ফাতেমি সালতানাতে অসম প্রতিরোধ : বৈরী শাসকের মোকাবেলায় আলেম সমাজ

আবদুল্লাহ বিন বশির:

ফাতেমি সালতানাত : প্রতিষ্ঠা ও সূচনা

সময়টা ২৯৭ হিজরির রবিউল আখির মাস। তিউনিসিয়ার কাইরাওয়ান শহরের জেলখানা থেকে মুক্ত হলো উবাইদুল্লাহ ইবনে মাইমুন। গায়ে অভিজাত পোশাক আর উন্নত জাতের একটি ঘোড়ায় চড়ে শহরে চলতে লাগল। চতুর্দিকে তাকবির ধ্বনির সাথে ‘ইমাম মাহদির জয়’ শ্লোগান উঠল। ঘোষণা হলো নতুন এক সাম্রাজ্যের। দাবী করা হলো এই সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা উবাইদুল্লাহ ইবনে মাইমুন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বংশধর হযরত ফাতেমা রা.-র সন্তান। তার দিকে সম্পৃক্ত করে সাম্রাজ্যের নাম দেওয়া হলো—‘ফাতেমি সাম্রাজ্য’। যাদের প্রধান কাজই ছিল রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আনীত দ্বীনকে মিটিয়ে ফেলা। [আখবারু বানু উবাইদ পৃ.৩৯]

ইমাম যাহাবী রহ. বলেন, উবাইদুল্লাহ হলো যিন্দিক ও খবিস। সে দ্বীনের বিকৃতকারী।…. রাসূলের দিকে বংশের সম্পৃক্ত করা সম্পূর্ণ মিথ্যা। ওদেরকে ফাতেমি বলা জায়েয হবে না। [সিয়ারু আলামিন নুবালা ১৫/১৮৪]

এভাবেই মুসলিম ইতিহাসে গোড়াপত্তন হয় ইসলামের খোলসধারী হিংস্র এক সাম্রাজ্যের। প্রায় তিনশ বছর স্থায়ী এই সাম্রাজ্য মুসলিম উম্মাহর জন্যে ছিল এক ভয়াবহ অভিশাপ। আফ্রিকা, মিশর, শামসহ মুসলিম ভুখণ্ডের যেখানেই তারা পা রেখেছে, হত্যা করেছে হাজারো কিংবা লাখো আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাতের অনুসারীদের। ‘গুম, খুন, লুণ্ঠন’ উবাইদি সাম্রাজ্যের মুসলমানদের জন্যে হয়ে উঠছিল নিত্যনৈমিত্তিক বিষয়। অজ্ঞ ও মূর্খ লোকদের ওরা সহজে ধোঁকায় ফেলে দিতে পারতো। তাই তাদের সকল ক্ষোভ ছিল আলেমদের নিয়ে। সামান্য বিষয়ে তারা আলেমদের হত্যা করত নির্বিচারে।

মুসলিম ভূখণ্ড দখল করে মুসলমানদের হত্যা করাই শুধু এদের উদ্দেশ্য ছিল না। পুরো ইসলামকে শিকড় থেকে উপড়ে ফেলাই ছিল রাফেজি ধর্মে বিশ্বাসি এই উবাইদিদের উদ্দেশ্য৷ সে উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে তারা ইসলামে অনুপ্রবেশ করাতে থাকে তাদের রাফেজি আকিদা এবং বিভিন্ন কুফরি মতবাদ ও কর্ম। তাদের আকিদার বিষয়ে সামান্য টু শব্দ যে করেছে, তাদেরকে হত্যা করা হয়েছে নির্মমভাবে। এতে সামান্যতম বাছ-বিচার করা হয়নি। দ্বীনবিকৃতি আর আহলুস সুন্নাহদের হত্যার এই ভয়াবহ ধারা সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা উবাইদুল্লাহ থেকে নিয়ে শেষ উবাইদি শাসক আল-আযেদ পর্যন্ত চলছিল সমানভাবে। ক্রমান্বয়ে শুধু তা বেড়েছে। সাথে যুক্ত হয়েছে নিত্যনতুন পন্থায় হরেক কিসিমের বিদয়াত-কুফরির সয়লাব ও হত্যা অত্যচারের ধরন।

উবাইদিদের দ্বীন বিকৃতি ও কুফরির কিছু নমুনা

উবাইদিরা তাদের কুফরি প্রচারে ওলামায়ে কেরাম বা সাধারণ দ্বীনদার শ্রেণিকে এড়িয়ে চলত। কারণ, তাদের কাছে এই সমস্ত প্রকাশ্য কুফরগুলো ধরা পড়ে যেত মুহুর্তেই। তাই এই সমস্ত কুফরিগুলো প্রচারের মূল টার্গেট ছিল সাধারণ জনগণ। কিন্তু তা সত্ত্বেও উবাইদি দায়ীরা খুব সতর্কতার সাথে চলত। প্রত্যেককেই অবস্থান বুঝে তাদের ভ্রান্ত ও কুফরি দাওয়াত দিত। প্রথম ধাপে শুধু এতটুকু বলত যে ‘উবাইদুল্লাহ ইবনে মাইমুন হলো প্রতীক্ষিত সেই মাহদি, যে আল্লাহর রাসূলের বংশধর’। কেউ যখন এই দাওয়াত গ্রহণ করে নিত, তখন তাকে দ্বিতীয় ধাপের দাওয়াত দেওয়া হতো। বলা হতো, ‘উবাইদুল্লাহ হলো আল্লাহর প্রেরিত রাসূল’। যারা এই ধাপ গ্রহণ করে নিত তাদেরকে শেষ স্তরের দাওয়াত দেওয়া হতো। বলা হতো, উবাইদুল্লাহই হলো আমাদের সৃষ্টিকর্তা, খোদা ও রিজিকদাতা। [আররাওজাতাইন ফি আখবারিদ দাওলাতাইন ২/২১৮, আবু শামাহ আলমাকদেসি]

১. উবাইদুল্লাহর নবুওয়াত দাবী

উবাইদুল্লাহ ইবনে মাইমুন তার গোপন দেওয়াতি মিশনে নিজেকে মাহদি পরিচয় দিলেও ২৯৯ হি.তে সে নিজেকে আল্লাহর প্রেরিত রাসূল দাবী করে। এবং এই দাবী না মানার কারণে দুইজন যুগ শ্রেষ্ঠ আলেমকে হত্যা করে। [সিয়ারু আলামিন নুবালা ১৪/২১৭]

২. খোদা দাবী করার ইচ্ছে পোষণ

উবাইদিদের ষষ্ঠ শাসক আল-হাকেম একবার নিজের ক্ষমতা দেখে ইচ্ছে পোষণ করল, সে নিজেকে ‘রব’ দাবী করবে। বিষয়টি নিয়ে সে মন্ত্রীসভায় আলোচনাও করে। মন্ত্রীরা তার কথা শুনে হতভম্ব হয়ে যায়। বহু কষ্টে তাকে বোঝানো হয় যে, এই দাবী করলে লোকেরা আমাদের বিরুদ্ধে ব্যাপক বিদ্রোহ করে বসবে। শাসনব্যবস্থা টিকিয়ে রাখা যাবে না। তখন হাকেম এই দাবী করা থেকে বিরত থাকে। [সিয়ারু আলামিন নুবালা ১৫/১৭৬]

৩. আল্লাহর হারামকৃত সকল বস্তুকে হালাল ঘোষণা দেওয়া

উবাইদিদের শাসন যারা মেনে নিতো, শাসক উবাইদুল্লাহকে যারা ইমাম মাহদি স্বীকৃতি দিত, তাদের জন্য মদ, যিনা থেকে শুরু করে দ্বীনের প্রায় প্রতিটি নিষিদ্ধ কাজকে হালাল করে দেওয়া হতো। একবার সে রাজদরবারে ঘোষণা করে ‘তোমরা সকলে যে দ্বীন পালন করছো তা বিকৃত। তোমরা হলে জানোয়ারের মতো। তাই তোমাদের কোনো নামাজ রোজা নেই। আজ থেকে তোমাদের জন্যে আমি প্রত্যেক ঐ জিনিস হালাল ঘোষণা দিচ্ছি যা আল্লাহ হারাম করেছে। যাও মদ খাও এবং যিনা করো, সব বৈধ। [রিয়াজুন নুফুস ২/৫০৫]

৪. রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে প্রকাশ্যে লানত দেওয়া

উবাইদিদের দ্বিতীয় শাসক ‘আল-কায়েম’ তার পিতার তৈরি ‘মাহদি শহরে’ হাসান আযযরীর নামক এক ব্যক্তিকে গভর্নর নিয়োগ দেয়। সে এত গালিগালাজ করত যে, তার উপাধিই হয়ে গেল ‘গালিবাজ’। সে শহরের বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে গিয়ে প্রকাশ্যে এই কবিতা আবৃতি করত-
العنوا عَائِشَة وبَعْلَها * العنوا الْغَار وَمن حوى
‘আয়েশা আর তার স্বামীর উপর লানত করো। গুহা এবং গুহার মধ্যে যারা ছিল তাদের লানত করো’। (অর্থাৎ গারে ছাওরে হযরত আবু বকর ও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অবস্থান)। [আররাওজাতাইন ফি আখবারিদ দাওলাতাইন ২/২১৯, আবু শামাহ আলমাকদেসি]

৫. রাষ্ট্রযন্ত্রের মাধ্যমে প্রকাশ্যে সাহাবাদের গালিগালাজ করার ব্যবস্থা করা

সাহাবায়ে কেরামকে গালি-গালাজ করা ছিল এই সাম্রাজ্যের সবচেয়ে জঘন্য ও ঘৃণিত কাজসমূহের একটি। সাধারণ উবাইদিরা একে শরীয়তের আমল মনে করত। সাহাবিদের মুহাব্বতকারীদের উপর চলত অত্যাচারের স্টিমরোলার। ষষ্ঠ উবাইদি শাসক আল-হাকেম আদেশ জারি করে, সাহাবাদের গালি দেওয়া বিভিন্ন বিলবোর্ড যেন চৌরাস্তা, বিশ্ববিদ্যালয়, বড় বড় রাস্তাসহ শহরের গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় ঝোলানো হয়। তার সমস্ত প্রশাসনিক লোকদের চিঠি লিখে প্রত্যেককে নিজ-নিজ অঞ্চলে এমনটা করার নির্দেশ দেয়। [আররাওজাতাইন ফি আখবারিদ দাওলাতাইন ২/২১৯, আবু শামাহ আলমাকদেসি]

হযরত আবু বকর বা ওমর রা.কে মুহাব্বত করার পরিণাম ছিল মৃত্যদণ্ড। উবাইদি শাসক আল-হাকেমের আমলে আফ্রিকার এক লোককে দামেশকের রাস্তায় প্রকাশ্যে ফাঁসি দেওয়া হয়। তখন ঘোষণা করা হয়, যে ব্যক্তি আবু বকর ও ওমরকে মুহাব্বত করবে তাদের অবস্থাও অনুরূপ হবে। [আররাওজাতাইন ফি আখবারিদ দাওলাতাইন ২/২১৯, আবু শামাহ আলমাকদেসি]

সাহাবায়ে কেরামকে গালি দেওয়ার এমন ভয়ংকর পরিবেশ তৈরি হয়েছিল যে, উবাইদিরা ‘দারুন নহর’ (কুরবানির ঘর) নামে একটি টর্চার সেল তৈরি করল। এই টর্চার সেলে তাদেরকেই আনা হতো, যারা সাহাবাদের মুহাব্বতের কথা বলত। আবুল হাসান আল কাবেসি রহ. বলেন, ‘দারুন নহরে’ উবাইদি সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা উবাইদুল্লাহ আর তার সন্তানরা শুধু সাহাবাদের শানে ভালো কথা বলার অপরাধে চার হাজারের মতো আলেম ও দ্বীনদার লোকদের হত্যা করেছে। [সিয়ারু আলামিন নুবালা ১৫/১৪৫; শাজারাতুয যাহাব ৪/১১৪-১১৫]

কাউকে হত্যা করার জন্যে শুধু এটুকু অপবাদই যথেষ্ট ছিল যে, সে আলি রা.কে সর্বশ্রেষ্ঠ সাহাবি বলে না। মুহাম্মদ ইবনে ইবরাহিম আসসানজারি ও হাসান ইবনে মুফাররিজ নামক দুইজন নেককার মানুষকে এই অপবাদে বেত্রাঘাত করা হয়। তারপর বর্শা দিয়ে হত্যা করে শহরের মাঝে শূলে চড়িয়ে দেওয়া হয়। [আলমিহান পৃ.২৯৪ আবুল আরব তামিমি (মৃত্যু ৩৩৩হি.)]

৬. কুরআন পোড়ানো ও মসজিদ অবমাননা

দ্বিতীয় উবাইদি শাসক আল-কায়েম বাহরাইনে অবস্থানকারী আবু তাহের আল-কারামেতিকে চিঠি লিখে জানায়, সেখানকার আহলুস সুন্নাহর অধিবাসীদের হত্যা করে ফেলো; তাদের মসজিদগুলো ভেঙ্গে গুড়িয়ে দাও এবং তাদের কুরআনগুলোও পুড়িয়ে দাও। [আররাওজাতাইন ফি আখবারিদ দাওলাতাইন ২/২১৯, আবু শামাহ আলমাকদেসি]

৭. কেবলা পরিবর্তন

উবাইদুল্লাহ নিজের জন্যে ‘মাহদিয়্যাহ’ নামক একটি শহর তৈরি করে। উবাইদিদের এক নিয়োগকৃত ব্যক্তি উবাইদুল্লাহকে খুশি করার জন্যে কিবলার দিকে না ফিরে ‘মাহদিয়্যাহ’র দিকে ফিরে নামাজ পড়া শুরু করে। এই ব্যাপারে প্রশ্ন করা হলে সে উত্তর দেয়, যে খোদাকে আমি দেখি না তার দিকে ফিরে কেন আমি নামাজ পড়ব? বরং যে খোদাকে আমি দেখি তাঁর দিকে ফিরেই আমি নামাজ পড়ব। [আল বায়ানুল মুগরিব ১/১৮৬]

৮. দ্বীনের মাঝে নিত্যনতুন বিধান জারি করা

উবাইদি সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা উবাইদুল্লাহ ক্ষমতা অর্জনের পরেই রমজানে তারাবীহ নিষিদ্ধ করে। ঘোষণা দেয়, সিয়াম পালন করতে হবে রমজান মাস শুরু হওয়ার দুইদিন আগে থেকে। ফজরের আজানে ‘আসসলাতু খাইরুম মিনান নাউম’ হটিয়ে দিয়ে সেখানে যুক্ত করে ‘হাইয়া আলাল খাইর মুহাম্মদ ওয়া আলি খাইরুল বাশার’। পরবর্তীতে এটাকে নিয়মিত আজানের অংশ ঘোষণা করা হয়। আজানের শেষে আজানের দোয়া না পড়ে কথিত মাহদি উবাইদুল্লাহর উপর দুরুদ পড়তে হবে। তারাবীহের ব্যাপারে তারা অত্যন্ত কঠোরতা করত। একবার আবুল হাসান ইবনুল জাদ আদ্দাক্কাক রহ. পুরো রমজানে তাঁর মসজিদে তারাবিহের নামাজ পড়ান। এই খবর সম্রাটের কাছে পৌঁছলে তাকে ধরে এনে হত্যা করে ফেলা হয়। [আখবারু বানু উবাইদ পৃ.-৯৮]

৯. মুসলিম কাফের নারী-পুরুষের অবাদ মেলামেশা ও ‘ধর্ম যার যার উৎসব সবার’ প্রথম প্রচলন

সপ্তম উবাইদি শাসক আজ-জাহের ছিল বিলাসি ও দুশ্চরিত্র স্বভাবের। সমাজের দুশ্চরিত্র ও নোংরামিপনা নিয়ে তার কোনো মাথাব্যাথা ছিল না। তার শাসনামলে রাষ্ট্রের অধঃপতন এমন হয়েছিল যে, খ্রিস্টানদের ধর্মীয় উৎসবে মুসলমানরা পুরাদমে অংশগ্রহণ করত। রাষ্ট্রীয়ভাবে এতে কোনো বিধিনিষেধ ছিল না। একবার খ্রিস্টানদের এক ধর্মীয় অনুষ্ঠানে ছোট ছোট তাবু করে সেখানে মদ আর নারীপুরুষের অবাধ বেহায়াপনার ব্যবস্থা করা হয়। খ্রিস্টানদের সাথে সেদিন শুধু মুসলিম পুরুষই নয়; মহিলারাও নোংরামিতে একসাথে অংশগ্রহণ করে। সকালের শুরু থেকে একদম দুপুরের শেষ পর্যন্ত অনুষ্ঠানটি চলে। মুসলিম নারীরা ঐদিন এত মদ পান করে যে, মাতাল হয়েই সেখানে একে অপরের উপর পড়ে থাকে। পরে মাল বোঝাইয়ের গাড়িতে করে তাদেরকে সেখান থেকে সরানো হয়। [ইত্তিয়াজুল হুনাফা ২/১৩৭]

উবাইদিরা শুধু কুফরির প্রচলন আর কুফরির সয়লাবই করেনি বরং আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাতের অনুসারীদের জীবনকে দুনিয়ার বুকেই নরকে পরিণত করেছে। গণহত্যা, লুণ্ঠন, অরাজকতা আর শোষণে তারা এমন দৃষ্টান্ত প্রতিষ্ঠা করেছে, কাফের সম্প্রদায়েরও মুসলিমদের সাথে এমন ঘটনা বিরল।

উবাইদিদের গণহত্যা, লুণ্ঠন আর অরাজকতার কিছু নমুনা

ইহুদি-খ্রিস্টানের মতো উবাইদিরা কোন মুসলিম ভুখণ্ড দখল করলে সেখানের আহলুস সুন্নাহের অনুসারীদের হত্যা করত গণহারে। আবু আব্দুল্লাহ শিয়া যখন কাইরাওয়ানের পাশ্ববর্তী শহর আরইস দখল করে, সেখানে ব্যপক হত্যা আর লুণ্ঠন চালায়। ভয়ে মানুষরা দিগ্বিদিক ছুটতে থাকে। কোথাও আশ্রয়স্থল না পেয়ে ত্রিশ হাজারের মতো মানুষ জামে মসজিদে গিয়ে আশ্রয় নেয়। হয়ত ভেবেছিল আল্লাহ আর রাসূলের কথা বলা এই মানুষগুলো মসজিদে খুন-খারাবি করবে না। কিন্তু আবু আব্দুল্লাহ শিয়া মসজিদ ঘেরাও করে সেখানে মানুষদের কচুকাটা করতে থাকে। আসর থেকে এই নির্মম হত্যাকাণ্ড সকাল পর্যন্ত চলতে থাকে। নদীর স্রোতের মত মসজিদের দরজা দিয়ে সেদিন রক্ত প্রবাহিত হয়েছিল। [আল বায়ানুল মুগরিব ১/১৪৬-৪৭]

আল-হাকেম একবার কায়রোবাসীর উপর কোন কারণে খুব রাগান্বিত হয়। রাগ প্রশমন করতে সরকারি বাহিনীকে পুরো কায়রোতে লুটপাট চালাতে আদেশ দেয়। সরকারী বাহিনী সেদিন বাজারঘাট, এমনকি মানুষের ঘরবাড়িতেও লুটতরাজ চালায়। এরপর দোকানপাট আর বহু বাড়িঘরে আগুন লাগিয়ে দেয়। হাকেম তার একান্ত খাস খাদেমকে বাইরের লুটপাট দেখে এসে রিপোর্ট করতে বলে। সে বাইরের পরিবেশ দেখে এসে সংক্ষিপ্ত কিন্তু ব্যপক অর্থবোধক শব্দে এভাবে ব্যক্ত করে, ‘স্বয়ং রোমানরাও যদি কায়রো দখল করত তাহলে এতো লুটপাট করতে পারত না।’ খাদেমের এই বক্তব্য শুনে উবাইদি শাসক হাকেম খুশিতে তাকে হত্যা করে ফেলে।[সিয়ারু আলামিন নুবালা ১৫/১৭৭]

৪০০ হিজরীতে উবাইদি শাসক হাকেমের আদেশে ‘দারুল উলুম মিসর’ ও ‘জামিয়া হাকিমিয়্যাহ কায়রো’ দুটো বড় দ্বীনি প্রতিষ্ঠান তৈরি করা হয়। সারাদেশ থেকে এই দুই প্রতিষ্ঠানে বড় বড় মুহাদ্দিস ও ফুকাহাদের নিয়োগ দেওয়া হয় এবং ব্যাপকভাবে তাদেরকে দ্বীন শিখানোর অনুমতি দিয়ে দেয়। ‘মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি’ এমন কিছু মনে হত লাগল সকলের। ওলামায়ে কেরাম অবাক হন। উবাইদিদের কাছ থেকে এমন কিছু কেউ আশা করেনি। তার এই কর্মকাণ্ডে শুধু সাধারণ জনগণই নয়; ওলামায়ে কেরামও ভাবতে লাগলেন, এবার হয়ত তাদের দুঃখের অবসান হবে। এই শাসক হয়ত ভালো কিছু করবে। সকলেই হাকেমের জন্যে খুব দোয়া করতে লাগল। কিন্তু তিন বছর পর দরসগাহ মসজিদ সব বন্ধ করে দেওয়া হয় এবং সেখানের নিয়োগকৃত সমস্ত ওলামাদের ধরে এনে হত্যা করা হয়। [আল ইবার ফি খবারি মান গবার ২/১৯৬, ইমাম যাহাবী]

দুঃশাসন, জুলুম অত্যাচার; জনজীবনে চরম দুর্ভোগ

উবাইদি সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা নিজেকে হালাল হারামের উর্ধ্বে মনে করত। সেই বৈশিষ্ট তার উত্তরসূরীদের মাঝেও ব্যাপক আকারে দেখা দেয়। অন্যায় অনুশাসন, জুলুম অত্যাচারের এমন পরিবেশ ছিল যে, শাসকদের যখন যা মন চাইত তাই আদেশ করত। সে আদেশ যদি কেউ ন্যূনতম অমান্য করত তাকে প্রকাশ্যে জবাই করে ফেলা হতো।

সমাজের বহুল প্রচলিত খাবার নিষিদ্ধ করে জনজীবনকে দুর্বিষহ করে তোলা

আজ-জাহেরের শাসনামলে একবার সে পুরো দেশে গরু জবাই নিষিদ্ধ করে দেয়। সেসময় মানুষের প্রধান খাদ্য ছিল এই গরুর গোস্ত । জনজীবনে এক কঠিন দুর্ভোগ শুরু হয়ে যায়। কসাইখানার বিশাল বাণিজ্য পুরো ধ্বসে পড়ে। খ্রিস্টানদের প্রতি উবাইদিদের এতই উতলা প্রেম ছিল যে, তাদের উৎসব উপলক্ষে তিনদিনের জন্যে জবাইয়ের অনুমতি দেওয়া হয়। পরে আবার আগের হুকুম জারি করে দেওয়া হয়। [ইত্তিয়াজুল হুনাফা ২/১৪৯]

আল-হাকেমের শাসনামলে ৪০২ হিজরিতে সে পাকা খেজুর, আঙুর ও আঙুর থেকে উৎপাদিত সকল বস্তু নিষিদ্ধ ঘোষণা করে বাজেয়াপ্ত করে নেয়। সারাদেশের সকল আঙুর জমা করে তা পুড়িয়ে দেওয়া হয়। যার পরিমাণ ছিল প্রায় বড় বড় আটহাজার মটকা। শুধুমাত্র এই জিনিষগুলো পুড়ানোর জন্যে পাঁচশত দিনার খরচ করা হয়। [আখবারু বানু উবাইদ পৃ.৯৮]

সে আঁশ ছাড়া মাছ, গবাদি পশুদের এক বিশেষ ধরনের খাদ্য ও একপ্রকার শাকসহ আরো বেশকিছু খাবার নিষিদ্ধ করে। ঘোষণা করা হয়, কেউ এগুলো বিক্রি করলে তাকে শায়েস্তা করা হবে। একবার কিছু লোকের ব্যাপারে অভিযোগ আসে, তারা এই পণ্য বিক্রি করেছে। এর শাস্তিস্বরূপ তাদেরকে বেধড়ক পেটানো হয়। অতঃপর তাদের আহত দেহগুলো পুরো শহর ঘুরানো হয় মানুষকে শিক্ষা দেওয়ার জন্যে। অতঃপর প্রকাশ্যে তাদের গর্দান উড়িয়ে দেওয়া হয়। [আখবারু বানু উবাইদ পৃ.৯৮]

বিভিন্ন বিধিনিষেধ আরোপ করে মানুষের মৌলিক অধিকার খর্ব করা

উবাইদিরা নিজেদের ক্ষমতা হারিয়ে যেতে পারে সর্বদা এই ভয়ে থাকত। তাদের শাসনামলে তারা প্রথমেই জনজীবনকে একদম সংকুচিত করে দেয়। সবরকম জন-জমায়েত নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। বহু ওলামা আর সাধারণ জনগণকে শুধু এই কারণে হত্যা করা হয় যে, তার কাছে মানুষ কেন জমা হয়। সে যুগে মানুষ ওলামায়ে কেরামের জানাযায় ব্যাপকভাবে অংশগ্রহণ করত। সেখান থেকে বিদ্রোহের সূচনা হতে পারে—এই ভয়ে ব্যাপক আকারে জানাযায় যাওয়া বন্ধ করে দেয়। সন্ধ্যার শুরুতেই একধরনের ঘণ্টা বাজানো হতো। এরপর কাউকে রাস্তায় পাওয়া গেলে রাষ্ট্রদ্রোহীর মামলায় তাকে হত্যা করে ফেলা হতো। [মাদরাসাতু আহলুল হাদিস ফিল কাইরাওয়ান পৃ.৭৬]

অত্যাচারের নিত্যনতুন কৌশল আবিষ্কার করা

ধর্মীয় বিষয়ে কাউকে হত্যা করা ছিল উবাইদিদের কাছে একটি স্বাভাবিক বিষয়। কত মানুষকে শুধু সাহাবাদেরকে মুহাব্বত করার কারণে হত্যা করা হয়েছে তার কোনো ইয়ত্তা নেই। এছাড়াও তাদের তৈরি কোনো হাস্যকর বিধানও কেউ যদি মানতে অস্বীকার করত, তাহলে তাকে কোনো কারণে হত্যা করা না হলে দুনিয়াতেই তাকে জাহান্নামের শাস্তি চাপিয়ে দেওয়া হতো। এই উদ্দেশ্যেই উবাইদি শাসক হাকেম একটি টর্চার সেল তৈরি করে। সেখানে অত্যাচারের এতসব ব্যবস্থাপনা করা হয় যে, সেটার নাম রাখা হয় ‘জাহান্নাম’। [সিয়ারু আলামিন নুবালা- ১৫/১৭৭]

ওলামায়ে কেরামের প্রতিরোধ

যেকোনো বদদ্বীন আর কুফরের সয়লাবে ওলামায়ে কেরামের প্রথম দায়িত্ব হলো উম্মাহকে সে বিষয়ে সতর্ক করা। ইমান-কুফর আর সুন্নাত-বিদয়াতের মাঝে স্পষ্ট পার্থক্যরেখা টেনে দেওয়া। হকপন্থি ওলামায়ে কেরাম খুব ভালো করেই বোঝেন, মুসলমানদের সবকিছুর মূল ও প্রথম হলো আকিদা। কেননা যতক্ষণ পর্যন্ত আকিদার কনসেপ্ট ঠিক না হবে, ততক্ষণ একজন মুসলিম সঠিক কর্মপন্থা নির্ধারণ করতে পারবে না। কারণ একজন মুসলিমের সামনে যখন ভিন্ন মতাবলম্বী কোনো ব্যক্তি বা ঘটনা আসে তখন প্রথমেই নির্ধারণ করতে হবে—ভিন্নমতের বিষয়টি কি ইমান-কুফর, সুন্নাহ-বিদয়াত না শাখাগত কোনো দ্বীনি বিষয়? এটা ঠিক না হলে সে শরীয়াহর আদলে সঠিক কর্মপন্থা নির্ধারণ করতে পারবে না।

উবাইদিদের দখলকৃত অংশের ওলামায়ে কেরাম যখন দ্বীনের এই বিকৃতি, সাহাবাদের গালিগালাজ আর কুফরের সয়লাব প্রত্যক্ষ করলেন সাথে সাথে গর্জে উঠলেন। মৃত্যুর ভয়কে পিছনে ঠেলে মৃত্যুর দুয়ারে দাঁড়িয়ে কাফের শাসকদের বিপরীত তাঁদের প্রথম দায়িত্ব আদায় করলেন এই ঘোষণা দিয়ে- ‘উবাইদি শাসকরা কাফের’। আর এর সাথে সাথে এই কুফরি শাসনব্যবস্থা আর বৈরী পরিবেশে দ্বীন রক্ষার এক অসম লড়াইয়ের সম্মুখীন হলেন ওলামায়ে কেরাম। প্রত্যেকেই নিজ নিজ জায়গা থেকে প্রতিরোধ গড়ে তুললেন। যেহেতু স্পষ্টই হয়েছে উবাইদিদের সাথে মুসলমানদের সম্পর্ক ইমান-কুফরের, তাই কেউই নিজ বিশ্বাস ও আকিদার জায়গায় সামান্যতম ছাড় দিলেন না। কারণ তারা খুব ভালো করেই বুঝতে পেরেছিলেন, কুফরি এই শাসনব্যবস্থার সাথে ন্যূনতম আপোষ করে নেওয়ার অর্থ হলো ইমান-কুফরের সীমারেখা চিরতরে মুছে ফেলা।

ওলামায়ে কেরাম এই কুফরি শাসন আর সম্পূর্ণ বৈরী পরিবেশে দ্বীন রক্ষার এক অসম প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। দ্বীনের বিধান অনুযায়ী তারা সেখান থেকে হিজরত করতে পারতেন। কিন্তু মৃত্যুমুখে সেখানেই তারা রয়ে গেলেন এবং শুধুমাত্র উম্মাহের ইমান রক্ষার্থে দ্বীন রক্ষার সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়ে গেলেন। আর পরবর্তীদের কর্মপন্থা নির্ধারণে রেখে গেলেন আদর্শ।

১. কুফর ও জিহাদের ফতোয়া দেওয়ার মাধ্যমে প্রতিরো

উবাইদিদের কুফরি বিষয়ে এবং তাদের বিরুদ্ধে জিহাদ ফরজ—সর্বপ্রথম এই বিষয়ে সকলকে সতর্ক করেন কাইরাওয়ানের সবচেয়ে বড় ফকিহ জাবালাহ ইবনে হাম্মাদ রহ.। কাইরাওয়ান শহর দখল নেওয়ার পর উবাইদুল্লাহ ইবনে মাইমুন সেখানকার জামে মসজিদে প্রথমবারের মত জুমার খুতবা দেওয়া শুরু করল। কিছুক্ষণ এই খুতবা শুনে উঠে দাঁড়ালেন জাবালাহ রহ.। নিজের রুমাল মাথা থেকে সরালেন। যাতে সকল মানুষ তাকে চিনতে পারে। মসজিদে উপস্থিত আলেম ও সাধারণ মুসল্লি সকলেই উৎসুক হয়ে দেখতে লাগলেন শায়খ কী করছেন? জাবালাহ রহ. সোজা মসজিদের দরজা অভিমুখে চলতে শুরু করলেন আর জোরে জোরে এই কথা বলে বের হয়ে যেতে লাগলেন—‘এরা আল্লাহর দ্বীনকে নষ্ট করছে। আল্লাহ ওদের ধ্বংস করে দিক’।

উপস্থিত আলেম ও সাধারণ মুসল্লিগণ শায়খের এই কাজ দেখলে তারাও উঠে যান। উবাইদিদের জুমার নামাজে উপস্থিত হওয়া এবং তাদের পিছনে নামাজ পড়া ছেড়ে দেন। [রিয়াজুন নুফুস ২/৪৩]

কাইরাওয়ানের বিশিষ্ট ফকিহ আবুল ফজল মুম্মাসি রহ. ফতোয়া জারি করেন, ‘উবাইদিদের বিরুদ্ধে জিহাদ করা প্রত্যেক মুসলমানের জন্যে ফরজ। ওরা হলো অগ্নিপুজকদের উত্তরসূরি, যারা ইসলামের নামকে চিরতরে মিটিয়ে ফেলতে চাইছে। মুশরিকদের বিরুদ্ধে জিহাদ করার চেয়ে এই রাফেজি উবাইদিদের বিরুদ্ধে জিহাদ করা বেশি উত্তম’।

একবার তিনি সকল মানুষকে জিহাদের প্রতি আহবান জানান। সকলে উত্তর দেন, আগামীকাল তারা বের হবে। তিনি সকালে এসে সকলের উদ্দেশে বলেন, ‘হে লোকসকল! আমি গতরাতে পুরো কুরআন পড়েছি। কিন্তু কোথাও এমন পাইনি যে বর্তমানে এই সময়ে উবাইদিদের বিরুদ্ধে জিহাদ থেকে বিমুখ থাকার কোনো সুযোগ আছে। [রিয়াজুন নুফুস ২/২৯৭ আবু বকর আল-মালেকি]

কাইরাওয়ানের ওলামায়ে কেরাম সম্মিলিত ফতোয়া জারি করেন, উবাইদিরা আহলুল কিবলা নয়, তারা কাফের। যে তাদের দাওয়াত কবুল করবে সে কাফের। তদ্রুপ তাদের সম্মানে যে খুতবা পড়বে সে কাফের। এখানে কোনোরকম আপত্তি গ্রহণ করা হবে না। এই ফতোয়ায় স্বাক্ষর করেন কাইরাওয়ানের বিশিষ্ট ওলামায়ে কেরাম; যাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন মারওয়ান ইবনে নসর, আবুল ফজল আল মুম্মাসি, আবুল আরব ইবনে তামিম, আবুল আরব ইবনে তামিমসহ ইরাকেরও বেশকিছু ওলামায়ে কেরাম। [মাদরাসাতু আহলিল হাদিস ফি কাইরাওয়ান পৃ.৭৮]

কাজি ইয়াজ রহ. বলেন, ‘কাইরাওয়ানের সমস্ত আলেম একমত যে, উবাইদিরা শরীয়তের বিপরীত প্রকাশ্যে যে কাজগুলো করেছে এতে ওরা মুরতাদ হয়ে গেছে। আর অন্তরে লালন করে যে শরীয়ত, তা বেকার হয়ে গেছে। সুতরাং তারা যিন্দিক হয়ে গেছে। ওদের বিধান হবে যিন্দিকদের মতো। অর্থাৎ তাওবা করলে তা কবুল হবে না, হত্যা করে ফেলতে হবে। [তারতিবুল মাদারেক ৭/২৭৭]

ওলামায়ে কেরাম হত্যার কিছু হৃদয়বিদারক কিছু নমুনা

উবাইদিদের সাথে আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাতের হিসাব-নিকাশ ছিল ইমান কুফরের। তাই ওলামায়ে কেরাম নিজেদের জীবনের ন্যূনতম পরোয়া না করে উম্মাহকে ধেয়ে আসা কুফর থেকে রক্ষা করেছেন। কতটা ভয়ংকর ছিল উবাইদিদের কুফরি ফিতনা আর এই ফিতনার মোকাবেলায় ওলামায়ে কেরামের কুরবানি তা খুব অল্পকথায় ফুটিয়ে তুলেছেন ইবনে নাজি রহ.। তিনি লেখেন, ‘আল্লাহ কাইরাওয়ানের ওলামায়ে কেরামকে উত্তম প্রতিদান দিক। তারা মৃত্যুকে মেনে নিয়েছেন, জেলে গিয়েছেন, শত জুলুম অত্যাচার সহ্য করেছেন। কিন্তু ধৈর্যধারণ করছেন; সেখান থেকে পালায়ন করেননি। যদি তাঁরা পলায়ন করতেন তাহলে উবাইদিদের প্রথম সয়লাবেই সমস্ত কাইরাওয়ানবাসি কাফের হয়ে যেত’। [মাআলিমুল ইমান ফি মারিফাতি আহলিল কাইরাওয়ান ২/১৩২]

এটা শুধুই কাইরাওয়ানের আলেমদের অবস্থাই নয়, উবাইদিদের দখলকৃত প্রতিটি অঞ্চলের ওলামায়ে কেরামের অবস্থাই এমন ছিল। কীরূপ ছিল সে সবর বা ধৈর্য? হক্বের ফতোয়া দেওয়ার কারণে কেমন পরিবেশের মুখোমুখি দাঁড়াতে হয়েছে ওলামায়ে কেরামের? তার শত নমুনা ইতিহাস আমাদের জন্যে সংগ্রহ করে রেখেছে। এর কিছু অংশ এখানে উল্লেখ করা সমীচীন মনে করছি। পাঠকের কাছে আবেদন, যদি দুর্বল হৃদয়ে অধিকারী হন তাহলে ঘটনাগুলো এড়িয়ে যাওয়াটাই ঠিক হবে।

যুগশ্রেষ্ঠ একজন ফকিহকে জীবিত চামড়া ছিলে হত্যা

উবাইদি সাম্রাজ্যের চতুর্থ শাসক আল-মুয়িজের শাসনামল। পূর্বসূরীদের মত সেও যে অঞ্চল দখল করত সেখানের আলেমদের বন্দি-গুম-খুন শুরু করে দিত। সে সময় রামালার প্রসিদ্ধ ফকিহ ছিলেন আবু বকর আননাবুলুসি রহ.। তিনি শুরু থেকেই উবাইদিদের দ্বীন বিকৃতি, সাহাবাদের গালিগালাজ, আহলুস সুন্নাহদের হত্যা ও তাদের বিভিন্ন কুফরি বিষয়াবলির রাষ্ট্রযন্ত্রের সাহায্যে প্রকাশ্য প্রচার এই সবকিছুই জানতেন। স্পষ্টভাবে উবাইদিদের বিরুদ্ধে ফতোয়া দিলেন- ‘উবাইদিরা কাফের এবং তাদের বিরুদ্ধ জিহাদ করা ফরজ’। উবাইদিরা তার গ্রেফতার পরোয়ানা জারি করল। তিনি রামালা থেকে গোপনে অন্যত্র চলে গেলেন এবং একটি দীর্ঘসময় মুসলিমদেরকে উবাইদিদের কুফরি শাসনব্যবস্থা থেকে সতর্ক করতে লাগলেন। অবশেষে শামের গভর্নর আবু মাহমুদ নাবুলুসি রহ.কে গ্রেফতার করে ফেলল। গ্রেফতার করেই এই মহান ফকিহকে একটি কাঠের কুঠুরিতে বন্দী করে কায়রো পাঠিয়ে দেওয়া হলো। এক বছর তিনি সেখানের জেলে বন্দি ছিলেন। সে সময় উবাইদি সাম্রাজ্যের প্রধানমন্ত্রী ছিল রোমান বংশীয় জাওহার। সে ফকিহ আবু বকর আননাবুলুসি রহ.কে দরবারে ডেকে এনে জিজ্ঞাসা করল,
-‘আপনি নাকি আমাদের বিরুদ্ধে ফতোয়া জারি করেছেন, মুসলমানদের কাছে যদি দশটি তীর থাকে তাহলে তার একটি রোমানদের বিরুদ্ধে আর বাকি নয়টি উবাইদিদের বিরুদ্ধে চালানো ফরজ?’
নবির ওয়ারিস এই মর্দে মুজাহিদ গর্জে উঠে বললেন,
-‘তুমি ভুল শুনেছ। এটা আমার ফতোয়া না। আমার ফতোয়া ছিল, মুসলমানদের কাছে যদি দশটি তীর থাকে তাহলে তার সবগুলোই তোমাদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা ফরজ। কারণ তোমরা আল্লাহর দ্বীনকে শেষ করে দিয়েছ। নেককারদের হত্যা করেছ। হেদায়াতের নুর মিটিয়ে দিচ্ছ’।
জাওহার এই উত্তর শুনে ক্ষিপ্ত হয়ে যায়। মানুষের চামড়া ছিলতে পারে এমন এক ইহুদিকে ডেকে এনে নাবুলুসি রহ.কে সামনে দাঁড় করিয়ে আদেশ করে, এই বেয়াদবের চামড়া ছিলে ফেলো।

এভাবে জীবিত অবস্থায় ইহুদি মাথার উপরিভাগ থেকে চামড়া ছিলা শুরু করে দেয়। অন্তর বিদীর্ণ করে দেয় এমন জঘন্য অত্যাচারের পরেও নাবুলুসি রহ. এই কাফেরদের কাছে কোনোরকম দয়া ভিক্ষা চাননি। একদম নির্লিপ্ত হয়ে দাঁড়িয়ে কুরআন তেলাওয়াত করছিলেন। চামরা ছিলতে ছিলতে যখন বুক পর্যন্ত আসল তখন পাষাণ ইহুদিরও হৃদয়ও হয়তবা কেঁপে ওঠে। সে হাতের ছুরি নাবুলুসি রহ.-র বুকের মধ্যে গেঁথে দেয়। তিনি সেখানেই মৃত্যুবরণ করেন।

এই মর্মান্তিক মৃত্যুদণ্ডের খবরে সবাই কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে যায়। ইমাম দারাকুতনী রহ.-র সামনে যখনই আবু বকর নাবালুসি রহ.-র আলোচনা উঠতো তিনি এই মৃত্যুর কথা স্মরণ করে কাঁদতে থাকতেন। [সিয়ারু আলামিন নুবালা ১৬/১৪৮-৪৯]

বয়োবৃদ্ধ একজন আলেমকে পা দিয়ে মাড়িয়ে হত্যা

মুহাম্মদ ইবনে খাইরুন আলমায়াফি রহ. ছিলেন একজন বয়োবৃদ্ধ আলেম। উবাইদিদের কাইরাওয়ান দখল করার পর তিনি যখন তাদের থেকে একের পর এক দ্বীনের বিকৃতি দেখতে লাগলেন তখন স্পষ্ট ফতোয়া দিলেন, ‘উবাইদিদের সাথে জিহাদ করা মুসলমানদের উপর ফরজ। আর উবাইদুল্লাহ মিথ্যুক, যিন্দিক’। উবাইদুল্লাহের কানে এই সংবাদ পৌঁছলে সে কাইরাওয়ানের গভর্নর ইবনে আবি খিনজিরকে আদেশ দেয়, মুহাম্মদ ইবনে খাইরুনকে গ্রেফতার করে এনে পা দিয়ে মাড়িয়ে হত্যা করে ফেলতে। ইবনে আবি খিনজির তাই করল। মুহাম্মদ ইবনে খাইরুনকে দরবারে ধরে উপুড় করে শুইয়ে দিয়ে হাবশিদের আদেশ করল তার উপর লাফানোর। হাবশিরা তার উপর লাফাতে লাগল আর এভাবে তিনি মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়ে হক কথা বলে তাঁর রবের প্রিয় হয়ে গেলেন।

মুহাম্মদ ইবনে খাইরুন রহ. এর মৃত্যুর ঘটনা উল্লেখ করে ইমাম যাহাবী রহ. লেখেন, হায় আফসোস! যিন্দিক এই উবাইদুল্লাহর হাতে ইসলাম এবং মুসলমানদের কত কষ্টই না সইতে হয়েছে। [সিয়ারু আলামিন নুবালা ১১৪/২১৭]

দ্বীনের অপব্যাখ্যা না মানার কারণে হত্যা

উবাইদি সাম্রাজ্যের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনকারী উবাইদুল্লাহর যুগ। কাইরাওয়ান দখল করার পর আফ্রিকার সবচেয়ে সবুজ-শ্যামল অঞ্চল রাক্কাদায় অবস্থান করছিল উবাইদুল্লাহ। চতুর্দিক থেকে ওলামায়ে কেরাম এই সাম্রাজ্যের বিরোধিতা শুরু করেন। সে সময়ে আফ্রিকা অঞ্চলের প্রসিদ্ধ আলেম ইবরাহিম ইবনে বারদুন এবং আবু বকর ইবনে হুজাইল ছিলেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম। তাঁরা দুজন সমানভাবে উবাইদুল্লাহ এবং তার সাম্রাজ্যের বিরোধিতা করতে থাকেন। মানুষকে স্পষ্ট করে বোঝাতে থাকেন এই সাম্রাজ্যের কুফরি ও ক্ষতিগুলো।

২৯৯ হিজরীর সফর মাসে তাদের দুইজনকে একসাথে গ্রেফতার করে আবু আব্দুল্লাহ শিয়া রাক্কাদায় নিয়ে আসে। গ্রেফতারকৃত যুগের শ্রেষ্ঠ দুই আলেমকে রাজদরবারে নিয়ে আসা হয়। উবাইদুল্লাহ ইবনে মাইমুন তখন রাজ সিংহাসনে বসা ছিল। তার ডানে ছিল আবু আব্দুল্লাহ শিয়া এবং বামে ছিল তার ভাই আবুল আব্বাস। আবু আব্দুল্লাহ শিয়া দুজনকে লক্ষ্য করে জিজ্ঞাসা করল,
-‘তোমরা কী স্বীকার করো, আমাদের ইমাম উবাইদুল্লাহ আল্লাহর প্রেরিত রাসূল?’
নির্লিপ্ত কিন্তু সমস্বরে উভয় আলেম একসাথে উত্তর দিলেন,
-‘যদি উবাইদুল্লাহর ডান দিকে সুর্য আর বাম দিকে চন্দ্র থাকত আর সে চন্দ্র-সুর্য স্বাক্ষী দিত যে, উবাইদুল্লাহ আল্লাহর রাসূল, তাও আমরা তা অস্বীকার করতাম’।

উবাইদুল্লাহ এই জবাব শুনে ক্ষিপ্ত হয়ে গেল। কাইরাওয়ানের গভর্নর ইবনু আবিল খিনজিরকে আদেশ দিল ইবনে হুজাইলকে পাঁচশত বেত্রাঘাত এবং ইবনে বারদুনের গর্দান উড়িয়ে দেওয়ার। কিন্তু গভর্নর ভুলে ইবনে হুজাইল রহ.কে হত্যা করল আর ইবনে বারদুনকে করল বেত্রাঘাত। পরেরদিন যখন ভুলের কথা জানা গেল তখন ইবনে বারদুন রহ.কে ডেকে আনা হল।
-‘কিরে শুয়োর’! ইবনে বারদুন রহ. গভর্নর ইবনে আবিল খিনজিরের সামনে এসে দাঁড়াতেই গভর্নর তাকে সম্বোধন করে বলল।
-‘কে শুয়োর তা শুয়োরের গুণাবলি থেকেই চেনা যায়’। ইবনে বারদুন রহ. তৎক্ষণাৎ জবাব দিলেন। এরকম কঠোর জবাব শুনে ইবনে আবিল খিনজির ক্ষিপ্ত হয়ে হত্যার আদেশ দেয়। জল্লাদ হত্যার জন্যে যখন ইবনে বারদুন রহ.-র গায়ের জামা খুলছিল তখন পুনরায় আবার জিজ্ঞাসা করল,
-‘তুমি তোমার অবস্থান থেকে ফিরে আসবে?’
-‘আমি কী ইসলাম ধর্ম থেকে ফিরে যাবো?’ দৃঢ়তার সাথে উত্তর দিলেন ইবনে বারদুন রহ.। অতঃপর তাকে শূলে চড়িয়ে হত্যা করা হয়। [সিয়ারু আলামিন নুবালা ১৪/২১৮]

কত সংখ্যক ওলামায়ে কেরাম হত্যা করা হয়েছিল?

সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠাতা উবাইদুল্লাহ ইবনে মাইমুন খুব ভালোভাবেই বুঝতে পেরেছিল দ্বীন বিকৃতি আর কুফরি ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় সবচেয়ে বড় বাধার সম্মুখীন হতে হবে ওলামায়ে কেরামের পক্ষ থেকে। তাই শুরু থেকেই তার রাজনৈতিক পলিসি এটাই হাতে নেয় যে—‘হয় আপোষ করো, নয় মৃত্যুকে মেনে নাও’।

এই পলিসিকে সামনে রেখে উবাইদিরা কেমন সংখ্যক ওলামায়ে কেরামকে হত্যা করেছে, ইতিহাস তার কোনো নিশ্চিত পরিসংখ্যান আমাদেরকে দেয় না। ইতিহাস পরিসংখ্যান দিতে ব্যর্থ হলেও এমনকিছু ঘটনা উপস্থাপন করেছে, যা ভয়াবহতার সামগ্রিক একটি চিত্র আমাদের সামনে তুলে ধরে।
কাইরাওয়ানে উবাইদুল্লাহর নিয়োগকৃত গভর্নর ছিল ইবনু আবিল খিনজির। নামের মতই শুকর কিসিমের লোক ছিল সে। উবাইদি সাম্রাজ্যের জন্যে শত শত মানুষকে হত্যা করেছে কোনোরকম দ্বিধাদ্বন্দ্ব ছাড়াই। কিন্তু উবাইদুল্লাহর হাতে যখন সে এত অধিক পরিমাণ আলেমকে হত্যা হতে দেখল, তখন সহ্য করতে না পেরে বিদ্রোহ করে বসলো। পরে এই কারণে উবাইদুল্লাহ নিজেই তাকে হত্যা করে ফেলে।[সিয়ারু আলামিন নুবালা ১৪/২১৭।

সাধারণ দ্বীনদার মানুষের ত্যাগ ও কুরবানি

উবাইদিদের বিরুদ্ধে এই অসম প্রতিরোধে শুধু ওলামায়ে কেরামই নন; সাধারণ দ্বীনদার জনগণও হক্ব কথা বলে নিজের জীবন বিলিয়ে দিতে পিছপা হয়নি। অসম এই প্রতিরোধে তারাও ছিল ওলামায়ে কেরামের সাথি।

কাইরাওয়ানের ‘মসজিদে কাজি ইয়াজ রহ.’-র মুয়াজ্জিন ছিল উরুস নামক এক ব্যক্তি। সরকারি হুকুম জারি করা হলো, ‘আসসালাতু খারুম মিনান নাউমের’ জায়াগায় ‘হাইয়া আলাল খাইর মুহাম্মদ ও আলি খাইরুল বাশার’ বলতে হবে। উরুস এই বিদয়াত মানল না। সকালের আজানে প্রতিদিনের মত সে ‘আসসালাতু খাইরুম মিনান নাউম’ বলল। শহরের গভর্নর তাকে গ্রেফতার করে নিয়ে গেল। এই অপরাধের শাস্তি হিসেবে প্রথমে তাকে বেধড়ক পিটানো হলো। অতঃপর চাকু দিয়ে তার পুরো শরীর ক্ষত-বিক্ষত করল। জিহ্বা ছুঁড়ি দিয়ে কেটে তার দুইচোখ উপড়ে ফেলা হলো। তখনও সে জীবিত ছিল। এই অবস্থায় গাধার পিঠে চড়িয়ে তাকে পুরো কাইরাওয়ান শহরে ঘোরানো হয়। শেষে বর্শা দিয়ে হত্যা করে তাকে শহরে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়। [আলমিহান ২৯৪ পৃ., আবুল আরব তামিমি]

উবাইদুল্লাহ ইবনে মাইমুনের আমলে কাইরাওয়ানের এক মসজিদে রাফেজি এক বৃদ্ধলোক তার দলবল ও ঘোড়া নিয়ে ঘুমাত। স্থায়ী বাসিন্দারা মসজিদের এই অবমাননা সহ্য করতে না পেরে তাদেরকে নিষেধ করলে তারা উত্তর দেয়,
-‘এই ঘোড়ার মল-মূত্র পবিত্র। এগুলো মাহদির সৈনিকদের ঘোড়া’।
-‘যেখানে মাহদির নিজের মলমূত্র অপবিত্র সেখানে তার ঘোড়ার মলমূত্র কীভাবে পবিত্র হয়?’
মসজিদের জিম্মাদার তাদের এই ভ্রান্ত কথার জবাবে এই প্রশ্ন রাখলেন। রাফেজি সেই বৃদ্ধ কোনো উত্তর দিতে না পেরে ক্ষিপ্ত হয়ে বলল,
-‘তুই হযরত মাহদির ব্যাপারে অবমাননাকর কথা বলিস?’
এটা বলেই সে মসজিদের জিম্মাদারকে গ্রেফতার করে উবাইদুল্লাহর কাছে নিয়ে আসে। উবাইদুল্লাহ সব শুনে হত্যার আদেশ দেয়। [আল বায়ানুল মুগরিব ১/২৮৪]

আল মুয়িজের শাসনকালে বাইতুল মাকদিসে একলোক আজানে কেন ‘হাইয়া আলাল ফালাহ’ বলেছিল এই অপরাধে তার জিহ্বা কেটে ফেলা হয়। [আররাওজাতাইন ফি আখবারিদ দাওলাতাইন ২/২২১, আবু শামাহ আলমাকদেসি]

২. জিহাদে অংশ গ্রহণের মাধ্যমে প্রতিরোধ

উবাইদিদের বিরুদ্ধে ওলামায়ে কেরাম জিহাদকে এতটাই আবশ্যক মনে করতেন যে, এইজন্যে তাঁরা খারেজিদের সাথে জোট করতেও পিছপা হননি। উবাইদিদের দ্বিতীয় শাসক আল-কায়েমের সময়ে আবু ইয়াজিদ নামক এক খারেজি বিদ্রোহ করে বসে। সেসময় বিশিষ্ট ফকিহ আবু ইসহাক রহ. এই কথা বলে একদল বিশাল জামাত নিয়ে খারেজিদের সাথে জিহাদে রওয়ানা হন,
-‘এই দল (খারেজিদের দিকে ইশারা করে) হলো আহলে কিবলা। আর উবাইদিরা হলো কাফের। সুতরাং আমাদের উপর ফরজ হলো, আহলে কিবলার সাথে মিলে আল্লাহর এই শত্রুদের সাথে যুদ্ধ করা’।[রিয়াজুন নুফুস ২/২৩৯]

সে সময় আফ্রিকা অঞ্চলের সর্বজন শ্রদ্ধেয় আলেম রাবী আলকাত্তান রহ. ছিলেন অন্যতম। যিনি সর্বপ্রথম উবাইদিদের বিরুদ্ধে জিহাদের ফতোয়া দিয়েছিলেন। তিনি বয়স্ক অবস্থায়ও বিভিন্ন মজলিসে গিয়ে গিয়ে মানুষদের জিহাদের ফাজায়েল বলে উবাইদিদের বিরুদ্ধে জমা করতে লাগলেন। বাহিনী রওয়ানা যেদিন হবে ঐদিন তিনি সম্পূর্ণ অস্ত্র সজ্জিত হয়ে জিহাদের প্রথম কাতারে এসে দাঁড়ালেন। গলায় একটি কুরআন ঝুলিয়ে নিলেন। তার আশপাশে মুজাহিদিনরা অস্ত্র সজ্জিত হয়ে জমা হতে লাগল। এই দৃশ্য দেখে জামানার এই শ্রেষ্ঠ ফকিহ খুশিতে আল্লাহর দরবারে হাত তুলে দোয়া করতে লাগলেন, ‘সমস্ত প্রশংসা একমাত্র আল্লাহর যিনি আমাকে এত সময় জীবিত রেখেছেন, ফলে আমি এমন একটি দলের সাথে একত্রিত হতে পেরেছি যারা তাঁর শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াই করবে এবং তাঁর দ্বীনকে বিজয়ী করবে। হায় আল্লাহ! কোন আমলের বদৌলতে আজকের এই মহান কাজে আমি আসতে পেরেছি তা আমি জানিনা।’

এই কথা বলে তিনি এত কাঁদলেন যে, তাঁর দাঁড়ি ভিজে গেল। কান্না শেষ করে মুজাহিদিনদের জামাতের দিকে লক্ষ্য করে তিনি বললেন, ‘আজ যদি মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জীবিত থাকতেন তাহলে তোমাদের এই জামাত দেখে কতইনা খুশি হতেন।’

এরপর তিনি কুরআন-সুন্নাহর আলোকে জিহাদ সম্পৃক্ত এক তেজোদীপ্ত ভাষণ দেন। এতে সকলে খুব উদ্বুদ্ধ হয়। যুদ্ধের শুরু থেকেই হযরত রাবী আলকাত্তান রহ. সম্মুখভাগে থেকে লড়াই চালিয়ে যান। ওলামায়ে কেরাম, সাধারণ দ্বীনদার ও খারেজিদের সম্মিলিত লড়াইয়ে মুসলমানরা বিজয় অর্জন করে ফেলে। উবাইদিরা পালিয়ে ‘মাহদিয়্যাহ’ শহরে ঢুকে যায়। ওলামায়ে কেরাম শহর অবরোধ করে ফেলেন। ঠিক এই মুহুর্তে খারেজিরা গাদ্দারি করে পিছনে হটে যায়। উবাইদিরা এই দৃশ্য দেখে সুযোগ মনে করে শহরের বাহিরে এসে মুসলিমদের উপর আক্রমণ করে বসে। ওলামায়ে কেরাম জীবনের শেষ পর্যন্ত লড়তে লাগলেন। হযরত রাবী আলকাত্তানসহ ৮৫জন বিখ্যাত ওলামায়ে কেরাম সেই যুদ্ধে শহিদ হন এবং বাকিদের প্রায় অধিকাংশই আহত হন। [রিয়াজুন নুফুস ২/৩৪৪]

উবাইদিদের উদ্দেশ্য ছিল রাবী আল কাত্তান রহ.কে জীবিত ধরা। যাতে তাকে ভয়ংকর শাস্তি দিতে পারে। কিন্তু আল্লাহ তার এই মাহবুব বান্দাকে শাহাদাতের উচ্চ মাকাম দিয়ে এই যিন্দিকদের অত্যাচার থেকে হিফাজত করেছেন। [সিয়ারু আলামিন নুবালা ১৫/১৫৬]

৩. উবাইদিদের সাথে সবরকম সম্পর্ক ছিন্ন এবং উবাইদিদের সাথে সম্পর্ক রাখত এমন আলেমদের সাথে সম্পর্কচ্ছেদ করার মাধ্যমে প্রতিরোধ

উবাইদিদের থেকে দ্বীন ইসলাম ও মুসলমানদের রক্ষা করার ব্যাপারে ওলামায়ে কেরাম ছিলেন শতভাগ কঠোর। একটি মুসলিম সাম্রাজ্যে ওলামায়ে কেরামের যতধরনের রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব হতো, সব ধরনের রাষ্ট্রীয় কাজ থেকে বিরত হয়ে গেলেন। কাজির পদ ছেড়ে দেওয়া, উবাইদি শাসকদের পিছনে নামাজ না পড়া ইত্যাদি, সবধরনের কাজ থেকে নিজেরাও বিরত হলেন; সবধরনের মানুষকেও বিরত রাখলেন। পরিবেশ এমন হয়েছিল যে, কেউ যদি উবাইদিদের অত্যাচারের ভয়ে রাষ্ট্রের সাথে ভালো সম্পর্ক করতে চাইত, তাদের থেকেও ওলামায়ে কেরাম ও সাধারণ জনগণ সম্পূর্ণ বারাআত ঘোষণা করে দিতেন এবং সামাজিকভাবে বয়কট করে তাকে একঘরে করে ফেলতেন।

কাইরাওয়ানের সবচেয়ে বড় ফকিহ এবং স্বনামধন্য আলেম জাবালাহ রহ. এবিষয়ে ছিলেন অনেক কঠোর। কখনও যদি জানতে পারতেন কোনো মুসলমান হিকমাহ বা কোনো কৌশলের দোহাই দিয়ে অথবা উবাইদিদের অত্যাচার থেকে বাঁচার জন্যে উবাইদি শাসকদের সাথে কোনো রকম আঁতাত করার চেষ্টা করছে, তিনি তাদের থেকে সম্পর্ক ছিন্নের প্রকাশ্য ঘোষণা দিতেন। এমনকি বদদোয়াও করতেন। একবার তিনি খবর পেলেন একদল দুনিয়ালোভী আলেম আবু আব্দুল্লাহ শিয়ার দরবারে যাচ্ছে, তার সাথে আঁতাত করতে। তৎক্ষণাৎ তিনি বদদোয়া করলেন, ‘হে আল্লাহ! যারা আবু আব্দুল্লাহ শিয়ার কাছে তাকে সালাম জানাতে যাচ্ছে তাদের জীবন থেকে তুমি শান্তি উঠিয়ে নাও আর তাদের জীবন দুঃখ দিয়ে ভরে দাও’। বদদোয়া সাথে সাথে লেগে গেল। এই দল যখন আবু কুরাইব নামক অঞ্চলে পৌঁছলো, একদল ডাকাতের কবলে পড়ে গেল। ডাকাতরা তাদের এত কঠিনভাবে লুণ্ঠন করল যে, সকলের কাপড় পর্যন্ত খুলে নিয়ে গেল। শায়খ জাবালা রহ.-র কাছে যখন লুণ্ঠনের সংবাদ পৌঁছলো তখন বললেন, এদের এই অপদস্থতায় আমার কোনো দুঃখ নেই। শুধু আফসোস ঐ লোকটি যদি তাদের সাথে না থাকত। ঐ লোকটি ছিল কাইরাওয়ানের সাবেক বিচারপতি–হাম্মাস ইবনে মারওয়ান।[রিয়াজুন নুফুস ২/৪৩]

মুসলমানদের ইমানের হিফাজতের জন্যে উবাইদিদের থেকে সম্পর্কচ্ছেদে ওলামায়ে কেরাম কত বিরল বিরল দৃষ্টান্তই পরবর্তী উম্মাহকে তাদের কর্মপন্থা ঠিক করার জন্য রেখে গেছেন। আল্লাহ তাদের সকলের কবরকে জান্নাতের নেয়ামাত দ্বারা ভরে দিক। আমীন।

আবু মাইসারা আলকাইরাওয়ানি রহ. ছিলেন অন্ধ। তৃতীয় উবাইদি শাসক আল-মানসুর তাকে কাজি হওয়ার প্রস্তাব দেয়। ‘আমি অন্ধ মানুষ। আমি কিভাবে কাজির মত এত বড় পদের দায়িত্ব সামলাবো’ বায়োবৃদ্ধ এই আলেম সুকৌশলে এভাবে এড়িয়ে যেতে চাইলেন। কিন্তু তিনি বুঝতে পারলেন উবাইদিদের হাত থেকে তিনি বাঁচতে পারবেন না। তারা তাকে কাজির পদ দিয়েই ছাড়বে। তখন মুসলমানদের ইমান রক্ষার্থে তিনি আল্লাহর কাছে মৃত্যু কামনা করে ফেললেন, ‘হে আল্লাহ যৌবনে আমি তোমার সাথে সম্পর্ক করেছি। এখন এই বুড়ো বয়সে তুমি এমন কাফেরকে আমার উপর চাপিয়ে দিওনা’।

আবু মাইসারা রহ. মুসতাজাবুদ দাওয়াহ ছিলেন। আল্লাহ সাথে সাথে তাঁর দোয়া কবুল করলেন। ঐদিন আসরের সময় তিনি তাঁর আসল বন্ধুর নিকট চলে গেলেন। [সিয়ারু আলামিন নুবালা ১৫/৩৫৬]

উবাইদিরা খুব ভালো করে বুঝত, যদি ওলামায়ে কেরাম আমাদের সাথে মিলে যায় বা অন্তত আমাদের সাথে উঠাবসা করে বা আমাদের ব্যপারে ভাল ধারনা হলেও রাখে, তাহলে সাধারণ মানুষকে আমাদের মতবাদ খুব সহজে গিলিয়ে ফেলানো যাবে। বেশকিছু আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাতের আলেমদের তারা তাদের এই কুমতলবে ফাঁসিয়ে দেয় এবং এদের দেখিয়ে মানুষকে গোমরাহ করার ছক কষতে থাকে। ওলামায়ে কেরাম উবাইদিদের এই চাল খুব ভাল করেই ধরতে পেরেছিলেন। উবাইদিদের সম্পর্কে ভালো ভাবে বা উঠাবসা করে এমন সকল আলেমকে সামাজিকভাবে বয়কট করা হয়।

এমনই একজন আলেম ছিলেন আবুল কাসেম আল-বারজায়ী। অনেক যোগ্যতা সম্পন্ন একজন আলেম ছিলেন। তার লিখিত কিতাবাদি আলেম সমাজে প্রসিদ্ধ ছিল। কিন্তু যখন তিনি উবাইদিদের সাথে উঠাবসা শুরু করলেন, ওলামায়ে কেরাম ষ্পষ্ট ঘোষণা দিলেন-‘আবুল কাসেম আলবারযায়ীর কিতাব পড়া আর কারো জন্যে বৈধ হবে না’। আর এভাবেই তার সকল কিতাব ইতিহাসের পাতা থেকে হারিয়ে গেল। [আদদাওলাতুল ফাতেমিয়্যাহ পৃ.৮২, আলি সাল্লাবি]

উবাইদিরা তাদের এই কুফরি আর বিকৃত দ্বীনের দাওয়াতের বিপরীত সহিহ ও সুন্নাহসম্মত দ্বীনের প্রচার যেন না হয় এইদিকটিও খুব ভাল করে খেয়াল রাখছিল। তারা শহর দখল করে প্রথমেই যে বিষয়টি বেশি প্রচার করত তা হলো—‘তোমরা যে ইসলাম শিখেছ তা ভুল। তোমাদের আলেমরা তোমাদের ভুল ইলম শিখিয়েছে৷ সঠিক ইলম আমরা তোমাদের শিক্ষা দিবো’। আজও বৈরী শাসকরা ওলামায়ে কেরামের বিপরীত এই কাজটিই করে!

৪. আহলুস সুন্নাহের আলেমদের লিখিত কিতাব সংরক্ষণ

উবাইদিরা যে শহর দখল করত প্রথমেই সেখানের ইসলামের স্মৃতিগুলো মুছে দিত। এতে শুধু মুসলিম স্থাপত্য শিল্পই ছিল না। আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাতের লিখিত কিতাবাদি যা পেত সবটাই বিলীন করে দিত। সেখানে রাফেজি আলেমদের লেখা বইপত্র রাষ্ট্রীয়ভাবে পড়ার আদেশ জারি করত। ইসলামের কত ইলমি তুরাস এই যিন্দিকগুলোর দ্বারা নষ্ট হয়েছে, তা আল্লাহই ভালো জানেন।

হযরত আবু মুহাম্মদ আব্দুল্লাহ ইবনে আবু হাশেম একজন বিখ্যাত আলেম। পূর্ববর্তী আলেমদের প্রচুর কিতাব তার সংগ্রহে ছিল। সেগুলো খুব ভালোভাবেই তিনি লুকিয়ে রাখতেন। একবার তিনি খুব অসুস্থ হয়ে গেলেন। সকলেই বুঝতে পারলেন তিনি হয়ত আর বেশিদিন বাঁচবেন না। তাঁর এক শাগরেদ আবু যায়েদ বলল, ‘হযরত! আপনার কাছে অনেক কিতাব আছে। আমার আশংকা হচ্ছে যদি আপনি মারা যান, প্রশাসন এই কিতাবগুলো বাজেয়াপ্ত করে ফেলবে৷ আপনি কিতাবগুলো বিভিন্ন মানুষের কাছে ছড়িয়ে দিন যাতে সরকারের হাতে পড়লে অল্প কিছু পড়ে’। হযরত আবু মুহাম্মদ ইবনে আবুল হাশেম রহ. এই প্রস্তাবে সম্মত হলেন। আবু যায়েদকে তার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে আদেশ দিলেন। আবু যায়েদ কিতাব তিন ভাগ করে একভাগ নিজের কাছে রেখে আর দুইভাগ অন্য দুইজনের কাছে খুব গোপনে পাঠিয়ে দিলেন।

পরদিন হযরত আবু মুহাম্মদের কাছে আসলে তিনি আবু যায়েদকে লক্ষ্য করে বলতে লাগলেন, ‘কিতাবগুলো ঘর থেকে বের করার পর থেকে আমি আর ঘুমাতে পারছি না। কিসের যেন এক শূন্যতা অনুভব করছি। তুমি আমার কিতাবগুলো আমায় ফিরিয়ে দাও’।

শাগরেদ আবু যায়েদ হতাশ হয়ে লুকিয়ে রাখা অন্য দুভাগ শায়খকে ফিরিয়ে দিলেন। এর কিছুদিন হযরত আবু মুহাম্মদ মারা যান। প্রশাসনের লোক তাঁর ঘরে কিতাব থাকতে পারে এই আশংকায় ঘর তল্লাশি করে। সেখানের সমস্ত কিতাব বাজেয়াপ্ত করে নিয়ে যায় এবং তা ধ্বংস করে ফেলে। শুধু মাত্র শাগরেদ আবু যায়েদের কাছের একতৃতীয়াংশ কিতাবই ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা পায়। [রিয়াজুন নুফুস ২/৪২৩]

এভাবে তারা যখন সহিহ দ্বীন ও সুন্নাহর শিক্ষা বন্ধ করে দিচ্ছিল এবং আহলুস সুন্নাহের সকল প্রাচীন ও বর্তমান কিতাবাদি ধ্বংস করে দিচ্ছিল, সেই মুহুর্তে ওলামায়ে কেরাম দ্বীন রক্ষার জন্যে নিজেদের জীবনকে ইলমের জন্যে বিলীন করে দিলেন।

হযরত আবু বকর ইবনে লাব্বাদ ছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম। তিনি নিজ ঘরে ইলম চর্চা জারি রাখলেন। খুব গোপনে আবু মুহাম্মদ ইবনে আবি যায়েদ ও আবু মুহাম্মদ বিন বাত্তান নামক দুজন শাগরেদ তার কাছে পড়তে আসত। ঘরের কোনো ফাঁক দিয়ে উবাইদিরা দেখে ফেলবে এই ভয়ে সবকের সময় কিতাবকে সকলে এমনভাবে জড়িয়ে ধরে রাখত, অনেক সময় এমন হতো যে, শরীরের ঘামে কিতাব ভিজে যেত। কারণ উবাইদিরা এই খবর জানতে পারলে এর এক মাত্র পরিণাম হবে ‘মৃত্যু’। [রিয়াযুন নুফুস ২/২৭৭]

৫. নিজেদের ঘরেই গোপন ইলমের মারকাজ তৈরি

উবাইদিরা ওলামায়ে কেরামের মধ্যে যাদের হত্যা করার তাদের তো হত্যা করছিলই; কিন্তু যাদেরকে হত্যা করতে পারছিল না তারাও যেন কোনোভাবে দ্বীন শিক্ষা না দিতে পারে সে জন্যে কঠোর আইন পাশ করে। প্রসিদ্ধ আলেমদের নির্দিষ্ট করে তাদের দরস, ওয়াজ মৃত্যু পর্যন্ত বন্ধ করে দিল। কিন্তু দ্বীন শিক্ষার মহান দায়িত্ব থেকে ওলামায়ে কেরামকে বিরত রাখতে পারল না উবাইদিরা। প্রত্যেক ওলামায়ে কেরাম জীবনের মায়া ত্যাগ করে নিজ নিজ ঘরকেই ইলমের গোপন মারকাজ বানিয়ে নিলেন। একেকজন আলেমের ঘর হয়ে উঠেছিল একেকটি মাদরাসা। আবু ইসহাক আসসিবায়ী রহ. জিহাদের ময়দানে শহিদ হওয়ার আগে নিজ ঘরে গোপনে ইলম চর্চার এমন পরিবেশ তৈরি করেছিলেন যে, সেটা একটা মাদরাসার রূপ ধারণ করেছিল। [মাআলিমুল ইমান ৩/৬৬]

৬. ভবিষ্যতপ্রজন্ম তৈরি

দ্বীন শিক্ষার এই গোপন প্রতিরোধের মাঝে আফ্রিকার কিছু আলেম ‘ইতিহাসের গতিপথ পালটে দেওয়া’ এক গোপন মিশন হাতে নিলেন।

উবাইদিদের শক্তির প্রধান উৎস হল তিনটি গোত্র। কুত্তামি, সানহানি ও বারবার। উবাইদিরা রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের বড় বড় দায়িত্ব সাধারণত এই তিন গোত্রের লোকদের মাঝেই রাখত। ওলামায়ে উম্মত খুব গভীরভাবে অনুধাবন করলেন, ‘যদি এই তিন গোত্রের সামনের প্রজন্মের মাঝে দ্বীনের সঠিক জ্ঞানের বীজ বোনা যায় তাহলে এক সময় এই প্রজন্মই আমাদের পক্ষে কথা বলবে’।

ওলামায়ে কেরাম খুবই চাতুর্যের সাথে নিজের জীবনের মায়া উপেক্ষা করে এই গোত্রগুলোর বাচ্চাদের ইলমে দ্বীন শিখানো শুরু করেন। কারণ ধরা পড়ার অপর নাম মৃত্যু বৈ কিছুই নয়। ধীরে তবে ফলদায়ক এই প্রচেষ্টার সর্বপ্রথম রাষ্ট্রীয়ভাবে ফলাফলের মুখ দেখে ৪০৬ হিজরির পরে।

সানহানি গোত্রের মুয়িজ ইবনে বাদিস ছিলেন তিউনিসিয়ার শাসক। ছোটবেলায় তার অজান্তেই মনের গহীনে আহলুস সুন্নাহের বীজ বপন করে দিয়েছিলেন ওলামায়ে কেরাম। কালের পরিবর্তনে একসময় তা আহলুস সুন্নাহের জন্যে ছায়াদায়ক এক বিশাল বটগাছের রূপ ধারণ করে।

একবার ইদের জামাত পড়তে বের হয় তিউনিসিয়ার এই কিশোর শাসক মুয়িজ। বয়স তখন আট বছরের কিছু বেশি। সেজেগুজে গোলাম আর সৈন্যের বহর নিয়ে ইদগাহের দিকে যাচ্ছিলেন। হঠাৎ কোনো এক কারণে ঘোড়া থেকে পড়ে যান তিনি। মনের অজান্তেই সাহায্যের জন্যে মুখ দিয়ে বের হয়ে আসে ‘হযরত আবু বকর ও হযরত ওমরের’ নাম। স্থানীয় আহলুস সুন্নাহর জনগণ হতভম্ব হয়ে গেল। যে দেশে আবু বকর আর ওমরের নাম নিলে হত্যা করা হয় সেখানের শাসক কিনা বিপদে এই দুজনের নাম মুখে নিচ্ছেন। ঘনকালো মেঘের মাঝে হঠাৎ কিরণের একটু বিচ্ছুরণ দেখতে পেল সকলে। তাহলে কি শাসক মুয়িজ একজন…! ভাবতে পারল না আর সামনে। এদিকে মুয়িজের সাথে থাকা শিয়া সিপাহিরা নিজ শাসকের মুখে হযরত আবু বকর আর ওমরের নাম শুনে যেন পাগলা কুকুরের মত ক্ষিপ্ত হয়ে গেল। একজন যিন্দিক(?) আমাদের শাসক এটা তারা সহ্যই করতে পারল না। তেড়ে আসল হত্যার জন্যে। মুয়িজের খাদেম আর গোলামরা তাঁর চারপাশ বেষ্টন করে সৈন্যদের হাত থেকে কোনোমতে রক্ষা করে চলছিল।

এক শতাব্দির বেশি সময় ধরে বুকে পাথর চাপা দিয়ে সাহাবাদের শানে অকথ্য গালিগালাজ সহ্য করছিল আহলুস সুন্নাহর অনুসারীরা। জীবিত থেকেও প্রতিদিন শতবার মৃত্যুবরণ করছিল তারা। যে সমাজে প্রকাশ্যে সাহাবাদের কুৎসা রটানো হয় সেখানে কোনো মুসলমানের জিন্দা লাশ হয়ে বেঁচে থাকা ছাড়া আর কোনো উপায় থাকে না। এতদিনের শত জুলুম অত্যাচারের নিকষ অন্ধকারের মাঝে আজ একটুখানি আশার প্রদীপ দেখা গেল। তাও এই জালেমগুলো মুছে ফেলতে চাচ্ছে!

সাহাবাদের শত্রুদের বিরুদ্ধে মনের গভিরে জমতে থাকা ঘৃণা আর ক্ষোভের স্ফুলিঙ্গ বারুদের মত জ্বলে উঠল। আমজনতা এবার আর নিজেদের ধরে রাখতে পারল না। মৃত্যু উপেক্ষা করে বুড়ো জোয়ান কিশোর যার হাতে যা ছিল তাই নিয়ে বের হয়ে আসল। মানব প্রাচীর হয়ে দাঁড়িয়ে গেল ছোট শাসক মুয়িজের সামনে। অত্যচারে জর্জরিত আশেকে সাহাবার ইশকের বারুদ সেদিন এমনভাবে ফেটেছিল যে, প্রশিক্ষিত আর অস্ত্রসজ্জিত তিনহাজার সৈনিককে আমজনতা কচুকাটা করে ফেলে। উবাইদিদের সাম্রাজ্যে তারা এই প্রথম এভাবে কচুকাটা হয়। [আল বায়ানুল মুগরিব ১/২৭৪]

সেদিনের জানবাজি রাখা আলেমদের গোপন মেহনত উবাইদিদের ধ্বংসের প্রথম ভিত রচনা করে। ছোট সেই মুয়িজ পরবর্তীতে আহলুস সুন্নাহর আকিদায় দাওলাতে সানাবিহি প্রতিষ্ঠা করেন এবং কাইরাওয়ান-সহ পশ্চিম আফ্রিকার সকল মুসলমানদের এই রাফেজি পিশাচদের থেকে মুক্তি দেন৷

এখানে আমাদের জন্যে সবচেয়ে বড় যে শিক্ষাটি রয়েছে তা হলো—সিস্টেমের মধ্যে সিস্টেম পরিবর্তনের এই মহাযজ্ঞে ওলামায়ে কেরাম কখনও নিজেদের আকিদার জায়গাটা বিসর্জন দেননি। বরং তাঁরা সর্বদা চৌকান্না থাকতেন এই মেহনত যেন আবার হিতে বিপরীত না হয়ে যায়।

আবু ইসহাক আল জিবিন্নানি রহ. কুত্তামি বংশের বাচ্চাদের কুরআন পড়াতেন। তিনি এর বিনিময়ে কোনো টাকা নিতেন না। কুত্তামি বিভিন্ন সরদারের ছেলেদের পড়ানোর সময় তিনি খুব সতর্ক থাকতেন, যেন তাঁর এই শিক্ষা আবার ইসলামের বিপরীতে ব্যবহার না করা হয়। কারণ এই বাচ্চারা যদি ইলম অর্জন করে রাফেজিই থেকে যায় তখন তারা তাদের অর্জিত ইলমকে রাফেজিয়্যাতের পক্ষে ব্যবহার করবে। এই আশংকা থেকেই তিনি কুত্তামি বাচ্চাদের কুরআন ও বিভিন্ন কিতাব পড়াতেন কিন্তু লেখা শেখাতেন না৷ তিনি বলতেন, ‘এরা কুরআন শিক্ষার দ্বারা মানুষকে তেমন ক্ষতি করতে পারবে না। যতটা না লেখা শেখার মাধ্যমে করতে পারবে।’ [মাদরাসাতু আহলুল হাদিস ফিল কাইরাওয়ান পৃ.৮০]

আল্লাহ আমাদের সালাফদের ভরপুর জাযায়ে খায়ের দান করুক। আমীন।

৭. বিরোধী দলীয়দের সাথে মুবাহাসা-তর্ক করে উম্মাহকে সতর্ক করা

উবাইদিদের অনুসারীদের মধ্যে অধিকাংশ লোক ছিল অজ্ঞ। তাদের মধ্যে যে সমস্ত রাফেজি আলেম ছিল তারা নিজেদের মতবাদ সম্পর্কে খুব দম্ভ প্রকাশ করত। ওলামায়ে কেরামকে প্রকাশ্যে চ্যালেঞ্জ করত। ওলামায়ে কেরামও নিজের জীবনের মায়া ত্যাগ করে প্রকাশ্যে এই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতেন। কারণ, এই মুনাজারাগুলোতে উবাইদিদের পক্ষের লোকদের হারানোর অর্থ ছিল জেল-জুলুম বা হত্যা। এই মুনাজিরদের মধ্যে আল্লামা আবু বকর আলকাম্মুদি, আব্দুল্লাহ ইবনে তাব্বান, ও আবু উসমান সাইদ ইবনে মুহাম্মদ রহ. উল্লেখযোগ্য।

একবার আবু উসমান রহ. আবু মুসা নামক এক রাফেজি সর্দারকে তাদের গোমরাহী ও কুফরের ব্যাপারে দলিলের পর দলিল দিয়ে নাজেহাল করে ফেলেন। দলিলে না পেরে সে মারাত্মক ক্ষিপ্ত হয়ে যায় এবং হযরত আবু উসমান রহ.-র দিকে বর্শা তাক করে। আবু আব্দুল্লাহ শিয়া কাছেই ছিল। সে দ্রুত এসে সর্দারকে বলল, ‘মহাদয় আপনি শান্ত হোন’। এরপর আবু উসমান রহ.কে লক্ষ্য করে বলতে লাগল, ‘আপনি যে লোককে রাগান্বিত করছেন জানেন সে ক্ষিপ্ত হলে তার সাথে আরো বারো হাজার মানুষও ক্ষিপ্ত হয়ে যাবে’?
-‘আমি তো এই কাজ করছি ঐ মহান প্রতাপশালী ক্ষমতার অধিকারীকে সন্তুষ্ট করার জন্যে যিনি আদ আর সামুদের মত শক্তিশালী জাতিকে ধ্বংস করে দিয়েছেন’। আবু উসমান উত্তর দেন। [রিয়াজুন নুফুস ২/৬২]

মুহাম্মদ ইবনে আসাদ আসসাদ্দিনী তখন কাজি ছিল। একবার আফ্রিকার বিশিষ্ট মুনাজির আলেম ইবরিম আয-যিব্বি রহ.-র সাথে সে একটা মাসায়েল নিয়ে তর্ক করে। ইবরাহিম যিব্বি রহ. তাকে একদম লা-জবাব করে দিলে সে ক্ষিপ্ত হয়ে যিব্বি রহ.কে দুররা মারার আদেশ দেয়। [মাআলিমুল ইমান ২/২৬২]

উবাইদিদের ব্যাপারে মুসলিম বিশ্বের ওলামায়ে কেরামের সম্মিলিত ফতোয়া

উবাইদিদের কুফরি সম্পর্কে সে অঞ্চলের মুসলমানরা শত অত্যাচার সত্ত্বেও স্পষ্ট বলেই যাচ্ছিলেন। মুসলিম ভূখণ্ডের অন্য যেখানেই এই ফিরকার সংবাদ পৌঁছেছে তারাও চুপ বসে থাকেনি। ব্যক্তি বিশেষ সম্মিলিত সব ধরনের ফতোয়া তারা প্রকাশ করতে থাকেন। এর মাঝে অন্যতম হলো আব্বাসী খলিফা আলকাদের বিল্লাহের তত্ত্ববধানে বাগদাদ, ইরাক ও অন্যান্য ওলামায়ে কেরামের সম্মিলিত ফতোয়া। ইমাম যাহাবী রহ. সেই ফতোয়ার চম্বুক অংশ উল্লেখ করেছেন।

‘মিশরের শাসক মানসুর আল-হাকেম, আল্লাহ তাকে ধ্বংস করুক। তার দাদা আফ্রিকা অঞ্চল দখল করে নিজেকে প্রতিশ্রুত মাহদি দাবি করেছিল। আল-হাকেম ও তার উত্তরসূরিরা নাপাক ও নিকৃষ্ট। খারেজি স্বভাবের ও মিথ্যুক। সকলেই অবগত আছেন যে, এই বংশের মিথ্যাদাবীর পক্ষে ব্যাপারের কোনো আলেমই মত দেয়নি। এই পুরো বংশের লোকেরা কাফের ও যিন্দিক। অগ্নি ও চন্দ্র-সূর্য পূজারিদের ধর্মবিশ্বাস অন্তরে লালন করে। এরা শরীয়তের দণ্ডবিধিকে অকার্যকর করে দিয়েছে। হালালকে হারাম করেছে। গণহারে মুসলিম হত্যা, নবিদের গালি দেওয়া, সাহাবাদের লানত করা ও নিজেদের ব্যাপারে খোদা দাবী করার মত অন্যায় করেছে’।

৪০২ হিজরিতে এই ফতোয়া প্রকাশ করা হয় যাতে সাক্ষর করেছেন শাফেয়ী মাজহাবের বিশিষ্ট ইমাম আবু হামেদ আল ইসফারায়িনী, হানাফি মাজহাবের বিশিষ্ট ফকিহ আবুল হুসাইন আল কুদুরি, শিয়াদের প্রসিদ্ধ আলেম নাহজুল বালাগাহ কিতাবের লেখক শরীফ মুরতাজা, এবং আবুল কাসেম আল-জাযারীসহ আরো অসংখ্য ওলামায়ে কেরাম।[সিয়ারু আলামিন নুবালা ১৫/১৩২, আল ইবার ফি খাবারি মান গাবার ২/২০০]

দুইশত আটষট্টি বছর ছিল উবাইদিদের শাসনকাল। সুলতান সালাহুদ্দিন রহ. ৫৬৭হি.তে এই সালতানাতকে সমূলে ধ্বংস করে দেন। এই পুরো তিন শতাব্দীর ওলামায়ে কেরামের ত্যাগ-তিতিক্ষা ও চেষ্টা-প্রচেষ্টা সামনে রাখলে একটি বিষয় আমাদের কাছে স্পষ্ট ফুটে ওঠে—আল্লাহ সমস্ত জালেমকে এক নিমিষেই শেষ করে দেন না। চারপাঁচজন ওলামা আর দ্বীনদারদের হত্যা আর জেলে বন্দী করলেই কোনো জালেম সমূলে ধ্বংস হয়ে যায় না। তার ধ্বংসের জন্যে আসমানের দিকে তাকিয়ে থেকেও কোনো লাভ নেই। যতক্ষণ পর্যন্ত নিজেদেরকে পরস্পর সংশোধন ও কুরআন-সুন্নাহর আলোকে যেকোনো পরিবেশের জন্য কর্মপন্থা ঠিক করে সে অনুযায়ী কাজ করব না ততদিন পর্যন্ত জালেমের জুলুম বাড়তেই থাকবে। শুধু তার পরিমাণ আর স্তর একটু কম-বেশি হবে। আল্লাহ আমাদের বুঝ দান করুন ও দ্বীনের হেফাজতের জন্যে কবুল করুক। আমীন।

উবাইদিদের ব্যাপারে সামগ্রিক মূল্যায়ন

উবাইদিরা প্রায় তিনশত বছর মুসলিম ভূখণ্ডের একটি বড় অংশ দখল করে প্রতাপের সাথে শাসন করেছে। নিজেদের শাসনকে ইসলামী শাসন হিসেবে উপস্থাপন করার জন্য সবধরনের ছলচাতুরির আশ্রয় তারা নিত। উবাইদিরা চাইত তাদের শাসনব্যবস্থা আর শাসকদের ব্যাপারে কেউ যেন টু শব্দ না করে। বরং তারাই ইসলামের একমাত্র সঠিক প্রতিনিধি এই স্বীকৃতি সকলেই দিক। কারণ উবাইদিরা খুব ভালো করেই বুঝতে পেরেছিল, কোনো ধর্মচ্যুত ব্যক্তি বা কোনো কুফরি শাসনব্যবস্থা মুসলিমরা কখনও মেনে নিবে না। বারবার সে শাসনব্যবস্থা থেকে বের হয়ে আসার জন্য এবং উম্মাহকে সেই শাসনব্যবস্থার অকল্যাণ থেকে মুক্ত করার জন্য ওলামায়ে কেরাম ও দ্বীনদার মুসলিমরা নিজেদের সর্বোচ্চটা বিলিয়ে দিবে। তাই উবাইদিরা তাদের রাষ্ট্র ও শাসন ক্ষমতার স্থায়ীত্বের জন্যে সবচেয়ে বড় যে জিনিসের প্রয়োজন অনুভব করল তা হলো ‘ইসলামী রাষ্ট্র’ এই লেভেলটি। কারণ মুসলমানদের দেমাগে একবার যদি ঢুকিয়ে দেওয়া যায় যে, রাষ্ট্রটি ইসলাম ও মুসলমানদের তখন সে রাষ্ট্রের জন্যে তারা সবকিছু কুরবান করতেও ন্যূনতম পিছপা হয় না। চাই সেখানের শাসক জালেমই হোক না কেন।

আর এই স্বীকৃতি আদায়ের জন্যে উবাইদিরা তাদের গৃহপালিত শিয়া আর রাফেজি স্কলারদের সাহায্যই শুধু নিত এমন নয়, আহলুস সুন্নাহর আলেমদের মধ্যেই বেশকিছু দরবারি আলেমদের তারা এই কাজের জন্য পেয়ে গেল। কিন্তু হকপন্থি ওলামায়ে কেরাম কোনো ধোঁকাবাজের ধোঁকাতেই দ্বীন ইসলামকে বিকিয়ে দেননি। দ্বীনি ইলমের সহিহ চর্চা, তাকফির, ওয়ালা-বারা ও জিহাদসহ দ্বীন রক্ষার সকল চেষ্টার মাধ্যমে তাঁরা এই কুফরি শাসনব্যবস্থার ব্যাপারে প্রতিরোধ করে গেছেন। আল্লাহ তাদের সকলকে জাযায়ে খায়ের দান করুক।

ইতিহাসের পাতায় উবাইদিদের ব্যাপারে ওলামায়ে কেরামের হাজারো মূল্যায়ন আছে। সেখান থেকে আবু শামাহ আলমাকদেসি রহ.-র একটি মূল্যায়ন দিয়েই সংক্ষিপ্ত এই লেখাটি শেষ করবো।

আবুল কাসেম শিহাবুদ্দিন দামেশকি আবু শামাহ আল-মাকদেসি রহ. বলেন, ‘উবাইদুল্লাহ ইবনে মাইমুন একজন খবিস, যিন্দিক ও ইসলামের শত্রু ছিল। প্রকাশ্যে নিজেকে হযরত আলি রা.-র মুহাব্বতকারী বললেও অন্তরে সে দ্বীন ইসলামকে পুরোপুরি মিটিয়ে ফেলার ইচ্ছা লালন করত। সে ওলামা-ফুকাহা-নেককার ও দ্বীনদারদের ব্যাপকহারে হত্যা করেছে। সে চাইত, দুনিয়াকে ওলামায়ে কেরামমুক্ত করে সকল মানুষকে চতুষ্পদ জন্তুতে রূপান্তরিত করতে। সে তার সর্বাত্মক শক্তি ব্যয় করেছে মানুষের আকিদা নষ্ট করে তাদেরকে চূড়ান্তভাবে গোমরাহ করে দিতে। আর আল্লাহ তার নূরকে পূর্ণ করেছেন, যদিও কাফেরদের তা অপছন্দ।
উবাইদুল্লাহর সন্তানসন্ততি ও উত্তরসূরিরাও তার পদাঙ্কই অনুসরণ করেছে। রাষ্ট্র ক্ষমতায় ব্যাঘাত ঘটতে পারে এই ভয়ে তারা কখনও নিজেদের কুফরিগুলো লুকিয়ে রাখত। কিন্তু যখনই সুযোগ হতো প্রকাশ্যেই পূর্বসূরির কাজগুলো আঞ্জাম দিত।

উবাইদি ধর্মপ্রচারকরা সারা দেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকত। তারা মানুষকে ইমানের পথ থেকে কুফরে লিপ্ত করতে তাদের সর্বোচ্চটা উজাড় করে দিত। এই বিরাট বিপদ মুসলিমদের উপর ২৯৯ হিজরী থেকে ৫৬৭ পর্যন্ত ছিল।… অতঃপর আল্লাহ মহান সুলতান সালাহুদ্দিন রহ -র মাধ্যমে উম্মাহকে এই দুর্যোগ থেকে রক্ষা করেন। তিনি এই উবাইদি বংশকে সমূলে উৎখাত করেন।…ওরা নিজেদের সাম্রাজ্যকে ‘ফাতেমি সাম্রাজ্য’ বা ‘আলাবি সাম্রাজ্য’ বলত। বস্তুত ওরা হলো ‘ইহুদি সাম্রাজ্য’ বা ‘মুলহিদ বাতেনি অগ্নিপূজক সাম্রাজ্য’। [আররাওজাতাইন ফি আখবারিদ দাওলাতাইন ২/২১৫]

আগের সংবাদউমাইয়া শাসনামলে ক্ষমতার টানাপোড়েন : শাসকের মোকাবেলায় আলেম সমাজ
পরবর্তি সংবাদমানুষের সুদিন ফিরুক!