পূর্ব তিমুর বানানোর ষড়যন্ত্র: আলেমরা সতর্ক করেছেন আগেই

|| তাসনিফ আবীদ ||

দেশের পাবর্ত অঞ্চল নিয়ে দীর্ঘ দিন ধরেই মানুষকে সচেতন করে আসছে বিজ্ঞ আলেম সমাজ। পাহাড়ে খ্রিষ্টান মিশনারিদের অবাধ বিচরণ ও নানা চক্রান্তের তথ্যও সামনে আনেন তারা। এমনকি শান্তির ধর্ম ইসলামে দীক্ষিত হওয়ায় ওমর ফারুক ত্রিপুরাসহ বেশ কয়েকজনকে প্রাণও দিতে হয়ে পার্বত্য অঞ্চলে।

এবার বিষয়টি নিয়ে খোদ প্রধানমন্ত্রীকেও কথা বলতে শোনা গেছে। বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের একটি অংশ নিয়ে পূর্ব তিমুরের মতো খ্রিষ্টান দেশ বানানোর চক্রান্ত চলছে বলে জানান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

গত বৃহস্পতিবার (২৩ মে) প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন গণভবনে ১৪ দলীয় জোটের এক বৈঠকের সূচনা বক্তব্যে এসব তথ্য দেন প্রধানমন্ত্রী।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, চক্রান্ত এখনো আছে। পূর্ব তিমুরের (ইন্দোনেশিয়া ভেঙে গড়ে ওঠা) মতো বাংলাদেশের একটা অংশ নিয়ে, তারপরে চিটাগাং (পার্বত্য চট্টগ্রাম), মিয়ানমার মিলে একটা খ্রিস্টান রাষ্ট্র বানাবে। বঙ্গোপসাগরে একটা ঘাঁটি করবে।

প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্যের পর পাহাড়ে চলতে থাকা খ্রিষ্টান মিশনারিদের এই চক্রান্ত কি কোনো অংশে কমবে?

পাহাড়ে বসবাসরত একাধিক পরিবারের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বর্তমানে পার্বত্য চট্টগ্রামে অপ্রতিরুদ্ধ খ্রিস্টান মিশনারিরা, তাদের প্রভাব এতটাই বেশি যে, অনেক সময় প্রশাসনকেও পাত্তা দিতে চায় না।

দেশের সীমান্ত এলাকা ও পাহাড়ি অঞ্চলে বেশ লম্বা সময় ধরে দাওয়াতি কাজ করেন মাওলানা ইউসুফ হাসান। তার থেকে পাওয়া তথ্য মতে,  ২০ বছর আগেও খাগড়াছড়িতে খ্রিস্টান ধর্মের চিহ্নও ছিল না বলা যায়। স্ব স্ব জাতিগোষ্ঠীর ভাষা ও সংস্কৃতি পালন করতো তারা। তবে এখন এদের অধিকাংশই ধর্মান্তরিত হয়ে খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত হয়ে গেছেন।

‘পার্বত্য অঞ্চলের তিন জেলায় এক সময় বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের সংখ্যাধিক্য থাকলেও ধীরে ধীরে বদলে যাচ্ছে সেই হিসেব। ধর্ম প্রচার ও আর্থিক প্রলোভনে খ্রিস্টান ধর্মে দীক্ষিত হচ্ছেন অনেকেই। একই সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে গির্জার সংখ্যাও।’ –জানান তিনি

তিনি বলেন, বিষয়গুলো নিয়ে আমরা বারবার দেশের প্রশাসনসহ সবাইকে সতর্ক করেছি। কিন্তু কেউই গুরুত্বের সঙ্গে নেয় নি।

সীমান্ত এলাকায় দাওয়াতি কাজ করেন এমন একজন দাঈ আলেম মুফতি আব্দুল মাজিদ।বিষয়গুলো নিয়ে তিনি বলেন, এখন রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ চেয়ার (মাননীয় প্রধানমন্ত্রী)  থেকে যে আশঙ্কা ও বিপদের কথা শোনানো হচ্ছে ১২ বছর আগে সে আশঙ্কা ও  ব্যথা অন্তরে লালন করে ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম : ষড়যন্ত্রের অন্যরূপ’ শিরোনামে আমি একটা কলাম লিখেছিলাম মাসিক আল কাউসারে ।

‘আসলে খ্রিস্টান ও কাদিয়ানীদের মধ্যে আছে পিতা-পুত্রের গভীর সম্বন্ধ। ইন্দোনেশিয়ার পূর্ব তিমুর এবং দক্ষিণ সুদানের ন্যায় প্ল্যান করে স্বাধীনতা আন্দোলনের ডাক দিয়ে তারপর পশ্চিমা দুনিয়ার মাধ্যমে গণভোট চাপিয়ে দুইটি পৃথক খ্রিস্টান রাষ্ট্র বানানোর ঘটনা তো আমাদের চোখের সামনেই ঘটল। আফসোস করা ছাড়া ঐসব অঞ্চলের জনগণ আর কী করতে পেরেছে? আমরাও কি এমন একটি অসাড় আফসোসের দিকে যাচ্ছি? আল্লাহ তাআলা হেফাযত করুন।’ –বলেন তিনি

তিনি তথ্য দেন, বাংলাদেশের পার্বত্য জেলাগুলোকে নিয়ে এমন একটি ষড়যন্ত্রের হুঁশিয়ারি কিছুদিন পূর্বে সেনাদপ্তর থেকে দেওয়া হয়েছিল। ২০১১ সালের আগস্ট মাসের বিভিন্ন তারিখে বেশ কয়েকটি দৈনিক পত্রিকাতেও এ বিষয়ক প্রতিবেদন ছাপা হয়েছে।

‘উপজাতিদের সাথে বাংলাদেশের সেনাবাহিনী ছাড়া আর কেউ থাকে না। তাদের অভিজ্ঞতাই বাস্তব অভিজ্ঞতা। এরই সাথে দেশের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা খ্রিস্টানদেরকে পার্বত্য জেলাগুলোতে নিয়ে সংখ্যাগুরু বানানো হচ্ছে, যা পূর্ব তিমুরে হয়েছিল। এভাবে গণভোটে বিজয়ের ক্ষেত্রও তৈরি করা হচ্ছে। আমি এখানে তাদের ওয়েবসাইটের একটি পরিসংখ্যান তুলে ধরছি-১৮৮১ সালে বাংলাদেশে খ্রিস্টানদের অনুপাত ছিল প্রতি ৬০০০ জনে ১ জন। ২০০০ সালে তা দাঁড়ায় ১১ জনে ১ জন। সময় খুব দ্রুত ফুরিয়ে আসছে। এরপর হয়তো সচেতন হওয়ারও সময় থাকবে না।’ –সাবধান করে বলেন মুফতি আব্দুল মাজিদ

অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ও গবেষক আলেম ড. আ ফ ম খালিদ হোসেন আরো ৩ বছর আগে একটি জাতীয় দৈনিকে লেখা এক আর্টিকেলে বলেছিলেন, বাংলাদেশ সংবিধানের ৪১ অনুচ্ছেদের ১ নম্বর ধারার ক, খ, গ উপধারায় স্পষ্টভাবে বলা আছে- এ দেশে যে কেউ স্বেচ্ছায় ধর্মাবলম্বন, ধর্মচর্চা, ধর্মানুশীলন, ধর্মপ্রচার, ধর্মীয় উপাসনালয় স্থাপন করতে পারবেন। এটা নাগরিকের মৌলিক অধিকারের অন্তর্ভুক্ত। সংবিধানের ভাষ্যমতে, যেকোনো ধর্মপ্রচার বা স্বেচ্ছায় ধর্ম পরিবর্তন করতে আইনত কোনো বাধা নেই। তবে দারিদ্র্যের সুযোগ নিয়ে জোরপূর্বক ধর্মান্তরণ ফৌজদারি অপরাধ। স্মর্তব্য, বৈদেশিক সাহায্যপুষ্ট কতিপয় বেসরকারি সেবাসংস্থা চিকিৎসা, সমাজ ও মানবতার সেবার আড়ালে মূলত পার্বত্য এলাকার দারিদ্র্যপীড়িত জনগোষ্ঠীকে ইউরোপীয় জীবনাচার ও দর্শনের দিকে আকৃষ্ট করার প্রয়াস চালাচ্ছে।

‘বিদেশী তহবিলে পরিপুষ্ট ঝাঁকে ঝাঁকে এনজিও এখন তিন পার্বত্য জেলায় সক্রিয়। কিন্তু এতদিনে পরিষ্কার হয়ে গেছে যে, আর্ত-মানবতার সেবার নামে এসব এনজিওর বেশির ভাগই আসলে পাহাড়ি জনগোষ্ঠীকে ধর্মান্তরিত করার কাজে কোমর বেঁধে নেমেছে। এ কাজে তাদের সাফল্য চোখধাঁধানো। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তৈরি করা প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে ঢাকার একটি দৈনিকে প্রকাশিত রিপোর্টে বলা হয়েছে, গত ২০ বছরে সেখানে ১২ হাজার উপজাতীয় পরিবারকে ধর্মান্তরিত করে খ্রিষ্টান বানানো হয়েছে। ওই রিপোর্টের তথ্যানুযায়ী, তিন পার্বত্য জেলা- খাগড়াছড়ি, বান্দরবান ও রাঙ্গামাটিতে বর্তমানে ১৯৪টি গির্জা রয়েছে। খাগড়াছড়ি জেলায় আছে ৭৩টি গির্জা। ১৯৯২ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত এ জেলায় চার হাজার ৩১টি পরিবার খ্রিষ্টান হয়েছে। বান্দরবান জেলায় গির্জা আছে ১১৭টি। এখানে একই সময়ে খ্রিষ্টান হয়েছে ছয় হাজার ৪৮০টি উপজাতীয় পরিবার। রাঙ্গামাটিতে চারটি চার্চ খ্রিষ্টান বানিয়েছে এক হাজার ৬৯০টি উপজাতীয় পরিবারকে। এগুলো ১০ বছর আগের হিসাব। এখন এ সংখ্যা আরো বৃদ্ধি পেয়েছে। পাহাড়ি যেসব জনগোষ্ঠীর লোকসংখ্যা তুলনামূলকভাবে কম, তাদের প্রায় শতভাগ খ্রিষ্টান হয়ে গেছে অনেক আগেই।’ –জানান তিনি

তার গবেষণা বলছে, সীমান্তের ওপারে ‘সেভেন সিস্টার্স নামে খ্যাত- আসাম, ত্রিপুরা, মেঘালয়, মিজোরাম, নাগাল্যান্ড, মনিপুর, অরুণাচল পাহাড়ি অঞ্চলের বৃহত্তর জনগোষ্ঠী এখন ধর্মান্তরিত খ্রিষ্টান। ওইসব পাহাড়ি অঞ্চলসংলগ্ন বাংলাদেশের পার্বত্য এলাকায়ও ইতোমধ্যে উল্লেখযোগ্য হারে খ্রিষ্টানের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। গড়ে উঠেছে পাহাড়ের কোলঘেঁষে সুদৃশ্য গির্জা ও মিশনারি স্কুল। সাম্প্রতিক আঞ্চলিক, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ঘটনাপ্রবাহ ইঙ্গিত দিচ্ছে যে, একদিন চট্টগ্রামের পার্বত্য অঞ্চল দক্ষিণ সুদান ও ইন্দোনেশিয়ার পূর্ব তিমুরের মতো জাতিসঙ্ঘের তত্ত্বাবধানে ‘স্বাধীনতা’ লাভ করতে পারে। গড়ে উঠতে পারে বাংলাদেশের বুকে আরেকটি পৃথক দেশ। খ্রিষ্টান অধ্যুষিত ইউরোপীয় দাতাগোষ্ঠী ও এনজিওরা পার্বত্য চট্টগ্রামকে টার্গেট করে সামনে এগোচ্ছে। প্রায় দু’বছর স্থগিত থাকার পর জাতিসঙ্ঘ উন্নয়ন কর্মসূচি (UNDP) রাঙ্গামাটি, বিলাইছড়ি, বান্দরবান ও থানচি উপজেলায় ২০ লাখ মার্কিন ডলারের ‘কমিউনিটি উন্নয়ন কর্মসূচি’ নামে প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে যাচ্ছে। ২০০১ সালে পার্বত্য চট্টগ্রামে তিন বিদেশী নাগরিককে (ব্রিটিশ ও ড্যানিশ) অপহরণের পর বিদেশী সংস্থাগুলো তাদের তৎপরতা সাময়িকভাবে স্থগিত রাখে। ইতোমধ্যে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা উন্নয়নের নামে দেদার বৈদেশিক অর্থ দিয়ে নবদীক্ষিত খ্রিষ্টান জনগোষ্ঠীকে পুনর্বাসনের কাজে লিপ্ত হয়েছে। কমিউনিটি ডেভেলপমেন্টের প্ল্যানের অধীনে তারা ধর্মান্তরিত খ্রিষ্টান যুবকদের উচ্চশিক্ষার জন্য যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা প্রভৃতি দেশে পাঠায়। পরিস্থিতি এভাবে অব্যাহত থাকলে গোটা পার্বত্যাঞ্চলে অর্থনৈতিক দিক দিয়ে সচ্ছল এবং রাজনৈতিক দিক দিয়ে বিপজ্জনক, খ্রিষ্টান জনগোষ্ঠী গড়ে উঠবে। এই পারের পাহাড়ি খ্রিষ্টানরা সীমান্তবর্তী ওই পারের পার্বত্যাঞ্চলে বসবাসরত নবদীক্ষিত খ্রিষ্টানদের সাথে মিলে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন পরিচালনা করতে পারে। এই আশঙ্কা অমূলক নয়। এনজিও তথা বেসরকারি সংস্থাগুলো কোনো দেশের কোনো সরকারের বন্ধু নয়। এনজিওরা তাদের খ্রিষ্টান দাতাগোষ্ঠীর গোপন পরিকল্পনাই বাস্তবায়ন করে থাকে। বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী ভারতীয় ছয়টি রাজ্যের পাহাড়ি এলাকায় বহুদিন যাবৎ এনজিও এবং খ্রিষ্টান মিশনারিরা ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীদের ধর্মান্তরের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে সুকৌশলে। সম্প্রতি ওইসব সংস্থার সাথে এতদঞ্চলের উগ্রপন্থী সংগঠনের সম্পর্ক থাকার খবর পাওয়ার পর ভারতীয় সিবিআই ও অন্যান্য গোয়েন্দা সংস্থা তদন্ত শুরু করেছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে ৮২০টি এনজিও সংস্থাকে ভারতীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কালো তালিকাভুক্ত করে ওইসব রাজ্যের জেলা প্রশাসকদের সতর্ক থাকার নির্দেশ দিয়েছে। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের ছয়টি রাষ্ট্রের কালো তালিকাভুক্ত এনজিওদের মধ্যে রয়েছে- ত্রিপুরায় ৬৯, মনিপূরের ১৯৭, আসামের ১৫১, নাগাল্যান্ডের ৭৮, সিকিমের দুটি ও মেঘালয়ে ৩২৩টি।

তিনি বলেন, ভয়াবহ পরিস্থিতির এই প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের মুসলমানদের দ্বীনের দাওয়াতি ও সেবার ইতিবাচক মানসিকতা নিয়ে বাস্তব কর্মসূচি হাতে নিতে হবে যাতে খ্রিষ্টান মিশনারিদের কবল থেকে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব, উত্তরাধিকার, ঐতিহ্য ও লালিত কৃষ্টি রক্ষা করা যায়। রাজনীতিবিদ, বুদ্ধিজীবী, আলেমসহ সর্বস্তরের মুসলমানের এই বিষয়ে সুচিন্তিত কর্মপন্থা নির্ধারণ করতে হবে। পার্বত্য এলাকায় ইসলামের দাওয়াতি তৎপরতা চালানোর জন্য টাস্কফোর্স গঠন করা সময়ের অপরিহার্য দাবি। যেসব মানুষ ইসলামের আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে পুরনো ধর্ম ত্যাগ করেন, তারা নিজেদের পরিবার ও সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। তাদের স্থায়ী পুনর্বাসন, বাসস্থান, শিক্ষা ও জীবিকা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সুচিন্তিত কর্মকৌশল ও মজবুত ফান্ড গড়ে তুলতে হবে। অনেক সময় ধর্মান্তরিত মুসলমানদের ভিক্ষা করতে দেখা যায়। এটা কেবল বেদনাদায়ক নয়, লজ্জাজনকও বটে।

আগের সংবাদইউজিসি কেন কওমি মাদরাসার স্বীকৃতি মেনে নিচ্ছে না?
পরবর্তি সংবাদসৌদি পৌঁছেছেন ৫৬৫৫৯ বাংলাদেশী হজযাত্রী