বে না।

অসহনশীল ও বড় ক্ষতি বলতে ঠিক কী, এটা আসলে স্থান-কাল-পাত্র হিসেবে বিভিন্ন ধরনের হতে পারে, যা নিশ্চিত করার জন্য জন্য বিজ্ঞ মুফতির পরামর্শ জরুরি। এসকল ক্ষেত্রে সন্তানের দায়িত্ব হলো, যথাসম্ভব নিজের অক্ষমতা প্রকাশ করে ক্ষমা চাওয়া এবং আদিষ্ট বিষয়ে চাহিদা যথাসম্ভব পূরণ করা। বিষয়টি যদি এমন হয়, যাতে কোন উপকার নেই এবং ক্ষতিও নেই, একেবারে নিছক সাধারণ তুচ্ছ বিষয়, সেক্ষেত্রে ফুকাহাদের ইখতেলাফ রয়েছে। এসব বিষয়ে পিতামাতার আদেশ মান্য করাই শ্রেয়।

চার

 যে সকল বিষয় অবাধ্যতার অন্তর্ভুক্ত নয়

১. পিতামাতার এমন সব আদেশ না মানা, যাতে কেবল বোকামি ও অনিষ্টতা প্রকাশ পায়, উপকার বা কল্যাণ থাকে না এবং সে আদেশ শরীয়ার চাহিদার বিরুদ্ধে হয়।

ইবনে হাজার হাইতামি বলেন, বাবা-মায়ের কোন আদেশে যদি বোকামি ও অনর্থ ইত্যাদি প্রকাশ পায়, তাহলে সেই আদেশে গুরুত্ব দেওয়া যাবে না। যেমন সন্তানের স্ত্রীকে তালাক দিতে আদেশ করা। শায়খুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়াকে জিজ্ঞেস করা হয় এমন একজনের ব্যাপারে যার মা তাকে তার স্ত্রীকে তালাক দিতে আদেশ দিচ্ছে। তিনি বললেন, তার জন্য তালাক দেয়া জায়েয নেই। তার উচিত তার মার সাথে সদ্ভাবে চলা। তালাক দেয়াটা সদ্ভাবে জীবনযাপনের সাথে যুক্ত নয়।

২. এমন সব বিষয়ে নিষেধ করা যেখানে ক্ষতি নেই, কিন্তু কল্যান স্পষ্ট এবং সেই কল্যান থেকে বঞ্চিত হলে ক্ষতি হতে পারে। যেমন স্ত্রীর থেকে পৃথক বসবাস, উপকারি কর্মক্ষেত্র বাদ দেয়া, জরুরি শিক্ষা অর্জন থেকে মানা করা ইত্যাদি বিষয়ে আদেশ মান্য করা আবশ্যক নয়। তবে শর্ত হলো, উক্ত বিষয়সমূহ থেকে নিজের অথবা পিতামাতার কোন ক্ষতি বের হয়ে আসে কিনা তা বিবেচনা করতে হবে। তাই আমাদের তুরাসে এসব বিষয়ে সাধারণ সিদ্ধান্তের বাইরে যেসব ফতোয়া দেখা যায়, তার সবই সেই স্থান-কাল-পাত্রের সাথে সম্পর্কিত, বিশেষ মাসলাহাত অনুযায়ী দেয়া ফতোয়া।

শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া বলেন,‘পিতামাতার নিজের পছন্দের পাত্র-পাত্রীর সাথে বিয়ে করতে ছেলে অথবা মেয়েকে বাধ্য করার অধিকার নেই বাবা-মায়ের। ফলে সন্তান যদি উক্ত বিয়েতে রাজি না হয়, তাহলে তাকে অবাধ্য বলা হবে না। কেননা প্রাপ্তবয়স্ক সন্তানকে তারা যেমন ভালো খাবার খাওয়ার সক্ষমতা থাকা অবস্থায় তার অপছন্দনীয় খাবার খাওয়াতে বাধ্য করতে পারে না, সেক্ষেত্রে বিয়ে তো আরো বড় বিষয়। কেননা অপছন্দনীয় খাবারের কষ্ট সাময়িক, কিন্তু পারস্পরিক অপছন্দনীয় যুগলের কষ্ট আজীবন।’ মূলত ইসলামের মাকসাদ হচ্ছে বাবা-মায়ের সাথে সন্তানের যৌথ বোঝাপড়া ও পছন্দের ভিত্তিতে বিবাহ সম্পাদন করা। কিন্তু বাবা-মায়ের জন্য কিছুতেই বৈধ নয় তাদের সন্তানকে স্বেচ্ছাচারীভাবে তার অমতে বিয়েতে বাধ্য করা।

৩. সন্তান পিতামাতার এমন সব আদেশ মানতে বাধ্য নয়, যাতে পিতামাতা সন্তানের জীবন, সম্পদ ও সম্মানের সাথে শত্রুতা পোষণ করে। বরং এসব ক্ষেত্রে সন্তানের দায়িত্ব হচ্ছে যথাসম্ভব সে সকল শত্রুতাকে প্রতিরোধ করবে।

৪. সন্তানদের সাথে বাবা-মায়ের অন্যায় আচরণ বিভিন্ন স্তরের হতে পারে। একজন ফকীহের দায়িত্ব স্তর অনুযায়ী আলাদা আলাদাভাবে সন্তান কিভাবে সে সকল অন্যায় আচরণ সত্ত্বেও বাকি বিষয়ে সম্মান ও সদ্ভাব বজায় রাখতে পারে তার দিকনির্দেশনা দেয়া।

যে সকল বিষয় অবাধ্যতার মধ্যে পড়ে না, সেসব ক্ষেত্রেও তাদের সাথে বিন্দুমাত্র খারাপ আচরণ করা জায়েয নেই। বরং যথাসম্ভব নিজের অক্ষমতা ও  ওজরটা সুন্দর করে বলতে হবে। অন্য কিছু করে তাদের মনটাকে খুশি করে দেওয়ার চেষ্টা করতে হবে। এভাবে ভারসাম্য রক্ষা করা উচিত, যাতে ফাসাদ থেকে নিজেকে রক্ষার পাশাপাশি বাবা-মায়ের সন্তুষ্টিও ধরে রাখা যায়। তবে যদি কোন সঠিক কাজ করার পরও তারা অসন্তুষ্ট হন, তবে সেক্ষেত্রে সন্তানের এখানে কোন দায় নেই, তবে তাদের সেই সন্তুষ্টি  অন্য কিছুর মাধ্যমে ফিরিয়ে আনার যথাসম্ভব চেষ্টা করা উচিত।

একথা বলাই বাহুল্য যে, আমাদের সমাজে  পিতামাতার সাথে দুর্ব্যবহার ইত্যাদি ক্রমেই বিপুল পরিমাণে বেড়েই চলছে। অনেকসময় শরীয়তের অনেক শাখা আহকাম মানতে গিয়ে বাবা-মায়ের সাথে আমরা সম্পর্কত্যাগ করছি যা অকাট্যভাবে হারাম। ঠিক তেমনিভাবে বাবা-মায়ের আনুগত্যের আরেক প্রান্তিক আচরণের দ্বারা আমরা অনেকসময় অন্যদের হক নষ্ট করছি। এসব কিছুর দায় বিশেষভাবে আমাদের ওপরেও পড়বে। আমাদের সমাজে নানাস্তরের নৈতিক অবক্ষয় ও ফাসাদের কারণে  এ আলোচনা অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে। যা আমাদের অনেক বাবা-মাকেও স্পর্শ করছে।  দিনশেষে বাবা-মায়ের সঠিক আনুগত্য ও সদ্ভাব আচরণের ধারণাটি সঠিকভাবে বুঝলে ও প্রয়োগ করলে শরিয়ার মূল মাকসাদ পূরণ হবে। যা ন্যায়বিচার, ইনসাফ ও ভারসাম্যপন্থার সাথে গভীরভাবে যুক্ত।

সূত্র:

১. মাজমুউল ফাতাওয়া লি ইবনে তাইমিয়া

২. আল মুওয়াফাকাত

৩.আল ফাতাওয়াল ফিকহিয়াতুল কুবরা

৪. আল ফুরুক লিল কারাফি

৫. আদাবুশ শারইয়াহ লি ইবনিল মুফলিহ

আগের সংবাদমুসলিম সভ্যতায় গোয়েন্দা ব্যবস্থা
পরবর্তি সংবাদসাইয়েদাতুত তাবিইয়াত হাফসা বিনতে সীরীন