ফিলিস্তিনের একগুচ্ছ কবিতা

কুদসে
মূল : মাহমুদ দারবিশ

আল কুদসে, তার প্রাচীন সীমানার ভেতর স্মৃতিহীন আমি
প‌রিভ্রমণ ক‌রি যুগ-যুগান্তর
আমার বুকে বন্দুক তাক করছো?
অথচ এখানে নবিগণ বিলি করতেন পবিত্রতার ইতিহাস
যাঁরা আকাশ থেকে ফিরেছিলেন বেদনা ও উপেক্ষা সঙ্গী করে
ভালোবাসা আর শান্তি, পবিত্র শব্দদুটির অভিমুখ এই শহরের দিকে;

ঢালু ভূমিতে হাঁটছি, আর আমার ত্রস্ত্র হৃদয় নিশ্চুপ বলছে—
তাওরাতে সুস্পষ্ট বাক্য থাকার পরও বর্ণনাকারীরা মতবিরোধ করল?
কেন মুখ ফসকে ‘অনুজ্জ্বল পাথরের’ বদলে ‘যুদ্ধ’ বলে দিল?

স্বপ্নালোক ভ্রমণ শেষে তীব্র বেগে চোখ খুলে দেখি
সামনে-পেছনে কেউ নেই, কিছু নেই
তাই এখন এই আলো সব আমার। যেখানে আমি হাঁটি আর হালকা হই
এবং উ‌ড়ি যে কোনো মুহূর্তে। তারপর প্রকাশ্যে পরিবর্তিত হয়ে যাই।
সদ্য ফোটা গুল্মের মতো ভবিষ্যদ্বাণী,
উদ্গত হয় নবির মুখ থেকে-‘যদি তোমরা ইমান না আন, তবে নিরাপত্তা পাবে না কখনো!’

আমি হাঁটি, যেন আমি ছাড়া অন্যজন, আমার ক্ষত যেন ফুটন্ত গোলাপ
শাদা বাইবেলের মতোন।

হাতগুলো যেন আমার নিষ্পাপ দুটি কবুতর
যারা ক্রুশের অনেক উপরে ওড়ে বহন করে ভূধর।

এখন আমি হাঁটি না, আকাশে উড়ি আর পরিবর্তিত হই।
আমার কোনো সময় নেই এবং নেই কোনো প্রান্তর।

তাহলে আমি কে? আমি ‘আমি না’ যেন অন্য কেউ।
তবে একাকী চিন্তা করি, আমার প্রিয় নবি বলতেন বিশুদ্ধ আরবি।
তারপর, তারপর কী হলো?
একজন সৈন্য চিৎকার দিল,
তুই কি আরেকজন? একটু আগে না তোকে গুলি করে মারলাম!
তাকে আমি বলি, আমাকেই মেরেছ তুমি… আমি সব ভুলে যাই,
ঠিক তোমার মতোন। যেন দেখা পাই আবার, শান্ত মৃত্যুর, জনম জনম।

কবি পরিচিতি: মাহমুদ দারবিশ

ফিলিস্তিনের জাতীয় কবি এবং ‘ফিলিস্তিনের প্রেমিক’ নামে প্রসিদ্ধ। প্রতীকাশ্রয়ী আরবি কবিতার অন্যতম সৃজক তিনি। তার অসংখ্য কবিতা একাধিক ভাষায় অনূদিত হয়ে অগণিত মানুষের হৃদয় জয় করেছে। ১৯৪২ সালে ফিলিস্তিনের গ্যালিলি প্রদেশের আল-বিরওয়াহ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৪৮ সালে ইজরাইলি আক্রমণে মাত্র ছয় বছর বয়সে সপরিবারে গভীর রাতে লেবাননে রওয়ানা করেন। সেই থেকেই শুরু তার উদ্বাস্তু জীবন। আমৃত্যু কোথাও স্থির হতে পারেননি। কখনো মিশরে, কখনো বৈরুতে, কখনো প্যারিসে। আবার কখনো খোদ প্যালেস্টাইনে, নিজভূমে পরবাসী হয়ে।

দারবিশ একজন মানবতাবাদী কবি। তার কবিতার প্রতিটি বর্ণ স্বর্ণছোঁয়া। সৌন্দর্যে অবিনশ্বর। সৌকর্যে অনুপম। শৈল্পিক সুষমায় চিরন্তন। আবার একই সাথে তিনি প্রতিবাদী। তার অনেক কবিতা ফিলিস্তিনকে ঘিরে। ফিলিস্তিনের প্রকৃতি, প্রেম, সঙ্কট, প্রত্যাশা, ভবিষ্যৎ ইত্যাদিই তার কবিতার উপজীব্য। স্বাধীনতার জন্য জাগরণ, প্রয়োজনে বিদ্রোহ। জীবনের প্রয়োজনেই স্বাধীনতা, পরাধীনতার শৃঙ্খলমুক্তি প্রভৃতির আহ্বান ছিল তার কবিতার অন্যতম সুর। ৯ আগস্ট ২০০৮ সালে আমেরিকার হেরমান মেমোরিয়াল হাসপাতালে ওপেনহার্ট সার্জারির সময় তিনি মৃত্যুবরণ করেন।

 

অনুভব করি
মূল : সামিহ আল-কাসিম

অনুভব করি, আমরা মারা যাচ্ছি
কেননা আমরা যুদ্ধ জানি না
তাই ফিরে আসি ডন কিহোতিতে
আর আক্ষেপ করি পুরুষদের উপর!

কবি পরিচিতি: সামিহ আল-কাসিম

১৯৩৯ সালে উত্তর জর্ডানের আজ-জারাকায় জন্মগ্রহণ করেন। তবে তার মাতৃভূমি ফিলিস্তিন। আরব-ইজরাইল যুদ্ধের আগে ফিলিস্তিনের গ্যালিলির রামেহ শহরে ছিল তার বাড়ি। নাকবার সময় অনেকেই ঘরবাড়ি ছেড়ে পালিয়ে গেলেও তার পরিবার বাড়ি ছেড়ে যায়নি। তিনি শিয়া মতাবলম্বী দ্রুজ সম্প্রদায়ের ছিলেন । ১৯৬৭ সালে তিনি হাদাস নামের কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দেন। তিনি মাহমুদ দারবিশের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। তার কবিতা আরববিশ্বে ব্যাপক জনপ্রিয়। ‘আরবের লোরকা’ হিসেবে পরিচিত সামিহ আল-কাসিমকে ‘প্রতিরোধের কবি’ও বলা হয়। ১৯ আগস্ট ২০১৪ সালে তিনি মারা যান।

প্রসারিত হাত
মূল : মুরিদ বারগুসি

ছোট্ট বালিকা, ধূলিমলিন, নগ্নপদ,
মাটিতে বসে আছে।
সারি সারি তাবুগুলো তার পাশে
যেন জীর্ণ হতে ধরেছে।

সম্মুখে তার রাখা আছে
পুরনো এক থালা
যা দিয়েছে তাকে,
কোনো এক সকালে
নাম করা ত্রাণ সংস্থা।

নাকে তার লেগে আছে স্যুপ
আর হাতে রুটি অবশিষ্ট
ভিনদেশি ফটোগ্রাফার চট করে নিল তার
ছবি এক উৎকৃষ্ট।

যাতে পষ্ট হবে শরণার্থী শিবির
আর দাউদাউ ক্ষুধা
তারপর সম্পাদক খুশি হবেন আচানক
বললেন, একি আহা!

তিন বছর আগে
তার পরিবার গেছে এই সমুদ্রতলে
এখন সে হাত পাতে
কোনোকিছু না পেয়ে
মতলবি সাংবাদিকের কাছে।

যেন ইশারায় সে বলে-
বাসি এক রুটিতে
সকাল ও সন্ধ্যা তার
কেটে যাবে নিমিষে।

কবি পরিচিতি: মুরিদ বারগুসি

ইজরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার চার বছর আগে ১৯৪৪ সালের ৮ জুলাই ফিলিস্তিনের পশ্চিমতীরে রামাল্লার কাছে অবস্থিত ‘দেইর গাসসানা’ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ষাটের দশকে তিনি মিশরের কায়রো ভার্সিটিতে পড়ালেখা করেন। ভার্সিটির শেষ বছর ১৯৬৭ সালে আরব-ইজরাইল যুদ্ধ শুরু হলে তিনি আটকা পড়েন। এরপর ১৯৯৬ সালে ৩০ বছর পরে মাত্র কয়েকদিনের জন্য রামাল্লায় ফিরে যাবার সুযোগ পান। এই ভ্রমণকে কেন্দ্র করে ‘রআইতু রামাল্লা’নামে বিখ্যাত আত্মজৈবনিক উপন্যাস লেখেন। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষ বইটি পড়েছে। এডওয়ার্ড সাইদ বইটিকে ফিলিস্তিনিদের বাস্তুচ্যুত হওয়া নিয়ে সুন্দরতম বর্ণনা হিসেবে আখ্যা দিয়েছিলেন। শিকড় থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার যে বেদনাভূতি, তিনি তা তুলে ধরেছিলেন এই বইটিতে। ১২টি কাব্যগ্রন্থসহ বিভিন্ন বিষয়ে অন্তত ২৫টি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে তার। দীর্ঘ সময় তিনি প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশনের (পিএলও) প্রতিনিধিত্ব করেছেন। বরাবরই রাজনীতির সঙ্গে দূরত্ব বজায় রেখে চলেছেন। তার স্ত্রী রাদওয়া আশুরকে নিয়ে কায়রোতেই থাকতেন। স্বামীর মতো আশুরও ছিলেন লেখক। যিনি তার অনেক কবিতা ইংরেজিতে অনুবাদ করে দিয়েছেন।

শুধু একটি বন্দুক চাই
মূল : নাজার কাবানি

শুধু একটি বন্দুক চাই
আমার মায়ের সোনার নোলক বিক্রি করে দিয়েছি
একটি বন্দুকের জন্য

আমার ক্লাসের পাঠ্য-পুস্তক সব বন্ধক রেখেছি
একটি বন্দুকের জন্য
যে ভাষায় আমরা ক্লাস করতাম, যে পাঠ্য আমরা পাঠ করতাম
যেসব কবিতা মুখস্থ করতাম
সেগুলো সব মিলে এক টাকার সমান হচ্ছে না একটি বন্দুকের সামনে
এখন আমি শুধুই বন্দুক চাই

তোমাদের সাথে আমাকেও নিয়ে চলো ফিলিস্তিনে
নিয়ে চলো আমার রবের কাছে
বিমর্ষ ও বাদানুবাদমুখর চেহারায় উপস্থিত হব সেখানে

হে বিপ্লব
চলো ফিলিস্তিনে
চলো হেবরনে
চলো বাইসানে
চলো আগওয়ারে
চলো বেথেলহেমে
এবং তোমরা যেখানে যেখানে আছ
হে পরাধীনতার শৃঙ্খল ছেঁড়া মরদের দল
এগিয়ে যাও, সামনে আগাও

শান্তিচুক্তির গল্প আজ নির্মম প্রহসন
সাম্যনীতির কিসসা-কাহিনী চরম উপহাস
ফিলিস্তিনে আজ পথ একটিই- বন্দুকের সাথে আত্মবিসর্জন।

কবি পরিচিতি: নাজার কাবানি

১৯২৩ সালের ২১ মার্চ দামেশকের একটি সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ফিলিস্তিনের অধিবাসী নন। তবে ফিলিস্তিনকে নিয়ে রচিত তার অসাধারণ কবিতার জন্য তাকে এ সংকলনে সংযুক্ত করা হয়েছে। সিরিয়ান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৪৫ সালে তিনি পড়াশোনা সমাপ্ত করেন। ১৯৪৪ সালে তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ বের হয়। ফিলিস্তিনি কবি ইজ্জুদ্দিন আল-মুনাসিরাহ বলেন, ‘নাজারের সাথে আমার পরিচয় বৈরুতে, কবিদের মাঝে সে অত্যন্ত ভদ্র ও রসিক।’ জীবনের শেষদিকে তিনি লন্ডনে থাকতেন। সেখানে প্রচুর রাজনৈতিক কবিতা লিখেছেন। ৩০ এপ্রিল ১৯৯৮ সালে তিনি মারা যান। জন্মভূমি দামেশকে তাকে সমাহিত করা হয়।

অনুবাদ: ওয়াহিদুর রহমান

আগের সংবাদদারুচিনি দ্বীপ : প্রবালে দোলে শৈবাল
পরবর্তি সংবাদস্মরণে দেওবন্দের তিন সূর্যসন্তান