ইমরান রাইহান
রাগে ফুঁসছেন ইরাকের গভর্নর হাজ্জাজ বিন ইউসুফ। ইবরাহিম বিন ইয়াজিদ নাখয়িকে পাওয়া যাচ্ছে না। পুলিশ ও গোয়েন্দারা হন্যে হয়ে খুঁজছে তাকে, কিন্তু এখনো তাঁর সন্ধান মেলেনি। ইবরাহিম বিন ইয়াজিদ নাখয়ি একজন তাবেয়ি। যুগের শ্রেষ্ঠ ফকিহদের একজন। তাঁর অপরাধ, তিনি হাজ্জাজের ঘোর বিরোধী। তিনি মনে করেন হাজ্জাজকে লানত করা বৈধ। একবার তাঁর দরসে প্রশ্ন করা হয়েছিল, কেউ যদি হাজ্জাজকে লানত দেয় তাকে আপনি কী বলবেন? তিনি জবাবে আয়াত তেলাওয়াত করেছিলেন أَلَا لَعْنَةُ اللَّهِ عَلَى الظَّالِمِينَ অর্থাৎশুনে রাখো, জালেমদের উপর আল্লাহর অভিসম্পাত রয়েছে। (সুরা হুদ ১১:১৮ )
মুহাম্মদ বিন আবদুর রহমান বিন আশআস যখন হাজ্জাজের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে তখন ইবরাহিম নাখয়ি তাকে সমর্থন দেন। হাজ্জাজ প্রচণ্ড ক্রোধান্বিত হন। পুলিশকে নির্দেশ দেন, ইবরাহিম নাখয়িকে গ্রেপ্তার করতে। ইবরাহিম গা–ঢাকা দেন। পুলিশ ও গোয়েন্দারা ইরাকের প্রতিটি শহরে খুঁজতে থাকে তাঁকে।
মধ্যরাত। কুফার বাসিন্দারা ঘুমে বিভোর। কোথাও কোনো সাড়াশব্দ নেই। কুফার বিখ্যাত আবেদ ইবরাহিম বিন ইয়াজিদ তাইমি ঘর থেকে বের হলেন। সরু গলি ধরে হাঁটছেন। হালকা চাঁদের আলো। পথ দেখতে অসুবিধা হচ্ছে না। সারারাত ঠাণ্ডা হাওয়া বয়ে চলেছে। ইবরাহিম তাইমি জামে মসজিদে পৌঁছে ওজু করলেন। নামাজে দাঁড়ালেন। মৃদু কণ্ঠে তেলাওত শুরু করলেন। মসজিদের একপাশে প্রদীপ জ্বলছে। মসজিদের দেয়ালে ইবরাহিম তাইমির প্রলম্বিত ছায়া মৃদু কাঁপছে।
প্রতিরাতের মতো হাজ্জাজের পুলিশ বাহিনী ঘুরছে কুফার অলিগলিতে। জামে মসজিদের সমুখ দিয়ে যাওয়ার সময় দেখা গেল ভেতরে কেউ একজন নামাজ পড়ছে। পুলিশ বাহিনীর লোকেরা মসজিদে প্রবেশ করল। ইবরাহিম তাইমির নামাজ শেষ হলে তাঁকে জিজ্ঞেস করা হলো, ‘আপনার নাম কী?’
‘ইবরাহিম’
‘আপনিই কি ইবরাহিম বিন ইয়াজিদ?’
‘জি, আমিই।’ শান্তকণ্ঠে বললেন ইবরাহিম তাইমি।
‘আপনাকে গ্রেপ্তার করা হলো। কী ভেবেছিলেন? আমাদের হাত ফাঁকি দিয়ে পালাবেন? আমরা তো পাতাল থেকেও অপরাধীকে ধরে নিয়ে আসি।’ পুলিশ অফিসার উল্লসিত কণ্ঠে বলল। ইবরাহিম তাইমি বুঝতে পারলেন পুলিশ এসেছে ইবরাহিম নাখয়িকে গ্রেপ্তার করতে। তবু তিনি নিজের আসল পরিচয় দিলেন না। চুপ থাকলেন। তিনি ভাবলেন নিজের গ্রেপ্তারির বিনিময়ে যদি ইবরাহিম নাখয়িকে রক্ষা করা যায়, তবে তা–ই তাঁর জন্য উত্তম।
ইবরাহিম তাইমিকে গ্রেপ্তার করে হাজ্জাজের সামনে উপস্থিত করা হলো। হাজ্জাজ কোনো প্রশ্ন না করে আদেশ দিলেন ইবরাহিম তাইমিকে দিমাসের কারাগারে বন্দী করতে।
সেকালে দিমাসের কারাগার ছিল ভয়ংকর কারাগার। শুধুমাত্র ভয়ংকর অপরাধীদেরকেই এখানে বন্দী করা হতো। এক প্রশস্ত ময়দানের চারপাশে প্রাচীর তুলে দেয়া, এর ভেতরে বন্দীরা থাকত। ভেতরে কোনো ঘর নেই। খোলা মাঠেই থাকতে হতো। রোদ বৃষ্টি ঝড় থেকে বাঁচার উপায় নেই। কিছুদিন পর ইবরাহিম তাইমির আম্মা এলেন ছেলেকে দেখতে। ছেলেকে দেখে তিনি নিজেই চিনতে পারলেন না। ইবরাহিম তাইমির শরীরে শুধু হাড়টুকু অবশিষ্ট আছে। মা প্রশ্ন করলেন, ‘বেটা, তুমি তো জানতে পুলিশ তোমাকে খুঁজছে না, তারা খুঁজছে ইবরাহিম নাখয়িকে। তবু কেন তুমি তাদেরকে নিজের আসল পরিচয় জানালে না?’ ইবরাহিম তাইমি জবাব দিলেন, ‘মা, ইবরাহিম নাখয়ি অনেক বড় আলেম। এই উম্মাহর জন্য তিনি রহমতস্বরূপ। আমি চেয়েছি তিনি নিরাপদ থাকুন। আমি ইবরাহিম তাইমির চেয়ে তাঁর নিরাপত্তা উম্মাহর জন্য অধিক প্রয়োজন। তাই আমি নিজেকে ধরিয়ে দিয়েছি।
ইবরাহিম তাইমি কারাগারেই ইন্তেকাল করলেন। তাঁর ইন্তেকালের রাতে হাজ্জাজ স্বপ্নে দেখলেন কেউ একজন বলছে, ‘আজ একজন জান্নাতি মানুষ মারা গেছে।’ সকালে হাজ্জাজ খবর নিয়ে ইবরাহিম তাইমির মৃত্যুসংবাদ শুনলেন। পাষণ্ড হাজ্জাজ আদেশ দিলেন, তাঁর লাশের উপর ঘোড়া চালিয়ে দিতে। ‘রাতের স্বপ্নটা ওয়াসওয়াসা ছিল’ এই ভেবে হাজ্জাজ নিজেকে সান্ত্বনা দিলেন। ইবরাহিমের লাশের সাথে বেয়াদবি করা হলো। ইবরাহিমের রুহ হয়তো তখন মুচকি হাসছিল। অপেক্ষায় ছিল রবের পক্ষ থেকে বিশেষ অভ্যর্থনার—
يَا أَيَّتُهَا النَّفْسُ الْمُطْمَئِنَّةَ * ارْجِعِي إِلَى رَبِّكِ رَاضِيَةً مَرْضِيَّةً
হে প্রশান্ত আত্মা! তুমি ফিরে এসো তোমার রবের প্রতি সন্তুষ্টচিত্তে, সন্তোষভাজন হয়ে। (ফাজর ২৭–২8)
সূত্র : সিয়ারু আলামিন নুবালা, ৫ম খণ্ড, ৬০–৬২ পৃষ্ঠা। হাফেজ শামসুদ্দিন জাহাবি। মুআসসাসাতুর রিসালাহ, বৈরুত
লেখক : তরুণ অনুবাদক ও ইতিহাস-গল্প লেখক